২.০৫ মস্কো থেকে লেনিনগ্রাড

মস্কো থেকে লেনিনগ্রাড ট্রেনে এক রাত্রির পথ। আমি এ দেশে এসে পৌঁছোবার মাত্র কয়েকদিন আগেই লেনিনগ্রাড শহরের নাম বদলের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। লেনিনের দুটো-একটা মূর্তি ভাঙা কিংবা সরিয়ে ফেলার চেয়েও অনেক মর্মান্তিক এই নাম পরিবর্তন। এই শহরের সঙ্গে লেনিনের স্মৃতি ওতোপ্রাতভাবে জড়িত। শ্রমিক অসন্তোষ এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ শুরু হয় এখানেই। শ্রমিক সংঘ ও সৈন্যবাহিনী হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে জারকে এই শহরে প্রবেশ করতেই দেওয়া হয়নি, তেসরা এপ্রিল জার সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন, কেরেনস্কির প্রধানমন্ত্রিত্বে গঠিত হয়েছিল জাতীয় সরকার। লেনিন অবশ্য সে সময় এখানে উপস্থিত ছিলেন না। জারের পতনের খবর পেয়ে তিনি সুইজারল্যান্ড থেকে দ্রুত চলে আসেন, তারপর ২৫ অক্টোবর (এখনকার পরিবর্তিত ক্যালেন্ডারে ৭ নভেম্বর) বেলশেভিক বিপ্লবের শুরু। সম্রাটদের বিখ্যাত শীতপ্রাসাদ দখল করে নিয়ে লেনিন কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেন। নিঃসন্দেহে এ এক বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা। একটা রাজবংশকে চিরকালের মতন মুছে দিয়ে ক্ষমতায় এল সাধারণ মানুষ।

লেনিনের আমলে এই শহরের নাম ছিল পেট্রোগ্রাড। শহরের নাম বদল করার রীতি রাশিয়ান অনেক দিনের। ব্যক্তিবিশেষের নামে শহরের নামকরণও এদেশে প্রচলিত। অন্যান্য দেশে সাধারণত এরকম ঘটনা ঘটে না, একটা শহরের নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠায় একবার স্থান করে নিলে তার পরিবর্তন না করাই সংগত। এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট পিটার দা গ্রেট সম্ভবত চক্ষুলজ্জায় নিজের নামে এই নতুন শহরের নামকরণ করেননি, কিন্তু খুঁজে খুঁজে এমন এক সন্তের নাম বার করেছিলেন, যাঁর সঙ্গে নিজের নামের মিল আছে। সেন্ট পিটার্সবার্গ নামটি বদলে ফেলা হয় প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। বার্গ কথাটায় জার্মান গন্ধ আছে, তাই নতুন নাম হল পেট্রোগ্রাড। এই নাম অবশ্য দশ বছরের বেশি টেকেনি। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর তাঁর নামে সম্মানিত হল এই শহর। কিন্তু নাম একবার বদলালে যেন বারবার বদলাবার ঝোঁক এসে যায়। কয়েক দশক আগে এ দেশে স্তালিনগ্রাড নামেও একটা শহর ছিল, স্তালিনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়ার ফলে সেই শহরেরও নাম বদলেছে। এবার, সর্বকালের ইতিহাসে বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে লেনিন সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে, তাঁর নামাঙ্কিত শহর আবার রূপান্তরিত হল। প্রথমে শোনার পর কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল বিনা প্রতিবাদে? কোনও আপত্তি উচ্চারিত হল না!

লেনিনগ্রাড সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে গেল কেন পেট্রোগ্রাড়ে কেন নয়, তাও বোঝা যায় না। সেন্ট পিটার্সবার্গে ধর্মীয় গন্ধ আছে, পেট্রোগ্রাড ধর্মনিরপেক্ষ।

কাগজে কলমে পরিবর্তন ঘটলেও মানুষের মন থেকে পুরোনো নাম সহজে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। অনেকেই এখনও লেনিনগ্রাড বলে, শুধু দু-চারজন সরকারি কর্মচারী সে নাম বলে ফেললেও শুধরে নেয়।

মস্কো থেকে ট্রেনে চাপার সময় আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল ঘুষের। এখানে এখন কী ধরনের ঘুষের কারবার যে চলছে, তা বর্ণনা করলেও অবিশ্বাস্য মনে হবে। চতুর্দিকে ঘুষ। যে-কোনও কাজে ঘুষ। এক টাকার কাজের জন্য দশ টাকা ঘুষ। সরকার এখন শিথিল বলে লোকে বেপরোয়া। ট্রেনের টিকিট কাটা থেকে ঘুষের শুরু। সারা রাতের জন্য ফাস্ট ক্লাস স্লিপারের ভাড়া চব্বিশ রুবল, আগেকার হিসেবে চব্বিশ রুবল ছিল অনেক টাকা, এখনকার বাজারদরে টাকা দশেক মাত্র। কিন্তু এত সস্তায় টিকিট পাওয়া যাবে কেন, সব টিকিট অদৃশ্য, দালালদের কাছ থেকে কিনতে হল পাঁচগুণ দামে। তারপর রাত্রিবেলা ট্রেনে ওঠার সময় কন্ডাকটর গার্ড আমাদের দরজার কাছে আটকাল। আমাদের তিনজনের দলটিতে একজন রুশী, দু’জন বঙ্গসন্তান। আমরা কোনও রকম মুখ খোলার আগেই সে বলল, তোমাদের মধ্যে দু’জন বিদেশি, বিদেশিদের ডলারে টিকিট কেনার কথা, তোমাদের এ টিকিট চলবে না। আমরা যে বিদেশি, তা সে চিনল কী করে, নিশ্চয়ই গায়ের রঙ কালো দেখে। কোনও শ্বেতাঙ্গ জার্মান বা ফরাসি অবশ্যই অবলীলাক্রমে পার হয়ে যেত, কারণ, ট্রেনে চাপার সময় তো পাসপোর্ট দেখাতে হয় না।

যাই হোক, ট্রেন প্রায় ছাড়ার মুখে। গার্ডটি বলল, ঠিক আছে, তোমরা উঠে সিট খুঁজে বসো, আমি দেখছি কী করতে পারি। ট্রেন চলতে শুরু করার পর গার্ডটি আমাদের কুপেতে প্রবেশ করল। কোনও দরাদরির প্রশ্নই নেই। সে ব্যস্তভাবে বলল, তোমরা প্রত্যেকে একশো রুবল করে দিয়ে দাও। যেন এটা তার নায্য দাবি। টাকাগুলো নিয়ে সে বেরিয়ে গেল, আর একবারও তার দেখা পাওয়া যায়নি। আগেরবার দেখেছিলাম, ভোরবেলা কন্ডাকটর গার্ড প্রত্যেক কুপেতে এসে চা দিয়ে যায়, এবার অনেক ডাকাডাকি করেও চা পাওয়া গেল না। সে ব্যবস্থা উঠে গেছে।

লেনিনগ্রাড রেল স্টেশনের মতন এতবড় একটা স্টেশনে একটা খাবারের দোকান নেই! সব বন্ধ। একটি মাত্র দোকানের সামনে লম্বা লাইন, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে অতি বিস্বাদ ট্যালটেলে কফি এবং ততোধিক খারাপ একটা বিস্কুট। আমাদের খিদে পেয়েছে, পকেটে পয়সা আছে, তবু আর কিছু কেনার উপায় নেই।

ট্রেনে যেমন ঘুষের অভিজ্ঞতা হল, স্টেশনে সেরকম অভিজ্ঞতা হল ভিক্ষার। এদেশে এখন ভিখারি এমন কিছু দুর্লভ নয়। মস্কোর রাস্তায় ভিখারি ও আঁস্তাকুড়-কুড়ানি দেখেনি বটে কিন্তু লেনিনগ্রাডের রেল স্টেশনের ভিখারিটি মনে ছাপ ফেলে দিয়ে গেল।

আমাদের রুশী বন্ধুটি গেছে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করতে। ট্যাক্সি সংগ্রহ করা অতি কঠিন কাজ। বাইরে অনেক ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে বটে কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট ভাড়ায় যাবে না, পঁচিশগুণ, তিরিশগুণ বেশি চায়। আমাদের দেখে বিদেশি বলে চিনতে পেরে তারা আরও বেশি দর হাঁকবে, তাই আমাদের আড়ালে দাঁড় করিয়ে রেখে রুশী বন্ধুটি একা গেছে।

এই সময় একজন লোক এসে সুবোধের সঙ্গে কী যেন কথা বলতে লাগলেন। লোকটির চেহারা পর্বত-অভিযাত্রীদের মতন, সারা মুখে অবিন্যস্ত দাড়ি, মাথায় বাবরি চুল, গায়ে একটা তালিমারা ওভার কোট। লোকটির ডান হাতের তিনটি আঙুল নেই, তার কথা বলার ভঙ্গিতে কিছুটা যেন লজ্জা লজ্জা ভাব। কী বলছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তাকে ভিখিরি বলে আমি বিন্দুমাত্র সন্দেহ করিনি, একটু পরে সুবোধ তাকে একটা বড় সংখ্যার রুবলের নোট দিল। তখন লোকটি সুবোধের হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল আর সুবোধ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।

শেষ পর্যন্ত লোকটিকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে হল। আমি জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার বলো তো সুবোধ!

সুবোধ বলল, এই লোকটি আগে আর্মিতে ছিল। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আর্মির হয়ে লড়তে গিয়েছিল, সেখানে আঙুলগুলো কাটা গেছে। ওই হাত দিয়ে বিশেষ কোনও কাজ করতে পারে না, কিন্তু সরকার ওর জন্য কোনও ব্যবস্থা করেনি। যা সামান্য পেনসন পায়, তাতে এই ইনফ্লেশানের বাজারে দু-বেলা খাওয়া জোটে না। ভিক্ষে করার ব্যাপারে এখনও পাক্কা হয়ে ওঠেনি। এখনও লজ্জা পায়।

তোমার হাত ধরে টানছিল কেন?

কিছু বেশি টাকা পেয়েছে বোধ হয়। যা আশা করেনি। তাই আমার হাতে চুমু খেতে চাইছিল। আমি আবার ওসব আদিখ্যেতা পছন্দ করি না।

লোকটি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে লজ্জা, দুঃখ, কৃতজ্ঞতা সব মিলেমিশে একটা অদ্ভুত রূপ নিয়েছে।

লেনিনগ্রাড তথা সেন্ট পিটার্সবার্গে আরও কয়েকটি মুখের কথা ভোলা যায় না।

এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্যই হচ্ছে হারমিটের মিউজিয়াম। বিশ্ববিখ্যাতএই মিউজিয়ামে ইম্প্রেশনিস্টদের ছবির দারুণ সংগ্রহে আছে। টিকিট কেটে ঢুকতে যাচ্ছি, সিঁড়ির মুখে এক বৃদ্ধা বাধা দিয়ে বলল, তোমরা তো বিদেশি, তোমাদের দুটো করে টিকিট কাটতে হবে।

কেন এই অদ্ভুত নিয়ম? অন্য কোথাও তো দেখিনি!

বৃদ্ধা বলল, তোমরা তো আমাদের দেশে অতিথি, তাই তোমাদের কাছে থেকে বেশি পয়সা চাইছি।

অতিথিপরায়ণতার এমন বিচিত্র ব্যাখ্যা কখনও শুনিনি। সুবোধ বিদ্রুপের সুরে বলল, অতিথি বলে তো আমাদের বিনা পয়সায় ঢুকতে দেওয়া উচিত!

বৃদ্ধা আঙুল তুলে বলল, ওপরওয়ালারা এই নিয়ম করেছে, আমি তো করিনি। আসলে আমাদের সরকারের এখন টাকা নেই।

সুবোধ বলল, সরকারকে দিতে চাই না, বেশি পয়সাটা বরং তুমি নাও!

বৃদ্ধা মুখ নীচু করল। নিদারুণ লজ্জায় সেই মুখখানা কুঁকড়ে গেছে।

আরও কয়েকটা মুখ দেখেছিলাম একটা হোটেলের দরজার বাইরে। দশ-বারোটি যুবতী, প্রত্যেকেই সাদা পোশাক পরা, কারুরই বয়েস তিরিশের বেশি নয়। সন্ধে আটটা, এমন ফিনফিনে হাওয়া দিচ্ছে যে, ওভারকোটের তলায়ও কেঁপে উঠছে আমাদের শরীর। সেই যুবতীদের অঙ্গে কিন্তু পাতলা পোশাক।

হোটেলটি নতুন ও পাঁচতারা। তার দরজার বাইরে অতগুলি সুশ্রী মেয়ে ভেতরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? হোটেলের ভেতরে ঢোকার তো কোনও নিষেধ নেই। আমরা সে হোটেলের বাসিন্দা নই, ভেতরে গিয়েছিলাম বাথরুম ব্যবহার করার জন্য। ওই নারীরা বাইরে কেন?

আমাদের রুশী বন্ধুটিকে এ প্রশ্ন করতে সে একটু দ্বিধা করে উত্তর দিল, বুঝতে পারছ না? ওরা দাঁড়িয়ে আছে ডাক পাওরার জন্য।

এরা পণ্যা নারী? এত ঠান্ডার মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, কখন কোন মাংসলোভী হাতছানি দেবে, সেই অপেক্ষায়? ওভারকোট পরেনি, কারণ বেশি বস্ত্র থাকলে শরীরের গড়ন বোঝা যাবে না। কিছুক্ষণের জন্য এই শরীরের বিনিময়ে পাবে কিছু টাকা। পাশ দিয়ে যাওরার সময় ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে এসব কথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। টকটকে লাল ঠোঁট, গালে গোলাপি রং, গাঢ় করে আঁকা ভুরু, চুড়ো করে বাঁধা চুল, জ্বলজ্বলে পোশাক, এইরকম চেহারা হয় বারবণিতাদের। কিন্তু এই মেয়েগুলি সেরকম কোনও সাজপোশাক পরেনি, সারল্য মাখা সুন্দর মুখ, মনে হয় যেন কোনও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। এরা প্রত্যেকেই উৎসুক যুবকদের প্রেমিকা হতে পারত, বিমান-সেবিকা হতে পারত, শিল্পীরা এরকম মডেল পেলে ধন্য হত, এরা কবিদের প্রেরণা দিতে পারত, কিংবা সুন্দর একটা সংসার গড়তে পারত। তার বদলে এই ঠান্ডার মধ্যে স্বল্পবেশে কাঙালিপনার মতন দাঁড়িয়ে আছে কোনও একজন অচেনা মানুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার জন্য। প্রত্যেকের দৃষ্টি একেবারে স্থির, তাতে কোনও ভাষা নেই। ক্ষুধা নেই, লোভ নেই, ব্যাকুলতা নেই, এমনকি লজ্জাও অনুপস্থিত। এই দৃষ্টি কি ভোলা যায়? সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ সেই দৃশ্যটি আমার চোখে ভাসে, এখনও যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কতখানি অসহায়তার জন্য এইসব মেয়েরা পুরুষদের লোভের সামগ্রী হতে চায়? পৃথিবীর সব দেশেই বড়-বড় হোটেলের ধারে-কাছে বেশ্যাদের ঘোরাঘুরি নতুন কিছু নয়, এমনকি চিনেও দেখেছি, কিন্তু লেনিনগ্রাডের ওই দৃশ্যটি আমার খুবই করুণ লেগেছিল।

মস্কোর তুলনায় লেনিনগ্রাড শহরটি অনেক সুন্দর। আগেকার তুলনায় চেহারাটা এখন কিছুটা মলিন। এখানকার মেয়র মহোদয় খুবই জনপ্রিয়, তাঁর চেষ্টায় গত অগাস্টের ব্যর্থ বিপ্লবের সময় লাল ফৌজ এই শহরে ঢুকতেই পারেনি, কৌশলে ট্যাংকগুলিকে ভুল রাস্তায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মেয়র মহোদয় রাজনীতিতে যতটা উৎসাহী, শহরের রাস্তা সারাবার দিকে তেমন মন নেই মনে হল। বড় বড় শহরের মেয়রদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে, এই পদ থেকে তাঁরা মন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হওরার দিকে ঝোঁকেন। কিন্তু নগরপ্রধান হওয়ার জন্য কি রাজনৈতিক নেতা অপরিহার্য? বরং এমন যোগ্য ব্যক্তিকেই কি নির্বাচন করা উচিত নয়, যিনি নগর সম্পর্কে বেশি চিন্তা করবেন, নগর পরিকল্পনায় অভিজ্ঞ হবেন? কিন্তু আজকাল রাজনীতি বিনা কথা নেই, দল ছাড়া রাজনীতি হয় না, নির্দলীয় গুণী-জ্ঞানীরা থাকেন আড়ালে।

স্টেশনে কিংবা রাস্তার ফলকে এখনও লেনিনগ্রাড নাম পালটে সেন্ট পিটার্সবার্গে লেখা হয়নি, তবে এরই মধ্যে সেন্ট পিটার্সবার্গ নামে শহরের ম্যাপ ছাপা হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গী রুশী বন্ধুটি মস্কোয় সরকারি অফিসার, কিন্তু তাঁর নিজের বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ি এই শহরে, এখানেই তিনি বর্ধিত হয়েছেন। তাঁরও নাম সের্গেই, মনে রাখা সহজ। আমি জিগ্যেস করলাম, এই যে আপনার বাল্যকাল থেকে পরিচিত শহরটার নাম বদলে গেল, এটা কি আপনার পছন্দ হয়েছে?

সের্গেই বললেন, এটা একটা জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত, সবাই মেনে নিয়েছে, এ বিষয়ে আমার মতামত দেওরার তো প্রশ্ন ওঠে না!

আমি বললাম, আপনার কূটনীতি অবলম্বন করার দরকার নেই, সোজাসুজি আপনার মনের কথাটা বলুন না। আপনার পছন্দ-অপছন্দের কথা জানতে চাই।

সের্গেই কিছুক্ষণ আমতা আমতা করলেন, তারপর বলেই ফেললেন, আমার লেনিনগ্রাড নামটাই পছন্দ! বদলাবার কোনও প্রয়োজন ছিল না বোধহয়।

আমি লেনিনগ্রাড শহরের কেউ নই, আমার মতামতেরও কোনও মূল্য নেই। কিন্তু এই ডামাডোলের মধ্যে অকস্মাৎ লেনিনগ্রাড থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যাওয়াটা আমারও মতে ঠিক হয়নি। লেনিনের ভূমিকা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ চলতে পারে, কিন্তু বিশ্ব-ইতিহাসে লেনিনের নাম চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। এমন এক বিপ্লবের তিনি নায়ক, যা সত্যিই দুনিয়া কাঁপিয়েছে। যারা ঝটপট শহরের নাম বদলায়, তারা ভুলে যায় যে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়, ইতিহাসের একটা নিজস্ব গতি আছে, জোর করে ইতিহাস বদলানো যায় না, আজকের নাম বদল এক যুগ বাদে আবার অন্য নাম বদলের পালা আনতে পারে।