স্বর্গ-মর্ত

গান

      মাটির প্রদীপখানি আছে
                মাটির ঘরের কোলে,
      সন্ধ্যাতারা তাকায় তারই
                আলো দেখবে ব’লে।
      সেই আলোটি নিমেষহত
      প্রিয়ার ব্যাকুল চাওয়ার মতো,
      সেই আলোটি মায়ের প্রাণের
                ভয়ের মতো দোলে॥
 
      সেই আলোটি নেবে জ্বলে
                শ্যামল ধরার হৃদয়তলে,
      সেই আলোটি চপল হাওয়ায়
                ব্যথায় কাঁপে পলে পলে।
      নামল সন্ধ্যাতারার বাণী
      আকাশ হতে আশিস আনি,
      অমর শিখা আকুল হল
                মর্ত শিখায় উঠতে জ্বলে॥

ইন্দ্র। সুরগুরো, একদিন দৈত্যদের হাতে আমরা স্বর্গ হারিয়েছিলুম। তখন দেবে মানবে মিলে আমরা স্বর্গের জন্যে লড়াই করেছি, এবং স্বর্গকে উদ্ধার করেছি, কিন্তু এখন আমাদের বিপদ তার চেয়ে অনেক বেশি। সে কথা চিন্তা করে দেখবেন।

বৃহস্পতি। মহেন্দ্র, আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে। স্বর্গের কী বিপদ আশঙ্কা করছেন।

ইন্দ্র। স্বর্গ নেই।

বৃহস্পতি। নেই? সে কী কথা। তা হলে আমরা আছি কোথায়।

ইন্দ্র। আমরা আমাদের অভ্যাসের উপর আছি স্বর্গ যে কখন ক্রমে ক্ষীণ হয়ে, ছায়া হয়ে, লুপ্ত হয়ে গেছে, তা জানতেও পারি নি।

কার্তিকেয়। কেন দেবরাজ, স্বর্গের সমস্ত সমারোহ, সমস্ত অনুষ্ঠানই তো চলছে।

ইন্দ্র। অনুষ্ঠান ও সমারোহ বেড়ে উঠেছে, দিনশেষে সূর্যাস্তের সমারোহের মতো, তার পশ্চাতে অন্ধকার। তুমি তো জান দেবসেনাপতি, স্বর্গ এত মিথ্যা হয়েছে যে, সকলপ্রকার বিপদের ভয় পর্যন্ত তার চলে গেছে। দৈত্যেরা যে কত যুগযুগান্তর তাকে আক্রমণ করে নি তা মনে পড়ে না। আক্রমণ করবার যে কিছুই নেই। মাঝে মাঝে স্বর্গের যখন পরাভব হ’ত তখনও স্বর্গ ছিল, কিন্তু যখন থেকে—

কার্তিকেয়। আপনার কথা যেন কিছু কিছু বুঝতে পারছি।

বৃহস্পতি। স্বপ্ন থেকে জাগবা মাত্রই যেমন বোঝা যায়, স্বপ্ন দেখছিলুম, ইন্দ্রের কথা শুনেই তেমনি মনে হচ্ছে, একটা যেন মায়ার মধ্যে ছিলুম, কিন্তু তবু এখনও সম্পূর্ণ ঘোর ভাঙে নি।

কার্তিকেয়। আমার কী রকম বোধ হচ্ছে বলব? তূণের মধ্যে শর আছে, সেই শরের ভার বহন করছি, সেই শরের দিকেই মন বদ্ধ আছে, ভাবছি সমস্তই ঠিক আছে। এমন সময়ে কে যেন বললে, একবার তোমার চার দিকে তাকিয়ে দেখো। চেয়ে দেখি, শর আছে কিন্তু লক্ষ্য করবার কিছুই নেই। স্বর্গের লক্ষ্য চলে গেছে।

বৃহস্পতি। কেন এমন হল তার কারণ তো জানা চাই।

ইন্দ্র। যে মাটির থেকে রস টেনে স্বর্গ আপনার ফুল ফুটিয়েছিল সেই মাটির সঙ্গে তার সম্বন্ধ ছিন্ন হয়ে গেছে।

বৃহস্পতি। মাটি আপনি কাকে বলছেন।

ইন্দ্র। পৃথিবীকে। মনে তো আছে, একদিন মানুষ স্বর্গে এসে দেবতার কাজে যোগ দিয়েছে এবং দেবতা পৃথিবীতে নেমে মানুষের যুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। তখন স্বর্গ মর্ত উভয়েই সত্য হয়ে উঠেছিল, তাই সেই যুগকে সত্যযুগ বলত। সেই পৃথিবীর সঙ্গে যোগ না থাকলে স্বর্গ আপনার অমৃতে আপনি কি বাঁচতে পারে।

কার্তিকেয়। আর, পৃথিবীও যে যায়, দেবরাজ। মানুষ এমনি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যাচ্ছে যে, সে আপনার শৌর্যকে আর বিশ্বাস করে না, কেবল বস্তুর উপরেই তার ভরসা। বস্তু নিয়ে মারামারি কাটাকাটি পড়ে গেছে। স্বর্গের টান যে ছিন্ন হয়েছে, তাই আত্মা বস্তু ভেদ করে আলোকের দিকে উঠতে পারছে না।

বৃহস্পতি। এখন উদ্ধারের উপায় কী।

ইন্দ্র। পৃথিবীর সঙ্গে স্বর্গের আবার যোগসাধন করতে হবে।

বৃহস্পতি। কিন্তু, দেবতারা যে পথ দিয়ে পৃথিবীতে যেতেন, অনেক দিন হল, সে পথের চিহ্ন লোপ হয়ে গেছে। আমি মনে করেছিলুম, ভালৈ হয়েছে। ভেবেছিলুম, এইবার প্রমাণ হয়ে যাবে, স্বর্গ নিরপেক্ষ, নিরবলম্ব, আপনাতেই আপনি সম্পূর্ণ।

ইন্দ্র। একদিন সকলেরই সেই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রেমেই স্বর্গ বাঁচে, নইলে স্বর্গ শুকিয়ে যায়। অমৃতের অভিমানে সেই কথা ভুলেছিলুম ব’লেই পৃথিবীতে দেবতার যাবার পথের চিহ্ন লোপ পেয়েছিল।

কার্তিকেয়। দৈত্যদের পরাভবের পর থেকে আমরা আটঘাট বেঁধে স্বর্গকে সুরক্ষিত করে তুলেছি। তার পর থেকে স্বর্গের ঐশ্বর্য স্বর্গের মধ্যেই জমে আসছে; বাহিরে তার আর প্রয়োগ নেই, তার আর ক্ষয় নেই। যুগ যুগ হতে অব্যাঘাতে তার এতই উন্নতি হয়ে এসেছে যে, বাহিরের অন্য সমস্ত-কিছু থেকে স্বর্গ বহু দূরে চলে গেছে। স্বর্গ তাই আজ একলা।

ইন্দ্র। উন্নতিই হোক আর দুর্গতিই হোক, যাতেই চার দিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ আনে তাতেই ব্যর্থতা আনে। ক্ষুদ্র থেকে মহৎ যখন সুদূরে চলে যায় তখন তার মহত্ত্ব নিরর্থক হয়ে আপনাকে আপনি ভারগ্রস্ত করে মাত্র। স্বর্গের আলো আজ আপনার মাটির প্রদীপের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলেয়ার আলো হয়ে উঠেছে, লোকালয়ের আয়ত্তের অতীত হয়ে সে নিজেরও আয়ত্তের অতীত হয়েছে; নির্বাপণের শাস্তির চেয়ে তার এই শাস্তি গুরুতর। দেবলোক আপনাকে অতি বিশুদ্ধ রাখতে গিয়ে আপন শুচিতার উচ্চ প্রাচীরে নিজেকে বন্দী করেছে, সেই দুর্গম প্রাচীর ভেঙে গঙ্গার ধারার মতো মলিন মর্তের মধ্যে তাকে প্রবাহিত করে দিয়ে তবে তার বন্ধনমোচন হবে। তার সেই স্বাতন্ত্র্যের বেষ্টন বিদীর্ণ করবার জন্যেই আমার মন আজ এমন বিচলিত হয়ে উঠেছে। স্বর্গকে আমি ঘিরতে দেব না, বৃহস্পতি; মলিনের সঙ্গে, পতিতের সঙ্গে, অজ্ঞানীর সঙ্গে, দুঃখীর সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিতে হবে।

বৃহস্পতি। তা হলে আপনি কী করতে চান।

ইন্দ্র। আমি পৃথিবীতে যাব।

বৃহস্পতি। সেই যাবার পথটাই বন্ধ, সেই নিয়েই তো দুঃখ।

ইন্দ্র। দেবতার স্বরূপে সেখানে আর যেতে পারব না, মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করব। নক্ষত্র যেমন খ’সে প’ড়ে তার আকাশের আলো আকাশে নিবিয়ে দিয়ে, মাটি হয়ে মাটিকে আলিঙ্গন করে, আমি তেমনি করে পৃথিবীতে যাব।

বৃহস্পতি। আপনার জন্মাবার উপযুক্ত বংশ পৃথিবীতে এখন কোথায়।

কার্তিকেয়। বৈশ্য এখন রাজা, ক্ষত্রিয় এখন বৈশ্যের সেবায় লড়াই করছে, ব্রাহ্মণ এখন বৈশ্যের দাস।

ইন্দ্র। কোথায় জন্মাব সে তো আমার ইচ্ছার উপরে নেই, যেখানে আমাকে আকর্ষণ করে নেবে সেইখানেই আমার স্থান হবে।

বৃহস্পতি। আপনি যে ইন্দ্র সেই স্মৃতি কেমন করে—

ইন্দ্র। সেই স্মৃতি লোপ করে দিয়ে তবেই আমি মর্তবাসী হয়ে মর্তের সাধনা করতে পারব।

কার্তিকেয়। এতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব ভুলেই ছিলুম, আজ আপনার কথায় হঠাৎ মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। সেই তন্বী শ্যামা ধরণী সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের পথ ধরে স্বর্গের দিকে কী উৎসুক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে। সেই ভীরুর ভয় ভাঙিয়ে দিতে কী আনন্দ। সেই ব্যথিতার মনে আশার সঞ্চার করতে কী গৌরব। সেই চন্দ্রকান্তমণিকিরীটিণী নীলাম্বরী সুন্দরী কেমন করে ভুলে গিয়েছে যে সে রানী। তাকে আবার মনে করিয়ে দিতে হবে যে, সে দেবতার সাধনার ধন, সে স্বর্গের চিরদয়িতা।

ইন্দ্র। আমি সেখানে গিয়ে তার দক্ষিণসমীরণে এই কথাটি রেখে আসতে চাই যে, তারই বিরহে স্বর্গের অমৃতে স্বাদ চলে গেছে এবং নন্দনের পারিজাত ম্লান; তাকে বেষ্টন ক’রে ধ’রে যে সমুদ্র রয়েছে সেই তো স্বর্গের অশ্রু, তারই বিচ্ছেদক্রন্দনকেই তো সে মর্তে অনন্ত করে রেখেছে।

কার্তিকেয়। দেবরাজ, যদি অনুমতি করেন তা হলে আমরাও পৃথিবীতে যাই।

বৃহস্পতি। সেখানে মৃত্যুর অবগুণ্ঠনের ভিতর দিয়ে অমৃতের জ্যোতিকে একবার দেখে আসি।

কার্তিকেয়। বৈকুণ্ঠের লক্ষ্ণী তাঁর মাটির ঘরটিতে যে নিত্যনূতন লীলা বিস্তার করেছেন আমরা তার রস থেকে কেন বঞ্চিত হব। আমি যে বুঝতে পারছি, আমাকে পৃথিবীর দরকার আছে; আমি নেই ব’লেই তো সেখানে মানুষ স্বার্থের জন্যে নির্লজ্জ হয়ে যুদ্ধ করছে, ধর্মের জন্যে নয়।

বৃহস্পতি। আর, আমি নেই বলেই তো মানুষ কেবল ব্যবহারের জন্যে জ্ঞানের সাধনা করছে, মুক্তির জন্যে নয়।

ইন্দ্র। তোমরা সেখানে যাবে, আমি তো তারই উপায় করতে চলেছি; সময় হলেই তোমরা পরিণত ফলের মতো আপন মাধুর্যভাবে সহজেই মর্তে স্খলিত হয়ে পড়বে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

কার্তিকেয়। কখন টের পাব মহেন্দ্র, যে, আপনার সাধনা সার্থক হল।

বৃহস্পতি। সে কি আর চাপা থাকবে। যখন জয়শঙ্খধ্বনিতে স্বর্গলোক কেঁপে উঠবে তখনি বুঝব যে—

ইন্দ্র। না দেবগুরু, জয়ধ্বনি উঠবে না। স্বর্গের চোখে যখন করুণার অশ্রু গলে পড়বে তখনই জানবেন, পৃথিবীতে আমার জন্মলাভ সফল হল।

কার্তিকেয়। তত দিন বোধ হয় জানতে পারব না, সেখানে ধুলার আবরণে আপনি কোথায় লুকিয়ে আছেন।

বৃহস্পতি। পৃথিবীর রসই তো হল এই লুকোচুরিতে। ঐশ্বর্য সেখানে দরিদ্রবেশে দেখা দেয়, শক্তি সেখানে অক্ষমের কোলে মানুষ হয়, বীর্য সেখানে পরাভবের মাটির তলায় আপন জয়স্তম্ভের ভিত্তি খনন করে। সম্ভব সেখানে অসম্ভবের মধ্যে বাসা করে থাকে। যা দেখা দেয়, পৃথিবীতে তাকে মানতে গিয়েই ভুল হয়; যা না দেখা দেয় তারই উপর চিরদিন ভরসা রাখতে হবে।

কার্তিকেয়। কিন্তু সুররাজ, আপনার ললাটের চিরোজ্জ্বল জ্যোতি আজ ম্লান হল কেন।

বৃহস্পতি। মর্তে যে যাবেন তার গৌরবের প্রভা আজ দীপ্যমান হয়ে উঠুক।

ইন্দ্র। দেবগুরু, জন্মের যে বেদনা সেই বেদনা এখনি আমাকে পীড়িত করছে। আজ আমি দুঃখেরই অভিসারে চলেছি, তারই আহ্বানে আমার মনকে টেনেছে। শিবের সঙ্গে সতীর যেমন বিচ্ছেদ হয়েছিল, স্বর্গের আনন্দের সঙ্গে পৃথিবীর ব্যথার তেমনি বিচ্ছেদ হয়েছে; সেই বিচ্ছেদের দুঃখ এত দিন পরে আজ আমার মনে রাশীকৃত হয়ে উঠেছে। আমি চললুম সেই ব্যথাকে বুকে তুলে নেবার জন্যে। প্রেমের অমৃতে সেই ব্যথাকে আমি সৌভাগ্যবতী করে তুলব। আমাকে বিদায় দাও।

কার্তিকেয়। মহেন্দ্র, আমাদের জন্যে পথ করে দাও, আমরা সেইখানেই গিয়ে তোমার সঙ্গে মিলব। স্বর্গ আজ দুঃখের অভিযানে বাহির হোক।

বৃহস্পতি। আমারা পথের অপেক্ষাতেই রইলুম, দেবরাজ। স্বর্গ থেকে বাহির হবার পথ করে দাও, নইলে আমাদের মুক্তি নেই।

কার্তিকেয়। বাহির করো, দেবরাজ, স্বর্গের বন্ধন থেকে আমাদের বাহির করো— মৃত্যুর ভিতর দিয়ে আমাদের পথ রচনা করো।

বৃহস্পতি। তুমি স্বর্গরাজ, আজ তুমি স্বর্গের তপোভঙ্গ ক’রে জানিয়ে দাও যে, স্বর্গ পৃথিবীরই।

কার্তিকেয়। যারা স্বর্গকামনায় পৃথিবীকে ত্যাগ করবার সাধনা করেছে চিরদিন তুমি তাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছ, আজ স্বয়ং স্বর্গকে সেই পথে নিয়ে যেতে হবে।

ইন্দ্র। সেই বাধার ভিতর দিয়ে মুক্তিতে যাবার পথ—

বৃহস্পতি। যে মুক্তি আপন আনন্দে চিরদিনই বাধার সঙ্গে সংগ্রাম করে।

গান

    পথিক হে, পথিক হে,
              ঐ যে চলে, ঐ যে চলে,
                   সঙ্গী তোমার দলে দলে।
    অন্যমনে থাকি কোণে,
    চমক লাগে ক্ষণে ক্ষণে,
              হঠাৎ শুনি জলে স্থলে
                    পায়ের ধ্বনি আকাশতলে।
    পথিক হে, পথিক হে,
              যেতে যেতে পথের থেকে,
                     আমায় তুমি যেয়ো ডেকে।
    যুগে যুগে বারে বারে
    এসেছিল আমার দ্বারে,
              হঠাৎ যে তাই জানিতে পাই
                     তোমার চলা হৃদয়তলে।

ফাল্গুন ১৩২৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *