১১. অন্য পৃথিবীর সমুদ্র পাড়ি

১১. অন্য পৃথিবীর সমুদ্র পাড়ি

তেইশে অগস্ট সকালবেলায় আমাদের ভেলা অজানা সমুদ্রে রওনা হলো। হান্‌স্ পাল তুলে দিয়ে হালের কাছে গিয়ে বসলো। অনুকূল হাওয়া আর

স্রোতের টানে তরতর করে ভেলা এগিয়ে চললো।

কাকামণি বললেন, যেখান থেকে আমাদের ভেলা ছাড়লো, সেই বন্দরটার একটা নাম দেয়া উচিত। কী নাম দেওয়া যায় বল তো?

কেন? বন্দরটার নাম পোর্ট গ্রোবেন দিলেই তো হয়।

স্মিতমুখে আমার দিকে তাকিয়ে কাকামণি বললেন, পোর্ট গ্রোবেন? বেশ, তাই হোক।

এই লক্ষ্যহীন নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরোবার পর থেকে সত্যিই গ্রোবেনকে খুব বেশি করে মনে পড়ছিলো।

চব্বিশে অগস্ট শুক্রবার বাতাসকে বেশ শান্ত আর সুস্থির মনে হলো। ভেলা তেমনি তরতর করে এগিয়ে চলেছে। সামনে, দু-পাশে, পিছনে–চারদিকে শুধু এল আর জল।

দুপুরবেলার দিকে হান্‌স্‌ একটি ছিপ নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে বসলো। বঁড়শিতে মাংসের টোপ গেঁথে ছিপ ফেলে বসে রইলো সে। ঘণ্টা-য়েক পরে একসময়ে কিন্তু সত্যি সত্যি ছিপে টান পড়লো। হান্‌স্‌ তক্ষুনি ছিপ টানলে। দেখতে পেলাম জলে একটা মাছ ছটফট করে নড়ছে।

মাছটা একটু অদ্ভুত ধরনের। মাথাটা আশ্চর্য রকম চ্যাপ্টা, মুখটা গোল, গারে বনরুইয়ের মতো শক্ত আঁশ। মুখে দাত নেই, পিছনে লেজও নেই। কাকামণি বললেন, এটা এ-যুগের মাছ নয়। এ হচ্ছে কোটি-কোটি বছর। আগেকার যুগের মাছ। পৃথিবী থেকে এ-মাছ লোপ পেয়ে গেছে। ঐ দ্যাখ, মাছটার কোনো চোখ নেই। পণ্ডিতেরা এ-মাছের তিনটে নাম দিয়েছেন–গ্যানোখাড, ফোলাসপিডে আর প্টেরিকথিস।

আমি অবাক চোখে এই দাতভাঙা ত্ৰিনামধারী অদ্ভুত মাছটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হান্‌স্‌ আবার ছিপ ফেললে। দেখতে-দেখতে হান্‌স্‌ সেই আতের ও অন্যান্য ধরনের প্রায় কুড়িটা মাছ ধরলে। কাকামণি সযত্নে সেগুলি রক্ষার ব্যবস্থা করলেন।

সমুদ্রে এতো মাছ, কিন্তু আশ্চর্য, শূন্তে কোনো পাখি নেই।

ছাব্বিশে অগস্ট, রবিবার। কাল সারাদিনে উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটেনি, শুধু আকাশটা একটু মেঘলা ছিলো। আজ আকাশ আবার পরিচ্ছন্ন।

সমুদ্রের কোনো কিনারা চোখে পড়লো না। কাকামণিকে খুব উত্তেজিত দেখালো। সমুদ্রের শেষ নেই বলে তার রাগের সীমা ছিলো না। আরেকটা প্রশ্নও আমাদের সামনে ছিলো। সাক্‌ন্যুউজম্‌ কী সত্যিই সমুদ্রপথে এসেছিলেন?

আটাশে অগস্ট, মলবার। কাল বিকেল থেকে সমুদ্রের জলে ভীষণ আলোড়ন চলছে। তবু হান্‌স্‌ সতর্ক হাতে ভেলাটিকে সামলে রেখেছে। আজো সারাদিনে কোথাও সমুদ্রের শেষ দেখা গেলো না। সন্ধেবেলার দিকে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ এক ভীষণ ধাক্কায় আমার দুঃস্বপ্নভরা ঘুম ভেঙে গেলো। ভেলার যে কোণে আমি শুয়েছিলাম, সেই প্রচণ্ড ধাক্কায় সে-কোণ থেকে ছিটকে এসে লোর অন্য কোণে পড়লাম আমি। ঘুমের ঘোর কাটবার আগেই একটা জিনিস স্পষ্ট বোঝা গেল যে, কোনো মারাত্মক কারণেই সমুদ্র এমন আলুথালু হয়ে উঠেছে।

তারপরেই সন্ধেবেলার অস্পষ্ট আলোয় দেখতে পেলাম ছ-শো গজ দূরে প্রকাণ্ড একটা রাত্রির মতো কালো জিনিশ। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে-সঙ্গে সেও লাফালাফি করছে। অবাক হয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, এ যে একটা অতিকায় শুশুক!

কাকামণি পর্যন্ত অক্ষুট বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ঐ যে একটা ভয়ঙ্কর কুমির! কী বিরাট দেহ! মুখের হাঁ আর চোয়ালের বহরটা দেখেছিস?

ঐ দ্যাখো কাকামণি, একটা সামুদ্রিক গিরগিটি–অনায়াসে আমাদের মতো জনাপঞ্চাশকে গিলে ফেলতে পারে!

ঐদিকে দ্যাখ তিমিমাছটা কীভাবে জলের মধ্যে আলোড়ন তুলেছে!

এতগুলো মারাত্মক রকমের অতিকায় জলজন্তু একসঙ্গে দেখে বিস্ময় হতবাক হয়ে গেলাম। দেখতে-দেখতে চারদিকে আরো অনেকগুলো লিজ ভেসে উঠলো। তাদের সে কী বিরাট চেহারা। শরীরে কী অসম্ভব জোর! তাদের মধ্যে যেটি সবচেয়ে ছোটো, সেও বোধহয় তার লেজের এক ঝাঁপটায় আমাদের এই ডেলাটি একেবারে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে দিতে পারে।

এইসব ভয়ানক জলজন্তুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য হান্‌স্‌ তাড়াতাড়ি ভেলার মুখ খুলে দিলে, যাতে কোনোমতে কোনো নিরাপদ এলাকায় গিয়ে পৌঁছননা যায়। কিন্তু যেদিকেই সে তেলা চালায়, সেদিকেই পথ বন্ধ। কোথাও পঞ্চাশ ফুট লম্বা একটি কচ্ছপ পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও বা তারও বড়ো একটি সাপ ফণা তুলে লেজের ঝাঁপটা মেয়ে কি করে তুলেছে জল। কোনোদিকে যাওয়ার উপায় নেই।

ভয়ে কাঠ হয়ে বসে রইলাম। এ-কথা বুঝতে আমাদের বাকি ছিলো না যে এদের গুলি করেও কোনো লাভ নেই। এমন সময়ে দুটি জন্তু একেবারে ভেলায় দুপাশে এসে পড়লো–একদিকে সেই মারাত্মক কুমির, আর অন্যদিকে একটি সাংঘাতিক সাপ। ভয়ে আমি চোখ বুজোলাম-এবারে আর রেহাই নেই! জলজন্তু-দুটি কিন্তু ভেলা আক্রমণ না করে পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভেলা থেকে প্রায় তিনশে গজ দূরে তাদের লড়াই চলতে লাগলো। সেই ভয়ংকর ও অলৌকিক লড়াই-এর বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তাদের লেজের ঝাঁপটা আর দেহের পেষণে সমুদ্র ফুলে, ফেঁপে, ফুশে উঠলো রাগে। সাপের চোখদুটি টকটকে লাল মাথাটা আকারে মানুষের মাথার মতো। লম্বায় একশো ফুট সাপটা। কুমিরের শরীরে লোহার মতো কঠিন কালো রঙের আঁশ। তাদের প্রচণ্ড সংগ্রামে মথিত-উন্মথিত হতে লাগলো সমুদ্র। আর সেই উথালপাখাল সমুদ্রে কতবার যে ওল্টাতে-ওটাতে বেঁচে গেলো আমাদের ভেলা, তার কোনো লেখাজোখা নেই।

কততক্ষণ যে ওদের লড়াই চললো, সে-কথা আমার পক্ষে বলা অসম্ভব। শুধু এই কথাই বলতে পারি, অনেকক্ষণ পর অকস্মাৎ দুটিতেই জলের ভিতরে ড়ুব দিয়ে সমুদ্রের নিচে লড়াই শুরু করে দিলে, আর আরো অনেকক্ষণ পর হঠাৎ জলের উপরে জেগে উঠল একটি ভয়ংকর মাথা। সেটি সাপের। কুমিরের মরণকামড়ে মুহূর্ষু সাপটা যন্ত্রণায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে, আর তার মৃত্যু-যন্ত্রণার আলোড়নে সমুদ্র আলুথালু হতে থাকলো। কিছুক্ষণ পরে আর সেই সাপটার চিহ্নমাত্র দেখা গেলো না। কুমিরটা কোথায় অদৃশ্য হয়েছে কে জানে। সমুদ্রজলের উপর নেমে এলো একরাশ শব্দহীন সমারোহ।

বরাত? হ্যাঁ, বরাত ভালো না থাকলে এমনি অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আর একটুও দেরি না করে প্রাণপণে ভেলাটিকে অন্যদিকে নিয়ে চললাম আমরা।

উনত্রিশে অগস্ট, বুধবার। আকাশে ঘন মেঘ। বিদ্যুতের চাবুক বারে বারে সেই মেঘকে ছিন্ন-ভিন্ন করছে। বিকেল চারটের সময় হান্‌স্ মাস্তুলের উপরে উঠে চারদিক লক্ষ করতে লাগলো—কোথাও তীরের সন্ধান পাওয়া যায় কি না। সমুদ্রের একদিকে সে অনেকক্ষণ ধরে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ দূরে কিসের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো, অবাক গলায় বললো, ঐ যে! ঐ দেখুন।

তক্ষুনি দূরবীন নিয়ে নির্দেশিত দিকে তাকালেন কাকামণি। তারপর উনিও চেঁচিয়ে উঠলেন, হুঁ! তাই তো দেখছি!

বিস্মিত হয়ে শুধোলা, কী কাকামণি? আবার নতুন কোনো জানোয়ার নাকি? তবে আর দেরি করা ঠিক হবে না। শিগগিরই অন্যদিকে জেলা নিয়ে যেতে হবে।

হ্যাঁ বললেন কাকামণি, আর দেরি করা ঠিক হবে না।

ভেলা থেকে সেই অপার্থিব অতিকায় বস্তুটি মাইলকয়েক দূরে হবে। তিমিমাছের মতন শূন্যে জলের ফোয়ারা ছুড়ছিলো সে।

হান্‌স্‌ যখন সেই অতিকায় জলজন্তুটির দিকেই ভেলা চালাতে লাগলো, তখন রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সহস্রবার বারণ করা সত্ত্বেও সে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলো না আমার কথায়। আস্তে-আস্তে সেই প্রচণ্ড ফোয়ারা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো, আর স্পষ্ট হয়ে উঠলো সেই অতিকায় জন্তুটির কুচকুচে কালো শরীর। আর ঠিক সেই সময়ে হান্‌স্‌ আইসল্যাণ্ডের ভাষায় কী যেন বলে উঠলো ঐ জন্তুটিকে নির্দেশ করে।

হান্‌সের কথা শুনে কাকামণি অবাক হয়ে গেলেন। দ্বীপ? বলো কী হান্‌স্‌?

আমার তো বিস্ময়ে বাকরোধ হয়ে গেলে একেবারে। হান্‌স্‌ কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? কিন্তু পরক্ষণে শুনলাম কাকামণি বলছেন, না, হান্‌স্‌ ঠিকই বলেছে। দ্বীপই। ঐ জলের ফোয়ারাটা হলো উষ্ণ প্রস্রবণ।

একটু পরেই বোঝা গেলো যে কাকামণির ধারণা মোটেই মিথ্যে নয়। স্পষ্ট হতে থাকার সঙ্গে-সঙ্গে উষ্ণ প্রস্রবণটিকে সুন্দর দেখাতে লাগলো। দ্বীপের গড়নটুকুও ভারি অদ্ভুত। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন একটা অতিকায় জলজন্তু জলের উপরে ভাসছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সেই ফোয়ারার চারদিকে বারেবারে নীল রঙের বিদ্যুৎ ঝিলিক মেরে উঠছিলো।

প্রস্রবণটি যেদিকে ছিলো, তার বিপরীত দিকে ভেলাটিকে বাধা হলো। দ্বীপটি গ্রানাইট পাথরের। দ্বীগকে দেখলাম থরথর করে কাঁপছে টিম-ইঞ্জিনের বয়লারের মতো; দেখা গেলো দ্বীপটা ফাপা, ভিতরটা কেবল গরম বাষ্পে ভরা।

খানিকটা এদিক-ওদিক ঘুরে ডেলায় ফিরে দেখি, হান্‌স্‌ ইতিমধ্যে ভেলার হালটা মেরামত করে নিয়েছে। সেদিন একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল কিনা জলের ঝাঁপটায়! ভেলায় উঠে আবার সেই প্রস্রবণটির দিকে তাকালাম, একটা অদ্ভুত ব্যাপার নজরে পড়লো। ফোয়ারার জল একবার খুব জোরে উঠছে, আর পরের বারে উঠছে খুব আস্তে-আস্তে–ঠিক যেন ইঞ্জিনের ভাল্ভ থেকে ভলকে ভলকে বাষ্প বেরোচ্ছে,

এইসব লক্ষণ দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা একটা ভয়াবহ আগ্নেয় দ্বীপ।

সারারাত্রি ভেলায় করে অজানা সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলাম আমরা, তাই পরদিন ভোরবেলায় সেই উষ্ণ প্রস্রবণটি আর চোখে পড়লো না।

জোরালো হাওয়ার মুখে পড়ে বেশ দ্রুতবেগেই ভেলা চলছিলো। আকাশ ঘন মেঘে আচ্ছন্ন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো ঘন-ঘন। মেঘের নিবিড় রঙ দেখে বোঝ গেলো, শিগগিরই একটা ভয়ংকর ঝড় উঠবে। এ-ঝড় তো আর আমাদের পরিচিত পৃথিবীর ঝড় নয় যে, খানিকক্ষণ ধুলোবালি উড়িয়ে গাছ-পালা ভেঙে চারদিক লণ্ডভণ্ড করে থেমে যাবে এ হলো শুধু বিদ্যুতের তাণ্ডবলীলা।

ধারণাটি যে মোটই মিথ্যে নয় তা বুঝতে পারলাম, যখন হঠাৎ আমার দম বন্ধ হয়ে যেতে চাইলো। সারা শরীরের মধ্যে কিসের যেন উন্মাদ নৃত্য চলতে লাগলো। স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্যে চঞ্চল হয়ে উঠলো রক্ত। মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠলো, কাটা দিয়ে উঠলো গায়ে। আমার খালি মনে হতে লাগলো, এখন যদি কেউ আমাকে ছোঁয়, তবে তখুনি সে ভীষণ শক্ খাবে। এমন প্রবল বিদ্যুতের তোত আমার শরীরের মধ্য দিয়ে বয়ে যেতে লাগলো, অথচ এমনি স্থানকালের মাহাত্ম্য, যে আমার মৃত্যু হলো না।

বাতাসের বেগও বেড়ে চললো দ্রুতগতিতে। মনে হতে লাগলো, দিগন্তবিসারী মেঘ ফেটে এখনি বুঝি ভলকে ভলকে আগুন বেরোবে।

কাকামণি আর হান্‌সের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম যে তাদের অবস্থাও আমারই মতো।

ঠিক এমন সময়ে আকাশ ফেটে মুষলধারে নামল বৃষ্টি। ভীষণ বেগে ঝড় এলো। ঝড়ের পাল্লায় পড়ে নৌকোর মুখ ঘুরে গেলো, পাগল হয়ে গেলো যেন সে। কাকামণি আর আমি ভেলার উপর কাত হয়ে পড়ে গেলাম। শুধু হান্‌স্‌ কোনমতে হালটিকে শক্ত করে ঘরে বসে রইলো। হাওয়ায় তার চুল উড়তে লাগলো, আর চুলের ডগায় জ্বলতে লাগলো বিদ্যুৎ। ভেলা বিদ্যুতের মতো অজানার উজানে ছুটে চলল।

দোসরা সেপ্টেম্বর, রোববার। আজও তেমনি ভয়ংকর হয়ে আছে ঝড়ের প্রতাপ। ভেলা ঠিক আগের মতোই তীব্রগতিতে ধেয়ে চলেছে। আমরা তিনজনেই নিঃঝুম হয়ে পড়ে আছি ভেলার উপরে। শুধু সকালের দিকে একবার। যেন সম্বিত ফিরে এসেছিলো, বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার নাক আর কান দিয়ে দরদর করে রক্তধারা ছুটছে। তারপর যেন বোধশক্তি পর্যন্ত প্রায় সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেলো।

তেসরা সেপ্টেম্বর, সোমবার। আজ ঝড় যেন আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। উন্মাদ সমুদ্রের উপর দিয়ে আমাদের ডেলা হু-হু করে ছুটে চলেছে। আমরা তিনজনে কোনোমতে পড়ে আছি ভেলার উপরে। ভেলাটি যে এখনো কেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে না, তা বুঝবার ক্ষমতা পর্যন্ত আমাদের নেই। তিনদিন ধরে আহার, নিদ্রা, কথা বলা–সমস্ত বন্ধ। যেন আমরা সবাই মৃত।

এমন সময়ে ঘটলো একটি অপার্থিব ব্যাপার। তার বর্ণনা দিই, এমন শক্তি আমার নেই। দূর থেকে নক্ষত্রবেগে একটা গোল আগুনের গোলা এসে পড়লো আমাদের ভেলার উপর। তারপর যে কী হতে লাগলো, তা যেন ঠিক বুঝতেই পারলাম না। তবে মনে হলো সেই আগুনের বলটার রঙ উজ্জল শাদা, আর তাতে নীল রঙের ঈষৎ আভাস। ভেলার উপরে বলটা তীব্রবেগে ছুটোছুটি করতে লাগলো। মাস্তুল, পাল, ছই–সব উড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে আমরা মৃত্যুর জন্যে তৈরি হয়ে নিলাম। সেই গোল অগ্নিপিণ্ড একবার কাকামণির দিকে এগোয়, আবার কখনো-বা আমার দিকে ছুটে আসে, হঠাৎ আবার হাসের দিকে যায়। সেই ভয়াবহ নীলাভ উজ্জ্বল উত্তপ্ত বলটির দিকে তাকালেও চোখ ঝলসে যায়। আর আশ্চর্য, কী-এক অদৃশ্য অলৌকিক ক্ষমতায় তখন ভেলার উপরকার সমস্ত লোহার জিনিশপত্র পরস্পর পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলো। তারপর হঠাৎ সেই অগ্নিপিণ্ড ভয়ংকর শব্দে ফেটে গেলো। চারদিকে ছুটতে লাগলো আগুনের ফুলকি। উগ্র নাইট্রোজেন গ্যাসে ভরে গেলো চারদিক। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলে আমাদের।

একটু সম্বিত ফিরলে পর তাকিয়ে দেখি, সেই অগ্নিপিণ্ড অদৃশ্য হয়েছে। কাকামণি ভেলার উপরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। হান্‌স্‌ হিস্টিরিয়া রোগীর মতো মৃত চোখে তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে।

চৌঠা সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। সকাল হতেই দেখা গেলো আকাশে তখন নিবিড় মেঘের অন্ধকার লীলা, তখনো ঝড়ের তেমনি তাণ্ডব। এরই মধ্যে কাকামণি হিশেব করে এক সময়ে চি-চি করে নিস্তেজ গলায় জানালেন যে, আমরা ঠিক জার্মেনির নিচে আছি। একথা শুনে হামবুর্গের কথা মনে পড়লো আমার, মনে পড়লো, আমাদের ছোটো বাড়িটার কথা, মাথার কথা, গ্রোবেনের কথা। আর, ঠিক এমন সময়ে একটা ভয়ংকর শব্দ কানে এলো।

কী হলো বুঝে ওঠার আগেই প্রবলবেগে ভেলা থেকে ছিটকে পড়লাম সমুদ্রের জলে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই হান্‌স্ জলে লাফিয়ে পড়ে তার সবল বাহুতে আমাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে আমাকে ফিরিয়ে আনলো হাসের সেই সুঠাম, সবল চেহারা আমি কখনো ভুলবো না। কিন্তু তারপরে কী ঘটেছিলো, তা আমার মনে নেই। জ্ঞান ফিরে এলে দেখি আমি ডাঙায় শুয়ে আছি। আমার চারিদিকে সকালবেলার অনাবিল আলো।

আমাকে চোখ খুলতে দেখে কাকামণি বললেন, যাক, শেষ অবধি এই নচ্ছার সমুদ্রযাত্রা শেষ হলো। শেষ হলো, তো যেন বাঁচা গেলো। এবার ডাঙার উপর দিয়ে চলব, আর তাও সোজা নিচের দিকে।

বললাম, আচ্ছা কাকামণি, দিনের পর দিন তো এগিয়েই চলেছি; কিন্তু ফিরবো কী করে? আর কবে?

কাকামণি হেসে বললেন, আগে তোত পৌঁছুই, তারপরে কবে ফিরবে। সে-কথা ভাবা যাবে। চল, ভেলার হাল-চাল কীরকম দেখে আসি।

ভেলার কাছে গিয়ে দেখি, অনেক খাবার ভেসে গেছে, বন্দুকগুলো অকেজো হয়ে গেছে, আর ভেলার যা হাল, তাতে মেরামত না করলে জলে ভাসানো চলবে না। খাবার যা আছে তাতে অনায়াসে মাসচারেক চলে যাবে। যন্ত্রপাতির মধ্যে কাকামণি দিকবীক্ষণ যন্ত্রটা (কম্পাস) তুলে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখমুখের ভাব বদলে গেলো। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই নীরবে তিনি কম্পাসটি আমার হাতে তুলে দিলেন। লক্ষ করে দেখি, কী আশ্চর্য, যে দিক দক্ষিণ বলে ভেবেছিলাম, যন্ত্রের কাটা সে দিককে উত্তর বলে নির্দেশ করছে!

বিমূঢ়ভাবে কাকামণি খানিকক্ষণ ছবির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর নিষ্ফল আক্রোশে কাঁপতে লাগলেন শুধু। সামনে না গিয়ে এতদিন তবে আমরা শুধু পিছিয়েই চলেছি! ভাগ্যের এ কী পরিহাস!!

ইতিমধ্যে কাকামণি নিজেকে সামলে নিয়েছেন। নিশ্চিত কণ্ঠে তিনি বললেন, আবার তবে নতুন করে রওনা হবো আমরা।

আমি থ হয়ে গেলাম। কাকামণি তবে কোনোমতেই হাল ছাড়বেন না।

কাকামণি কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হাসকে নির্দেশ দিলেন ভেলাটি খুব শিগগির মেরামত করে ফেলবার জন্য, তারপর আমায় বললেন, আয় একবার দ্বীপটা ঘুরে আসা যাক।

প্রতিবাদ করবার কোনো চেষ্টা করলাম না আমি। জানতাম নিষ্ফল হবে। নীরবে কাকামণির সঙ্গে দ্বীপ-ভ্রমণে বেরোলাম। সামনেই একটা ছোটো টিলা পড়লো। টিলাট ছাড়িয়ে একটা ঢালু জায়গা। সেখানে রাশি রাশি সামুদ্রিক জন্তুর কঙ্কাল। যতোই এগোতে লাগলাম, ততোই এই কঙ্কালের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। এদের বিবর্ণ ধূলি-ধুসর অবস্থা দেখে বোঝা গেলো, বহু সহস্র বছর ধরে এরা পড়ে আছে। কাকামণি এক পা চলেন, তারপর থামেন, হেঁট হয়ে সেইসব কঙ্কাল পরীক্ষা করেন, আর বিস্ময়ে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার চোখ মুখ। মাঝে-মাঝে এই কারণে তিনি আমার পিছনে পড়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার বিহ্বল চিৎকার শুনে কাছে ছুটে গিয়ে দেখি, দুহাতের চেটোর উপর একটা মানুষের মাথার খুলি নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

এ যে মানুষের মাথার খুলি।

অনেকক্ষণ আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না।

বৈজ্ঞানিকদের মত যাই হোক না কেন, স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম যে, কোটিকোটি বছর আগে হাতি গণ্ডার বা অন্য কোনো ভূচর প্রাণীর সৃষ্টির আগেই মানুষ জন্ম নিয়েছিলো। খানিকক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে আবার কাকামণি এগোতে লাগলেন। আমিও নীরবে তাকে অনুসরণ করলাম। এইমাত্র নিজের চোখে যা দেখলাম, তা যেন আমার নিজেরই বিশ্বাস হতে চাইছিলো না। এরপর পথে অসংখ্য নরকঙ্কাল দেখতে পেলাম। পণ্ড কঙ্কালও। চারদিকেই যেন। মৃত্যু সদাজাগ্রত প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে—এমনি দেখাতে লাগলো সেই কঙ্কালময় শ্মশানভূমিকে।

দুমাইল চলবার পর এক বিশাল ধন-সন্নদ্ধ অরণ্যের কাছে এসে দাঁড়ালাম। গাছপালা যে এতো বড়ো, এতে সতেজ হতে পারে, সে ধারণা ছিলো না। পাইন, বার্চ, সাইপ্রেস, ফার, ওক প্রভৃতি আকাশ-ছোঁয়া নানান জাতের গাছের সমারোহ। তবে একটা জিনিশ দেখলাম যে, গাছগুলি সমস্তই বিবর্ণ। বুঝতে পারলাম, সূর্যালোকের অভাবই এর প্রচ্ছন্ন কারণ।

কাকামণি নির্ভয়ে অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করলেন। বাধ্য হয়ে আমিও তাকে পায়ে-পায়ে অনুসরণ করলাম। আর খানিকক্ষণ চলার পর যা চোখে পড়লো, তা দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম আমি। তাড়াতাড়ি থমকে দাঁড়িয়ে গতিরোধ করলাম কাকামণির। উজ্জল বিদ্যুতালোকে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।

দেখা যাচ্ছিলো যে, অরণ্যের মধ্যে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অতিকায় সব মূর্তি ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই অতিকায় জন্তুগুলো আর কিছুই নয়,-হাতি আঠারোশো এক সালে ওডিও শহরে ভূগর্ত থেকে যে জাতের হাতির বিরাট একটি কঙ্কাল সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো, এই হাতিগুলোও সেই অধুনালুপ্ত আদিম পৃথিবীর হাতির দলের।

আমার জন্যে কিন্তু আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো। স্তম্ভিত বিস্ময়ে নিষ্পলক চোখে হাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময়ে কাকামণি অরণ্যের এক-প্রান্তের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন। নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। কোনো সুস্থ-মস্তিষ্ক ব্যক্তি এ-কথা কল্পনায় আনতে পারে না। দেখতে পেলাম, একটি আকাশ-ছোঁয়া ওক গাছের নিচে একটি জীবন্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে দানবের মতে, লম্বায়চওড়ায় আমাদের চারগুণ হবে, হাতে তার রীতিমতো বড়োসড়ো একটি গাছ। বুঝতে পারলাম, সে হাতিগুলোর রাখাল। মাথায় তার এলোমেলো বড়ো-বড়ো চুল, মাথাটি দেখতে অনেকটা মহিষের মতো, মুখের ভাব যেন কোনো বনমানুষের।

ভয়ে বিস্ময়ে আমার গলা শুকিয়ে গেলো। ছবির মতো পঁড়িয়ে রইলাম আমি হতবাক হয়ে। আর, ঠিক এমন সময়ে কাকামণি আমার হাতে চাপ দিয়ে ফিসফিশিয়ে বললেন : শিগগির, এখুনি আমাদের পালাতে হবে।

তারপর সে কী ছোটা! এক নিশ্বাসেই যেন ভেলার কাছে এসে পৌঁছলাম আমরা। হা–যে হানস কখনও অবাক হয় না-সে পর্যন্ত আশ্চর্য হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তখনো আমাদের কথা বলবার শক্তি ফিরে আসেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাফাচ্ছিলাম আমরা। এইমাত্র যা দেখে এলাম, তা কি সত্যি, না আমাদের বিকৃত কল্পনা? সত্যিই কি পৃথিবীর অনেক নিচে যে আরেক পৃথিবী, সেখানে এখনো আদিম যুগের মানুষদের বাস?

অনেকক্ষণ পর যখন একটু সুস্থ হলাম, তখন কাকামণি হিশেব করে জানালেন যে, পোর্ট গ্লোবেন থেকে আমরা বেশি দূরে নেই। কেননা ঝড়ের জন্যে আমরা দিক ভুল করে আবার সেই আগের দ্বীপেই ফিরে এসেছি।

এবার তাই হাসকে নিয়ে আমরা অন্য দিকে হেঁটে চললাম। যে করেই হোক, পোর্ট গ্লোবেন খুঁজে বার করতে হবে।

অল্পক্ষণ চলবার পর বেলাভূমির উপরে কী একটা চকচকে জিনিশ দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে নিলাম। দেখি, একটি ছোরা, তার কোনো-কোনো স্থানে মরচে পড়ে গেছে। কাকামণিকে দেখাতে তিনি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে বললেন : কোত্থেকে এলো এটা? আমরা তো এদিকে আগে আসিনি। এরকম ছোরাও তো আমাদের নেই। ছোরাটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলেন কাকামণি। শেষে বললেন : না, এ আমাদের ছোরা নয়। এর গড়ন দেখে বোঝা যাচ্ছে এ অনেক দিন আগেকার ছোরা। আর যতদিন আগেকারই হোক না কেন, এ তো আর নিজে থেকে এখানে আসেনি, একজন কেউ নিয়ে

এসেছিল নিশ্চয়ই।

কিন্তু কে সেই ব্যক্তি? শুধোলাম আমি।

ছোরার ডগাটা কী রকম অসমানভাবে ক্ষয়ে গেছে, দেখেছিস? ঠিক মনে হয়। কেউ এটা দিয়ে পাথরের উপরে নিজের নাম খোদাই করে গেছে। এখন সেইটেই আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।

কাকামণির কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে চারদিকের পাথরের গা পরীক্ষা করতে করতে চললাম। ঘণ্টাখানেক পরে সমুদ্র-সৈকতে একটা পাথরের উপরে দেখলাম দুটি অদ্ভুত ধরনের হরফ খোদাই করা রয়েছে। সেই অক্ষর-দুটো দেখে কাকামণি চেঁচিয়ে উঠলেন, এ, এস! তার মানে, আর সাউজ!

বলা বাহুল্য, খোদিত হরফ-দুটো রুনিক। আর যে পাথরটার উপরে তা খোদাই করা, তার পাশেই রয়েছে একটা সুড়ঙ্গপথ।