কর্মফল – ০২

অষ্টম পরিচ্ছেদ
নলিনী। সতীশ, আমি তোমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছি বলি, রাগ কোরো না।
সতীশ। তুমি ডেকেছ বলে রাগ করব, আমার মেজাজ কি এতই বদ।
নলিনী। না, ও-সব কথা থাক্। সকল সময়েই নন্দী-সাহেবের চেলাগিরি কোরো না। বলো দেখি, আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে অমন দামী জিনিস কেন দিলে।
সতীশ। যাঁকে দিয়েছি তাঁর তুলনায় জিনিসটার দাম এমন কি বেশি।
নলিনী। আবার ফের নন্দীর নকল!
সতীশ। নন্দীর নকল সাধে করি! তার প্রতি যখন ব্যক্তিবিশেষের পক্ষপাত—
নলিনী। তবে যাও, তোমার সঙ্গে আমি আর কথা কব না।
সতীশ। আচ্ছা, মাপ করো, আমি চুপ করে শুনব।
নলিনী। দেখো সতীশ, মিস্টার নন্দী আমাকে নির্বোধের মতো একটা দামী ব্রেসলেট পাঠিয়েছিলেন, তুমি অমনি নির্বুদ্ধিতার সুর চড়িয়ে তার চেয়ে দামী একটা নেক্লেস পাঠাতে গেলে কেন।
সতীশ। যে অবস্থায় লোকের বিবেচনাশক্তি থাকে না সে অবস্থাটা তোমার জানা নেই বলে তুমি রাগ করছ,নেলি।
নলিনী। আমার সাতজন্মে জেনে কাজ নেই। কিন্তু এ নেকলেস তোমাকে ফিরে নিয়ে যেতে হবে।
সতীশ। ফিরে দেবে?
নলিনী। দেব। বাহাদুরি দেখাবার জন্যে যে দান, আমার কাছে সে দানের কোনো মূল্য নেই।
সতীশ। তুমি অন্যায় বলছ নেলি।
নলিনী। আমি কিছুই অন্যায় বলছি নে— তুমি যদি আমায় একটি ফুল দিতে আমি ঢের বেশি খুশি হতেম। তুমি যখন-তখন প্রায়ই মাঝে মাঝে আমাকে কিছু-না-কিছু দামী জিনিস পাঠাতে আরম্ভ করেছ। পাছে তোমার মনে লাগে বলে আমি এতদিন কিছুই বলি নি। কিন্তু, ক্রমেই মাত্রা বেড়েই চলেছে, আর আমার চুপ করে থাকা উচিত নয়। এই নাও তোমার নেকলেস।
সতীশ। এ নেকলেস তুমি রাস্তায় টান মেরে ফেলে দাও, কিন্তু আমি এ কিছুতেই নেব না।
নলিনী। আচ্ছা সতীশ, আমি তো তোমাকে ছেলেবেলা হতেই জানি, আমার কাছে ভাঁড়িয়ো না। সত্য করে বলো, তোমার কি অনেক টাকা ধার হয় নি।
সতীশ। কে তোমাকে বলেছে। নরেন বুঝি?
নলিনী। কেউ বলে নি। আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারি। আমার জন্য তুমি অন্যায় কেন করছ।
সতীশ। সময়বিশেষে লোকবিশেষের জন্য মানুষ প্রাণ দিতে ইচ্ছা করে; আজকালকার দিনে প্রাণ দেবার অবকাশ খুঁজে পাওয়া যায় না— অন্তত ধার করবার দুঃখটুকু স্বীকার করবার যে সুখ তাও কি ভোগ করতে দেবে না। আমার পক্ষে যা দুঃসাধ্য আমি তোমার জন্য তাই করতে চাই নেলি, একেও যদি তুমি নন্দী-সাহেবের নকল বল তবে আমার পক্ষে মর্মান্তিক হয়।
নলিনী। আচ্ছা, তোমার যা করবার তা তো করেছ- তোমার সেই ত্যাগস্বীকারটুকু আমি নিলেম- এখন এ জিনিসটা ফিরে নাও।
সতীশ। ওটা যদি আমাকে ফিরিয়ে নিতে হয় তবে ঐ নেকলেসটা গলায় ফাঁস লাগিয়ে দম বন্ধ করে আমার পক্ষে মরা ভালো।
নলিনী। দেনা তুমি শোধ করবে কী করে।
সতীশ। মার কাছ হতে টাকা পাব।
নলিনী। ছি ছি, তিনি মনে করবেন আমার জন্যই তাঁর ছেলের দেনা হচ্ছে।
সতীশ। সে কথা তিনি কখনোই মনে করবেন না, তাঁর ছেলেকে তিনি অনেকদিন হতে জানেন।
নলিনী। আচ্ছা সে যাই হোক, তুমি প্রতিজ্ঞা করো, এখন হতে তুমি আমাকে দামী জিনিস দেবে না। বড়োজোর ফুলের তোড়ার বেশি আর কিছু দিতে পারবে না।
সতীশ। আচ্ছা, সেই প্রতিজ্ঞাই করলেম।
নলিনী। যাক্ এখন তবে তোমার গুরু নন্দী-সাহেবের পাঠ আবৃত্তি করো। দেখি, স্তুতিবাদ করবার বিদ্যা তোমার কতদূর অগ্রসর হল। আচ্ছা,আমার কানের ডগা সম্মন্ধে কী বলতে পার বলো— আমি তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিলেম।
সতীশ। যা বলব তাতে ঐ ডগাটুকু লাল হয়ে উঠবে।
নলিনী। বেশ বেশ, ভূমিকাটি মন্দ হয় নি। আজকের মতো ঐটুকুই থাক্, বাকিটুকু আর-একদিন হবে। এখনই কান ঝাঁঝাঁ করতে শুরু হয়েছে।

নবম পরিচ্ছেদ
বিধু। আমার উপর রাগ কর যা কর, ছেলের উপর কোরো না। তোমার পায়ে ধরি, এবারকার মতো তার দেনাটা শোধ করে দাও।
মন্মথ। আমি রাগারাগি করছি নে, আমার যা কর্তব্য তা আমাকে করতেই হবে। আমি সতীশকে বার বার বলেছি, দেনা করলে শোধবার ভার আমি নেব না। আমার সে কথার অন্যথা হবে না।
বিধু। ওগো, এতবড় সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির হলে সংসার চলে না। সতীশের এখন বয়স হয়েছে, তাকে জলপানি যা দাও তাতে ধার না করে তার চলে কী করে বলো দেখি।
মন্মথ। যার যেরূপ সাধ্য তার চেয়ে চাল বড়ো করলে কারোই চলে না- ফকিরেরও না। বাদশারও না।
বিধু। তবে কি ছেলেকে জেলে যেতে দেবে।
মন্মথ। সে যদি যাবার আয়োজন করে এবং তোমরা যদি তার জোগাড় দাও তবে আমি ঠেকিয়ে রাখব কী করে।
মন্মথর প্রস্থান। শশধরের প্রবেশ

শশধর। আমাকে এ বাড়িতে দেখলে মন্মথ ভয় পায়। ভাবে, কালো কোর্তা ফরমাশ দেবার জন্য ফিতা হাতে তার ছেলের গায়ের মাপ নিতে এসেছি। তাই কদিন আসি নি। আজ তোমার চিঠি পেয়ে সুকু কান্নাকাটি করে আমাকে বাড়িছাড়া করেছে।
বিধু। দিদি আসেন নি?
শশধর। তিনি এখনই আসবেন। ব্যাপারটা কী।
বিধু। সবই তো শুনেছ। এখন ছেলেটাকে জেলে না দিলে ওঁর মন সুস্থির হচ্ছে না। র্যাঙ্কিন-হার্মানের পোশাক তাঁর পছন্দ হল না, জেলখানার কাপড়টাই বোধ হয় তাঁর মতে বেশ সুসভ্য।
শশধর। আর যাই বল মন্মথকে বোঝাতে যেতে আমি পারব না। তার কথা আমি বুঝি নে, আমার কথাও সে বোঝে না, শেষকালে—
বিধু। সে কি আমি জানি নে। তোমরা তো তাঁর স্ত্রী নও যে মাথা হেঁট করে সমস্তই সহ্য করবে। কিন্তু এখন এ বিপদ ঠেকাই কী করে।
শশধর। তোমার হাতে কিছু কি—
বিধু। কিছুই নেই- সতীশের ধার শুধতে আমার প্রায় সমস্ত গহনাই বাঁধা পড়েছে, হাতে কেবল বালাজোড়া আছে।
সতীশের প্রবেশ

শশধর। কী সতীশ, খরচপত্র বিবেচনা করে কর না, এখন কী মুশকিলে পড়েছ দেখো দেখি।
সতীশ। মুশকিল তো কিছুই দেখি নে।
শশধর। তবে হাতে কিছু আছে বুঝি! ফাঁস কর নি।
সতীশ। কিছু তো আছেই।
শশধর। কত?
সতীশ। আফিম কেনবার মতো।
বিধু। (কাঁদিয়া উঠিয়া) সতীশ, ও কী কথা তুই বলিস। আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি, আমাকে আর দগ্ধাস নে।
শশধর। ছি ছি, সতীশ। এমন কথা যদি-বা কখনো মনেও আসে তবু কি মার সামনে উচ্চারণ করা যায়। বড়ো অন্যায় কথা।
সুকুমারীর প্রবেশ

বিধু। দিদি, সতীশকে রক্ষা করো। ও কোন্দিন কী করে বসে আমি তো ভয়ে বাঁচি নে। ও যা বলে শুনে আমার গা কাঁপে।
সুকুমারী। ও আবার কী বলে।
বিধু। বলে কিনা আফিম কিনে আনবে।
সুকুমারী। কী সর্বনাশ! সতীশ, আমার গা ছুঁয়ে বল্ এমন কথা মনেও আনবি নে। চুপ করে রইলি যে। লক্ষ্মী বাপ আমার। তোর মা-মাসির কথা মনে করিস।
সতীশ। জেলে বসে মনে করার চেয়ে এ-সমস্ত হাস্যকর ব্যাপার জেলের বাইরে চুকিয়ে ফেলাই ভালো।
সুকুমারী। আমরা থাকতে তোকে জেলে কে নিয়ে যাবে।
সতীশ। পেয়াদা।
সুকুমারী। আচ্ছা, সে দেখব কতবড়ো পেয়াদা; ওগো, এই টাকাটা ফেলে দাও-না, ছেলেমানুষকে কেন কষ্ট দেওয়া।
শশধর। টাকা ফেলে দিতে পারি, কিন্তু মন্মথ আমার মাথায় ইঁট ফেলে না মারে।
সতীশ। মেসোমশায়, সে ইঁট তোমার মাথায় পৌঁছবে না, আমার ঘাড়ে পড়বে। একে এক্জামিনে ফেল করেছি, তার উপরে দেনা, এর উপরে জেলে যাবার এতবড়ো সুযোগটা যদি মাটি হয়ে যায় তবে বাবা আমার সে অপরাধ মাপ করবেন না।
বিধু। সত্যি দিদি, সতীশ মেসোর টাকা নিয়েছে শুনলে তিনি বোধ হয় ওকে বাড়ি হতে বার করে দেবেন।
সুকুমারী। তা দিন-না। আর কি কোথাও বাড়ি নেই নাকি। ও বিধু, সতীশকে তুই আমাকেই দিয়ে দে-না। আমার তো ছেলেপুলে নেই, আমি নাহয় ওকেই মানুষ করি। কী বল গো।
শশধর। সে তো ভালোই। কিন্তু সতীশ যে বাঘের বাচ্ছা, ওকে টানতে গেলে তার মুখ থেকে প্রাণ বাচাঁনো দায় হবে।
সুকুমারী। বাঘমশায় তো বাচ্ছাটিকে জেলের পেয়াদার হাতেই সমর্পণ করে দিয়েছেন, আমরা যদি তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাই এখন তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না।
শশধর। বাঘিনী কী বলেন, বাচ্ছাই বা কী বলে।
সুকুমারী। যা বলে সে আমি জানি, সে কথা আর জিজ্ঞাসা করতে হবে না। তুমি এখন দেনাটা শোধ করে দাও।
বিধু। দিদি।
সুকুমারী। আর দিদি দিদি করে কাঁদতে হবে না। চল্, তোর চুল বেঁধে দিই গে। এমন ছিরি করে তোর ভগ্নীপতির সামনে বার হতে লজ্জা করে না?
শশধর ব্যতীত সকলের প্রস্থান। মন্মথর প্রবেশ

শশধর। মন্মথ, ভাই, তুমি একটু বিবেচনা করে দেখো—
মন্মথ। বিবেচনা না করে তো আমি কিছুই করি না।
শশধর। তবে দোহাই তোমার, বিবেচনা একটু খাটো করো। ছেলেটাকে কি জেলে দেবে। তাতে কি ওর ভালো হবে।
মন্মথ। ভালোমন্দর কথা কেউই শেষ পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারে না। আমি মোটামুটি এই বুঝি যে, বার বার সাবধান করে দেওয়ার পরও যদি কেউ অন্যায় করে তবে তার ফলভোগ হতে তাকে কৃত্রিম উপায়ে রক্ষা করা কারও উচিত হয় না। আমরা যদি মাঝে পড়ে ব্যর্থ করে না দিতেম তবে প্রকৃতির কঠিন শিক্ষায় মানুষ যথার্থ মানুষ হয়ে উঠতে পারত।
শশধর। প্রকৃতির কঠোর শিক্ষাই যদি একমাত্র শিক্ষা হত তবে বিধাতা বাপমায়ের মনে স্নেহটুকু দিতেন না। মন্মথ, তুমি দিনরাত কর্মফল কর্মফল করো আমি তা সম্পূর্ণ মানি না। প্রকৃতি আমাদের কাছ হতে কর্মফল কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নিতে চায় কিন্তু প্রকৃতির উপরে যিনি কর্তা আছেন তিনি মাঝে পড়ে তার অনেকটাই মহকূপ দিয়ে থাকেন, নইলে কর্মফলের দেনা শুধতে শুধতে অস্তিত্ব পর্যন্ত বিকিয়ে যেত। বিজ্ঞানের হিসাবে কর্মফল সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানের উপরেও বিজ্ঞান আছে, সেখানে প্রেমের হিসাবে ফলাফল সমস্ত অন্যরকম। কর্মফল নৈসর্গিক, মার্জনাটা তার উপরের কথা।
মন্মথ। যিনি অনৈসর্গিক মানুষ তিনি যা খুশি করবেন, আমি অতি সামান্য নৈসর্গিক, আমি কর্মফল শেষ পর্যন্তই মানি।
শশধর। আচ্ছা, আমি যদি সতীশের দেনা শোধ করে তাকে খালাস করি, তুমি কী করবে।
মন্মথ। আমি তাকে ত্যাগ করব। দেখো, সতীশকে আমি যে ভাবে মানুষ করতে চেয়েছিলাম প্রথম হতেই বাধা দিয়ে তোমরা তা ব্যর্থ করেছ। এক দিক হতে সংযম আর-এক দিক হতে প্রশ্রয় পেয়ে সে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ক্রমাগতই ভিক্ষা পেয়ে যদি তার সম্মানবোধ এবং দায়িত্ববোধ চলে যায়, যে কাজের যে পরিণাম তোমরা যদি মাঝে পড়ে কিছুতেই তাকে বুঝতে না দাও, তবে তার আশা আমি ত্যাগ করলেম। তোমাদের মতোই তাকে মানুষ করো— দুই নৌকোয় পা দিয়েই তার বিপদ ঘটেছে।
শশধর। ও কী কথা বলছ মন্মথ— তোমার ছেলে—
মন্মথ। দেখো শশধর, নিজের প্রকৃতি ও বিশ্বাস মতেই নিজের ছেলেকে আমি মানুষ করতে পারি, অন্য কোনো উপায় তো জানি না। যখন নিশ্চয় দেখছি তা কোনোমতেই হবার নয়, তখন পিতার দায়িত্ব আমি আর রাখব না। আমার যা সাধ্য তার বেশি আমি করতে পারব না।
মন্মথর প্রস্থান

শশধর। কী করা যায়। ছেলেটাকে তো জেলে দেওয়া যায় না। অপরাধ মানুষের পক্ষে যত সর্বনেশেই হোক, জেলখানা তার চেয়ে ঢের বেশি।

দশম পরিচ্ছেদ
ভাদুড়িজায়া। শুনেছ? সতীশের বাপ হঠাৎ মারা গেছে।
মিস্টার ভাদুড়ি। হাঁ, সে তো শুনেছি।
জায়া। সে-যে সমস্ত সম্পত্তি হাসপাতালে দিয়ে গেছে, কেবল সতীশের মার জন্য জীবিতকাল পর্যন্ত ৭৫ টাকা মাসহারা বরাদ্দ করে গেছে। এখন কী করা যায়।
ভাদুড়ি। এত ভাবনা কেন তোমার।
জায়া। বেশ লোক যা হোক তুমি। তোমার মেয়ে যে সতীশকে ভালোবাসে সেটা বুঝি তুমি দুই চক্ষু মেলে দেখতে পাও না! তুমি তো ওদের বিবাহ দিতেও প্রস্তুত ছিলে। এখন উপায় কী করবে।
ভাদুড়ি। আমি তো মন্মথর টাকার উপর বিশেষ নির্ভর করি নি।
জায়া। তবে কি ছেলেটির চেহারার উপরেই নির্ভর করে বসেছিলে। অন্নবস্ত্রটা বুঝি অনাবশ্যক?
ভাদুড়ি। সম্পূর্ণ আবশ্যক। যিনি যাই বলুন, ওর চেয়ে আবশ্যক আর-কিছুই নেই। সতীশের একটি মেসো আছে, বোধ হয জান।
জায়া। মেসো তো ঢের লোকেরই থাকে, তাতে ক্ষুধাশান্তি হয় না।
ভাদুড়ি। এই মেসোটি আমার মক্কেল— অগাধ টাকা— ছেলেপুলে কিছুই নেই— বয়সও নিতান্ত অল্প নয়। সে তো সতীশকেই পোষ্যপুত্র নিতে চায়।
জায়া। মেসোটি তো ভালো। তা চট্পট্ নিক-না। তুমি একটু তাড়া দাও-না।
ভাদুড়ি। তাড়া আমাকে দিতে হবে না, তার ঘরের মধ্যেই তাড়া দেবার লোক আছে। সবই প্রায় ঠিকঠাক, এখন কেবল একটা আইনের খটকা উঠেছে— এক ছেলেকে পোষ্যপুত্র লওয়া যায় কি না- তা ছাড়া সতীশের আবার বয়স হয়ে গেছে।
জায়া। আইন তো তোমাদেরই হাতে— তোমরা চোখ বুজে একটা বিধান দিয়ে দাও-না।
ভাদুড়ি। ব্যস্ত হোয়ো না— পোষ্যপুত্র না নিলেও অন্য উপায় আছে।
জায়া। আমাকে বাঁচালে। আমি ভাবছিলেম, সম্মন্ধ ভাঙি কী করে। আবার, আমাদের নেলি যেরকম জেদালো মেয়ে, সে যে কী করে বসত বলা যায় না। কিন্তু তাই বলে গরিবের হাতে তো মেয়ে দেওয়া যায় না। ঐ দেখো, তোমার মেয়ে কেঁদে চোখ
ফুলিয়েছে। কাল যখন খেতে বসেছিল এমন সময় সতীশের বাপ-মরার খবর পেল, অমনি তখনই উঠে চলে গেল।
ভাদুড়ি। কিন্তু, নেলি যে সতীশকে ভালোবাসে সে তো দেখে মনে হয় না। ও তো সতীশকে নাকের জলে চোখের জলে করে। আমি আরো মনে করতাম, নন্দীর উপরেই ওর বেশি টান।
জায়া। তোমার মেয়েটির ঐ স্বভাব। সে যাকে ভালোবাসে তাকেই জ্বালাতন করে। দেখো না বিড়ালছানাটাকে নিয়ে কী কাণ্ডটাই করে! কিন্তু আশ্চর্য এই, তবু তো ওকে কেউ ছাড়তে চায় না।
নলিনীর প্রবেশ

নলিনী। মা, একবার সতীশবাবুর বাড়ি যাবে না? তাঁর মা বোধ হয় খুব কাতর হয়ে পড়েছেন। বাবা, আমি একবার তাঁর কাছে যেতে চাই।

একাদশ পরিচ্ছেদ
সতীশ। মা, এখানে আমি যে কত সুখে আছি সে তো আমার কাপড়-চোপড় দেখেই বুঝতে পার। কিন্তু মেসোমশায় যতক্ষণ না আমাকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেন ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হতে পারছি নে। তুমি যে মাসহারা পাও আমার তো তাতে কোনো সাহায্য হবে না। অনেকদিন হতে নেব-নেব করেও আমাকে পোষ্যপুত্র নিচ্ছেন না— বোধ হয় ওঁদের মনে মনে সন্তানলাভের আশা এখনো আছে।
বিধু। (হতাশভাবে) সে আশা সফল হয়-বা, সতীশ।
সতীশ। অ্যাঁ! বলো কী মা!
বিধু। লক্ষণ দেখে তো তাই বোধ হয়।
সতীশ। লক্ষণ অমন অনেক সময় ভুলও তো হয়।
বিধু। না, ভুল নয় সতীশ, এবার তোর ভাই হবে।
সতীশ। কী যে বল মা, তার ঠিক নেই— ভাই হবেই কে বললে! বোন হতে পারে না বুঝি!
বিধু। দিদির চেহারা যেরকম হয়ে গেছে নিশ্চয় তাঁর মেয়ে হবে না, ছেলেই হবে। তা ছাড়া ছেলেই হোক, মেয়েই হোক, আমাদের পক্ষে সমানই।
সতীশ। এত বয়সের প্রথম ছেলে, ইতিমধ্যে অনেক বিঘ্ন ঘটতে পারে।
বিধু। সতীশ, তুই চাকরির চেষ্টা কর্।
সতীশ। অসম্ভব। পাস করতে পারি নি। তা ছাড়া চাকরি করবার অভ্যাস আমার একেবারে গেছে। কিন্তু, যাই বল মা, এ ভারি অন্যায়। আমি তো এতদিনে বাবার সম্পত্তি পেতেম, তার থেকে বঞ্চিত হলেম, তার পরে যদি আবার—
বিধু। অন্যায় নয় তো কী,সতীশ। এ দিকে তোকে ঘরে এনেছেন, ও দিকে আবার ডাক্তার ডাকিয়ে ওষুধও খাওয়া চলছে। নিজের বোনপোর সঙ্গে এ কিরকম ব্যবহার। শেষকালে দয়াল ডাক্তারের ওষুধ তো খেটে গেল। অস্থির হোস নে সতীশ। একমনে ভগবানকে ডাক— তাঁর কাছে কোনো ডাক্তারই লাগে না। তিনি যদি—
সতীশ। আহা, তিনি যদি এখনো— এখনো সময় আছে। মা, এঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, কিন্তু যেরকম অন্যায় হল, সে ভাব রক্ষা করা শক্ত হয়ে উঠেছে। ঈশ্বরের কাছে এঁদের একটা দুর্ঘটনা না প্রার্থনা করে থাকতে পারছি নে— তিনি দয়া করে যেন—
বিধু। আহা তাই হোক, নইলে তোর উপায় কী হবে সতীশ, আমি তাই ভাবি। হে ভগবান, তুমি যেন—
সতীশ। এ যদি না হয় তবে ঈশ্বরকে আমি আর মানব না। কাগজে নাস্তিকতা প্রচার করব।
বিধু। আরে চুপ চুপ, এখন এমন কথা মুখে আনতে নেই। তিনি দয়াময়, তাঁর দয়া হলে কী না ঘটতে পারে। সতীশ, তুই আজ এত ফিট্ফাট্ সাজ করে কোথায় চলেছিস। উঁচু কলার পরে মাথা যে আকাশে গিয়ে ঠেকল! ঘাড় হেঁট করবি কী করে।
সতীশ। এমনি করে কলারের জোরে যতদিন মাথা তুলে চলতে পারি চলব, তার পরে ঘাড় হেঁট করবার দিন যখন আসবে তখন এগুলো ফেলে দিলেই চলবে। বিশেষ কাজ আছে মা, কথাবার্তা পরে হবে।
[প্রস্থান]
বিধু। কাজ কোথায় আছে তা জানি। মাগো, ছেলের আর তর সয় না। এ বিবাহটা ঘটবেই। আমি জানি, আমার সতীশের অদৃষ্ট খারাপ নয়; প্রথমে বিঘ্ন যতই ঘটুক, শেষকালটায় ওর ভালো হয়ই, এ আমি বরাবর দেখে আসছি। না হবেই বা কেন। আমি তো জ্ঞাতসারে কোনো পাপ করি নি— আমি তো সতী স্ত্রী ছিলাম, সেইজন্যে আমার খুব বিশ্বাস হচ্ছে দিদির এবারে—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *