কলিকাতায় এক বাসায় ওই শোনো ভাই বিশু, পথে শুনি ‘জয় যিশু’! কেমনে এ নাম করিব সহ্য আমরা আর্যশিশু! কূর্ম, কল্কি, স্কন্দ এখন করো তো বন্ধ। যদি যিশু ভজে রবে না ভারতে পুরাণের নামগন্ধ। ওই দেখো ভাই, শুনি— যাজ্ঞবল্ক্য মুনি, বিষ্ণু, হারীত, নারদ, অত্রি কেঁদে হল খুনোখুনি! কোথায় রহিল কর্ম, কোথা সনাতন ধর্ম! সম্প্রতি তবু কিছু শোনা যায় বেদ-পুরাণের মর্ম! ওঠো, ওঠো ভাই, জাগো, মনে মনে খুব রাগো! আর্যশাস্ত্র উদ্ধার করি, কোমর বাঁধিয়া লাগো! কাছাকোঁচা লও আঁটি, হাতে তুলে লও লাঠি। হিন্দুধর্ম করিব রক্ষা, খৃস্টানি হবে মাটি। কোথা গেল ভাই ভজা হিন্দুধর্মধ্বজা? ষন্ডা ছিল সে, সে যদি থাকিত আজ হত দুশো মজা! এসো মোনো, এস ভুতো, প’রে লও বুট জুতো। পাদ্রি বেটার পা মাড়িয়ে দিয়ো পাও যদি কোনো ছুতো! আগে দেব দুয়ো তালি, তার পরে দেব গালি। কিছু না বলিলে পড়িব তখন বিশ-পঁচিশ বাঙালি। তুমি আগে যেয়ো তেড়ে, আমি নেব টুপি কেড়ে। গোলেমালে শেষে পাঁচজনে প’ড়ে মাটিতে ফেলিয়ো পেড়ে। কাঁচি দিয়ে তার চুল কেটে দেব বিলকুল। কোটের বোতাম আগাগোড়া তার করে দেব নির্মূল। তবে উঠ, সবে উঠ— বাঁধো কটি, আঁটো মুঠো! দেখো, ভাই, যেন ভুলো না, অমনি সাথে নিয়ো লাঠি দুটো! দলপতির শিষ ও গান : প্রাণসই রে, মনোজ্বালা কারে কই রে! কোমরে চাদর বাঁধিয়া, লাঠি হস্তে, মহোৎসাহে সকলের প্রস্থান। পথে বিশু হারু মোনো ভুতোর সমাগম। গেরুয়াবস্ত্রাচ্ছাদিত অনাবৃতপদ মুক্তিফৌজের প্রচারকঃ ধন্য হউক তোমার প্রেম, ধন্য তোমার নাম, ভুবন-মাঝারে হউক উদয় নূতন জেরুজিলাম। ধরণী হইতে যাক ঘৃণাদ্বেষ, নিঠুরতা দূর হোক— মুছে দাও, প্রভু, মানবের আঁখি, ঘুচাও মরণশোক। তৃষিত যাহারা, জীবনের বারি করো তাহাদের দান। দয়াময় যিশু, তোমার দয়ায় পাপীজনে করো ত্রাণ। ‘ওরে ভাই বিশু, এ কে, জুতো কোথা এল রেখে! গোরা বটে, তবু হতেছে ভরসা গেরুয়া বসন দেখে।’ ‘হারু, তবে তুই এগো! বল্— বাছা, তুমি কে গো? কিচিমিচি রাখো, খিদে পেয়েছে কি? দুটো কলা এনে দে গো!’ বধির নিদয় কঠিন হৃদয় তারে প্রভু দাও কোল। অক্ষম আমি কী করিতে পারি— ‘হরিবোল হরিবোল!’ ‘আরে, রেখে দাও খৃস্ট! এখনি দেখাও পৃষ্ঠ! দাঁড়ে উঠে চড়ো, পড়ো বাবা পড়ো হরে হরে হরে কৃষ্ট!’ তুমি যা সয়েছ তাহাই স্মরিয়া সহিব সকল ক্লেশ, ক্রুস গুরুভার করিব বহন— ‘বেশ, বাবা, বেশ বেশ!’ দাও ব্যথা, যদি কারো মুছে পাপ আমার নয়ননীরে। প্রাণ দিব, যদি এ জীবন দিলে পাপীর জীবন ফিরে। আপনার জন-আপনার দেশ— হয়েছি সর্ব-ত্যাগী। হৃদয়ের প্রেম সব ছেড়ে যায় তোমার প্রেমের লাগি। সুখ, সভ্যতা, রমণীর প্রেম, বন্ধুর কোলাকুলি— ফেলি দিয়া পথে তব মহাব্রত মাথায় লয়েছি তুলি। এখনো তাদের ভুলিতে পারি নে, মাঝে মাঝে জাগে প্রাণে— চিরজীবনের সুখবন্ধন সেই গৃহ-মাঝে টানে। তখন তোমার রক্তসিক্ত ওই মুখপানে চাহি, ও প্রেমের কাছে স্বদেশ বিদেশ আপনা ও পর নাহি। ওই প্রেম তুমি করো বিতরণ আমার হৃদয় দিয়ে, বিষ দিতে যারা এসেছে তাহরা ঘরে যাক সুধা নিয়ে। পাপ লয়ে প্রাণে এসেছিল যারা তাহারা আসুক বুকে— পড়ুক প্রেমের মধুর আলোক ভ্রূকুটিকুটিল মুখে! ‘আর প্রাণে নাহি সহে, আর্যরক্ত দহে?’ ‘ওহে হারু, ওহে মাধু, লাঠি নিয়ে ঘা-কতক দাও তো হে!’ ‘যদি চাস তুই ইষ্ট বল্ মুখে বল্ কৃষ্ট।’ ধন্য হউক তোমার নাম দয়াময় যিশুখৃস্ট! ‘তবে রে! লাগাও লাঠি কোমরে কাপড় আঁটি।’ ‘হিন্দুধর্ম হউক রক্ষা খৃস্টানি হোক মাটি!’ প্রচারকের মাথায় লাঠি প্রহার। মাথা ফাটিয়া রক্তপাত। রক্ত মুছিয়া : প্রভু তোমাদের করুন কুশল, দিন তিনি শুভমতি। আমি তাঁর দীন অধম ভৃত্য, তিনি জগতের পতি। ‘ওরে শিবু, ওরে হারু, ওরে ননি, ওরে চারু, তামাশা দেখার এই কি সময়— প্রাণে ভয় নেই কারু!’ ‘পুলিস আসিছে গুঁতা উঁচাইয়া, এইবেলা দাও দৌড়!’ ‘ধন্য হইল আর্য ধর্ম, ধন্য হইল গৌড়।’ ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন। বাসায় ফিরিয়া : সাহেব মেরেছি! বঙ্গবাসীর কলঙ্ক গেছে ঘুচি। মেজবউ কোথা, ডেকে দাও তারে— কোথা ছোকা, কোথা লুচি! এখনো আমার তপ্ত রক্ত উঠিতেছে উচ্ছ্বসি— তাড়াতাড়ি আজ লুচি না পাইলে কী জানি কী ক’রে বসি! স্বামী যবে এল যুদ্ধ সারিয়া ঘরে নেই লুচি ভাজা! আর্যনারীর এ কেমন প্রথা, সমুচিত দিব সাজা। যাজ্ঞবল্ক্য অত্রি হারীত জলে গুলে খেলে সবে— মারধোর ক’রে হিন্দুধর্ম রক্ষা করিতে হবে। কোথা পুরাতন পাতিব্রত্য, সনাতন লুচি ছোকা— বৎসরে শুধু সংসারে আসে একখানি করে খোকা। এই কবিতায় বর্ণিত ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়!
পূর্ববর্তী:
« দেশের উন্নতি
« দেশের উন্নতি
পরবর্তী:
ধ্যান »
ধ্যান »
Leave a Reply