উপসংহার

উপসংহার

সাঁওতালদের নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে কৌতূহলের অন্ত নেই এ কথা, আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সাঁওতালদের নিয়ে বহু গ্রন্থও রচিত হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় যেটা উল্লেখ না করলেই নয় সেটা হল সাঁওতালদের নিয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হলেও সাঁওতালদের মত এক মহান জাতির রীতিনীতির, সভ্যতা সংস্কৃতির যথার্থ প্রতিফলন এই সব গ্রন্থে আদৌও ঘটেছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। কারণ সাঁওতালরা অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোন অঞ্চল নাই, তারা নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলে সীমাবদ্ধও নয়। তাই তাদের রীতিনীতি, আচার আচরণ ইত্যাদি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের মতই বৈচিত্র্যপূর্ণ। অন্যদিকে সাঁওতালদের নিয়ে রচিত পুঁথিগুলির রসদ বিশেষ বিশেষ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ও রচিত। ফলে সেই সব গ্রন্থে সেই সব অঞ্চলের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যেই প্রতিফলিত হয়েছে, সমগ্র সাঁওতাল সমাজের প্রতিফলন তার মধ্যে নেই। তাই তাকে সমগ্র সাঁওতাল সমাজের বৈশিষ্ট্য বলে দাবী করা অন্যায় শুধু নয়, অনুচিত। দু, একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। দঙ লাগড়ে, বাহা এবং সহরায়ের প্রচলন entire সাঁওতাল সমাজেই আছে। বাদ্য যন্ত্র হিসেবে মাদল এবং নাগড়ার প্রচলনও সব জায়গায় আছে। গানের সুর এবং বাজনা ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাই মেদিনীপুর, সিংভূম কিম্বা সাঁওতাল পরগণার দুমকার সঙ্গে পুরুলিয়ার গান বাজনার মিল নেই। এই বৈচিত্র্য শুধুমাত্র গান বাজনার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এই পার্থক্য সমাজের সব ক্ষেত্রেই, সবত্রই বিদ্যমান। তাই সাঁওতাল পরগণার দুমকা থেকে অথবা উপসংহারে উল্লেখিত যে কোন একটি অংশ থেকে সংগৃহীত বৈশিষ্ট্যকে সমগ্র সাঁওতাল সমাজের বলে দাবী করা ঠিক নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়।

উপসংহার লিখতে গিয়ে আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। তুচ্ছ ঘটনা, কিন্তু তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম বলেই বহুকাল আগের হলেও স্পষ্ট মনে আছে। ঘটনাটা গ্রামের সামান্য এক শখের যাত্রাপালাকে কেন্দ্র করে। গ্রাম বাংলায় একসময় যাত্রা পালার বেশ প্রচলন ছিল। সেখানে আয়োজন থেকে শুরু করে অভিনয় সবই গ্রামের ছেলেরাই করতেন। এ রকমই কোনো এক শখের যাত্রায় ঘটনাটা ঘটেছিল। গ্রামে যাত্রাপালার আসর বসবে। মঞ্চ তৈরি, চারপাশে চারটে খুঁটি পুঁতে সামিয়ানাও টাঙানো হয়েছে। হ্যাজাকের আলো জ্বলছে। লোকজন রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে মঞ্চের চারপাশে এসে ভীড় জমিয়েছে। সবাই উন্মুখ হয়ে আছে। কখন গ্রীনরুমের পর্দা উঠবে, যাত্রা শুরুর ঘণ্টা বাজবে? অবশেষে এক সময় গ্রীনরুমের পর্দা উঠল, ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই শখের যাত্রা শুরু হল। কিন্তু প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যের অভিনয় দেখেই দর্শকরা হতাশ হয়ে পড়লেন। কারণ আর কিছুই নয়, গাঁয়ের পঞ্চানন যাকে সবাই পচা বলে ডাকে তার গায়ে রাজার পোশাক। দর্শক শ্রোতা তাকে রাজা বলে মানতে নারাজ! ফলে যাত্রাপালা সুঅভিনীত হলেও দর্শকদের আনন্দ দিতে পারেনি। আলোচ্য ‘অথ সাঁওতাল কথা’ পড়েও পাঠকের মন খারাপ হতে পারে কারণ এতদিন পর্যন্ত যাদের Aboriginal, Semi Savage বলে জেনে এসেছি তাকে মহান বলে গ্রহণ করতে মন চাইবে না। তাদের কাছে আমার অনুরোধ বইটি পড়ার আগে এতদিন ধরে প্রচলিত Aboriginal এবং Semi-Savage শব্দগুলি মন থেকে সরিয়ে নিন, দেখবেন এতদিন পর্যন্ত যাকে অবহেলা করে এসেছেন, বঞ্চিত করে এসেছেন তাকেই মহান বলে মনে হবে। তাই আমার বক্তব্য, যা আমি বলতে চাই—ওরা হচ্ছে সাঁওতাল Aboriginal বা Semi Savage নয়! বুনো ওল কিম্বা বাঘা তেঁতুলও নয়। সাঁওতাল অর্থাৎ ‘The Santal’, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ব বিভাগের অধ্যাপক মার্টিন ওরান্সের কথায় ‘A Tribe in Search of a great tradition.’

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপসংহার

উপসংহার

ভোজরাজের দেশে যে মেয়েটি ভোরবেলাতে দেবমন্দিরে গান গাইতে যায় সে কুড়িয়ে-পাওয়া মেয়ে।

আচার্য বলেন, ‘একদিন শেষরাত্রে আমার কানে একখানি সুর লাগল। তার পরে সেইদিন যখন সাজি নিয়ে পারুলবনে ফুল তুলতে গেছি তখন এই মেয়েটিকে ফুলগাছতলায় কুড়িয়ে পেলেম।’

সেই অবধি আচার্য মেয়েটিকে আপন তম্বুরাটির মতো কোলে নিয়ে মানুষ করেছে; এর মুখে যখন কথা ফোটে নি এর গলায় তখন গান জাগল।

আজ আচার্যের কণ্ঠ ক্ষীণ, চোখে ভালো দেখেন না। মেয়েটি তাঁকে শিশুর মতো মানুষ করে।

কত যুবা দেশবিদেশ থেকে এই মেয়েটির গান শুনতে আসে। তাই দেখে মাঝে মাঝে আচার্যের বুক কেঁপে ওঠে; বলেন, ‘যে বোঁটা আলগা হয়ে আসে ফুলটি তাকে ছেড়ে যায়।’

মেয়েটি বলে, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি এক পলক বাঁচি নে।’

আচার্য তার মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘যে গান আজ আমার কণ্ঠ ছেড়ে গেল সেই গান তোরই মধ্যে রূপ নিয়েছে। তুই যদি ছেড়ে যাস তা হলে আমার চিরজন্মের সাধনাকে আমি হারাব।’

ফাগুনপূর্ণিমায় আচার্যের প্রধান শিষ্য কুমারসেন গুরুর পায়ে একটি আমের মঞ্জরী রেখে প্রণাম করলে। বললে, ‘মাধবীর হৃদয় পেয়েছি, এখন প্রভুর যদি সম্মতি পাই তা হলে দুজনে মিলে আপনার চরণসেবা করি।’

আচার্যের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বললেন, ‘আনো দেখি আমার তম্বুরা। আর, তোমরা দুইজনে রাজার মতো, রানীর মতো, আমার সামনে এসে বসো।’

তম্বুরা নিয়ে আচার্য গান গাইতে বসলেন। দুলহা-দুলহীর গান, সাহানার সুরে। বললেন, ‘আজ আমার জীবনের শেষ গান গাব।’

এক পদ গাইলেন। গান আর এগোয় না। বৃষ্টির ফোঁটায় ভেরে-ওঠা জুঁইফুলটির মতো হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে খসে পড়ে। শেষে তম্বুরাটি কুমারসেনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘বৎস, এই লও আমার যন্ত্র।’

তার পরে মাধবীর হাতখানি তার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই লও আমার প্রাণ।’

তার পরে বললেন, ‘আমার গানটি দুজনে মিলে শেষ করে দাও, আমি শুনি।’

মাধবী আর কুমার গান ধরলে— সে যেন আকাশ আর পূর্ণচাঁদের কণ্ঠ মিলিয়ে গাওয়া।

এমন সময়ে দ্বারে এল রাজদূত, গান থেমে গেল।

আচার্য কাঁপতে কাঁপতে আসন থেকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মহারাজের কী আদেশ।’

দূত বললে, ‘তোমার মেয়ের ভাগ্য প্রসন্ন, মহারাজ তাকে ডেকেছেন।’

আচার্য জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ইচ্ছা তাঁর।’

দূত বললে, ‘আজ রাত পোয়ালে রাজকন্যা কাম্বোজে পতিগৃহে যাত্রা করবেন, মাধবী তাঁর সঙ্গিনী হয়ে যাবে।’

রাত পোয়ালো, রাজকন্যা যাত্রা করলে।

মহিষী মাধবীকে ডেকে বললে, ‘আমার মেয়ে প্রবাসে গিয়ে যাতে প্রসন্ন থাকে সে ভার তোমার উপরে।’

মাধবীর চোখে জল পড়ল না, কিন্তু অনাবৃষ্টির আকাশ থেকে যেন রৌদ্র ঠিকরে পড়ল।

রাজকন্যার ময়ূরপংখি আগে যায়, আর তার পিছে পিছে যায় মাধবীর পাল্কি। সে পাল্কি কিংখাবে ঢাকা, তার দুই পাশে পাহারা।

পথের ধারে ধুলোর উপরে ঝড়ে-ভাঙা অশ্বত্থডালের মতো পড়ে রইলেন আচার্য, আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুমারসেন।

পাখিরা গান গাইছিল পলাশের ডালে; আমের বোলের গন্ধে বাতাস বিহ্বল হয়ে উঠেছিল। পাছে রাজকন্যার মন প্রবাসে কোনোদিন ফাগুনসন্ধ্যায় হঠাৎ নিমেষের জন্য উতলা হয়, এই চিন্তায় রাজপুরীর লোকে নিশ্বাস ফেললে।

বৈশাখ ১৩২৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *