মালিনী – ৪

চতুর্থ দৃশ্য

রাজ-উপবন

মালিনী পরিচারিকাবর্গ ও সুপ্রিয়

মালিনী।     হায়, কী বলিব! তুমিও কি মোর দ্বারে
আসিয়াছ দ্বিজোত্তম? কী দিব তোমারে?
কী তর্ক করিব? কী শাস্ত্র দেখাব আনি?
তুমি যাহা নাহি জান আমি কি তা জানি?
সুপ্রিয়।      শাস্ত্রসাথে তর্ক করি, নহে তোমা-সনে।
সভায় পণ্ডিত আমি, তোমার চরণে
বালকের মতো। দেবী, লহো মোর ভার।
যে পথে লইয়া যাবে জীবন আমার
সাথে যাবে, সর্ব তর্ক করি পরিহার,
নীরব ছায়ার মতো দীপবর্তিকার।
মালিনী।     হে ব্রাহ্মণ, চলে যায় সকল ক্ষমতা
তুমি যবে প্রশ্ন কর, নাহি পাই কথা।
বড়ই বিস্ময় লাগে মনে। হে সুপ্রিয়,
মোর কাছে কী জানিতে এসেছ তুমিও?
সুপ্রিয়।       জানিবার কিছু নাই, নাহি চাহি জ্ঞান।
সব শাস্ত্র পড়িয়াছি, করিয়াছি ধ্যান
শত তর্ক শত মত। ভুলাও, ভুলাও,
যত জানি সব জানা দূর করে দাও।
পথ আছে শতলক্ষ, শুধু আলো নাই
ওগো দেবী জ্যোতির্ময়ী– তাই আমি চাই
একটি আলোর রেখা উজ্জ্বল সুন্দর
তোমার অন্তর হতে।
মালিনী।                         হায় বিপ্রবর,
যত তুমি চাহিতেছ আমি যেন তত
আপনারে হেরিতেছি দরিদ্রের মতো।
যে দেবতা মর্মে মোর বজ্রালোক হানি
বলেছিল একদিন বিদ্যুন্ময়ী বাণী
সে আজি কোথায় গেল। সেদিন, ব্রাহ্মণ,
কেন তুমি আসিলে না? কেন এতক্ষণ
সন্দেহে রহিলে দূরে? বিশ্বে বাহিরিয়া
আজি মোর জাগে ভয়, কেঁপে ওঠে হিয়া,
কী করিব কী বলিব বুঝিতে না পারি–
মহাধর্মতরণীর বালিকা কাণ্ডারী
নাহি জানি কোথা যেতে হবে। মনে হয়
বড়ো একাকিনী আমি– সহস্র সংশয়,
বৃহৎ সংসার, অসংখ্য জটিল পথ,
নানা প্রাণী–দিব্যজ্ঞান ক্ষণপ্রভাবৎ
ক্ষণিকের তরে আসে। তুমি মহাজ্ঞানী
হবে কি সহায় মোর?
সুপ্রিয়।                          বহু ভাগ্য মানি
যদি চাহ মোরে।
মালিনী।                      মাঝে মাঝে নিরুৎসাহ
রুদ্ধ করে দেয় যেন প্রাণের প্রবাহ–
পীড়ন করিতে থাকে নিরুদ্ধ নিশ্বাসে,
থেকে থেকে অকারণ অশ্রুজলে ভাসে
দু-নয়ন কোন্‌ বেদনায়। অকস্মাৎ
আপনার ‘পরে যেন পড়ে দৃষ্টিপাত
সহস্র লোকের মাঝে, সেই দুঃসময়ে
তুমি মোর বন্ধু হবে? মন্ত্রগুরু হয়ে
দিবে নবপ্রাণ?
সুপ্রিয়।                    প্রস্তুত রাখিব নিত্য
এ ক্ষুদ্র জীবন। আমার সকল চিত্ত
সবল নির্মল করি, বুদ্ধি করি শান্ত,
সমর্পণ করি দিব নিয়ত একান্ত
তব কাজে।

প্রতিহারীর প্রবেশ

প্রতিহারী।                  প্রজাগণ দরশন যাচে।
মালিনী।     আজ নহে, আজ নহে। সকলের কাছে
মিনতি আমার; আজি  মোর কিছু নাহি।
রিক্ত চিত্ত মাঝে মাঝে ভরিবারে চাহি–
বিশ্রাম প্রার্থনা করি ঘুচাতে জড়তা।    

[ প্রতিহারীর প্রস্থান

সুপ্রিয়ের প্রতি
যে কথা শুনাতেছিলে কহ সেই কথা,
আপন কাহিনী। শুনিয়া বিস্ময় লাগে,
নূতন বারতা পাই, নবদৃশ্য জাগে
চক্ষে মোর। তোমাদের সুখদুঃখ যত,
গৃহের বারতা সব, আত্মীয়ের মতো
সকলি প্রত্যক্ষ যেন জানিবারে পাই।
ক্ষেমংকর বান্ধব তোমার?

সুপ্রিয়।                               বন্ধু, ভাই,
প্রভু। সূর্য সে আমার, আমি তার রাহু,
আমি তার মহামোহ। বলিষ্ঠ সে বাহু,
আমি তাহে লৌহপাশ। বাল্যকাল হতে
দৃঢ় সে অটলচিত্ত, সংশয়ের স্রোতে
আমি ভাসমান। তবু সে নিয়ত মোরে
বন্ধুমোহে বক্ষোমাঝে রাখিয়াছে ধরে
প্রবল অটল প্রেমপাশে, নিঃসন্দেহে
বিনা পরিতাপে, চন্দ্রমা যেমন স্নেহে
সহাস্যে বহন করে কলঙ্ক অক্ষয়
অনন্ত ভ্রমণপথে। ব্যর্থ নাহি হয়
বিধির নিয়ম কভু– লৌহময় তরী
হোক না যতই দৃঢ়, যদি রাখে ধরি
বক্ষতলে ক্ষুদ্র ছিদ্রটিরে, এক দিন
সংকটসমুদ্রমাঝে উপায়বিহীন
ডুবিতে হইবে তারে। বন্ধু চিরন্তন,
তোমারে ডুবাব আমি, ছিল এ লিখন।
মালিনী।     ডুবায়েছ তারে?
সুপ্রিয়।                     দেবী, ডুবায়েছি তারে।
জীবনের সব কথা বলেছি তোমারে,
শুধু, সেই কথা আছে বাকি।
    যেই দিন
বিদ্বেষ উঠিল গর্জি দয়াধর্মহীন
তোমারে ঘেরিয়া চারি দিকে, একাকিনী
দাঁড়াইয়া পূর্ণ মহিমায়, কী রাগিণী
বাজাইলে! বংশীরবে যেন মন্ত্রাহত
বিদ্রোহ করিল আসি ফণা অবনত
তব পদতলে। শুধু বিপ্র ক্ষেমংকর
রহিল পাষাণচিত্ত, অটল-অন্তর।
একদা ধরিয়া কর কহিল সে মোরে
“বন্ধু, আমি চলিলাম দূর দেশান্তরে।
আনিয়া বিদেশী সৈন্য বরুণার কূলে
নবধর্ম উৎপাটন করিব সমূলে
পুণ্য কাশী হতে।’ চলি গেল রিক্ত হাতে
অজ্ঞাত ভুবনে। শুধু লয়ে গেল সাথে
আমার হৃদয়, আর, প্রতিজ্ঞা কঠোর।
তার পরে জান তুমি কী ঘটিল মোর।
লভিলাম যেন আমি নবজন্মভূমি
যেদিন এ শুষ্ক চিত্তে বরষিলে তুমি
সুধাবৃষ্টি। “সর্ব জীবে দয়া’ জানে সবে,
অতি পুরাতন কথা– তবু এই ভবে
এই কথা বসি আছে লক্ষবর্ষ ধরি
সংসারের পরতীরে। তারে পার করি
তুমি আজি আনিয়াছ সোনার তরীতে
সবার ঘরের দ্বারে। হৃদয়-অমৃতে
স্তন্যদান করিয়াছ সে দেবশিশুরে,
লয়েছে সে নবজন্ম মানবের পুরে
তোমারে মা ব’লে। স্বর্গ আছে কোন্‌ দূরে,
কোথায় দেবতা– কে বা সে সংবাদ জানে
শুধু জানি বলি দিয়া আত্ম-অভিমানে
বাসিতে হইবে ভালো, বিশ্বের বেদনা
আপন করিতে হবে– যে কিছু বাসনা
শুধু আপনার তরে তাই দুঃখময়।
যজ্ঞে যাগে তপস্যায় কভু মুক্তি নয়,
মুক্তি শুধু  বিশ্বকাজে। ফিরে গিয়ে ঘরে
সে নিশীথে কাঁদিয়া কহিনু উচ্চস্বরে,
“বন্ধু, বন্ধু, কোথা গেছ বহু বহু দূরে–
অসীম ধরণীতলে মরিতেছ ঘুরে!’
ছিনু তার পত্র-আশে– পত্র নাহি পাই,
না জানি সংবাদ। আমি শুধু আসি যাই
রাজগৃহমাঝে, চারি দিকে দৃষ্টি রাখি,
শুধাই বিদেশীজনে, ভয়ে ভয়ে থাকি–
নাবিক যেমন দেখে চকিত নয়নে
সমুদ্রের মাঝে, গগনের কোন্‌ কোণে
ঘনাইছে ঝড়। এল ঝড় অবশেষে
একখানি ছোটো পত্ররূপে! লিখেছে সে–
রত্নবতী নগরীর রাজগৃহ হতে
সৈন্য লয়ে আসিছে সে শোণিতের স্রোতে
ভাসাইতে নবধর্ম, ভিড়াইতে তীরে
পিতৃধর্ম  মগ্নপ্রায়, রাজকুমারীরে
প্রাণদণ্ড দিতে। প্রচণ্ড আঘাতে সেই
ছিঁড়িল প্রাচীন পাশ এক নিমেষেই।
রাজারে দেখানু পত্র। মৃগয়ার ছলে
গোপনে গেছেন রাজা সৈন্যদলবলে
আক্রমিতে তারে। আমি হেথা লুটাতেছি
পৃথ#aলে– আপনার মর্মে ফুটাতেছি
দন্ত আপনার।
মালিনী।                  হায়, কেন তুমি তারে
আসিতে দিলে না হেথা মোর গৃহদ্বারে
সৈন্যসাথে? এ ঘরে সে প্রবেশিত আসি
পূজ্য অতিথির মতো, সুচিরপ্রবাসী
ফিরিত স্বদেশে তার।
রাজার প্রবেশ
রাজা।                            এসো আলিঙ্গনে
হে সুপ্রিয়!  গিয়েছিনু অনুকূল ক্ষণে
বার্তা পেয়ে। বন্দী করিয়াছি ক্ষেমংকরে
বিনাক্লেশে। তিলেক বিলম্ব হলে পরে
সুপ্তরাজগৃহশিরে বজ্র ভয়ংকর
পড়িত ঝঞ্ঝনি, জাগিবার অবসর
পেতেম না কভু। এসো আলিঙ্গনে মম
বান্ধব, আত্মীয় তুমি।
সুপ্রিয়।                          ক্ষম মোরে ক্ষম
মহারাজ!
রাজা।                 শুধু নহে শূন্য আত্মীয়তা
প্রিয়বন্ধু! মনে আনিয়ো না হেন কথা
শুধু রাজ-আলিঙ্গনে পুরস্কার তব।
কী ঐশ্বর্য চাহ? কী সম্মান অভিনব
করিব সৃজন তোমাতরে? কহো মোরে!
সুপ্রিয়।      কিছু নহে, কিছু নহে, খাব ভিক্ষা করে
দ্বারে দ্বারে।
রাজা।                  সত্য কহো, রাজ্যখণ্ড লবে?
সুপ্রিয়।      রাজ্যে ধিক্‌ থাক্‌।
রাজা।                         অহো, বুঝিলাম তবে
কোন্‌ পণ চাহ জিনিবারে, কোন্‌ চাঁদ
পেতে চাও হাতে। ভালো, পুরাইব সাধ,
দিলাম অভয়। কোন্‌ অসম্ভব আশা
আছে মনে, খুলে বলো। কোথা গেল ভাষা!
বেশি দিন নহে, বিপ্র, সে কি মনে পড়ে
এই কন্যা মালিনীর নির্বাসনতরে
অগ্রবর্তী ছিলে তুমি। আজি আরবার
করিবে কি সে প্রার্থনা? রাজদুহিতার
নির্বাসন পিতৃগৃহ হতে? সাধনার
অসাধ্য কিছুই নাই–বাঞ্ছা সিদ্ধ হবে,
ভরসা বাঁধহ বক্ষোমাঝে। শুন তবে–
জীবনপ্রতিমে, বৎসে, যে তোমার প্রাণ
রক্ষা করিয়াছে, সেহ বিপ্র গুণবান্‌
সুপ্রিয় সবার প্রিয়, প্রিয়দরশন,
তারে–
সুপ্রিয়।              ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও হে রাজন্‌!
অয়ি দেবী,আজন্মের ভক্তি-উপহারে
পেয়েছে আপন ঘরে ইষ্টদেবতারে
কত অকিঞ্চন– তেমনি পেতেম যদি
আমার দেবীরে, রহিতাম নিরবধি
ধন্য হয়ে। রাজহস্ত হতে পুরস্কার!
কী করেছি? আশৈশব বন্ধুত্ব আমার
করেছি বিক্রয়, আজি তারি বিনিময়ে
লয়ে যাব শিরে করি আপন আলয়ে
পরিপূর্ণ সার্থকতা? তপস্যা করিয়া
মাগিব পরমসিদ্ধি জন্মান্ত ধরিয়া–
জন্মান্তরে পাই যদি তবে তাই হোক–
বন্ধুর বিশ্বাস ভাঙি সপ্ত স্বর্গলোক
চাহি না লভিতে।  পূর্ণকাম তুমি দেবী,
আপনার অন্তরের মহত্ত্বেরে সেবি
পেয়েছ অনন্ত শান্তি– আমি দীনহীন
পথে পথে ফিরে মরি অদৃষ্ট-অধীন
শ্রান্ত নিজভারে। আর কিছু চাহিব না–
দিতেছ নিখিলময় যে শুভকামনা
মনে করে অভাগারে তারি এক কণা
দিয়ো মনে মনে।
মালিনী।                     ওরে রমণীর মন,
কোথা বক্ষোমাঝে বসে করিস ক্রন্দন
মধ্যাহ্নে নির্জন নীড়ে প্রিয়বিরহিতা
কপোতীর প্রায়?– কী করেছ বলো পিতা
বন্দীর বিচার?
রাজা।                      প্রাণদণ্ড হবে তার।
মালিনী।     ক্ষমা করো–একান্ত এ প্রার্থনা আমার
তব পদে।
রাজা।                 রাজদ্রোহী, ক্ষমিব তাহারে
বৎসে?
সুপ্রিয়।              কে কার বিচার করে এ সংসারে!
সে কি চেয়েছিল তব সসাগরা মহী
মহারাজ? সে জানিত তুমি ধর্মদ্রোহী,
তাই সে আসিতেছিল তোমার বিচার
করিতে আপন বলে। বেশি বল যার
সেই বিচারক। সে যদি জিনিত আজি
দৈবক্রমে, সে বসিত বিচারক সাজি,
তুমি হতে অপরাধী!
মালিনী।                         রাখো প্রাণ তার
মহারাজ!  তার পরে স্মরি উপকার
হিতৈষী বন্ধুরে তব যাহা ইচ্ছা দিয়ো,
লবে সে আদর করি।
রাজা।                           কী বল সুপ্রিয়?
বন্ধুরে করিব বন্ধুদান?
সুপ্রিয়।                          চিরদিন
স্মরণে রহিবে তব অনুগ্রহ-ঋণ
নরপতি।
রাজা।                 কিন্তু তার পূর্বে এক বার
দেখিব পরীক্ষা করি বীরত্ব তাহার।
দেখিব মরণভয়ে টলে কি না টলে
কর্তব্যের বল। মহত্ত্বের শিখা জ্বলে
নক্ষত্রের মতো– দীপ নিবে যায় ঝড়ে,
তারা নাহি নিবে। সে কথা হইবে পরে।
তোমার বন্ধুরে তুমি পাবে, মাঝখানে
উপলক্ষ আমি।  সে দানে তৃপ্তি না মানে
মন। আরো দিব। পুরস্কার ব’লে নয়–
রাজার হৃদয় তুমি করিয়াছ জয়,
সেথা হতে লহ তুলি রত্ন সর্বোত্তম
হৃদয়ের।– কন্যা, কোথা ছিল এ শরম
এতদিন! বালিকার লজ্জাভয়শোক
দূর করি দীপ্তি পেত অম্লান আলোক
দুঃসহ উজ্জ্বল। কোথা হতে এল আজ
অশ্রুবাষ্পে ছলছল কম্পমান লাজ–
যেন দীপ্ত হোমহুতাশনশিখা ছাড়ি
সদ্য বাহিরিয়া এল স্নিগ্ধসুকুমারী
দ্রুপদদুহিতা।  
সুপ্রিয়ের প্রতি
উঠ, ছাড়ো পদতল।
বৎস, বক্ষে এস। সুখ করিছে বিহ্বল
দুর্ভর দুঃখেরই মতো। দাও অবসর,
হেরি প্রাণপ্রতিমার মুখশশধর
বিরলে আনন্দভরে শুধু ক্ষণকাল।

[ সুপ্রিয়ের প্রস্থান

স্বগত

বহুদিন পরে মোর মালিনীর ভাল
লজ্জার আভায় রাঙা। কপোল উষার
যখনি রাঙিয়া উঠে, বুঝা যায়, তার
তপন উদয় হতে দেরি নাই আর।
এ রাঙা আভাস দেখে আনন্দে আমার
হৃদয় উঠিছে ভরি ; বুঝিলাম মনে
আমাদের কন্যাটুকু বুঝি এতক্ষণে
বিকশি উঠিল–দেবী না রে, দয়া না রে,
ঘরের সে মেয়ে।

প্রতিহারীর  প্রবেশ

প্রতিহারী।                   জয় মহারাজ, দ্বারে
উপনীত বন্দী ক্ষেমংকর।
রাজা।                               আনো তারে।
শৃঙ্খলবদ্ধ ক্ষেমংকরের প্রবেশ
নেত্র স্থির, ঊর্ধ্বশির, ভ্রূকুটির ‘পরে
ঘনায়ে রয়েছে ঝড়, হিমাদ্রিশিখরে
স্তম্ভিত শ্রাবণসম।
মালিনী।                      লোহার শৃঙ্খল
ধিক্কার মানিছে যেন লজ্জায় বিকল
ওই অঙ্গ-‘পরে। মহত্ত্বের অপমান
মরে অপমানে। ধন্য মানি এ পরান
ইন্দ্রতুল্য হেন মুর্তি হেরি।
বন্দির প্রতি
রাজা।                                 কী বিধান
হয়েছে শুনেছ?
ক্ষেমংকর।                 মৃত্যুদণ্ড।
রাজা।                                 যদি প্রাণ
ফিরে দিই, যদি ক্ষমা করি!
ক্ষেমংকর।                            পুনর্বার
তুলিয়া লইতে হবে কর্তব্যের ভার–
যে পথে চলিতেছিনু আবার সে পথে
যেতে হবে।
রাজা।                  বাঁচিতে চাহ না কোনোমতে!
ব্রাহ্মণ, প্রস্তুত হও মমতা তেয়াগি
জীবনের। এই বেলা লহ তবে মাগি
প্রার্থনা যা-কিছু থাকে।
ক্ষেমংকর।                          আর কিছু নাহি
বন্ধু সুপ্রিয়েরে শুধু দেখিবারে চাহি।

প্রতিহারীর প্রতি

রাজা।        ডেকে আনো তারে।
মালিনী।                          হৃদয় কাঁপিছে বুকে।
কী যেন পরমা শক্তি আছে ওই মুখে
বজ্রসম ভয়ংকর। রক্ষা করো পিতঃ,
আনিয়ো না সুপ্রিয়েরে।
রাজা।                              কেন, মা, শঙ্কিত
অকারণে? কোনো ভয় নাই।
ক্ষেমংকরের নিকট সুপ্রিয়ের আগমন
 আলিঙ্গন প্রত্যাখ্যান করিয়া
ক্ষেমংকর।                              থাক্‌ থাক্‌
যাহা বলিবার আছে  আগে হয়ে যাক–
পরে হবে প্রণয়সম্মান। এসো হেথা।
জান সখে, বাক্যদীন আমি– বেশি কথা
জোগায় না মুখে। সময় অধিক নাই,
আমার বিচার হল শেষ–আমি চাই
তোমার বিচার এবে। বলো মোর কাছে
এ কাজ করেছ কেন?
সুপ্রিয়।                          বন্ধু এক আছে
শ্রেষ্ঠতম, সে আমার আত্মার নিশ্বাস,
সব ছেড়ে রাখিয়াছি তাহারি বিশ্বাস
প্রাণসখে–ধর্ম সে আমার।
ক্ষেমংকর।                            জানি জানি
ধর্ম কে তোমার। ওই স্তব্ধ মুখখানি
অন্তর্জ্যোতির্ময়,মূর্তিমতী,  দৈববাণী
রাজকন্যারূপে– চতুর্বেদ হতে, সখে,
কেড়ে লয়ে পিতৃধর্ম ওই নেত্রালোকে
দিয়েছ আহুতি তুমি। ধর্ম ওই তব।
ওই প্রিয়মুখে তুমি রচিয়াছ নব
ধর্মশাস্ত্র আজি।
সুপ্রিয়।                      সত্য বুঝিয়াছ সখে।
মোর ধর্ম অবতীর্ণ দীন মর্ত্যলোকে
ওই নারীমূর্তি ধরি। শাস্ত্র এতদিন
মোর কাছে ছিল অন্ধ জীবনবিহীন ;
ওই দুটি নেত্রে জ্বলে যে উজ্জ্বল শিখা
সে আলোকে পড়িয়াছি বিশ্বশাস্ত্রে লিখা–
যেথা দয়া সেথা ধর্ম, যেথা প্রেমস্নেহ,
যেথায় মানব, যেথা মানবের গেহ।
বুঝিলাম, ধর্ম দেয় স্নেহ মাতারূপে,
পুত্ররূপে স্নেহ লয় পুন; দাতারূপে
করে দান, দীনরূপে করে তা গ্রহণ ;
শিষ্যরূপে করে ভক্তি, গুরুরূপে করে
আশীর্বাদ; প্রিয়া হয়ে পাষাণ-অন্তরে
প্রেম-উৎস লয় টানি, অনুরক্ত হয়ে
করে সর্বত্যাগ। ধর্ম বিশ্বলোকালয়ে
ফেলিয়াছে চিত্তজাল, নিখিল ভুবন
টানিতেছে প্রেমক্রোড়ে– সে মহাবন্ধন
ভরেছে অন্তর মোর আনন্দবেদনে
চাহি ওই উষারুণ করুণ বদনে।
ওই ধর্ম মোর।
ক্ষেমংকর।                  আমি কি দেখি নি ওরে?
আমিও কি ভাবি নাই মুহূর্তের ঘোরে
এসেছে অনাদি ধর্ম নারীমূর্তি ধরে
কঠিন পুরুষমন কেড়ে নিয়ে যেতে
স্বর্গপানে? ক্ষণতরে মুগ্ধ হৃদয়েতে
জন্মে নি কি স্বপ্নাবেশ? অপূর্ব সংগীতে
বক্ষের পঞ্জর মোর লাগিল কাঁদিতে
সহস্র বংশীর মতো–সর্ব সফলতা
জীবনের যৌবনের আশাকল্পলতা
জড়ায়ে জড়ায়ে মোর অন্তরে অন্তরে
মঞ্জরি উঠিল যেন পত্রপুষ্পভরে
এক নিমেষের মাঝে। তবু কি সবলে
ছিঁড়ি নি মায়ার বন্ধ, যাই নি কি চলে
দেশে দেশে দ্বারে দ্বারে, ভিক্ষুকের মতো
লই নি কি শিরে ধরি অপমান শত
হীন হস্ত হতে–সহি নি কি অহরহ
আজন্মের বন্ধু তুমি তোমার বিরহ?
সিদ্ধি যবে লব্ধপ্রায়, তুমি হেথা বসে
কী করেছ–রাজগৃহমাঝে সুখালসে
কী ধর্ম মনের মতো করেছ সৃজন
দীর্ঘ অবসরে!  
সুপ্রিয়।                   ওগো বন্ধু, এ ভুবন
নহে কি বৃহৎ? নাই কি অসংখ্য জন,
বিচিত্র স্বভাব? কাহার কী প্রয়োজন
তুমি কি তা জান? গগনে অগণ্য তারা
নিশিনিশি বিবাদ কি করিছে তাহারা
ক্ষেমংকর? তেমনি জালায়ে নিজ জ্যোতি
কত ধর্ম জাগিতেছে তাহে কোন্‌ ক্ষতি!
ক্ষেমংকর।  মিছে আর কেন বন্ধু। ফুরালো সময়,
বাক্য লয়ে মিথ্যা খেলা, তর্ক আর নয়।
সত্যমিথ্যা পাশাপাশি নির্বিরোধে রবে
এত স্থান নাহি নাহি অনন্ত এ ভবে।
অন্নরূপে ধান্য যেথা উঠে চিরদিন
রোপিবে তাহারি মাঝে কন্টক নবীন,
হে সুপ্রিয়, প্রেম এত সর্বপ্রেমী নয়।
ছিল চিরদিবসের বিশ্রব্ধ প্রণয়,
আনিবে বিশ্বাসঘাত বক্ষোমাঝে তার,
বন্ধু মোর, উদারতা এত কি উদার!
কেহ বা ধর্মের লাগি সহি নির্যাতন
অকালে অস্থানে মরে চোরের মতন,
কেহ বা ধর্মের ব্রত করিয়া নিষ্ফল
বাঁচিবে সম্মানে সুখে, এ ধরণীতল
হেন বিপরীত ধর্ম এক বক্ষে বহে–
এত বড়ো এত দৃঢ় কভু নহে নহে।

মালিনীর প্রতি ফিরিয়া

সুপ্রিয়।      হে দেবী, তোমারি জয়! নিজ পদ্মকরে
যে পবিত্র শিখা তুমি আমার অন্তরে
জ্বালায়েছ, আজি হল পরীক্ষা তাহার–
তুমি হলে জয়ী। সর্ব অপমানভার
সকল নিষ্ঠুরঘাত করিনু গ্রহণ।
রক্ত উচ্ছ্বসিয়া উঠে উৎসের মতন
বিদীর্ণ হৃদয় হতে– তবু সমুজ্জ্বল
তব শান্তি, তব প্রীতি, তব সুমঙ্গল
অম্লান-অচল-দীপ্তি করিছে বিরাজ
সর্বোপরি। ভক্তের পরীক্ষা হল আজ,
জয় দেবী। ক্ষেমংকর, তুমি দিবে প্রাণ–
আমার ধর্মের লাগি করিয়াছি দান
প্রাণের অধিক প্রিয় তোমার প্রণয়,
তোমার বিশ্বাস। তার কাছে প্রাণভয়
তুচ্ছ শতবার।
ক্ষেমংকর।                  ছাড়ো এ প্রলাপবাণী।
মৃত্যু যিনি তাঁহারেই ধর্মরাজ জানি–
ধর্মের পরীক্ষা তাঁরি কাছে। বন্ধুবর,
এস তবে কাছে এসো, ধরো মোর কর,
চলো মোরা যাই সেথা দোঁহে এক সনে,
যেমন সে বাল্যকালে– সে কি পড়ে মনে,
কতদিন সারারাত্রি তর্ক করি, শেষে
প্রভাতে যেতেম দোঁহে গুরুর উদ্দেশে
কে সত্য কে মিথ্যা তাহা করিতে নির্ণয়।
তেমনি প্রভাত হোক। সকল সংশয়
আজিকে লইয়া চলি অসংশয় ধামে,
দাঁড়াই মৃত্যুর পাশে দক্ষিণে ও বামে
দুই সখা, লয়ে দু জনের প্রশ্ন যত।
সেথায় প্রত্যক্ষ সত্য উজ্জ্বল উন্নত–
মুহূর্তে পর্বতপ্রায় বিচার-বিরোধ
বাষ্পসম কোথা যাবে! দুইটি অবোধ
আনন্দে হাসিব চাহি  দোঁহে দোঁহাকারে।
সব চেয়ে বড়ো আজি মনে কর যারে
তাহারে রাখিয়া দেখো মৃত্যুর সম্মুখে।
সুপ্রিয়।      বন্ধু, তাই হোক।
ক্ষেমংকর।                   এস তবে, এসো বুকে।
বহুদূরে গিয়েছিলে এসো কাছে তবে
যেথায় অনন্তকাল বিচ্ছেদ না হবে।
লহো তবে বন্ধুহস্তে করুণ বিচার–
এই লহ।
শৃঙ্খল দ্বারা সুপ্রিয়ের মস্তকে আঘাত
 ও তাহার পতন
সুপ্রিয়।                  দেবী, তব জয়।

[ মৃত্যু

মৃতদেহের উপর পড়িয়া

ক্ষেমংকর।                              এইবার
ডাকো, ডাকো ঘাতকেরে।
রাজা।                                 কে আছিস ওরে!
আন্‌ খড়্গ।
মালিনী।                 মহারাজ, ক্ষমো ক্ষেমংকরে।    

[ মূর্ছিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *