০৮. পথের শেষ কোথায়, পথের শেষ?

০৮. পথের শেষ কোথায়, পথের শেষ?

কাকামণির কথায় প্রতিবাদ করবার মতো অবস্থা তখন আমার না,–না দেহের, না মনের। শুধু একবার কতটুকু জল এখনো হাতে আছে দেখে নিলাম। তখন তিনদিনের উপযোগী জল ছিলো। কিন্তু কদিন যে লাগবে এই পথের শেষ দেখতে, তা কে জানে? সে-কথা আর ভাববার চেষ্টাও করলাম না। ভেবে কোনোই লাভ নেই। কাকামণি তো আর আমার কথা শুনবেন না। কাজেই শ্রান্ত পায়ে এগিয়ে চলতে লাগলাম শুধু।

এবার দেখতে পেলাম, মারবেল পাথরের রাজ্যে এসে পৌঁছেছি। শাদা, লাল, নীল, হলুদ নানান বর্ণের পাথর। কোনো-কোনো জায়গায় আবার দেখলাম, নানান জাতের মাছ ও সরীসৃপের কঙ্কাল ইতস্তত ছড়ানো। বুঝতে পারলাম, আমরা ক্রমশ সৃষ্টির আদি যুগের দিকে চলেছি। তবে কি আমরা একেবারে পৃথিবীর অন্দরমহলের কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম?

ক্রমশ আবার সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গে এসে নামলে আর-একটি রাত্রি। লণ্ঠনের অল্প আলোয় কোনোরকমে আমরা আহার সেরে নিলাম। জল ফুরিয়ে যাবে এই ভয়ে বেশি জল খাওয়ার সাহস পর্যন্ত হলো না। তারপর অতৃপ্ত তৃষ্ণা নিয়েই আশ্রয় নিলাম প্রস্তর-শয্যায়।

পরদিন একটানা দশ ঘণ্টা চলবার পর দেখলাম, প্রাচীরের গায়ে টর্চের আলো আর তেমন যেন ফুটতে চাইছে না। পরীক্ষা করে দেখতে পেলাম, মারবেল পাথর, চুন পাথর, শ্বেত পাথর নেই, স্নেট পাথরের স্তরও অন্তর্হিত। সামনে আছে শুধু ঘন কালো রঙের আস্তরণ-ঢাকা সুড়ঙ্গ-প্রাচীর। প্রাচীরের গা থেকে হাত সরিয়ে নিতেই চোখে পড়লো, হাত কালো হয়ে গেছে।

বিস্ময়ে অস্ফুট কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলাম : কয়লার খনি! কয়লার খনি!

কাকামণি হেসে বললেন : এই কয়লার খনিতে এর আগে মানুষের আবির্ভাব ঘটেনি। আমরাই এই দেশের প্রথম আগন্তুক। তারপর হাসের দিকে ফিরে তাকালেন উনি। বললেন : আজ এখানেই থামা যাক, হান্‌স্‌। অনেকক্ষণ এগোেনো গেছে। একদিনের পক্ষে এই যথেষ্ট।

রাত্রির আহার সেরে নিতে বসলাম সবাই মিলে। খেতে আমার কোনোই আগ্রহ ছিলো না। আমার ভাগে যে অল্প-একটু জল পড়লে প্রাণভরে তাই শুধু পান করলাম।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই সবাই শুয়ে পড়লাম। কাকামণি আর হান্‌স্‌ সহজেই ঘুমিয়ে পড়লো, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নামলো না। জলের চিন্তায় আমার ঘুম আসতে চাইলো না। অনেকক্ষণ জেগে থাকবার পর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টের পাইনি। সকালবেলায় যখন কাকামণি আর হান্‌স্‌ যাত্রার অঙ্গে প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন আমার ঘুম ভাঙলো। প্রাতরাশ সেরে নিয়ে আবার নিয়মিতভাবে চলা শুরু হলো।

কিছুদূর এগোনোর পর সামনে একটা বিপুল আকারের গহবর পড়লো। অন্ধকার হাঁ মেলে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই অন্ধকারে রয়েছে সর্বনাশের সম্ভাবনা। প্রকৃতি ছাড়া এমনতরো দ্বিতীয় একটি গহ্বর সৃষ্টি করবার ক্ষমতা আর কারো নেই। গহ্বরটার পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম।

সেদিনও সারা দিন হেঁটে পথের শেষ দেখা গেলো না। আমাদের যেমন চলার বিরতি নেই, তেমনি সুড়ঙ্গটারও কোনো শেষ হবার লক্ষণ নেই। যতই এগোই না কেন, সুড়ঙ্গ যেন আর ফুরোবে না। কাকামণি পর্যন্ত আস্তে-আস্তে অধৈর্য হয়ে উঠতে লাগলেন।

রাত না দিন বোঝবার জো নেই এমনিতে। শুধু আকারহীন ঘন অন্ধকার। আমাদের হাতের আলো যেন সেই অন্ধকারকে আরো বাড়িয়ে তুলছিলো। ঘড়ি দেখেই নিয়ম-মতো সময়ে আমরা জিরোই, আহার করি, ঘুমোই, তারপর আবার চলতে থাকি।

অবশেষে ঘড়িতে একসময়ে সন্ধে ছটা বাজলো। আর ঠিক সেই সময়েই দেখতে পেলাম, আমাদের সামনে একটা নিরেট প্রাচীর মাথা তুলে পড়িয়ে আছে। এই পথের তাহলে এখানেই শেষ।

কাকামণি কিন্তু নির্বিকার। শুধু বললেন : ভালো। এতক্ষণে তবু একটা পথের শেষ দেখা গেলো। সাউজ তবে এই পথে আসেননি। এবার তাহলে ফেরার উদ্যোগ করা যাক। আফশোষ করে আর লাভ কী খামোকা? আমরা পথ ভুল করেছিলুম-এবার ফিরে গিয়ে আসল পথ ধরে এগোবে।

এই হতাশার মধ্যেও কেন জানি না হাসি পেলে আমার। ম্লান স্বরে বললাম : ফিরবে তত নিশ্চয়ই, কিন্তু শক্তি কই?

নেই মানে? এতোটা পথ আসতে পারলাম, আর কেরবার বেলা পারবো না?

আশঙ্কাটা প্রকাশ করে বললাম : কিন্তু কাকামণি, কালকেই যে সব অল ফুরিয়ে যাবে!

নিকুচি করেছে তোর জলের! অধৈর্য হয়ে উঠলেন কাকামণি। অল ফুরিয়ে যাবে বলে কি আমাদের ধৈর্য, সাহস, সঙ্কল্প সবকিছুই ফুরিয়ে যাবে নাকি?

এই কথার জবাব দেবার সাধ্য আমার ছিলো না। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম, এতটা পথ আসতে লেগেছে পাঁচ দিন, ফিরে যেতেও তো আবার সেই পাঁচ দিনের ধাক্কা। ততোদিন কি জল না খেয়ে বাঁচবো?

কিন্তু এখানে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকলেও তো বাচবার সম্ভাবনা নেই। গেলেও মৃত্যু, থাকলেও তথৈবচ। সুতরাং বৃথা দেরি না করে তখুনি প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ করলাম আমরা।