১.০৮ হাঙ্গেরি থেকে রুমানিয়া যাত্রা

হাঙ্গেরি থেকে আমরা রুমানিয়া যাত্রা করলাম ট্রেনে। এই সেই বিখ্যাত ট্রেন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস, বহু গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে, সিনেমা তৈরি হয়েছে এই ট্রেন নিয়ে। নাম ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস হলেও এই ট্রেন অবশ্য প্রাচ্যের মধ্য দিয়ে যায় না, লন্ডন থেকে যাত্রা করে ইউরোপের অনেকগুলি দেশ পেরিয়ে ইস্তামবুলে এসে প্রাচ্যের এক প্রান্ত ছোঁয় শুধু। ইস্তামবুল শহরটিরও অর্ধেক ইউরোপে।

আমরা চারজন টিকিট কেটেছিলাম সেকেন্ড ক্লাসের। আন্তর্জাতিক যাত্রা হিসেবে ভাড়া খুবই সস্তা। আর একটু আরামদায়ক ক্লাসের টিকিট কাটার সাধ্য থাকলেও আমাদের স্বভাবই তো সস্তা খোঁজা। রাত ন’টা থেকে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত থাকতে হবে ট্রেনে। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস-এর সেই গৌরবের দিন আর নেই, তা ছাড়া গল্প-উপন্যাসগুলি উঁচু ক্লাসেই ঘটে, আমরা যে বগিতে উঠলাম সেটাতে রীতিমতন ভিড়। সাধারণ ট্রেনের সঙ্গে কোনও তফাত নেই। এই ট্রেনটি যখন যে-দেশের মধ্য দিয়ে চলে, তখন সে দেশের ব্যবস্থাপনা, হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ার বর্তমান অবস্থার জন্য এই ট্রেনেও নানারকম বিশৃঙ্খলা। যে কুপেতে আমাদের স্থান হল, সেটি থ্রি-টিয়ার, অর্থাৎ ছ’জন লোকের শোওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু ছ’জন মানুষ শুয়ে পড়লে সেখানে মালপত্র রাখার আর কোনও জায়গা থাকে না, তা ছাড়া একেবারে ওপরের বাংক বেশ ছোট। লম্বা মানুষের অনুপযুক্ত। আমাদের দেশের ট্রেনের তুলনায় বেশ খারাপ। আরও দুজন লোক এসে পড়লে আমাদের চারখানা সুটকেস। কোথায় রাখা হবে, এই চিন্তায় আমরা যখন বিচলিত তখন ভাস্কর একটা উপায় যার করে ফেলল। প্রথমে সে কন্ডাক্টরি গার্ডকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে এইটুকু একটা কুপেতে দুজন মানুষ থাকবে কী করে? কন্ডাকটর গার্ডটি বলল, এখানে তো ছ’জনেরই রিজার্ভেশান, অন্য ছ’জন এলে জায়গা দিতেই হবে। ভাস্কর বলল, অন্য কুপেতে যদি একটা-দুটো সিট খালি থাকে, সেখানে তাদের চালান করে দেওয়া যায় না? আমরা চারজন এক সঙ্গে আছি…। কন্ডাকটর গার্ডটি মানতে চায় না। তখন ভাস্কর একটা একশো ফোরিন্টের নোট এগিয়ে দিল তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতন কাজ হল। কন্ডাকটর গার্ডিটি অল্প বয়েসি যুবক, অত্যন্ত সুদর্শন, শুট-টাই পরা নিখুঁত পোশাক, চিত্র তারকা হলে তাকে বেশ মানাত, মাত্র একশো ফোরিন্ট পেয়ে (আমাদের হিসেবে তিরিশ টাকার কাছাকাছি) তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে জানাল যে আমাদের কোনও চিন্তা নেই, আমাদের কুপেতে আর কেউ ঢুকবে না, সে আমাদের যে-কোনও সাহায্য করতে প্রস্তুত। সে নিজে ধরাধরি করে আমাদের ভারী ভারী সুটকেস তুলে দিল ওপরের বাংকে।

সুষ্ঠুভাবে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার পর ভাস্করের হঠাৎ ঈষৎ গর্বিত মুখের দিকে চেয়ে অসীম ভর্ৎসনার সুরে বলল, ভাস্কর, তুমি কোন সাহসে লোকটিকে ঘুষ দিতে গেলে? আমি তো ইউরোপে কোনও লোককে এইভাবে ঘুষ দেওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারি না।

ভাস্কর বলল, মানুষের চরিত্র স্টাডি করতে হয়। সে ক্ষমতা তোমার নেই। এ ছেলেটার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলেই আমি ধরে ফেলছি এর লোভ আছে। দেখলে না, টাকাটা কী রকম খপ করে নিয়ে নিল।

আমিও এই প্রথম এত সাবলীলভাবে ঘুষের ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করলাম। এমন সুসজ্জিত, সুদর্শন যুবকটি যে এই সামান্য টাকার জন্য ব্যগ্র হবে, এ যেন কল্পনাই করা যায় না। ভাস্কর যখন প্রথম নোটটা বাড়িয়ে দিল, তখন আমার বেশ ভয়ই করছিল, যদি সে উলটে আমাদের অপমান করে।

চোখের সামনে না দেখলেও এইসব দেশে যে কী রকম ঘুষের রাজত্ব চলে, তা অনেকের মুখেই শুনেছি ও নানা লেখায় পড়েছি। ঘুষ ছাড়া অনেক জায়গায় কোনও কাজই হয় না। অনেকের ধারণা ভারতের মতন গরিব দেশগুলিতেই বুঝি ঘুষ-প্রবণতা রয়েছে, আসলে কিন্তু নানা ছদ্মবেশে ঘুষ-ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। এসব দেশে কী রকম বাধ্যতামূলকভাবে ঘুষ দিতে হয়, তার একটা উদাহরণ শুনেছি। ধরা যাক, এক বাড়িতে জলের কল খারাপ হয়ে গেল। খাবার জলও আসছে না। শহরের কোনও দাবিই ব্যক্তিগত মালিকানার নয়, সবই সরকারি কোয়ার্টার, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বের জন্যও সরকারি বিভাগ আছে। বিপন্ন ব্যক্তিটি জলের কল সারাবার বিভাগে খবর দিল। খবর দিলেই যে সঙ্গে সঙ্গে মিস্তিরি ছুটে আসবে তা তো নয়। কাকুতি-মিনতি করে একজন মিস্তিরিকে ডেকে আনতে হবে। মিস্তিরি দেখে শুনে বলল, একটা ওয়াশার না পালটালে কল ঠিক হবে না, জল আসবে না। নীতিগতভাবে, সরকারি বিভাগ থেকে বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে ওয়াশার পাওয়ার কথা। কিন্তু নীতি আর বাস্তব ব্যবস্থার মধ্যে অনেক তফাত ঘটে যায়। মিস্তিরিটি বলল, ওয়াশার তো এখন স্টকে নেই! কবে আসবে বলা যাচ্ছে না, এক সপ্তাহও হতে পারে, তিন মাসও হতে পারে! এখন উপায়? নাগরিকজীবনে কলের জল ছাড়া কি একদিনও চলে? তখন মিস্তিরিটি বলবে, দশ রুবল পেলে সে কোনওক্রমে একটা ওয়াশার জোগাড় করে দিতে পারে।

আমাদের দেশে বেচারা কলের মিস্তিরিরা এক পয়সাও ঘুষ পায় না, একজনের বদলে অন্য মিস্তিরি ডেকে আনা যায়, বাজারের অনেক দোকানেই ওয়াশার কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশেও কোনও বাড়িতে বা কোয়ার্টারে নতুন জলের কলের কানেকশান পেতে হলে প্রচুর হাঁটাহাঁটি ও পুরসভার কোনও কর্মীকে ঘুষ দেওয়াটা আশ্চর্য কিছু নয়। মানুষ নীতি নির্ধারণ করে, আবার মানুষই তা ভাঙে।

চিনে গিয়ে শুনেছি, সেখানে ঘুষ দেওয়া নেওয়া সাংঘাতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য হলেও কোনও সরকারি কর্মচারী ও পার্টির উঁচু দিকের সদস্যদের সঙ্গে চেনাশুনো থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারুর কোনও জরুরি প্রয়োজন হলেই অমনি চতুর্দিকে খুঁজতে শুরু করে, কেউ চেনা আছে? ভালো চাকরি থেকে বিদেশযাত্রার অনুমতি পর্যন্ত অনেক কিছুই নির্ভর করে, ওপর মহলে কার কতটা চেনা আছে তার ওপর।

ধনতান্ত্রিক দেশের লোকজন আমাদের দেশে এলে রাস্তার ট্রাফিক পুলিশ হাসপাতালের চতুর্থশ্রেণির কর্মচারীদেরও প্রকাশ্যে ঘুষ নিতে দেখে নাক সিটকোয়। অধিকাংশ বিদেশিদের রচনায় এর উল্লেখ থাকে। ওদের দেশে রাস্তার পুলিশ ঘুষ নেয় না, কোনও সামাজিক সরকারি অফিসের কর্মচারী ঘুষের জন্য হাত পাতে না তা ঠিক, এসব সামাজিকভাবে নিন্দনীয়। ওসব দেশের রীতি হচ্ছে, চোখের সামনে ভদ্র সেজে থাকো, আড়ালে যত খুশি কুকীর্তি করে যেতে পারো। সামান্য দু-দশ টাকা ঘুষের বদলে ওসব শ যে লক্ষ-কোটি টাকার ঘুষের কারবার অনবরত চলে, তা কে না জানে! তবু ভণ্ডামি করে আমাদের দেশের এইসব ছোটখাটো ঘুষের ব্যাপার দেখে তারা আঁতকে ওঠে যেন ঘুষ কথাটার মানেই আগে জানত না।

সস্তায় এদিককার দেশগুলি ঘোরার জন্য ‘ইস্টার্ন ইউরোপ অন আ শু স্ট্রিং’ নামে একটি গাইড বই আছে। তার লেখক এই দেশগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল, কোথাও নিন্দে করেননি। ভালো জিনিসপত্রের কথাই লিখেছেন, মন্দ দিকের কথা বাদ দিয়ে গেছেন। তবে তিনি কোথায় কীভাবে ঘুষ দিতে হবে, না দিলে কাজ পাওয়া যাবে না, তারও বেশ প্রয়োজনীয় বিবরণ দিয়েছেন। খুব বেশি টাকার ঘুষ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না বলে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন পকেটে অনেকগুলো এক ডলারের নোট এবং আমেরিকান সিগারেট রাখবার জন্য। আমেরিকান সিগারেটের খুব চাহিদা এই সব দেশে। তিনি লিখেছেন, কোনও কোনও জায়গায় কুড়ি ডলার দেওয়ার চেয়েও এক প্যাকেট কেন্ট সিগারেট দিলে বেশি কাজ হয়।

ভাস্কর সিগারেট খায় না, কিন্তু অনেকগুলি প্যাকেট কেন্ট সিগারেট নিয়ে এসেছে।

আমরা রুমানিয়ায় যাব শুনে জার্মানিতে অনেকেই চোখ কপালে তুলে বলেছিল, সেখানে কেন যাবে? রুমানিয়াতে গিয়ে কিছু খেতে পাবে না।

আমরা হেসে উত্তর দিয়েছি, আমরা গরিব ভারতের মানুষ, আমাদের আবার না খেতে পাওয়ার ভয় কী!

শুধু চাওসেস্কুর অপসারণের পরেই নয়, বছর চারেক ধরেই সারা ইউরোপে শোনা গেছে যে রুমানিয়ায় দারুণ খাদ্যাভাব। পোলান্ডে যখন দারুণ অনটন চলছে, তখনও অনেকে বলেছে যে এর তুলনায় রুমানিয়ার অবস্থা অনেক খারাপ। তবু কেউ কিছু ব্যবস্থা নেয়নি কেন? ওয়ারশ প্যাক্টের অন্তর্বর্তী হলেও এখানকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি কিন্তু পরস্পরকে অনেক ব্যাপারেই সাহায্য করেনি। এর মধ্যে হাঙ্গেরি ও রুমানিয়া। এই পাশাপাশি দুটি দেশের মধ্যে চরম বিরোধ। হাঙ্গেরিতে আমরা রুমানিয়ার প্রসঙ্গ তুললেই সবাই গম্ভীর হয়ে গেছে। আমাদের বন্ধু জর্জ সোমলিও-কে জিগ্যেস করেছিলাম, তুমি এর মধ্যে রুমানিয়া বেড়াতে যাওনি? জর্জ প্রায় খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল, রুমানিয়া বেড়াতে যাব কোন দুঃখে? ওটা আবার একটা দেশ নাকি?

অসীম বুদ্ধি করে কিছু রুটি-মাখন-সসেজ নিয়ে এসেছে সঙ্গে। অতি সুদৃশ্য ডাইনিং কার ঘুরে এসে ভাস্কর জানাল সেখানে কোনও খাবার নেই।

রাত আড়াইটের সময় ট্রেন এসে দাঁড়াল হাঙ্গেরি-রুমানিয়া সীমান্তে। তারপর শুরু হল ইমিগ্রেশন-কাস্টমসের অত্যাচার।

সারা পৃথিবীতেই এখন ভিসা ব্যবস্থা বিচিত্র ও উদ্ভট। কোন দেশে কার কী ধরনের ভিসা লাগবে, তার কোনও নির্দিষ্ট মান নেই। হাঙ্গেরিতে ভিসা পাওয়ার জন্য বাদল ও আমাকে হোটেল বুক করে বাজে পয়সা খরচ করতে হয়েছিল, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড থেকে আসা অসীম ও ভাস্করের ভিসাই লাগেনি। ঠিক পাশের দেশটিতেই উলটো ব্যবহার। ভারতীয় হিসেবে বাদল ও আমার ভিসার প্রয়োজন নেই, কিন্তু অসীম ও ভাস্করের লাগবে, তাও আবার অসীমের তুলনায় ভাস্করের ভিসা ফি অনেক বেশি। তিনজন ব্যক্তি আমাদের কিউবিকলে এসে পাশপোর্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল, তাদের মধ্যে একজন ফরাসি ফ্রাংক ও ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্যবান হিসেব করতে হিমসিম খেয়ে গেল, অন্য দুজন আবদার ধরল, আমাদের সুটকেস খুলে দেখবে। রাত্রির তৃতীয় প্রহরে, ঘুম চোখে এসব অত্যাচারের মতনই মনে হয়। সুটকেস খুলতে বাধ্য করে, তারা হাত দিয়ে অন্যমনস্কভাবে জামা-কাপড় উলটে দেয়, আসলে তারা কিছুই দেখে না, সত্যিকারের গোপনীয় কোনও বস্তু থাকলে ওভাবে তা কিছুতেই বোঝা যাবে না, তবু নিছক লণ্ডভণ্ড করাতেই যেন তাদের আনন্দ।

কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের লোকজনদের ওপর যে কোনও চোটপাট করা যায় না, এ বিবেচনা হারিয়ে ফেলে ভাস্কর রীতিমতন তর্জন-গর্জন শুরু করে দিল। আমি আর বাদল ভাস্করকে থামাবার চেষ্টা করেও পারি না, তাকে টেনে নিয়ে গেলাম একপাশে। লোকগুলো ইংরিজি প্রায় বোঝেই না, তাই যা রক্ষে।

প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে লোকগুলি বিদায় নিলে অসীম বলল, ভাস্কর, তুমি কী করছিলে? বিপদে ফেলে দিচ্ছিলে সবাইকে।

ভাস্কর বলল, তা বলে কি অসভ্যতা সহ্য করতে হবে রাত আড়াইটের সময়? বিপদ, বিপদ আবার কী?

অসীম বলল, যদি আমাদের জেলে পুরে দিত? একটা কিছু ফলস চার্জ দিয়ে দিলেই তো হল!

ভাস্কর বলল, জেলে দেবে, মামাবাড়ির আবদার? আমরা কি চুরি-জোচ্চুরি করেছি? আমাদের এমব্যাসিতে ফোন করতাম!

বাদল বলল। জেলে না দিলেও এই শীতের যাতে আমাদের ট্রেন থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসিয়ে রাখতে তো পারত! সে ক্ষমতা এদের আছে। তখন কী হত?

ভাস্কর এবার ঠিক কোনও উত্তর খুঁজে না পেয়ে টপ করে শুয়ে পড়ে পাশ ফিরে নাক ডাকাতে লাগল।

পৃথিবীর অনেক দেশেই ঢোকার সময় লক্ষ করেছি, আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করার আগেই, আমাদের চেহারা দেখে ভারতীয় (ভারত উপমহাদেশীয়) বলে চিনতে পারলেই ইমিগ্রেশানের লোকদের ব্যবহার বদলে যায়। ভারতীয়রা আজ আর পৃথিবীর কোথাও স্বাগত নয়। সকলেরই ধারণা, এ দেশটা অত্যন্ত জনবহুল আর দরিদ্র, এ দেশে ছেলেমেয়েরা চাকরি কিংবা জীবিকার লোভে সব সময় অন্য দেশে থেকে যাওয়ার সুযোগ খোঁজে। একবার আমি আফ্রিকার কিনিয়ায় গিয়েছিলাম। আগে সেখানে ভারতীয়দের জন্য ভিসা লাগত না, আমি যাওয়ার আগের দিন থেকে ভিসা প্রবর্তিত হয়েছে, তা জানতে পেরে আমি লন্ডন থেকে কষ্ট করে ভিসা সংগ্রহ করেছিলাম। ইমিগ্রেশনের কাউন্টারে একজন কুচকুচে কালো রঙের মানুষ লাইনের সামনের দিকের শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিল ও চটপট স্ট্যাম্প মেরে ছেড়ে দিচ্ছিল। আমাকে দেখামাত্র লোকটি গম্ভীর হয়ে গেল। আমার কাগজপত্র সব ঠিকঠাক, তবু সে জিগ্যেস করল, তুমি কেন এসেছ? কতদিন থাকবে? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলাম, আমরা যতই বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে রাগারাগি করি, আসলে কালো লোকরাই কালো লোকদের দেখতে পারে না।

হাঙ্গেরিতে ঢোকার মুখে আমার ও বাদলের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। উপযুক্ত ভিসা সঙ্গে আছে, ইমিগ্রেশান কাউন্টার থেকে ছেড়েও অফিসার দূর থেকে ডেকে আমাদের থামাল এবং পাশপোর্ট দেখতে চাইল। কাস্টমস অফিসারের পক্ষে মালপত্রের আকার-প্রকার লক্ষ করাই স্বাভাবিক, কিন্তু সে আমাদের পাসপোর্ট দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে গেল এবং আমাদের অতি নিরীহ চেহারার সুটকেস দুটি খুলতে বলল, কী দেখল সে আমাদের পাসপোর্টে? বিরক্তি চেপে তাকে আমাদের সুটকেস দুটি ঘাঁটাঘাঁটি করার সুযোগ দিলাম। যথারীতি মিনিট দু-এক বাদে লোকটি বলল, ঠিক আছে, যেতে পারো।

বাক্স গুছোবার পর আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, একটা প্রশ্ন করতে পারি? এই যে দেখছি গ্রিন চ্যানেল দিয়ে অন্য অনেক লোক সোজা বেরিয়ে যাচ্ছে, তুমি শুধু আমাদের থামালে কেন? আমাদের মুখ দেখে?

লোকটি থতমত খেয়ে বলল, না, সে সব নয়। পাঁচজন-দশজন পরপর এক এক জনকে থামাই!

এ কথাটি মোটেই সত্যি নয়। আমরা চোখের সামনে কুড়ি-পঁচিশ জনকে পার হতে দেখেছি। সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে। তা ছাড়া, দশজন অন্তর একজনকে চেক করার ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দু’জনকে ধরা হল কেন? সমগ্র প্লেন-যাত্রীদের মধ্যে আমরা দু’জনেই মাত্র অশ্বেতকায়। হাঙ্গেরিতে বর্ণবিদ্বেষের কথা কখনও শোনা যায়নি, তবু আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অবশ্য এ কথাও ঠিক, ওই একটি ঘটনা ছাড়া। হাঙ্গেরিতে আমরা যে-কটা দিন কাটিয়েছি, সকলের কাছ থেকেই ভালো ব্যবহার পেয়েছি। এমনও হতে পারে, কাস্টমস অফিসারটি প্রথমে আমাদের জিপসি ভেবেছিল, পরে পাসপোর্ট দেখে বুঝেছিল, আমরা জিপসিদের পূর্বপুরুষের দেশের। হাঙ্গেরিতে অনেকেই জিপসিদের পছন্দ করে না। এখানকার জিপসিদের প্রতি সরকারের বিরূপ মনোভাব এবং পুলিশি অত্যাচারের কিছু কিছু বিবরণ পত্র-পত্রিকায় পড়েছি।

লন্ডনের বিমানবন্দরে ভারতীয়দের বহু হয়রানির কাহিনি শোনা যায়। আমার কখনও সেরকম অভিজ্ঞতা হয়নি, বরং এ কথা বলতে পারি যে ইংরেজেরা এখানে রুল অফ ল মানে। ইমিগ্রেশান থেকে আপত্তি জানালেও তার ওপর আপিলের ব্যবস্থা আছে। মনে যদি অপরাধবোধ না থাকে, তা হলে ইমিগ্রেশান কর্মচারীর সঙ্গে তর্ক করা যায়। চার বছর আগেও ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য ভারতীয়দের কোনও ভিসার ব্যবস্থা ছিল না। সেইরকমই একটা সময়ে আমি মস্কো থেকে ফেরার পথে লন্ডন গিয়েছিলাম। ভিসা ছিল না, কিন্তু ইমিগ্রেশান কাউন্টারে নানারকম প্রশ্নপর্ব চলত। আমাকে কর্মচারীটি জিগ্যেস করল, তুমি লন্ডনে আসতে চাও কেন? আমি হালকাভাবে উত্তর দিলাম, রাশিয়ায় একটা সরকারি নেমন্তন্ন ছিল, ফেরার পথে লন্ডনে বন্ধুদের সঙ্গে কয়েকদিন আড্ডা দিয়ে যেতে চাই। সে জিগ্যেস করল, থাকবে কোথায়? পয়সা পাবে কোথায়? আমি উত্তর দিলাম, এক বন্ধুর বাড়িতে থাকব, বিশেষ পয়সা লাগবে না। লোকটি অবিশ্বাসের চোখে কয়েক পলক চেয়ে রইল। ইংরেজ জাতি আড়ার মর্ম বোঝে না, আমাদের কাছে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আডড়ার চেয়ে মনোরম আর কী হতে পারে? কর্মচারীটি একবার জিগ্যেস করল, সোভিয়েত সরকার যে তোমায় নেমন্তন্ন করেছিল, তার প্রমাণ কোথায়? তুমি যে মস্কো থেকে আসছ তা বুঝব কী করে? তোমার পাসপোর্টে তো সোভিয়েত ভিসা নেই এর আমার একটু মজা করার ইচ্ছে হল। আমার কোনও ঝুঁকি নেই, জরুরি কোনও কাজেও আসিনি, ঢুকতে যদি না দেয়, পরের প্লেনে চেপে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাব। লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, তুমি এই কাউন্টারে বসে কাজ করছ, অথচ তুমি এটা জানো না যে সোভিয়েত ভিসার ছাপ কখনও থাকে না পাসপোর্টে? আলাদা কাগজে ভিসা থাকে, আসার সময় সেটা নিয়ে নেয়! এই কথাটা শোনামাত্র রাগ করার বদলে অত্যন্ত বিনীতভাবে সেই কর্মচারীটি বলল, ঠিক! ঠিক! আপনার লন্ডন-বাস সুখকর হোক! ব্রিটিশ চরিত্রের এই দিকটি আমার ভালো লাগে।

সকালবেলা চলন্ত জানালা দিয়ে দেখা গেল রুমানিয়ার দৃশ্য। ছোট ছোট পাহাড় ও নিবিড় জঙ্গল। শীত শুরু হয়েছে, কিন্তু সব গাছের পাতা ঝরেনি। এদিককার গাছের পাতা ঝরে যাওয়ার আগে নানারকম রং বদলায়। এই অরণ্য যেন টেকনিকালার।

ব্রেকফাস্ট খাবার জন্য আমরা গেলাম ডাইনিং কামরায়। প্রচুর চেয়ার টেবিল, প্রায় সবই ফাঁকা। ফাঁকা থাকার কারণটাও অবিলম্বে জানা যায়, কোনও খাবার নেই। এত বড় একটা খাবারের জায়গা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে, অথচ কোনও খাবার নেই। অনেক দূরের একটা টেবিলে একজন লোক বসে কিছু খাচ্ছে। ভাস্কর সেই দিকে আঙুল তুলে দেখাতেই পরিচারক বলল, ওইটুকুই শেষ খাবার ছিল, তারপর ফুরিয়ে গেছে।

ভাস্কর ছাড়ার পাত্র নয়। পকেট থেকে বার করল কেন্ট সিগারেটের একটা প্যাকেট। তারপরেই চলে এল চার প্লেট ওমলেট। এর সঙ্গে টোস্টের দুরাশা করে কোনও লাভ নেই, কারণ রুটি সত্যি নেই। ওমলেটে ছড়াবার জন্য গোলমরিচও পাওয়া যাবে না। চা কফির জন্য দুধ নেই। শুধু নুন দেওয়া ডিম ভাজা ও কালো চা, তাই খেতে খেতে মনে পড়ল গ্রাহাম গ্রিন ও আগাথা ক্রিস্টি এই ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে খাওয়া দাওয়ার কত না বর্ণনা লিখেছেন!

বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে আরও মনে হল, এই সুন্দর দেশটিতে খাদ্যাভাব সৃষ্টি করেছে কিছু মানুষ। রুমানিয়া কখনও খুব গরিব দেশ ছিল না, এখন সারা ইউরোপের করুণার পাত্র।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেট করে ট্রেন ঢুকল বুখারেস্ট শহরে।