মুক্তি

বিরহিণী তার ফুলবাগানের এক ধারে বেদী সাজিয়ে তার উপর মূর্তি গড়তে বসল। তার মনের মধ্যে যে মানুষটি ছিল বাইরে তারই প্রতিরূপ প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে, আর চেয়ে চেয়ে দেখে, আর ভাবে, আর চোখ দিয়ে জল পড়ে।

কিন্তু, যে রূপটি একদিন তার চিত্তপটে স্পষ্ট ছিল তার উপরে ক্রমে যেন ছায়া পড়ে আসছে। রাতের বেলাকার পদ্মের মতো স্মৃতির পাপড়িগুলি অল্প অল্প করে যেন মুদে এল।

মেয়েটি তার নিজের উপর রাগ করে, লজ্জা পায়। সাধনা তার কঠিন হল, ফল খায় আর জল খায়, আর তৃণশয্যায় পড়ে থাকে।

মূর্তিটি মনের ভিতর থেকে গড়তে গড়তে সে আর প্রতিমূর্তি রইল না। মনে হল, এ যেন কোনো বিশেষ মানুষের ছবি নয়। যতই বেশি চেষ্টা করে ততই বেশি তফাত হয়ে যায়।

মূর্তিকে তখন সে গয়না দিয়ে সাজাতে থাকে, একশো এক পদ্মের ডালি দিয়ে পুজো করে, সন্ধেবেলায় তার সামনে গন্ধতৈলের প্রদীপ জ্বালে— সে প্রদীপ সোনার, সে তেলের অনেক দাম।

দিনে দিনে গয়না বেড়ে ওঠে, পুজোর সামগ্রীতেই বেদী ঢেকে যায়, মূর্তিকে দেখা যায় না।

এক ছেলে এসে তাকে বললে, ‘আমরা খেলব।’

‘কোথায়।’

‘ঐখানে, যেখানে তোমার পুতুল সাজিয়েছ।’

মেয়ে তাকে হাঁকিয়ে দেয়; বলে, ‘এখানে কোনোদিন খেলা হবে না।’

আর-এক ছেলে এসে বলে, ‘আমরা ফুল তুলব।’

‘কোথায়।’

‘ঐযে, তোমার পুতুলের ঘরের শিয়রে যে চাঁপাগাছ আছে ঐ গাছ থেকে।’

মেয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়; বলে, ‘এ ফুল কেউ ছুঁতে পাবে না।’

আর-এক ছেলে এসে বলে, ‘প্রদীপ ধরে আমাদের পথ দেখিয়ে দাও।’

‘প্রদীপ কোথায়?’

‘ঐ যেটা তোমার পুতুলের ঘরে জ্বাল।’

মেয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়; বলে, ‘ও প্রদীপ ওখান থেকে সরাতে পারব না।’

এক ছেলের দল যায়, আর-এক ছেলের দল আসে।

মেয়েটি শোনে তাদের কলরব, আর দেখে তাদের নৃত্য। ক্ষণকালের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে যায়। অমনি চমকে ওঠে, লজ্জা পায়।

মেলার দিন কাছে এল।

পাড়ার বুড়ো এসে বললে, ‘বাছা, মেলা দেখতে যাবি নে?’

মেয়ে বললে, ‘আমি কোথাও যাব না।’

সঙ্গিনী এসে বললে, ‘চল্‌‍, মেলা দেখবি চল্‌‍।’

মেয়ে বললে, ‘আমার সময় নেই।’

ছোটো ছেলেটি এসে বললে, ‘আমায় সঙ্গে নিয়ে মেলায় চলো-না।’

মেয়ে বললে, ‘যেতে পারব না, এইখানে যে আমার পুজো।’

একদিন রাত্রে ঘুমের মধ্যেও সে যেন শুনতে পেলে সমুদ্রগর্জনের মতো শব্দ। দলে দলে দেশবিদেশের লোক চলেছে—কেউ বা রথে, কেউ বা পায়ে হেঁটে; কেউ বা বোঝা পিঠে নিয়ে, কেউ বা বোঝা ফেলে দিয়ে।

সকালে যখন সে জেগে উঠল তখন যাত্রীর গানে পাখির গান আর শোনা যায় না। ওর হঠাৎ মনে হল, ‘আমাকেও যেতে হবে।’

অমনি মনে পড়ে গেল, ‘আমার যে পুজো আছে, আমার তো যাবার জো নেই।’

তখনি ছুটে চলল তার বাগানের দিকে যেখানে মূর্তি সাজিয়ে রেখেছে।

গিয়ে দেখে, মূর্তি কোথায়! বেদীর উপর দিয়ে পথ হয়ে গেছে। লোকের পরে লোক চলে, বিশ্রাম নেই।

‘এইখানে যাকে বসিয়ে রেখেছিলেম সে কোথায়।’

কে তার মনের মধ্যে বলে উঠল, ‘যারা চলেছে তাদেরই মধ্যে।’

এমন সময় ছোটো ছেলে এসে বললে, ‘আমাকে হাতে ধরে নিয়ে চলো।’

‘কোথায়।’

ছেলে বললে, ‘মেলার মধ্যে তুমিও যাবে না?’

মেয়ে বললে, ‘হাঁ, আমিও যাব।’

যে বেদীর সামনে এসে সে বসে থাকত সেই বেদীর উপর হল তার পথ, আর মূর্তির মধ্যে যে ঢেকে গিয়েছিল সকল যাত্রীর মধ্যে তাকে পেলে।

পৌষ ১৩২৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *