১.০৩ অবিভক্ত বার্লিন শহরের প্রতীক

এককালে অবিভক্ত বার্লিন শহরের প্রতীক ছিল বিশাল, জমকালো ব্রান্ডেনবুগ গেট। এখানেই উন্টার ডেন লিনডেন একটি ভুবনবিখ্যাত সুদৃশ্য রাস্তা। অদূরেই য়াইখস্ট্যাগ প্রাসাদ, যা এক সময়ে ছিল জার্মানির পার্লামেন্ট, দলবল নিয়ে এর মধ্যে আগুন লাগিয়ে দেবার ছুতোয় বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করে হিটলার একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়। পটসডামের প্লাস ছিল একটি ব্যস্ত চৌরাস্তা, সেখানেই মাটির নীচে তৈরি হয় গুপ্ত বুংকার। এই অঞ্চল থেকেই হিটলার বিশ্বব্যাপী মারণযজ্ঞ চালিয়েছিল। মিত্র বাহিনীর ট্যাংকগুলি যখন গোলাগুলি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে রাস্তায় এসে পড়েছিল, তখন মাটির নীচে হিটলার নিজের মাথায় গুলি চালায়।

এই অঞ্চলটি বিশ্ব ইতিহাসের পানিপথ!

আবার এখানেই সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে, বাতাসে একটুও বারুদের গন্ধ না ছড়িয়ে দুই জার্মানির মিলন-উৎসব হল। বিনা যুদ্ধে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মতন দুই প্রবল প্রতিপক্ষ হাত মেলালো। এটাও বিশ্ব ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

বারুদের গন্ধ একেবারে ছিল না বলাটা ঠিক হল না। ছিল, তবে তা গোলাগুলির নয়। বাজির। দু-তারিখ রাত্রি ঠিক বারোটার পর বাজি ফাটতে লাগল, আকাশে উড়ল শত-শত বর্ণাঢ্য হাউই। বিমান থেকে বোমা বর্ষণের বদলে মাটি থেকে উত্থিত হাউইগুলির ঝলমলে রঙে আকাশ রাঙিয়ে দেওয়ায় কত তফাত! একই জায়গা, একই মনুষ্যজাতি, কখনও হিংসায় পরস্পরের দিকে অস্ত্র হেনেছে, কখনও বন্ধুত্বে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছে।

সন্ধে থেকেই এখানে সমবেত হয়েছিল কয়েক লক্ষ মানুষ। কথা ছিল প্রেসিডেন্ট বুশ, মিখাইল গর্বাচভ, মার্গারিট থ্যাচার প্রমুখ রাষ্ট্রনায়ক-নায়িকারা উপস্থিত থাকবেন এই মিলন-উৎসবে, কিন্তু এর মধ্যে ইরাকের সাদ্দাম হুসেন মধ্যপ্রাচ্যে কুয়ায়েতি কাণ্ডটি ঘটাবার পর সবাই বিচলিত ও ব্যস্ত, তাঁরা আসতে পারেননি কেউ। অবশ্য এই রাত্তিরে নেতাদের বক্তৃতারও তেমন গুরুত্ব নেই, দু-দিকের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত হাত মেলানোই বড় কথা, মাঝখানের বিভেদের দেওয়াল ভাঙার সঙ্গে-সঙ্গেই তো মিলনপর্ব শুরু হয়ে গেছে। মধ্যরাত্রি পার হওয়া মাত্র সমস্ত গির্জায় গির্জায় বেজে উঠল, ঘণ্টা, কনসার্ট হলে ধ্বনিত হল বিটোফেনের নাইনথ সিমফনি, আকাশে ভাসল আলোর মালা। সঙ্গীত ও আলোর মধ্যেই ঘোষিত হল জার্মান জাতির পুনর্জন্মের বার্তা।

এমনও আশঙ্কা ছিল যে এই উৎসবের মধ্যে আকস্মিক কোনও হামলায় আনন্দের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। সকলেই যে মনে-প্রাণে এই মিলন মেনে নিয়েছে এমন তো নয়, এমন হতে পারে না। সমাজতন্ত্রের ভাবধারায় যারা সত্যিকারের দীক্ষিত তাদের ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রতি বদ্ধমূল ঘৃণা থাকতেই পারে। কিংবা পূর্ব দিকে যারা ক্ষমতার মৌরসীপাট্টায় ছিল, তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ক্ষোভ হঠাৎ বিস্ফোরিত হতেই পারে। আবার এদিকের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যারা সচ্ছল, তাদেরও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি রয়েছে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য। অনেকেই মিলনের সমর্থক নয়। কিন্তু জার্মানির অন্যান্য শহরে দু-একটা ছোটখাটো গোলমাল হলেও বার্লিনের মূল উৎসব নিরুপদ্রবেই শেষ হল, অনেক রাত পর্যন্ত বাজি পুড়িয়ে, বিয়ার পান করে ও সমবেত গান গেয়ে ভোরের দিকে সবাই শুতে গেল, ঘুমোল পরের দিন অনেক বেলা পর্যন্ত। ৩রা অক্টোবর জাতীয় ছুটির দিন ঘোষিত হয়েছে।

জার্মানরা ছুটির দিনে সাধারণত বাড়ি থেকে বেরুতেই চায় না। কিন্তু বিকেলের দিকে আমরা ট্যাক্সি নিয়ে ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের দিকে এগোতে গিয়ে পদে-পদে থামতে হল। দারুণ ট্র্যাফিক জ্যাম, খানিক বাদে ট্যাক্সি ড্রাইভারই বলল, এরকমভাবে যেতে গেলে তোমাদের অনেক পয়সা খরচ হয়ে যাবে, এর চেয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো।

হাঁটতে-হাঁটতে খানিক দূর যাওয়ার পর দেখলাম, মানুষের ভিড় এতই বেশি যে পুলিশ আর কোনও গাড়িকে সামনের দিকে যেতেই দিচ্ছে না। এখনও অনেকটা পথ। আমি ও বাদল বসু আগে বার্লিনে এলেও রাস্তা-ঘাট তেমন চিনি না। অনেককাল বার্লিন প্রবাসী পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সংক্ষিপ্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল চেক পয়েন্ট চার্লির দিকে। চার বছর আগে এই সীমান্তদ্বার দিয়ে আমরা কয়েকজন পূর্ব বার্লিনে গিয়েছিলাম, সেবার সমরেশ বসুও সঙ্গে ছিলেন। ভারতের সঙ্গে পূর্ব জার্মানির সুসম্পর্ক থাকা সত্বেও ওই চেক পয়েন্ট চার্লি পার হতে আমাদের অনেক বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়েছিল, প্রহরীদের উৎকট গাম্ভীর্যমাখা মুখ, শিকারি কুকুরদের বুক কাঁপানো হুঙ্কার, জালে ঘেরা সরু পথ দিয়ে অনেকটা হাঁটতে বাধ্য করা, একটা ঘরের মধ্যে খামোকা বসিয়ে রাখা। সমরেশ বসু অসুস্থ ছিলেন, বারবার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলছিলেন, কেন, কেন এরা মানুষকে এত অবিশ্বাস করে!

আজ সেইসব অপ্রয়োজনীয় সতর্কতা, পাহারা, অস্ত্রধারী সৈনিকদের এলাহি ব্যবস্থা কোন হাওয়ায় উড়ে গেছে। দেওয়াল ভাঙা, কাঁটা তারের বেড়া এখানে সেখানে গোটানো, শিকারি কুকুরগুলো কিনে নিয়ে গেছে বিভিন্ন দেশের ধনী কুকুর-প্রেমিকেরা। একটা ফাঁকা চুঙ্গি ঘরে বসে তিনটি বাচ্চা ছেলে মিলিটারি-মিলিটারি খেলছে। আমাদের দেখে তারা বলে উঠল, হল্ট। পাসপোর্ট! তারপর খিলখিল করে হেসে এ-ওর গায়ে গড়াতে লাগল। এই সরল সুন্দর বাচ্চাদের মুখগুলো দেখে চারবছর আগেকার সেই রক্ত চক্ষু প্রহরীদের মুখের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করি।

পথে-পথে জনারণ্য, অনেকে ছোট ছেলেমেয়েদের হাত ধরে এনেছে, যাতে তারাও এই ঐতিহাসিক ঘটনার অংশীদার হতে পারে। ফুটপাথে বসে গেছে অজস্র অস্থায়ী দোকান, সেখানে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের সুভেনির, প্রাক্তন পূর্ব জার্মানির প্রহরীদের টুপি, ইনসিগনিয়া, বার্লিন দেওয়ালের টুকরো। এই দেওয়ালের টুকরো স্মারক হিসেবে রেখে দিতে অনেকেই চায়। কিছু কিছু অত্যুৎসাহী তরুণ-তরুণী নিজেরাই হাতুড়ি -খন্তা এনে দেওয়াল ভাঙছে। তখনই আমরা দেখলাম, কী শক্ত করে তৈরি করা হয়েছিল এই দেওয়াল। ভেতরে-ভেতরে লোহা বসানো রি-ইনফোর্সড কংক্রিট। দড়াম-দড়াম করে হাতুড়ির ঘায়েও একটা চল্টাও উঠছে না। যারা এই দেওয়াল বানিয়েছিল, তারা ভেবেছিল, এই বিভেদের প্রাচীর চিরস্থায়ী হবে। দেওয়ালের এক দিকটা বর্ণহীন, সেখানে কারুর হাত ছোঁয়াবার অধিকার ছিল না, অন্যদিকে নানারকম রঙিন ছবি ও কবিতা। দেখা যাচ্ছে ছবি ও কবিতাই জয়ী হল।

এক জায়গায় সেই উঁচু প্রাচীরের ওপর উঠে এক জোড়া যুবক-যুবতী গান গাইছে। মাত্র বছর খানেক আগেও ওইভাবে পাঁচিলের ওপর বসলে তাদের গুলি খেয়ে মরতে হত। এখন অনেক মানুষ তাদের গান শুনে হাততালি দিচ্ছে।

যেখানে সেখানে বসে গেছে এরকম গানের দল। লোকসঙ্গীতে সমসাময়িক ঘটনার উল্লেখ। এ যেন জয়দেব-কেঁদুলির মেলা।

এই সীমানা-ভাঙা মানুষের উচ্ছ্বাস আনন্দ দেখে আমার ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যায় দুই বাংলার মাঝখানের গভীর বিভেদের রেখার কথা। মনে তো পড়বেই। কলকাতা থেকে পশ্চিমবাংলার সীমানা পর্যন্ত রাস্তাটির নাম আজও যশোর রোড। ওপারের রাস্তাটির নামও যশোর রোড। এ যেন আমাদের উন্টার ডেন লিনডেন। দুই ভিয়েতনাম এক হয়ে গেছে, দুই কোরিয়া মিলনের আলোচনা চালাচ্ছে। আর আমাদের দুই বাংলা? ‘হায় ধর্ম, এ কী সুকঠোর দণ্ড তব!’

চেক পয়েন্ট চার্লির একটি প্রবেশপথের কাছে প্রচুর পুলিশের সমাবেশ, আশেপাশের উঁচু বাড়িগুলির প্রতিটি জানলায় নারী-পুরুষরা দূরের কী যেন দেখছে। মাইক্রোফোনে বারবার কিছু ঘোষণা করা হচ্ছে, পঙ্কজ আমাদের বুঝিয়ে দিল যে, একটা মিছিল আসছে, তাই সাবধান করে দিচ্ছে পুলিশ। পথচারীদের সরে যেতে বলছে।

অনেকে ছুটোছুটি করতে লাগল, কিন্তু একটা মিছিল এলে ভয় পেয়ে পালাতে হবে কেন? পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যায় না। মিছিলটা সম্মিলিত বামপন্থীদের, তাদের মধ্যে উগ্রপন্থী, নৈরাজ্যবাদী ও আরও অনেক রকম দল আছে, তারা গোলাগুলি ছুঁড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে। তা ছাড়া, এই বার্লিনেই আছে নিও-নাতসি দল, তারা বামপন্থীদের সাংঘাতিক বিরোধী, তারাও হঠাৎ এসে আক্রমণ করতে পারে এই মিছিল।

আমরা প্রথমে একটা মাঠের মধ্যে সরে গিয়েও আবার কৌতূহল দমন করতে না পেরে ফিরে এলাম রাস্তার ধারে। মিছিলটি বেশ বড়, অন্তত দশ-পনেরো হাজার লোক তো হবেই। নানারকম ফেস্টুন ও প্লাকার্ড, পোশাকও বিচিত্র, অনেকের মুখোশ পরা, কেউ-কেউ কাপড় দিনে মুখ ঢেকেছে, যাতে তাদের চিনতে না পারা যায়। মিছিলের দু’পাশে হাঁটছে প্রায় সমান সংখ্যক পুলিশ, অস্ত্রধারী, কিন্তু নত মুখ, তারা মিছিলে কোনও বাধা দেবে না, বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতেও দেবে না। শেষ পর্যন্ত কোনও সংঘর্ষ হল না।

মিছিলের উচ্চ কণ্ঠে স্লোগান দুই জার্মানির মিলনের বিরুদ্ধে। ভোগ্যপণ্য ও ধনতন্ত্রের চাকচিক্যের মোহে পূর্ব জার্মানির এই আত্মসমর্পণ ঠিক হয়নি।

বামপন্থীদের এই প্রতিবাদ মিছিলে কয়েক হাজার মানুষ যোগ দিয়েছে বটে, কিন্তু ঘরে-ঘরে আরও লক্ষ-লক্ষ মানুষের মনে এই রকম সংশয় রয়েছে। এত দ্রুত সব ঘটনা ঘটে যাওয়ায় অনেকেরই খানিকটা ভ্যাবাচাকা অবস্থা। পূর্ব জার্মানির শাসকদলের বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষ প্রথমে রাস্তায় নেমেছিল, তারা চেয়েছিল শাসক শ্রেণির অপসারণ, দুই জার্মানির মিলনের ধ্বনি তখনও ওঠেনি। ক্রমশ আবেগ উত্তাল হয়ে উঠল, প্রহরীদের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে হাজার-হাজার মানুষ ছুটে গিয়ে বার্লিনের দেওয়াল ভাঙতে লাগল। একটুখানি ভাঙা গর্ত দিনে বহু লোক চলে এল পশ্চিমে, সেখানেও তারা কোনও বাধা পেল না, বরং পেল উষ্ণ অভ্যর্থনা, হাতখরচ হিসেবে পশ্চিম জার্মানির দুর্লভ মুদ্রা এবং আশ্রয় ও জীবিকার আশ্বাস। প্রথম দিকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির বিশেষ কেউ পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসেনি, এসেছে দলে-দলে শ্রমিক শ্রেণি। শ্রমিকরাই সমাজতন্ত্রের মেরুদণ্ড, অথচ শ্রমিকরাই যদি এই ব্যবস্থা ছেড়ে অন্য ব্যবস্থার দিকে আকৃষ্ট হয়, তাহলে আর সমাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখা যাবে কী করে? পোল্যান্ডে লেক ভালেনসার নেতৃত্বে আন্দোলনই সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিল যে, শ্রমিকরাও এই ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ।

পশ্চিম জার্মানিতে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ এই মিলনকে স্বাগত জানিয়েছে বটে, আবার অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেছে। গুন্টার গ্রাস-এর মতন কিছু কিছু লেখক-বুদ্ধজীবী বলেছেন, এত তাড়াহুড়ো করে দুই জার্মানির মিলনের প্রয়োজন ছিল না।

সত্যি কথা বলতে কী, ঐতিহাসিক তেসরা অক্টোবরে সারা জার্মানিতে যত বিরাট উৎসব ও আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখা যাবে বলে আশা করা গিয়েছিল, ততটা দেখা যায়নি। বার্লিনে বড় আকারের উৎসব-আড়ম্বর হয়েছে বটে, কিন্তু জার্মানির অন্যান্য শহরে কিছু পটকা ফেটেছে, বাজি পুড়েছে, কিছু গান-বাজনা হয়েছে মাত্র, তেমন কিছু উদ্দামতা ছিল না। সব মিলিয়ে বরং যেন একটা নির্লিপ্ত ভাব।

এর একটা কারণ, গত নভেম্বরে যখন দেওয়াল ভাঙতে শুরু করল, দলে দলে লোক এদিকে আসত লাগল, দু-দিকের যাতায়াতে আর কোনও বাধা রইল না, তখনই বোঝা গিয়েছিল, দুই জার্মানিকে আর আলাদা করে রাখা যাবে না। দুই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরও মাঝখানে সীমানা থাকে, সেই সীমানা নিয়ে ঝগড়াও হয়, যেমন হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চিনের, হাঙ্গেরির সঙ্গে রুমানিয়ার। মাঝখানে কোনও সীমানা থাকবে না, অথচ একটি সমাজতান্ত্রিক ও একটি ধনতান্ত্রিক দেশের সহাবস্থান হবে, পৃথিবী এখনও এর যোগ্য হয়ে ওঠেনি।

অর্থাৎ দুই জার্মানির মিলন দেওয়াল ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, তেসরা অক্টোবর তার চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হল মাত্র। সাধারণ মানুষের মাতামাতি এই কয়েক মাসে অনেকটা কমে এসেছে, মনে অন্য প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি মারছে।

হির্সবার্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের স্ত্রী ট্রুডবার্টাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, দুই জার্মানির মিলনে আপনি খুশি? তিনি জোর দিনে বলেছিলেন, এত কালের বিচ্ছেদটাই ছিল অস্বাভাবিক, এই মিলনের বাসনা প্রত্যেক জার্মানের মনের মধ্যে ছিল। ফ্রাংকফুর্ট আমাদের বাংলাদেশি বন্ধু ইউসুফের স্ত্রী ক্লাউডিয়াকে ওই একই প্রশ্ন করতে সেও বলেছিল, জার্মানরা একই জাতি, একই ভাষা, তবু তারা দুটো আলাদা দেশের নাগরিক হয়ে কেন থাকবে? সে সদ্য তরুণী, সে দারুণভাবে জার্মান। এ ছাড়াও বিভিন্ন শহরে কিছু সাধারণ জার্মানদের কথাবার্তা শুনে বুঝেছি, সীমানা মুছে যাওয়ায় তারা আনন্দিত। এটা যেন তাদেরই জয়। তবু কিছু কিছু সংশয় তাদের মনে এখন উঁকি ঝুঁকি মারছে। আবেগ ও উচ্ছ্বাস কেটে গেলে কিছু কিছু বাস্তব সত্য মনে পড়ে। পশ্চিম জার্মানি অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী দেশ, বিশ্বের প্রধান তিনটি দেশের অন্যতম, তবু এত বড় একটা বোঝ ঘাড়ে নিয়ে কি সামলাতে পারবে? এখানকার নাগরিকরা এতদিন যতখানি আরামে বিলাসে ছিল, তার কিছু কিছু ত ছাড়তে হবে বটেই। ট্যাক্সের বোঝা চাপবে, এর মধ্যেই কিছু কিছু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। পশ্চিমের তুলনায় পূর্বের কলকারখানাগুলি অনুন্নত। সেগুলির আধুনিকীকরণ প্রয়োজন, কাজ দিতে হবে প্রচুর বেকারকে। পশ্চিম জার্মানিতে বহু সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক ও কর্মী রয়েছে, তুর্কি, ইতালিয়ান, ভারতীয় বাংলাদেশি-পাকিস্তানিও। তাদের নিয়ে কী হবে, এবার কি তাড়িয়ে দিতে হবে এই হাজার-হাজার মানুষকে?

পূর্বের লোকদের মধ্যেও বাঁধ ভাঙার প্রাথমিক আনন্দ ও জোয়ার কিছুটা স্তিমিত হওয়ার পর তাদের মনেও প্রশ্ন জাগে। পুনর্মিলিত দেশে তাদের অবস্থাটা ঠিক কীরকম হবে। বিরাট ধনীর বাড়িতে গরিব আত্মীয়ের আশ্রয় নেওয়ার মতন? এরা আশ্রয় দিচ্ছে, হাত খরচ দিচ্ছে, এরপর কাজের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যে কী খানিকটা দয়া দাক্ষিণ্যের ভাব নেই? পশ্চিমের বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, পূর্বের লোকেরা কাজ করতে জানে না, অলস।

যেখানেই পূর্ব-পশ্চিমের ভাগাভাগির প্রশ্ন আসে, সেখানেই একটা যেন দো-টানার ভাব থাকে। পূর্ব ও পশ্চিম পরস্পরকে ঠিক যেন গ্রহণ করতে পারে না, আবার বর্জনও করতে পারে না, আকর্ষণ-বিকর্ষণের খেলা চলতে থাকে। মানুষের ইতিহাসেই বারবার দেখা যায় পূর্ব-পশ্চিমের এই দ্বন্দ্ব ও টান। তার কারণ, আমার ধারণা, প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যেও থাকে পূর্ব-পশ্চিম, উদয় ও অস্তের বৈপরীত্য।

গরিবেরও আত্মমর্যাদা বোধ থাকে। সব গরিব কখনও ধনী আত্মীয়দের দিকে লোলুপ হয়ে ছুটে যায় না। সমাজতান্ত্রিক দেশের মানুষের সেরকম আত্মমর্যাদা বোধ থাকাই স্বাভাবিক। তবু পূর্ব থেকে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ দেওয়াল ভেঙে পশ্চিমের দিকে যেতে চাইল কেন? শুধু ভোগ্যপণ্য আর ধনতন্ত্রের চাকচিক্যের লোভে? ধনতন্ত্র ও গণতন্ত্রের চেয়েও সমাজতন্ত্র নিঃসন্দেহে আদর্শ হিসেবে উচ্চতর। আমি এখনও তা বিশ্বাস করি। তবু সেই আদর্শের ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না কেন?

মানুষ আদর্শ চিবিয়ে খায় না। আদর্শের জন্য অনেকে প্রাণ পর্যন্ত দেয়, সাধারণ মানুষও কিছু কিছু আত্মত্যাগ করতে রাজি থাকে। একটা সমাজ ব্যবস্থার যখন পালাবদল ঘটে তখন কিছু কিছু বিপর্যয় দেখা দিতে বাধ্য। উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, সাধারণ মানুষকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। কিন্তু কতদিন? পাঁচ বছর, দশ বছর? পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে নিশ্চয়ই নয়। পুরো একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে গেল। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পালাবদলের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা অত মনে রাখে না। তারা দেখে যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান যদি সব দুর্যোগ সামলে নিয়ে এত সচ্ছল হতে পারে, তা হলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি পারবে না কেন? সমাজতান্ত্রিক দেশে বিধি-নিষেধের কঠিন বন্ধন, অথচ ওসব দেশের মানুষ খোলামেলা। এই মুক্তির টানে এবং পেটের টানেই দেওয়াল ভেঙেছে।

শুধু ভোগ্য পণ্য, অর্থাৎ গাড়ি, ফ্রিজ, টিভি, চকলেট, মদের লোভ নয়, সমাজতান্ত্রিক দেশের মানুষদের প্রতিদিনের মূল খাদ্যেও টান পড়েছিল। মাংস আছে তো রুটি নেই, রুটি আছে তো মাখন নেই। দুধ নেই। শাক-সবজি ফল-মূল নেই, কফি নেই। এই নেই এর তালিকা এক-একটা দেশে আরও সুদীর্ঘ। রুমানিয়ায় টয়লেট পেপার পর্যন্ত পাওয়া

যায় না। ইলেকট্রিসিটি অকুলান, প্রচণ্ড ঠান্ডায় লোকে ঘর গরম করতে পারেনি। মাংস, রুটি, আলু, মাখন, আর দুধ, এইগুলি ইউরোপীয়দের প্রধান খাদ্য, এতেও টান পড়লে কত বছর তারা আদর্শ আঁকড়ে থাকবে?

সমাজতান্ত্রিক দেশের মানুষ গরিব হয়ে থাকবে, যুগের পর যুগ কৃচ্ছসাধন করবে। এমন কথা মার্কসবাদে কোথাও নেই। বরং এই ব্যবস্থায় সব মানুষের সচ্ছল, সুখী থাকার কথা। তবু কোনও গলদে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির উৎপাদন কমে গেল, সাধারণ মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলিও দিতে পারল না সরকার? অথচ অন্যদিকে ইউরোপের যেসব দেশ এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, ধনতন্ত্র-গণতন্ত্র আঁকড়ে আছে, তারা দিব্যি ফুলে কেঁপে উঠল কী করে? সেসব দেশে সব জিনিসই অঢেল।

আমার একটা কথা ভেবে আশ্চর্য লাগে। অনেক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মার্কসবাদে বিশ্বাসী এবং সমাজতন্ত্রের সমর্থক। অনেক তাত্বিক ও অধ্যাপক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নানারকম ব্যাখ্যা করেছেন এবং শিষ্য-প্রশিষ্য পরম্পরায় তা প্রচার করে আসছেন। তাঁরা বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও শ্রদ্ধেয়, কিন্তু আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র সমর্থনীয় হলেও তার রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োগে যে অনেক ছিদ্র দেখা যাচ্ছে, সেসব দেশে যে অনেক বছর ধরেই নানা রকম অব্যবস্থা ও অনটন চলছে, সে সম্পর্কে তাঁরা কখনও কিছু বলেননি কেন? জানতেন না, কিংবা জেনেশুনেও সত্য গোপন করেছেন? এতরকম সেমিনারে তাঁরা ওই রকম সব দেশে যান। তাঁদের চোখে পড়েনি? নিছক প্রচার পুস্তিকার ওপর নির্ভর না করে ওইসব দেশের প্রকৃত অবস্থা জানার আগ্রহ তাদের হয়নি? একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি বছরখানেক আগে আমাকে আফসোসের সুরে বলেছিলেন, মস্কোয় মাংস পাওয়া যায় না, সোসালিজম টিকবে কী করে? আমি অবাক। তিনি অন্তত পঞ্চাশবার মস্কো গেছেন। সেখানে যে প্রায়ই মাংস পাওয়া যায় না, কখনও মাংস এলে দোকানের সামনে লম্বা লাইন পড়ে, তা কি তিনি জানতেন না? গর্বাচভ পেরেস্রোইকা ঘোষণা করার পর তিনি মুখ খুলেছেন? সমাজতন্ত্রের সমর্থন করেও তার বাস্তব প্রয়োগের দোষত্রুটির বিচার-বিশ্লেষণ করা যেত না? সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধীরা এর যত না ক্ষতি করেছে, সম্ভবত তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করেছে এর সমর্থক ও শাসকদের মিথ্যাচার ও গোপনীয়তা। সত্যকে কিছুতেই বেশিদিন চেপে রাখা যায় না। গর্বাচভ বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী মানুষ, তিনি তা বুঝতে পেরেই বিক্ষুব্ধ মানুষদের বিরুদ্ধে অস্ত্র সংবরণ করেছেন, খুলে দিয়েছেন দ্বার।