পরী

পরী

এক

মাঘ মাসের কুয়াশা ঢাকা নিশুতি রাত। নির্জন নিস্তব্ধ চারদিক। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। সাহাবুদ্দিন স্যর ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে শীতে কাঁপতে-কাঁপতে লেপের ভিতর ঢুকে জবুথুবু হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর হাত-পায়ের তালু বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে তিনি লেপের ভিতরে, কিন্তু হাত-পা গরম হচ্ছে না।

সাহাবুদ্দিন স্যর আজ নেছারাবাদ গিয়েছিলেন ওয়াজ-মাহফিল শুনতে। বড়-বড় অনেক আলেম-মাওলানারা ওয়াজ করেছেন সেখানে। ওয়াজের এক পর্যায়ে বিশিষ্ট আলেম হাফেজ মাওলানা মোঃ শওকত হোসেন যখন মৃত্যু ও পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে ওয়াজ করছিলেন তখন সাহাবুদ্দিন স্যরের চোখ বারবার ভিজে উঠছিল। কী ছোট্ট আমাদের এই জীবন! কিছু সময়ের জন্য এই পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছি আমরা। মৃত্যুর পরেই হচ্ছে আসল জীবন, অনন্ত জীবন। পৃথিবীতে আমরা যদি ভাল কাজ করি তা হলে মৃত্যুর পরে পাব অনাবিল চিরসুখের বেহেস্ত আর খারাপ কাজ করলে…

ওয়াজ শুনে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। বাড়িতে সাহাবুদ্দিন স্যর একা। দুই দিন আগে তাঁর স্ত্রী ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছেন। দুপুরের রান্না করা ঠাণ্ডা ভাত ছিল। একটা ডিম ভেজে সেই ঠাণ্ডা ভাতই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে ফেলেন। ভাত খাওয়ার পরই খুব শীত লাগতে লাগল। দেরি না করে লেপের ভিতরে ঢুকে পড়লেন।

অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, জলদি ঘুমানো উচিত। ভোরে ঘুম থেকে উঠে রান্না-বান্না করে, গোসল সেরে, খেয়ে দেয়ে স্কুলে যেতে হবে। কিন্তু শীতে ঘুম আসছে না। তা ছাড়া ওয়াজে শোনা আলেমদের বিভিন্ন কথা মাথার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সাহারা খাতুন হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক সাহাবুদ্দিন স্যর। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মাঝারি উচ্চতা। স্বাস্থ্য ভাল। মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি ছোট করে ছাঁটা। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। উঁচু নাক। সহজ-সরল চোখের চাহনি। অত্যন্ত সাদাসিধা ভদ্র গোছের মানুষ।

আজকে ওয়াজ শুনে সাহাবুদ্দিন স্যর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-তিনি জীবনে আর কোন দিন কোন পাপের কাজ করবেন না। এমনিতেও তিনি তেমন কোন পাপের কাজ করেন না, মাঝে-মাঝে হয়তো নিজের অজান্তে ছোট-খাট দু’একটা পাপ করে ফেলেন। আজ থেকে ছোট-খাট পাপও আর করবেন না।

ভাবতে-ভাবতে কখন যেন সাহাবুদ্দিন স্যর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। দরজায় অনবরত কড়া নাড়ার শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’

‘মাস্টার সাহেব, আমি। দরজাটা খোলেন।’

সাহাবুদ্দিন স্যর চমকে উঠলেন। একটা নারী কণ্ঠ। এত রাতে মেয়ে মানুষ! তিনি ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠলেন। গলায় সন্দেহ নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত রাতে! কে আপনি???

‘দরজাটা খোলেন, তা হলেই বুঝতে পারবেন আমি কে।’

সাহাবুদ্দিন স্যর আলো জ্বেলে দরজা খুললেন। দরজা খুলে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। দরজার সামনে উলঙ্গ এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ। অত্যন্ত মিষ্টি চেহারা। সারা শরীরে উপচে পড়া যৌবনের ঢেউ।

মেয়েটা সাহাবুদ্দিন স্যরের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল। চেহারায় আহ্বানের হাতছানি।

সাহাবুদ্দিন স্যর ‘অস্তাক ফিরুল্লা’ বলে খটাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

বন্ধ দরজার ওপাশে মেয়েটা খিলখিল করে হেসেই চলছে। নিঝুম রাতে হাসির শব্দটা কেমন অদ্ভুত গা ছমছমে লাগছে।

প্রচণ্ড শীতের মাঝেও ঘরের ভিতরে সাহাবুদ্দিন স্যর ঘেমে নেয়ে উঠলেন। তাঁর বুকের ভিতরটাও টিপটিপ করছে। উলঙ্গ মেয়েটা কে!? রাস্তার কোন পাগলি! পাগলি তাঁর কাছে কী চায়! গত এক মাসেও তো রাস্তায় কোন পাগলি চোখে পড়েনি! এমন নিশুতি রাতে মেয়েটা কোত্থেকে এল! প্রচণ্ড এই শীতের মাঝেও মেয়েটা কী করে বিবস্ত্র অবস্থায় স্বাভাবিক আছে!

বিভিন্ন চিন্তা মাথার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে সাহাবুদ্দিন স্যরের। মেয়েটার মুখের আদলটা কেমন পরিচিত পরিচিত লাগছে। এর আগে কোথায় যেন দেখেছেন, ঠিক মনে করতে পারছেন না।

মেয়েটার একঘেয়ে হাসির শব্দ এক সময় থেমে গেল। দূর থেকে ভেসে এল ফজরের আযানের ধ্বনি।

দুই

সকালে নাওয়া-খাওয়া কিছুই করলেন না সাহাবুদ্দিন স্যর। চেহারায় ছন্নছাড় ভাব নিয়েই স্কুলে চলে গেলেন। ভেবে রেখেছেন, একটা ক্লাস নিয়েই স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে ফিরে আসবেন। বলতে গেলে গত রাতটা সম্পূর্ণই নির্ঘুম কেটেছে।

স্কুলে যাওয়ার পথে চারপাশটা খুব ভালভাবে লক্ষ করলেন। না, রাস্তাঘাটে কোন পাগলি চোখে পড়েনি। গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোন ব্যাখ্যাই তিনি দাঁড় করাতে পারছেন না।

স্কুলে ঢোকার পর প্রথমেই দেখা হলো দপ্তরি হেদায়েতের সাথে। হেদায়েত পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করল, ‘ছ্যারের শ‍ইলডা খারাব নাহি? ক্যামন জানি দেহাইতেছে।

সাহাবুদ্দিন স্যর আস্তে করে বললেন, ‘রাতে ঘুম হয়নি।

হেদায়েত গলায় কৌতূহল নিয়ে বলল, ‘ক্যান, ছ্যার, ঘুম হয় নাই ক্যান?’

‘এমনি,’ বলে সাহাবুদ্দিন স্যর চলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে বললেন, ‘হেদায়েত, গত দু-এক দিনে রাস্তাঘাটে কোন উলঙ্গ পাগলি দেখেছ?’

হেদায়েত মুখে কিছুই বলল না, চোখ বড় বড় করে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, না, সে দেখেনি।

.

একটা ক্লাস শেষে হেডস্যর তাঁর রুমে সাহাবুদ্দিন স্যরকে ডেকে পাঠালেন।

স্কুলের হেডস্যর হচ্ছেন বদিউল আলম। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেঁটে-ঘাট, মোটাসোটা শরীরের অধিকারী। মাথায় সব সময় গোল টুপি পরে থাকেন। চোখে সুরমা লাগান। ক্লিন শেইভ। মাঝে-মাঝে পাঞ্জাবি পরে স্কুলে আসেন। গায়ে কড়া গন্ধের আতর মাখেন। সারাক্ষণ জর্দা দেওয়া পান খান। কাছে গেলে, জর্দা আর আতরের মিশ্রিত মাথা ঝিমঝিম করা এক ধরনের তীব্র গন্ধ পাওয়া যায়।

হেডস্যর বদিউল আলমের বিরুদ্ধে স্কুলের মেয়েদের অনেক অভিযোগ রয়েছে। তিনি নাকি সব সময় মেয়েদের বুকের দিকে কুকুরের মত তাকিয়ে থাকেন। স্কুলের কোন মেয়ে ছুটি চাইতে বা অন্য কোন কারণে তাঁর কাছে গেলে তিনি মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে নানা রকমের প্রশ্ন করেন। ‘…কী জন্যে ছুটি লাগবে, সোনা?… অসুস্থ? …জ্বর হয়েছে?’ মেয়েদের কপালে-গালে হাত রেখে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থেকে, ‘কই, জ্বর তো নেই…তা হলে?’ মাঝে মাঝে খুবই আপত্তিকর প্রশ্নও করে ফেলেন, ‘লক্ষ্মী সোনা, তোমার কি এখন ঋতুকাল চলছে?’

মেয়েরা আড়ালে-আবডালে তাঁকে লুচ্চা হেডস্যর বলে ডাকে। তাঁর চরিত্রের ওই সর গুণাবলীর জন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দিনে-দিনে কমে যাচ্ছে।

সাহাবুদ্দিন স্যর, হেডস্যরের মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন। হেডস্যরের মুখ হাসিহাসি। চেহারায় কৌতূহল লুকোচুরি খেলছে।

হেডস্যর পিকদানিতে পানের পিক ফেলে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পান চিবুতে চিবুতে গলায় যতটা সম্ভব গাম্ভীর্য এনে বললেন, ‘আপনাকে তো ভাল মানুষ বলেই জানতাম, এ-কী শুনলাম আপনার নামে!’

সাহাবুদ্দিন স্যর অবাক হয়ে বললেন, ‘কী শুনেছেন?’

‘গত রাতে আপনি নাকি একটা উলঙ্গ পাগলিকে নিয়ে রাত কাটিয়েছেন! তাই সারা রাত নাকি ঘুমাতে পারেননি।’

সাহাবুদ্দিন স্যর ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। স্কুলের দপ্তরি ধূর্ত হেদায়েত যে এমন কথা রটাচ্ছে তা বুঝতে তাঁর দেরি হলো না।

হেডস্যর আবার গম্ভীর গলায় বললেন, ‘দেখুন, আমাদের স্কুলের একটা সম্মান আছে, ‘স্কুলের শিক্ষকদের সম্মান আছে। এখন যদি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, গার্ডিয়ানরা জানতে পারে যে স্কুলের কোন এক শিক্ষক রাস্তা থেকে পাগলি ধরে এনে রাত কাটায়, তা হলে কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন! আমাদের মান-মর্যাদা-সম্মান কোথায় যাবে?’

হেডস্যর নুয়ে মেঝে থেকে পিকদানি তুলে পানের ছিবড়া ফেলে আবার বললেন, ‘স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বাড়িতে নেই এই সুযোগে আপনি এমন একটা অপকর্ম করবেন! বুঝি পুরুষ মানুষের স্বভাব হচ্ছে পাখির মত উড়ে-উড়ে এক ডাল থেকে আর এক ডালে বসা। এক ডালে বেশিক্ষণ ভাল লাগে না। তাই বলে রাস্তা থেকে পাগলি ধরে এনে…শহরে গিয়ে কোন হোটেলে রাত কাটাতে পারতেন। আজকাল তো প্রায় সব হোটেলেই…’

হেডস্যরের এ ধরনের কথাবার্তা শুনে ঘেন্নায় মাথা নুইয়ে বসে থাকেন সাহাবুদ্দিন স্যর। কথাবার্তার এক পর্যায়ে হেডস্যর টেবিলের উপরে ঝুঁকে সাহাবুদ্দিন স্যরের দিকে মুখ বাড়িয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মত নিচু গলায় বললেন, ‘তা পাগলিটাকে পেয়েছিলেন কোথায়?…বয়স কেমন? দেখতে নিশ্চয়ই সুন্দর?…’

সাহাবুদ্দিন স্যর হেডস্যরের রূম থেকে বেরিয়ে সরাসরি বাসায় ফিরে এলেন। তাঁর নিজের উপর খুব রাগ লাগছে। কেন যে স্কুলের দপ্তরি দুষ্টমতি হেদায়েতের কাছে উলঙ্গ পাগলির কথা জিজ্ঞেস করতে গেলেন। এখন হেদায়েত আর বদ চরিত্রের হেডস্যর বদিউল আলম দু’জনে মিলে আরও কত কী রটায় তার কোন ইয়ত্তা নেই।

সাহাবুদ্দিন স্যর টের পেলেন প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। এখন বেলা বারোটা। রান্না-বান্না করে, গোসল সেরে, পেট ভরে খেয়ে এক চোট ঘুমানো দরকার। ঘুম থেকে উঠে গত রাতের সেই নগ্ন পাগলিকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

তিন

মাগরিবের আযানের শব্দে সাহাবুদ্দিন স্যরের ঘুম ভাঙল। ওযু করে তিনি মাগরিবের নামাজ আদায় করলেন।

গতকালের চেয়ে আজকে শীত যেন আরও বেশি পড়েছে। ভালভাবে শীতের পোশাক পরে তার উপরে একটা চাদর জড়িয়ে, মাফলার দিয়ে মাথা, কান, গলা পেঁচিয়ে, চা খাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বাইরে বেরুলেন সাহাবুদ্দিন স্যর। শীত থেকে রক্ষার এত ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও গায়ে যেন শীতের কাঁটা বিধছে। অবশ্য শীতের দিনে ঘুম থেকে জাগার পরে বেশ কিছুক্ষণ শীতটা বেশি অনুভব হয়। ধীরে-ধীরে গা গরম হয়ে শীত কমে যায়।

সাহাবুদ্দিন স্যর চায়ের দোকানে অনেকক্ষণ ধরে বসে রইলেন। দুই কাপ চা আর চার পিস সল্টেড বিস্কিট খেয়ে শেষ করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল চায়ের দোকানের লোকজনের আলাপ আলোচনা শুনে আন্দাজ করবেন এলাকায় কোন পাগলির আবির্ভাব ঘটেছে কিনা। কমবয়সী পাগলি রাস্তাঘাটে উলঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়ালে, তা যে কারও-কারও আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু হবে তাতে তো কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু পাগলি নিয়ে কোন আলাপ- আলোচনাই শোনা গেল না।

সাহাবুদ্দিন স্যর চায়ের দোকান থেকে উঠে একটা ফোনের দোকানে গিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছে ফোন করলেন।

মোবাইল ফোনের এই স্বর্ণ যুগেও তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। মোবাইল ফোনকে তাঁর কাছে একটা বাড়তি ঝামেলা বলে মনে হয়। কথা নেই বার্তা নেই যখন-তখন পকেটের মধ্যে টুং-ট্যাং করে বেজে ওঠা। নিজের ব্যক্তিগত মুহূর্ত বলে কিছু থাকে না। সময়ে অসময়ে কেউ একজন ফোন করে প্যাচাল শুরু। কই আগের দিনের মানুষের তো মোবাইল ফোন ছিল না, তারা সুন্দরভাবে জীবন কাটাত না? বর্তমানের চেয়ে বরং আগের মানুষের জীবন আরও সুখী, আনন্দময়, সাবলীল ছিল।

সাহাবুদ্দিন স্যরের স্ত্রীর ফিরতে আরও তিন দিন লাগবে। স্ত্রী হ্যান-ত্যান অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে, ‘…তুমি ভাল আছো তো? শরীর সুস্থ তো? প্রতিবার শীতে তো ঠাণ্ডা লাগিয়ে বসো, ঠাণ্ডা লাগেনি তো? খাওয়া-দাওয়া ঠিক মত হচ্ছে তো?…’

যত সব আলগা দরদ! স্ত্রীর এ ধরনের ন্যাকামি সাহাবুদ্দিন স্যরের কাছে অসহ্য লাগে। এমন ভান করে যেন স্বামীর চিন্তায় সে অস্থির। অথচ… নারী জাতি মানেই ভান। মনে এক আর মুখে আর এক। অন্তরে বিষ মুখে মধু।

স্ত্রীর কাছে গত রাতের সেই পাগলির কথা মোটেই উল্লেখ করেন না। স্ত্রী এমনিতেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। কী বলতে কী বুঝবে। শেষে দেখা যাবে দপ্তরি হেদায়েত আর হেডস্যরের মত ভয়ঙ্কর কিছু ভেবে বসবে।

স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলা শেষে, ফোনের দোকান থেকে বেরিয়ে এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় রাস্তায় হাঁটাহাঁটি শুরু করেন। তাঁর উদ্দেশ্য গত রাতের পাগলিটার যদি দেখা মেলে।

পাক্কা দুই ঘণ্টা এলাকার প্রায় সব রাস্তা, অলি-গলিতে ঘোরাঘুরি করেও কোন পাগলির দেখা মেলে না।

সাহাবুদ্দিন স্যর যখন বাসায় ফিরলেন তখন রাত সাড়ে নয়টা। ইলেকট্রিসিটি নেই। লোডশেডিং চলছে। শীতের দিনেও যে কেন লোডশেডিং হয় এর কোন ব্যাখ্যা নেই।

তিনি ঘরে ঢুকে মোম জ্বাললেন। মোমের টিমটিমে আলোতে ঘরটা সামান্য আলোকিত হওয়ার পরে, বিছানার উপরে চোখ পড়তেই তিনি চমকে উঠলেন। এতক্ষণ ধরে যে পাগলিকে সমস্ত এলাকায় খুঁজে বেড়িয়েছেন সেই পাগলি তাঁর বিছানার উপরে শুয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পা নাচাচ্ছে। সেই আগের মতই সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায়। পাগলির গা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

তাঁকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাগলি খুব স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল, ‘শীতের মধ্যে এত রাত পর্যন্ত বাইরে কী করেছেন?’

সাহাবুদ্দিন স্যর কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, তার আগেই সাগলি আবার বলে উঠল, ‘বাইরে গিয়ে প্রথমে চা খেয়েছেন, এর পরে স্ত্রীর কাছে ফোন করেছেন, তার পরে রাস্তায় রাস্তায় আমাকে খুঁজেছেন।’ কথা শেষ করে পাগলি খিলখিল করে হাসতে লাগল।

সাহাবুদ্দিন স্যর জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলেন, তুমি কে? তার আগেই পাগলি বলে উঠল, ‘আমি কে তা আপনার চেয়ে কেউ ভাল জানে না!’

সাহাবুদ্দিন স্যর খুবই অবাক হলেন। পাগলি কি তাঁর মনের কথা বুঝতে পারছে! কিছু বলার আগেই পাগলি নিজে থেকেই বলে উঠছে।

পাগলি আবার খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, ‘ঠিকই ধরেছেন। আপনি যা ভাবেন আমি তা বুঝতে পারি, আপনি যা জানেন আমিও তা জানি।’

পাগলির বলা শেষ হতেই সাহাবুদ্দিন স্যর বলে উঠলেন, ‘আমি যা ভাবি তা তুমি বুঝতে পারো! আমি যা জানি তা তুমিও জানো! এর মানে কী? ‘বুঝলেন না আপনার মনের নাড়ী-নক্ষত্র সবখানেই আমার বিচরণ। সাহাবুদ্দিন স্যর চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘তা হলে আমার মনের এমন কোন গোপন কথা বলো তো যা আমি ছাড়া এই পৃথিবীর আর কেউ জানে না।’

‘এটা তো খুব সহজ কাজ। শুনুন তা হলে আপনার মনের কিছু গোপন কথা। আপনি আপনার স্ত্রী রুমাকে মোটেই পছন্দ করেন না। বিয়ের সময়ই তাকে আপনার পছন্দ হয়নি। এর পরেও তাকে বিয়ে করেছেন তার বাপের টাকা-পয়সা দেখে। আপনার স্ত্রীর গায়ের রং যেমন ময়লা তেমন বিদঘুটে চেহারা, তার উপরে রাতে যখন আপনার পাশে সে শোয় তখন তার গা থেকে ঘামের বিশ্রী বোটকা গন্ধ পান। সব কিছু মেনে নিয়ে মুখ বুজে পড়ে আছেন শুধু শ্বশুরের অগাধ টাকা-পয়সার লোভে। আপনার স্ত্রী তো আবার বাপের এক মেয়ে। শ্বশুরের মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি, টাকা-পয়সার মালিক হবে আপনার স্ত্রী। আর স্ত্রী মানেই তো আপনি। স্ত্রীকে তো ভয়ানক ভাবে সন্দেহও করেন। আপনার গায়ের রং কালো, স্ত্রীর গায়ের রং কালো তা হলে আপনার মেঝ ছেলেটা অমন ফর্সা রং, সুন্দর চেহারা পেল কী করে! মেঝ ছেলেটা চেহারা পেয়েছে আপনার শ্বশুরের ম্যানেজার আজিজ সাহেবের। আজিজ সাহেবের সঙ্গে তো আপনার স্ত্রীর দহরম-মহরম ভাব। স্ত্রী যে কেন এত ঘনঘন বাপের বাড়ি যায়…’

সাহাবুদ্দিন স্যর পাগলি মেয়েটার কথা শুনে ঝিম মেরে গেলেন। ভাবতে লাগলেন—মেয়েটা কে? কোত্থেকে এসেছে? কী করে তাঁর মনের গোপন কথা গড়গড় করে বলে যাচ্ছে! মেয়েটার মধ্যে অস্বাভাবিকতা বলতে সে উলঙ্গ, এ ছাড়া তার কথাবার্তা, লজিক শুনে মোটেই মনে হচ্ছে না সে মস্তিষ্কবিকৃত।

মেয়েটা সাহাবুদ্দিন স্যরের ভাবনা বুঝে ফেলল। খিলখিল করে হাসতে- হাসতে বলল, ‘আমি কে, কোত্থেকে এসেছি, তা আপনার চেয়ে কেউ ভাল জানে না।’

সাহাবুদ্দিন স্যর অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ‘তুমি উলঙ্গ কেন?’

‘আপনি আমাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে চান তাই আমি উলঙ্গ।

সাহাবুদ্দিন স্যর বেশ লজ্জা পেলেন। সত্যিই মেয়েটাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে তাঁর খুব ভাল লাগছে। অমন ভরা যৌবনা টসটসে একটা মেয়েকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে কার না ভাল লাগে।

মেয়েটা সাহাবুদ্দিন স্যরের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে দু-ঠোঁটে দুষ্টুমি আর কামনা মিশিয়ে রহস্যময় হাসি দিল।

সাহাবুদ্দিন স্যর প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলেন—তুমি কি ভূত-পেত্নী, জিন-পরী বা ওই জাতীয় কিছু—এমন সময় ইলেকট্রিসিটি চলে এল। ইলেকট্রিকের উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠতেই মেয়েটা একটা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি হয়ে হাওয়ায় মিশে গেল। আতংকে সাহাবুদ্দিন স্যরের মুখ হাঁ হয়ে গেল।

চার

এশার নামাজ শেষে, দোয়া-দরূদ পড়ে সাহাবুদ্দিন স্যর অনেকক্ষণ আল্লার কাছে কান্নাকাটি করলেন। একী হচ্ছে তাঁর সাথে! তাঁর মত সহজ-সরল একটা মানুষের উপর শেষ পর্যন্ত পরী ভর করেছে!

দোয়া-দরূদ পড়ে বুকে ফুঁ দেয়ার পর ভয় অনেকটাই কেটে গেছে। আরও একটা কথা ভেবে ভয় কেটেছে-পরীটা তো তাঁর কোন ক্ষতি করছে না, শুধু খিলখিল করে হাসে আর অপরূপ চেহারার রূপ ধরে নগ্ন অবস্থায় তাঁর চোখে ধরা দেয়। পরীটার শরীরটা বেশ আকর্ষণীয়, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভিতরের আদিম পশুটা জেগে উঠতে চায়। সাহাবুদ্দিন স্যরের মনটা খারাপ হয়ে গেল-ছিঃ-ছিঃ এসব কী কথা ভাবছেন তিনি।

অনেক রাত পর্যন্ত সাহাবুদ্দিন স্যর জেগে জেগে পরীটার কথা ভাবলেন। এই বুঝি পরীটা এল-সেই ভাবনায় বুকটা কেঁপে-কেঁপে উঠল। একটা ব্যাপার লক্ষ করে তিনি অবাক হলেন-পরীটার জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন। ভয় লাগছে আবার মনের ভিতর অন্য রকম একটা অনুভূতিও হচ্ছে।

ডিম লাইট জ্বেলে, সাহাবুদ্দিন স্যর বিছানায় শুয়ে পড়লেন। ঘর একেবারে অন্ধকার করতে ভয়-ভয় লাগছে।

শেষ রাতে আচমকা সাহাবুদ্দিন স্যরের ঘুম ভেঙে গেল। তাঁর শরীরের সঙ্গে একটা উষ্ণ নরম শরীর জড়িয়ে রয়েছে। ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটতেই পাশ ফিরে ডিম লাইটের অস্পষ্ট আলোতে দেখেন পরী মেয়েটা তাঁকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রয়েছে। খুব একটা খারাপ লাগছে না, তবে কিছুটা ভয়- ভয় লাগছে।

সাহাবুদ্দিন স্যর মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, ভোর হতেই ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে চলে যাবেন। ফিরবেন একেবারে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সঙ্গে নিয়ে। কোন বাড়িতে, একা একটা মানুষ থাকলেই দেখা

যায়-ভূত-পেত্নী বা জিন-পরী আছর করে। তাঁকেও একলা পেয়ে পরীটা তাঁর উপর আছর করেছে।

পাঁচ

সাহাবুদ্দিন স্যর শ্বশুর বাড়ি থেকে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ফেরার পরে আবার আগের মতই তাঁর নির্ঝঞ্ঝাট ঝামেলাহীন সহজ-সরল জীবন চলতে শুরু করে। সেই রাতের পর আর তিনি পরীটার দেখা পাননি। পরীর আছরের কথা কাউকে তিনি বলেনওনি, এমন কী স্ত্রীকেও নয়। স্ত্রীর প্রতি সন্দেহটা আগের মতই রয়েছে। রাতে স্ত্রী যখন তাঁর পাশে শোয় তখন আগের মতই স্ত্রীর গায়ের ঘামের বোটকা গন্ধে অন্য পাশে ফিরে মুখ বুজে পড়ে থাকেন। তখন সুন্দরী পরীটার কথা খুব বেশি মনে পড়ে।

চার-পাঁচ মাস পরে সাহাবুদ্দিন স্যরের স্ত্রী ছেলে-মেয়ে নিয়ে আবার সপ্তাহখানেকের জন্য বাপের বাড়ি বেড়াতে যান। বাড়িতে একলা পড়ে থাকেন সাহাবুদ্দিন স্যর। গতবারের সেই উলঙ্গ পরীর কথা এত দিনে তিনি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বেড়াতে যাওয়ার প্রথম রাতেই পরীটার আবার আবির্ভাব ঘটে। আগের মতই পরীটা খিলখিল করে হাসে আর মনের গোপন কথাগুলো বলে দেয়।

সাহাবুদ্দিন স্যরের তিন-চার দিন কেটে যায় পরীকে সঙ্গে নিয়েই। সারা দিন-রাত পরীটার সঙ্গে গুটুর গুটুর করে গল্প করেন আর মাঝে-মাঝেই মেতে ওঠেন আদিম খেলায়। তিন-চার দিন পর প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভরে ওঠে তাঁর মন। একী করছেন তিনি। ছিঃ-ছিঃ। তাঁর মত নম্র-ভদ্র একটা মানুষ শেষ পর্যন্ত সুন্দরী পরীর সঙ্গে…

সাহাবুদ্দিন স্যরের মনে পড়ে তাঁর বাল্যবন্ধু আতিকুর রহমানের কথা। আতিকুর রহমান একজন বড় সাইকিয়াট্রিস্ট। ঢাকার একটা মেন্টাল হসপিটালের সিনিয়র ডাক্তার। আতিকুর রহমান ভূত-পেত্নী, জিন-পরীতে মোটেও বিশ্বাস করে না। ভূত-পেত্নী, জিন-পরী সব কিছুর ব্যাখ্যাই তার কাছে আছে।

সাহাবুদ্দিন স্যর সিদ্ধান্ত নেন, ঢাকা গিয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু আতিকুর রহমানের কাছে পরী বিষয়ক সব কিছু খুলে বলবেন। খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তার কাছে সব কিছু খুলে বলতে লজ্জাও লাগবে না। বন্ধু নিশ্চয়ই কোন ভাল পরামর্শ দিতে পারবে।

সাইকিয়াট্রিস্ট আতিকুর রহমান বন্ধু সাহাবুদ্দিনের পরী সংক্রান্ত সব কথা শুনে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকেন। তিনি ভাবছেন মফস্বল শহরের স্কুল শিক্ষক সহজ-সরল বন্ধুকে কীভাবে বললে তাকে বোঝানো যাবে যে পরী সমস্যাটা সে নিজে-নিজেই সৃষ্টি করছে, বাস্তবে পরীর অস্তিত্ব বলে কিছুই নেই।

নীরবতা ভেঙে এক সময় গলা খাঁকারি দিয়ে আতিকুর রহমান মুখ খুললেন, ‘দেখ, সাহাবুদ্দিন, আমি যতটুকু জানি তুই একজন সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, আদর্শবান, নম্র-ভদ্র, লাজুক স্বভাবের মানুষ। তোর মত মানুষ সাধারণত মনের খারাপ ভাবনা বা কুপ্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয় না। তোর মত মানুষরা আদর্শ ও সততাকে আঁকড়ে ধরেই সারা জীবন পার করে দেয়। কিন্তু একটা বিষয় কি জানিস, প্রতিটা মানুষের মনের দুইটা দিক থাকে-একটা আলোকিত দিক অন্যটা অন্ধকার দিক। তা মানুষটা যতই ভাল হোক আর খারাপ হোক, তোর মত ভাল মনের মানুষদের মনের অন্ধকার দিকটা অবচেতন মনের খুব গভীরে গোপনে থাকে। আবার কেউ-কেউ ভাল মানুষের মুখোশ পরে থাকে অথচ তাদের মনের ভিতরের অন্ধকারটা যে কতটা বিস্তৃত তা তারা কখনওই প্রকাশ করে না। মুখোশের আড়ালে নিজের প্রকৃত রূপ লুকিয়ে রাখে। আজকাল খবরের কাগজ, পত্রিকা ঘাঁটলেই দেখবি-ষাট বছরের সাদাসিধা বৃদ্ধ, আট-নয় বছরের বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা সুন্দরী স্ত্রীকে ফেলে রেখে কেউ আবার গভীর রাতে কুৎসিত চেহারার কাজের মেয়ের কাছে যায়…এগুলো হচ্ছে মানুষের মনের কুপ্রবৃত্তি। তোর মত ভাল মনের মানুষরা মনের ওই সব কুপ্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় না দিয়ে মনের ভিতরেই দমিয়ে রাখে। কখনও কখনও দেখা যায় মনের সেই সুপ্ত কুপ্রবৃত্তিগুলো অন্যভাবে রূপ নিয়ে দেখা দেয়।

‘তোর কাছে যে উলঙ্গ পরীটা আসে সেই পরীর বসবাস তোর অবচেতন মনের অন্ধকারের গভীরে। তোর স্ত্রীর প্রতি অনীহা, সন্দেহ, দূরত্ব থেকে সুন্দরী পরীটা তোর মনের ভিতরে জন্ম নিয়েছে। তোর অবচেতন মন সারাক্ষণ চায় অমন একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গ। তুই যেমন নম্র-ভদ্র তেমন লাজুক, ভীতু স্বভাবের। বাস্তবে কোন সুন্দরী মেয়ের কাছে গিয়ে তোর চাহিদা পূরণের পথে ভয়, চক্ষুলজ্জা যেমন বাধা দেয় তেমন চেতন মনের বিবেকটাও সারাক্ষণ আগলে রাখে। ওদিকে মনের গভীরে অন্ধকারটা তো দিনে-দিনে বেড়েই চলছে। এক সময় অবচেতন মন নিজে-নিজেই সৃষ্টি করে নেয় সুন্দরী উলঙ্গ পরী।

‘আমি যা বলছি তা যে যুক্তিসঙ্গত তুই নিজেও একটু ভালভাবে বিশ্লেষণ করে ভাবলে বুঝতে পারবি। তুই নিজেই বলেছিস পরীটাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তুমি কে? কোত্থেকে এসেছ?’ তখন পরীটা উত্তর দেয়, ‘আমি কে, কোত্থেকে এসেছি তা আপনার চেয়ে কেউ ভাল জানে না।’ বাস্তবিকই তুই-ই জানিস পরীটা কোত্থেকে এসেছে। পরীটা তোর মনের ভাবনা বুঝতে পারে, তুই যা জানিস সে-ও তা জানে। কারণ সে তোর মনেরই একটা অংশ। তুই যখন বাড়িতে একা থাকিস তখনই পরীটার আবির্ভাব হয়। তোর স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে থাকাকালীন সময়ে পরীটা আসে না। এর মানে তোর একাকীত্বে অবচেতন মনের ভিতর থেকে পরীর সত্তা জেগে ওঠে। প্রথম দেখায়ই পরীটার মুখের আদল তোর কেমন পরিচিত পরিচিত মনে হয়েছে কারণ এমন চেহারার একটা মেয়ের কথা তুই সবসময় ভাবিস।

‘পরী মেয়েটা নিজে কিন্তু কখনওই বলেনি সে পরী। সে যে পরী তা তুই বুঝলি কী করে? নিজের কল্পনাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য তুই নিজেই নিজেকে বলেছিস সে পরী। তোর মনের একটা দিক পরী মেয়েটাকে চাচ্ছে আবার অন্য দিকটা চাচ্ছে না। মাঝে-মাঝে তুই নিজেও বুঝতে পারছিস কোথাও বড় রকমের কোন ভুল হচ্ছে। তুই যে তাকে চাচ্ছিস না এর বড় প্রমাণ হচ্ছে তুই তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমার কাছে এসেছিস। আবার তুই যে তাকে চাচ্ছিস সেটার যুক্তি হচ্ছে তার সম্পর্কে বলার সময় তোর গলায় ছিল আগ্রহ, আনন্দ আর উচ্ছ্বাস, চোখ-মুখ ছিল উজ্জ্বল। পরী মেয়েটার সঙ্গ তোর খুবই ভাল লাগে। তোর মন এখন কী চায় তা তুই নিজেও বুঝতে পারছিস না।

ডা. আতিকুর রহমান একটু থেমে প্রেসক্রিপশন লিখতে-লিখতে আবার বলতে লাগলেন, ‘পরীটার জন্ম তোর অবচেতন মনে। যখন থেকে তুই মনে- প্রাণে ভাববি পরী বলতে কিছু নেই, তখন থেকে দেখবি পরী আর আসে না। পরীর অস্তিত্ব বলতে বাস্তবে কিছুই নেই, শুধুই তোর মনের অতিকল্পনা।’

সাহাবুদ্দিন স্যর তাঁর সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুর কথা পুরোপুরি বিশ্বাস ও করেননি আবার অবিশ্বাসও করেননি। বন্ধুর কাছ থেকে ফেরার পথেই তিনি প্রেসক্রিপশনটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন।

পরী সত্যি হোক আর মিথ্যে, পরীর সঙ্গ তাঁর খুবই ভাল লাগে, তিনি পরীকে হারাতে চান না।

একটা কথা সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুকে বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। পরী তাঁকে একটা আংটি উপহার দিয়েছে। পরী বলেছে, আংটিটা সব সময় পরে থাকতে আর ওই আংটিটার দিকে তাকিয়ে যখনই পরীর কথা ভাববেন তখনই পরী উপস্থিত হবে। লাল হীরের পাথর বসানো চমৎকার একটা আংটি। আংটিটা যে-ই দেখে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। সামান্য স্কুল শিক্ষক এত দামী আংটি পেল কোথায়! সেদিন তো স্কুলের হেডস্যর বদিউল আলম জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘এত দামী আংটি আপনি পেলেন কোথায়?’

সাহাবুদ্দিন স্যর লজ্জিত গলায় বলেছেন, ‘শ্বশুরবাড়ি থেকে দিয়েছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পরী

পরী

কুসমি বললে, তুমি বড্ড বানিয়ে কথা বল। একটা সত্যিকার গল্প শোনাও-না।

আমি বললুম, জগতে দুরকম পদার্থ আছে। এক হচ্ছে সত্য, আর হচ্ছে—আরও-সত্য। আমার কারবার আরো-সত্যকে নিয়ে।

দাদামশায়, সবাই বলে, তুমি কী যে বল কিছু বোঝাই যায় না।

আমি বললুম, কথাটা সত্যি, কিন্তু যারা বোঝে না সেটা তাদেরই দোষ।

আরো-সত্যি কাকে বলছ একটু বুঝিয়ে বলো-না।

আমি বললুম, এই যেমন তোমাকে সবাই কুসমি বলে জানে। এই কথাটা খুবই সত্য; তার হাজার প্রমাণ আছে। আমি কিন্তু সন্ধান পেয়েছি যে, তুমি পরীস্থানের পরী। এটা হল আরো-সত্য।

খুশি হল কুসমি। বলল, আচ্ছা, সন্ধান পেলে কী করে।

আমি বললুম, তোমার ছিল একজামিন, বিছানার উপরে বসে বসে ভূগোল-বৃত্তান্ত মুখস্থ করছিলে, কখন তোমার মাথা ঠেকল বালিশে, পড়লে ঘুমিয়ে। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত্রি। জানলার ভিতর দিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়ল তোমার মুখের উপরে, তোমার আসমানি রঙের শাড়ির উপরে। আমি সেদিন স্পষ্ট দেখতে পেলুম, পরীস্থানের রাজা চর পাঠিয়েছে তাদের পলাতকা পরীর খবর নিতে। সে এসেছিল আমার জানলার কাছে, তার সাদা চাদরটা উড়ে পড়েছিল ঘরের মধ্যে। চর দেখল তোমাকে আগাগোড়া, ভেবে পেল না তুমি তাদের সেই পালিয়ে-আসা পরী কি না। তুমি এই পৃথিবীর পরী বলে তার সন্দেহ হল। তোমাকে মাটির কোল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সহজ হবে না। এত ভার সইবে না। ক্রমে চাঁদ উপরে উঠে গেল, ঘরের মধ্যে ছায়া পড়ল, চর শিশুগাছের ছায়ায় মাথা নেড়ে চলে গেল। সেদিন আমি খবর পেলুম, তুমি পরীস্থানের পরী, পৃথিবীর মাটির ভারে বাঁধা পড়ে গেছ।

কুসমি বললে, আচ্ছা দাদামশায়, আমি পরীস্থান থেকে এলুম কী করে।

আমি বললুম, সেখানে একদিন তুমি পারিজাতের বনে প্রজাপতির পিঠে চড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিলে, হঠাৎ তোমার চোখে পড়ল দিগন্তের ঘাটে এসে ঠেকেছে একটা খেয়ানৌকো। সেটা সাদা মেঘ দিয়ে গড়া, হাওয়া লেগে দুলছে। তোমার কী মনে হল, তুমি উঠে পড়লে সেই নৌকোয়। নৌকো চলল ভেসে, ঠেকল এসে পৃথিবীর ঘাটে, তোমার মা নিলেন কুড়িয়ে।

কুসমি ভারি খুশি হয়ে বললে হাততালি দিয়ে, দাদামশায়, আচ্ছা, এ কি সত্যি।

আমি বললুম, ঐ দেখো, কে বললে সত্যি। আমি কি সত্যিকে মানি। এ হল আরো-সত্যি।

কুসমি বললে, আচ্ছা, আমি কি পরীস্থানে ফিরে যেতে পারব না।

আমি বললুম, পারতেও পার, যদি তোমার স্বপ্নের পালে পরীস্থানের হাওয়া এসে লাগে।

আচ্ছা, যদি হাওয়া লাগে তবে কোন্‌ রাস্তায় কোথা দিয়ে কোথায় যাব। সে কি অনে—ক দূরে।

আমি বললুম, সে খুব কাছে।

কত কাছে।

যত কাছে তুমি আছ আর আমি আছি। ঐ বিছানার বাইরে যেতে হবে না। আর-একদিন জানলা দিয়ে পড়ুক এসে জ্যোৎস্না; এবার যখন তুমি তাকিয়ে দেখবে বাইরে, তোমার আর সন্দেহ হবে না। তুমি দেখবে জ্যোৎস্নার স্রোত বেয়ে মেঘের খেয়ানৌকো এসে পৌঁচচ্ছে। কিন্তু, তুমি যে এখন পৃথিবীর পরী হয়েছ, ও নৌকোয় তোমার কুলোবে না। এখন তুমি তোমার দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, কেবল তোমার মন থাকবে তোমার সাথি। তোমার সত্য থাকবে এই পৃথিবীতে পড়ে আর তোমার আরো-সত্য যাবে কোথায় ভেসে, আমরা কেউ তার নাগাল পাব না।

কুসমি বললে, আচ্ছা, এবারে পূর্ণিমারাত এলে আমি ঐ আকাশের পানে তাকিয়ে থাকব। দাদামশায়, তুমি কি আমার হাত ধরে যাবে।

আমি বললুম, আমি এইখানে বসে বসে পথ দেখিয়ে দিতে পারব। আমার সেই ক্ষমতা আছে—কেননা আমি সেই আরো-সত্যের কারবারি।
*
* *
যেটা তোমায় লুকিয়ে-জানা সেটাই আমার পেয়ার,
বাপ মা তোমায় যে নাম দিল থোড়াই করি কেয়ার।
সত্য দেখায় যেটা দেখি তারেই বলি পরী,
আমি ছাড়া কজন জানে তুমি যে অপ্সরী।
কেটে দেব বাঁধা নামের বন্দীর শৃঙ্খল,
সেই কাজেতেই লেগে গেছি আমরা কবির দল—
কোনো নামেই কোনো কালে কুলোয় নাকো যারে
তাহার নামের ইশারা দেই ছন্দে ঝংকারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *