একই রাগিণীর বিভিন্ন আলাপ


অসুস্থতা ঈগলচঞ্চুর মতো ঝুঁকে থাকে আমার উপর,
ঠোকরায় প্রায়শই।এখানে আমার কোনো স্থায়ী
ডেরা নেই, এ-কথা স্মরণ
করিয়ে দেয়ার জন্যে সে এসে দুরন্ত
ডানার ঝাপটে চোখ মুখ ঢেকে দেয়। তারপর অকস্মাৎ
জানলা কাঁপিয়ে চলে যায় দূরে, ঘাম দিয়ে জ্বর
ছাড়ে, যেন কোনো ধোপা কাপড়ের মতো
নিঃড়ে নিঃড়ে আমাকে শুকোতে দেয় রোদ্দুরে, হাওয়ায়।

ভয়াবহ তিলে তিলে নিঃস্পন্দ অন্তিমে পৌঁছে যাওয়া,
তারও চেয়ে ভয়ানক বার্ধক্যের দুর্বহ ভারের
চাপ বুকে নিয়ে
নিরাশ্রিত পড়ে-থাকা এক কোণে, ইচ্ছে হয় লিখি
এপিটাফ, কিন্তু আজো কলম বেয়াড়া। কী আশ্চর্য, মাঝে মাঝে
ভীষণ নিষ্ঠুর বলে যাকে মনে হয়, যে আমার
হাড়মাস চিবিয়ে চিবিয়ে
ছুঁড়ে দিতে চায় আস্তাঁকুড়ে, অন্যের প্রণয়াচিহ্ন, তীব্র, গাঢ়,
নিয়ে দেখা দেয় অবলীলাক্রমে, তারই জন্যে আজো পুড়ে পুড়ে
বেঁচে থাকবার সাধ হয়।


দোতালার সিঁড়ির পিছনের ধাপেই ভালোবাসা, ধরা ছোঁয়ার
বাইরে। আমার বিষণ্ন হাতে
কোনো বাঁশি নেই, তবু হাসি ঝুলিয়ে মুখে পিছনে না
তাকিয়ে নামার
অর্ফিয়ুসী-চেষ্টা। স্যান্ডেলের শব্দে এই শতকের
শেষ অব্দের ছন্দ; ভালোবাসার চোখ আমার দুলে-ওঠা
ঝাঁকড়া চুলে অথবা পিঠে
নিবদ্ধ ছিল নাকি অন্য কোথাও, কে বলবে? রাস্তা খুঁজি,
নিজকে বলি, একা-একা কোথায় যাও?

ভালোবাসা আমার কাঁধে আলতো রাখে
হাত, এরকম ভ্রম পাখা
ঝাপটায়। কোত্থেকে অবিশ্বাস্য সুন্দর এক পাখি
ডাকাডাকি ছাড়াই আমার কাঁধটিকে বানায় ডাল। পালকের নরম
ঈষৎ গরম ছড়ায় গালে, কানে এবং গানে
গানে নিমেষে নিয়ে যায় হাফিজের কালের
গোলাপ বাগানে। বিচ্ছিন্নতা কোনো কথা না বলে
হাঁটতে শুরু করে আমার হাত ধরে।

ভালোবাসা দাঁড়ানো যৌবনের মদিরতায়।
একবারও ফিরে তাকাইনি, যদি সে গোলাপের
সৌরভের মতো মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। এখানে
তাকে পাওয়ার আশা নিছক
কুহক হয়ে নেচে বেড়ায়। অথচ সিঁড়ির
পিছনের ধাপেই ছিল। তার হেঁয়ালি
বোঝার আশা দিয়েছি ভাসিয়ে
ভঘঘুরে মেঘের ছায়ায়।

সে আমার ছিল না খ্রীষ্টপূর্ব সন্ধ্যায়,
যে আমার নয়, তাকে হারাবার ভয় কেন সবসময়
নিষাদ-তাড়িয়ে হরিণের মতো দিগ্ধিদিক
ছোটাছুটি করে? এই দুপুর থাকবে না, সন্ধ্যা ডুবে যাবে,
রাত্রিও যাবে,
একটু একটু করে আমাকে খাবে ঠুকরে ডোম কাকা।
যথাসর্বস্ব
বিলিয়েও পারবো না যেতে সেই ঝর্ণাতলায়,
যেখানে তার আবাসভূমি,
যাকে তুমি বলে ডাকে আমার হৃদয়ের তন্তুজাল!

পাওয়ার আগেই হারাতে চলেছি তাকে। কাকে বলে পাওয়া?
আমাকে আপাদমস্তক পরিয়ে নিঃসঙ্গতা কিছুক্ষণ
কোনো কথা না বলেই থাকবে দাঁড়িয়ে কী খেয়ালে,
কে জানে? আমার মাংসের দেয়ালে বিছের কামড়,
সে চলে যাবে সন্ধ্যেবেলা। আমাকে মাড়িয়ে শহরের
সকল যান, মানুষ ছুটে যাবে। কীসের টানে
এখনো আরামপ্রদ স্টেশন ভেবে জায়গাটাকে বুকের খুব
কাছের কিছু বলে মেনে নিই? মুখ নিচু করে স্যান্ডেল ঘষি
পাথরে
শেষটায় ভোলার চেষ্টায় ব্যর্থ না-লেখা কবিতার
গুঞ্জরণ নিয়ে পা বাড়াই। পাবো কি দেখা
আবার কখনো? জলমগ্ন বিশাল ঝিনুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে
এসেছে যে থৈ থৈ যৌবন নিয়ে, অনেক পথ পেরিয়ে এসে
যার দিকে ফিরে তাকাতে পারিনি। আমার পাশাপাশি
হাসি মুখে হাঁটতে থাকে বিচ্ছেদ, তাকায় আকাশ-উপচানো
নক্ষত্রের দিকে আর সেই মনোহর পাখিটা আমার নিশাচর
কাঁধে বসে চঞ্চু ঘষে ঘষে কবিতার প্রস্রবণ জাগাতে চায়।


যখন তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসলাম,
হঠাৎ তখনই তুমি চলে যাচ্ছো আমার দৃষ্টির
অন্তরালে; এরকমই হয়, হতে থাকে চিরদিন।
তোমাকে যেতেই হবে সুগভীর নক্ষত্র নিবিয়ে?

আমার অজানা নয় দুঃসময়; কতবার তার
অগ্নিঝড় স্বপ্নমুগ্ধ ঘরদোর সব তছনছ
করে উড়িয়েছে ভস্মরাশি চতুর্দিকে। এরকম
সময়েও তোমার চোখের পাখি শুনিয়েছে গান।

আমার একটু স্পর্শে চমকে উঠছো, ঢিল-পড়া
সরোবর যেন আর তোমার পায়ের পাতা ছুঁয়ে
পায়ে ভেবে নিয়েছি আমিও দ্বিপ্রহরে স্বপ্নে ভেসে
যেতে পারি অবলুপ্ত কার্থেজের চিত্রিত জাহাজে।

যখন তোমার হাতে চুমো খেয়েছি প্রথম, তুমি
দ্রুত হাত সরিয়ে কেমন স্তব্ধতায় ডুবে গিয়ে
বসেছিলে। আজো সেই দুপুরের জ্বলজ্বলে স্মতি
নূপুরের ধরনে ধ্বনিত গাঢ় বর্ষার তিমিরে।

তোমার কোমরে পাক দিয়ে ওঠে নদী বাঁকে বাঁকে,
এবং যখন হাসো রাজহংসীর মসৃণ ডানা থেকে
ঝরে যায় জলকণা নিরিবিলি; তোমার মুখশ্রী
প্রাচীন বাংলার রূপ হয়ে জ্বলে প্রেমিকা আমার।

তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে, বলো তুমি
কী এমন দেখ এই চোখে, এত বিশ্রী। চোখ মেঘে
যখন তাকাও তুমি আমার উদ্দেশে, মনে হয়
কোনোখানে তোমার অধিক কোনো আততায়ী নেই!


আজকাল গোলাপের চাষ কমেছে কি বেড়েছে, জানি না;
জীবনের রলরোলে শুধু মনে পড়ে;
দিয়েছিলে তুমি স্মিতা একটি গোলাপ, তাজা, টকটকে।
মনে হলো নিভৃত ফুটন্ত রক্তগোলাপের ছলে
তোমার হৃদয় দিলে তুমি কম্পিত আমার হাতে।
সে মুহূর্ত চিরস্থায়ী হলে, বলো কোন্‌ ক্ষতি হতো?
কোথায় লুকাবো তাকে ভেবে পায়চারী করে ক্লান্ত;
পকেটে দিলাম ঠাঁই। গোলাপ মুষড়ে পড়ে সাত
তাড়াতাড়ি, ছিল না খেয়াল। শুধু দেখি তোমাকেই
কেমন বিহ্বল চোখে; তুমি ছাড়া অন্য সব কিছু
ঝাপ্‌সা কাঁচের মতো লেগেছিল। পুষ্পতত্ত্ববিদ্‌ যা ইচ্ছে বলুন, জানি
সে গোলাপ হৃদয়ের ভেতরেই প্রিয় আয়ুষ্মতী।

দ্বিধা তো থেকেই যায়। অন্য কারো উদ্দেশে গচ্ছিত
সে অর্ঘ এসেছে হাতে বলে অত্যন্ত কর্কশ।
কণ্ঠস্বর আমাকে পীড়ন করে ক্ষণে ক্ষণে, হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে খায়
নিষ্ঠুর ঈগল এক, মাথা কোটে অন্তর্গত দুর্বার উন্মাদ।
দ্বিধা তো থেকেই যায়; যখন চোখের মণি দুটো গলে গলে
নীরেট পাথর, চতুর্দিকে নাচে গোলাপের প্রেত!

চিৎকার চিৎকারে দশদিক ছিঁড়ে খুঁড়ে দিই আর
নিজই নিজের মুণ্ড চিবিয়ে খাবার
ইচ্ছেটাকে চাবকাতে থাকি, আদিম মানুষ বশ
মেনে যায়, অজান্তে পকেটে হাত দিয়ে অকস্মাৎ
বের করে আনি সেই উপহার, নিষ্পাপ গোলাপ।
মনে হয়, যেন আমি ভুল করে ছুঁয়েছি অঙ্গার।

তোমাকে একলা ছেড়ে (তুমি কি নিশ্চিত একাকিনী?)
চলে যাবো বহু দূরে পুড়ে পুড়ে।
যাবো একা, বড় একা, নিরাশায় ডোবা রাত্তিরকে অধিক প্রসন্ন করে
থাকবে নিঃসঙ্গ ঝুলে আসমানে আধখানা চাঁদ।
গ্রিক বণিকের ম্লান স্মৃতিসৌধ জোনাকির ভিড়, চকিতে পড়বে মনে
তোমার চোখে কালো কত শত দূর শতাব্দীর।


চাই কিনা চাই শেষ অব্দি দূরত্বের ধূসরিমা
ভেতরে বিরাজান। নৌকো
ঘাটে ভেড়াবার প্রয়াসের উপরে শীতল জল
প্রবল গড়িয়ে পড়ে; মনে হয়, নিজের মৃত্যুর
আগে কোনো মুহূর্তে সে-মুখ
দেখবো না, যায় সেই শরমের আবীর রাঙানো ভঙ্গিমায়
নির্ভরতা আছে; জানি, একটু একটু করে আমি
স্ব ধ্বনি, সব ঘ্রাণ, সব গান, সব দৃশ্য থেকে দূরে সরে যাবো,
নিশি-পাওয়া মানুষের মতো একই দিকে

হবো ভ্রাম্যমাণ, যদি তাকে ভ্রমণের
সঙ্গে তুলনীয় ভাবি। যাকে এতকাল দেখে
কেটেছে আমার বেলা, আসলে সে অন্য কেউ, তার
সঙ্গে কোনো জানাশোনা নেই, অথচ সে
আমার নিজেরই তৈরি। তখন নিজকে প্রতারিত,
বঞ্চিত, কী শূন্য লাগে। খুব তাড়াতাড়ি
চলে যাবো নাকি? গোরস্তানে যারা ধরিয়ে নিঃস্পৃহ
সিগারেট চোখ স্বাভাবিকভাবে চৌদিকে বুলিয়ে
নেয় অনুভূতিহীন, নিশ্চেতন,
তাদের কারুর মতো থাকবো এখনো
নিরর্থক জীবনের জিন্দানে বন্দির স্বপ্ন নিয়ে?