তার আগেই যদি

আরো দশদিন তোমার কঙ্গে আমার
দেখা হবে না। ভরা আষাঢ়ের
পুরো দশ দশটি দিন
আমার কাটবে শূন্যতায়।
আকাশে
মেঘের ভেজা কাঁথা,
মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের জরি,
আমার ভেতরে একটা অসহায়
আশ্রয়হীন পাখি
ডেকে উঠলো বার বার, তুমি নেই।
বৃষ্টি বন্দী শহরের রাস্তায়
বেবী ট্রাক্সিতে যেতে-যেতে
ট্রাউজারে ঢাকা আমার উরুতে আঙুল
বুলিয়ে তুমি জাগিয়ে দিচ্ছিলে
বিসমিল্লা খানের মানাই।
আলিঙ্গন আর চুম্বনের আশ্বাস
আমার সত্তায় ছড়িয়ে বলেছিলে-
দশদিন পরে আবার দেখা হবে আমাদের।
বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিলো
তোমার মুখে;
গ্রীক পুরাণের কোনো দেবীর ধরনে
তুমি মুছে নিচ্ছিলে
পানির বিন্দু সমুদয়,
দেখছিলাম মুগ্ধাবেশে।

হঠাৎ মধ্য দুপুরে নেমেছিলো
দৃষ্টি ঝাপ্‌সা ক’রে দেয়া বৃষ্টি।
আমরা দু’জন
এমন ঘন ঘোর বর্ষায়
দোকানপাট আর
মানুষের ভিড়ে আট্‌কা প’ড়ে
হাঁসফাঁস; বৃষ্টি আর দরস্ত
তাতারী হাওয়া,
পথঘাট ঘোলা জলে সরলাব।
একটু পরেই
বেবী ট্যাক্সি, যেন একটা জলচয় পাখি
থমকে দাঁড়ালো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে।

আরো দশদিন তোমাকে দেখবো না,
কী দীর্ঘ আর অন্তহীন এই সময়। ভাবলেই
মৃত্যু তার ঠান্ডা হাত বাড়াতে থাকে
আমার হৃৎপিন্ডের দিকে। কী ভাবে,
কোন্‌ জাদু বলে
পার হবো তুমিহীনতার মরুভূমি? আমার
অস্তিত্ব কি ঝল্‌সে যাবে না
সূর্যের ক্ষমাহীন উত্তাপে?
মরু শেয়ালেরা কি খর জিহ্বায়
ভীষণ চেটে চেটে
নিশ্চিহ্ন ক’রে ফেলবে না
আমার মাংসের দেয়াল?

তোমাকে না দেখে, তোমার কণ্ঠস্বর না শুনে
তোমাকে একবারও না ছুঁয়ে
কী ক’রে কাটবে আমার সময়?
কবিতা লেখা আর না লেখার
কানামাছি খেলায় কি
ভেসে যাবে দিনগুলি, রাতগুলি? যখন ঘুম থেকে
জেগে উঠবো ভোরবেলা কি সোনায়
মূড়ে দিতে পারবে
আমার আকাঙ্ক্ষার মুকুলগুলোকে?
যখন কিছুতেই ঘুমোতে পারবো না,
রাত্রি কি পারবে আমার সময়কে
সাজিয়ে দিতে
স্বপ্নের পাপড়িতে? কী ক’রে সইবো
আসন্ন বিচ্ছেদের স্বৈরাচার?
কেন এমন হয় না যে রোজ তোমাকে দেখতে পাবো
অন্তত একবার?
যত ক্ষণস্থায়ী হোক সেই সাক্ষাৎ
ক্ষতি নেই; প্রত্যহ তোমাকে এক ঝলক
দেখে নেবার পর,
তোমার হাত আর চুল নিয়ে
কিছুক্ষণ খেলা করার পর, ওষ্ঠে
তোমার চুম্বনের
প্রসাদ নেবার পর
মেনে নেবো পৃথিবীর যে কোনো রুক্ষতা, বিরুনতা।

প্রতি মুহূর্তে তোমার কাছেই আমার যাওয়া,
অথচ চৌদিকে উঁচানো বাধার সঙিন,
প্রহরীদের চাবুকের সপাং সপাং।
বন্দী, তৃষ্ণার্ত বেনহুরের মুখ থেকে
যেমন অত্যাচারীরা পানপাত্র সরিয়ে
নিয়ে গিয়েছিলো চরম তাচ্ছিল্যে, তেমনি কেউ কেউ
আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চায়
তোমার সান্নিধ্য থেকে। ওদের ক্রোধ আর হিংসা
আমার সত্তার মাটি খুঁড়তে থাকে
লাশসন্ধানী কুকুরের মতো।

যদি ওরা তোমার আমার মধ্যে কাঁটা
বিছিয়ে রাখে, সেই বিষাক্ত কাঁটাকে ফুল ভেবে
হেঁটে যাবো তোমার দিকে। যদি ওরা
আমার হাতে হাতকড়া আর পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেয়,
আমি সেই নিষ্ঠুর বন্ধনের উৎপীড়ন
উপেক্ষা ক’রে যাত্রা করবো
তোমার উদ্দেশে আর
লোহার শেকল ঝন্‌ঝনিয়ে
গেয়ে উঠবে ভালোবাসার গান,
ভালোবাসা রক্তগোলাপের মতো উন্মীলিত আমার বুকে।
দশদিন পর তোমার সঙ্গে আমার দেখা
হবার কথা। আজ থেকে দশদিন পর।
সেই কাঙ্ক্ষিত দিনের প্রতীক্ষার করাত
আমাকে কেটে চলেছে মুহূর্তে মুহূর্তে। শুধু
তোমাকে দেখার জন্যে, দুশো চল্লিশ ঘন্টার পর
শিরায় শিরায় তোমার দৃষ্টির সম্মোহন
অনুভব করার জন্যে বেঁচে আছি।
কিন্তু তার আগেই যদি মৃত্যু
নাছোড় পাওনাদারের মতো এসে দাঁড়ায়
আমার দোরগোড়ায়, তবে কী হবে?

৬,৭,৮৮