১.১১ মার্কসবাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী

ঐতিহাসিক টয়েনবি বলেছিলেন, মার্কসবাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবে জাতীয়তাবাদ।

আমরা ভাবতাম, এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে জাতীয়তাবাদই একদিন পরাস্ত হবে। জাতীয়তাবাদের মধ্যে সংকীর্ণত আছে, কিন্তু মার্কসবাদ বিশ্বমানবতার পথ দেখিয়েছে। আমরা কি নিছক বাঙালি বা ভারতীয় বা পাকিস্তানি বা ইংরেজ বা চিনে বা রাশিয়ান হওয়ার বদলে শুধু মানুষ হতে চাই না? আমরা শুধু একটা দেশের নাগরিক হওয়ার বদলে কি হতে চাই না সমগ্র পৃথিবীর নাগরিক? পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলির সীমানাই তো কৃত্রিম, মাত্র আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে এই সব সীমানার রেখাগুলি কতবার ভাঙচুর হয়েছে। মাতৃভূমি কিংবা পিতৃভূমি বলে যে ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়েছে, সেসব শুধু শাসকশ্রেণির প্রচার ছাড়া আর কী? দেশাত্মবোধক গানগুলিতে সমৃদ্ধ হয় অস্ত্রের কারখানা। দেশপ্রেমের নামে বহুবার লক্ষ লক্ষ মানুষ অকারণ যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। দেশের জন্য লড়াই করতে গিয়ে অকালে এই পৃথিবীটাকেই ছেড়ে চলে যাওয়ার কি কোনও যুক্তি থাকতে পারে?

বিশ্বমানবতা কিংবা বিশ্বনাগরিকত্ব, এসবই এখনও নিছক কবি-কল্পনা? অনেক সময় কবিরাও উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়।

মার্কসবাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের লড়াইটা ঠিকমতন শুরুই হল না। জাতীয়তাবাদ প্রবল প্রতাপে প্রায় সমস্ত মানুষের মস্তিষ্ক অধিকার করে আছে। মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে যেসব দেশ সমাজতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হচ্ছিল, সেখানেও জাতীয়তাবাদ নির্মূল করার কোনও চেষ্টা হয়নি। পাশাপাশি দেশগুলির মধ্যে রেষারেষি প্রকট হয়ে উঠেছে মাঝে মাঝে। চিনে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়েছে। অথচ সীমান্ত থাকারই তো কথা নয়! এই দুই অতিকায় সমাজতান্ত্রিক দেশের মধ্যে বিচ্ছেদ বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে এরা দুজনেই এদের আদর্শের প্রবল প্রতিপক্ষ আমেরিকার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াল।

একই সমাজতান্ত্রিক দেশের মধ্যেও হয়ে রয়ে গেছে জাতিভেদ। চেকোশ্লোভাকিয়ায় গিয়ে টের পেয়েছিলাম, চেক এবং শ্লোভাকদের মধ্যে রীতিমতন ঈর্ষার সম্পর্ক, শ্লোভাকরা চেকদের তুলনায় নিজেদের বঞ্চিত মনে করে।

ভারত এবং পাকিস্তানের চিরবৈরিতার উপলক্ষ যেমন কাশ্মীর, তেমনি হাঙ্গেরি আর রুমানিয়া, এই দুই পাশাপাশি দেশের মধ্যে রয়ে গেছে এক কাশ্মীর, এখানে তার নাম ট্রানসিলভানিয়া।

কাশ্মীরের জনসংখ্যার অধিকাংশই মুসলমান, কিন্তু রাজ্য ছিল হিন্দু, গোড়ার দিকে জনসাধারণের নেতা শেখ আবদুল্লা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ, তাই কাশ্মীর সংযুক্ত হল ভারতের সঙ্গে। কিন্তু ওই অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য পাকিস্তান তার দাবি ছাড়বে কেন? আর ট্রানসিলভানিয়া রুমানিয়ার অন্তর্গত হলেও এককালে ছিল হাঙ্গেরির মধ্যে, এখনও সেখানে প্রচুর হাঙ্গেরিয়ান বাস করে। এই উপলক্ষ নিয়ে বিরোধ লেগেই আছে। হাঙ্গেরিতে ‘হিস্ট্রি অব ট্রানসিলভানিয়া’ নামে বই প্রকাশিত হলে রুমানিয়া সেটা ইতিহাসের বিকৃতি বলে নিষিদ্ধ করে দেয়। আবার রুমানিয়ার সরকার একবার সে দেশে হাঙ্গেরিয়ার নাম শুনলেই অবজ্ঞায় ঠোঁট কুঁচকোয়। আর রুমানিয়ানরা মনে করে, তাদের অনেক দুর্ভাগ্যের মূলে আছে হাঙ্গেরিয়ানরা। বর্তমান দুঃসময়েও হাঙ্গেরিয়ানা আইসক্রিম খায়, রুমানিয়ানরা শুধু বরফ চোষে। বেলজিয়ামে এক আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনে আমি একদিন হাঙ্গেরিয়ান কবি জর্জ সোমলিও’র স্ত্রী আনাকে কাঁদতে দেখেছিলাম। কারণ জিগ্যেস করে জেনেছিলাম যে আমার ঠিক পাশেই এক রুমানিয়ায় কবির বসার জায়গা, কিন্তু সে একজন হাঙ্গেরিয়ানদের পাশে বসতে অস্বীকার করে উঠে চলে গিয়েছিল। কবিদের মধ্যেও এমন ভুল জাত্যাভিমান।

রুমানিয়ায় কোনওদিন গণতন্ত্রের ঠিক মতন পরীক্ষাই হয়নি। সামন্ততন্ত্র থেকেই পৌঁছে গিয়েছিল সমাজতন্ত্রে। নানা উপজাতি অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি মোটামুটি একটি দেশ হিসেবে দানা বাঁধে রোমান আমলে। রোমান সাম্রাজ্য ড্যানিউব নদীর দুই প্রান্ত ধরে এগিয়ে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। দশম শতাব্দীর থেকে বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের ভগ্নদশা শুরু হয়। রোমানিয়ার ট্রানসিলভানিয়া অঞ্চল চলে যায় হাঙ্গেরির দখলে। তারপর তুর্কিদের অটোমান সাম্রাজ্য হাঙ্গেরিকে গ্রাস করার পর ট্রানসিলভানিয়াও নিয়ে নেয়। তারপর হাতবদল হতে হতে, এই শতাব্দীর প্রথম মহাযুদ্ধে ট্রানসিলভানিয়া আবার রুমানিয়ার অন্তর্গত হয়ে যায়। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পর রুমানিয়া নিজের পায়ে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রুমানিয়ার ভূমিকা ছিল খুবই দুর্ভাগ্যজনক। প্রথমদিকে এই দেশ ছিল মিত্র বাহিনীর পক্ষে। নাতসি জার্মানি হাঙ্গেরির ওপর আধিপত্য বিস্তার করার পর রুমানিয়ার দিকে ধেয়ে আসে। ট্রানসিলভানিয়ার অনেকখানি অংশ আবার হাঙ্গেরিতে চলে যায়। এর ফলে যে জনবিক্ষোভ হয়, তাতে রাজা দ্বিতীয় ক্যারল সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, সেই সিংহাসনে বসলেন তাঁর ছেলে মাইকেল। রাজা মাইকেল সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে আপোস করতে গেলেন হিটলারের সঙ্গে। জনগণ কিন্তু সোভিয়েত বিরোধী ভূমিকা মেনে নিতে চায়নি। জার্মানির শেষ দশায় সোভিয়েত বাহিনী যখন রুমানিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে, তখন জনসাধারণের প্রবল প্রতিবাদে রুমানিয়া আবার হঠাৎ দল বদল করে। রুমানিয়ার সরকার সোভিয়েত পক্ষকে সমর্থন করে এবং যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানির বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত বাহিনীর সহায়তায় জার্মানি হাঙ্গেরিয়ান সৈন্যদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হয় রুমানিয়া। দুবার দু পক্ষে লড়াই করে তার নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচণ্ড। এইটুকু দেশের সাড়ে ছ’লাখেরও বেশি সৈন্য নিহত হয়।

যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই রুমানিয়ায় রাজতন্ত্রের অবসান হল। ত্রাতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সংবর্ধনা জানাল সাধারণ মানুষ, এবং সোভিয়েত ধাঁচের সরকারই যে এখানে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটাও স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলো মিলে গিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি নাম দিয়ে সরকার গড়ল। ১৯৬৫ সালে এই ওয়ার্কার্স পার্টি আবার নাম নিল কমিউনিস্ট পার্টি, সেই সালেই চাউসেস্কুর ক্ষমতার রঙ্গভূমিতে প্ৰথম আগমন।

প্রথমদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রুমানিয়া যথেষ্ট উন্নতি করেছিল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতি আস্তে-আস্তে চাঙ্গা হয়, বৈদেশিক ঋণ অনেক কমে যায়, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপও সমৃদ্ধ হয়। সোভিয়েত ব্লকের অন্তর্গত হয়েও রুমানিয়া তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। প্রেসিডেন্ট চাউসেস্কুর ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানবোধ সর্ব স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে। ক্রমে সেই আত্মসম্মানবোধ, রূপান্তরিত হতে লাগল আত্মম্ভরিতায়, সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রীর হাতে, স্বেচ্ছাচার থেকে এল স্বৈরাচার। হিটলারের কবল থেকে উদ্ধার পেয়ে যে দেশ এক কল্যাণমূলক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানকার রাষ্ট্রনায়ক যে ক্রমশ এক ছোটখাটো হিটলারে রূপান্তরিত হচ্ছে, সেদিকে কেউ নজর দিল না, কিংবা বাধা দিল না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যতই ত্রুটি থাক, অপদার্থ প্রধানমন্ত্রীকে তবু সরিয়ে দেওয়া যায়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সে ব্যবস্থা থাকতে পারে না? যেহেতু সংবাদপত্রের বাক স্বাধীনতা দেওয়া হয় না, কোনও বিরোধী দলের অস্তিত্ব রাখা হয় না, তাই স্বৈরাচারী শাসক ও তার ঘনিষ্ঠ দলবলের কীর্তিকাহিনী প্রকাশেরও কোনও উপায় থাকে না। স্টালিনের জীবিতকালে কেউ তার প্রতিবাদ করেনি, দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে, এমনকী হাজার হাজার সাচ্চা কমিউনিস্টকেও স্টালিন ফাঁসির মঞ্চে পাঠিয়েছিল, তা তখন জানা যায়নি।

মানুষকে হাত-পা বেঁধে কারাগারে রাখা যায়, কিন্তু তার মনটাকে কিছুতেই বন্দি করা যায় না।

বিংশ শতাব্দী শেষ হওয়ার দশ বছর আগেই সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ উত্তাল হয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিকে একসঙ্গে কাঁপিয়ে দিল। একটির পর একটি দেশ জনসাধারণের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। সৈন্যবাহিনী দিয়েও যে এই প্রতিবাদ দমন করা যাবে না, শাসকশ্রেণি তা বুঝেছিল বলে রক্তাক্ত সংগ্রাম হয়নি। চেকোশ্লোভাকিয়ায় মিছিলের মানুষ সৈন্যদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে ফুলের মালা।

একমাত্র রুমানিয়ার বৃদ্ধ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কী নিদারুণ লোভ! সেই লোভের পরিণামে বুখারেস্টের পথে পথে রক্তগঙ্গা বয়েছে। চাউসেস্কু ভেবেছিলেন তিনি। অমর হবেন, কী সব ওষুধ-বিষুধ খেয়ে নাকি তিনি জরা দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তাঁর ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়া বউ ইচ্ছেমতন ডক্টরেট নিয়েছেন, রুমানিয়ার রাজরাজেশ্বরী হয়েও তৃপ্ত হননি, চেয়েছিলেন অনন্ত পরমায়ু। বুখারেস্ট শহরের একটা বিরাট এলাকার সমস্ত ঘরবাড়ি ধ্বংস করে চাউসেস্কু বানাচ্ছিলেন এক বিশাল প্রাসাদ। তার সামনের উদ্যানে সবেমাত্র গাছ পোঁতা হয়েছিল, ফুল-ফল দেখা দেয়নি। চাউসেস্কু দম্পতি আশা করেছিলেন, আরও বহু বছর বেঁচে তারা ওই প্রাসাদ ও উদ্যান উপভোগ করে যাবেন।

বিক্ষোভ বা বিদ্রোহের আশঙ্কায় চাউসেস্কু আগে থেকেই এক নিজস্ব গুপ্ত রক্ষী বাহিনী তৈরি করে রেখেছিলেন। শুধু চাউসেস্কু দম্পতিকে আমৃত্যু রক্ষা করার জন্য এরা নাকি ছিল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এদের অবস্থান ছিল মাটির নীচে। যে-কোনও বাড়ির ভূমি ভেদ করে এরা উঠে আসতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, জাতীয় মিউজিয়ামের ফাঁপা দেওয়ালের মধ্যেও এরা লুকিয়ে ছিল। যেখান থেকে সেখান থেকে এরা হঠাৎ-হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনী জনসাধারণের দিকে চলে গেলেও এই গুপ্ত রক্ষীবাহিনী অকারণে কত যে নরহত্যা করেছে তার ঠিক নেই। বুখারেস্টে এখনও লোকের মুখে মুখে সেই বীভৎস কাহিনি শোনা যায়। সে সব কাহিনি যে অতিরঞ্জিত নয়, তার প্রমাণ রয়েছে শহরের বহু বাড়ির দেওয়ালে গুলিগোলার দাগে। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির হাজার হাজার বই পুড়েছে, জাতীয় মিউজিয়ামের অনেক অমূল্য সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে এদের তাণ্ডবে।

বুখারেস্ট শহরটি এককালে বেশ সুদৃশ্য ছিল এমন পড়েছি, কিন্তু এখন দেখার মতন বিশেষ কিছু চোখে পড়ে না। বুড়াপেস্ট-এর সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। ড্যানিয়ুব নদী এ শহর থেকে অনেক দূরে। এখানকার প্রাচীন এলাকাগুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয়রা ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য পুরোনো বাড়িগুলো সযত্নে রক্ষা করে, চাউসেস্কু সেগুলো নষ্ট করে শুধু সারি সারি ফ্ল্যাটবাড়ি তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন। অমিতা বসুর সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘুরছিলাম। যে-কোনও কথাতেই চাউসেস্কুর কোনও না কোনও অত্যাচারের প্রসঙ্গ আসে। চাউসেস্কুর প্রাসাদ, পার্টি অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রণাঙ্গন, বুলেট-বিক্ষত মিউজিয়াম, এই সব ছাড়া যেন আর কিছুই দেখার নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানি কিংবা হাঙ্গেরিতে বড় বড় গির্জাগুলি সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করা হত, কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মকে বাদ দিলেও এই সব পুরোনো গির্জাগুলি চমৎকার ভাস্কর্যের নিদর্শন। এখানে গির্জাগুলি অবহেলিত, কোনও কোনও গির্জা ভেঙেও ফেলা হয়েছে শুনেছি।

রুমানিয়ার একজন কবির সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। আয়ওয়া শহরে আমরা কিছুদিন প্রতিবেশী ছিলাম। সেই কবির নাম মারিন সোরেস্তু, তাঁর খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি কানাডা চলে গেছেন কোনও সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে। রাজনীতির লোকদের সঙ্গে আমি কথাবার্তায় সুবিধে করতে পারি না, আমার ইচ্ছে ছিল দু-একজন কবি বা লেখকের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর। অমিতা এরকম অনেককে চেনেন। বিদেশ যাত্রার পথ খুলে যাওয়ায় প্রধান কবি-সাহিত্যিকরা অনেকেই এখন বিদেশে। যে দু একজন আছেন, তাঁরা ইংরিজি জানেন না। ইয়োন হোরেয়া এখানকার একজন বিখ্যাত কবি এবং সম্পাদক। এঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও নিরাশ হতে হল, কারণ মাত্র কয়েকদিন আগে এই কবির মা মারা গেছেন, তিনি বাড়ি থেকে বেরুচ্ছেন না। তবে ইয়োন হোরেয়া’র মেয়ে ইরিনা আমাদের নেমন্তন্ন করল এক সন্ধ্যায় তার অ্যাপার্টমেন্টে।

রুমানিয়ায় নিজের বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে কোনও বিদেশিকে আমন্ত্রণ জানানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। কারুর বাড়িতে বিদেশি অতিথি এলে পুলিশি হামলা ছিল অবধারিত। ইরিনার ফ্ল্যাটে আমরাই প্রথম বিদেশি।

ইরিনার বয়েস তিরিশের কাছাকাছি, ছিপছিপে ধারালো চেহারা, বিবাহ-বিচ্ছিন্না। একটি সন্তান নিয়ে আলাদা থাকে। ইরিনা ঠিক লেখিকা নয়, অনুবাদিকা, ইংরিজি সাহিত্য পড়েছে, তার বাবার একটি সাহিত্য পত্রিকা চালাতে সে সবরকম সাহায্য করে, নিজে প্রুফ দেখে পর্যন্ত।

ঠিকানা খুঁজে আমরা এলাম একটা দশতলা বাড়িতে। ইরিনা থাকে দশমতলায় কিন্তু সে বাড়ির লিফট ন’তলা পর্যন্ত। বাড়িটি নতুন, কিন্তু লিফটটা অমন কেন, তা বোঝা গেল না। ইরিনার ফ্ল্যাটটি বেশ বড়। ভাড়া নয়, নিজস্ব। এত কম বয়েসে, শুধু অনুবাদের কাজ করে সে এরকম একটা ফ্ল্যাট কিনেছে? এদেশে লিখে কি এত টাকা পাওয়া যায়? আমাদের মনে-মনে এই প্রশ্নটা ঘুরছিল, সেটা একবার উচ্চারিত হতে ইরিনা জানাল যে সে তার প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে খোরপোষ বাবদ এক পয়সাও নেয়নি, তার নিজস্ব উপার্জনেও এরকম ফ্ল্যাট কেনা যায় না। সে তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, তাঁরা তাঁদের কন্যাকে এই ফ্ল্যাটটা উপহার দিয়েছেন।

এসব দেশে কেউ সন্ধের পর নেমন্তন্ন করলে ফুল ও ওয়াইনের বোতল নিয়ে যাওয়ার প্রথা। ইরিনা আমাদের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেছিল, তিনটি ডিম সেদ্ধ টুকরো টুকরো করা, কয়েক স্লাইস রুটি, কয়েক টুকরো স্যালামি ও কিছু স্যালাড। আমরা পাঁচজন বুভুক্ষুর মতন দ্রুত সেগুলো শেষ করে ফেললাম। কারুর বাড়ির খাদ্যতালিকা এভাবে জানানো শিষ্টাচার সম্মত নয়, তা ছাড়া আমরা গেছি আড্ডা দিতে, খাবারের ব্যাপারটা জরুরি নয়। তবু এই কথাটা মনে আসেই যে আমাদের দেশের যে-কোনও মধ্যবিত্ত বাড়িতে পাঁচজন অতিথি এলে এর চেয়ে অনেক বেশি খাবারের ব্যবস্থা থাকে। ইরিনার ফ্ল্যাটটা যেভাবে সাজানো, তাতে তার অবস্থা বেশ সচ্ছলই বলা যায়। কিন্তু এদেশে যে এখন পয়সা থাকলেও কিছু পাওয়া যায় না। এইগুলি সংগ্রহ করতেই নিশ্চয়ই ইরিনাকে অনেক কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।

ইরিনা বেশ তেজি ধরনের মেয়ে। যে-কোনও প্রশ্নের উত্তরে কোনও দ্বিধা না করে স্পষ্ট কথা বলে। আমরা অমিতার মুখে এখনকার দ্বিতীয় বিপ্লব ও চাউসেস্কুর পতনের কাহিনি শুনেছি। এবার সেই কাহিনিই শুনতে চাইলাম ইরিনার মুখে। দুটো ভাষ্য মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। অমিতা ও ইরিনার মধ্যে কিছু কিছু মতভেদ আছে, চাউসেস্কুর আমলের প্রতি অমিতার রয়েছে ভীতি ও ঘৃণার ভাব, ইরিনার রয়েছে অবিমিশ্র ক্রোধ। এমনকি বর্তমান রুমানিয়ার শাসকদেরও ইরিনা পছন্দ করে না, তার ধারণা এদের মধ্যেও রয়ে গেছে চাউসেস্কুর কিছু কিছু গুপ্ত সমর্থক।

আমি জিগ্যেস করলাম, চাউসেস্কুকে এরকম বাড়তে দেওয়া হল কেন? একটা সমাজতান্ত্রিক দেশের কর্ণধার কী করে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে? তাকে সংযত করার কোনও ক্ষমতা কি পার্টির ছিল না। কিংবা পার্টি তাকে সরিয়ে দিতে পারেনি?

ইরিনা বলল, না। কেউ সাহস করেনি। তার জন্য আমিও দায়ী। এককালে আমিও ছিলাম কমিউনিস্ট পার্টির কট্টর সদস্য।

ভাস্কর জিগ্যেস করল, তুমি গোড়া থেকে বলো। তুমি কবে পার্টি মেম্বার হলে?

ইরিনা বলল, তখন আমি সদ্য ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছি। আমার বাবা বহুদিনের। কমিউনিস্ট। সাচ্চা কমিউনিস্ট, এই আদর্শে বিশ্বাস করতেন, কোনওদিন পার্টির পোস্ট নিতে চাননি। আমার বয়ফ্রেন্ড যে পরে আমার স্বামী হয় সেও পার্টির সক্রিয় সদস্য। পৃথিবীতে যে দুজনকে আমি সবচেয়ে ভালোবাসি, তারা যে আদর্শে বিশ্বাস করে, আমি সেই আদর্শকে মহৎ মনে করব না? তাই আমিও পার্টির সদস্য হতে চাইলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি অবশ্য আমাকে যাচাই করে নিয়েছিল। বারবার প্রশ্ন করেছিল, কেন আমি সদস্য হতে চাই।

বাদল জিগ্যেস করল, কেন, যে কেউ বুঝি ইচ্ছে করলেই পার্টির মেম্বার হতে পারত না?

ইরিনা বলল, না। খুব বেছে-বেছে মেম্বার করা হত। পরে আমি তার কারণটা বুঝতে পেরেছি। তখন আমাদের দেশের যা অবস্থা, তাতে পার্টির মেম্বার হওয়া মানেই বিশেষ কতকগুলো সুবিধেভোগী হওয়া, সবাইকে তারা সেই সুযোগ দেবে কেন?

অসীম জিগ্যেস করল, এটা তুমি কবে জানলে?

ইরিনা বলল, প্রায় প্রথমদিকেই। আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম, ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য আমাকে কাজে লাগানো হত। আমি সেটা খুশি মনেই করতাম। একদিন একটা ধাক্কা খেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টি মেম্বারদের নিয়ে একদিন একটা গোপন মিটিং হল, একজন অধ্যাপক আমাদের নীতি বোঝাতে এলেন। সেই অধ্যাপকটির ভাষা কী খারাপ! সে অন্যান্য কয়েকজন অধ্যাপকের নামে কুৎসিত গালমন্দ করে বলল, ওরা প্রতিক্রিয়াশীল, ওদের চিনে রাখতে হবে। কিন্তু সেইসব অধ্যাপকদের আমি চিনি, তাঁরা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, মন দিয়ে পড়ান, কোনও সাত-পাঁচে থাকেন না। বরং আমাদের নেতা এই অধ্যাপকটিই ফাঁকিবাজ এবং অযোগ্য বাড়িতে আমি বাবার সামনে এসে কেঁদে ফেলেছিলাম। কেন একজন কমিউনিস্ট খারাপ গালাগালি দেবে? নিজে অযোগ্য হয়েও কেন অন্য অধ্যাপকদের নিন্দে করবে। এইরকম লোক নেতা হয় কী করে?

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, পার্টির মধ্যে এরকম দু-একজন লোক তো ঢুকে পড়তেই পারে। প্রথমেই অত ভেঙে পড়িস না! এই আদর্শের জন্য কত মেম্বার কত আত্মত্যাগ করেছে, সেটাও দেখতে পাবি!

কিন্তু আমি আরও ধাক্কা খেতে লাগলাম। আমার ধারণা ছিল, যারা এই পার্টির মেম্বার হয়, তারা একটা আদর্শকে নিজের জীবনেও প্রমাণ করে, তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির লোভ থাকে না, তারা দেশের মানুষের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সে রকম মানুষ অনেক ছিল, যখন পার্টি ছিল সংগ্রামের মধ্যে, যখন পার্টি ছিল বামপন্থী অর্থাৎ সরকার বিরোধী পক্ষ। কিন্তু পাটি যখন একচ্ছত্র ক্ষমতায় এল, তারপর থেকে অবস্থা হল, যেন পার্টির মেম্বার হওয়া মানেই যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া। ঘুষ, কালোবাজারি, ইচ্ছেমতন যাকে তাকে শাস্তি দেওয়া, এসব কিছুই বাদ যায়নি। বিয়ের আগেই আমি প্রেগন্যান্ট হই। আমার বয়ফ্রেন্ডের তখন আমার ওপর টান চলে গেছে। আমি তাকে জোর করে বিয়ে করতে চাইনি। কিন্তু আমার সন্তানকেও নষ্ট করতে চাইনি। আমি তাকে কাতরভাবে অনুরোধ করলাম, কিন্তু সে ছিল একটা সত্যিকারের রাস্কেল, কিছুদিন পরই বিয়ে ভেঙে গেল। এবং আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমার ছেলেকে কেড়ে নিতে চাইল। আমি তখন লড়ে গেছি। একা ছুটোছুটি করেছি ডাক্তারের কাছে, কোর্টে কেস করেছি। কিন্তু ডাক্তার থেকে বিচারক পর্যন্ত আমার কাছে ঘুষ চেয়েছে। এক এক সময় আমার নার্ভাস ব্রেকডাউনের মতন হত।

আমি জিগ্যেস করলাম, ডাক্তার, বিচারক, এঁরা ঘুষ চাইলে এঁদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করা যেত না।

ইরিনা বলল, এরা সবাই ছিল পার্টির বড় বড় পোস্টে। এদের গায়ে হাত ছোঁয়াবার কোনও উপায় ছিল না। বুঝতে পারছ না, এরাও ছিল ছোট ছোট চাউসেস্কু! সেইজন্যই বড় চাউসেস্কুকে এরা সরাতে চায়নি। আমি নিজে তখন পার্টির মেম্বারশিপ ছেড়ে দেওয়ার কথা অনেকবার ভেবেছি। কিন্তু পারিনি। মেম্বারশিপ পাওয়া যেমন শক্ত, ছেড়ে দেওয়াও তেমন শক্ত। ছেড়ে দিলেই পার্টি পেছনে লাগত। আমি তবু অন্য দেশে পালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু ভেবেছিলাম, আমি চলে গেলে ওরা আমার বাবার ওপর অত্যাচার করবে। আমার যাবা যে খাঁটি মানুষ! পরে, এই বিপ্লবের পরে, যাবা বলেছেন যে সেই সময়ে দুঃখে-অভিমানে বাবাও পার্টি ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিলেন, কিন্তু তিনি ভয় পেয়েছিলেন আমার কথা ভেবে। তিনি ছেড়ে দিলে ওরা যদি আমার ওপর প্রতিশোধ নেয়!

অনেকক্ষণ ধরে চলতে লাগল এইসব কথা। ইরিনা চোখের জল মুছতে লাগল বারবার। একসময় ধরা গলায় সে আবার বলল, আপদগুলো বিদায় হয়েছে। আমাদের দেশটা কবে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াবে জানি না। কিন্তু এত কিছু সত্বেও আমি কমিউনিজমের ওপর বিশ্বাস হারাইনি। এইসব লোকগুলো তাকে নষ্ট করেছে, দেশটাকে এত খারাপ অবস্থান নিয়ে গেছে, তবু আদর্শ হিসেবে একে বাদ দেওয়া যায় না।

আমি বললাম, আদর্শ হিসেবে সাম্যবাদ অবশ্যই অনেক উঁচুতে।

ইরিনা বলল, ইচ্ছে করলে আমি এখন দেশের বাইরে চলে যেতে পারি। আমি ইংরিজি জানি, জার্মান জানি, জার্মানিতে আমার কিছু বন্ধুবান্ধব আছে, সেখানে গেলে আমার কাজ পাওয়ার কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু আমি যাব না, কিছুতেই যাব না। অনেকে চলে যাচ্ছে, আমি যাব না। সাম্যবাদের সঙ্গে মানুষের স্বাধীনতার কি কোনও বিরোধ আছে? কেন এতগুলো বছর ধরে দেশের মানুষকে ভয় দেখিয়ে, ঠকিয়ে, মিথ্যে

কথা বলে সাম্যবাদ প্রচার করা হয়েছিল? মিথ্যে কথা আমি দু চক্ষে সহ্য করতে পারি না। আমি চাই সত্য এবং ন্যায়, সমস্ত মানুষের চিন্তা ও জীবনযাত্রার স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সাম্যবাদ, সব একসঙ্গে।