মণিহারা

নৌকা ছাড়তে না ছাড়তেই নব গান ধরে দিল,

ওরে সায়েবের পো আন্টুনি,
তোর কটা বাপ বল শুনি

গানটা শেষ হতে পেল না। ভোলা হেঁকে উঠল, থাম থাম। কটা ঘণ্টা বাজছে শোন দিকিনি।

ভোলা জেলে। গঙ্গার বাপ। বিনি জেলেনির বর। সে নিজেই গুনতে আরম্ভ করল, এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত…। আরে বাপরে, সাতটা ঘণ্টা বেজে গেল। চেপে চল, চেপে চল নবা; আজ বড় দেরি হয়ে গেছে!

নব হাল বৈঠায় বার কয়েক জোর চাপ দিল। দুলে উঠল নৌকা। নিঃশব্দ গঙ্গার বুকে বার কয়েক ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ উঠল। রুদ্ধ কণ্ঠের কয়েকটা আচমকা চাপা আর্তনাদের মতো সে শব্দ চকিতে উঠে হারিয়ে গেল বৈশাখের খরো হাওয়ায়, তারপর আবার নবর হাতে বৈঠা যেমন চলছিল চলতে লাগল তেমনি।

কেবল ভোলার হাতে দাঁড় দ্রুত উঠে নেমে, ছপছপ শব্দে অখণ্ড নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে ফেলতে চেষ্টা করল। পূর্ণ জোয়ারের টাবুটুবু গঙ্গার নৈঃশব্দ্য এতই গভীর যে, সে নৈঃশব্দ্যেরই একটি তালের মতো বাজতে লাগল ছপছপ শব্দ।

চুঁচুড়ার পাড় ঘেঁষে চলেছে তারা। অন্ধকার এরই মধ্যে এত ঘন হয়ে এসেছে যে, পাড়ের ওপর লোকজন ঠাওর করা যায় না। শুধু দেখা যায়, পাষাণপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে গঙ্গার তীরের বিশাল প্রাসাদমালার মাথা। বট, বকুল ও ঝাউ গাছের শীর্ষদেশ উঠেছে কোথাও, দাঁড়িয়ে আছে বিশাল অট্টালিকার বুক ও মুখের কাছে। পেছনে তার কিছুক্ষণ আগের রক্তাভ আকাশ। তার লালিমায় সন্ধ্যার কালো ঘোমটা এসেছে নেমে। সেই ঘোমটার বুকে চুমকি বাহারের মতো একটি একটি করে ফুটছে তারা। বৈশাখের দুরন্ত বাতাস ওই প্রাসাদ ও গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে বুক ভাঙা দীর্ঘশ্বাসের মতো লুটিয়ে পড়ছে বীচি বিক্ষুব্ধ গঙ্গার বুকে।

সাত ঘণ্টা বেজে গেল ঘণ্টাঘাটের গির্জায়। গির্জা ওলন্দাজদের। গঙ্গার কিনারে ওই গির্জার ঘড়ির ঘন্টার ঢং ঢং শব্দগুলি শুনে ঘাটের নাম হয়ে গেছে ঘন্টাঘাট! গির্জার নাম হয়েছে ঘণ্টাঘাটের গির্জা।

প্রাসাদমালার দরজা জানলা অধিকাংশ বন্ধ। কোথাও কোথাও বেতের জাফরি দিয়ে দেখা যাচ্ছে ম্লান আলোর রেখা। চুঁচুড়ার অভ্যন্তরের কল-কোলাহল ভেসে আসে না এত দূরে, শুধু কাছাকাছি শোনা যাচ্ছে একাধিক ঘোড়ার পায়ের শব্দ। যেন দূর থেকে সে শব্দ ক্রমাগত কাছে আসছে। প্রাসাদে কার্নিশে খিলানে প্রতিধ্বনিত হয়ে সে শব্দ আছড়ে পড়ছে এসে গঙ্গা সৈকতে। হয়তো চার ঘোড়ার গাড়িতে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন কোনও ইংরেজ রাজপুরুষ।

কিন্তু আচমকা অশ্বক্ষুর পিছলে যাওয়ার মতো সে শব্দ চকিতে থেমে আবার উধধাও হয়ে যেতে লাগল দূরে। দূরে অন্যদিকে, অন্য কোনও পথে, অন্যখানে। সুস্পষ্ট হয়ে উঠল পালকি বাহক উড়ে বেহারাদের বিচিত্র সুর তালময় ধ্বনি৷ কার ভাঙা ও মোটা কণ্ঠের ব্যস্ত উৎকণ্ঠিত সাবধানী স্বর ভেসে আসছে, দূর যাও, হট যাও, হট যাও, বড়কা বিবির পালকি যায়।

কে জানে কোন বড়কা বিবি। কে জানে, কোন দিক থেকে চলেছে কোন দিকে। হয়তো কোনও রাজপুরুষের বিবি হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন গঙ্গার ধারে। হয়তো যাবেন ব্যান্ডেলের দিকে, কিংবা প্রত্যাগমন হচ্ছে ভ্রমণ সেরে।

দূরে যণ্ডেশ্বর বাবার মন্দিরের প্রাঙ্গণ থেকে ভেসে আসছে ঢাকের বাজনা। ঢাকের বাজনা কানে এলেই মনে পড়ে যায় ঢাকের চেহারা। পেল্লায় ঢাক। ওলন্দাজদের আমলে, তারা উপহার দিয়েছিল ওই ঢাক বাবা ষণ্ডেশ্বরকে। ঢাকের সঙ্গে কাঁসির শব্দটা বড় স্তিমিত মনে হচ্ছে।

ভোলা আবার হাঁক দিল, কী রে নবা, ঘুমোচ্ছিস নাকি? চাপ দে, চাপ দে ব্যাটা। মেয়েটা একলা রয়েছে। রাত হল। কেঁদে-কেটে একশা হবেখুনি।

আবার চাপা আর্তনাদ উঠল বৈঠার। এবার আর থামল না। নৌকায় ওঠার কিছুক্ষণ আগেই কয়েক ছিলিম গাঁজা টেনে কেমন ঝিম ধরে রয়েছে নবর হাত পা। গাঁজা টানছে ভোলাও। কিন্তু তার হাত-পা অত সহজে শিথিল হয় না।

মেয়েটার কথা শুনে নবর হাত পায়ের আলস্য আপনি কেটে গেল। চোখের উপর ভেসে উঠল গঙ্গার মুখ। রূপসী ভানুমতীর চোখ। সত্যি, এতক্ষণ তো মনেই ছিল না।

 নবর অনেক আশা। ভোলার প্রতিবেশী সে। কিন্তু নিজের ঘর-দোর কিছুই নেই, থাকে পরের বাড়িতে। জাতে জেলে। কিন্তু জাল, নৌকা কিছুই নেই। ভোলা তাকে নিয়েছে সঙ্গী হিসাবে। ভোলার সঙ্গে সারাদিন মাছ ধরে, বিক্রি করে বাজারে। মানুষটা সে বুদ্ধিমান নয়। চালাকি চাতুরি নেই। বরং খানিকটা বোকা-সোকা মানুষ। যা বলে তাই করে। না পারলে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকে। বকুনি খায়, সময় সময় গোঁয়ার ভোলা জেলের চড় চাপড়টাও খেতে হয়। খেয়ে কখনও হাসে, কখনও ছোট ছেলের মতো অভিমানে গোঁ ধরে বসে থাকে। দেখলে লোকের হাসি পায়, রাগও হয়! এতখানি বয়স হয়েও নব সেই ছেলেমানুষটি রয়ে গেছে আজও। কিন্তু, আদতে মানুষটি বড় বিশ্বাসী। ভোলা নিজে জাল ফেলে গঙ্গায় বসে থেকে কত দিন তাকে মাছ বিক্রি করতে পাঠিয়েছে। কিন্তু আধ পয়সা লুকোয়নি নব কোনওদিন। বোকা বলে যে লুকোয়নি তা নয়। ওটা নব রপ্ত করতে পারেনি কোনওদিন। বোধ হয়, ভোলার গোঁয়ার্তুমির পেছনে যে অদৃশ্য স্নেহের রস তাকে সিক্ত করছে দিবানিশি, সেটুকুই তাকে এ সহজলভ্য পয়সা রোজগারের নীচতা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সবকিছুরই যেমন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আছে, এও তেমনি। আয়নার মতো। যেমনটি দেখাবে, তেমনটি দেখবে। ভোলার স্নেহ ও বিশ্বাস না থাকলে, এই নব-ই কেমন হত, কে জানে।

কিন্তু একটি বিষয়ে নব তার নিজের মনের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। বড় সন্তর্পণে, অতি গোপনে, দুরন্ত ভয়ে ও দুঃসাহসেও বটে। মনে মনে সে পিরিতের গ্রন্থি বেঁধেছে ভানুমতীর সঙ্গে। কেমন করে, কোন দিন সে মনে মনে ভানুমতীকে আঁকতে আরম্ভ করেছে নিজের বুকে, নিজেও বুঝি জানেনা। ভানুর সেই খবরা চোখের চাউনি দিবানিশি বিপে অবহেলায় ছিন্নভিন্ন করে তার বুক! হাসিতে হৃদয় কেটে করে খান খান। টিকোলো নাকখানি তুলে তুলে মাটিতে বসিয়ে দেয় অসহায় নবর মাথা। তবু, হৃদয় কী নির্লজ্জ, বেয়াদপ, বজ্জাত! অত অপমানেও সে বাধা মানে না। ভেতরের ব্যাকুল নব, অদৃশ্য পাগল নব তবু ঘুরঘুর করে ওই এক চিমটি, মুখরা দুর্বিনীত মেয়ের পেছনে পেছনে। কতদিন জাল টানতে ভুল হয়েছে, কতদিন ইলিশের মরশুমে জাল ফেলে, ইলিশ আটকাবার হাতের আংটা রয়ে গেছে হাতে। আর গালাগাল ও মার খেয়েছে ভোলার হাতে। শুধু এই মেয়ের জন্যে।

আশা মরীচিকা। তবু, ভাবলেও বুকের মধ্যে বন্ধ হয়ে আসে নিশ্বাস। একে ওই ডাকাতে মেয়ে। সোনা হিরে ছাড়া যার মুখে কথা নেই। রাজবাড়ি আর পালঙ্ক ছাড়া যার আকাঙ্ক্ষা নেই। তার উপরে ওই বাপ। গোঁয়ার ভোলা খুড়ো। বাপরে! হাসলে যে মারতে আসে, মেয়ে চাইবে তার কাছে? চাইলে বোধ হয়, জালে পাথর বেঁধে চিরদিনের জন্যে ডুবিয়ে দেবে গঙ্গার অতল জলে। তবু তো প্রাণ মানে না। মেয়ে কেঁদে একশা হবে শুনেই শিথিল হাতে তার শক্তি এল দানবের! আর গলা দিয়ে তার গান আবার বেরিয়ে এল,

কী তোমার চাই বল মন
গোসা করো না।
এনেছি আলতা শাড়ি আতরদান
চেয়ে দেখো না ।

 তার আবেগে থরো থরো উচ্চকণ্ঠের গান ভেসে গেল পাষাণপুরী চুঁচুড়ার বুকে। প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেসে এল গঙ্গায়। ভেসে গেল ঢেউয়ে ঢেউয়ে ওপারের অন্ধকার নৈহাটি তটে।

 ভোলার গঞ্জিকা ধোঁয়াচ্ছন্ন মাথায় গানটি সরস তালের সৃষ্টি করল। মনটা তার ভাল ছিল এ সন্ধ্যাকালে। গানের দ্রুত তালের সঙ্গে দাঁড় ওঠাপড়া করতে লাগল তার। চুঁচুড়ায় সে বড় একটা আসে না। মাঝে মাঝে আসে, যেদিন বড় বড় মাছ ধরা পড়ে, সেইদিন আসে। টোবিস সাহেবকে মাছ বিক্রি করতে আসে। সাহেবের পুরো নাম কেউ জানে না। টোবিস বলেই তার পরিচয়। সাহেবের রং ফরসা। লাল মুখ, আগুনের মতো লকলকে চুল। কিন্তু, সাহেব ইংরেজ নয়। সবাই বলে, ওলন্দাজ। ঘরে তার শ্যামাঙ্গিনী বাঙালি বউ। নাম তার মঙ্গলি বিবি। আসলে নাম তার মঙ্গলা ঠাকরুন। হুগলির পাশে, কেওটা গাঁয়ের এক বামুনের মেয়ে মঙ্গলা। জোয়ান টোবিসের সঙ্গে তার কেমন করে পরিচয় হল কে জানে। সে আজ ত্রিশ বছর আগের কথা। তার কয়েক বছর আগে টোবিস সাহেবদের কাছ থেকে ইংরেজরা কিনে নিয়েছে চুঁচুড়ার কুঠি।

টোবিস ছিল ওলন্দাজদের গাস্টাভাস দুর্গের কেরানি সাহেব। ভোলার ঝাপসা স্মৃতিতে এখনও ভেসে ওঠে সেই তাঞ্জামের চিত্র। তাঞ্জাম ছিল চুঁচুড়ার কুঠির বড় সাহেবের পালকি। বড় সাহেব অর্থাৎ গভর্নর। পালকি কী বিরাট! এত বড় ছিল তার ফাঁদ যে, ভেতরে তার পাতা হত মস্ত বড় চেয়ার। সেই চেয়ারে পায়ের উপর পা দিয়ে বসত বড় সাহেব। বাজনা বাজত ঝর ঝম করে। কুড়ি জন বেহারা হুম হুম করে ছুটত তাঞ্জাম নিয়ে। সেপাই লশকর যেত বন্দুক তলোয়ার ঘাড়ে করে।

টোবিস ঘোড়া নিয়ে ছুটে যেত নিরালা গ্রাম কেওটার বন ঝোপে। পথের মাঝে পড়ত পর্তুগিজদের ব্যান্ডেল গির্জা ও কুঠি। টোবিসকে তারা ঠাট্টা করত, বিদ্রূপ করত। কখনও অন্তরাল থেকে ছুঁড়ে দিত ঢিল টোবিসকে লক্ষ্য করে।

তারপর একদিন, সন্ধ্যার অন্ধকারে বন্দুক হাতে তার পথ রোধ করল দুজন পর্তুগিজ আর একজন ইংরাজ। কারও কুঠির এলাকা দিয়ে যেতে আইনের নিষেধ ছিল না। আসলে টোবিসকে অপমান করাই তাদের লক্ষ্য।

টোবিসও কম যায় না। কোমর থেকে তলোয়ার খুলে, চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনজনের উপর। টোবিসের সেই রুদ্রমূর্তি দেখে পালিয়ে গেল তিনজনেই। শুধু একজনের একটি ছিন্ন আঙুল পড়ে রইল রাস্তার উপর।

এই নিয়ে তখন হুগলি চুঁচুড়ায় ভারী শোরগোল হয়েছিল। মহা হইহই রইরই কাণ্ড। তারপর জানাজানি হল মঙ্গলার কথা। টোবিস বিয়ে করল মঙ্গলাকে। চিরতরে কেওটা ছেড়ে যেতে হল মঙ্গলার বাপ-মাকে। আর ঠিক সেই সময়ই ইংরেজকে চুঁচুড়া বিক্রি করে দিল ওলন্দাজদের দেশের রাজা। অনেক ওলন্দাজ চলে গেছে তাদের সমুদ্র পাড়ের নতুন কুঠিতে সুমাত্রা, যবদ্বীপে। অনেকে রয়ে গেছে। টোবিসও রয়ে গেছে তেমনি৷ এই দেশের মাটি ও বাতাসের মধ্যে, নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে সে।

ত্রিশ বছর। কম নয়। সে সময় ভোলার বয়স ভানুর মতো। বছর এগারো-বারো বয়স। টোবিসকে সে চেনে তখন থেকে।

এখন টোবিসের বাস চুঁচুড়ার শুড়িপাড়ার কাছাকাছি। ঘরে তার সোহাগি বিবি মঙ্গলা। তিন-চারটে ছেলেমেয়ে। মঙ্গলা দিব্যি শাড়ি পরে, শাঁখা পরে, কপালে সিঁথিতে দেয় সিঁদুর। টোবিসকে সঙ্গে নিয়ে যায় ষণ্ডেশ্বরের মন্দিরে। বলে, গড় করো।

টোবিস বলে কেনো?

 মঙ্গলা বলে, আমার শাঁখা সিঁদুর অক্ষয় হবে, আমি তোমার পাতে মাছ ভাত খেয়ে মরব।

টোবিস বলে, হাঁ? টবে হাজারবার গড় করি মঙ্গলা, টোমাডের ষণ্ডেশ্বর বাবা আমাকে কৃপা করুন।

তারপরে, মঙ্গলার হাত ধরে সে নিয়ে যায় তাকে ঘণ্টাঘাটের গির্জায়। বলে, টুমি গড় কর। বল হে ভগবান, আমাকে মুকটির পট দেখাও, আমার হাট ঢর টুমি৷

অনেক কথা। টোবিস মঙ্গলার অনেক কথা। ইংরেজরা তাদের হীন চোখে দেখে। কিন্তু হুগলি চুঁচুড়ার মানুষ আপন জ্ঞান করে।

টোবিস বলে দিয়েছে ভোলাকে, ভোলা যেদিন বড় মাছ ধরবে, সেদিন যেন টোবিসের বাড়ি সেটি যায়। মঙ্গলাবিবি মাছ না হলে খেতে পারে না।

সেই থেকে বড় মাছ পেলেই টোবিস সাহেবের বাড়ি যায় সে। আজ পেয়েছিল বড় বড় অসময়ের তপসে মাছ। সোনালি মাছ যেন টোবিস সাহেবের গায়ের মতো সুন্দর। অসময়ে এত বড় তপসে, তাও কুটলে ওজনে প্রায় চার সের। মঙ্গলাঠাকরুনের আনন্দ আর ধরে না। আর টোবিসের লাল কালো বাচ্চাগুলিও হয়েছে তেমনি মাছের আঁশ খেকো। মাছ দেখে কী তাদের লাফালাফি!

পুরো দুখানি রুপোর টাকা দিয়েছে টোবিস সাহেব মাছের জন্যে। এক টাকা, পাঁচ সিকের বেশি কেউ দিত না। তা ছাড়া মঙ্গলাবিবি ঠাকরুন বার বার করে বলে দিয়েছে, তোমার গঙ্গা মেয়েকে নিয়ে এসো ভোলা। ওকে আমি দুটো রুপোর চুড়ি দেব। সেই জন্যেই মনটি বড় খুশি আছে ভোলার। যা গহনা অন্তপ্রাণ তার ভানুমতীর! মঙ্গলাবিবি রুপোর চুড়ি দেবে শুনলে হুঁড়ি লাফাবে।

আর পুরো দুটি টাকা। নির্ভাবনায় দু আনার গাঁজাই খেয়েছে নবকে সঙ্গে করে। পাঁচ সের পূরবী বালাম চাল কিনেছে। সাহেবরা বাবুরা খায় ওই চাল। সোয়া দু টাকা মন! কম নয়! নবরও আজ বালাম চালের ভোজ হবে মন্দ নয়। তাও আবার ভানুর হাতে।

মন তাদের দুজনেরই প্রফুল্ল। কিন্তু তারা তো জানে না, কী সর্বনাশ হয়েছে। ভোলা তো জানে না, সে ঘোড়ারূপী জিন হয়ে তার আদরের মেয়ের প্রাণ হরণের জন্য ঘুরছে হন্যে হয়ে। আর সে এখন পার হয়ে চলেছে ত্রিবেণীর বাঁক।

গান গাইতে গাইতে নব থামল। পাড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ গো খুড়ো, বলি, এ ইমামবাড়ি না কী ছাই, একি তৈরি শেষ হবে না? জন্ম অবধি যে দেখে আসছি, তৈরিই হচ্ছে।

ভোলা তাকাল পাড়ের দিকে। সত্যি এ ইমামবাড়ি তৈরি শুরু হয়েছে আজ বছর বিশেক হতে চলল। এখনও তার চারদিকে বাঁশের ভারা বাঁধা রয়েছে। বিনির সঙ্গে ভোলার বিয়ের আগে গাড়া হয়েছে এর ভিত। তারপরে মাঝে কত কী ঘটে গেল। কিন্তু ইমামবাড়ি তৈরি হল না আজও। এক ওই পাথর দিয়ে উঁচু গঙ্গার উপরে পোস্তা তৈরি হতেই দেখল কয়েক বছর ধরে। শোনা গেল দিল্লি লাহোর থেকে কারিগর আনিয়েছে মাতোয়ালি সাহেবরা। সেই ধার্মিক, খোদাভক্ত, ইসলাম অন্তপ্রাণ মহসীন তো মারা গিয়েছেন অনেক দিন। ইমামবাড়ির পোস্তার পাশেই, ওই অদূরে দেখা যাচ্ছে তাঁর কবরখানা। উন্মুক্ত, অনাচ্ছাদিত সমাধিস্থূপ। বৈশাখের ঝোড়ো হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে ছোট ছোট চারাগাছ সমাধিস্থূপের উপরে। গরিবের মা বাপ ছিলেন রাজা। জীবন কাটিয়ে গেছেন ফকিরের মতো। তারপর সর্বস্ব তুলে দিয়ে গেছেন মাতোয়ালিদের হাতে। গভর্নমেন্টের ঘরে রইল টাকা। দরকার মতো খরচ করবেন মাতোয়ালিরা। মাতোয়ালিদেরই বলে গেছেন ইমামবাড়ি তৈরি করবার কথা। তাঁর সেই বাসনা পাঁচ বছরের পর মূর্তি ধরে উঠছে দিনের পর দিন। ওই পোস্তা বাঁধাতেই নাকি খরচ হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। তারপরে ওই সুউচ্চ মিনার।

নব বলল, হ্যাঁ গো খুড়ো, ওই মিনের দুটো নাকি দিল্লি বেলাত থেকেও দেখা যাবে? একটু সংশয় হল ভোলার। মিনার অবশ্য খুবই উঁচু। কিন্তু দিল্লি-বিলাত থেকে দেখা সম্ভব কিনা কে জানে। কেনো, সে শুনেছে, সেই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে নাকি বিলাত। অত দূর থেকে দেখা যাবে কি?

সে জবাব দিল, তা হতে পারে। যা উঁচু, আরে বাপরে বাপ। ব্যান্ডেলের গির্জের চুড়োকে বলে, ওদিক যাক। ঘণ্টাঘাটের গির্জের চুড়োকে বলে, ওদিক যাক। ঘণ্টাঘাটের গির্জের চুডোর চেয়েও উঁচু। ওই যে বলে না,

কে বলেরে বুড়ি গেছল বেন্দাবন।
ঘন্টাঘাটের গির্জে দেখে বললে গিরি গোবর্ধন।

 তা এবার ইমামবাড়ির মিনার দেখে বলবে গোবর্ধনের মন্দিরের চুড়ো।

শুধু উঁচু নয়, ঝিকিমিকি জোনাকির সব চুমকি পাথর গাঁথা হয়েছে মিনারের গায়ে। তবু এখনও কাজ শেষ হয়নি, এখনও বাঁশের ভারায় ভারায় চারিদিক শ্রীহীন বলে মনে হয়। গঙ্গার ধারের পেছনের দেয়ালে মহসীনের দানপত্র খোদাই হয়েছে কত দিন ধরে।

ভোলার নিজেরই ঝাপসা হয়ে এসেছে সেই ভিত গাঁথার দিনের কথা। নব তো সেদিনের ছেলে। বছর কুড়ি বয়স। দু-এক বছর বেশি হতে পারে। তার জন্মের সময় আরম্ভ। সে তো ও কথা বলবেই।

ভোলা বলল, তবে শুনেছি নাকি, শেষ হয়ে গেছে। এবার ভারা খুলতে আরম্ভ করবে।নবর মনে একটি ভয়ের ছমছমানিও ছিল। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, খুড়ো, শুনছি, এর নীচে তিনজনের কবর রয়েছে? ভোলা বলল, তিনজনের কেন, ছজনের।

জোয়ান নবর বুকের মধ্যে শিউরে উঠল। অন্ধকারের মধ্যে দন্ত বিকশিত হাসির মতো চকচক করে উঠছে গঙ্গার ঢেউ। শাঁ শাঁ করে বইছে হাওয়া। পাড়ের গাছগাছালিতে ঝোড়ো শোঁ-শোঁ ধ্বনি। আর সামনে অসংখ্য বাঁশের মাথা খাড়া করা সুবিশাল ইমারত। নীচে তার ছটি মানুষ। সে ছটির যদিও কোনও সাড়া শব্দ নেই, কিন্তু পাশে যাঁর কবর রয়েছে তিনি প্রাণবন্ত। অত বড় দাতা মানুষ, এখনও হয়তো কবরের উপর জেগে রয়েছে তাঁর নিষ্পলক হাস্যময় ব্যাকুল চোখ। তাকিয়ে আছেন, তাঁর সাধের ইমামবাড়ির দিকে। কিন্তু একবারও কি আর নবা জেলের নৌকার দিকে না তাকাচ্ছেন?

নব রাম নাম জপতে আরম্ভ করল। কেন যে খুড়ো চুঁচুড়ার দিকে আসে। এলে তো নৈহাটি ঘেঁষে এলেই হত। তাড়াতাড়ি মন থেকে ভাবনাটা ঘোচাবার জন্যে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা খুড়ো, শুনছি। বেলাত থেকে ঘড়ি এনে বসানো হবে এর ছাতে?

ভোলা বলল, ছাতে নয়। শুনিচি, ওই মিনারের গায়ে বসানো হবে ঘড়ি। সে তো পেল্লায় ঘড়ি, ঘণ্টাঘাটের গির্জের চেয়েও নাকি জোরে বাজবে।

হালিশর থেকে শোনা যাবে?

তা আর যাবে না? বলে ভোলা আবার তাড়া দিল, নে এবার টেনে চল দিকিনি। রাত হল অনেক। আবার শুধু শুধু জল পুলুশশা হুজজোত করবে। আর মেয়েটা না জানি কী করছে।

মেয়েটা। সেই মেয়েটা। নামটা মুখে আনতেও সাহস হয় না নবর। শুধু মূর্তিখানা ধ্যান করে বুকের মধ্যে, লুকিয়ে, ভয়ে ভয়ে। মনে মনে নাম করতেও ভয় হয়। যদি ভোলা খুড়ো তাতেও শুনে ফেলে?

এরকম হয়েছে কত দিন। ফিরতে দেরি হয়েছে। রাগে কান্নায় হাত-পা ছুঁড়েছে গঙ্গা। বাপের আদরে সোহাগে ভুলে আবার ঘুম চোখে বসেছে রান্না করতে। দুরে বসে বসে দেখেছে নব। উনুনের আগুন তার চোখে ঠেকত না। মনে হত তার শিখার চেয়েও ভানুর রূপের আলো বেশি। আজ তো সে খাবে। নিজেই ছুটে ছুটে জল জোগাবে, আগুন জ্বালাতে সাহায্য করবে। আর দু চোখের বিষের মতো তাকে দেখবে ভানু, বলবে, রাক্কোস কমনেকার। গেলবার জন্যে মলো৷

হ্যাঁ হোক ছোট্টটি, তবু অমনি পাকা পাকা তার কথা। আর কথাগুলি যে কী ভালইনা লাগে নবর। রাতে না ঘুমিয়ে, খালি ওই কথাগুলি বিড়বিড় করে আপন মনে। আর বলে, হে ভগবান, হে মৎস্যদেবী, একদিন একটা মাছের পেট কেটেও যদি কিছু হিরে জহরত পেয়ে যাই, তো মাইরি, ও মেয়ের পায়ে দিয়ে আমি ওর তোলো নাকটি নামিয়ে দিই।

সেই মেয়েটা। কাঁদবে, সত্যি কাঁদবে বাপের দেরি দেখে। নবর প্রাণখানিও কেঁদে ওঠে অমনি। ব্যান্ডেল গির্জার পাশ থেকে কোণ বরাবর পাড়ি দিল সে। দিয়ে আবার গান ধরে দিল,

সই, রাত পোহালো ফরসা হল।
তোমার নাগর এল না ৷

জোয়ারের জল ঢুকেছে হালিশহরের জেলেপাড়ার মাঠের নয়ানজুলির মধ্যে। তার মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে বেঁধে, চাল ও বাজারের পুঁটলি নিয়ে নেমে এল। অন্ধকারে পা আটকায় না। চেনা রাস্তা। পাড়ায় তখনও লোকজনের রীতিমতো সাড়া শব্দ শোনা যাচ্ছে। সতীশ জেলের বাড়িতে, খোল করতাল সহযোগে নামগান চলেছে এখনও। বাড়ির উঠোনে ঢুকে রোজকার মতো ডাক দিল ভোলা, গঙ্গা! ও গঙ্গা! ভানু।

সাড়া না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে উঠল ভোলার। পেছনে তার নব। দুজনেই তাকিয়ে দেখল উঠোন দাওয়া ঘর সবই অন্ধকার।

নব বলল, খিল এঁটে ঘুমোচ্ছে। ভয় লাগে তো।

সে কথা ঠিক। তবু, সারাদিন খেটে-খুটে, সাড়াশব্দহীন অন্ধকার বাড়ি দেখলে কেমন রাগ হয় ভোলার। সে দাওয়ায় উঠে, দরজা ধাক্কা দিল। ডাকল, ভানি, ও ভানি, দরজা খোল, ওঠ।

শব্দ নেই। গোলপাতার বাতায় হাওয়ার সরসরানি। বাঁশের মাচার ক্যাঁ কোঁ ধ্বনি। আর খোল করতালের স্তিমিত স্বপ্নজড়িত আওয়াজ।

 ভোলা বিরক্ত হয়ে বলল, কী হল, ছুঁড়ি দোর খোলে না কেন? হারামজাদির সারাদিন টো টো, আর সনজে হলেই ঘুমে কাদা। ওলো ও গঙ্গা, দোর খোল লো, দোর খোল।

তবুও সাড়া নেই। কোথায় আচমকা দীর্ঘস্বরে ডেকে উঠছে একটা রোগ-মারী-গন্ধ পাওয়া শঙ্কিতা মার্জারী। নব আশায়, আগ্রহে অধীর হয়ে দীপ্ত চোখে তাকিয়ে ছিল অন্ধকার দাওয়ার দিকে। সেও বিস্মিত হল। এত ডাকতে হয় না তো৷ বলল, খুড়ো, শেকল গাছটায় হাত দে দ্যাখো তো, আঁটা আছে নাকি?

