চোখের বালি ৫৫

৫৫
রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু হইলে পর শ্রাদ্ধশেষে মহেন্দ্র কহিল,”ভাই বিহারী, আমি ডাক্তারি জানি–তুমি যে-কাজ আরম্ভ করিয়াছে, আমাকেও তাহার মধ্যে নাও। চুনি যেরূপ গৃহিণী হইয়াছে সেও তোমার অনেক সহায়তা করিতে পারিবে। আমরা সকলে সেইখানেই থাকিব।”
বিহারী কহিল,”মহিনদা, ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখো–এ কাজ কি বরাবর তোমার ভালো লাগিবে? বৈরাগ্যের ক্ষণিক উচ্ছ্বাসের মুখে একটা স্থায়ী ভার গ্রহণ করিয়া বসিয়ো না।”
মহেন্দ্র কহিল, “বিহারী, তুমিও ভাবিয়া দেখো, যে জীবন আমি গঠন করিয়াছি, তাহাকে লইয়া আলস্যভরে আর উপভোগ করিবার জো নাই–কর্মের দ্বারা তাহাকে যদি টানিয়া লইয়া না চলি, তবে কোন্‌ দিন সে আমাকে টানিয়া অবসাদের মধ্যে ফেলিবে। তোমার কর্মের মধ্যে আমাকে স্থান দিতেই হইবে।”
সেই কথাই স্থির হইয়া গেল।
অন্নপূর্ণা ও বিহারী বসিয়া শান্ত বিষাদের সহিত সেকালের কথা আলোচনা করিতেছিলেন। তাঁহাদের পরস্পরের বিদায়ের সময় কাছে আসিয়াছে। বিনোদিনী দ্বারের কাছে আসিয়া কহিল, “কাকীমা, আমি কি এখানে একটু বসিতে পারি।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “এসো এসো বাছা, বসো।”
বিনোদিনী আসিয়া বসিলে তাহার সহিত দুই-চারিটা কথা কহিয়া বিছানা তুলিবার উপলক্ষ করিয়া অন্নপূর্ণা বারান্দায় গেলেন।
বিনোদিনী বিহারীকে কহিল,”এখন আমার প্রতি তোমার যাহা আদেশ, তাহা বলো।”
বিহারী কহিল,”বোঠান, তুমিই বলো, তুমি কী করিতে চাও।” বিনোদিনী কহিল,”শুনিলাম, গরিবদের চিকিৎসার জন্য গঙ্গার ধারে তুমি একখানি বাগান লইয়াছ–আমি সেখানে তোমার কোনো একটা কাজ করিব। কিছু না হয় তো আমি রাঁধিয়া দিতে পারি।”
বিহারী কহিল, “বোঠান, আমি অনেক ভাবিয়াছি। নানান হাঙ্গামে আমাদের জীবনের জালে অনেক জট পড়িয়া গেছে। এখন নিভৃতে বসিয়া বসিয়া তাহারই একটি একটি গ্রন্থি মোচন করিবার দিন আসিয়াছে। পূর্বে সমস্ত পরিস্কার করিয়া লইতে হইবে। এখন হৃদয় যাহা চায়, তাহাকে আর প্রশ্রয় দিতে সাহস হয় না। এ পর্যন্ত যাহা-কিছু ঘটিয়াছে, যাহা-কিছু সহ্য করিয়াছি, তাহার সমস্ত আবর্তন, সমস্ত আন্দোলন শান্ত করিতে না পারিলে, জীবনের সমাপ্তির জন্য প্রস্তুত হইতে পারিব না। যদি সমস্ত অতীতকাল অনুকূল হইত, তবে সংসারে একমাত্র তোমার দ্বারাই আমার জীবন সম্পূর্ণ হইতে পারিত–এখন তোমা হইতে আমাকে বঞ্চিত হইতেই হইবে। এখন আর সুখের জন্য চেষ্টা বৃথা, এখন কেবল আস্তে আস্তে সমস্ত ভাঙচুর সারিয়া লইতে হইবে।”
এই সময় অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিতেই বিনোদিনী কহিল, “মা, আমাকে তোমার পায়ে স্থান দিতে হইবে।
পাপিষ্ঠা বলিয়া আমাকে তুমি ঠেলিয়ো না।” অন্নপূর্ণা কহিলেন, “মা, চলো, আমার সঙ্গেই চলো।” অন্নপূর্ণা ও বিনোদিনীর কাশীতে যাইবার দিন কোনো সুযোগে বিহারী বিরলে বিনোদিনীর সহিত দেখা করিল। কহিল,”বোঠান, তোমার একটা কিছু চিহ্ন আমি কাছে রাখিতে চাই।” বিনোদিনী কহিল,”আমার এমন কী আছে, যাহা চিহ্নের মতো কাছে রাখিতে পার?”
বিহারী লজ্জা ও সংকোচের সহিত কহিল,”ইংরেজের একটা প্রথা আছে, প্রিয়জনের একগুচ্ছ চুল
সমরণের জন্য রাখিয়া দেয়–যদি তুমি–।”
বিনোদিনী। ছি ছি, কী ঘৃণা। আমার চুল লইয়া কী করিবে। সেই অশুচি মৃতবস্তু আমার এমন কিছুই নহে, যাহা আমি তোমকে দিতে পারি। আমি হত-ভাগিনী তোমার কাজে থাকিতে পারিব না–আমি এমন একটাকিছু দিতে চাই, যাহা আমার হইয়া তোমার কাজ করিবে–বলো,তুমি লইবে?
বিহারী কহিল, “লইব।” তখন বিনোদিনী তাহার অঞ্চলের প্রান্ত খুলিয়া হাজার টাকার দুইখানি নোট বিহারীর হাতে দিল। বিহারী সুগভীর আবেগের সহিত স্থিরদৃষ্টিতে বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। খানিক বাদে বিহারী
কহিল, “আমি কি তোমাকে কিছু দিতে পারিব না।”
বিনোদিনী কহিল, “তোমার চিহ্ন আমার কাছে আছে, তাহা আমার অঙ্গের ভূষণ–তাহা কেহ কাড়িতে পারিবে না। আমার আর কিছু দরকার নাই।” বলিয়া সে নিজের হাতের সেই কাটা দাগ দেখাইল। বিহারী আশ্চর্য হইয়া রহিল। বিনোদিনী কহিল, “তুমি জান না–এ তোমারই আঘাত–এবং এ আঘাত তোমারই উপযুক্ত। ইহা এখন তুমিও ফিরাইতে পার না।”
মাসিমার উপদেশসত্ত্বেও আশা বিনোদিনী সম্বন্ধে মনকে নিষ্কন্টক করিতে পারে নাই। রাজলক্ষ্মীর সেবায় দুইজনে একত্রে কাজ করিয়াছে, কিন্তু আশা যখনই বিনোদিনীকে দেখিয়াছে তখনই তাহার বুকের মধ্যে ব্যথা লাগিয়াছে–মুখ দিয়া সহজে কথা বাহির হয় নাই, এবং হাসিবার চেষ্টা তাহাকে পীড়ন করিয়াছে। বিনোদিনীর নিকট হইতে সামান্য কোনো সেবা গ্রহণ করিতেও তাহার সমস্ত চিত্ত বিমুখ হইয়াছে। বিনোদিনীর সাজা পান অনেক সময়ে শিষ্টতার খাতিরে তাহাকে গ্রহণ করিতে হইয়াছে, কিন্তু আড়ালে তাহা ফেলিয়া দিয়াছে। কিন্তু আজ যখন বিদায়কাল উপস্থিত হইল–মাসিমা সংসার হইতে দ্বিতীয়বার চলিয়া যাইতেছেন বলিয়া আশার হৃদয় যখন অশ্রুজলে আর্দ্র হইয়া গেল, তখন সেইসঙ্গে বিনোদিনীর প্রতি তাহার করুণার উদয় হইল। যে একেবারে চলিয়া যাইতেছে তাহাকে মাপ করিতে পারে না, এমন কঠিন মন অল্পই আছে। আশা জানিত, বিনোদিনী মহেন্দ্রকে ভালোবাসে; মহেন্দ্রকে ভালো না বাসিবেই বা কেন। মহেন্দ্রকে ভালোবাসা যে কিরূপ অনিবার্য, আশা তাহা নিজের হৃদয়ের ভিতর হইতেই জানে। নিজের ভালোবাসার সেই বেদনায় বিনোদিনীর প্রতি আজ তাহার বড়ো দয়া হইল। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে চিরদিনের জন্য ছাড়িয়া যাইতেছে, তাহার যে দুর্বিষহ দুঃখ, তাহা আশা অতিবড়ো শত্রুর জন্যও কামনা করিতে পারে না–মনে করিয়া তাহার চক্ষে জল আসিল; এককালে সে বিনোদিনীকে ভালোবাসিয়াছিল–সেই ভালোবাসা তাহাকে স্পর্শ করিল। সে ধীরে ধীরে বিনোদিনীর কাছে আসিয়া অত্যন্ত করুণার সঙ্গে, স্নেহের সঙ্গে, বিষাদের সঙ্গে মৃদুস্বরে কহিল, “দিদি, তুমি চলিলে?”
বিনোদিনী আশার চিবুক ধরিয়া কহিল, “হাঁ বোন, আমার যাইবার সময় আসিয়াছে। একসময় তুমি আমাকে ভালোবাসিয়াছিলে–এখন সুখের দিনে সেই ভালোবাসার একটুখানি আমার জন্যে রাখিয়ো, ভাই–আর সব ভুলিয়া যেয়ো!”
মহেন্দ্র আসিয়া প্রণাম করিয়া কহিল, “বৌঠান, মাপ করিয়ো।” তাহার চোখের প্রান্তে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া পড়িল।
বিনোদিনী কহিল, “তুমিও মাপ করিয়ো ঠাকুরপো, ভগবান তোমাদের চিরসুখী করুন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *