জাহাজী

জাহাজী 

এঞ্জিন মৃদু-মৃদু আওয়াজ করতে শুরু করেছে। স্টোকহোল্ডে কয়লাওয়ালাদের মুখ লাল হয়ে উঠেছে : তাদের সামনে যে-বিরাট অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠেছে—তারই তাপে ঝলসাচ্ছে ওদের মুখ। ভোর নাগাদ জাহাজ ছাড়বে। কিন্তু মাল তোলা এখনো শেষ হয় নি; কার্গো-উইঞ্চে একঘেয়ে আওয়াজ হচ্ছে : ঘর ঘর ঘর। ওধারে ডকের আবরণ দেয়া-আলোর মধ্যে রহস্য, অস্পষ্ট কোলাহল, আর ধোঁয়া। 

রাতের শেষাশেষি। বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গ কেবিন হতে বেরিয়ে এল—তার ক্ষুদ্র চোখে ঘুমাবসানের ঔজ্জ্বল্য ও স্বচ্ছতা। জাহাজ কাঁপছে মৃদু-মৃদু। ওপরে ফানেল দুটো দিয়ে ধোঁয়ার শীর্ণ রেখা নিষ্কম্পভাবে ঋজু হয়ে উঠে হাওয়াশূন্য কালো আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। করিম সারেঙ্গ ঘুরে এল এদিকে, দেখলে গ্যাঙ্গওয়ে এখনো তোলা হয় নি। কোণে আবছা অন্ধকার; সে-অন্ধকারে গ্যাঙ্গওয়ের পাহারায় একটা মূর্তি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল সারেঙ্গ, তারপর তীব্র গলায় প্রশ্ন করলে : 

—ইবা কন? 

সুখানি মজিদের চোখ হয়তো তন্দ্রায় ভরে উঠেছিল, সারেঙ্গের প্রশ্নে সে সচকিত হয়ে উঠল। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে উত্তর দিলে : 

—আঁই, মজিদ। 

আকাশে তারাগুলো ম্লান হয়ে উঠেছে, কেবল শুকতারা দপদপ করছে উজ্জ্বলভাবে। ওধারে ডকে এখনো প্রচুর মাল। মরচেধরা পুরোনো কার্গো-উইঞ্চটা ঘরঘর করছে অবিরাম : ডক থেকে মাল তুলে ঘুরে এসে হ্যাচওয়ের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে একটু পরে আবার শূন্য অবস্থায় লকলক করে বেরিয়ে আসছে। 

জাহাজটা মালবাহী। তাই খোলা খোলা। গলি দিয়ে স্টারবোর্ডে গিয়ে আরেক জায়গায় থমকে দাঁড়াল সারেঙ্গ। ওপরে চার্টরুমের আবৃত উজ্জ্বল আলো নজরে পড়ল। বন্ধ জানালার শার্সিতে কার ছায়া বিকৃত হয়ে পড়েছে। চোখ ছোট করে তাকাল সারেঙ্গ : হয়তো থার্ডমেটের ছায়া। 

তারপর সারেঙ্গ আবার ফিরে এল কেবিনে। সেটি একধারে বলে তাতে একটি পোর্টহোল রয়েছে। কেবিনে আলো, বাইরে তখনো রাত্রির অন্ধকার বলে তাতে ঘরের ছায়া, সারেঙ্গের প্রতিমূর্তি। তবু ক্ষুদ্র উজ্জ্বল চোখে বাইরে তাকাল সে : আকাশ যেন স্বচ্ছ হয়ে আসছে ক্ৰমে-ক্রমে, অতি নম্র নির্মল পবিত্রতা প্রকাশ পাচ্ছে বাইরের জগতে। এ-সময়ে করিম সারেঙ্গ বরাবর স্তব্ধ হয়ে থাকে। দিন শুরু হবে শীঘ্র, জাহাজী জীবনের অনির্দিষ্ট দিনগুলোর একটি দিন হবে শুরু : এবং রাত ও দিনের এ-সন্ধিক্ষণে শুদ্ধচিত্তে সে স্তব্ধ হয়ে থাকে, আর কেবিনের নির্জনতা ও নীরবতার মধ্যে কেমন কোমল হয়ে ওঠে তার ভেতরটা। লস্করদের কাছে তার ব্যক্তিত্ব বড় জমকালো। তারা তাকে শ্রদ্ধা করে ভয় করে। সারেঙ্গও অনুভব করে কর্তৃত্বের ভারিত্ব। কিন্তু এ-সময়ে তার সে-মন সহজ হয়ে পড়ে, দিনের মৃদু অথচ বিস্ময়কর বিকাশের কাছে অতি ক্ষুদ্র মনে হয় নিজেকে। খোদা আছেন : সর্বশক্তিময় খোদা। তাঁর অস্তিত্ব নিঃসঙ্গ করিম সারেঙ্গ অনন্ত আকাশের তলে ও অকূল সমুদ্রের মধ্যে বিচিত্রভাবে অনুভব করেছে, এবং এ-অনুভূতিতে কখনো-কখনো তার ব্যক্তিত্বে-ভারি মন-ও কেমন বেদনার আনন্দে কেঁদে ওঠে। রাত্রির শেষ। প্রখর সূর্যালোকের তলে বাস্তব জগতের সাথে এখনো দেখা হয় নি : নির্মল প্রশান্তিতে সারেঙ্গ ফজরের নামায পড়ে। শুভ্র দাড়িতে আবৃত গৌর মুখ পবিত্রতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এবং গভীর এবাদতী নিবিষ্টতায় তার ক্ষুদ্র চোখ—যে-চোখের তীক্ষ্ণতায় লস্কররা ভীত চমকিত হয়—সে-চোখ বুজে থাকে নিবিড়ভাবে। খোদা আছেন : সর্বশক্তিমান বিশ্বনিয়ামক খোদা। 

ধ্যানমগ্ন মুহূর্ত পিছলে পিছলে যায়, ক্রমে ক্রমে ওধারে জানালা গলে এবার আলো আসে ভেতরে। যে-পবিত্রতা একসময় সূর্যালোকের কুৎসিত প্রখরতায় নিঃশেষ হয়ে যাবে, সে-পবিত্রতা এবার ঘোষণায় পরিণত হচ্ছে। সারেঙ্গের চোখ ছলছল করে, নিমীলিত চোখের প্রান্তে তার আভাস স্তিমিত-হয়ে ওঠা বৈদ্যুতিক আলোতে চকচক করে। মানুষ জানে না—অনুভব করে না খোদাতালার অস্তিত্ব। সূর্যালোকে মানুষ দুনিয়া দেখে, দেখে পরস্পরের পাপ-পঙ্কিলতা, এবং খোদার দান সূর্যালোক হয়ে ওঠে কদর্য। যে-অশ্রু নিমীলিত চোখের প্রান্ত শুধু চকচক করছিল, ছুরা ফাতেহা পড়তে গিয়ে এবার তা ছাপিয়ে ওঠে। জাহাজী জীবনই সারেঙ্গের অস্তিত্ব, আর সমগ্র দুনিয়ায় ঘুরে সে সত্যিকার জীবনকে জেনেছে। কোটি-কোটি মানব যে-পথে চলে তোমার অপার রহমান লাভ করেছে—সেই পথে আমাকে পরিচালিত করো : আমার জীবন-পথ তোমার কৃপায় সিক্ত করো। কিন্তু সারেঙ্গ একটা কথা ভাবে। সে বৃদ্ধ হয়েছে, বাঙলার বন্দরে পৌঁছে এবার সে এ-জাহাজী জীবন থেকে চিরতরে বিদায় নেবে। এবং খোদা তো তার এ-দীর্ঘ সামুদ্রিক জীবন-পথ তাঁর কৃপা ও করুণায় সিক্ত করেছেন, তাই জীবন-পথ করুণায় সিক্ত করবার জন্যে আর কেন প্রার্থনা? 

দীর্ঘ মোনাজাত শেষ হতেই তার হাত দুটো যেন হঠাৎ অবশ হয়ে কোলের ওপর পড়ে গেল, ঈষৎ মুখ ফিরিয়ে পোর্টহোল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সারেঙ্গ স্তব্ধ হয়ে গেল। কেবিনের আলো ইতিমধ্যে ম্লান হয়ে উঠেছে, আর বাইরের আলো হয়ে উঠেছে স্পষ্ট। ঘর ও বাইরের আলোর মধ্যে এবার দ্বন্দ্ব চলছে। ঠিক যেন এ-রকম দ্বন্দ্ব অন্য কোথাও চলছে। কোথায়? খোদার অস্তিত্ব বিশ্বময় বিরাজমান, সারেঙ্গের অন্তরে-ও এক অস্তিত্ব : এ-দুই অস্তিত্বে কি দ্বন্দ চলছে? সারেঙ্গ স্তব্ধ। কিন্তু ঘরের আলো শীঘ্র ম্লান ও নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। তা উঠুক, তবে কী-একটা প্রশ্ন—অতি অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য-প্রায় কী-একটা প্রশ্ন থেকে-থেকে মাথানাড়া দিয়ে উঠছে। দীর্ঘ জীবন-তো অতিক্রান্ত হল প্রায়, কর্মজীবনের অবসান ঘনিয়ে এসেছে, কিন্তু তুমি আমাকে কী দিলে, আর আমি তোমাকে কী দিলাম? সারেঙ্গ কিছু চঞ্চল হয়ে উঠল : পবিত্র প্রভাত—এ-সময়ে বেদনার মতো অবসাদ ঘনিয়ে উঠছে কেন মনে। সে-অবসন্ন মনের কোণে দুর্বোধ্য-প্রায় প্রশ্নটি বারে বারে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, আর তার প্রতিটি ধ্বনি শূন্য গহ্বরে যেন আওয়াজ করছে—অর্থহীন শূন্যতায় যার কোনো উত্তর মিলছে না। অতিক্রান্ত দীর্ঘ জীবন অদ্ভুতভাবে শূন্য ও ব্যর্থ ঠেকছে কঙ্কালের চোখের মতো। 

সারেঙ্গ নিশ্চল। অন্তরে কান্নাও স্তব্ধ। 

কার্গো-উইঞ্চ নীরব হয়েছে। পোশাক পরে করিম সারেঙ্গকে বেরুতে হল। গলির মুখে পৌঁছতেই দেখলে ভেতরে দুটি অস্পষ্ট মূর্তি; এদিকেই তারা আসছিল—সারেঙ্গকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। সারেঙ্গ এগিয়ে গিয়ে দেখলে নতুন লস্করটা দাঁড়িয়ে; পেছনে মতিন কাসাব-ও রয়েছে। 

—কী অ’ডা ছাত্তার? 

ছাত্তার কী যেন বলবার চেষ্টা করলে, কিন্তু তার ঠোঁট কেঁপে থেমে গেল। সারেঙ্গ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার পানে, তাকিয়ে বুঝলে কিছু গোলযোগ ঘটেছে। তারপর সারেঙ্গ মতিনের পানে তাকাতেই সে দ্রুতভঙ্গিতে এগিয়ে এল দু পা, যেন সারেঙ্গের প্রশ্নসূচক দৃষ্টির অপেক্ষাতেই সে ছিল। 

মতিন চট্টগ্রাম অধিবাসী, সারেঙ্গ-ও। স্ব জিলার ভাষায় দ্রুতভাবে চাপা উত্তেজনায় সে যা বললে তার সারাংশ এই : প্রায় গত সন্ধ্যা থেকে ছাত্তার কার্গো-উইঞ্চে কাজ করছিল। চিফ অফিসারের হুকুম ছিল যে শেষরাতের মধ্যেই মাল তোলা শেষ করতে হবে, কিন্তু অত মাল কি এত তাড়াতাড়ি তোলা যায়? উইঞ্চটা দুর্বল, তবু তার ক্ষমতার অধিক মাল এক-একবার নিয়ে অবিশ্রান্ত মাল তোলা হয়েছে। উইঞ্চম্যান ও লস্কররা এক মুহূর্ত বিরাম দেয় নি, ক্রমাগত খেটেছে। ছাত্তারের শরীরটা কিছুদিন যাবৎ ভালো যাচ্ছে না, তাই সারারাত একটানা খেটে সে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তখন ভোর হয়েছে। উইঞ্চের আংটা ডকে মাল তুলছে—এই ফাঁকে হ্যাচওয়ের পাশে বসে ছাত্তার একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে চিফ অফিসার রুক্ষ মেজাজে তদারক করতে এসে দেখলে সে বসে রয়েছে। অমনি কোনো কথা নেই—এগিয়ে এসে তীব্রভাবে ক-টা লাথি দিয়ে দাঁড় করাল তাকে। 

সারেঙ্গ শুনলে। শুনে কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে রইল। তার চোখে আগুন জ্বলে উঠছিল, কিন্তু সংযত হয়ে আস্তে শুধু বললে : 

—যা, আঁই দেইক্যুম। 

তার কণ্ঠে হয়তো একটু স্নেহের কোমলতা ছিল, এবং তারই আভাস পেয়ে ছাত্তার হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সারেঙ্গ চমকিত হয়ে তাকাল তার পানে, কিন্তু পরমুহূর্তে আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কিন্তু কান্নায় মানুষ বিচলিত না হয়ে পারে না, তার ওপর সময়টা এমন : শান্ত প্রভাত, সূর্যালোক এখনো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নি, জাহাজের এখনো জ্বলন্ত আলোগুলোতে রাত্রির আভাস। তাছাড়া ছাত্তারকে দেখেও মায়া হয়। অল্প বয়স, লস্কর-জীবনের এই তার প্রথম অভিজ্ঞতা : এ-জীবনের অনাত্মীয় নিঃসঙ্গতা ও নীরস নির্মম কাঠিন্যে এখনো হয়তো সে নিজেকে খাপ খাইয়ে উঠতে পারে নি, হয়তো বাড়ির জন্যে ও স্নেহমমতার জন্যে মন তার এখনো কাঁদে। 

কয়েক মুহূর্ত করিম সারেঙ্গ কোনো ভাষা পেল না। সে কি ইদানীং দুর্বল হয়ে উঠেছে : কিন্তু হঠাৎ সে কঠিন হয়ে উঠল, দ্রুতভাবে বললে : যা যা—দেইক্যুম আঁই। একটু থেমে কেমন গভীর তিক্ততায় শুধু বললে : হেতেরা কি মানুষ? 

তীর রেখার মতো হয়ে অবশেষে মিলিয়ে গেল। দিনটা আজ ঝকঝকে শান্ত। আকাশ নিবিড় নীল; বীর্যহীন সাদা সাদা হালকা মেঘ দূরে দূরে নির্জীব হয়ে রয়েছে। এমন দিনে হয়তো সারেঙ্গের মন স্নিগ্ধতায় ভরে উঠতে পারত, কিন্তু কেমন একটা চাপা ক্রোধে তার মনটা থেকে-থেকে জ্বালা করে উঠছে। লস্করদের ওপর এমনি অত্যাচার সময়-সময় হয়ে থাকে বটে, কিন্তু ছাত্তারের ব্যাপারটা তাকে বিচলিত করল। ছাত্তারের বয়সই-বা কী : এ-বয়সেও ছেলেরা স্বপ্নে মায়ের কোল দেখে। তাছাড়া এ-পর্যন্ত দুনিয়ায় সে কেবল স্নেহ-মমতাই দেখেছে, মানুষে-মানুষে হিংসা-বিদ্বেষের অভিজ্ঞতা তার এখনো হয় নি, এবং এ-পর্যন্ত যা বা দেখেছে—তা ব্যতিক্রম ভেবে নিশ্চিন্ত রয়েছে, জানে নি যে এটাই দুনিয়ার রীতি। সদ্য গ্রাম থেকে এসেছে বলে এখনো তার ধারণা—সব মানুষ সমান : মানুষে-মানুষে পদ ও সামাজিক স্তরের জন্যে যে ঢের প্রভেদ আছে—এ-জ্ঞান আজো তেমন স্পষ্ট হয় নি। করিম সারেঙ্গের প্রতি তার যে-ভয় ও শ্রদ্ধা রয়েছে, তা পদের জন্যে নয়-পিতৃসুলভ মর্যাদার জন্যে। 

স্নেহ-বেদনায় সারেঙ্গের অন্তর কেমন করে ওঠে। কিন্তু সে কি ইদানীং দুর্বল হয়ে উঠেছে? শক্ত হয়ে ওঠে সারেঙ্গ। সে-সময়ে ছাত্তারের সামনে অসাবধানতায় একটু তিক্ততা প্রকাশ পেয়েছিল—সে প্রশ্ন করেছিল : তারা কি মানুষ?-এটা অনুচিত হয়েছে। বৃহত্তর দুনিয়ার পঙ্কিলতায় সে যখন এসে নেবেছে তাকে শিখতে ও জানতে হবে সবকিছু : অন্তরের দয়ামায়ার কোমলতা-দৌর্বল্য দূর করে তীক্ষ্ণ ধারালো কাঠিন্যে সে-অন্তর শক্ত ও প্রতিঘাতী করে তুলতে হবে, নইলে বাঁচতে পারবে কি সে এ-দুনিয়ায়? তাকে মানুষ হতে হলে প্রথমে মানুষের লাথি খেতে হবে। 

সরু লোহার সিঁড়ির গোড়ায় করিম সারেঙ্গের দেখা হল এঞ্জিন-ঘরের সারেঙ্গের সাথে, কিন্তু কোনো কথা হল না। আড়চোখে তাকাল লোকটি, কিন্তু অন্যমনস্কভাবে করিম সারেঙ্গ ওপরে উঠে গেল। ওদিকে আকাশে আর নিস্তরঙ্গ সাগর ছুঁয়ে ছুঁয়ে সাদা পাখি উড়ছে : উড়ছে না তো যেন শান্তিতে ভাসছে। আর ব্রিজের রেলিং ধরে দণ্ডায়মান চিফ অফিসারের দাঁতগুলোও সাদা : ধোপদুরস্ত সাদা পোশাকের মধ্যেও তার দাঁতের সে-শুভ্রতা নজরে পড়ে। কাপ্তানের গালদুটো গাঢ় লাল্‌চে, ফুলোফুলো, মদের সঞ্চিত রসে চকচকে। আর চোখ সাগরের মতো নীল। ওই যে দেখছ তীর-রেখাশূন্য অকূল সমুদ্র—এ-সমুদ্র আমার : কথা বোলো না, লাথি খাবে। আর জাহাজের কোনো প্রান্তে ছাত্তার হয়তো ম্রিয়মাণ হয়ে রয়েছে। কিন্তু তাকে এ-কথা কে বোঝাবে যে মান সবার জন্যে নয়, জুতোকে জুতো ভাবলে চলবে না এ-পৃথিবীতে, আর পৃথিবীর প্রাণ গোলামির রক্তে। কাপ্তানের চোখ চিকমিক করে : ভ্রূ কুঁচিয়ে সে তাকিয়ে রয়েছে দূরে—সমুদ্র দেখছে, এবং প্রত্যয়ে নিষ্কম্প সে-দৃষ্টি। ওদিকে পাখি উড়ছে, উড়ছে, ঘুমের পাখা মেলে প্রশান্তিতে ভাসছে। 

চারটে লস্কর ওধারে ডেক-ধোয়ামোছায় লিপ্ত। আরেক স্থানে আরো কয়েকজন গোল হয়ে বসে জীর্ণ ক্যানভাসে মোটা মোটা ছুঁচ ফুড়ছে। জাহাজের কোনো অংশে হয়তো রং চটেছে, তাই দুটো কাসাব বড় একটা গামলায় রং গোলাচ্ছে উবু হয়ে। 

ডেক ধোয়ায় লিপ্ত লস্কররা একটা অশ্লীল ইয়ার্কি করে হাসিতে ফেটে পড়ছিল—প্রায় হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে নীরব হয়ে গেল। করিম সারেঙ্গ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। 

আঁই দেইক্যুম। করিম সারেঙ্গ আশ্বাস দিয়েছিল, এবং তার সে-আশ্বাসে ও কণ্ঠে ঈষৎ-স্পষ্ট স্নেহের আভাস পেয়ে ছাত্তার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। সে দেখবে। অর্থাৎ দেখে নেবে। কিন্তু কী আশ্চর্য—দুনিয়াতে যেন এমন কোনো শক্তি নেই যে-শক্তি চিফ অফিসারের হাসিতে বিস্ফারিত ঠোঁটে অনুতাপের ছায়া ঘনাতে পারে। অথচ সারেঙ্গের সাড়া পেয়ে লস্কররা উচ্ছ্বসিত হাসি-ও এক নিমেষে দমিয়ে ফেলতে পারে। কিছু দূর থেকে সারেঙ্গ আবার আড়চোখে তাকাল : ওরা তো মাথা নিচু করে রয় নি, নিকৃষ্টতম দৈন্য হেঁট হয়ে রয়েছে লজ্জাকর হীনতায়। 

হেতেরা কি মানুষ? কিন্তু কারা মানুষ? 

দীর্ঘ সামুদ্রিক জীবন অতিক্রান্ত হয়ে এল। পথের শেষে পৌঁছে পথের প্রারম্ভের কথা মনে পড়ে। তখন জাহাজগুলো ছিল হাঁদা-হাঁদা। বৈদ্যুতিক আলো তখন সব জাহাজে হয় নি। মনে পড়ে বড়-বড় লণ্ঠনগুলোর কথা—যার অস্পষ্ট আলো আজ স্মৃতির অস্পষ্টতার মধ্যে মিলিয়ে উঠেছে প্রায়। কিন্তু সে-কথাটি অতি স্পষ্টভাবে মনে পড়ে : স্নেহ-মমতার বন্ধনযুক্ত একটি এতিম ছেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সাতসাগর পাড়ি দিয়ে প্রচুর অর্থ করবার প্রবল আকাঙ্ক্ষায়। তবে অর্থলোভের চেয়ে-ও প্রবল ছিল একটা কৌতূহল : সাতটি তো সাগর, সাগরে-সাগরে তফাতটা কেমন? কিন্তু প্রথম যাত্রায় বুঝতে পারলে যে চোখের পানির মতো ঐ অকূল সাগর লবণাক্ত—যে-লবণাক্ত সাগর সর্বত্র এক : সাগরে-সাগরে কোনো প্রভেদ নেই। প্রথম-যাত্রা দ্বিতীয়-যাত্রা তৃতীয়-যাত্রা—অথচ সামুদ্রিক জীবনের প্রারম্ভে প্রত্যেকবার-ই সে ভেবেছে, আর নয়, এই যাত্রাই শেষ, আবার যাত্রাশেষে ভেবেছে জীবনের আসল কিছুই-তো দেখা হল না, এত সাধারণ হতে পারে না মানুষের জীবন। তারপর ক্রমে ক্রমে আশা-আকাঙ্ক্ষাশূন্য শান্ততা এল মনে। 

স্মৃতিমন্থনে অদ্ভুত বেদনা। যে-দিন কেটে গেছে, সে-দিন আর কখনো ফিরবে না। এবং জীবন যদি ব্যর্থ হয়ে থাকে, তবে ব্যর্থই হল। করিম সারেঙ্গের ভেতরটা যেন ফাঁপা, শূন্য, প্রচণ্ড ব্যর্থতায় রিক্ত। এবার সে-অন্তরে আবার সে-প্রশ্নটি অবুঝ গোঁয়ার ছেলের মতো গুমরে গুমরে উঠতে লাগল। তুমি কী দিলে আমাকে, আর আমি কী দিলাম তোমাকে। স্বীকার করি, কিছু অর্থ মিলেছে। কিন্তু সে-থেকে বঞ্চিত হলেই কি অধর্মের বন্যা ছুটবে, আর মিললেই কি ধর্মের বজ্র ঘোষণা হবে? দীর্ঘ জীবন-তো অতিক্রম করে এলাম, জীবনের এ-পিঠ ও-পিঠ উলটে-পালটে দেখলাম, তবু যৌবনে কল্পনায় যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে-স্বপ্নের বাস্তব রূপান্তর দেখলাম না। কিন্তু, তোমার রাহ্মানিয়তের সীমা নেই, তুমি-ই বলেছ। তবে অর্থ প্রাপ্তিতে তৃপ্ত মন তোমার সে-কল্পনাতীত অনন্ত করুণাসাগরে ভেসে তৃপ্তি পাবে কি? 

আঁই দেইক্যুম। আমি দেখব। আশ্চর্য, এখন সে-কথা উলঙ্গ পঙ্গুর মতো ঠেকছে। কিন্তু যদিও স্বপ্নের বাস্তব রূপান্তর ঘটে নি, বাস্তবে-বাস্তবে সংঘর্ষ-তো ঘটতে পারে। লস্কররা হাসছে নিচে, এখানে-ও তার কিছু আওয়াজ ভেসে আসছে। করিম সারেঙ্গের মুখ গাম্ভীর্যে নিশ্চল। মাথা কাত করে আড়চোখে চিফ অফিসার তাকাল। কী হয়েছে? লস্কররা ক্ষেপে গেছে? কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থেকে হঠাৎ সে হেসে উঠল উচ্ছ্বসিত গলায়। বটে, ক্ষেপেছে তারা, তাই তো তাদের উচ্চ হাসির আওয়াজ এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে। 

ধীরে ধীরে বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গ সরে এল। ছাত্তারকে আরেক অমূল্য জ্ঞান জানাতে হবে : অন্যায় করো, অথচ সে-অন্যায় সম্বন্ধে সজ্ঞান হয়ো না; হলেও কখনো তা স্বীকার করো না; আর, কারো অন্যায়ে কেউ যদি ক্ষেপে থাকে তবে এ-কথা ভেবো না যে সবাই ক্ষেপেছে। এমন ভাবা সুস্থ-মস্তিষ্কের পরিচায়ক নয়। 

.

মানুষ বিয়ে করে কিছুটা জৈবিক কারণে, কিছুটা স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত দেখবার জন্যে। তাছাড়া বৃদ্ধ বয়সে যৌবনক্ষয়ের রিক্ততা ও অসহায়তায় মানুষ ক্ষেপে ওঠে, তবু সন্তানের মধ্যে তা সঞ্চিত হতে দেখলে শান্তি পায়। করিম সারেঙ্গ নিঃসঙ্গ। তার ক্ষয় ক্ষয়ই : তার ভাঙা তীর অন্য কোথাও আর তীর গড়ছে না। 

মন কাঁদে কি? কিন্তু শূন্যতায় মন কাঁদে না। অন্তর শূন্য, জীবন-তো তাকে কিছু দিল না; আর সামনেও শূন্যতার আনন্ত্য। অতিক্রান্ত দীর্ঘ জীবন শূন্য কলসের মতো শুধু ঠনঠন করছে। 

কিছু নেই, তাই ছাত্তারের কথা বড় হয়ে মনে জাগছে। ছাত্তার হয়তো সে-লাথি হজম করতে পেরেছে, অন্তত তাই তো মনে হচ্ছে তার প্রশ্ন ও কৌতূহলশূন্য নির্বাকতায়। দুনিয়ার নিষ্ঠুরতায় শক্ত-কঠিন হয়ে ওঠা অভিজ্ঞ লস্কররা হয়তো তাকে বুঝিয়েছে, তার ভুল ভাঙিয়েছে। করিম সারেঙ্গের মনে কিন্তু গভীর যন্ত্রণা। দেখাবে বলে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত কী সে দেখাল—এ-কথা জানবার জন্যে ও ছাত্তার একবার তার কাছে এসে কৌতূহল জানাল না। তার ক্ষমতা হয়তো বুঝতে পেরেছে; অথচ তাকে দেখলে সে-ই আবার সন্ত্রস্ত হয়ে উঠবে। 

দিন তেমনি ঝকমকে, শান্ত। শুকনো ডেক খটখট করে জুতোর আওয়াজে। করিম সারেঙ্গ নিঃশব্দে হাঁটতে চাইছে, তবু জোরালো আওয়াজ হচ্ছে মেঝেতে। মাটির জন্যে -ঘাসভরা নরম মাটির জন্যে তার মনটা হঠাৎ কেমন করে উঠল। সাগর নেই : শক্ত মাটি, দোলা নেই : অর্থপূর্ণতায় স্থির জীবন। শতসহস্র ঢেউয়ের মাথায় নেচে সারাজীবন অবিরাম যাত্রা করে সে দেখলে, পৃথিবী শুধু গোল, আবার ঘুরে এসেছে যেখান থেকে রওনা হয়েছে। যাত্রার পর যাত্রা, এবং জীবন পূর্ণ না হয়ে উঠে বরঞ্চ ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেল, ফাঁপা হয়ে উঠল বিরাট শূন্যতায় 

অথচ চার্টরুম ঝকমক করে, আর ওধারে সে বিশ্ববিজয়ের গর্বে মাথা উন্নত করে সুখানি কামাল স্টিয়ারিং ধরে ঋজুদেহে মূর্তিবৎ স্তব্ধ হয়ে রয়েছে—চোখে তার সন্ধানী দৃষ্টি : সমুদ্রে সে পথ দেখছে।  

হামেদ লস্কর সোজা হয়ে দাঁড়াল। করিম সারেঙ্গ তার পানে না তাকিয়ে শুধু দ্রুতভাবে বললে : 

—ছাত্তারগারে ফাডাই দিয়ো তো— 

তারপর সে কেবিনে গেল। বিছানার চাদর ধবধব করছে, অথচ ওধারে পোর্টহোলের কাচে ধুলো, দাগ। 

অল্পক্ষণ পরে ছাত্তারের সামনে বহুদিন বাদে আজ করিম সারেঙ্গ হাসল। দাড়ি শুভ্র, কিন্তু তার চেয়ে-ও শুভ্র হাসি সে হাসল, তারপর কী যেন ভাবতে-ভাবতে তার সে হাসি আস্তে মিলিয়ে এল। কয়েক মুহূর্ত পর সে সচেতন হল, আবার সে হাসল, হেসে অক্ষম স্নেহে দুর্বল গলায় বললে : 

—অ’ডা, খালি লাথি এনা খাইয়ছ দে— 

কিন্তু সে-কথা বলার কথা নয়, অন্য কথা ছিল সারেঙ্গের মনে। তার জীবনে যদি গ্রন্থি পড়ত তবে ছাত্তারের মতো এমনি একটি ছেলে এমনিভাবে দাঁড়াতে পারত তার সামনে। একটু পরে সে শুধু প্রশ্ন করল : 

—বারিৎ কন আছে তোর? 

ছাত্তারের মা আছে, বাপ আছে, তাছাড়া তিনটি বোন দুটি ভাই-ও আছে। শুনল সারেঙ্গ—ক্ষুধার্তের মতো গোগ্রাসে শুনল। তারপর আবার আশ্চর্যভাবে স্তব্ধ হয়ে রইল। অবশেষে আস্তে বললে : 

—যা; এ’নে ডাক্যিলাম দে। 

সবাই রয়েছে ছাত্তারের, এবং এ-সংবাদ শোনার পর আর কোনো কথা বলবার নেই যেন করিম সারেঙ্গের। যেহেতু তার নেই কেউ। 

বিছানার চাদর ধবধব করে, দরজার ঝকঝকে পেতলের নবে গোল হয়ে পড়া ঘরের ছায়া, আর পোর্টহোলের কাচে ধুলো, দাগ। এই তার ঘর। পৃথিবী-ও। 

সন্ধ্যার পর সারেঙ্গ যখন কেবিনে, ছাত্তার তখন আরেকবার এল। 

—কী রে? 

লজ্জিত নত মুখে ছাত্তার কেবল বললে : 

—না, এনে আস্যি দে। 

কোনো প্রয়োজনে সে আসে নি, এমনি এসেছে। এবং এমনি এসেছে বলেই আস্তে-আস্তে এমনি কত কথা উঠল, আর তার মধ্যে সারেঙ্গের স্নেহ-ক্ষুধার্ত মন জোঁকের মতো ওর অন্তরের স্নেহমমতা শুষতে লাগল। ছাত্তারের অন্তর খুলে গেল, এবং একসময়ে সে কেমন করে কেঁদে উঠল। হঠাৎ, তারপর হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে কাঁদতেই থাকল। সারেঙ্গ স্তব্ধ-ভাবনার অতলে স্তব্ধ। ঝিকঝিকঝিক—জাহাজ চলছে, অথবা হয়তো মানুষের জীবনকে উপেক্ষা করে কাল চলছে সমাপ্তিহীন যাত্রায় অনন্ত তমিস্রার পানে। 

ছাত্তারের কান্না কখন আস্তে থেমে গেল। এবার সে মুখ তুললে, তুলে সারেঙ্গের পানে না তাকিয়ে বললে : 

—বারির লাই মন কাঁদে। 

স্বাভাবিক। সারেঙ্গ কোনো কথা বললে না। 

একটু নীরব থেকে ছাত্তার আবার বললে : 

—আর, বারির তুন পলাই আস্যি আঁই-ইয়ল্লাই মন আরো ব্যাশ কাঁদে জে। পালিয়ে আসার জন্যে মন আরো বেশি কাঁদে—তাও স্বাভাবিক। কিন্তু আবার না পালিয়ে বাপ-মায়ের চোখের সামনে দিয়ে কোনো ছেলে এ-নির্মম নিষ্করুণ জীবনে আসতে পারে না। কিন্তু হঠাৎ কী হল, সারেঙ্গ অপ্রত্যাশিতভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল : হয়তো একটা বিকৃত হিংসা ঝকে উঠেছে . মনে। পালিয়ে এসেছে সে, পালিয়ে? জাহাজী—জীবনকে কি খেলা ভেবেছে? পালিয়ে আসবার সময় কি এ-কথা ভেবেছে যে স্নেহের সমুদ্রে ভাসতে চলেছে?—অসহ্য ক্রোধে থরথর করে কাঁপতে লাগল সারেঙ্গের ঠোঁট। 

ছাত্তার হতবুদ্ধি, নিশ্চল। 

.

নদীর মোহানায় জাহাজ এক ঘণ্টা পরে, আর সন্ধ্যায় পৌঁছবে কলকাতা-বন্দরে। তাই করিম সারেঙ্গের সারা অন্তর কেমন তিক্ত বেদনায় জ্বালা করে উঠছে। সাগর আজ কিছু তরঙ্গায়িত। সমান দ্রুতিতে মালে-ভারি জাহাজটা অবিশ্রান্ত চলছে করিম সারেঙ্গকে তার শূন্য কর্মজীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে দিতে। এবার শেষ হবে তার সামুদ্রিক জীবন, এবার এ-অশান্ত জীবন থেকে সে মুক্তি পাবে। কিন্তু তারপরে কি শান্তি? 

লস্করদের মধ্যে চাপা চাঞ্চল্য। বন্দরে কাল জাহাজ পৌঁছবে। উইঞ্চম্যান কার্গো-উইঞ্চ নিয়ে ব্যস্ত : মরচে-ধরা পুরোনো উইঞ্চটার এখানে-সেখানে তেল ঢালছে; কিন্তু তেমন কাজ নেই বলে করিম সারেঙ্গ তার কেবিনে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। পোর্টহোল দিয়ে ঈষৎ তরঙ্গায়িত সাগর নজরে পড়ে। কিন্তু তীর দেখা যায় কি? কেমন একটা ভীতি সারাদেহে শীতলতা আনছে : তীর দেখার ভয় মৃত্যু-ভয়ের মতো ঠেকছে। সারেঙ্গ তীর দেখতে ভয় পাচ্ছে, তীর দেখতে সে চায় না আজ। এবং সে-তীরই তার মনে ভীতি সঞ্চার করছে, যে-তীরে কোটি-কোটি মানবের স্থবির জীবন স্নেহমমতার শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে মাটির মধ্যে শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে। 

ডান ধারের দেয়ালে ডিম্বাকৃতি স্বচ্ছ আয়না। সে আয়নায় সারেঙ্গের দৃষ্টি পড়ল, এবং সে-দেখল, এক বৃদ্ধ অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে তারই পানে। বৃদ্ধের মুখে দাড়ি, সে-দাড়িতে বর্ণহীন নিষ্ফল শুভ্রতা। 

.

সন্ধ্যার সময় জাহাজ বন্দরে পৌঁছল। লস্কররা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে লাইন নিয়ে; চাপা চাঞ্চল্যে তারা তাকাচ্ছে নিষ্প্রদীপ্তপ্রায় স্বপ্নালোকিত রহস্যময় বন্দরের পানে। 

করিম সারেঙ্গ ছাত্তারকে খুঁজে নিল। 

—অ’ডা গেয়া, খতা হুনি যা। তারপর অদ্ভুত মমতায় বললে, তুই বারিৎ যা গই, আর ন আইছ্। 

উইন্ডল্যাস ঘরঘর করছে : নোঙর পড়ছে। তার সামুদ্রিক জীবনেও কি নোঙর পড়ছে? 

কিন্তু এ-জীবন ছেড়ে কোথায় সে যাবে? দেশে আপনার বলতে কেউ নেই : সেখানে মমতাশূন্য শুষ্কতা। আত্মীয় যারা আছে তারা নামে আত্মীয়, দীর্ঘ বিচ্ছেদের জন্যে তার জীবনের সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই। ছাত্তারের যেমন সবাই আছে, তেমনি তার কেউ-ই নেই। অতএব ছাত্তার যাবে, সে থাকবে। আবার সে জাহাজে চুক্তি নেবে, এবং যদি পারে আমৃত্যু সমুদ্রের বুকেই বাস করবে। 

কিন্তু অন্তরের শূন্যতা কাটবে কি? তুমি কী দিলে আমাকে, আর আমি কী দিলাম তোমাকে : তার অন্তরে আর সমুদ্রের প্রতি তরঙ্গে সে-প্রশ্ন অবিরাম ধ্বনিত হবে হোক। সব কথার উত্তর মেলে না সব সময়, প্রশ্নের কাঁটার মধ্যেই-তো মানুষের জীবনের অবসান ঘটে। 

গ্যাঙ্গওয়ের পাহারায় ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক সুখানি—করিম সারেঙ্গ তার নাম জানে না। কয়েকজন লস্কর নাবছে মৃদুগুঞ্জন করে। সে-দলে ছাত্তারও রয়েছে। তার মুখে হয়তো মুক্তির ঔজ্জ্বল্য, তবে সে নত মাথায় নাবছে বলে ওপর থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ওপরের পানে মুখ তুলে একবার সে তাকাবে কি? রেলিং ধরে ঝুঁকে করিম সারেঙ্গ দাঁড়িয়ে রইল প্রেতের মতো আবছা হয়ে—চোখ দুটো তার দীনতায় বীভৎস হয়ে উঠেছে। 

ও তাকাল না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *