হেরো ওই বাড়িতেছে বেলা , বসে আমি রয়েছি একেলা । ওই হোথা যায় দেখা সুদূরে বনের রেখা মিশেছে আকাশনীলিমায়; দিক হতে দিগন্তরে মাঠ শুধু ধূ ধূ করে , বায়ু কোথা বহে চলে যায় । সুদূর মাঠের পারে গ্রামখানি এক ধারে, গাছ দিয়ে ছায়া দিয়ে ঘেরা । কাননের গায়ে যেন ছায়াখানি বুলাইয়া ভেসে চলে কোথায় মেঘেরা । মধুর উদাস প্রাণে চাই চারি দিক-পানে , স্তব্ধ সব ছবির মতন । সব যেন চারি ধারে অবশ আলসভারে স্বর্ণময় মায়ায় মগন । গ্রামখানি , মাঠখানি , উঁচুনিচু পথখানি , দু-একটি গাছ মাঝে মাঝে , আকাশ-সমুদ্রে-ঘেরা সুবর্ণ দ্বীপের পারা কোথা যেন সুদূরে বিরাজে । কনকলাবণ্য লয়ে যেন অভিভূত হয়ে আপনাতে আপনি ঘুমায় , নিঝুম পাদপলতা , শ্রান্তকায় নীরবতা শুয়ে আছে গাছের ছায়ায় । শুধু অতি মৃদু স্বরে গুন গুন গান করে যেন সব ঘুমন্ত ভ্রমর , যেন মধু খেতে খেতে ঘুমিয়েছে কুসুমেতে মরিয়া এসেছে কণ্ঠস্বর । নীল শূন্যে ছবি আঁকা রবির-কিরণ-মাখা , সেথা যেন বাস করিতেছি । জীবনের আধখানি যেন ভুলে গেছি আমি , কোথা যেন ফেলিয়ে এসেছি । আনমনে ধীরি ধীরি বেড়াতেছি ফিরি ফিরি ঘুমঘোর ছায়ায় ছায়ায় — কোথা যাব কোথা যাই সে কথা যে মনে নাই , ভুলে আছি মধুর মায়ায় । মধুর বাতাসে আজি যেন রে উঠিছে বাজি পরানের ঘুমন্ত বীণাটি , ভালোবাসা আজি কেন সঙ্গীহারা পাখি যেন বসিয়া গাহিছে একেলাটি । কে জানে কাহারে চায় , প্রাণ যেন উভরায়, ডাকে কারে 'এসো এসো ' ব'লে , কাছে কারে পেতে চায় , সব তারে দিতে চায় , মাথাটি রাখিতে চায় কোলে । স্তব্ধ তরুতলে গিয়া পা দুখানি ছড়াইয়া নিমগন মধুময় মোহে , আনমনে গান গেয়ে দূর শূন্যপানে চেয়ে ঘুমায়ে পড়িতে চায় দোঁহে । দূর মরীচিকা-সম ওই বন-উপবন , ওরি মাঝে পরান উদাসী — বিজন বকুলতলে পল্লবের মরমরে নাম ধরে বাজাইছে বাঁশি । সে যেন কোথায় আছে সুদূর বনের পাছে কত নদী-সমুদ্রের পারে , নিভৃত নির্ঝরতীরে লতায় পাতায় ঘিরে বসে আছে নিকুঞ্জ-আঁধারে । সাধ যায় বাঁশি করে বন হতে বনান্তরে চলে যাই আপনার মনে , কুসুমিত নদীতীরে বেড়াইব ফিরে ফিরে কে জানে কাহার অন্বেষণে । সহসা দেখিব তারে , নিমেষেই একেবারে প্রাণে প্রাণে হইবে মিলন এই মরীচিকাদেশে দুজনে বাসরবেশে ছায়ারাজ্যে করিব ভ্রমণ । বাঁধিবে সে বাহুপাশে , চোখে তার স্বপ্ন ভাসে , মুখে তার হাসির মুকুল — কে জানে বুকের কাছে আঁচল আছে না আছে , পিঠেতে পড়েছে এলো চুল । মুখে আধখানি কথা , চোখে আধখানি কথা , আধখানি হাসিতে জড়ানো — দুজনেতে চলে যাই , কে জানে কোথায় যাই পদতলে কুসুম ছড়ানো । বুঝি রে এমনি বেলা ছায়ায় করিত খেলা তপোবনে ঋষিবালিকারা , পরিয়া বাকলবাস , মুখেতে বিমল হাস , বনে বনে বেড়াইত তারা । হরিণশিশুরা এসে কাছেতে বসিত ঘেঁষে , মালিনী বহিত পদতলে — দু-চারি সখীতে মেলি কথা কয় হাসি খেলি তরুতলে বসি কুতূহলে । কারো কোলে কারো মাথা , সরল প্রাণের কথা নিরালায় কহে প্রাণ খুলি — লুকিয়ে গাছের আড়ে সাধ যায় শুনিবারে কী কথা কহিছে মেয়েগুলি । লতার পাতার মাঝে , ঘাসের ফুলের মাঝে হরিণশিশুর সাথে মিলি , অঙ্গে আভরণ নাই , বাকল-বসন পরি রূপগুলি বেড়াইছে খেলি । ওই দূর বনছায়া ও যে কী জানে রে মায়া , ও যেন রে রেখেছে লুকায়ে — সেই স্নিগ্ধ তপোবন , চিরফুল্ল তরুগণ , হরিণশাবক তরুছায়ে । হোথায় মালিনী নদী বহে যেন নিরবধি , ঋষিকন্যা কুটিরের মাঝে — কভু বসি তরুতলে স্নেহে তারে ভাই বলে , ফুলটি ঝরিলে ব্যথা বাজে । কত ছবি মনে আসে , পরানের আশেপাশে কল্পনা কত যে করে খেলা — বাতাস লাগায়ে গায়ে বসিয়া তরুর ছায়ে কেমনে কাটিয়া যায় বেলা ।
Leave a Reply