ভোলা শিকলে হাত দিয়ে দেখল, শিকল আঁটা। বলল, তাই তো রে, ঘর যে শিকলবন্ধ।

নব একগাল হেসে বলল, হেঁ হেঁ, তাই তো বলছি, লইলে সাড়া নেই কেন। নিচ্চয় নদে পিসির বাড়ি গে বসে আছে। তুমি থাকো, আমি ডেকে নে আসি।

কিন্তু ভোলা বড় অস্থির মানুষ। এমন গোঁয়ার, এত রাগ, এত হাঁকডাক। কিন্তু তার মন বড় দুর্বল। বিনি চলে যাবার পর থেকে এমনি হয়েছে। অল্পতেই বড় দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। সিঁদুরে মেঘ দেখা গোরুর মতো। বুকের আধখানা পুড়ে গেছে। আধখানা আছে। তাও কখন আগুন লাগে, কে জানে। মুখে যাই বলুক, যতই ছেড়ে থাকুক সারাদিন, মনটি পড়ে থাকে এখানে, এই ঘরে। সারাদিনের ধুকপুকুনি কাটে, বুকের কাছে মেয়েটাকে নিয়ে শুয়ে। বলল, চল, আমিও যাই।

নব মনে মনে নিরাশ হল। ফিরতি পথে যাও বা ভানুর একটু মিঠে কড়া বুলি শুনতে শুনতে আসা যেত, তাও হবে না। নদে পিসির বাড়িতে গিয়ে ডাকল। নকুলমামার বউ নদেবালা। ভানুকে বড় ভালবাসে। সে বেরিয়ে এসে বলল, কই, সারাদিন তো আজ ভানির দেখা ছিল না এ পাড়ায়। দেখগে তালে, সতীশের বাড়িতে। আজ তার বাড়িতে পালা গাইবার কথা।

ভোলার রাগ চড়ল। আর স্তম্ভিত হল নব। বাপের হাতে ভানুর পীড়নের কথা ভেবে। সতীশের বাড়িতে অনেক লোকজন এসেছে। সবাই তাকে ডেকে বসাতে গেল। সে জিজ্ঞেস করল, আমাদের গঙ্গা এসেছে?

মেয়ে পুরুষ সবাই বলল, না তো৷ গঙ্গার মতো মেয়ে, নজরে পড়তই এক বার। তবে? তবে এক বার উত্তর পাড়াটা ঘুরে দেখা যাক। কিন্তু উত্তরপাড়াতেও নেই। সেখান থেকে এসে পড়ল বামুন পাড়ার মধ্যে। এ পাড়া; সে পাড়া, কোনও পাড়াতেই নেই। বরেন্দ্ৰগলির শিবের মন্দিরে গেল নাকি পুজোর প্রসাদ খেতে? না, সেখানেও নেই। মন্দিরের দরজা বন্ধ। কেবল একটি প্রদীপ জ্বলছে বাইরে। প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে মন্দিরের গায়ের পুতুলের বিচিত্র মূর্তির কিয়দংশ। পোড়া ইটের মধ্যে নানান কাহিনীর চিত্র। রামায়ণ মহাভারত। তা ছাড়াও আছে, সপ্তদশ শতাব্দীর ফিরিঙ্গিদের অনেক চিত্র। কেমন করে তারা লড়াই করে, কেমন করে লুঠ করছে তারা এদেশের মেয়ে পুরুষদের। কেমন করে বুকে ধরে আদর করছে এদেশের মেয়েকে। সাহেবের বুকে দেশি মেয়ে, যেন টোবিসের বুকে মঙ্গলাবিবি। মাথায় তার এত বড় খোঁপা, বিচিত্র শাড়ি পরার ধরন। হাতে কঙ্কণ ও বাজুবন্ধ। পায়ে মল।

মন্দিরের গায়ের সেই সব মূর্তি, নিঃশব্দ নিরালার অবসরে নিজেদের লীলায় ব্যস্ত ছিল। তারা যেন কম্পিত প্রদীপের শিখায় জেগে উঠেছিল। হঠাৎ দুটি মানুষ দেখে নিশ্চল হল তারা। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ভোলা আর নবর দিকে। তারপর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে টিকটিকির টকটক শব্দের মধ্যে নিজেদের বিদ্রূপ ভরা হাসিকে মিশিয়ে দিল তারা। ও! ভানুমতীর বাপ এটা। হায়, সে যে কখন চলে গেছে, কখন নিয়ে গেছে তাকে। আমাদের মতো সেও এখন মন্দিরের পুতুল হয়ে গিয়েছে।

 নেই, এখানে নেই ভানি। চল তো সিদ্ধেশ্বরী তলায়। লাটু ঠাকুর অনেক পুথি পাঁচালি সুর করে পড়ে। সেখানে তো প্রায়ই যায় ভানু।

সেখানে এল। কেউ নেই। লাটু ঠাকুরও নেই। হঠাৎ কানে এল, কারা কথা বলছে। হালকা মদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।

কে একজন বলছে, নো নো, আমাকে বুঝিয়ে দাও শ্ৰীমন্ত, রামমোহনের সঙ্গে কেশব বাবুর ব্রাহ্ম ফিলজফির মিলটা আর আছে কোথায়?

আর একজন বলছে, থাক বা না থাক দ্যাট ইজ নট আওয়ার অ্যাফেয়ার। তুমি বলেছ, ঈশ্বর গুপ্তের এটা ছ্যাবলামি হয়েছে। প্রভাকরের মতো একটা কাগজও তুমি বার করে দিকিনি?

ভোলা বুঝল, কথা বলছে গাঙ্গুলিবাড়ির বড় ছেলে শ্ৰীমন্তবাবু। ওপারের মহসীন কলেজে পড়ে। গাঁয়ের সব কলেজের পোডোরা প্রায়ই এখানে মিলিত হয়, মদ খায়। শোনা যাচ্ছে, তারা নাকি কলকাতার সাহেব ন্যাটো বাবুদের মতো হিন্দুর অখাদ্যও খায়।

ফিরে আসছিল। শ্ৰীমন্ত মত্ত কণ্ঠে ঘেঁকে উঠল, কে রে সিদ্ধেশ্বরী তলায়?

ভোলা বলল, আমি, ভোলা জেলে।

–ওখানে কী করছিস?

–মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছিনে বাবু। তাই দেখতে এসেছিলুম।

 শ্ৰীমন্ত জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ইউ মিন ডটার? ইওর ডটার? হাউ ওলড ইজ শি? টেক দি জেট ব্ল্যাক ডল অব গডেস সিদ্ধেশ্বরী অ্যান্ড গো হোম। ডোন্ট কাম হিয়ার। উই আর নট আফটার ইওর ডটার।

কে একজন বলে উঠল, আঃ শ্ৰীমন্ত, বেচারি ওর মেয়েকে খুঁজছে। কী যা-তা বলছ। এখুনি লোকজন জমে যাবে। জমাটি আসরটা মাটি হবে। ইউ বেটার রিসাইট ফ্রম শেলি! হাউ বিউটিফুল নাইট।…

পোড়ো মাতালের কাণ্ড। সব লেখাপড়া জানা দেশি বাবু সাহেব। এখানে গঙ্গার অন্ধকার নিরালায় আসে মদ খেতে। কী অদ্ভুত খেয়াল। যে যার নিজের খেয়ালে আছে।

সেখান থেকে চলে এল ভোলা আর নব। মনে করেছিল ওরাই বুঝি বলে দেবে ভানুর কথা। কিন্তু না, কোথায় গেল মেয়েটা? আবার ঢুকল অন্য পাড়ায়। বাতি জ্বলছে নিশিকান্ত ঠাকুরের চণ্ডীমণ্ডপে। কুলীন নিশিকান্ত বিয়ে করেছে প্রায় পঞ্চাশটি। এ আসরে এসে জুটেছে আরও গোটা তিনেক কুলীন বন্ধু। সকলেই প্রায় আফিমের নেশায় চুর চুর।

তবু হাঁক দিল, কে যায়?

ভোলা জেলে।

 কোথায় যাচ্ছিস?

মেয়েটাকে পাচ্ছিনে ঠাকুর মশাই?

তোর সেই বিধবা মেয়েটা তো?

ভোলা বললে, না তো। আমার আইবুড়ো মেয়ে।

নেশার ঝোঁকে নিশিকান্ত এক প্রহসন আরম্ভ করল, আমি বলছি সে বিধবা, কী বলল হে বাঁড়ুজ্জে?

তারাও বলল,  নিশ্চয়ই। বলছ যখন, তখন নিশ্চয়ই সে মেয়ে বিধবা।

ভোলা মাতালের মাতলামিতে বিরক্ত হলেও মনে মনে ভাবল, আমার আইবুড়ো ভানি এদের কথায় তো আর বিধবা হয়ে যাবে না। আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করল, তা যেন হল ঠাকুর, কিন্তুস দেখেছ তাকে?

নিশিকান্ত বিকৃত মুখে ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, তোর সেই বিধবা মেয়েকে? জানিস নে, বিধবার যম, তোদের বিদ্যেসাগর এসেছে ওপারে! দেখগে যা কোন বেজন্মার সঙ্গে তোর মেয়ের বে দিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু গোখরোর ফণার মতো মাথা তুলল ভোলা। বেজন্মার সঙ্গে ভানির বিয়ে? পরমুহূর্তেই তার মস্তিষ্ক নাড়া খেল। ক্রুদ্ধ চোখে একবার সেদিকে দেখে আবার দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটল পাড়া থেকে পাড়ায়। বাড়ি থেকে বাড়িতে। মন্দির থেকে মন্দিরে।

আমার ভানিকে দেখেছ? না? তবে, কোথায় গেল মেয়েটা? ভোলা হতাশায় মুহূর্তে মুহূর্তে ভেঙে পড়ছে। নব নতুন নতুন আশায় ফিরছে তার পেছনে। কোথায় কোথায় যেতে পারে মেয়েটা।

গ্রাম ঘুমিয়ে পড়ছে। রাত বাড়ছে। অন্ধকার ক্রমে যেন আরও গাঢ় হচ্ছে। বাতাস দুরন্ত হয়ে উঠছে। আরও। গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসছে ভোলার। সম্ভব অসম্ভব, কত কী আসছে মাথায়। শুকনো উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, চল তোলবা, পঞ্চমুণ্ডির তলায়।

রামপ্রসাদের পঞ্চবটীর তলায়। কিন্তু সেখানে কেন যাবে এত রাত্রে? যদি যায়! প্রাণ যে মানছে না। নবও বোকাটে ভাঙা গলায় বলল, চলো।

ঘোর অন্ধকার। বিশাল পঞ্চবটী, বিরাট বিরাট অজগরের মতো পাকিয়ে জড়িয়ে, লতিয়ে মাথা তুলেছে আকাশে। উপর থেকে নেমে এসেছে সর্পিল শিকড়, গেঁথে গেছে আবার মাটিতে। বাতাসে ঝরঝর শব্দে দুলছে বনস্পতির মাথা। অদূরে রামপ্রসাদের ত্রিশূল-গাঁথা ছোট্ট ঘর। আর কোনও দেবদেবীর মূর্তি নেই। আর চারিদিক গাঢ় অন্ধকার ও ভয়ংকর জঙ্গল। তীব্র হাসনুহেনার গন্ধ অজস্র অদৃশ্য কালকেউটের মতো যেন কিলবিল করে চারপাশে। সুমধুর তীব্র বিষের মতো স্নায়ুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যেন অবশ করে দিতে চায়। অন্ধকারে সন্ধানী উদ্দীপ্ত চোখ জ্বলজ্বল করছে ভোলার। নবরও তাই। রামপ্রসাদের সাধন দেবীর দুটো দুতের মতো কয়েক মুহূর্ত তারা দুজনে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। তারপর আশাহত হয়েও অকারণ ভোলা হঠাৎ ডেকে উঠল, গঙ্গা। গঙ্গা। গঙ্গা!..

উত্তরে একটা দমকা হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল পঞ্চবটীর গায়ে। নেই? তবে? অন্ধকারে তারা পরস্পরের দিকে ফিরে তাকাল। তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।

নবর বুক কেঁপে উঠল অন্ধকারে ভোলার সেই চোখের দিকে তাকিয়ে। ভোলার মনে পড়ছে আট বছর আগের কথা। বিনির চলে যাওয়ার দিনের কথা। সেই বুকভরা আগুনের কথা। একদিক পুড়ল, আর একদিক রইল। বুকে করে এত বড়টি করেছে। কী হল তার? সেও কি তেমনি করেই গেল? কিন্তু ওইটুকু এক ফোঁটা মেয়ে। কী করে সে যাবে। সে যে আমার বুক না হলে মাথাই রাখতে পারে না। আমাকে না জড়ালে যে তার পোড় চোখে ঘুম আসে না। আমার সেই ভানি, গঙ্গা, ভানুমতী কোথা গেলি হতভাগী, কোথা গেলি?

হাত থেকে পড়ে গেল তার চালের পুঁটলি। ছড়িয়ে গেল মশলা আর কয়েকটা তপসে মাছ। রেখে দিয়েছিল তার ভানুর জন্যে। নরম হয়ে গেছে মাছগুলি। গন্ধ বেরুচ্ছে। নব তাড়াতাড়ি তুলে নিল চালের পুঁটলিটা। রামপ্রসাদের পঞ্চবটী। মা কালীর ঠাঁই। মাছ পড়ল এখানে? তাড়াতাড়ি তুলে পুঁটলিতে ভরতে গিয়েও ফেলে দিল সামনে পুকুরে। অমনি কয়েকটা অদৃশ্য ভোঁদড় তীক্ষ্ণ দাঁত মেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। ভোঁদড়ের উল্লাসে ক্ষুব্ধ শেয়াল কয়েকটা বনের ভিতর দিয়ে পালাল সড় সড় করে।

ভোলা আবার হনহন করে চলল। নব গেল পেছন পেছন। গঙ্গার ধার দিয়ে ভোলা ছুটল হাজিনগরের দিকে। সেখানে জানাশোনা লোকের বাড়িতে রাত করে হানা দিল। হাজিনগর থেকে গরিফা।

তারপর আবার ফিরে এল। অন্ধকার। আর আকাশ ভরা অগণিত নক্ষত্র। সমস্ত গ্রাম নিদ্রামগ্ন। গ্রাম্য দেবী সিদ্ধেশ্বরীতলায় এসে দাঁড়াল দুজনে, দুটি রাত্রিচর ব্যাকুল মূক মানুষ। দুজনেই ঘামছে দরদর করে।

সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির খোলা। প্রদীপ জ্বলছে ভিতরে। চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী। আধ হাত লম্বা। কালো কুচকুচে। কিন্তু সাদা আকর্ণবিস্তৃত চোখ।

ভোলা ডাকতে গেল, মা, মা! শব্দ বেরুল না গলা দিয়ে। নবও ডাকতে চাইল। শুষ্ক কণ্ঠতালুতে শব্দ নেই। দুজনেই তারা চমকে ফিরে তাকাল দুজনের দিকে। একজনের কন্যা। আর একজনের গোপন প্রেয়সী। ভোলা তাকিয়ে রইল নবর দিকে। হঠাৎ বলল, তুই কেন ঘুরছিস লবা?

ভোলার স্ফীত মাংসপেশি ও অস্বাভাবিক চোখের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস আটকে এল নবর গলার কাছে। মারবে নাকি! তবু বলল, আর কোথা যাব খুড়ো?

পাগলের মতো বিভ্রান্ত চোখে ভোলার জল আসছে মনে হল। মাথা নেড়ে বলল, সত্যি আর কোথা যাবি?

আবার ঢুকল জেলে পাড়ায়। রাত পোহাল। সারাদিন খোঁজা হল। দুপুর বেলা দেখা হল সর্বেশ্বরের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাকি মেয়ে হারিয়েছে, ভোলা বাবাজি? চারিদিকে একেবারে সাড়া পড়ে গেছে শুনলুম! ভোলা শুধু তাকিয়ে রইল। সঙ্গে নব। এখন শুধু প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করে, তারা দুজনেই তাকিয়ে থাকে। ভোলার সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সর্বেশ্বরের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি উড়নি দিয়ে মুখ মুছে বলল, আহা, সোনার চাঁদ মেয়ে। খুঁজে দেখো। আমিও দেখব, যেখানেই যাই।

তারপর মনে মনে দুর্গানাম জপ করতে করতে সরে পড়ল। টের পেলে বোধ হয় বঁটিতে কুচিয়ে কাটবে। ব্যাটা খুনির মতো হয়ে উঠেছে।

আর কথা নেই ভোলার মুখে। কথা নেই নবর মুখেও। বারকয়েক পাগলের মতো নৌকা নিয়ে পারাপার করল হুগলি হালিশহর। বড় বড় পাতা জাল সব উঠিয়ে উঠিয়ে দেখল নদীর বুকে। নেই। নেই। কোথাও নেই। সব আছে, সবাই আছে, ভানি নেই।

শরীরের শক্তি কমে এল সারাদিনে। তবু গলায় দড়ি দেওয়া মড়ার মতো বিচিত্র উদ্দীপ্ত চক্ষু ভোলার ও নবর।

কন্যা ও প্রেয়সী সন্ধানে পাগল দুটি মানুষ।

দিন গেল। রাত হল। সেই রাত। প্রাণ ভোলানো বাতাস, আকাশে কোটি কোটি সন্ধ্যাকলির মতো নক্ষত্র। তারপর হঠাৎ গুমোট। হাওয়া বন্ধ হল। বায়ুকোণে বিদ্যুঝলক দেখা দিল। কালো হয়ে এল আকাশ। গঙ্গার ধারে, ভোলা আর নব সিদ্ধেশ্বরীর বটতলায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। বাঁধা নৌকাটা স্থির হয়ে রয়েছে। হঠাৎ ঢেউ স্তব্ধ হয়েছে আচমকা গুমোটে। বটগাছটা স্থির। একটিও পাতা নড়ছে না। যেন ঝড়ের পূর্বলক্ষণে ঝিঁঝি পোকাটাও থেকে থেকে ডাকছে আর চুপ করছে। আবার ডাকছে। এই নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ওপার থেকে দ্রুত ঘোড়ার পায়ের সুদুর শব্দ ভেসে আসছে এপারে স্তিমিত হয়ে।

দুজনে তাকিয়ে ছিল দুজনের দিকে। তারপর হঠাৎ পূরবী বালাম চালের পুঁটলিটা মুখে চেপে প্রথমে নব-ই ফুঁপিয়ে উঠল। গোপন প্রেম প্রকাশের ফোঁপানি, দুঃসাহসের ফোঁপানি। হৃদয়কে আর বেঁধে রাখা গেল না। কালকে একবার রামপ্রসাদের ভিটেয় দাঁড়িয়ে ডেকে উঠেছিল ভোলা মেয়ের নাম নিয়ে। নবর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সারাদিন পরে আবার গলার শির ফুলিয়ে আচমকা চিৎকার করে ডেকে উঠল সে, ভানু, ভানু ভা…নি!তারপর বলল, নব, তুইও ডাক।

নব বলল, আমিও?

 তারপর জ্ঞানশুন্য বধির অন্ধ দুটি মানুষ চিৎকার করে ডাকতে লাগল, ভানি..ই-ই-ই? তার মধ্যে দুই সুর। বাপের সুর আর প্রেমিকের সুর যেন। এমনি করে ডাকলেই ভানু কোথাও থেকে বলে উঠবে, এই যে বাবা গো! এই যে আমি এখেনে। এখেনে।

কিন্তু নেই। বাতাস নেই। সে করুণ ও আর্ত ডাক সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরে ঘা খেয়ে তাদেরই চারপাশে ঘুরে ফিরে পাক খেয়ে বেড়াতে লাগল। শুধু কানে পৌঁছচ্ছে সর্বেশ্বরের। ঘরের মধ্যে তার মুখরা ব্রাহ্মণীর গায়ের কাছ ঘেঁষে সে কাঁপছিল থরথর করে।

ব্রাহ্মণীকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হয়নি। গঙ্গাকে খোঁজাখুঁজি করতে দেখে, আর সেই সঙ্গে সর্বেশ্বরের ভাবান্তর লক্ষ করেই সব বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে, রাক্ষস মিনসে নন্দনের সঙ্গে গিয়ে মেয়েটাকে খেয়ে এসেছে। বুঝবেই। নিজের ব্রাহ্মণীর কাছেই এক বার প্রস্তাব করেছিল সর্বেশ্বর, একটা মস্ত দাঁও মারা যায়, যদি তার ব্রাহ্মণী দুরাত্রির জন্যে কনে সাজতে পারে। কেউ ধরতেও পারবে না, বরও অশীতিপর। আর স্থানও এখানে নয়, চন্দননগর।

ব্রাহ্মণী একেবারে মা কালী হয়ে উঠেছিল। প্রায় পাড়া মাথায় করেছিল আর কী! সেই থেকে ব্রাহ্মণীকে বড় ভয় সর্বেশ্বরের।

সর্বেশ্বরের কাঁপুনি দেখে তার যত ঘৃণা হচ্ছিল, হাসি পাচ্ছিল তত। অন্ধকারে মুখ টিপে হেসে বলল, কেন, এখন অত হাড় কাঁপানি কেন মদ্দো মিনসের। ডাকি এক বার ভোলাকে, ডেকে বলি, এই ঘটক ঠাকুরকে ধরো বাছা, বড় ঘটা করে ঠাকুর তোমার মেয়ের বে দিয়ে এসেছে।

ভয়ে সর্বেশ্বরের হেঁচকি ভোলার মতো হাসি পেয়ে গেল। বলল, কী যে বলিস, হেঁ হে! একটু আস্তে, মানে বেড়ারও কান আছে কিনা।

ব্রাহ্মণী মুখ টিপে হেসে নির্বিকার গলায় বলল, তা তো আছেই। সেই জন্যেই তো বলছি। ভোলার মেয়েটাকে…

সর্বেশ্বর দু হাতে বউয়ের মুখ চাপা দিয়ে বলল, চুপ কর মাইরি, ভোলা যে ডাকাত! গঙ্গায় ডুবিয়ে মেরে ফেলবে আমাকে।

মারুক।

তাতে কি তোর লাভ হবে?

নৈশ বাতাস ভেদ করে আবার ভেসে এল, ভোলা আর নবর ডাক, ভানি-ইই…।

এখন শুধু ডাকার জন্যেই ডাকা। যে-ডাকে আর সাড়ার প্রত্যাশা নেই। শুধু বারে বারে নামটা উচ্চারণ করার জন্যেই যেন। ভানি, ভানি, গঙ্গা, গঙ্গা..

ব্রাহ্মণীর সারা অন্তর ব্যথায় ও ঘৃণায় তিক্ত হয়ে উঠল। সরোষ চাপা গলায় বলে উঠল, লাভ হবে এই, আমি বিধবা হব, বুঝেছ, বিধবা হব, তোমার ভাত আর আমাকে গিলতে হবে না।

সর্বেশ্বর হুশ করে একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, দ্যাখ, দেখছিস চার্বাকীরা বলে, পাপ করলে পাপের সাজা মানুষ বেঁচে থেকেই ভোগ করে যায়। আমিও সেই রকম ভোগ করছি।

ব্রাহ্মণী মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, মরে যাই আর কী! ভোলা তখনও ডাকছে। সর্বেশ্বর তেমনি করুণ স্বরেই বলল, পাগল, দুটোই পাগল।

ব্রাহ্মণী আবার বলল, মরণ!

মণিহারা

মণিহারা

সেই জীর্ণপ্রায় বাঁধাঘাটের ধারে আমার বোট লাগানো ছিল। তখন সূর্য অস্ত গিয়াছে।

বোটের ছাদের উপরে মাঝি নমাজ পড়িতেছে। পশ্চিমের জ্বলন্ত আকাশপটে তাহার নীরব উপাসনা ক্ষণে ক্ষণে ছবির মতো আঁকা পড়িতেছিল। স্থির রেখাহীন নদীর জলের উপর ভাষাতীত অসংখ্য বর্ণচ্ছটা দেখিতে দেখিতে ফিকা হইতে গাঢ় লেখায়, সোনার রঙ হইতে ইস্পাতের রঙে, এক আভা হইতে আর-এক আভায় মিলাইয়া আসিতেছিল।

জানালা-ভাঙা বারান্দা-ঝুলিয়া-পড়া জরাগ্রস্ত বৃহৎ অট্টালিকার সম্মুখে অশ্বত্থমূল-বিদারিত ঘাটের উপরে ঝিল্লিমুখর সন্ধ্যাবেলায় একলা বসিয়া আমার শুষ্ক চক্ষুর কোণ ভিজিবে-ভিজিবে করিতেছে, এমন সময়ে মাথা হইতে পা পর্যন্ত হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া শুনিলাম, “মহাশয়ের কোথা হইতে আগমন।”

দেখিলাম, ভদ্রলোকটি স্বল্পাহারশীর্ণ, ভাগ্যলক্ষ্মী কর্তৃক নিতান্ত অনাদৃত। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদেশী চাক্‌রের যেমন একরকম বহুকাল-জীর্ণসংস্কার-বিহীন চেহারা, ইঁহারও সেইরূপ। ধুতির উপরে একখানি মলিন তৈলাক্ত আসামী মটকার বোতাম খোলা চাপকান; কর্মক্ষেত্রে হইতে যেন অল্পক্ষণ হইল ফিরিতেছেন। এবং যেসময় কিঞ্চিৎ জলপান খাওয়া উচিত ছিল সে সময় হতভাগ্য নদীতীরে কেবল সন্ধ্যার হাওয়া খাইতে আসিয়াছেন।

আগন্তুক সোপানপার্শ্বে আসনগ্রহণ করিলেন। আমি কহিলাম, “আমি রাঁচি হইতে আসিতেছি।”

“কী করা হয়।”

“ব্যাবসা করিয়া থাকি।”

“কী ব্যাবসা।”

“হরীতকী, রেশমের গুটি এবং কাঠের ব্যবসা।”

“কী নাম।”

ঈষৎ থামিয়া একটা নাম বলিলাম। কিন্তু সে আমার নিজের নাম নহে।

ভদ্রলোকের কৌতুহলনিবৃত্তি হইল না। পুনরায় প্রশ্ন হইল, “এখানে কী করিতে আগমন।”

আমি কহিলাম, “বায়ুপরিবর্তন।”

লোকটি কিছু আশ্চর্য হইল। কহিল, “মহাশয়, আজ প্রায় ছয়বৎসর ধরিয়া এখানকার বায়ু এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যহ গড়ে পনেরো গ্রেন্‌ করিয়া কুইনাইন খাইতেছি কিন্তু কিছু তো ফল পাই নাই।”

আমি কহিলাম, “এ কথা মানিতেই হইবে রাঁচি হইতে এখানে বায়ুর যথেষ্ট পরিবর্তন দেখা যাইবে।”

তিনি কহিলেন, “আজ্ঞা, হাঁ, যথেষ্ট। এখানে কোথায় বাসা করিবেন।”

আমি ঘাটের উপরকার জীর্ণবাড়ি দেখাইয়া কহিলাম, “এই বাড়িতে।”

বোধকরি লোকটির মনে সন্দেহ হইল, আমি এই পোড়ো বাড়িতে কোনো গুপ্তধনের সন্ধান পাইয়াছি। কিন্তু এ সম্বন্ধে আর কোনো তর্ক তুলিলেন না, কেবল আজ পনেরো বৎসর পূর্বে এই অভিশাপগ্রস্ত বাড়িতে যে ঘটনাটি ঘটিয়াছিল তাহারই বিস্তারিত বর্ণনা করিলেন।

লোকটি এখানকার ইস্কুলমাস্টার। তাঁহার ক্ষুধা ও রোগ শীর্ণ মুখে মস্ত একটা টাকের নীচে একজোড়া বড়ো বড়ো চক্ষু আপন কোটরের ভিতর হইতে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় জ্বলিতেছিল। তাঁহাকে দেখিয়া ইংরাজ কবি কোল্‌রিজের সৃষ্ট প্রাচীন নাবিকের কথা আমার মনে পড়িল।

মাঝি নমাজ পড়া সমাধা করিয়া রন্ধনকার্যে মন দিয়াছে। সন্ধ্যার শেষ আভাটুকু মিলাইয়া আসিয়া ঘাটের উপরকার জনশূন্য অন্ধকার বাড়ি আপন পূর্বাবস্থার প্রকাণ্ড প্রেতমূর্তির মতো নিস্তব্ধ দাঁড়াইয়া রহিল।

ইস্কুলমাস্টার কহিলেন—

আমি এই গ্রামে আসার প্রায় দশ বৎসর পূর্বে এই বাড়িতে ফণিভূষণ সাহা বাস করিতেন। তিনি তাঁহার অপুত্রক পিতৃব্য দুর্গামোহন সাহার বৃহৎ বিষয় এবং ব্যবসায়ের উত্তরাধিকারী হইয়াছিলেন।

কিন্তু , তাঁহাকে একালে ধরিয়াছিল। তিনি লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। তিনি জুতাসমেত সাহেবের আপিসে ঢুকিয়া সম্পূর্ণ খাঁটি ইংরাজি বলিতেন। তাহাতে আবার দাড়ি রাখিয়াছিলেন, সুতরাং সাহেব-সওদাগরের নিকট তাঁহার উন্নতির সম্ভাবনামাত্র ছিল না। তাঁহাকে দেখিবামাত্রই নব্যবঙ্গ বলিয়া ঠাহর হইত।

আবার ঘরের মধ্যেও এক উপসর্গ জুটিয়াছিল। তাঁহার স্ত্রীটি ছিলেন সুন্দরী। একে কালেজে-পড়া তাহাতে সুন্দরী স্ত্রী, সুতরাং সেকালের চালচলন আর রহিল না। এমন-কি, ব্যামো হইলে অ্যাসিস্ট্যান্ট্-সার্জনকে ডাকা হইত। অশন বসন ভূষণও এই পরিমাণে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল।

মহাশয় নিশ্চয়ই বিবাহিত, অতএব এ কথা আপনাকে বলাই বাহুল্য যে, সাধারণত স্ত্রীজাতি কাঁচা আম, ঝাল লঙ্কা এবং কড়া স্বামীই ভালোবাসে। যে দুর্ভাগ্য পুরুষ নিজের স্ত্রীর ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত সে-যে কুশ্রী অথবা নির্ধন তাহা নহে, সে নিতান্ত নিরীহ।

যদি জিজ্ঞাসা করেন কেন এমন হইল, আমি এ সম্বন্ধে অনেক কথা ভাবিয়া রাখিয়াছি। যাহার যা প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতা সেটার চর্চা না করিলে সে সুখী হয় না। শিঙে শান দিবার জন্য হরিণ শক্ত গাছের গুঁড়ি খোঁজে, কলাগাছে তাহার শিং ঘষিবার সুখ হয় না। নরনারীর ভেদ হইয়া অবধি স্ত্রীলোক দুরন্ত পুরুষকে নানা কৌশলে ভুলাইয়া বশ করিবার বিদ্যা চর্চা করিয়া আসিতেছে। যে স্বামী আপনি বশ হইয়া বসিয়া থাকে তাহার স্ত্রী-বেচারা একেবারেই বেকার, সে তাহার মাতামহীদের নিকট হইতে শতলক্ষ বৎসরের শান-দেওয়া যে উজ্জ্বল বরুণাস্ত্র, অগ্নিবাণ ও নাগপাশবন্ধনগুলি পাইয়াছিল তাহা সমস্ত নিস্ফল হইয়া যায়।

স্ত্রীলোক পুরুষকে ভুলাইয়া নিজের শক্তিতে ভালোবাসা আদায় করিয়া লইতে চায়, স্বামী যদি ভালোমানুষ হইয়া সে অবসরটুকু না দেয় তবে স্বামীর অদৃষ্ট মন্দ এবং স্ত্রীরও ততোধিক।

নবসভ্যতার শিক্ষামন্ত্রে পুরুষ আপন স্বভাবসিদ্ধ বিধাতাদত্ত সুমহৎ বর্বরতা হারাইয়া আধুনিক দাম্পত্যসম্বন্ধটাকে এমন শিথিল করিয়া ফেলিয়াছে। অভাগা ফণিভূষণ আধুনিক সভ্যতার কল হইতে অত্যন্ত ভালোমানুষটি হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছিল— ব্যবসায়েও সে সুবিধা করিতে পারিল না, দাম্পত্যেও তাহার তেমন সুযোগ ঘটে নাই।

ফণিভূষণের স্ত্রী মণিমালিকা বিনা চেষ্টায় আদর, বিনা অশ্রুবর্ষণে ঢাকাই শাড়ি এবং বিনা দুর্জয় মানে বাজুবন্ধ লাভ করিত। এইরূপে তাহার নারীপ্রকৃতি এবং সেইসঙ্গে তাহার ভালোবাসা নিশ্চেষ্ট হইয়া গিয়াছিল; সে কেবল গ্রহণ করিত, কিছু দিত না। তাহার নিরীহ এবং নির্বোধ স্বামীটি মনে করিত, দানই বুঝি প্রতিদান পাইবার উপায়। একেবারে উলটা বুঝিয়াছিল আর কি।

ইহার ফল হইল এই যে, স্বামীকে সে আপন ঢাকাই শাড়ি এবং বাজুবন্ধ জোগাইবার যন্ত্রস্বরূপ জ্ঞান করিত; যন্ত্রটিও এমন সুচারু যে, কোনোদিন তাহার চাকায় এক ফোঁটা তেল জোগাইবারও দরকার হয় নাই।

ফণিভূষণের জন্মস্থান ফুলবেড়ে, বাণিজ্যস্থান এখানে। কর্মানুরোধে এইখানেই তাহাকে অধিকাংশ সময় থাকিতে হইত। ফুলবেড়ের বাড়িতে তাহার মা ছিল না, তবু পিসি মাসি ও অন্য পাঁচজন ছিল। কিন্তু ফণিভূষণ পিসি মাসি ও অন্য পাঁচজনের উপকারার্থেই বিশেষ করিয়া সুন্দরী স্ত্রী ঘরে আনে নাই। সুতরাং স্ত্রীকে সে পাঁচজনের কাছ থেকে আনিয়া এই কুঠিতে একলা নিজের কাছেই রাখিল। কিন্তু অন্যান্য অধিকার হইতে স্ত্রী-অধিকারের প্রভেদ এই যে, স্ত্রীকে পাঁচজনের কাছ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া একলা নিজের কাছে রাখিলেই যে সব সময় বেশি করিয়া পাওয়া যায় তাহা নহে।

স্ত্রীটি বেশি কথাবার্তা কহিত না, পাড়াপ্রতিবেশিনীদের সঙ্গেও তাহার মেলামেশা বেশি ছিল না ব্রত উপলক্ষ্য করিয়া দুটো ব্রাক্ষ্মণকে খাওয়ানো বা বৈষ্ণবীকে দুটো পয়সা ভিক্ষা বেশী দেওয়া কখনো তাহার দ্বারা ঘটে নাই। তাহার হাতে কোনো জিনিস নষ্ট হয় নাই; কেবল স্বামীর আদরগুলা ছাড়া আর যাহা পাইয়াছে সমস্তই জমা করিয়া রাখিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সে নিজের অপরূপ যৌবনশ্রী হইতেও যেন লেশমাত্র অপব্যয় ঘটিতে দেয় নাই। লোকে বলে, তাহার চব্বিশ বৎসর বয়সের সময়ও তাহাকে চৌদ্দবৎসরের মতো কাঁচা দেখিতে ছিল। যাহাদের হৃৎপিণ্ড বরফের পিণ্ড, যাহাদের বুকের মধ্যে ভালোবাসার জ্বালাযন্ত্রণা স্থান পায় না, তাহারা বোধ করি সুদীর্ঘকাল তাজা থাকে, তাহারা কৃপণের মতো অন্তরে বাহিরে আপনাকে জমাইয়া রাখিতে পারে।

ঘনপল্লবিত অতিসতেজ লতার মতো বিধাতা মণিমালিকাকে নিষ্ফলা করিয়া রাখিলেন, তাহাকে সন্তান হইতে বঞ্চিত করিলেন। অর্থাৎ তাহাকে এমন একটা-কিছু দিলেন না যাহাকে সে আপন লোহার সিন্দুকের মণিমাণিক্য অপেক্ষা বেশি করিয়া বুঝিতে পারে, যাহা বসন্তপ্রভাতের নবসূর্যের মতো আপন কোমল উত্তাপে তাহার হৃদয়ের বরফপিণ্ডটা গলাইয়া সংসারের উপর একটা স্নেহনির্ঝর বহাইয়া দেয়।

কিন্তু মণিমালিকা কাজকর্মে মজবুত ছিল। কখনোই সে লোকজন বেশি রাখে নাই। যে কাজ তাহার দ্বারা সাধ্য সে কাজে কেহ বেতন লইয়া যাইবে ইহা সে সহিতে পারিত না। সে কাহারও জন্য চিন্তা করিত না, কাহাকেও ভালোবাসিত না, কেবল কাজ করিত এবং জমা করিত, এইজন্য তাহার রোগ শোক তাপ কিছুই ছিল না; অপরিমিত স্বাস্থ্য, অবিচলিত শান্তি এবং সঞ্চীয়মান সম্পদের মধ্যে সে সবলে বিরাজ করিত।

অধিকাংশ স্বামীর পক্ষে ইহাই যথেষ্ট; যথেষ্ট কেন, ইহা দুর্লভ। অঙ্গের মধ্যে কটিদেশ বলিয়া একটা ব্যাপার আছে তাহা কোমরে ব্যথা না হইলে মনে পড়ে না; গৃহের আশ্রয়স্বরূপে স্ত্রী যে একজন আছে ভালোবাসার তাড়নায় তাহা পদে পদে এবং তাহা চব্বিশঘণ্টা অনুভব করার নাম ঘরকর্‌‌‌নার কোমরে ব্যথা। নিরতিশয় পাতিব্রত্যটা স্ত্রীর পক্ষে গৌরবের বিষয় কিন্তু পতির পক্ষে আরামের নহে, আমার তো এইরূপ মত।

মহাশয়, স্ত্রীর ভালোবাসা ঠিক কতটা পাইলাম, ঠিক কতটুকু কম পড়িল, অতি সূক্ষ্ম নিক্তি ধরিয়া তাহা অহরহ তৌল করিতে বসা কি পুরুষমানুষের কর্ম! স্ত্রী আপনার কাজ করুক, আমি আপনার কাজ করি, ঘরের মোটা হিসাবটা তো এই। অব্যক্তের মধ্যে কতটা ব্যক্ত, ভাবের মধ্যে কতটুকু অভাব, সুস্পষ্টের মধ্যেও কী পরিমাণ ইঙ্গিত, অণুপরমাণুর মধ্যে কতটা বিপুলতা— ভালোবাসাবাসির তত সুসূক্ষ্ম বোধশক্তি বিধাতা পুরুষমানুষকে দেন নাই, দিবার প্রয়োজন হয় নাই। পুরুষমানুষের তিলপরিমাণ অনুরাগ-বিরাগের লক্ষণ লইয়া মেয়েরা বটে ওজন করিতে বসে। কথার মধ্য হইতে আসল ভঙ্গীটুকু এবং ভঙ্গীর মধ্য হইতে আসল কথাটুকু চিরিয়া চিরিয়া চুনিয়া চুনিয়া বাহির করিতে থাকে। কারণ, পুরুষের ভালোবাসাই তাহাদের বল, তাহাদের জীবনব্যবসায়ের মূলধন। ইহারই হাওয়ার গতিক লক্ষ্য করিয়া ঠিক সময় ঠিকমতো পাল ঘুরাইতে পারিলে তবেই তাহাদের তরণী তরিয়া যায়। এইজন্যই বিধাতা ভালোবাসামান- যন্ত্রটি মেয়েদের হৃদয়ের মধ্যে ঝুলাইয়া দিয়াছেন, পুরুষদের দেন নাই।

কিন্তু বিধাতা যাহা দেন নাই সম্প্রতি পুরুষরা সেটি সংগ্রহ করিয়া লইয়াছেন। কবিরা বিধাতার উপর টেক্কা দিয়া এই দুর্লভ যন্ত্রটি, এই দিগ্‌দর্শন যন্ত্রণাশলাকাটি নির্বিচারে সর্বসাধারণের হস্তে দিয়াছেন। বিধাতার দোষ দিই না, তিনি মেয়েপুরুষকে যথেষ্ট ভিন্ন করিয়াই সৃষ্টি করিয়াছিলেন, কিন্তু সভ্যতায় সে ভেদ আর থাকে না, এখন মেয়েও পুরুষ হইতেছে, পুরুষও মেয়ে হইতেছে; সুতরাং ঘরের মধ্য হইতে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিদায় লইল। এখন শুভবিবাহের পূর্বে পুরুষকে বিবাহ করিতেছি না মেয়েকে বিবাহ করিতেছি, তাহা কোনোমতে নিশ্চয় করিতে না পারিয়া, বরকন্যা উভয়েরই চিত্ত আশঙ্কায় দুরু দুরু করিতে থাকে।
আপনি বিরক্ত হইতেছেন! একলা পড়িয়া থাকি, স্ত্রীর নিকট হইতে নির্বাসিত; দূর হইতে সংসারের অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব মনের মধ্যে উদয় হয়— এগুলো ছাত্রদের কাছে বলিবার বিষয় নয়, কথাপ্রসঙ্গে আপনাকে বলিয়া লইলাম, চিন্তা করিয়া দেখিবেন।

মোট কথাটা এই যে, যদিচ রন্ধনে নুন কম হইত না এবং পানে চুন বেশি হইত না, তথাপি ফণিভূষণের হৃদয় কী-যেন-কী নামক একটু দুঃসাধ্য উৎপাত অনুভব করিত। স্ত্রীর কোনো দোষ ছিল না, কোনো ভ্রম ছিল না, তবু স্বামীর কোনো সুখ ছিল না। সে তাহার সহধর্মিণীর শূন্যগহ্বর হৃদয় লক্ষ্য করিয়া কেবল হীরামুক্তার গহনা ঢালিত কিন্তু সেগুলা পড়িত গিয়া লোহার সিন্দুকে, হৃদয় শূন্যই থাকিত। খুড়া দুর্গামোহন ভালোবাসা এত সূক্ষ্ম করিয়া বুঝিত না। এত কাতর হইয়া চাহিত না, এত প্রচুর পরিমাণে দিত না, অথচ খুড়ির নিকট হইতে তাহা অজস্র পরিমাণে লাভ করিত। ব্যবসায়ী হইতে গেলে নব্যবাবু হইলে চলে না এবং স্বামী হইতে গেলে পুরুষ হওয়া দরকার, এ কথায় সন্দেহমাত্র করিবেন না।

ঠিক এই সময়ে শৃগালগুলা নিকটবর্তী ঝোপের মধ্য হইতে অত্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল। মাস্টারমহাশয়ের গল্পস্রোতে মিনিটকয়েকের জন্য বাধা পড়িল। ঠিক মনে হইল, সেই অন্ধকার সভাভূমিতে কৌতুকপ্রিয় শৃগালসম্প্রদায় ইস্কুলমাস্টারের ব্যাখ্যাত দাম্পত্যনীতি শুনিয়াই হউক বা নবসভ্যতাদুর্বল ফণিভূষণের আচরণেই হউক, রহিয়া রহিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিতে লাগিল। তাহাদের ভাবোচ্ছ্বাস নিবৃত্ত হইয়া জলস্থল দ্বিগুণতর নিস্তব্ধ হইলে পর মাস্টার সন্ধ্যার অন্ধকারে তাঁহার বৃহৎ উজ্জ্বল চক্ষু পাকাইয়া গল্প বলিতে লাগিলেন—

ফণিভূষণের জটিল এবং বহুবিস্তৃত ব্যবসায়ে হঠাৎ একটা ফাঁড়া উপস্থিত হইল। ব্যাপারটা কী তাহা আমার মতো অব্যবসায়ীর পক্ষে বোঝা এবং বোঝানো শক্ত। মোদ্দা কথা, সহসা কী কারণে বাজারে তাহার ক্রেডিট রাখা কঠিন হইয়া পড়িয়াছিল। যদি কেবলমাত্র পাঁচটা দিনের জন্যও সে কোথাও হইতে লাখদেড়েক টাকা বাহির করিতে পারে, বাজারে একবার বিদ্যুতের মতো এই টাকাটার চেহারা দেখাইয়া যায়, তাহা হইলেই মুহূর্তের মধ্যে সংকট উত্তীর্ণ হইয়া তাহার ব্যাবসা পালভরে ছুটিয়া চলিতে পারে।

টাকাটার সুযোগ হইতেছিল না। স্থানীয় পরিচিত মহাজনদের নিকট হইতে ধার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে এরূপ জনরব উঠিলে তাহার ব্যবসায়ের দ্বিগুণ অনিষ্ট হইবে, আশঙ্কায় তাহাকে অপরিচিত স্থানে ঋণের চেষ্টা দেখিতে হইতেছিল। সেখানে উপযুক্ত বন্ধক না রাখিলে চলে না।

গহনা বন্ধক রাখিলে লেখাপড়া এবং বিলম্বের কারণ থাকে না, চট্‌পট্‌ এবং সহজেই কাজ হইয়া যায়।

ফণিভূষণ একবার স্ত্রীর কাছে গেল। নিজের স্ত্রীর কাছে স্বামী যেমন সহজভাবে যাইতে পারে ফণিভূষণের তেমন করিয়া যাইবার ক্ষমতা ছিল না। সে দুর্ভাগ্যক্রমে নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসিত, যেমন ভালোবাসা কাব্যের নায়ক কাব্যের নায়িকাকে বাসে; যে ভালোবাসায় সন্তর্পণে পদক্ষেপ করিতে হয় এবং সকল কথা মুখে ফুটিয়া বাহির হইতে পারে না, যে ভালোবাসার প্রবল আকর্ষণ সূর্য এবং পৃথিবীর আকর্ষণের ন্যায় মাঝখানে একটা অতিদূর ব্যবধান রাখিয়া দেয়।

তথাপি তেমন তেমন দায়ে পড়িলে কাব্যের নায়ককেও প্রেয়সীর নিকট হুন্ডি এবং বন্ধক এবং হ্যাণ্ড্‌নোটের প্রসঙ্গ তুলিতে হয়; কিন্তু সুর বাধিয়া যায়, বাক্যস্খলন হয়, এমন-সকল পরিষ্কার কাজের কথার মধ্যেও ভাবের জড়িমা ও বেদনার বেপথু আসিয়া উপস্থিত হয়। হতভাগ্য ফণিভূষণ স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না, ‘ওগো, আমার দরকার হইয়াছে, তোমার গহনাগুলো দাও।’

কথাটা বলিল, অথচ অত্যন্ত দুর্বলভাবে বলিল। মণিমালিকা যখন কঠিন মুখ করিয়া হাঁ-না কিছুই উত্তর করিল না তখন সে একটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর আঘাত পাইল কিন্তু আঘাত করিল না। কারণ, পুরুষোচিত বর্বরতা লেশমাত্র তাহার ছিল না। যেখানে জোর করিয়া কাড়িয়া লওয়া উচিত ছিল, সেখানে সে আপনার আন্তরিক ক্ষোভ পর্যন্ত চাপিয়া গেল। যেখানে ভালোবাসার একমাত্র অধিকার, সর্বনাশ হইয়া গেলেও সেখানে বলকে প্রবেশ করিতে দিবে না, এই তাহার মনের ভাব। এ সম্বন্ধে তাহাকে যদি ভর্ৎসনা করা যাইত তবে সম্ভবত সে এইরূপ সূক্ষ্ম তর্ক করিত যে, বাজারে যদি অন্যায় কারণেও আমার ক্রেডিট না থাকে তবে তাই বলিয়া বাজার লুটিয়া লইবার অধিকার আমার নাই, স্ত্রী যদি স্বেচ্ছাপূর্বক বিশ্বাস করিয়া আমাকে গহনা না দেয় তবে তাহা আমি কাড়িয়া লইতে পারি না। বাজারে যেমন ক্রেডিট ঘরে তেমনি ভালোবাসা, বাহুবল কেবলমাত্র রণক্ষেত্রে। পদে পদে এইরূপ অত্যন্ত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম তর্কসূত্র কাটিবার জন্যই কি বিধাতা পুরুষমানুষকে এরূপ উদার, এরূপ প্রবল, এরূপ বৃহদাকার করিয়া নির্মাণ করিয়াছিলেন। তাঁহার কি বসিয়া বসিয়া অত্যন্ত সুকুমার চিত্তবৃত্তিকে নিরতিশয় তনিমার সহিত অনুভব করিবার অবকাশ আছে, না, ইহা তাঁহাকে শোভা পায়।

যাহা হউক, আপন উন্নত হৃদয়বৃত্তির গর্বে স্ত্রীর গহনা স্পর্শ না করিয়া ফণিভূষণ অন্য উপায়ে অর্থ সংগ্রহের জন্য কলিকাতায় চলিয়া গেল।

সংসারে সাধারণত স্ত্রীকে স্বামী যতটা চেনে স্বামীকে স্ত্রী তাহার চেয়ে অনেক বেশি চেনে; কিন্তু স্বামীর প্রকৃতি যদি অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয় তবে স্ত্রীর অনুবীক্ষণে তাহার সমস্তটা ধরা পড়ে না। আমাদের ফণিভূষণকে ফণিভূষণের স্ত্রী ঠিক বুঝিত না। স্ত্রীলোকের অশিক্ষিতপটুত্ব যে-সকল বহুকালাগত প্রাচীন সংস্কারের দ্বারা গঠিত, অত্যন্ত নব্য পুরুষেরা তাহার বাহিরে গিয়া পড়ে। ইহারা এক রকমের! ইহারা মেয়েমানুষের মতোই রহস্যময় হইয়া উঠিতেছে। সাধারণ পুরুষমানুষের যে-কটা বড়ো বড়ো কোটা আছে, অর্থাৎ কেহ-বা বর্বর, কেহ-বা নির্বোধ, কেহ-বা অন্ধ, তাহার মধ্যে কোনোটাতেই ইহাদিগকে ঠিকমতো স্থাপন করা যায় না।

সুতরাৎ মণিমালিকা পরামর্শের জন্য তাহার মন্ত্রীকে ডাকিল। গ্রামসম্পর্কে অথবা দূরসম্পর্কে মণিমালিকার এক ভাই ফণিভূষণের কুঠিতে গোমস্তার অধীনে কাজ করিত। তাহার এমন স্বভাব ছিল না যে কাজের দ্বারা উন্নতি লাভ করে, কোনো-একটা উপলক্ষ্য করিয়া আত্মীয়তার জোরে বেতন এবং বেতনেরও বেশি কিছু কিছু সংগ্রহ করিত।

মণিমালিকা তাহাকে ডাকিয়া সকল কথা বলিল; জিজ্ঞাসা করিল, ‘এখন পরামর্শ কী।’

সে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো মাথা নাড়িল; অর্থাৎ গতিক ভালো নহে। বুদ্ধিমানেরা কখনোই গতিক ভালো দেখে না। সে কহিল, ‘বাবু কখনোই টাকা সংগ্রহ করিতে পারিবেন না, শেষকালে তোমার এ গহনাতে টান পড়িবেই।’

মণিমালিকা মানুষকে যেরূপ জানিত তাহাতে বুঝিল, এইরূপ হওয়াই সম্ভব এবং ইহাই সংগত। তাহার দুশ্চিন্তা সুতীব্র হইয়া উঠিল। সংসারে তাহার সন্তান নাই; স্বামী আছে বটে কিন্তু স্বামীর অস্তিত্ব সে অন্তরের মধ্যে অনুভব করে না, অতএব যাহা তাহার একমাত্র যত্নের ধন, যাহা তাহার ছেলের মতো ক্রমে ক্রমে বৎসরে বৎসরে বাড়িয়া উঠিতেছে, যাহা রূপকমাত্র নহে, যাহা প্রকৃতই সোনা, যাহা মানিক, যাহা বক্ষের, যাহা কণ্ঠের, যাহা মাথার— সেই অনেকদিনের অনেক সাধের সামগ্রী এক মুহূর্তেই ব্যবসায়ের অতলস্পর্শ গহ্বরের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইবে ইহা কল্পনা করিয়া তাহার সর্বশরীর হিম হইয়া আসিল। সে কহিল, ‘কী করা যায়।’

মধুসূদন কহিল, ‘গহনাগুলো লইয়া এইবেলা বাপের বাড়ি চলো।’ গহনার কিছু অংশ, এমন-কি অধিকাংশই যে তাহার ভাগে আসিবে বুদ্ধিমান মধু মনে মনে তাহার উপায় ঠাওরাইল।

মণিমালিকা এ প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইল।

আষাঢ়শেষের সন্ধ্যাবেলায় এই ঘাটের ধারে একখানি নৌকা আসিয়া লাগিল। ঘনমেঘাচ্ছন্ন প্রত্যুষে নিবিড় অন্ধকারে নিদ্রাহীন ভেকের কলরবের মধ্যে একখানি মোটা চাদরে পা হইতে মাথা পর্যন্ত আবৃত করিয়া মণিমালিকা নৌকায় উঠিল। মধুসূদন নৌকার মধ্য হইতে জাগিয়া উঠিয়া কহিল, ‘গহনার বাক্সটা আমার কাছে দাও।’ মণি কহিল, ‘সে পরে হইবে, এখন নৌকা খুলিয়া দাও।’
নৌকা খুলিয়া দিল, খরস্রোতে হুহু করিয়া ভাসিয়া গেল।

মণিমালিকা সমস্ত রাত ধরিয়া একটি একটি করিয়া তাহার সমস্ত গহনা সর্বাঙ্গ ভরিয়া পরিয়াছে, মাথা হইতে পা পর্যন্ত আর স্থান ছিল না। বাক্সে করিয়া গহনা লইলে সে বাক্স হাতছাড়া হইয়া যাইতে পারে, এ আশঙ্কা তাহার ছিল। কিন্তু গায়ে পরিয়া গেলে তাহাকে না বধ করিয়া সে গহনা কেহ লইতে পারিবে না।

সঙ্গে কোনোপ্রকার বাক্স না দেখিয়া মধুসূদন কিছু বুঝিতে পারিল না, মোটা চাদরের নিচে যে মণিমালিকার দেহপ্রাণের সঙ্গে সঙ্গে দেহপ্রাণের অধিক গহনাগুলি আচ্ছন্ন ছিল তাহা সে অনুমান করিতে পারে নাই! মণিমালিকা ফণিভূষণকে বুঝিত না বটে, কিন্তু মধুসূদনকে চিনিতে তাহার বাকি ছিল না।

মধুসূদন গোমস্তার কাছে একখানা চিঠি রাখিয়া গেল যে, সে কর্ত্রীকে পিত্রালয়ে পৌঁছাইয়া দিতে রওনা হইল। গোমস্তা ফণিভূষণের বাপের আমলের; সে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া হ্রস্ব-ইকারকে দীর্ঘ-ঈকার এবং দন্ত্য-স’কে তালব্য-শ করিয়া মনিবকে এক পত্র লিখিল, ভালো বাংলা লিখিল না কিন্তু স্ত্রীকে অযথা প্রশ্রয় দেওয়া যে পুরুষোচিত নহে, এ কথাটা ঠিকমতোই প্রকাশ করিল।

ফণিভূষণ মণিমালিকার মনের কথাটা ঠিক বুঝিল। তাহার মনে এই আঘাতটা প্রবল হইল যে, আমি গুরুতর ক্ষতিসম্ভাবনা সত্ত্বেও স্ত্রীর অলংকার পরিত্যাগ করিয়া প্রাণপণ চেষ্টায় অর্থসংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তবু আমাকে সন্দেহ। আমাকে আজিও চিনিল না।

নিজের প্রতি যে নিদারুণ অন্যায়ে ক্রুদ্ধ হওয়া উচিত ছিল, ফণিভূষণ তাহাতে ক্ষুব্ধ হইল মাত্র। পুরুষমানুষ বিধাতার ন্যায়দণ্ড, তাহার মধ্যে তিনি বজ্রাগ্নি নিহিত করিয়া রাখিয়াছেন, নিজের প্রতি অথবা অপরের প্রতি অন্যায়ের সংঘর্ষে সে যদি দপ্‌ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতে না পারে তবে ধিক্‌ তাহাকে। পুরুষমানুষ দাবাগ্নির মতো রাগিয়া উঠিবে সামান্য কারণে, আর স্ত্রীলোক শ্রাবণমেঘের মতো অশ্রুপাত করিতে থাকিবে বিনা উপলক্ষে বিধাতা এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন, কিন্তু সে আর টেঁকে না।

ফণিভূষণ অপরাধিনী স্ত্রীকে লক্ষ্য করিয়া মনে মনে কহিল, ‘এই যদি তোমার বিচার হয় তবে এইরূপই হউক, আমার কর্তব্য আমি করিয়া যাইব।’ আরো শতাব্দী-পাঁচছয় পরে যখন কেবল অধ্যাত্মশক্তিতে জগৎ চলিবে তখন যাহার জন্মগ্রহণ করা উচিত ছিল সেই ভাবী যুগের ফণিভূষণ ঊনবিংশ শতাব্দীতে অবতীর্ণ হইয়া সেই আদিযুগের স্ত্রীলোককে বিবাহ করিয়া বসিয়াছে শাস্ত্রে যাহার বুদ্ধিকে প্রলয়ংকরী বলিয়া থাকে। ফণিভূষণ স্ত্রীকে এক-অক্ষর পত্র লিখিল না এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল, এ সম্বন্ধে স্ত্রীর কাছে কখনও সে কোনো কথার উল্লেখ করিবে না। কী ভীষণ দণ্ডবিধি।

দিনদশেক পরে কোনোমতে যথোপযুক্ত টাকা সংগ্রহ করিয়া বিপদুত্তীর্ণ ফণিভূষণ বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। সে জানিত, বাপের বাড়িতে গহনাপত্র রাখিয়া এতদিনে মণিমালিকা ঘরে ফিরিয়া আসিয়াছে। সেদিনকার দীনপ্রার্থীভাব ত্যাগ করিয়া কৃতকার্য কৃতীপুরুষ স্ত্রীর কাছে দেখা দিলে মণি যে কিরূপ লজ্জিত এবং অনাবশ্যক প্রয়াসের জন্য কিঞ্চিৎ অনুতপ্ত হইবে, ইহাই কল্পনা করিতে করিতে ফণিভূষণ অন্তঃপুরে শয়নাগারের দ্বারের কাছে আসিয়া উপনীত হইল।

দেখিল, দ্বার রুদ্ধ। তালা ভাঙিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, ঘর শূন্য। কোণে লোহার সিন্দুক খোলা পড়িয়া আছে, তাহাতে গহনাপত্রের চিহ্নমাত্র নাই। স্বামীর বুকের মধ্যে ধক্‌ করিয়া একটা ঘা লাগিল! মনে হইল সংসার উদ্দেশ্যহীন এবং ভালোবাসা ও বাণিজ্য-ব্যবসা সমস্তই ব্যর্থ। আমরা এই সংসারপিঞ্জরের প্রত্যেক শলাকার উপরে প্রাণপাত করিতে বসিয়াছি, কিন্তু তাহার ভিতরে পাখি নাই, রাখিলেও সে থাকে না। তবে অহরহ হৃদয়খানির রক্তমানিক ও অশ্রুজলের মুক্তামালা দিয়া কী সাজাইতে বসিয়াছি। এই চিরজীবনের সর্বস্বজড়ানো শূন্য সংসার-খাঁচাটা ফণিভূষণ মনে মনে পদাঘাত করিয়া অতিদূরে ফেলিয়া দিল।

ফণিভূষণ স্ত্রীর সম্বন্ধে কোনোরূপ চেষ্টা করিতে চাহিল না। মনে করিল, যদি ইচ্ছা হয় তো ফিরিয়া আসিবে। বৃদ্ধ ব্রাক্ষ্মণ গোমস্তা আসিয়া কহিল, ‘চুপ করিয়া থাকিলে কী হইবে, কর্ত্রীবধূর খবর লওয়া চাই তো।’ এই বলিয়া মণিমালিকার পিত্রালয়ে লোক পাঠাইয়া দিল। সেখান হইতে খবর আসিল, মণি অথবা মধু এ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছে নাই।
তখন চারি দিকে খোঁজ পড়িয়া গেল। নদীতীরে-তীরে প্রশ্ন করিতে করিতে লোক ছুটিল। মধুর তল্লাস করিতে পুলিসে খবর দেওয়া হইল— কোন্‌ নৌকা, নৌকার মাঝি কে, কোন্‌ পথে তাহারা কোথায় চলিয়া গেল, তাহার কোনো সন্ধান মিলিল না।

সর্বপ্রকার আশা ছাড়িয়া দিয়া একদিন ফণিভূষণ সন্ধ্যাকালে তাহার পরিত্যক্ত শয়নগৃহের মধ্যে প্রবেশ করিল। সেদিন জন্মাষ্টমী, সকাল হইতে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়িতেছে। উৎসব উপলক্ষ্যে গ্রামের প্রান্তরে একটা মেলা বসে, সেখানে আটচালার মধ্যে বারোয়ারির যাত্রা আরম্ভ হইয়াছে। মুষলধারায় বৃষ্টিপাতশব্দে যাত্রার গানের সুর মৃদুতর হইয়া কানে আসিয়া প্রবেশ করিতেছে। ঐ-যে বাতায়নের উপরে শিথিলকব্জা দরজাটা ঝুলিয়া পড়িয়াছে ঐখানে ফণিভূষণ অন্ধকারে একলা বসিয়াছিল— বাদলার হাওয়া, বৃষ্টির ছাট এবং যাত্রার গান ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতেছিল, কোনো খেয়ালই ছিল না। ঘরের দেওয়ালে আর্টস্টুডিয়ো-রচিত লক্ষ্মীসরস্বতীর একজোড়া ছবি টাঙানো; আলনার উপরে একটি গামছা ও তোয়ালে, একটি চুড়িপেড়ে ও একটি ডুরে শাড়ি সদ্যব্যবহারযোগ্যভাবে পাকানো ঝুলানো রহিয়াছে। ঘরের কোণে টিপাইয়ের উপরে পিতলের ডিবায় মণিমালিকার স্বহস্তরচিত গুটিকতক পান শুষ্ক হইয়া পড়িয়া আছে। কাচের আলমারির মধ্যে তাহার আবাল্যসঞ্চিত চীনের পুতুল, এসেন্সের শিশি, রঙিন কাচের ডিক্যাণ্টার, শৌখিন তাস, সমুদ্রের বড়ো বড়ো কড়ি, এমন-কি, শূন্য সাবানের বাক্সগুলি পর্যন্ত অতি পরিপাটি করিয়া সাজানো; যে অতিক্ষুদ্র গোলকবিশিষ্ট ছোটো শখের কেরোসিন-ল্যাম্প সে নিজে প্রতিদিন প্রস্তুত করিয়া স্বহস্তে জ্বালাইয়া কুলুঙ্গিটির উপর রাখিয়া দিত তাহা যথাস্থানে নির্বাপিত এবং ম্লান হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, কেবল সেই ক্ষুদ্র ল্যাম্পটি এই শয়নকক্ষে মণিমালিকার শেষমুহূর্তের নিরুত্তর সাক্ষী; সমস্ত শূন্য করিয়া যে চলিয়া যায়, সেও এত চিহ্ন এত ইতিহাস, সমস্ত জড়সামগ্রীর উপর আপন সজীব হৃদয়ের এত স্নেহস্বাক্ষর রাখিয়া যায়! এসো মণিমালিকা, এসো, তোমার দীপটি তুমি জ্বালাও, তোমার ঘরটি তুমি আলো করো, আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া তোমার যত্নকুঞ্চিত শাড়িটি তুমি পরো, তোমার জিনিসগুলি তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। তোমার কাছ হইতে কেহ কিছু প্রত্যাশা করে না, কেবল তুমি উপস্থিত হইয়া মাত্র তোমার অক্ষয় যৌবন তোমার অম্লান সৌন্দর্য লইয়া চারিদিকের এই-সকল বিপুল বিক্ষিপ্ত অনাথ জড়সামগ্রীরাশিকে একটি প্রাণের ঐক্যে সঞ্জীবিত করিয়া রাখো; এই-সকল মূক প্রাণহীন পদার্থের অব্যক্ত ক্রন্দন গৃহকে শ্মশান করিয়া তুলিয়াছে।

গভীর রাত্রে কখন্‌ একসময়ে বৃষ্টির ধারা এবং যাত্রার গান থামিয়া গেছে। ফণিভূষণ জানলার কাছে যেমন বসিয়া ছিল তেমনি বসিয়া আছে। বাতায়নের বাহিরে এমন একটা জগদ্‌ব্যাপী নীরন্ধ্র অন্ধকার যে তাহার মনে হইতেছিল, যেন সম্মুখে যমালয়ের একটা অভ্রভেদী সিংহদ্বার যেন এইখানে দাঁড়াইয়া কাঁদিয়া ডাকিলে চিরকালের লুপ্ত জিনিস অচিরকালের মতো একবার দেখা দিতেও পারে। এই মসীকৃষ্ণ মৃত্যুর পটে এই অতি কঠিন নিকষ-পাষাণের উপর এই হারানো সোনার একটি রেখা পড়িতেও পারে।

এমনসময় একটা ঠক্‌ঠক্‌ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গহনার ঝম্‌ঝম্‌ শব্দ শোনা গেল। ঠিক মনে হইল শব্দটা নদীর ঘাটের উপর হইতে উঠিয়া আসিতেছে। তখন নদীর জল এবং রাত্রির অন্ধকার এক হইয়া মিশিয়া গিয়াছিল। পুলকিত ফণিভূষণ দুই উৎসুক চক্ষু দিয়া অন্ধকার ঠেলিয়া ঠেলিয়া ফুঁড়িয়া ফুঁড়িয়া দেখিতে চেষ্টা করিতে লাগিল— স্ফীত হৃদয় এবং ব্যগ্র দৃষ্টি ব্যথিত হইয়া উঠিল, কিছুই দেখা গেল না। দেখিবার চেষ্টা যতই একান্ত বাড়িয়া উঠিল অন্ধকার ততই যেন ঘনীভূত, জগৎ ততই যেন ছায়াবৎ হইয়া আসিল। প্রকৃতি নিশীথরাত্রে আপন মৃত্যুনিকেতনের গবাক্ষদ্বারে অকস্মাৎ অতিথিসমাগম দেখিয়া দ্রুত হস্তে আরো একটা বেশি করিয়া পর্দা ফেলিয়া দিল।

শব্দটা ক্রমে ঘাটের সর্বোচ্চ সোপানতল ছাড়িয়া বাড়ির দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। বাড়ির সম্মুখে আসিয়া থামিল। দেউড়ি বন্ধ করিয়া দরোয়ান যাত্রা শুনিতে গিয়াছিল। তখন সেই রুদ্ধ দ্বারের উপর ঠক্‌ঠক্‌ ঝম্‌ঝম্‌ করিয়া ঘা পড়িতে লাগিল, যেন অলংকারের সঙ্গে সঙ্গে একটা শক্ত জিনিস দ্বারের উপর আসিয়া পড়িতেছে। ফণিভূষণ আর থাকিতে পারিল না। নির্বাণদীপ কক্ষগুলি পার হইয়া অন্ধকার সিঁড়ি দিয়া নামিয়া রুদ্ধ দ্বারের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। দ্বার বাহির হইতে তালাবন্ধ ছিল। ফণিভূষণ প্রাণপণে দুই হাতে সেই দ্বার নাড়া দিতেই সেই সংঘাতে এবং তাহার শব্দে চমকিয়া জাগিয়া উঠিল। দেখিতে পাইল, সে নিদ্রিত অবস্থায় উপর হইতে নিচে নামিয়া আসিয়া ছিল। তাহার সর্বশরীর ঘর্মাক্ত, হাত পা বরফের মতো ঠাণ্ডা এবং হৃৎপিন্ড নির্বাণোম্মুখ প্রদীপের মতো স্ফুরিত হইতেছে। স্বপ্ন ভাঙিয়া দেখিল, বাহিরে আর কোনো শব্দ নাই, কেবল শ্রাবণের ধারা তখনও ঝর্‌‌‌ঝর্‌‌‌ শব্দে পড়িতেছিল এবং তাহারই সহিত মিশ্রিত হইয়া শুনা যাইতেছিল যাত্রার ছেলেরা ভোরের সুরে তান ধরিয়াছে ।
যদিচ ব্যাপারটা সমস্তই স্বপ্ন কিন্তু এত অধিক নিকটবর্তী এবং সত্যবৎ যে ফণিভূষণের মনে হইল, যেন অতি অল্পের জন্যই সে তাহার অসম্ভব আকাঙ্ক্ষার আশ্চর্য সফলতা হইতে বঞ্চিত হইল। সেই জলপতনশব্দের সহিত দূরাগত ভৈরবীর তান তাহাকে বলিতে লাগিল, এই জাগরণই স্বপ্ন, এই জগৎই মিথ্যা।

তাহার পরদিনেও যাত্রা ছিল এবং দরোয়ানেরও ছুটি ছিল। ফণিভূষণ হুকুম দিল, আজ সমস্ত রাত্রি যেন দেউড়ির দরজা খোলা থাকে। দরোয়ান কহিল, ‘মেলা উপলক্ষ্যে নানা দেশ হইতে নানা প্রকারের লোক আসিয়াছে, দরজা খোলা রাখিতে সাহস হয় না।’ ফণিভূষণ সে কথা মানিল না। দরোয়ান কহিল, ‘তবে আমি সমস্ত রাত্রি হাজির থাকিয়া পাহারা দিব।’ ফণিভূষণ কহিল, ‘সে হইবে না, তোমাকে যাত্রা শুনিতে যাইতেই হইবে।’ দরোয়ান আশ্চর্য হইয়া গেল।

পরদিন সন্ধ্যাবেলায় দীপ নিভাইয়া দিয়া ফণিভূষণ তাহার শয়নকক্ষের সেই বাতায়নে আসিয়া বসিল। আকাশে অবৃষ্টিসংরম্ভ মেঘ এবং চতুর্দিকে কোনো-একটি অনির্দিষ্ট আসন্নপ্রতীক্ষার নিস্তব্ধতা। ভেকের অশ্রান্ত কলরব এবং যাত্রার গানের চিৎকারধ্বনি সেই স্তব্ধতা ভাঙিতে পারে নাই, কেবল তাহার মধ্যে একটা অসংগত অদ্ভুতরস বিস্তার করিতেছিল।

অনেকরাত্রে একসময়ে ভেক এবং ঝিল্লি এবং যাত্রার দলের ছেলেরা চুপ করিয়া গেল এবং রাত্রের অন্ধকারের উপরে আরো একটা কিসের অন্ধকার আসিয়া পড়িল। বুঝা গেল, এইবার সময় আসিয়াছে।

পূর্বদিনের মতো নদীর ঘাটে একটা ঠক্‌ঠক্‌ এবং ঝম্‌ঝম্‌ শব্দ উঠিল। কিন্তু ফণিভূষণ সে দিকে চোখ ফিরাইল না। তাহার ভয় হইল, পাছে অধীর ইচ্ছা এবং অশান্ত চেষ্টায় তাহার সকল ইচ্ছা, সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া যায়। পাছে আগ্রহের বেগ তাহার ইন্দ্রিয়শক্তিকে অভিভূত করিয়া ফেলে। সে আপনার সকল চেষ্টা নিজের মনকে দমন করিবার জন্য প্রয়োগ করিল, কাঠের মূর্তির মতো শক্ত হইয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

শিঞ্জিত শব্দ আজ ঘাট হইতে ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হইয়া মুক্ত দ্বারের মধ্যে প্রবেশ করিল। শুনা গেল, অন্দরমহলের গোলসিঁড়ি দিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে শব্দ উপরে উঠিতেছে। ফণিভূষণ আপনাকে আর দমন করিতে পারে না, তাহার বক্ষ তুফানের ডিঙির মতো আছাড় খাইতে লাগিল এবং নিশ্বাস রোধ হইবার উপক্রম হইল। গোলসিঁড়ি শেষ করিয়া সেই শব্দ বারান্দা দিয়া ক্রমে ঘরের নিকটবর্তী হইতে লাগিল। অবশেষে ঠিক সেই শয়নকক্ষের দ্বারের কাছে আসিয়া খট্‌খট্‌ এবং ঝম্‌ঝম্‌ থামিয়া গেল। কেবল চৌকাঠটি পার হইলেই হয়।

ফণিভূষণ আর থাকিতে পারিল না। তাহার রুদ্ধ আবেগ এক মুহূর্তে প্রবলবেগে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, সে বিদ্যুৎবেগে চৌকি হইতে উঠিয়া কাঁদিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘মণি!’ অমনি সচকিত হইয়া জাগিয়া দেখিল, তাহারই সেই ব্যাকুল কণ্ঠের চিৎকারে ঘরের শাসিগুলা পর্যন্ত ধ্বনিত স্পন্দিত হইতেছে। বাহিরে সেই ভেকের কলরব এবং যাত্রার ছেলেদের ক্লিষ্ট কণ্ঠের গান।

ফণিভূষণ নিজের ললাটে সবলে আঘাত করিল।

পরদিন মেলা ভাঙিয়া গেছে। দোকানি এবং যাত্রার দল চলিয়া গেল। ফণিভূষণ হুকুম দিল, সেদিন সন্ধ্যার পর তাহার বাড়িতে সে নিজে ছাড়া আর কেহই থাকিবে না। চাকরেরা স্থির করিল, বাবু তান্ত্রিকমতে একটা কী সাধনে নিযুক্ত আছেন। ফণিভূষণ সমস্তদিন উপবাস করিয়া রহিল।

জনশূন্য বাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় ফণিভূষণ বাতায়নতলে আসিয়া বসিল। সেদিন আকাশের স্থানে স্থানে মেঘ ছিল না, এবং ধৌত নির্মল বাতাসের মধ্য দিয়া নক্ষত্রগুলিকে অত্যুজ্জ্বল দেখাইতেছিল। কৃষ্ণপক্ষ দশমীর চাঁদ উঠিতে অনেক বিলম্ব আছে। মেলা উত্তীর্ণ হইয়া যাওয়াতে পরিপূর্ণ নদীতে নৌকা মাত্রই ছিল না এবং উৎসব-জাগরণক্লান্ত গ্রাম দুইরাত্রি জাগরণের পর আজ গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন।

ফণিভূষণ একখানা চৌকিতে বসিয়া চৌকির পিঠের উপর মাথা ঊর্ধ্বমুখ করিয়া তারা দেখিতেছিল; ভাবিতেছিল, একদিন যখন তাহার বয়স ছিল উনিশ, যখন কলিকাতার কালেজে পড়িত, যখন সন্ধ্যাকালে গোলদিঘির তৃণশয়নে চিত হইয়া হাতের উপরে মাথা রাখিয়া ঐ অনন্তকালের তারাগুলির দিকে চাহিয়া থাকিত এবং মনে পড়িত তাহার সেই নদীকূলবর্তী শ্বশুরবাড়ির একটি বিরলকক্ষে চোদ্দবৎসরের বয়ঃসন্ধিগতা মণির সেই উজ্জ্বল কাঁচা মুখখানি, তখনকার সেই বিরহ কী সুমধূর, তখনকার সেই তারাগুলির আলোকস্পন্দন হৃদয়ের যৌবনস্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে কী বিচিত্র ‘বসন্তরাগেণ যতিতালাভ্যাং’ বাজিয়া বাজিয়া উঠিত! আজ সেই একই তারা আগুন দিয়া আকাশে মোহমুদগরের শ্লোক কয়টা লিখিয়া রাখিয়াছে; বলিতেছে, ‘সংসারোহয়মতীব বিচিত্রঃ!’

দেখিতে দেখিতে তারাগুলি সমস্ত লুপ্ত হইয়া গেল। আকাশ হইতে একখানা অন্ধকার নামিয়া এবং পৃথিবী হইতে একখানা অন্ধকার উঠিয়া চোখের উপরকার এবং নিচেরকার পল্লবের মতো একত্র আসিয়া মিলিত হইল। আজ ফণিভূষণের চিত্ত শান্ত ছিল। সে নিশ্চয় জানিত, আজ তাহার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে, সাধকের নিকট মৃত্যু আপন রহস্য উদ্‌ঘাটন করিয়া দিবে।

পূর্বরাত্রির মতো সেই শব্দ নদীর জলের মধ্য হইতে ঘাটের সোপানের উপর উঠিল। ফণিভূষণ দুই চক্ষু নিমীলিত করিয়া স্থির দৃঢ়চিত্তে ধ্যানাসনে বসিল। শব্দ দ্বারীশূন্য দেউড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল, শব্দ জনশূন্য অন্তঃপুরের গোলসিঁড়ির মধ্য দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া উঠিতে লাগিল, শব্দ দীর্ঘ বারান্দা পার হইল, এবং শয়নকক্ষের দ্বারের কাছে আসিয়া ক্ষণকালের জন্য থামিল।

ফণিভূষণের হৃদয় ব্যাকুল এবং সর্বাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া উঠিল, কিন্তু আজ সে চক্ষু খুলিল না। শব্দ চৌকাঠ পার হইয়া অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আলনায় যেখানে শাড়ি কোঁচানো আছে, কুলুঙ্গিতে যেখানে কেরোসিনের দীপ দাঁড়াইয়া, টিপাইয়ের ধারে যেখানে পানের বাটায় পান শুষ্ক, এবং সেই বিচিত্রসামগ্রীপূর্ণ আলমারির কাছে প্রত্যেক জায়গায় এক-একবার করিয়া দাঁড়াইয়া অবশেষে শব্দটা ফণিভূষণের অত্যন্ত কাছে আসিয়া থামিল।

তখন ফণিভূষণ চোখ মেলিল এবং দেখিল, ঘরে নবোদিত দশমীর চন্দ্রালোক আসিয়া প্রবেশ করিয়াছে, এবং তাহার চৌকির ঠিক সম্মুখে একটি কঙ্কাল দাঁড়াইয়া। সেই কঙ্কালের আট আঙুলে আংটি, করতলে রতনচক্র, প্রকোষ্ঠে বালা, বাহুতে বাজুবন্ধ, গলায় কণ্ঠি, মাথায় সিঁথি, তাহার আপাদমস্তকে অস্থিতে অস্থিতে এক-একটি আভরণ সোনায় হীরায় ঝক্‌ঝক্‌ করিতেছে। অলংকারগুলি ঢিলা, ঢল্‌ঢল্‌ করিতেছে, কিন্তু অঙ্গ হইতে খসিয়া পড়িতেছে না। সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর, তাহার অস্থিময় মুখে তাহার দুই চক্ষু ছিল সজীব; সেই কালো তারা, সেই ঘনদীর্ঘ পক্ষ্ম, সেই সজল উজ্জ্বলতা, সেই অবিচলিত দৃঢ়শান্তি দৃষ্টি। আজ আঠারো বৎসর পূর্বে একদিন আলোকিত সভাগৃহে নহবতের সাহানা-আলাপের মধ্যে ফণিভূষণ যে দুটি আয়ত সুন্দর কালো-কালো ঢলঢল চোখ শুভদৃষ্টিতে প্রথম দেখিয়াছিল সেই দুটি চক্ষুই আজ শ্রাবণের অর্ধরাত্রে কৃষ্ণপক্ষ দশমীর চন্দ্রকিরণে দেখিল, দেখিয়া তাহার সর্বশরীরের রক্ত হিম হইয়া আসিল। প্রাণপণে দুই চক্ষু বুজিতে চেষ্টা করিল, কিছুতেই পারিল না; তাহার চক্ষু মৃত মানুষের চক্ষুর মতো নির্নিমেষ চাহিয়া রহিল।

তখন সেই কঙ্কাল স্তম্ভিত ফণিভূষণের মুখের দিকে তাহার দৃষ্টি স্থির রাখিয়া দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া নীরবে অঙ্গুলিসংকেতে ডাকিল। তাহার চার আঙুলের অস্তিতে হীরার আংটি ঝক্‌মক করিয়া উঠিল।

ফণিভূষণ মূঢ়ের মতো উঠিয়া দাঁড়াইল। কঙ্কাল দ্বারের অভিমুখে চলিল; হাড়েতে হাড়েতে গহনায় গহনায় কঠিন শব্দ হইতে লাগিল। ফণিভূষণ পাশবদ্ধ পুত্তলীর মতো তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। বারান্দা পার হইল, নিবিড় অন্ধকার গোলসিঁড়ি ঘুরিয়া ঘুরিয়া খট্‌খট্‌ ঠক্‌ঠক্‌ ঝম্‌ঝম্‌ করিতে করিতে নিচে উত্তীর্ণ হইল। নিচেকার বারান্দা পার হইয়া জনশূন্য দীপহীন দেউড়িতে প্রবেশ করিল। অবশেষে দেউড়ি পার হইয়া ইটের-খোয়া-দেওয়া বাগানের রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। খোয়াগুলি অস্থিপাতে কড়্‌কড়্‌ করিতে লাগিল। সেখানে ক্ষীণ জ্যোৎস্না ঘন ডালপালার মধ্যে আটক খাইয়া কোথাও নিষ্কৃতির পথ পাইতেছিল না; সেই বর্ষার নিবিড়গন্ধ অন্ধকার ছায়াপথে জোনাকির ঝাঁকের মধ্য দিয়া উভয়ে নদীর ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইল।

ঘাটের যে ধাপ বাহিয়া শব্দ উপরে উঠিয়াছিল সেই ধাপ দিয়া অলংকৃত কঙ্কাল তাহার আন্দোলনহীন ঋজুগতিতে কঠিন শব্দ করিয়া এক-পা এক-পা নামিতে লাগিল। পরিপূর্ণ বর্ষানদীর প্রবলস্রোত জলের উপর জ্যোৎস্নার একটি দীর্ঘরেখা ঝিক্‌ঝিক্‌ করিতেছে।

কঙ্কাল নদীতে নামিল, অনুবর্তী ফণিভূষণও জলে পা দিল। জলস্পর্শ করিবামাত্র ফণিভূষণের তন্দ্রা ছুটিয়া গেল। সম্মুখে আর তাহার পথপ্রদর্শক নাই, কেবল নদীর পরপারে গাছগুলা স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া এবং তাহাদের মাথার উপরে খণ্ড চাঁদ শান্ত অবাক্‌ভাবে চাহিয়া আছে। আপাদমস্তক বারংবার শিহরিয়া শিহরিয়া স্খলিতপদে ফণিভূষণ স্রোতের মধ্যে পড়িয়া গেল। যদিও সাঁতার জানিত কিন্তু স্নায়ু তাহার বশ মানিল না, স্বপ্নের মধ্য হইতে কেবল মুহূর্তমাত্র জাগরণের প্রান্তে আসিয়া পরক্ষণে অতলস্পর্শ সুপ্তির মধ্যে নিমগ্ন হইয়া গেল।

গল্প শেষ করিয়া ইস্কুলমাস্টার খানিকক্ষণ থামিলেন। হঠাৎ থামিবামাত্র বোঝা গেল, তিনি ছাড়া ইতিমধ্যে জগতের আর-সকলই নীরব নিস্তব্ধ হইয়া গেছে। অনেকক্ষণ আমি একটি কথাও বলিলাম না এবং অন্ধকারে তিনি আমার মুখের ভাব দেখিতে পাইলেন না।

আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি এ গল্প বিশ্বাস করিলেন না।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কি ইহা বিশ্বাস করেন।”

তিনি কহিলেন, “না। কেন করি না তাহার কয়েকটি যুক্তি দিতেছি। প্রথমত, প্রকৃতিঠাকুরানী উপন্যাসলেখিকা নহেন, তাঁহার হাতে বিস্তর কাজ আছে—”

আমি কহিলাম, “দ্বিতীয়ত, আমারই নাম শ্রীযুক্ত ফণিভূষণ সাহা।”

ইস্কুলমাস্টার কিছুমাত্র লজ্জিত না হইয়া কহিলেন, “আমি তাহা হইলে ঠিকই অনুমান করিয়াছিলাম। আপনার স্ত্রীর নাম কী ছিল।”

আমি কহিলাম, “নৃত্যকালী।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *