চিত্রাঙ্গদা – ০৯

বনচরগণ ও অর্জুন

বনচর।          হায় হায়, কে রক্ষা করিবে।
অর্জুন।                                         কী হয়েছে।
বনচর।                    উত্তর-পর্বত হতে আসিছে ছুটিয়া
দস্যুদল, বরষার পার্বত্য বন্যার
মতো বেগে, বিনাশ করিতে লোকালয়।
অর্জুন।         এ রাজ্যে রক্ষক কেহ নাই?
বনচর।                                          রাজকন্যা
চিত্রাঙ্গদা আছিলেন দুষ্টের দমন;
তাঁর ভয়ে রাজ্যে নাহি ছিল কোনো ভয়,
যমভয় ছাড়া। শুনেছি গেছেন তিনি
তীর্থপর্যটনে, অজ্ঞাত ভ্রমনব্রত।
অর্জুন।          এ রাজ্যের রক্ষক রমণী?
বনচর।                                           এক দেহে
তিনি পিতামাতা অনুরক্ত প্রজাদের।
স্নেহে তিনি রাজমাতা, বীর্যে যুবরাজ।              [  প্রস্থান
চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ
চিত্রাঙ্গদা।       কী ভাবিছ নাথ।
অর্জুন।                           রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা
কেমন না জানি তাই ভাবিতেছি মনে।
প্রতিদিন শুনিতেছি শত মুখ হতে
তারি কথা, নব নব অপূর্ব কাহিনী।
চিত্রাঙ্গদা।                    কুৎসিত, কুরূপ। এমন বঙ্কিম ভুরু
নাই তার–এমন নিবিড় কৃষ্ণতারা।
কঠিন সবল বাহু বিঁধিতে শিখেছে
লক্ষ্য, বাঁধিতে পারে না বীরতনু হেন
সুকোমল নাগপাশে।
অর্জুন।                                  কিন্তু শুনিয়াছি,
স্নেহে নারী, বীর্যে সে পুরুষ।
চিত্রাঙ্গদা।                                          ছি ছি, সেই
তার মন্দভাগ্য। নারী যদি নারী হয়
শুধু, শুধু ধরণীর শোভা, শুধু আলো,
শুধু ভালোবাসা–শুধু সুমধুর ছলে
শতরূপ ভঙ্গিমায় পলকে পলকে
লুটায়ে জড়ায়ে বেঁকে বেঁধে হেসে কেঁদে,
সেবায় সোহাগে ছেয়ে চেয়ে থাকে সদা,
তবে তার সার্থক জনম। কী হইবে
কর্মকীর্তি বীর্যবল শিক্ষাদীক্ষা তার।
হে পৌরব, কাল যদি দেখিতে তাহারে
এই বনপথপার্শ্বে, এই পূর্ণাতীরে,
ওই দেবালয়মাঝে–হেসে চলে যেতে।
হায় হায়, আজ এত হয়েছে অরুচি
নারীর সৌন্দর্যে, নারীতে খুঁজিতে চাও
পৌরুষের স্বাদ!
এসো নাথ, ওই দেখো
গাঢ়চ্ছায়া শৈলগুহামুখে বিছাইয়া
রাখিয়াছি আমাদের মধ্যাহ্নশয়ন
কচি কচি পীতশ্যাম কিশলয় তুলি
আর্দ্র করি ঝরনার শীকরনিকরে।
গভীর পল্লবছায়ে বসি ক্লান্তকণ্ঠে
কাঁদিছে কপোত, “বেলা যায়” “বেলা যায়”
বলি। কুলু কুলু বহিয়া চলেছে নদী
ছায়াতল দিয়া। শিলাখণ্ডে স্তরে স্তরে
সরল সুস্নিগ্ধ সিক্ত শ্যামল শৈবাল
নয়ন চুম্বন করে কোমল অধরে।
এসো, নাথ, বিরল বিরামে।
অর্জুন।                                          আজ নহে
প্রিয়ে।
চিত্রাঙ্গদা।                 কেন নাথ।
অর্জুন।                                শুনিয়াছি দস্যুদল
আসিছে নাশিতে জনপদ। ভীত জনে
করিব রক্ষণ।
চিত্রাঙ্গদা।                        কোনো ভয় নাই প্রভু।
তীর্থযাত্রাকালে, রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা
স্থাপন করিয়া গেছে সতর্ক প্রহরী
দিকে দিকে; বিপদের যত পথ ছিল
বন্ধ করে দিয়ে গেছে বহু তর্ক করি।
অর্জুন।                    তবু আজ্ঞা করো প্রিয়ে, স্বল্পকালতরে
করে আসি কর্তব্যসন্ধান। বহুদিন
রয়েছে অলস হয়ে ক্ষত্রিয়ের বাহু।
সুমধ্যমে, ক্ষীণকীর্তি এই ভুজদ্বয়
পুনর্বার নবীন গৌরবে ভরি আনি
তোমার মস্তকতলে যতনে রাখিব,
হবে তব যোগ্য উপাধান।
চিত্রাঙ্গদা।                                     যদি আমি
নাই যেতে দিই? যদি বেঁধে রাখি? ছিন্ন
করে যাবে? তাই যাও। কিন্তু মনে রেখো
ছিন্ন লতা জোড়া নাহি লাগে। যদি তৃপ্তি
হয়ে থাকে, তবে যাও, করিব না মানা;
যদি তৃপ্তি নাহি হয়ে থাকে, তবে মনে
রেখো, চঞ্চলা সুখের লক্ষ্মী কারো তরে
বসে নাহি থাকে; সে কাহারো সেবাদাসী
নহে; তার সেবা করে নরনারী, অতি
ভয়ে ভয়ে, নিশিদিন রাখে চোখে চোখে
যত দিন প্রসন্ন সে থাকে। রেখে যাবে
যারে সুখের কলিকা, কর্মক্ষেত্র হতে
ফিরে এসে সন্ধ্যাকালে দেখিবে তাহার
দলগুলি ফুটে ঝরে পড়ে গেছে ভূমে
সব কর্ম ব্যর্থ মনে হবে। চিরদিন
রহিবে জীবনমাঝে জীবন্ত অতৃপ্তি
ক্ষুধাতুরা। এসো নাথ, বসো। কেন আজি
এত অন্যমন। কার কথা ভাবিতেছ।
চিত্রাঙ্গদা? আজ তার এত ভাগ্য কেন।
অর্জুন।                    ভাবিতেছি বীরাঙ্গনা কিসের লাগিয়া
ধরেছে দুষ্কর ব্রত। কী অভাব তার।
চিত্রাঙ্গদা।                    কী অভাব তার? কী ছিল সে অভাগীর?
বীর্য তার অভ্রভেদী দুর্গ সুদুর্গম
রেখেছিল চতুর্দিকে অবরুদ্ধ করি
রুদ্যমান রমণীহৃদয়। রমণী তো
সহজেই অন্তরবাসিনী; সংগোপনে
থাকে আপনাতে; কে তারে দেখিতে পায়,
হৃদয়ের প্রতিবিম্ব দেহের শোভায়
প্রকাশ না পায় যদি। কী অভাব তার!
অরুণলাবণ্যলেখাচিরনির্বাপিত
উষার মতন, যে-রমণী আপনার
শতস্তর তিমিরের তলে বসে থাকে
বীর্যশৈলশৃঙ্গ’পরে নিত্য-একাকিনী,
কী অভাব তার! থাক্‌, থাক্‌ তার কথা;
পুরুষের শ্রুতিসুমধুর নহে তার
ইতিহাস।
অর্জুন।                        বলো বলো। শ্রবণলালসা
ক্রমশ বাড়িছে মোর। হৃদয় তাহার
করিতেছি অনুভব হৃদয়ের মাঝে।
যেন পান্থ আমি, প্রবেশ করেছি গিয়া
কোন্‌ অপরূপ দেশে অর্ধরজনীতে।
নদীগিরিবনভূমি সুপ্তিনিমগন,
শুভ্রসৌধকিরীটিনী উদার নগরী
ছায়াসম অর্ধষ্ফুট দেখা যায়, শুনা
যায় সাগরগর্জন; প্রভাতপ্রকাশে
বিচিত্র বিস্ময়ে যেন ফুটিবে চৌদিক;
প্রতীক্ষা করিয়া আছি উৎসুক হৃদয়ে
তারি তরে। বলো বলো,শুনি তার কথা।
চিত্রাঙ্গদা।         কী আর শুনিবে।
অর্জুন।                                দেখিতে পেতেছি তারে–
বাম করে অশ্বরশ্মি ধরি অবহেলে,
দক্ষিণেতে ধনুঃশর, হৃষ্ট নগরের
বিজয়লক্ষ্মীর মতো আর্ত প্রজাগণে
করিছেন বরাভয় দান। দরিদ্রের
সংকীর্ণ দুয়ারে, রাজার মহিমা যেথা
নত হয় প্রবেশ করিতে, মাতৃরূপ
ধরি সেথা করিছেন দয়া বিতরণ।
সিংহিনীর মতো চারি দিকে আপনার
বৎসগণে রয়েছেন আগলিয়া, শত্রু
কেহ কাছে নাহি আসে ডরে। ফিরিছেন
মুক্তলজ্জা ভয়হীনা প্রসন্নহাসিনী,
বীর্যসিংহ’পরে চড়ি জগদ্ধাত্রী দয়া।
রমণীর কমনীয় দুই বাহু’পরে
স্বাধীন সে অসংকোচ বল, ধিক থাক্‌
তার কাছে রুনুঝুনু কঙ্কণকিঙ্কিণী।
অয়ি বরারোহে, বহুদিন কর্মহীন
এ পরান মোর, উঠিছে অশান্ত হয়ে
দীর্ঘশীতসুপ্তোত্থিত ভুজঙ্গের মতো।
এসো এসো দোঁহে দুই মত্ত অশ্ব লয়ে
পাশাপাশি ছুটে চলে যাই, মহাবেগে
দুই দীপ্ত জ্ঞ্যোতিষ্কের মতো। বাহিরিয়া
যাই, এই রুদ্ধ সমীরণ, এই তিক্ত
পুষ্পগন্ধমদিরায় নিদ্রাঘনঘোর
অরণ্যের অন্ধগর্ভ হতে।
চিত্রাঙ্গদা।                                   হে কৌন্তেয়,
যদি এ লালিত্য, এই কোমল ভীরুতা,
স্পর্শক্লেশকাতর শিরীষপেলব
এই রূপ, ছিন্ন করে ঘৃণাভরে ফেলি
পদতলে, পরের বসনখণ্ড সম–
সে ক্ষতি কি সহিতে পারিবে। কামিনীর
ছলাকলা মায়ামন্ত্র দূর করে দিয়ে
উঠিয়া দাঁড়াই যদি সরল উন্নত
বীর্যমন্ত অন্তরের বলে, পর্বতের
তেজস্বী তরুণ তরুসম, বায়ুভরে
আনম্র সুন্দর, কিন্তু লতিকার মতো
নহে নিত্য কুণ্ঠিত লুন্ঠিত– সে কি ভালো
লাগিবে পুরুষ-চোখে। থাক্‌ থাক্‌ তার
চেয়ে এই ভালো। আপন যৌবনখানি
দুদিনের বহুমুল্য ধন, সাজাইয়া
সযতনে, পথ চেয়ে বসিয়া রহিব;
অবসরে আসিবে যখন, আপনার
সুধাটুকু দেহপাত্রে আকর্ণ পুরিয়া
করাইব পান; সুখস্বাদে শ্রান্তি হলে
চলে যাবে কর্মের সন্ধানে; পুরাতন
হলে, যেথা স্থান দিবে, সেথায় রহিব
পার্শ্বে পড়ি। যামিনীর নর্মসহচরী
যদি হয় দিবসের কর্মসহচরী,
সতত প্রস্তুত থাকে বামহস্তসম
দক্ষিণহস্তের অনুচর, সে কি ভালো
লাগিবে বীরের প্রাণে।
অর্জুন।                                      বুঝিতে পারি নে
আমি রহস্য তোমার। এতদিন আছি,
তবু যেন পাই নি সন্ধান। তুমি যেন
বঞ্চিত করিছ মোরে গুপ্ত থেকে সদা;
তুমি যেন দেবীর মতন, প্রতিমার
অন্তরালে থেকে আমারে করিছ দান
অমূল্য চুম্বনরত্ন, আলিঙ্গনসুধা;
নিজে কিছু চাহ না, লহ না। অঙ্গহীন
ছন্দোহীন প্রেম, প্রতিক্ষণে পরিতাপ
জাগায় অন্তরে। তেজস্বিনী, পরিচয়
পাই তব মাঝে মাঝে কথায় কথায়।
তার কাছে এ সৌন্দর্যরাশি মনে হয়
মৃত্তিকার মূর্তি শুধু, নিপুণচিত্রিত
শিল্পযবনিকা। মাঝে মাঝে মনে হয়
তোমারে তোমার রূপ ধারণ করিতে
পারিছে না আর, কাঁপিতেছে টলমল
করি। নিত্যদীপ্ত হাসির অন্তরে
ভরা অশ্রু করিতেছে বাস, মাঝে মাঝে
ছলছল করে ওঠে, মূহূর্তের মাঝে
ফাটিয়া পড়িবে যেন আবরণ টুটি।
সাধকের কাছে, প্রথমেতে ভ্রান্তি আসে
মনোহর মায়াকায়া ধরি; তার পরে
সত্য দেখা দেয়, ভূষণবিহীন রূপে
আলো করি অন্তর বাহির। সেই সত্য
কোথা আছে তোমার মাঝারে, দাও তারে।
আমার যে সত্য তাই লও। শ্রান্তিহীন
সে মিলন চিরদিবসের–অশ্রু কেন
প্রিয়ে! বাহুতে লুকায়ে মুখ কেন এই
ব্যাকুলতা! বেদনা দিয়েছি প্রিয়তমে?
তবে থাক্‌, তবে থাক্‌। ওই মনোহর
রূপ পুণ্যফল মোর। এই-যে সংগীত
শোনা যায় মাঝে মাঝে বসন্তসমীরে
এ যৌবনযমুনার পরপার হতে,
এই মোর বহুভাগ্য। এ বেদনা মোর
সুখের অধিক সুখ, আশার অধিক
আশা, হৃদয়ের চেয়ে বড়ো, তাই তারে
হৃদয়ের ব্যথা বলে মনে হয় প্রিয়ে।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *