বিসর্জন – ১

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

মন্দির

গুণবতী

গুণবতী। মার কাছে কী করেছি দোষ! ভিখারি যে
সন্তান বিক্রয় করে উদরের দায়ে,
তারে দাও শিশু–পাপিষ্ঠা যে লোকলাজে
সন্তানেরে বধ করে, তার গর্ভে দাও
পাঠাইয়া অসহায় জীব। আমি হেথা
সোনার পালঙ্কে মহারানী, শত শত
দাস দাসী সৈন্য প্রজা ল’য়ে, বসে আছি
তপ্ত বক্ষে শুধু এক শিশুর পরশ
লালসিয়া, আপনার প্রাণের ভিতরে
আরেকটি প্রাণাধিক প্রাণ করিবারে
অনুভব–এই বক্ষ, এই বাহু দুটি,
এই কোল, এই দৃষ্টি দিয়ে, বিরচিতে
নিবিড় জীবন্ত নীড়, শুধু একটুকু
প্রাণকণিকার তরে। হেরিবে আমারে
একটি নূতন আঁখি প্রথম আলোকে,
ফুটিবে আমারি কোলে কথাহীন মুখে
অকারণ আনন্দের প্রথম হাসিটি!
কুমারজননী মাতঃ, কোন্‌ পাপে মোরে
করিলি বঞ্চিত মাতৃস্বর্গ হতে?

রঘুপতির প্রবেশ

                                     প্রভু,
চিরদিন মা’র পূজা করি। জেনে শুনে
কিছু তো করি নি দোষ। পুণ্যের শরীর
মোর স্বামী মহাদেবসম–তবে কোন্‌
দোষ দেখে আমারে করিল মহামায়া
নিঃসন্তানশ্মশানচারিণী?

রঘুপতি।                                      মা’র খেলা
কে বুঝিতে পারে বলো? পাষাণতনয়া
ইচ্ছাময়ী, সুখ দুঃখ তাঁরি ইচ্ছা, ধৈর্য
ধরো। এবার তোমার নামে মা’র পূজা
হবে। প্রসন্ন হইবে শ্যামা।
গুণবতী।                                      এ বৎসর
পূজার বলির পশু আমি নিজে দিব।
করিনু মানত, মা যদি সন্তান দেন
বর্ষে বর্ষে দিব তাঁরে এক-শো মহিষ,
তিন শত ছাগ।
রঘুপতি।                         পূজার সময় হল।

[ উভয়ের প্রস্থান

গোবিন্দমাণিক্য অপর্ণা ও জয়সিংহের প্রবেশ

জয়সিংহ। কী আদেশ মহারাজ?
গোবিন্দমাণিক্য।                ক্ষুদ্র ছাগশিশু
দরিদ্র এ বালিকার স্নেহের পুত্তলি,
তারে নাকি কেড়ে আনিয়াছ মা’র কাছে
বলি দিতে? এ দান কি নেবেন জননী
প্রসন্ন দক্ষিণ হস্তে?
জয়সিংহ।                         কেমনে জানিব,
মহারাজ, কোথা হতে অনুচরগণ
আনে পশু দেবীর পূজার তরে।–হাঁ গা,
কেন তুমি কাঁদিতেছ? আপনি নিয়েছে
যারে বিশ্বমাতা, তার তরে ক্রন্দন কি
শোভা পায়?
অপর্ণা।               কে তোমার বিশ্বমাতা! মোর
শিশু চিনিবে না তারে। মা-হারা শাবক
জানে না সে আপন মায়েরে। আমি যদি
বেলা করে আসি, খায় না সে তৃণদল,
ডেকে ডেকে চায় পথপানে–কোলে করে
নিয়ে তারে, ভিক্ষা-অন্ন কয় জনে ভাগ
করে খাই। আমি তার মাতা।
জয়সিংহ।                               মহারাজ,
আপনার প্রাণ-অংশ দিয়ে, যদি তারে
বাঁচাইতে পারিতাম, দিতাম বাঁচায়ে।
মা তাহারে নিয়েছেন–আমি তারে আর
ফিরাব কেমনে?
অপর্ণা।                         মা তাহারে নিয়েছেন?
মিছে কথা! রাক্ষসী নিয়েছে তারে!
জয়সিংহ।                                         ছি ছি,
ও কথা এনো না মুখে।
অপর্ণা।                                   মা, তুমি নিয়েছ
কেড়ে দরিদ্রের ধন! রাজা যদি চুরি
করে, শুনিয়াছি নাকি, আছে জগতের
রাজা–তুমি যদি চুরি করো, কে তোমার
করিবে বিচার! মহারাজ, বলো তুমি–
গোবিন্দমাণিক্য।      বৎসে, আমি বাক্যহীন–এত ব্যথা কেন,
এত রক্ত কেন, কে বলিয়া দিবে মোরে?
অপর্ণা।    এই-যে সোপান বেয়ে রক্তচিহ্ন দেখি
এ কি তারি রক্ত? ওরে বাছনি আমার!
মরি মরি, মোরে ডেকে কেঁদেছিল কত,
চেয়েছিল চারি দিকে ব্যাকুল নয়নে,
কম্পিত কাতর বক্ষে, মোর প্রাণ কেন
যেথা ছিল সেথা হতে ছুটিয়া এল না?

প্রতিমার প্রতি

জয়সিংহ। আজন্ম পূজিনু তোরে, তবু তোর মায়া
বুঝিতে পারি নে। করুণায় কাঁদে প্রাণ
মানবের, দয়া নাই বিশ্বজননীর!

জয়সিংহের প্রতি

অপর্ণা। তুমি তো নিষ্ঠুর নহ–আঁখি-প্রান্তে তব
অশ্রু ঝরে মোর দুখে। তবে এস তুমি,
এ মন্দির ছেড়ে এস। তবে ক্ষম মোরে,
মিথ্যা আমি অপরাধী করেছি তোমায়।

প্রতিমার প্রতি

জয়সিংহ। তোমার মন্দিরে এ কী নূতন সংগীত
ধ্বনিয়া উঠিল আজি, হে গিরিনন্দিনী,
করুণাকাতর কণ্ঠস্বরে! ভক্তহৃদি
অপরূপ বেদনায় উঠিল ব্যাকুলি।
হে শোভনে, কোথা যাব এ মন্দির ছেড়ে?
কোথায় আশ্রয় আছে?

জনান্তিক হইতে

গোবিন্দমাণিক্য।                  যেথা আছে প্রেম।

[ প্রস্থান

জয়সিংহ।              কোথা আছে প্রেম!
       অয়ি ভদ্রে, এস তুমি
আমার কুটিরে। অতিথিরে দেবীরূপে
আজিকে করিব পূজা করিয়াছি পণ।

[ জয়সিংহ ও অপর্ণার প্রস্থান

দ্বিতীয় দৃশ্য

রাজসভা

রাজা রঘুপতি ও নক্ষত্ররায়ের প্রবেশ

সভাসদ্‌গণ উঠিয়া

সকলে। জয় হোক মহারাজ!
রঘুপতি।                        রাজার ভাণ্ডারে
এসেছি বলির পশু সংগ্রহ করিতে।
গোবিন্দমাণিক্য।         মন্দিরেতে জীববলি এ বৎসর হতে
হইল নিষেধ।
নয়নরায়।                                বলি নিষেধ!
মন্ত্রী।                                                 নিষেধ!
নক্ষত্ররায়।                তাই তো! বলি নিষেধ!
রঘুপতি।                                            এ কি স্বপ্নে শুনি?
গোবিন্দমাণিক্য।          স্বপ্ন নহে প্রভু! এতদিন স্বপ্নে ছিনু,
আজ জাগরণ। বালিকার মূর্তি ধ’রে
স্বয়ং জননী মোরে বলে গিয়েছেন,
জীবরক্ত সহে না তাঁহার।
রঘুপতি।                                               এতদিন
সহিল কী করে? সহস্র বৎসর ধ’রে
রক্ত করেছেন পান, আজি এ অরুচি!
গোবিন্দমাণিক্য।          করেন নি পান। মুখ ফিরাতেন দেবী
করিতে শোণিতপাত তোমরা যখন।
রঘুপতি।               মহারাজ, কী করিছ ভালো করে ভেবে
দেখো। শাস্ত্রবিধি তোমার অধীন নহে।
গোবিন্দমাণিক্য।          সকল শাস্ত্রের বড়ো দেবীর আদেশ।
রঘুপতি।               একে ভ্রান্তি, তাহে অহংকার! অজ্ঞ নর,
তুমি শুধু শুনিয়াছ দেবীর আদেশ,
আমি শুনি নাই?
নক্ষত্ররায়।                                   তাই তো, কী বলো মন্ত্রী,–
এ বড়ো আশ্চর্য! ঠাকুর শোনেন নাই?
গোবিন্দমাণিক্য।          দেবী-আজ্ঞা নিত্যকাল ধ্বনিছে জগতে।
সেই তো বধিরতম যেজন সে বাণী
শুনেও শুনে না।
রঘুপতি।                                  পাষণ্ড, নাস্তিক তুমি!
গোবিন্দমাণিক্য।          ঠাকুর, সময় নষ্ট হয়। যাও এবে
মন্দিরের কাজে। প্রচার করিয়া দিয়ো
পথে যেতে যেতে, আমার ত্রিপুররাজ্যে
যে করিবে জীবহত্যা জীবজননীর
পূজাচ্ছলে, তারে দিব নির্বাসন-দণ্ড।
রঘুপতি।              এই কি হইল স্থির?
গোবিন্দমাণিক্য।                                  স্থির এই।
উঠিয়া
রঘুপতি।                                                       তবে
উচ্ছন্ন! উচ্ছন্ন যাও!

ছুটিয়া আসিয়া

চাঁদপাল।              হাঁ হাঁ! থামো! থামো!
গোবিন্দমাণিক্য।         বোসো চাঁদপাল। ঠাকুর, বলিয়া যাও।
মনোব্যথা লঘু করে যাও নিজ কাজে।
রঘুপতি।              তুমি কি ভেবেছ মনে ত্রিপুর-ঈশ্বরী
ত্রিপুরার প্রজা? প্রচারিবে তাঁর ‘পরে
তোমার নিয়ম? হরণ করিবে তাঁর
বলি? হেন সাধ্য নাই তব। আমি আছি
মায়ের সেবক।

[ প্রস্থান

নয়নরায়।                                  ক্ষমা করো অধীনের
স্পর্ধা মহারাজ। কোন্‌ অধিকারে, প্রভু,
জননীর বলি–
চাঁদপাল।                               শান্ত হও সেনাপতি।
মন্ত্রী।                  মহারাজ, একেবারে করেছ কি স্থির?
                  আজ্ঞা আর ফিরিবে না?
গোবিন্দমাণিক্য।                                     আর নহে মন্ত্রী,
বিলম্ব উচিত নহে বিনাশ করিতে
পাপ।
মন্ত্রী।                 পাপের কি এত পরমায়ু হবে?
কত শত বর্ষ ধরে যে প্রাচীন প্রথা
দেবতাচরণতলে বৃদ্ধ হয়ে এল,
সে কি পাপ হতে পারে?

রাজার নিরুত্তরে চিন্তা

নক্ষত্ররায়।                                             তাই তো হে মন্ত্রী,
সে কি পাপ হতে পারে?
মন্ত্রী।                                              পিতামহগণ
এসেছে পালন করে যত্নে ভক্তিভরে
সনাতন রীতি। তাঁহাদের অপমান
তার অপমানে।

রাজার চিন্তা

নক্ষত্ররায়।                                 ভেবে দেখো মহারাজ,
যুগে যুগে যে পেয়েছে শতসহস্রের
ভক্তির সম্মতি, তাহারে করিতে নাশ
তোমার কী আছে অধিকার।

সনিশ্বাসে

গোবিন্দমাণিক্য।                                             থাক্‌ তর্ক!
যাও মন্ত্রী, আদেশ প্রচার করো গিয়ে–
আজ হতে বন্ধ বলিদান।

[ প্রস্থান

মন্ত্রী।                  একি হল!
নক্ষত্ররায়।               তাই তো হে মন্ত্রী, এ কী হল! শুনেছিনু
মগের মন্দিরে বলি নেই, অবশেষে
মগেতে হিন্দুতে ভেদ রহিল না কিছু।
কী বল হে চাঁদপাল, তুমি কেন চুপ?
চাঁদপাল।              ভীরু আমি ক্ষুদ্র প্রাণী, বুদ্ধি কিছু কম,
না বুঝে পালন করি রাজার আদেশ।

তৃতীয় দৃশ্য

মন্দির

জয়সিংহ

জয়সিংহ।              মা গো, শুধু তুই আর আমি! এ মন্দিরে
সারাদিন আর কেহ নাই–সারা দীর্ঘ
দিন! মাঝে মাঝে কে আমারে ডাকে যেন।
তোর কাছে থেকে তবু একা মনে হয়!

নেপথ্যে গান

আমি          একলা চলেছি এ ভবে,
আমায়       পথের সন্ধান কে কবে?
জয়সিংহ।              মা গো, এ কী মায়া! দেবতারে প্রাণ দেয়
মানবের প্রাণ! এইমাত্র ছিলে তুমি
নির্বাক্‌ নিশ্চল–উঠিলে জীবন্ত হয়ে
সন্তানের কণ্ঠস্বরে সজাগ জননী!
গান গাহিতে গাহিতে অপর্ণার প্রবেশ
আমি          একলা চলেছি এ ভবে,
আমায়       পথের সন্ধান কে কবে?
ভয় নেই, ভয় নেই,          যাও আপন মনেই
যেমন          একলা মধুপ ধেয়ে যায়
কেবল  ফুলের সৌরভে।
জয়সিংহ।              কেবলি একেলা! দক্ষিণ বাতাস যদি
বন্ধ হয়ে যায়, ফুলের সৌরভ যদি
নাহি আসে, দশ দিক জেগে ওঠে যদি
দশটি সন্দেহ-সম, তখন কোথায়
সুখ, কোথা পথ? জান কি একেলা কারে
বলে?
অপর্ণা।                       জানি। যবে বসে আছি ভরা মনে–
দিতে চাই, নিতে কেহ নাই!
জয়সিংহ।                                                সৃজনের
আগে দেবতা যেমন একা! তাই বটে!
তাই বটে! মনে হয় এ জীবন বড়ো
বেশি আছে–যত বড়ো তত শূন্য, তত
আবশ্যকহীন।
অপর্ণা।                                জয়সিংহ, তুমি বুঝি
একা! তাই দেখিয়াছি, কাঙাল যে জন

তাহারো কাঙাল তুমি। যে তোমার সব
নিতে পারে, তারে তুমি খুঁজিতেছ যেন।
ভ্রমিতেছ দীনদুঃখী সকলের দ্বারে।
এতদিন ভিক্ষা মেগে ফিরিতেছি–কত
লোক দেখি, কত মুখপানে চাই, লোকে
ভাবে শুধু বুঝি ভিক্ষাতরে–দূর হতে
দেয় তাই মুষ্টিভিক্ষা ক্ষুদ্র দয়াভরে।
এত দয়া পাই নে কোথাও–যাহা পেয়ে
আপনার দৈন্য আর মনে নাহি পড়ে।

জয়সিংহ।              যথার্থ যে দাতা, আপনি নামিয়া আসে
দানরূপে দরিদ্রের পানে, ভূমিতলে।
যেমন আকাশ হতে বৃষ্টিরূপে মেঘ
নেমে আসে মরুভূমে–দেবী নেমে আসে
মানবী হইয়া, যারে ভালোবাসি তার
মুখে। দরিদ্র ও দাতা, দেবতা মানব
সমান হইয়া যায়।–
                        ওই আসিছেন
মোর গুরুদেব।
অপর্ণা।                                 আমি তবে সরে যাই
অন্তরালে। ব্রাহ্মণেরে বড়ো ভয় করি।
কী কঠিন তীব্র দৃষ্টি! কঠিন ললাট
পাষাণসোপান যেন দেবীমন্দিরের।

[ প্রস্থান

জয়সিংহ।              কঠিন? কঠিন বটে। বিধাতার মতো।
                 কঠিনতা নিখিলের অটল নির্ভর।

রঘুপতির প্রবেশ

পা ধুইবার জল প্রভৃতি অগ্রসর করিয়া

জয়সিংহ।              গুরুদেব!
রঘুপতি।                         যাও, যাও!
জয়সিংহ।                                       আনিয়াছি জল।
রঘুপতি।               থাক্‌, রেখে দাও জল।
জয়সিংহ।                                         বসন।
রঘুপতি।                                               কে চাহে
বসন!
জয়সিংহ।                     অপরাধ করেছি কি?
রঘুপতি।                                             আবার!
কে নিয়েছে অপরাধ তব?–
                               ঘোর কলি
এসেছে ঘনায়ে। বাহুবল রাহুসম
ব্রহ্মতেজ গ্রাসিবারে চায়–সিংহাসন
তোলে শির যজ্ঞবেদী-‘পরে। হায় হায়,
কলির দেবতা, তোমরাও চাটুকর
সভাসদ্‌সম, নতশিরে রাজ-আজ্ঞা
বহিতেছ? চতুর্ভুজা, চারি হস্ত আছ
জোড় করি! বৈকুণ্ঠ কি আবার নিয়েছে
কেড়ে দৈত্যগণ? গিয়েছে দেবতা যত
রসাতলে? শুধু, দানবে মানবে মিলে
বিশ্বের রাজত্ব দর্পে করিতেছে ভোগ?
দেবতা না যদি থাকে, ব্রাহ্মণ রয়েছে।
ব্রাহ্মণের রোষযজ্ঞে দণ্ড সিংহাসন
হবিকাষ্ঠ হবে।
জয়সিংহের নিকট গিয়া সস্নেহে
                   বৎস, আজ করিয়াছি
রুক্ষ আচরণ তোমা-‘পরে, চিত্ত বড়ো
ক্ষুব্ধ মোর।
জয়সিংহ।                           কী হয়েছে প্রভু!
রঘুপতি।                                               কী হয়েছে!
শুধাও অপমানিত ত্রিপুরেশ্বরীরে।
এই মুখে কেমনে বলিব কী হয়েছে!
জয়সিংহ।              কে করেছে অপমান?
রঘুপতি।                                       গোবিন্দমাণিক্য।
জয়সিংহ।              গোবিন্দমাণিক্য! প্রভু, কারে অপমান?
রঘুপতি।              কারে! তুমি, আমি, সর্বশাস্ত্র, সর্বদেশ,
সর্বকাল, সর্বদেশকাল-অধিষ্ঠাত্রী        
মহাকালী, সকলেরে করে অপমান
ক্ষুদ্র সিংহাসনে বসি। মা’র পূজা-বলি
নিষেধিল স্পর্ধাভরে।
জয়সিংহ।                                        গোবিন্দমাণিক্য!
রঘুপতি।              হাঁ গো, হাঁ, তোমার রাজা গোবিন্দমাণিক্য!
তোমার সকল-শ্রেষ্ঠ–তোমার প্রাণের
অধীশ্বর! অকৃতজ্ঞ! পালন করিনু
এত যত্নে স্নেহে তোরে শিশুকাল হতে
আমা-চেয়ে প্রিয়তর আজ তোর কাছে
গোবিন্দমাণিক্য?
জয়সিংহ।                                 প্রভু, পিতৃকোলে বসি
আকাশে বাড়ায় হাত ক্ষুদ্র মুগ্ধ শিশু
পূর্ণচন্দ্র-পানে–দেব, তুমি পিতা মোর,
পূর্ণশশী মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য।
কিন্তু এ কী বকিতেছি! কী কথা শুনিনু!
মায়ের পূজার বলি নিষেধ করেছে
রাজা? এ আদেশ কে মানিবে?
রঘুপতি।                                                  না মানিলে
নির্বাসন।
জয়সিংহ।                          মাতৃপূজাহীন রাজ্য হতে    
নির্বাসন দণ্ড নহে। এ প্রাণ থাকিতে
অসম্পূর্ণ নাহি রবে জননীর পূজা।

চতুর্থ দৃশ্য

অন্তঃপুর

গুণবতী ও পরিচারিকা

গুণবতী।               কী বলিস? মন্দিরের দুয়ার হইতে
রানীর পূজার বলি ফিরায়ে দিয়াছে?
এক দেহে কত মুণ্ড আছে তার? কে সে
দুরদৃষ্ট?      
পরিচারিকা।                         বলিতে সাহস নাহি মানি–
গুণবতী।               বলিতে সাহস নাহি? এ কথা বলিলি
                 কী সাহসে? আমা-চেয়ে কারে তোর ভয়?
পরিচারিকা।               ক্ষমা করো।
গুণবতী।                             কাল সন্ধেবেলা ছিনু রানী;
কাল সন্ধেবেলা বন্দীগণ করে গেছে
স্তব, বিপ্রগণ করে গেছে আশীর্বাদ,
ভৃত্যগণ করজোড়ে আজ্ঞা লয়ে গেছে–
একরাত্রে উলটিল সকল নিয়ম?
দেবী পাইল না পূজা, রানীর মহিমা
অবনত? ত্রিপুরা কি স্বপ্নরাজ্য ছিল?
ত্বরা করে ডেকে আন্‌ ব্রাহ্মণ-ঠাকুরে।

[ পরিচারিকার প্রস্থান

গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ

গুণবতী।               মহারাজ, শুনিতেছ? মার দ্বার হতে
                 আমার পূজার বলি ফিরায়ে দিয়েছে।
গোবিন্দমাণিক্য।         জানি তাহা।
গুণবতী।                              জান তুমি? নিষেধ কর নি
তবু? জ্ঞাতসারে মহিষীর অপমান?
গোবিন্দমাণিক্য।         তারে ক্ষমা করো প্রিয়ে!
গুণবতী।                                            দয়ার শরীর
তব, কিন্তু মহারাজ, এ তো দয়া নয়–
এ শুধু কাপুরুষতা! দয়ায় দুর্বল
তুমি, নিজ হাতে দণ্ড দিতে নাহি পারো
যদি, আমি দণ্ড দিব। বলো মোরে কে সে
অপরাধী।
গোবিন্দমাণিক্য।                     দেবী, আমি। অপরাধ আর
কিছু নহে, তোমারে দিয়েছি ব্যথা এই
অপরাধ।
গুণবতী।                         কী বলিছ মহারাজ!
গোবিন্দমাণিক্য।                                          আজ
হতে, দেবতার নামে জীবরক্তপাত
আমার ত্রিপুররাজ্যে হয়েছে নিষেধ।
গুণবতী।               কাহার নিষেধ?
গোবিন্দমাণিক্য।                           জননীর।
গুণবতী।                                           কে শুনেছে?
গোবিন্দমাণিক্য।         আমি।
গুণবতী।                      তুমি? মহারাজ, শুনে হাসি আসে।
রাজদ্বারে এসেছেন ভুবন-ঈশ্বরী
জানাইতে আবেদন!
গোবিন্দমাণিক্য।                                হেসো না মহিষী!
জননী আপনি এসে সন্তানের প্রাণে
বেদনা জানায়েছেন, আবেদন নহে।
গুণবতী।               কথা রেখে দাও মহারাজ! মন্দিরের
বাহিরে তোমার রাজ্য। যেথা তব আজ্ঞা
নাহি চলে, সেথা আজ্ঞা নাহি দিয়ো।
গোবিন্দমাণিক্য।                                                   মা’র
আজ্ঞা, মোর আজ্ঞা নহে।
গুণবতী।                                            কেমনে জানিলে?
গোবিন্দমাণিক্য।         ক্ষীণ দীপালোকে গৃহকোণে থেকে যায়
অন্ধকার; সব পারে, আপনার ছায়া
কিছুতে ঘুচাতে নারে দীপ। মানবের
বুদ্ধি দীপসম, যত আলো করে দান
তত রেখে দেয় সংশয়ের ছায়া। স্বর্গ
হতে নামে যবে জ্ঞান, নিমেষে সংশয়
টুটে। আমার হৃদয়ে সংশয় কিছুই
নাই।
গুণবতী।                     শুনিয়াছি, আপনার পাপপুণ্য
আপনার কাছে। তুমি থাকো আপনার
অসংশয় নিয়ে–আমারে দুয়ার ছাড়ো,
আমার পূজার বলি আমি নিয়ে যাই
আমার মায়ের কাছে।
গোবিন্দমাণিক্য।                                  দেবী, জননীর
আজ্ঞা পারি না লঙ্ঘিতে।
গুণবতী।                                            আমিও পারি না।
মা’র কাছে আছি প্রতিশ্রুত। সেইমত
যথাশাস্ত্র যথাবিধি পূজিব তাঁহারে।
যাও, তুমি যাও!
গোবিন্দমাণিক্য।                             যে আদেশ মহারানী!

[ প্রস্থান

রঘুপতির প্রবেশ

গুণবতী।               ঠাকুর, আমার পূজা ফিরায়ে দিয়েছে
মাতৃদ্বার হতে!
রঘুপতি।                                 মহারানী, মা’র পূজা
ফিরে গেছে, নহে সে তোমার। উঞ্ছবৃত্ত
দরিদ্রের ভিক্ষালব্ধ পূজা, রাজেন্দ্রাণী,
তোমার পূজার চেয়ে ন্যূন নহে। কিন্তু,
এই বড়ো সর্বনাশ, মা’র পূজা ফিরে
গেছে। এই বড়ো সর্বনাশ, রাজদর্প
ক্রমে স্ফীত হয়ে, করিতেছে অতিক্রম
পৃথিবীর রাজত্বের সীমা–বসিয়াছে
দেবতার দ্বার রোধ করি, জননীর
ভক্তদের প্রতি দুই আঁখি রাঙাইয়া।
গুণবতী।              কী হবে ঠাকুর!
রঘুপতি।                                 জানেন তো মহামায়া।
এই শুধু জানি –যে সিংহাসনের ছায়া
পড়েছে মায়ের দ্বারে, ফুৎকারে ফাটিবে
সেই দম্ভমঞ্চখানি জলবিম্বসম।
যুগে যুগে রাজপিতাপিতামহ মিলে
ঊর্ধ্ব-পানে তুলিয়াছে যে রাজমহিমা
অভ্রভেদী ক’রে, মুহূর্তে হইয়া যাবে
ধূলিসাৎ, বজ্রদীর্ণ, দগ্ধ, ঝঞ্ঝাহত।
গুণবতী।               রক্ষা করো, রক্ষা করো প্রভু!
রঘুপতি।              হা হা! আমি
রক্ষা করিব তোমারে! যে প্রবল রাজা
স্বর্গে মর্তে প্রচারিছে আপন শাসন
তুমি তাঁরি রানী! দেব-ব্রাহ্মণের যিনি–
ধিক্‌, ধিক্‌ শতবার! ধিক্‌ লক্ষবার!
কলির ব্রাহ্মণে ধিক্‌। ব্রহ্মশাপ কোথা!
ব্যর্থ ব্রহ্মতেজ শুধু বক্ষে আপনার
আহত বৃশ্চিক-সম আপনি দংশিছে!
                 মিথ্যা ব্রহ্ম-আড়ম্বর!

পৈতা ছিঁড়িতে উদ্যত

গুণবতী।                                         কী কর! কী কর
দেব! রাখো, রাখো, দয়া করো নির্দোষীরে!
রঘুপতি।              ফিরায়ে দে ব্রাহ্মণের অধিকার।
গুণবতী।                                                   দিব।
যাও প্রভু, পূজা করো মন্দিরেতে গিয়ে,
হবে নাকো পূজার ব্যাঘাত।
রঘুপতি।                                               যে আদেশ
রাজ-অধীশ্বরী! দেবতা কৃতার্থ হল
তোমারি আদেশ বলে, ফিরে পেল পুন
ব্রাহ্মণ আপন তেজ! ধন্য তোমরাই,
যতদিন নাহি জাগে কল্কি-অবতার!

[ প্রস্থান

গোবিন্দমাণিক্যের পুনঃপ্রবেশ

গোবিন্দমাণিক্য।         অপ্রসন্ন প্রেয়সীর মুখ, বিশ্বমাঝে
সব আলো সব সুখ লুপ্ত করে রাখে।
উন্মনা-উৎসুক-চিত্তে ফিরে ফিরে আসি।
গুণবতী।              যাও, যাও। এস না এ গৃহে। অভিশাপ
আনিয়ো না হেথা।
গোবিন্দমাণিক্য।                              প্রিয়তমে, প্রেমে করে
অভিশাপ নাশ, দয়া করে অকল্যাণ
দূর। সতীর হৃদয় হতে প্রেম গেলে
পতিগৃহে লাগে অভিশাপ।–যাই তবে
দেবী!
গুণবতী।                      যাও! ফিরে আর দেখায়ো না মুখ।
গোবিন্দমাণিক্য।         স্মরণ করিবে যবে, আবার আসিব।  

[ প্রস্থানোন্মুখ

পায়ে পড়িয়া

গুণবতী।              ক্ষমা করো, ক্ষমা করো নাথ! এতই কি
হয়েছ নিষ্ঠুর, রমণীর অভিমান
ঠেলে চলে যাবে? জান না কি প্রিয়তম,
ব্যর্থ প্রেম দেখা দেয় রোষের ধরিয়া
ছদ্মবেশ? ভালো, আপনার অভিমানে
আপনি করিনু অপমান ক্ষমা করো!
গোবিন্দমাণিক্য।         প্রিয়তমে, তোমা-‘পরে টুটিলে বিশ্বাস
সেই দণ্ডে টুটিত জীবনবন্ধ। জানি
প্রিয়ে, মেঘ ক্ষণিকের, চিরদিবসের
সূর্য।
গুণবতী।                     মেঘ ক্ষণিকের এ মেঘ কাটিয়া
যাবে, বিধির উদ্যত বজ্র ফিরে যাবে,
চিরদিবসের সূর্য উঠিবে আবার
চিরদিবসের প্রথা জাগায়ে জগতে,
অভয় পাইবে সর্বলোক–ভুলে যাবে
দু দণ্ডের দুঃস্বপন। সেই আজ্ঞা করো।
ব্রাহ্মণ ফিরিয়া পাক নিজ অধিকার,
দেবী নিজ পূজা, রাজদণ্ড ফিরে যাক
নিজ অপ্রমত্ত মর্ত-অধিকার-মাঝে।
গোবিন্দমাণিক্য।         ধর্মহানি ব্রাহ্মণের নহে অধিকার।
অসহায় জীবরক্ত নহে জননীর
পূজা। দেবতার আজ্ঞা পালন করিতে
রাজা বিপ্র সকলেরই আছে অধিকার।
গুণবতী।               ভিক্ষা, ভিক্ষা চাই! একান্ত মিনতি করি
চরণে তোমার প্রভু! চিরাগত প্রথা
চিরপ্রবাহিত মুক্ত সমীরণ-সম,
নহে তা রাজার ধন–তাও জোড়করে
সমস্ত প্রজার নামে ভিক্ষা মাগিতেছে
মহিষী তোমার। প্রেমের দোহাই মানো
প্রিয়তম! বিধাতাও করিবেন ক্ষমা
প্রেম-আকর্ষণ-বশে কর্তব্যের ত্রুটি।
গোবিন্দমাণিক্য।          এই কি উচিত মহারানী? নীচ স্বার্থ,
নিষ্ঠুর ক্ষমতাদর্প, অন্ধ অজ্ঞানতা,
চির রক্তপানে স্ফীত হিংস্র বৃদ্ধ প্রথা–
সহস্র শত্রুর সাথে একা যুদ্ধ করি;
শ্রান্তদেহে আসি গৃহে নারীচিত্ত হতে
অমৃত করিতে পান; সেথাও কি নাই
দয়াসুধা? গৃহমাঝে পুণ্যপ্রেম বহে,
তারো সাথে মিশিয়াছে রক্তধারা? এত
রক্তস্রোত কোন্‌ দৈত্য দিয়েছে খুলিয়া–
ভক্তিতে প্রেমেতে রক্ত মাখামাখি হয়,
ক্রূর হিংসা দয়াময়ী রমণীর প্রাণে
দিয়ে যায় শোণিতের ছাপ! এ শোণিতে
তবু করিব না রোধ?

মুখ ঢাকিয়া

গুণবতী।                                        যাও, যাও তুমি!
গোবিন্দমাণিক্য।          হায় মহারানী, কর্তব্য কঠিন হয়
তোমরা ফিরালে মুখ।

[ প্রস্থান

কাঁদিয়া উঠিয়া

গুণবতী।                                           ওরে অভাগিনী,
এতদিন এ কী ভ্রান্তি পুষেছিলি মনে!
ছিল না সংশয়মাত্র, ব্যর্থ হবে আজ
এত অনুরোধ, এত অনুনয়, এত
অভিমান। ধিক্‌, কী সোহাগে পুত্রহীনা
পতিরে জানায় অভিমান! ছাই হোক
অভিমান তোর! ছাই এ কপাল! চাই
মহিষীগরব! আর নহে প্রেমখেলা,
সোহাগক্রন্দন। বুঝিয়াছি আপনার
স্থান–হয় ধূলিতলে নতশির, নয়
ঊর্ধ্বফণা ভুজঙ্গিনী আপনার তেজে।

পঞ্চম দৃশ্য

মন্দির

একদল লোকের প্রবেশ

নেপাল।

কোথায় হে, তোমাদের তিন-শো পাঁঠা, এক-শো-এক মোষ। একটা টিকটিকির ছেঁড়া নেজটুকু পর্যন্ত দেখবার জো নেই। বাজনাবাদ্যি গেল কোথায়, সব যে হাঁ-হাঁ করছে। খরচপত্র করে পুজো দেখতে এলুম, আচ্ছা শাস্তি হয়েছে!

গণেশ।

দেখ্‌, মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে অমন করে বলিস নে। মা পাঁঠা পায় নি, এবার জেগে উঠে তোদের এক-একটাকে ধরে ধরে মুখে পুরবে।

হারু।

কেন! গেল বছরে বাছারা সব ছিলে কোথায়? আর, সেই ও-বছর, যখন ব্রত সাঙ্গ করে রানীমা পুজো দিয়েছিল, তখন কি তোদের পায়ে কাঁটা ফুটেছিল? তখন একবার দেখে যেতে পার নি? রক্তে যে গোমতী রাঙা হয়ে গিয়েছিল। আর অলুক্ষুনে বেটারা এসেছিস, আর মায়ের খোরাক পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। তোদের এক-একটাকে ধরে মা’র কাছে নিবেদন করে দিলে মনের খেদ মেটে।

কানু।

আর ভাই, মিছে রাগ করিস। আমাদের কি আর বলবার মুখ আছে! তা হলে কি আর দাঁড়িয়ে ওর কথা শুনি!

হারু।

তা যা বলিস ভাই, অপ্পেতেই আমার রাগ হয় সে কথা সত্যি। সেদিন ও ব্যক্তি শালা পর্যন্ত উঠেছিল, তার বেশি যদি একটা কথা বলত, কিম্বা আমার গায়ে হাত দিত, মাইরি বলছি, তা হলে আমি–

নেপাল।

তা, চল্‌-না দেখি, কার হাড়ে কত শক্তি আছে।

হারু।

তা, আয়-না, জানিস? এখানকার দফাদার আমার মামাতো ভাই হয়!

নেপাল।

তা, নিয়ে আয় তোর মামাকে সুদ্ধ নিয়ে আয়, তোর দফাদারের দফা নিকেশ করে দিই।

হারু।

তোমরা সকলেই শুনলে!

গণেশ ও কানু।

আর দূর কর্‌ ভাই, ঘরে চল্‌। আজ আর কিছুতে গা লাগছে না। এখন তোদের তামাশা তুলে রাখ্‌।

হারু।

এ কি তামাশা হল? আমার মামাকে নিয়ে তামাশা! আমাদের দফাদারের আপনার বাবাকে নিয়ে–

গণেশ ও কানু।

আর রেখে দে! তোর আপনার বাবা নিয়ে তুই আপনি মর্‌।

[ সকলের প্রস্থান

রঘুপতি নয়নরায় ও জয়সিংহের প্রবেশ

রঘুপতি।              মা’র ‘পরে ভক্তি নাই তব?
নয়নরায়।                                                 হেন কথা
                 কার সাধ্য বলে? ভক্তবংশে জন্ম মোর।
রঘুপতি।              সাধু, সাধু! তবে তুমি মায়ের সেবক,
                 আমাদেরই লোক।
নয়নরায়।                                      প্রভু, মাতৃভক্ত যাঁরা
                 আমি তাঁহাদেরই দাস।
রঘুপতি।                                        সাধু! ভক্তি তব
হউক অক্ষয়। ভক্তি তব বাহুমাঝে
করুক সঞ্চার অতি দুর্জয় শকতি।
ভক্তি তব তরবারি করুক শাণিত,
বজ্রসম দিক তাহে তেজ। ভক্তি তব
হৃদয়েতে করুক বসতি, পদমান
সকলের উচ্চে।
নয়নরায়।                                  ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ
ব্যর্থ হইবে না।
রঘুপতি।                                শুন তবে সেনাপতি,
তোমার সকল বল করো একত্রিত
মা’র কাজে। নাশ করো মাতৃবিদ্রোহীরে।
নয়নরায়।                যে আদেশ প্রভু! কে আছে মায়ের শত্রু?
রঘুপতি।              গোবিন্দমাণিক্য।
নয়নরায়।                                  আমাদের মহারাজ!
রঘুপতি।              লয়ে তব সৈন্যদল, অক্রমণ করো
তারে।
নয়নরায়।                         ধিক্‌ পাপ-পরামর্শ! প্রভু, এ কি
পরীক্ষা আমারে?
রঘুপতি।                                   পরীক্ষাই বটে। কার
ভৃত্য তুমি। এবার পরীক্ষা হবে তার।
ছাড়ো চিন্তা, ছাড়ো দ্বিধা, কাল নাহি আর–
ত্রিপুরেশ্বরীর আজ্ঞা হতেছে ধ্বনিত
প্রলয়ের শৃঙ্গসম–ছিন্ন হয়ে গেছে
আজি সকল বন্ধন।
নয়নরায়।                                      নাই চিন্তা, নাই
কোনো দ্বিধা। যে পদে রেখেছে দেবী, আমি
তাহে রয়েছি অটল।
রঘুপতি।                                      সাধু!
নয়নরায়।                                               এত আমি
নরাধম জননীর সেবকের মাঝে
মোর ‘পরে হেন আজ্ঞা! আমি হব
বিশ্বাসঘাতক! আপনি দাঁড়ায়ে আছে
বিশ্বমাতা হৃদয়ের বিশ্বাসের ‘পরে,
সেই তাঁর অটল আসন–আপনি তা
ভাঙিতে বলিবে দেবী আপনার মুখে?
তাহা হলে আজ যাবে রাজা, কাল দেবী–
মনুষ্যত্ব ভেঙে পড়ে যাবে জীর্ণভিত্তি
অট্টালিকা-সম।
জয়সিংহ।                                ধন্য, সেনাপতি ধন্য!
রঘুপতি।              ধন্য বটে তুমি। কিন্তু এ কী ভ্রান্তি তব!
যে রাজা বিশ্বাসঘাতী জননীর কাছে,
তার সাথে বিশ্বাসের বন্ধন কোথায়?      
নয়নরায়।                কী হইবে মিছে তর্কে? বুদ্ধির বিপাকে
চাহি না পড়িতে। আমি জানি এক পথ
আছে–সেই পথ বিশ্বাসের পথ। সেই
সিধে পথ বেয়ে চিরদিন চলে যাবে
অবোধ অধম ভৃত্য এ নয়নরায়।

[ প্রস্থান

জয়সিংহ।               চিন্তা কেন দেব? এমনি বিশ্বাসবলে
মোরাও করিব কাজ। কারে ভয় প্রভু!
সৈন্যবলে কোন্‌ কাজ! অস্ত্র কোন্‌ ছার!
যার ‘পরে রয়েছে যে ভার, বল তার
আছে সে কাজের। করিবই মা’র পূজা
যদি সত্য মায়ের সেবক হই মোরা।
চলো প্রভু, বাজাই মায়ের ডঙ্কা, ডেকে
আনি পুরবাসীগণে, মন্দিরের দ্বার
খুলে দিই!–ওরে, আয় তোরা, আয়, আয়,
অভয়ার পূজা হবে–নির্ভয়ে আয় রে
তোরা মায়ের সন্তান! আয় পুরবাসী!

[ জয়সিংহ ও রঘুপতির প্রস্থান

পুরবাসীগণের প্রবেশ

অক্রূর।       ওরে, আয় রে আয়!
সকলে।      জয় মা!
হারু।     আয় রে, মায়ের সামনে বাহু তুলে নৃত্য করি।

গান

উলঙ্গিনী          নাচে রণরঙ্গে।
আমরা       নৃত্য করি সঙ্গে।
দশ দিক       আঁধার ক’রে মাতিল দিক্‌বসনা,
জ্বলে          বহ্নিশিখা রাঙা-রসনা,
দেখে          মরিবারে ধাইছে পতঙ্গে।
কালো কেশ          উড়িল আকাশে,
রবি সোম          লুকালো তরাসে।
রাঙা          রক্তধারা ঝরে কালো অঙ্গে,
ত্রিভুবন কাঁপে ভুরুভঙ্গে।
সকলে।

জয় মা!

গণেশ।

আর ভয় নেই!

কানু।

ওরে, সেই দক্ষিণদ’র মানুষগুলো এখন গেল কোথায়?

গণেশ।

মায়ের ঐশ্বর্য বেটাদের সইল না। তারা ভেগেছে।

হারু।

কেবল মায়ের ঐশ্বর্য নয়, আমি তাদের এমনি শাসিয়ে দিয়েছি, তারা আর এমুখো হবে না। বুঝলে অক্রূরদা, আমার মামাতো ভাই দফাদারের নাম করবা-মাত্র তাদের মুখ চুন হয়ে গেল।

অক্রূর।

আমাদের নিতাই সেদিন তাদের খুব কড়া দুটো কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। ওই যার সেই ছুঁচ-পারা মুখ সেই বেটা তেড়ে উত্তর দিতে এসেছিল; আমাদের নিতাই বললে, “ওরে, তোরা দক্ষিণদেশে থাকিস, তোরা উত্তরের কী জানিস? উত্তর দিতে এসেছিস, উত্তরের জানিস কী?” শুনে আমরা হেসে কে কার গায়ে পড়ি।

গণেশ।

ইদিকে ঐ ভালোমানুষটি, কিন্তু নিতাইয়ের সঙ্গে কথায় আঁটবার জো নেই।

হারু।

নিতাই আমার পিসে হয়।

কানু।

শোনো একবার কথা শোনো। নিতাই আবার তোর পিসে হল কবে?

হারু।

তোমরা আমার সকল কথাই ধরতে আরম্ভ করেছ। আচ্ছা, পিসে নয় তো পিসে নয়। তাতে তোমার সুখটা কী হল? আমার হল না বলে কি তোমারই পিসে হল?

রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রবেশ

রঘুপতি।

শুনলুম সৈন্য আসছে। জয়সিংহ অস্ত্র নিয়ে তুমি এইখানে দাঁড়াও। তোরা আয়, তোরা এইখানে দাঁড়া! মন্দিরের দ্বার আগলাতে হবে। আমি তোদের অস্ত্র এনে দিচ্ছি।

গণেশ।

অস্ত্র কেন ঠাকুর?

রঘুপতি।

মায়ের পুজো বন্ধ করবার জন্য রাজার সৈন্য আসছে।

হারু।

সৈন্য আসছে! প্রভু, তবে আমরা প্রণাম হই।

কানু।

আমরা ক’জনা, সৈন্য এলে কী করতে পারব?

হারু।

করতে সবই পারি–কিন্তু সৈন্য এলে এখেনে জায়গা হবে কোথায়? লড়াই তো পরের কথা, এখানে দাঁড়াব কোন্‌খানে?

অক্রূর।

তোর কথা রেখে দে। দেখছিস নে প্রভু রাগে কাঁপছেন? তা ঠাকুর, অনুমতি করেন তো আমাদের দলবল সমস্ত ডেকে নিয়ে আসি।

হারু।

সেই ভালো। অমনি আমার মামাতো ভাইকে ডেকে আনি। কিন্তু, আর একটুও বিলম্ব করা উচিত নয়।

[ সকলের প্রস্থানোদ্যম

সরোষে

রঘুপতি।

দাঁড়া তোরা!

করজোড়ে

জয়সিংহ।               যেতে দাও প্রভু–প্রাণভয়ে ভীত এরা
বুদ্ধিহীন, আগে হতে রয়েছে মরিয়া।
আমি আছি মায়ের সৈনিক। এক দেহে
সহস্র সৈন্যের বল। অস্ত্র থাক্‌ পড়ে।
ভীরুদের যেতে দাও।

স্বগত

রঘুপতি।                                        সে-কাল গিয়েছে।
                  অস্ত্র চাই, অস্ত্র চাই–শুধু ভক্তি নয়।

প্রকাশ্যে

জয়সিংহ।               সৈন্য নহে প্রভু, আসিছে রানীর পূজা।

রানীর অনুচর ও পুরবাসীগণের প্রবেশ

সকলে।      ওরে, ভয় নেই–সৈন্য কোথায়? মা’র পূজা আসছে।
হারু।     আমরা আছি খবর পেয়েছে, সৈন্যেরা শীঘ্র এ দিকে আসছে না।
কানু।      ঠাকুর, রানীমা, পুজো পাঠিয়েছেন।
রঘুপতি।       জয়সিংহ, শীঘ্র পূজার আয়োজন করো।

[ জয়সিংহের প্রস্থান

গোবিন্দমাণিক্য।         চলে যাও হেথা হতে–নিয়ে যাও বলি।
রঘুপতি, শোন নাই আদেশ আমার?
রঘুপতি।              শুনি নাই।
গোবিন্দমাণিক্য।                       তবে তুমি এ রাজ্যের নহ।
রঘুপতি।              নহি আমি। আমি আছি যেথা, সেথা এলে
রাজদণ্ড খসে যায় রাজহস্ত হতে,
মুকুট ধুলায় পড়ে লুটে। কে আছিস,
আন্‌ মার পূজা।

বাদ্যোদ্যম

গোবিন্দমাণিক্য।                               চুপ কর্‌!

অনুচরের প্রতি

                                                     কোথা আছে
সেনাপতি, ডেকে আন্‌! হায় রঘুপতি,
অবশেষে সৈন্য দিয়ে ঘিরিতে হইল
ধর্ম! লজ্জা হয় ডাকিতে সৈনিকদল,
বাহুবল দুর্বলতা করায় স্মরণ।

রঘুপতি।              অবিশ্বাসী, সত্যই কি হয়েছে ধারণা
কলিযুগে ব্রহ্মতেজ গেছে–তাই এত
দুঃসাহস? যায় নাই। যে দীপ্ত অনল
জ্বলিছে অন্তরে, সে তোমার সিংহাসনে
নিশ্চয় লাগিবে। নতুবা এ মনানলে
ছাই করে পুড়াইব সব শাস্ত্র, সব
ব্রহ্মগর্ব, সমস্ত তেত্রিশ কোটি মিথ্যা।
আজ নহে মহারাজ, রাজ-অধিরাজ,
এই দিন মনে কোরো আর-এক দিন।

নয়নরায় ও চাঁদপালের প্রবেশ

নয়নের প্রতি

গোবিন্দমাণিক্য।         সৈন্য হয়ে থাকো হেথা নিষেধ করিতে
                 জীববলি।
নয়নরায়।                           ক্ষমা করো অধম কিংকরে।
অক্ষম রাজার ভৃত্য দেবতামন্দিরে।
যতদূর যেতে পারে রাজার প্রতাপ
মোরা ছায়া সঙ্গে যাই।
চাঁদপাল।                                        থামো সেনাপতি,
দীপশিখা থাকে এক ঠাঁই, দীপালোক
যায় বহুদূরে। রাজ-ইচ্ছা যেথা যাবে
সেথা যাব মোরা।
গোবিন্দমাণিক্য।                             সেনাপতি, মোর আজ্ঞা
তোমার বিচারাধীন নহে। ধর্মাধর্ম
লাভক্ষতি রহিল আমার, কার্য শুধু
তব হাতে।
নয়নরায়।                             এ কথা হৃদয় নাহি মানে।
মহারাজ, ভৃত্য বটে, তবুও মানুষ
আমি। আছে বুদ্ধি, আছে ধর্ম, আছ প্রভু,
আছেন দেবতা।
গোবিন্দমাণিক্য।                            তবে ফেলো অস্ত্র তব।
চাঁদপাল, তুমি হলে সেনাপতি, দুই
পদ রহিল তোমার। সাবধানে সৈন্য
লয়ে মন্দির করিব রক্ষা।
চাঁদপাল।                                          যে আদেশ
মহারাজ!
গোবিন্দমাণিক্য।                     নয়ন, তোমার অস্ত্র দাও
                 চাঁদপালে।
নয়নরায়।                            চাঁদপালে? কেন মহারাজ!
এ অস্ত্র তোমার পূর্ব রাজপিতামহ
দিয়েছেন আমাদের পিতামহে। ফিরে
নিতে চাও যদি, তুমি লও। স্বর্গে আছ
তোমরা হে পিতৃপিতামহ। সাক্ষী থাকো
এতদিন যে রাজবিশ্বাস পালিয়াছ
বহু যত্নে, সাগ্নিকের পুণ্য অগ্নি-সম,
যার ধন তারি হাতে ফিরে দিনু আজ
কলঙ্কবিহীন।
চাঁদপাল।                             কথা আছে ভাই!
নয়নরায়।                                                   ধিক্‌!
                  চুপ করো! মহারাজ, বিদায় হলেম।

[ প্রণামপূর্বক প্রস্থান

গোবিন্দমাণিক্য।          ক্ষুদ্র স্নেহ নাই রাজকাজে। দেবতার
কার্যভার তুচ্ছ মানবের ‘পরে, হায়
কী কঠিন!
রঘুপতি।                           এমনি করিয়া ব্রহ্মশাপ
ফলে, বিশ্বাসী হৃদয় ক্রমে দূরে যায়,
ভেঙে যায় দাঁড়াবার স্থান।

জয়সিংহের প্রবেশ

জয়সিংহ।                                              আয়োজন
হয়েছে পূজার। প্রস্তুত রয়েছে বলি।
গোবিন্দমাণিক্য।         বলি কার তরে?
জয়সিংহ।                                 মহারাজ, তুমি হেথা!
তবে শোনো নিবেদন–একান্ত মিনতি
যুগল চরণতলে, প্রভু, ফিরে লও
তব গর্বিত আদেশ। মানব হইয়া
দাঁড়ায়ো না দেবীরে আচ্ছন্ন করি–
রঘুপতি।                                                    ধিক্‌!
জয়সিংহ, ওঠো, ওঠো! চরণে পতিত
কার কাছে? আমি যার গুরু, এ সংসারে
এই পদতলে তার একমাত্র স্থান।
মূঢ়, ফিরে দেখ্‌–গুরুর চরণ ধরে
ক্ষমা ভিক্ষা কর্‌। রাজার আদেশ নিয়ে
করিব দেবীর পূজা, করালকালিকা,
এত কি হয়েছে তোর অধঃপাত! থাক্‌
পূজা, থাক্‌ বলি–দেখিব রাজার দর্প
কতদিন থাকে। চলে এস জয়সিংহ!

[ রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রস্থান

গোবিন্দমাণিক্য।         এ সংসারে বিনয় কোথায়? মহাদেবী,
যারা করে বিচরণ তব পদতলে
তারাও শেখে নি হায় কত ক্ষুদ্র তারা!
হরণ করিয়া লয়ে তোমার মহিমা
আপনার দেহে বহে, এত অহংকার!

[ প্রস্থান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *