মাটি নয়, মানুষের টানে

মাটি নয়, মানুষের টানে

পঞ্চান্ন বছর আগে পরে

একটি চোদ্দো বছর বয়েসের কিশোর গিয়েছিল তার এক মামার বাড়িতে বরযাত্রী হয়ে। পূর্ববাংলা তখন সদ্য নাম বদল করে হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান, তার ফরিদপুর জেলায়, মামাবাড়ির গ্রামের নাম আমগ্রাম বা আমগাঁ। মামার নাম গোবিন্দ গাঙ্গুলি, এক ছোটখাটো জমিদার বংশের শেষ প্রতিভূ। জমিদারের ছেলেদের ফরসা ও সুপুরুষ হওয়ার কথা, নাকের তলায় যত্নে লালিত গোঁফ, গল্প-উপন্যাসে বা যাত্রা-সিনেমায় এরকমই থাকে, কিন্তু গোবিন্দ গাঙ্গুলি এক বলিষ্ঠকায় ঘোর শ্যামবর্ণ পুরুষ, গোঁফ নেই, শুধু তাঁর তেজটাই জমিদারসুলভ। কিছুটা গোঁয়ার ধরনের এবং দুঃসাহসী, এই গোবিন্দ গাঙ্গুলি একবার বর্শা দিয়ে একটা হিংস্র পাগলা কুকুর মেরেছিলেন, শিয়ালও মেরেছেন কয়েকবার, একবার নাকি সুন্দরবন থেকে একটা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ছিটকে এদিকে এসে পড়ায় গোবিন্দ গাঙ্গুলি অস্ত্র হাতে নিয়ে বাঘ শিকারে গিয়েছিলেন অকুতোভয়ে, তবে শেষ পর্যন্ত বাঘে মানুষে মুখোমুখি হয়নি।

কিশোরটি বাবার সঙ্গে মামাবাড়িতে এসেছে, এই বিয়ে উপলক্ষে। এ বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় কত ধুমধাম সে দেখেছে দুবছর আগেও, কত মানুষের সমারোহ। বাড়ির বড় ছেলের বিয়েতে আরও অনেক বড় উৎসব হওয়ার কথা, দূর থেকে আসবে আত্মীয়স্বজন। সেসব কিছুই নেই। সেই বয়েসের কিশোররা বড় বড় চোখ মেলে সব কিছু দেখে, অন্যান্য বছর মামাবাড়িতে আসার উদ্যোগের সময় থেকেই তার দারুণ উত্তেজনা হত, এবারেও সেরকম মন নিয়েই এসেছে, কিন্তু অনেক কিছুই তার কাছে দুর্বোধ্য লাগছে। বিয়ে বাড়িতে এত কম লোক! সানাই বাজছে না।

সদ্য দেশ বিভাগের পর এখানকার মানুষদের মধ্যে যে নানারকম সংশয় ও আশঙ্কা চেপে বসে আছে, তা সে বুঝতে পারেনি। দিল্লিতে বসে কয়েকজন নেতা দেশ বিভাগের সিদ্ধান্ত নিলেন আর তাতেই যে সুদূর বাংলার এইসব গ্রামের লক্ষ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেল, এটা তার বোঝবার কথাও নয়। উনিশশো ছেচল্লিশ সালে কলকাতায় ডাইরেক্ট অ্যাকশানের ডাকে যে হিন্দু-মুসলমানের ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, তার জের চলল পূর্ববঙ্গের নোয়াখালিতে, স্বয়ং গাঁধীজি এসেও সে দাঙ্গা থামাতে পারেননি, তারপর আরও বীভৎস দাঙ্গা হল বিহারে। দাঙ্গা শব্দটির ভয়াল ধ্বনি এর পরের কয়েক দশক ধরে বিধ্বস্ত করে দিল বাঙালির জাতিসত্তা।

ফরিদপুরে তখনও কোনও দাঙ্গা হয়নি, হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ হয়নি। কিন্তু যে কোনও সময় বহিরাগতদের উসকানিতে বীভৎস কাণ্ড শুরু হয়ে যেতে পারে। এই দুশ্চিন্তা তো রয়েছেই। সেই জন্যই এই বিবাহপর্বটি যথাসম্ভব অনাড়ম্বরভাবে ও সংক্ষেপে সেরে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কলকাতা থেকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন আর কেউ আসেনি। কিশোরটির যাবা এসেছেন, তার প্রধান কারণ, তিনিই ঘটকালি করেছেন এই বিয়ের, পাত্রীটি তাঁরই নিজের গ্রামের প্রতিবেশী-কন্যা।

বিয়ের দিন অল্প কয়েকজন বরযাত্রী, তারা যাবে নৌকোয়। এ অঞ্চলে শীতের সময় কয়েক মাস বাদ দিলে নৌকোই একমাত্র যানবাহন। ভরা বর্ষা, সমস্ত নদীগুলিই স্বাস্থ্যবতী, তার মধ্যে আড়িয়াল খাঁ নদী নয়, নদ, এক দৃপ্ত বলশালী পুরুষেরই মতন তার ভাবভঙ্গি।

গোবিন্দ গাঙ্গুলির এই কিশোর ভাগ্নেটিরও পদবি গাঙ্গুলি (পরবর্তীকালে যে গঙ্গোপাধ্যায় হয়েছে)। হিন্দু ব্রাহ্মণকুলে কোনও গাঙ্গুলির মামা গাঙ্গুলি হতে পারে না, আসলে এই গোবিন্দ গাঙ্গুলি তার মায়ের সহোদর নয়, মায়ের বড় মামার ছেলে, কিন্তু বৃহৎ যৌথ পরিবারে সবাই ছিল সমান। এই মামার সঙ্গে বিয়ে হবে তার এক পিসির। এই পিসিও রক্তের সম্পর্কের নয়, এক গ্রামের সব নারীদেরই মাসি, পিসি বা দিদি বলে ডাকাই প্রথা। তবে পাত্রীটি, যার নাম প্রভা, একেবারে পাশের বাড়ির, তাই আপনেরই মতন।

নৌকোতে ওঠার আগে খানিকটা কাদার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হয়েছিল, তারপর নৌকো যখন মাঝ নদী দিয়ে চলেছে তখন ছেলেটি ভাবল, গলুইয়ের কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে জুতোর কাদা ধুয়ে নেবে। পাটাতনের ওপর শুয়ে সে এক পাটি জুতো ডুবিয়েছে জলে, নদীটি যে খরস্রোতা তা সে বুঝতে পারেনি, কিংবা খুব কাছেই একটি শুশুককে ভুস করে মাথা তুলতে দেখে সে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, জুতোটা খসে গেল হাত থেকে। একজন মাঝি শুধু দেখেছিল, কিন্তু তখন আর সে জুতো উদ্ধার করার কোনও উপায়ই নেই।

মামার বিয়ের বরযাত্রী হয়ে সে গিয়েছিল খালি পায়ে, এটা সারা জীবনে ভোলবার মতন নয়। অন্য সকলের মুখ অন্য কারণে নিরানন্দ, শুধু কিশোরটির মনোবেদনা জুতোর জন্য। গ্রামের ছেলেদের পক্ষে খালি পায়ে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সে তো সঠিক গ্রামের ছেলে নয়, সে থাকে কলকাতায়, এখানকার গ্রামের বন্ধুরা তাকে বলে ক্যালকেশিয়ান। তার সাজপোশাক অন্যরকম, সে মাঝখানে সিথি কেটে চুল আঁচড়ায় না। সে চুল অ্যালবার্ট করে।

নৌকো এসে পৌঁছল পুব মাইজপাড়ায়। মাদারিপুর শহর থেকে মাত্র ছ-সাত মাইল দূরে, একেবারে অজপাড়াগাঁ যাকে বলে। একটাও পাকারাস্তা নেই। গ্রামের প্রায় এক কোণে একটি ছোট্ট বামুন পাড়া, পাঁচটি পরিবারের বাস। আয়তক্ষেত্রের মতন একটি উঠোন, তার চার পাশে চারটি বাড়ি, কোনওটিই পাকা নয়, মাটির দেওয়াল টিনের ছাদ, তবে বেশ বড় বাড়ি, ঘরগুলি প্রশস্ত। সমস্ত পরিবেশটি ঝকঝকে তকতকে। চৌধুরী, দুই চ্যাটার্জি ব্যানার্জিদের বাড়ি, পঞ্চম বাড়িটি গাঙ্গলিদের, একটু পেছনের দিকে, তুলনায় তারা দরিদ্র। কিশোরটির ঠাকুর্দা (তিনি তখন জীবিত নন) ছিলেন টোলের পণ্ডিত, কিছু জমি জমা ছিল, তার থেকে সারা বছরের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হত।

বরযাত্রীদের থাকার জায়গা কোনও অসুবিধে নেই। আয়তক্ষেত্রের এক পাশের একটি বাড়ি খালি, সে পরিবারের লোকজন এর মধ্যেই এ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কিশোরটি তো তার বাবার সঙ্গে উঠল নিজেদের বাড়িতে। সে বাড়ির সামনে একটি বাতাবি লেবুর গাছ, তাতে এত ফল হয় যে খেয়ে শেষ করা যায় না। বাড়ির পেছনের উঠোনে একটা ঝাঁকড়া জামরুল গাছ। জামরুল ফুলের রেণু বৃষ্টির মতন ঝরে পড়ে। আরও পেছন দিকে কয়েকটি বড় বড় গাছ, তার মধ্যে একটি আমগাছের আমের নাম কে রেখেছিল কে জানে, বেশ কবিত্বময়, টিয়াঠুটি।

পল্লীটি ছোট, তাতেও তিনটি পুকুর। চৌধুরীদের বাড়ি সংলগ্ন পুকুরটি তাঁদের নিজস্ব, অবশ্য অন্যরাও সে পুকুরে ছিপ ফেলতে পারে। ছিপ ফেললেই চটাপট ওঠে পুঁটি মাছ। মেয়েরাই বেশি ব্যবহার করে সেই পুকুর। অন্য দুটি পুকুর এজমালি। সকালে দাঁত মাজা থেকে শুরু করে দুপুরের স্নান ও রাত্রির আঁচানো পর্যন্ত সবই একই পুকুরে। পানীয় জলও ওই পুকুরেরই, কিন্তু তা ফুটিয়ে নেওয়া হয় কি না, কিশোরটি জানে না। একটি পুকুরের একেবারে ধার ঘেঁষে একটা খে জ্বর গাছ, সেটি বেশ বাঁকা, অর্থাৎ অনেকখানি চলে গেছে জলের ওপারে। শীতকালে সেখানে রসের জন্য কলসি বেঁধে দেওয়া হয় ডগার কাছে। শীতকালের প্রারম্ভেই একজন লোক এসে সব খে জ্বর গাছগুলো ‘কামাই’ করে দিয়ে যায়। সেই লোকটিকে বলে শিয়ালি, কেন শিয়ালি তা কে জানে! এক একটা গাছে বেশি রস হয়, যেমন এই বক্র গাছটি। মাঝ রাত্তিরে খে জ্বর গাছ বেয়ে ওঠে হাঁড়ির মধ্যে পাটকাঠি ডুবিয়ে চোঁচো করে রস টেনে খাওয়া, বাচ্চাদের একটা মজার খেলা। এই কিশোরটি আরও কম বয়েসে ওই বাঁকা গাছটিতে উঠে রস খেতে গিয়েছিল। কোনও কারণে ভয় পেয়ে তার হাত পিছলে যায়, ঝপাং করে পড়েছিল পুকুরের জলে, শীতের রাত্তিরে। অবশ্য তখনই সে সাঁতার জানত।

বড় চ্যাটার্জি আর গাঙ্গুলিদের বাড়ির মাঝখানের সরু পথ দিয়ে যে পুকুরটিতে যাওয়া যায়, সেটি আকারে গরিষ্ঠ। কিশোরটি এই পুকুরেই সাঁতার শিখেছে। সে শেখা নিয়মমাফিক নয়। যখন তার পাঁচ-ছ’বছর বয়েস তখন পাড়ার মাসি-পিসিরা কৌতুকছলে তাকে উঁচু করে তুলে ছুঁড়ে দিত গভীর জলে। ছেলেটি কান্না ও আঁকুপাঁকু করে যখন প্রায় ডুবে যাচ্ছে, তখন হেসে গড়াগড়ি যেতে যেতে সেই নারীরা তাকে উদ্ধার করত, আবার ছুঁড়ে দিত জলে। এইরকমভাবে চার-পাঁচদিন চলার পরই হঠাৎ সেই বাচ্চাটি আর ডোবে না, জল পোকার মতন সাঁতরে দূরে চলে যায়। এখন কিশোর বয়েসে এসে তার সাঁতার নিয়ে বেশ গর্ব, সে মাঝ পুকুরেও ডুব দিয়ে মাটি তুলে আনতে পারে। কলকাতাতেও হেদো পার্কের (এখন আজাদ হিন্দ বাগ) পুকুরে সাঁতার দিয়ে এপার ওপার হয়ে সমবয়েসিদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

মাসি-পিসি শ্রেণির রমণীরা এই পুকুরে স্নান করত অনেকক্ষণ ধরে। সেটাই তাদের পরনিন্দা-পরচর্চা ও রঙ্গ-রস বিনিময়ের সময়। এখানে আব্রু রাখার মতন কোনও ঘেরা জায়গা নেই। স্নান সেরে ভিজে কাপড়েই তারা ফিরে যেত বাড়ি। সেইসব রমণীদের গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকা, শাড়িতে হেমেন মজুমদারের ছবি হয়ে ওঠে, সেই দৃশ্য সারাজীবনের মতন অঙ্কিত হয়ে গেছে কিশোরটির স্মৃতিতে। পুরুষরাও তো ভিজে গায়েই ওই পথে ফিরত, কিন্তু তার কোনও ছবি হয় না! কোনও নারী শিল্পীও সে দৃশ্য আঁকেন না।

পুকুর ছাড়া একটি খালও ঘিরে আছে এই পল্লীটিতে। প্রত্যেক বাড়ির পেছন দিকে এই খালের ওপর মল-মূত্র ত্যাগের জন্য মাচা বাঁধা। অর্থাৎ প্রতিদিন পরিষ্কার করতে কোনও ঝামেলা নেই, সবকিছু জলে ভেসে যায়। একেবারে বাইরের দিকে এরকম একটি টয়লেট আছে, সেটি বারোয়ারি, মজবুত ও উঁচু। একটা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে একটি চ্যাঁচার বেড়া দেওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকতে হয়। সেখানে বসে-বসে যে দৃশ্য দেখা যায়, তেমন দৃশ্য দেখার মতন অভিজ্ঞতা পশ্চিমবাংলার কারওই বোধহয় হয় না! টুপ-টুপ করে খসে পড়া পুরীষ খাওয়ার লোভে ছুটে আসে দলে দলে মাছ, তারা কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। বিশেষ কোনও এক রকমের মাছ নয়, অনেক রকম।

একটি সোজা রাস্ত এসে এই পল্লীটিতে প্রবেশ করেছে। ঢাকার মুখেই আর একটি পুকুর, তারপর অনেক গন্ধলেবুর গাছ। বাল্য চোখে মনে হত লেবুবন। সেই লেবু গাছের পাতা ছিঁড়ে পান্তা ভাতে দিয়ে রাখলে বেশ একটা হালকা সুগন্ধ হত।

এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বেশ মিলমিশ ছিল। হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষার চল বেশি, অনেক পরিবারের অবস্থাই সচ্ছল। সেই তুলনায় মুসলমানরা অধিকাংশই দরিদ্র, কয়েকঘর বেশ সম্পন্ন মুসলমানও আছে। কিশোরটি আরও কম বয়েসে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কলকাতা ছেড়ে গ্রামে বসবাস করতে এসে এক বছর পড়েছে গ্রামের বীরমোহন স্কুলে। তখন কয়েকজন মুসলমান সহপাঠীর সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল। এখন সে মা-বাবা-ভাই-বোনদের সঙ্গে কলকাতাবাসী। গ্রামের এই বাড়িতে সপরিবারে থাকেন তার জ্যাঠামশাই। দাঙ্গার আগুন এইসব গ্রাম পর্যন্ত এসে পৌঁছয়নি, তবু নানারকম গুজব শোনা যায়। জ্যাঠামশায়ের মুখে হাসি নেই, কপাল কুঁচকে থাকেন সবসময়। কিশোরটি তার বন্ধুদের খোঁজ নিতে যেতে চায়, কিন্তু প্রবীণরা তাকে নিষেধ করেন বাড়ির বাইরে বেশিদূর যেতে।

এখানেও বিয়ে বাড়িতে আড়ম্বর নেই। যেন দেশের বর্তমান অবস্থায় কোনও উৎসবের শোরগোল করাও একটা অপরাধ। জন্ম এবং মৃত্যু যেমন থেমে থাকে না, তেমন বিবাহও করতেই হয়, তবু যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে।

বড় চ্যাটার্জিদের বাড়িতে পাত্রী পক্ষের কাজের লোক বলতে গেলে একজনই, পাত্রীর দাদা চুনী। গ্রামের সব ছেলেমেয়েদেরই তিনি চুনীকাকা, তিনি বিবাহের উপকরণ জোগাড় করা, পুরুত ডাকা, বরযাত্রীদের আপ্যায়ন ও খাওয়ানো দাওয়ানোর ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন নিরলস পরিশ্রমে, অথচ হাসিমুখে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে, বেশ স্বাস্থ্যবান। এক একজন যুবকের ব্যক্তিত্বের গুণে ছোটরা খুব পছন্দ করে। এই কিশোরটির কাছেও চুনীকাকা খুব প্রিয় মানুষ। মালকোচা মারা ধুতি ও গেঞ্জি পরা, কোমরে গামছা বাঁধা সুদর্শন চুনীকাকা ছোটাছুটি করছেন সর্বত্র। শানাই-শঙ্খধ্বনি বাদ, শুধু নারীপক্ষের উলুতে সম্পন্ন হল বিবাহ অনুষ্ঠান, হ্যাজাকবাতি জ্বেলে। গ্রামের কিছু পরিবারের মাত্র একজন করে এসেছেন আমন্ত্রিত হয়ে, দুটি ঘরের মেঝেতে আসন, খাবার পরিবেশন করা হল কলাপাতায়। তত বেশিকিছু পদ নেই। তবে পুকুর থেকে জাল ফেলে ধরা পোনা মাছের

অপূর্ব স্বাদের জন্য ধন্য ধন্য করতে লাগল সবাই।

পাত্রীটি খুবই লাজুক এবং সুশ্রী। রগচটা গোবিন্দ গাঙ্গুলি মাথায় টোপর পরে শান্ত শিষ্টভাবে সব স্ত্রী-আচার মেনে নিলেন। হুল্লোড়-চ্যাঁচামেচি বাদ থাকলেও অনেকদিন বাদে এই পল্লিতে একটা অনুষ্ঠান হল। এবং তা নির্বিঘ্নে মিটে যাওয়ায় সকলেই খুশি।

পরিশ্রমে সব শরীর ঘর্মাক্ত, এক সময় চুনীকাকা কিশোরটিকে কাঁধে হাত রেখে সস্নেহে বললেন, কী রে, ভালো কইরা খাইছস তো? এর পরের যার যখন আসবি, তরে আমি তুইল্যার চরে নিয়ে যামু।

অন্য সবাই পান চিবুতে চিবুতে কুশল সংবাদ বিনিময় করছেন, বরযাত্রীদের সঙ্গে হাস্যপরিহাসও চলছে মাঝে-মাঝে। এইরকম সময়ে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করা সম্ভব নয় যে এখানে অনেকের সঙ্গে অনেকের এই শেষ দেখা। এরপর কে কোথায় ছিটকে পড়বেন তার ঠিক নেই।

কিশোরটির সঙ্গে তার প্রিয় চুনীকাকার আর দেখা হয়নি ইহজীবনে। তুইল্যার চর নামক স্থানে বিশেষ দ্রষ্টব্য কী আছে, তাও জানা হয়নি তার।

রাজ্জাক হাওলাদার

কানাডার মন্ট্রিয়েল শহরে সপরিবারে থাকে রাজ্জাক হাওলাদার। তার স্ত্রীর নাম ফরিদা পারভিন। দূর বিদেশে এসে যারা মধ্যবয়সে থিতু হতে পেয়েছে, তাদের প্রায় সকলেরই থাকে এক দুরন্ত সংগ্রামের ইতিহাস। শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, অনেককেই দেশ ছাড়তে হয় বাধ্য হয়ে। রাজ্জাকরা ছয় ভাই, উনিশশো একাত্তর সালে এই ছয় ভাই-ই যোগ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। তখন রাজ্জাকের বয়েস খুবই কম। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হল। পাকিস্তানি আমলে এখানকার সাধারণ মানুষদের বিদেশে যাওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর বহুসংখ্যক যুবক পাড়ি দিতে লাগল ইউরোপ-আমেরিকা, অধিকাংশই নিজের দেশে জীবিকা অর্জনের সুযোগ না পেয়ে (স্বাধীন ভারতেও অজস্র বেকার, কিন্তু ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবাংলার গ্রামের বেকার ছেলেরা বি . এ . পাস করেও চাকরি পায়নি। ঢাকা শহরে ঘোরাঘুরি করতে-করতে এক সাহেবের বদান্যতায় জার্মানি যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। সেখানে তাকে অসম্ভব পরিশ্রম করতে হত, সহ্য করতে হত নানাবিধ কষ্ট, কিন্তু হঠাৎ সে এক দয়াবতী মাতৃসমা, বিদুষী ও ধনী, চিরকুমারী (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জার্মানিতে পুরুষের সংখ্যা খুবই কমে যাওয়ায় অনেক মেয়েই তাদের পছন্দের স্বামী পায়নি) এক মহিলা রাজ্জাককে শুধু যে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন তাই-ই নয়, তার মানসিক প্রসারতা গঠনেও সাহায্য করেন অনেক। মহিলা নিজের চেষ্টায় বাংলা লিখেছেন। রাজ্জাকের গ্রামের বাড়িতে এসেও থেকে গেছেন।

যাই হোক, কানাডার উপার্জনের সুযোগ বেশি বলে রাজ্জাক এক সময় জার্মানি ছেড়ে চলে আসে। এখন সে মন্ট্রিয়েলের পাকাঁপাকি বাসিন্দা, দু’টি ছেলমেয়ের মধ্যে মেয়েটির একটি স্থায়ী অসুখ আছে, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা ওদেশেই ভালো বলে সে আর কানাডা ছাড়বে না।

মোটামুটি নিশ্চিন্ত আশ্রয় ও সংসার, তবু মাঝে মাঝেই তাকে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। সে কিছুতেই নিজের জন্মগ্রামের কথা ভুলতে পারে না, যখন তখন দেশে চলে আসে, গ্রামের মাটির ঘ্রাণ নেয়, গ্রামের মানুষের নানারকম সাহায্য করে, চিকিৎসার বা ঋণমুক্তির। একবার সে পাকাঁপাকিভাবে চলে আসবে ভেবে, মাদারিপুর শহরে ওকালতি শুরু করেছিল। বিশেষ সুবিধা হয়নি। তবু বছরে একবার অন্তত সে গ্রামে আসবেই।

শুধু নিজের গ্রামে নেয়, সে কলকাতায়ও আসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার কাছাকাছি কয়েকটি জায়গায় সে ট্রেনিং নিয়েছিল। এই অঞ্চলটি তার মোটামুটি চেনা। এখানে একটি মেয়ের সঙ্গে তার প্রেম-প্রেম ভাবও হয়েছিল। কিন্তু তা বেশি দূর গড়ায়নি।

রাজ্জাকের একটি প্রিয় শখ হচ্ছে, কলকাতার সন্নিকট অঞ্চলে কোথায়-কোথায় তার গ্রামের মানুষরা আশ্রয় নিয়ে আছে, তাদের খুঁজে বার করা। পূর্বপাকিস্তান বা বাংলাদেশের গ্রাম থেকে হিন্দুরা তো একসঙ্গে দল বেঁধে আসেনি, নানা ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে এসেছে। গরিব মানুষরা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে বাধ্য না হলে আসতে চায় না, পশ্চিমবাংলায় বা ভারতে কোথাও এই উদ্বাস্তুরা স্বাগত নয়, তবু এসেছে। রাজ্জাক তার ছেলেবেলায় গ্রামে অনেক হিন্দু দেখেছে। হিন্দু শিক্ষকদের কাছে পড়ছে, অনেক হিন্দু ছেলে ছিল তার বাল্যকালের খেলার সাথী। রাজ্জাক পশ্চিমবাংলায় এসে তার খেলার সাথীদের সঙ্গে পুনর্মিলন চায়। কয়েকজনকে যথাসাধ্য সাহায্য করে। এরই মধ্যে একটি কাহিনি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য।

রাজ্জাকের গ্রামের এক বাল্যসঙ্গীর নাম কালীপদ। তাদের একটি বিস্কুট তৈরির ছোটখাটো কারখানা ছিল। কোনও এক সময়ে সেই বিস্কুটের কারখানা আগুনে পুড়ে যায় কিংবা আগুন লাগানো হয়। কিংবা কিছু একটা ঘটেছিল, কালীপদদের বাড়ির সবাই দেশান্তরী হয়। ওই গ্রামের আরও অনেকটা উদ্বাস্তু কলকাতার মফস্বলে গড়িয়ার কাছে কামালগাজি অঞ্চলে কলোনি করে আছে। এতদিনে অনেকেই দাঁড়িয়ে গেছে মোটামুটি। শুধু কালীপদ কিছুতেই সুবিধা করতে পারেনি। এখানেও সে একটা বিস্কুটের কারখানা করতে চেয়েছিল, প্রতিযোগিতায় করতে পারেনি। এখন সে একটা পাউরুটির কারখানায় দিনমজুর। বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে তার থাকার জায়গাটিও নড়বড়ে। রাজ্জাক পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার পর তার বাসস্থানের দূরবস্থা দেখে নিজে টাকা দিয়ে একটা ছোট পাকা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। একে ঠিক নিয়তির পরিহাস বলা চলে না। নিয়তি মাঝে মাঝে মানবিকও হয়। পূর্ব বাংলার যে-গ্রাম থেকে কালীপদ বাড়িঘর ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে, সেই গ্রামেরই একজন মানুষ এসে পশ্চিমবাংলায় তার জন্য বাড়ি গড়ে দিয়েছে।

রাজ্জাক এ ব্যাপার নিয়ে বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। বন্ধুকে আর এক বন্ধু সাহায্য করবে এ তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার! ঠিক! আমরাও তো ভেবেছিলাম, াংলাদেশের সৃষ্টির পর দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্কটি হবে। হল কোথায়! রাজ্জাকের মতন মানুষ অতি অসাধারণ ব্যতিক্রম হয়েই রইল।

এতক্ষণ আমি ইচ্ছে করেই রাজ্জাক কোন গ্রামের মানুষ, সে নামটি উল্লেখ করেনি। পুব মাইজপাড়া। যেখানে ছিল আমাদের পিতা-পিতামহের বাড়ি। রাজ্জাক আমার কোনও একটি লেখা পড়ে আবিষ্কার করে যে আমি তার গ্রাম-সহোদর। রাজ্জাকের যাবা বেঁচে ছিলেন একশো বছর। তেমন লেখাপড়া জানতেন না। তবুও বিদ্যাশিক্ষাকে সমীহ করতেন বলেই দৃঢ় ইচ্ছায় সব ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তিনি প্রায়ই আপশোশ করে বলতেন, কত লেখকদের কথা শুনি, আমাদের গ্রামে কোনও লেখক জন্মায়নি। আমার পরিচয় জানার পর রাজ্জাক তার বাবাকে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে, হ্যাঁ, একজন লেখক আছে এই গ্রামেরই। যদিও সে এখন পশ্চিমবাংলায় থাকে। তিনি বলছিলেন, তাকে একবার এনে দেখাতে পারবি?

তা পারা যায়নি, তিনি এর মধ্যে চক্ষু বুজেছেন। তারপর রাজ্জাক জেদ ধরেছে, আমাকে একবার সেই গ্রামে নিয়ে যাবেই!

রাজ্জাকের সঙ্গে আমার দেখা বছর তিনেক আগে মন্ট্রিয়েল শহরেই। স্থানীয় বাংলাদেশিদের একটি সভায় আমি কবিতা পাঠ করেছিলাম। সভা শেষে ভিড়ের মধ্যে একজন কেউ এসে বলেছিল, আমি আর আপনি এক গ্রামের লোক, তা শুনে আমি তার প্রতি আলাদা কোনও মনোযোগ দিইনি। বস্তুত, সে স্বল্প সাক্ষাৎকারটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। রাজ্জাক পরে আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। পরে ঢাকাতেও নাকি একবার দেখা হয়েছিল রাজ্জাকের সঙ্গে। তেমনই ভিড়ের মধ্যে, সেবারেও তর পরিচয় জেনে মনে দাগ কাটেনি। মানুষের নানারকম পরিচয় থাকে, নিছক এক গ্রামের মানুষ বলেই তার প্রতি বিশেষ আগ্রহ হবে, গ্রাম-প্রীতি আমার নেই।

এর পরেও সে চিঠি লিখে আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিল। আনন্দবাজার পত্রিকা দপ্তরে তার প্রেরিত চিঠি কোথায় লুকিয়ে রইল, পৌঁছয়নি আমার হাতে। প্রকাশকদের কাছ থেকে আমার ঠিকানা জানতে চেয়েছিল, প্রকাশকরা এসব চিঠির উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব মানেন না। কিন্তু রাজ্জাক হাওলাদার তো এক অদম্য পুরুষ, আর আমার ঠিকানা এমন কিছু দুর্লভ বা গোপন ব্যাপারও নয়। এক সময় সে ঠিকানা সংগ্রহ করে ফেলল এবং ফোন নাম্বার। তারপর শুরু হল প্রতি সপ্তাহে একদিন সকালবেলা দূরভাষে ব্যাকুল আহ্বান, আমাকে একবার তার সঙ্গে পুব মাইজপাড়া গ্রামে যেতেই হবে। কেউ এমন আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানালে তা মন স্পর্শ করে ঠিকই। কিন্তু প্রতিবারই এড়িয়ে যাই।

বাংলাদেশে তো প্রায়ই যাওয়া হয় আমার। সেই উনিশশো একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের আগেই বেশ কয়েকবার, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তাঁবুতে ওষুধপত্র, খাবারদাবার ও বেতারযন্ত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য গিয়েছি। এবং ১২ ডিসেম্বর, যখন এদিকের সীমান্ত থেকে পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদ অপসারণ করছে, তখন সদলবলে গিয়েছিলাম ইছামতী নদী পেরিয়ে খুবই বিপজ্জনক মাইন অধ্যুষিত পথ দিয়ে সাতক্ষিরায়। কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধিরা গিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা তোলার জন্য। সাতক্ষিরায় আমরা সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। সেবারে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বীভৎস অত্যাচার ও অসংখ্য নারী ধর্ষণের (যাওয়ার পথে বাংকারে, ফক্স হোলে অজস্র ঘেঁড়া ব্রা-ব্লাউজ ও শাড়ি পড়েছিল চিহ্ন হিসেবে) কাহিনি শুনে মর্মাহত সুভাষদা অতি তীব্র ভাষায় লিখেছিলেন, ক্ষমা নেই।’ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও লিখেছিলেন, ‘ভোমরা থেকে সাতক্ষিরা। এক মাস পরেই গিয়েছিলাম ঢাকায়, তখনও সেখানে বিজয়-উৎসব চলছে।

তারপর এতগুলি বছরে বহুবার গেছি ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিং, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার: কলকাতা থেকে যে যশোর রোডের শুরু সেই রাস্তা ধরে সোজা পৌঁছেছি যশোর শহরে। বাংলাদেশে আমার বহু বন্ধু ও আপনজন। সেখানকার প্রায় সব কবি ও গদ্য লেখকরাই আমার সুহৃদ ও স্নেহভাজন। গাজি সাহাবুদ্দিনের বাড়ি সব সময় আমার ও স্বাতীর জন্য অবারিত দ্বার, ঢাকায় শান্তিনগরের হোয়াইট হাউজ নামে এক হোটেলের মালিক মাসুম ইকবাল আমাকে বলেছিলেন, সারা জীবনে যতবার খুশি আমি সেই হোটেলে গিয়ে থাকতে পারি, খদ্দের হিসেব নয়, তাঁর অতিথি হিসেবে। এই ধরনের কথা শুনলেই কৃতজ্ঞতায় মন দ্রব হয়ে যায়। যেখানে যত কাজই থাক, বাংলাদেশ থেকে কোনও ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেলেই ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়। এমনকি, এই তো গত বছরই, হুমায়ূন আহমেদ আমন্ত্রণ জানাল, সে যে ফিলমের শুটিং করছে, তার শেষ দিয়ে সবাই মিলে একটা ঘরোয়া উৎসব করবে, সেখানে কি আমি যোগ দিতে পারি না? অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহারুল ইসলামও সেই দাবি জানাল। একটা জরুরি লেখা অসমাপ্ত রেখে, সেই ফিল্মের সঙ্গে আমার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক না থাকলেও, সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে উৎসবে গা ভাসিয়ে দিলাম। (আক্ষরিক অর্থেই বা ভাসানো, সেই উৎসবের অনেকটা অংশ, গাজিপুরে, হুমায়ুনের নিজস্ব চলচ্চিত্র গ্রামের সুইমিং পুলে প্রায় ঘণ্টা তিনেক ধরে স্নান-পান এবং আড্ডা ও গান।)

কিন্তু নিজের গ্রাম দেখতে কখনও যাইনি। একবার বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে পৃথিবীর নানান দেশের পরিদর্শকদের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ভারতের দশজন প্রতিনিধির মধ্যে স্থান পেয়ে গিয়েছিলাম আমিও। আমি নিজেই বেছে নিয়েছিলাম বরিশাল জেলা (তপন য়ায় চৌধুরীর একটি অত্যুৎকৃষ্ট বই পড়ে আমার বরিশাল শহরটি দেখার খুব আগ্রহ হয়েছিল, তা ছাড়া জীবনানন্দ দাশের বাড়ি ও ধানসিড়ি নদী দেখার আকাঙ্খ)। আমাদের দেওয়া হয়েছিল একটি এসি গাড়ি, সেই গাড়ি নিয়ে আমরা যে-কোনও ভভাটকেন্দ্র বা যত্রতত্র ঘুরতে পারি, সেবারে আমার সঙ্গী হয়েছিল ভ্রাতৃপ্রতিম ইমাদাদুল হক মিলন। ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে বিক্রমপুর হয়ে, মিলনের গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে, মাওয়া ঘাট পেরিয়ে ওপারে পৌঁছলাম মাদারিপুর শহরে। এর তো খুব কাছেই আমাদের পৈতৃক গ্রাম ও মামার বাড়ি, মিলন বারবার বলেছিল, চলুন না আপনাদের বাড়িটা খুঁজে দেখি, ঠিক পাওয়া যাবে। আমি রাজি হয়নি, আমার যেতে ইচ্ছে হয়নি।

এই অনিচ্ছার জন্য কিন্তু কোনও অভিমান বা ক্ষোভ নেই। দেশভাগ একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। ইতিহাসে এমন বারবার বহু দেশেই ঘটেছে যে রাজা বা শাসক সম্প্রদায় বা নেতৃত্বের কোনও ভুল সিদ্ধান্তের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন ছে, কতবার দেখা গেছে অসহায় উদ্বাস্তুদের স্রোত। আমাদের এই দেশভাগ অবধারিত ছিল কি না, সে প্রশ্নের মীমাংসা বোধ হয় কোনওদিনও হবে না। তবে সেই দেশ ভাগের জের এখনও চলছে। মানুষের অশিক্ষা ও দারিদ্র্য ঘোচাবার বদলে চলেছে অস্ত্রের আস্ফালন, বেড়ে চলেছে ধর্মান্ধতা ও নির্বোধ মৌলবাদ, অপূর্ব সুন্দর শান্ত কাশ্মীর রাজ্যটি ছারখার হয়ে যাচ্ছে। রেষারেষি ও হানাহানির জন্য এই তিনটি দেশেরই বৈষয়িক উন্নতি হয়নি, তার চেয়েও বেশি দুঃখ হয় মানবিক অধঃপতন দেখে। যুক্তি ও মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে, ক্ষুদ্র স্বার্থের লোভে আমরা বৃহৎ ক্ষতি করে চলেছি। সামনের দিকেও কোনও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশানা নেই। দেশভাগ হয়েছে ছাপ্পান্ন বছর আগে। যে-কোনও কারণেই হোক ছেড়ে আসা গ্রামের বাড়ি এতগুলি বছর পরেও অবিকৃত, অভগ্ন থাকতে পারে না। অনেক গাছই এতদিন বাঁচে না। সেই গ্রামের পরিমণ্ডলটাই এতদিনে বদলে যেতে বাধ্য। কিন্তু আমার মনের মধ্যে চোদ্দ বছর বয়েসে শেষবার দেখা সেই দুটি গ্রামের ছবি অতি উজ্জ্বলভাবে বাঁধান আছে। Pristine এই ইংরেজি শব্দটি ব্যবহার করতে ইচ্ছে হয়। অতীতের সেই ছবিটাই আমি রেখে দিতে চাই তাই আমার কাছে বর্তমান চিত্রের প্রয়োজন নেই।

এর মধ্যে যা-যা ঘটেছে, তার কিছু-কিছু অংশ কানে এসেছে। চুনীকাকা খুন হয়েছিলেন মাদারিপুর থেকে বাড়ি ফেরার পথে। সেই চ্যাটার্জির মেয়ে প্রভা ছাড়া আর কারুর কথা কখনও শুনিনি। অন্য চ্যাটার্জিদের বাড়ির একজন, অতুলকাকা কাজ করতেন নেভিতে। সাদা রঙের প্যান্ট-সার্ট-কোট ও মাথায় নীল রঙের টুপি পরে তিনি গ্রামে হাজির তেন হঠাৎ। আমাদের চোখে তিনি ছিলেন এক রহস্যময় পুরুষ। সেই অতুলকাকাকে আমি পরবর্তীকালে স্বপ্নে দেখেছি বহুবার। তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

আমার জ্যাঠামশাইও কিছুদিন পরেই বাড়ির সব কিছু ফেলে রেখে, শুধু ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। প্রথম কিছুদিন আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। তখন আমার বাবার একমাত্র উপার্জনে সকলের গ্রাসাচ্ছাদন, খুবই কায়ক্লেশে কেটেছে সেই সব দিন। আমার বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, তখনকার দিনে শিক্ষকের বেতন ব্যাংকের ঝাড়দারের চেয়েও কম, বাবা তিন-চারটে টিউশনিও করতেন। ভোর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত একটানা পরিশ্রম। তখনই তাঁর স্বাস্থ্য ভাঙে। জ্যাঠামশাই কোনও ক্রমে একটা চাকরি জুটিয়ে পৃথক বাড়িতে চলে যান। বাকি জীবন তাঁকে মনে হত, একজন মেরুদণ্ড ভাঙা মানুষ, গলার আওয়াজ হয়ে গিয়েছিল খোনাখোনা। আমার দুই কাকার মধ্যে একজন আমাদের বাড়িতেই থেকে গেছেন। অন্যজন কোনওভাবে জুটে গিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনে।

পূর্ব মাইজপাড়া ব্রাহ্মণ পল্লিটি একবারে শূন্য হয়ে গিয়েছিল। ওদিকে আমগ্রামে আমার মামা গোবিন্দ গাঙ্গুলি থেকে গিয়েছিলেন অনেকদিন জেদ করে। কেন যেন তাঁর ধারণা হয়েছিল, দেশ বিভাগ বেশিদিন টিকবে না, আবার জোড়া লেগে যাবে। যেসব হিন্দু পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে চলে আসছিল, তিনি তাদের জমিজমা কিনে নিচ্ছিলেন, ভবিষ্যতে তারা ফিরে এলে সেইসব জমিজমা প্রত্যর্পণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আমার মায়ের সেজো মামা অর্থাৎ গোবিন্দ গাঙ্গুলির কাকা সুরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে। এখানে তিনিও প্রতিষ্ঠিত, মতিঝিলে তাঁর সুদৃশ্য বাড়ি, তাঁর ছেলেরাও উচ্চশিক্ষিত, মেয়েরা সম্পন্ন ঘরে পাত্রস্থ, এঁরা সবাই প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময় গ্রামে যেতেন, সেখানকার, পুজোর উৎসবে মেতে থাকতেন, দেশত্যাগের পর আর যাননি। গ্রামের সেই পুজো বন্ধ হয়ে গেলেও চালু হয়ে গেল কলকাতা সংলগ্ন মতিঝিলের বাড়িতে।

শুধু গোবিন্দ গাঙ্গুলি একা কুম্ভের মতো রয়ে গেলেন নকল বুদির গড় সামলাতে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রজারা মান্য করত তাঁকে। পুরো পূর্ব পাকিস্তানের আমল কাটিয়ে দিলেও তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে আর টিকতে পারলেন না। সামরিক শাসনের সময় গ্রাম বাংলায় অরাজকতা চলছিল, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হয়েছিল। তাই কে একদিন স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের নিয়ে চুপিচুপি পালিয়ে এলেন কলকাতায়। শুনেছি, আসবার দিয়ে, উঠোনের তারে কাপড় শুকাতে দিয়ে, রান্নাঘরে উনুন জ্বেলে, সব দরজা-জানালা খুলে রেখে ভোরবেলায় চলে আসেন। এটা গল্পের মতন শোনায়, আমি সঠিক কারণ জানি না। হয়তো গৃহত্যাগের সংবাদ রটে গেলে পথে লুটপাটের সম্ভাবনা ছিল সেসময়ে। সেই তেজি পুরুষ গোবিন্দ গাঙ্গুলি পশ্চিমবাংলার মফস্বলে এসে কাঁচুমাচু ধরনের মানুষ হয়ে যান। নিজ গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে অনেকেই তাঁকে নমস্কার ও সেলাম করত, এখানে তাঁকে কে চেনে! চৌরাস্তার ভিড় তাঁকে ধাক্কা দিয়ে লোকেরা চলে যায়, বাসে উঠলে কোনও হেঁজিপেঁজি লোক তাঁর পা মাড়িয়ে দেয়। অনেক গাছের চারাকে এক মাটি থেকে তুলে নিয়ে অন্য মাটিতে পুঁতলে কেমন যেন নেতিয়ে থাকে, এইসব মানুষদেরও সেই অবস্থা।

অনেক মুসলমানও পশ্চিমবাংলা তথা ভারত থেকে পাকিস্তানের দুই অংশে চলে গেছে, বা চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। তাদের জীবনেও এরকম ট্র্যাজেডি ঘটেছে। হয়তো তুলনামূলকভাবে তাদের সংখ্যা কম, তবু একজন মানুষের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়েও রচনা করা যেতে পারে।

নিজের বাড়ি কিংবা মামাবাড়ির সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক মুছে গেলেও, মাঝে-মাঝে মনে পড়ে সেই ছবি, এতকাল ধরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পটি পড়লেই আমার মনে পড়ত, আমাদের পাড়ার বড় চাটুজ্যেদের বাড়িটির কথা। ঠিক যেন ওইরকম বাড়িরই বর্ণনা। আমি নিজেও যখন কোনও গ্রামের পটভূমি নিয়ে গল্প লিখেছি, পশ্চিমবাংলার গ্রামের বদলে আমার অবচেতনে পূর্ব বাংলায় আমার চেনা গ্রামের ছবিই এসে যেত প্রথম দিকে। পরে, বাস্তবতার খাতিরে পশ্চিম বাংলার গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি অনেকবার।

জ্যাঠামশাই আমাদের বাড়ি-জমি বিক্রি করে আসতে পারেননি বা সে সুযোগ পাননি। ওদিককার শহরের হিন্দুরা এদিককার শহরের মুসলমানদের সঙ্গে সম্পত্তি বিনিময় করতে পেরেছেন অনেকে, গ্রামের মানুষদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। পাকিস্তানি আমলের শেষ দিকে হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ি-জমিকে শত্ৰু-সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা হয়। তা শুনে আমি হেসেছিলাম। এটা পরিহাস ছাড়া আর কী! আমাদের মতন অনেকেই পূর্ব বাংলার নদী-মাটি-গাছপালার ছবিকে ভালোবেসে বুকে ধরে রেখেছে, সেখানকার মানুষদের আত্মীয়জ্ঞান করে, হঠাৎ আমরা তাদের শত্রু হয়ে গেলাম কী করে? ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে, উলু খাগড়া পুড়ে মরে’, কত তীব্র সত্য এই প্রবাদ!

স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর যাতায়াত এত সহজ হয়ে গেলেও আমি মাদারিপুর অঞ্চলে যেতে চাইনি। তার আরও একটা কারণ আছে। অল্প বয়েসে, যখন পাকিস্তানে যাওয়া দুরূহ ছিল, তখন জন্মভূমি পুনর্দর্শনের তীব্র সাধ হত। আমার যাবা মৃত্যুকালে ‘বাড়ি যাব’, ‘বাড়ি যাব’ বলেছিলেন, সে বাড়ি তাঁর পূর্ব মাইজপাড়ার কুটির। আমার মৃত্যুকালে এরকম খেদ হওয়ার কথা নয়। কারণ, জন্মস্থান সম্পর্কে আমার সেই টান নেই। আরব্য উপন্যাসের সেই সমুদ্রে ডোবা কলশির দৈত্যের মতন মানুষের জীবনেও মতামত বা মনোভাবের বদল হতে পারে কয়েকবার। এখন আমি অনেকটা ঠাট্টা করে বলি, অনেকেই তো নার্সিংহোমে জন্মায়, তারা কি জন্মস্থান হিসেবে সেই নার্সিং হোম আবার দেখতে যায়? এমনকি দেশ সম্পর্কেও আমার মোহ ঘুচে গেছে। দেশ আবার কী? আমরা তো বিশ্বনাগরিক হতে চেয়েছিলাম। এক সময় ওয়েন্ডেল উইলকির লেখা ‘ওয়ান ওয়ার্লড’ নামে একটি বই পড়ে ভেবেছিলাম, যতদিন না মানুষ সারা পৃথিবীকে সীমানামুক্ত এবং স্বাধীনভাবে যদৃচ্ছ বিচরণক্ষেত্র হিসেবে পাবে, ততদিন ঝগড়া, মারামারি বা যুদ্ধ হয়, তখন তাকে বাল্যখিল্যতা ছাড়া আর কী বলা যায়?

যাই হোক, অনেক দূরে সরে এসেছি।

রাজ্জাক হাওলাদার একেবারে নাছোড়বান্দা। আমাকে টানতে পেরে সে অন্য পথ ধরল। টেলিফোন করেই তো বলে, দাদা একটু বউদির সঙ্গে কথা বলতে পারি? স্বাতীর সঙ্গে সে দিব্যি ভাব জমিয়ে নিল আর তাকে বোঝালে, বউদি, আমি আপনার গ্রাম সম্পর্কে দেওর, আপনি আমাদের গ্রাম দেখতে যাবেন না? স্বাতী সঙ্গে-সঙ্গে রাজি। এমনিতেই সে খুব ভ্রমণপিপাসু, শরীরে কখনও ব্যথা বেদনা থাকলেও বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই সব সেরে যায়, বাংলাদেশে অনেকবার গেছে, সেখানকার অনেকের। বন্ধুত্ব, সে রাজ্জাককে বলল, হ্যাঁ, আমি আবার শ্বশুরের ভিটে দেখতে যাব!

স্ত্রীদের অনুরোধ বা আবদার তো আসলে হুকুমেরই সমান। তা অগ্রাহ্য করার সাহস আমার নেই। তবু আমি নানান কায়দায় এড়িয়ে যেতে লাগলাম, আচ্ছা ঠিক আছে, পরে দেখা যাবে, এখন তো সময় নেই, এই সব বলে। সত্যি সত্যিই, আমার মন একটুও টানেনি।

এর মধ্যে রাজ্জাক তার লেখা একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি, ‘বাকি রয়ে গেছে কিছু পাঠিয়ে দিল আমার কাছে, ভূমিকা লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে। সবল, সাবলীল ভাষায় তার জীবনের অভিজ্ঞতা, তার মধ্যে অনেক সমসাময়িক চিত্র ফুটে উঠেছে। ধর্মের নামে স্বার্থপরতা ও ভণ্ডামি সম্পর্কেও অনেক তীব্র মন্তব্য আছে।

আবার হঠাৎ আমাকে একবার মন্ট্রিয়েল যেতে হল। সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার ব্যাপারে। এ খবর জানাজানি হতে দেরি লাগে না, রাজ্জাক অনুরোধ জানাল, আপনি যখন মন্ট্রিয়েলে আসছেনই, এক সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে ডাল ভাত খেতেই হবে। সে এতবার চিঠি লিখেছে ও টেলিফোন করেছে যে তার অনুরোধ উপেক্ষা করা যায় না। টরেন্টো থেকে গাড়ি নিয়ে বেরুনো হল, অশোক চক্রবর্তী, তার স্ত্রী ভারতী এবং কান্তি হোড়ের সঙ্গে। মধ্যপথে অটোয়ায় থামতে হল আমার শ্যালিকা জয় তাঁকে দেখে আসার জন্য, তারপর মন্ট্রিয়েলে রাজ্জাকের বাড়িতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল বেশ! এই প্রথম রাজ্জাক হাওলাদারের সঙ্গে প্রকৃত সাক্ষাৎ। নাতিদীর্ঘ, শ্যামলা রঙের মানুষটি, উৎসাহে একেবারে ভরপুর, জীবনীশক্তিতে সবসময় টগবগ করছে। (একটা কথা আমি রাজ্জাককে কখনও বলিনি, গায়ের রং ছাড়া তার সঙ্গে আমার বাবার চেহারার বেশ মিল আছে, শুধু তার ছোট গোঁফ এবং গলায় আওয়াজ আলাদা।)

রাজ্জাক একটা অনুষ্ঠানেরই আয়োজন করে ফেলেছে। তার অ্যাপার্টমেন্টে অনেক আমন্ত্রিত বিশিষ্ট নারীপুরুষ। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপারটি ঘটাল তার ছেলে আরিফ, তার বয়েস হবে বছর বারো। ওসব দেশে প্রতিপালিত এই বয়েসি বাঙালি ছেলেমেয়েরা শিখতেই চায় না, কিন্তু আরিফ গোটা-গোটা বাংলা অক্ষরে আমার নামে স্বাগত জানিয়ে একটা পোস্টার সেঁটেছে দেওয়ালে, এবং সে ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি নির্ভুল আবৃত্তি করে শুনিয়ে দিল।

সে রাতের আড়ার পর রাজ্জাকের সঙ্গে আবার দেখা হল অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। আমি কলকাতায় ফেরার পরের দিনই। সপরিবারে সে এসেছে বেড়াতে। আমাদের তখন আবার শান্তিনিকেতনে যাওয়ার কথা, ওরা কখনও শান্তিনিকেতন দেখেনি, তাই ওদেরও নিয়ে চললাম আমাদের সঙ্গে। তারপর এক সঙ্গে অনেকদিন কাটাবার ফলে ওদের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধুত্ব হয়ে গেল। রাজ্জাককে ভালো না লেগে উপায় নেই, ওর সুন্দরী স্ত্রী ফরিদা কম কথা বলে, খুব বুদ্ধিমতী, স্বামীর পাগলামিতে উৎসাহ দেয়। ছেলেমেয়ে দুটিও বেশ শিষ্ট। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অনেক রকম সংস্কারমুক্ত।

কলকাতায় এসেও রাজ্জাক কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করল আমার সঙ্গে। আমিও ওর সঙ্গে। ওর সাহায্যে নির্মিত কালীপদর বাড়ি দেখতে গেলাম গড়িয়ার দিকে। এসবের ফাঁকে-ফাঁকে রাজ্জাক আমাকে বারবার বলতে লাগল ওর গ্রামে নিয়ে যাওয়ার কথা। আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই, গায়ের সঙ্গে বাঁশির সঙ্গীতের মতন, ওর কথায় তাল দিয়ে যাচ্ছে স্বাতী। তবু, শেষ চেষ্টা হিসেবে বললাম, ঠিক আছে, যাওয়া যাবে এখন শীতকালে। তখন এপ্রিল মাস, প্রচণ্ড গরম, বাংলাদেশের আবহাওয়া তো প্রায় এখানকার মতন, এই গরমে গ্রামে যেতে ভয় লাগবারই কথা। রাজ্জাক তাতেও রাজি নয়, কারণ, এই কয়েক মাসের ব্যবধানে যদি আমি আবার মত বদলাই কিংবা, আমার তো যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, এর মধ্যে হঠাৎ টুপ করে পৃথিবী থেকে কেটে পড়লে ওর সাধ কিংবা গোঁ অপূর্ণ থেকে যাবে। পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। রাজ্জাক আর স্বাতী, দুজনেই মোগল।

ঘর নেই, ঘরে ফেরা

সেই চোদ্দো বছর বয়েসে শেষবার গিয়েছিলাম, তারপর কেটে গেছে পঞ্চান্ন বছর! ওঃ পঞ্চান্ন বছর, বিশ্বাসই হতে চায় না! কী করে কেটে গেল এত সুদীর্ঘ সময়, এত তাড়াতাড়ি! সমস্ত জীবনযাত্রাটাই যেন ম্যাজিক। আকস্মিক মৃত্যুও তো ম্যাজিকের খেলার মতন।

অবিভক্ত বাংলায় গ্রামে যেতাম ট্রেনে, স্টিমারে, তারপর নৌকোয়। ট্রেন বহুকাল অচল, স্টিমারও বাতিল, এখন অবশ্য কলকাতা-ঢাকা সরাসরি বাস চলে। সে বাসে কখনও উঠিনি, তবে কলকাতা থেকে একবার ঢাকা গিয়েছিলাম গাড়িতে, সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ যুদ্ধের পর, মনোজ বসু ও তাঁর ছেলে ময়ুখের সঙ্গে। তখন যুদ্ধের গোল বর্ষণে অনেক নদীরই সেতু উড়ে গেছে, গাড়িসুষ্ঠু ফেরি পার হতে হয়েছিল ছ-সাতবার। এবারে বেনাপোল সীমান্ত থেকে সোজা মাদারিপুর পৌঁছে গেলাম বাড়িতে, ফেরি পার হতে হল একবারও।

সপরিবারে বাংলাদেশে গিয়েছিল রাজ্জাক, আবার ফিরে এসেছে, আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। শুধু-শুধু অতিরিক্ত খরচ, কিন্তু তার আশঙ্কা, যদি শেষ মুহূর্তে মত বদল করে ফেলি। মন্ট্রিয়েলে গিয়ে দেখে এসেছি, রাজ্জাক কিন্তু ধনী নয়, সাধারণ মধ্যবিত্ত, তবু সে তার শখের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করতে পারে। ধনী হলে বোধহয় এইরকম শখ বা পাগলামি তার থাকতও না।

রাজ্জাক বলে রেখেছিল, আমাদের সঙ্গে যে কজনকে ইচ্ছে নিয়ে যেতে পারি। স্বাতী চায় আমার ভাইবোনরাও আমাদের সঙ্গী হোক, ওরা দেশের বাড়ি দেখেছে খুবই শিশু বয়েসে, এখন আর প্রায় কিছুই মনে থাকার কথা নয়। আমার মেজ ভাই অনিল আর ছোট বোন কণিকার বিশেষ উৎসাহ থাকলেও কিছু-কিছু অসুবিধে থাকায় শুধু ছোট ভাই অশোক সঙ্গে চলল। আমাদের অভিযানে সবচেয়ে খুশি হতেন মা, তিনি মাত্র কয়েক মাস আগে চির-বিদায় নিয়েছেন। মায়ের কাছে এসব গল্প আর শোনানো হল না।

বনগাঁ সীমান্তে এসে চক্ষু চড়কগাছ। শত শত ট্রাক আর গাড়ির ভিড়ে, রাস্তা প্রায় বন্ধ, কত ঘণ্টা লাগবে কে জানে, কিন্তু পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীদের তৎপরতায় খুব সহজেই পার হওয়া গেল। এতকাল লেখালেখি করার এইটুকু সুফল অন্তত পাওয়া যায়। তা ছাড়া, মাত্র এক বছর আগেই আমি ছিলাম কলকাতার শেরিফ, তাতেও বোধহয় কিছুটা নামের ওজন বাড়ে।

এদিককার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে, ওপারে রাজ্জাকের বন্ধুরা অপেক্ষা করছিলেন, ওঠা হল তাঁদের গাড়িতে। প্রথম বিরতি ফরিদপুরে। এই শহরটি সম্পর্কে আমার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আমরা যাতায়াত করতাম মাদারিপুর দিয়ে। সেখানে ফরিদপুর ছিল জেলার নাম, মাদারিপুর একটি মহকুমা শহর। এখন মাদারিপুর নিজেই একটি জেলা। বাংলাদেশের সমস্ত মহকুমাই জেলা হয়ে গেছে। ফরিদপুরে আমাদের মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা, কোনও হোটেলে নয়, রাজ্জাক আমাদের আগমনবার্তা আগেই রটিয়ে দিয়েছিল, ফরিদপুরের লেখক-কবি-সাংবাদিকদের একটি প্রতিষ্ঠান সব আয়োজন করে রেখেছিল একটি বাংলোতে। এরপরে কোথাও রাস্তার ওপর একটি স্কুলের ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করে থাকবে, তাই বেশি দেরি করা যাবে না, তাই খেতে বসেই সকলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় সারতে হল সংক্ষেপে। (আর একবার ফরিদপুরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসতে হল, তবে এই ধরনের অনেক প্রতিশ্রুতিই শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা যায় না।)

সেখানেই কে যেন বললেন, ফরিদপুরের জেলাপ্রশাসকের সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে হবে, তিনি অপেক্ষা করে বসে আছেন। প্রস্তাবটা আমার মনঃপূত হল না। খামোখা আমলাদের সঙ্গে দেখা করতে যাব কেন? কী কথা বলব তাঁদের সঙ্গে? আমি পুরোপুরি বেঁকে বসবার আগেই ওখানকার কয়েকজন বললেন, অন্তত কয়েক মিনিটের জন্য সৌজন্য সাক্ষাৎকার না করলে ভালো দেখায় না। যাওয়ার পথে একটু থামলেই হবে।

আমরা অনেক সময়ই ভুলে যাই যে জজ-ম্যাজিস্ট্রেটরাও আমার-আপনার বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতনই। স্কুল-কলেজ জীবনে তাঁরাও অন্য ছাত্রদেরই মতন শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করেন। পরে কেউ কেউ হয়তো ওসবের আর তোয়াক্কা করেন না। ফরিদপুরের ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার একজন সুদর্শন, যুবক, মৃদুভাষী, এখনও সাহিত্যপাঠে বিশেষ আগ্রহী। এঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করা যায়।

কিন্তু বিপদ এল অন্য দিক দিয়ে। একটুক্ষণ কথা বলার পরই ডি . সি . বললেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে, আসুন আগে খেয়ে নেওয়া যাক।

আমরা যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আবার খাব! মাত্র দশ-পনেরো মিনিট আগেই ভরপেট খাওয়া হয়ে গেছে। এখন আর কিছু মুখে তোলা অসম্ভব। তবু ডি . সি . সাহেবের উপ-কর্মচারী জোরাজুরি করতে লাগলেন। এখানেও কিছু রান্না হয়ে গেছে। লেখক সমিতি যে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করে রেখেছে, তা এই সরকারি মহল জানতেন না, আর এখানকার প্রস্তুতির কথাও জানেননি ওঁরা। তা বলে তো আমরা দুবার খেতে পারি না! কেউ একজন আমার কানে-কানে বললেন, ডি সি সাহেব নিজেও এতক্ষণ না খেয়ে অপেক্ষা করছেন, একবার অন্তত ওঁদের সঙ্গে খাবার টেবিলে না বসলে খুবই অভদ্রতা হবে।

পাশের প্রশস্ত কক্ষে লম্বা টেবিলে থরেথরে খাদ্যবস্তু সাজানো! কত রকম যে পদ, তা গুনে শেষ করা যায় না। খাদ্য এমনই বস্তু ক্ষুধার্ত অবস্থায় যে সুখাদ্য দেখলে লোভে চক্ষু চকচক করে, পেট ভরতি থাকলে সেই খাদ্যের দিকে তাকাতেই ইচ্ছে করে না। প্লেটে দু-একটা পদ একটু নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই হল।

বাংলাদেশের আতিথ্য নিয়ে আমার অনেকরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। খাদ্য নিয়ে এঁরা বড় বাড়াবাড়ি করেন। কারওকে দাওয়াত দিলে প্রত্যেকে বাড়িতেই এতগুলিপদ প্রস্তুত করা হয়, যা একজন মানুষের শুধু চেখে শেষ করাও অসম্ভব। যদি কারও পক্ষে সম্ভবও হয়, তারও খাওয়া উচিত নয়। পাঁচ রকমের মাছ, তিন রকমের মাংস, আরও কত রকমের ভর্তা ও ভাজাভুজি, চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় কিছুই বাদ থাকে না। ঢাকায় এক বাড়িতে সকালবেলা নাস্তা খেতে গিয়ে দেখি, বিরিয়ানি ও তিন রকম মাংস ও ফিরনি ইত্যাদি। সকালবেলাতেই বিরিয়ানি ভোজন আমাদের কাছে অকল্পনীয়। একটা প্রবাদ আছে, ‘হিন্দু লোকের বাড়ি, মুসলমানের হাঁড়ি আর মেয়েমানুষের শাড়ি।’ হিন্দুরা একটা বাড়ি বানাবার স্বপ্ন দেখে টাকা জমায়, আর মুসলমানরা খেয়ে ও খাইয়ে সব টাকা উড়িয়ে দেয়। তৃতীয়টি সম্পর্কে মন্তব্য অনাবশ্যক।

ডি সি সাহেব এর পরেও আবার এক কাণ্ড করলেন। খুব নিরীহভাবে অনুরোধ করলেন, কয়েক মিনিটের জন্য তাঁর বাড়ি যেতে হবে। তাঁর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে পরিচয় করালেন আর সেখানে এক কাপ চা। চায়ের সঙ্গে টায়ের পরিমাণ দেখেই চক্ষু চড়কগাছ। আবার অনেক রকম নোনতা ও মিষ্ট দ্রব্য এবং বাছাই করা সব ফল। গৃহস্বামিনীর আন্তরিকতা ও দ্রব্যগুলি যতই সুস্বাদু হোক, এখন যে হাঁসফাস করার মতন অবস্থা! আমি বামুনের ছেলে হিসেবে সবকিছ ছাঁদা বেঁধে নেওয়ার প্রস্তাব দিতে যাচ্ছিলাম। যদি এটা কলকাতায় ফেরার পথে হত, তা হলে নিশ্চিত এসব পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে আসতাম। বাংলাদেশে খাদ্য নিয়ে এই কাণ্ড দেখার অভিজ্ঞতা স্বাতীরও কিছুটা আছে, কিন্তু আমার ছোট ভাইয়ের কাছে সবই বিস্ময়কর।

মাদারিপুর পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে লিগাল এড সেন্টারের অতিথিশালায়। সেখানে অনেকগুলি ঘর, তার মধ্যে কয়েকটি বাতানুকূল। তা ছাড়াও এখানে রয়েছে একটি বড় আকারের ক্যান্টিন, আলোচনা কক্ষ, গ্রন্থাগার ইত্যাদি। বেশ বড় কমপ্লেক্সে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এতবড় আইন পরিসেবা কেন্দ্র পশ্চিমবাংলার কোনও মফস্বল শহরেই নেই।

এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন ডাক্তার আবদুল বারি। এঁর কথা রাজ্জাকের কাছে আগেই শুনেছি। ইনি সকালবেলা চোখের ডাক্তার, বিকেলবেলা অন্য মানুষ। সকালে প্রথম দু’ঘণ্টা ডাক্তারি করেন জীবিকা হিসেবে, তার পরের দুঘণ্টা বিনা পয়সায়। মূলত সমাজ সেবক ডাক্তার বারির আরেকটি বিচিত্র সখ আছে, মোটর সাইকেল করে তিনি গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়ান, হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাডিগুলির ইতিহাস সংগ্রহ করেন। এভাবে তিনি ১,৬০০ বাড়ির ইতিহাস এর মধ্যেই সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে ফেলেছেন। কোন গ্রাম যে অতুলপ্রসাদ সেনের জন্মস্থান, তা ওঁর কাছেই পরে শুনেছি। অতুলপ্রসাদ সেনের পরিবারের প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল এখনও চলে।

আমাদের বাড়ি নিয়ে বেশ একটা মজার ব্যাপার হয়েছিল।

পুব মাইজপাড়ায় ঠিক কোথায় ছিল আমাদের বাড়ি তা জানা যাবে কী করে? আমার স্মৃতি খুবই আংশিক। বীরমোহন স্কুলটির কথা মনে আছে, একটা কাঠের সেতু পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়, একটা সোজা রাস্তা চলে গেছে, ব্রাহ্মণ-পল্লিটি সেখানেই শেষ, সে পল্লির প্রতিটি বাড়ি আমার মনশ্চক্ষে উজ্জ্বল, কিন্তু পুরো গ্রামটি সম্পর্কে আমার ধারণা অস্পষ্ট। সুতরাং আমাদের বাড়ির অবস্থান ঠিক বোঝাতে পারিনি। রাজ্জাকদের পরিবার এখন পুব মাইজপাড়ায় এক গাঙ্গুলিদের বাড়িতে থাকে। অনেকখানি জমি সমেত বেশ বড় বাড়ি। রাজ্জাক আমাকে সেই গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে শুনে কেউ একজন তাকে বলেছিল, তুই তো এত সুনীলদা, সুনীলদা করিস, সুনীলদা যদি এখানে এসে তার বাড়ি ফেরত চায় তা হলে কী করবি? রাজ্জাক তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছিল, সুনীলদা চাইলে আমি সঙ্গে-সঙ্গে ও বাড়িতে আমার অংশ তাঁকে ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াব! এ কাহিনি শুনে আমি হাসতে-হাসতে বলেছিলাম, এই গাঙ্গুলিবাড়িটা আমাদের নয়। মনে আছে, যতু গাঙ্গুলির বাড়ি হিসেবে পরিচিত ও-বাড়ি ছিল কোনও ছোটখাটো জমিদারের। ও বাড়ির ছেলেমেয়েরা ফরসা-ফরসা, ব্যাডমিন্টন খেলত, পুকুর ঘাটে রূপসি মেয়েদের বসে থাকতে দেখতাম। আমাদের ছিল কাঁচা বাড়ি, এতকাল পরে তার অস্তিত্ব থাকাও বোধ হয় সম্ভব নয়।

অস্তিত্ব থাক বা না-থাক তার অবস্থান তো জানা দরকার। তখন গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছিলেন ডাক্তার বারি। ঘুরে-ঘুরে গ্রামের পুরোনো মানুষদের জিগ্যেস করে কয়েকটি গাঙ্গুলিবাড়ির সন্ধান পেলেন, তাতে সমস্যা মেটে না। তারপর মহাফেজখানায় খুঁজে পেলেন, আমার ঠাকুরদা অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে বসতবাড়ির জমির খতিয়ান।

সে রাতেই ঢাকা থেকে এসে উপস্থিত হল বেলাল চৌধুরী আর কবি অসীম সাহা। এখন ডাকা নিবাসী হলেও অসীমেরও বাড়ি ছিল এই মাদারিপুরে, তার বাবা অখিল বন্ধু সাহা ছিলেন খ্যাতনামা শিক্ষক, এখনও অনেকে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। বাবার মৃত্যুর পর তাদের গাছপালা ঘেরা বাড়িটি কীভাবে যেন বে-দখল হয়ে যায়, গত দশ বছরের মধ্যে আর অসীম এ শহরে আসেনি। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে ছিলেন ওদের প্রতিবেশী, তাঁর বাড়িটিও অন্যের দখলে। পরে বেলালকে সঙ্গে নিয়ে অসীম নিজের বাড়িটা দেখতে যায় এক সকালে, একটি বোবা মেয়ে তাকে চিনতে পেরে তার কাছে ছুটে আসে আকুতিভরা চোখে। পরে বেলাল এই ঘটনার মর্মস্পর্শী বিবরণ লিখেছে।

বেলাল তো শুধু কবি বা প্রাবন্ধিক বা সাংবাদিক নয়, সে আমাদের অনেক সময়ের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। যখন কয়েক বছর সে কলকাতায় ছিল, তার সঙ্গে কত অভিযানে গেছি, শুয়ে থেকেছি গাছতলায়। বাংলাদেশেও বহু স্থানে সফরে বেলালকে পেয়েছি। রাজদ্বারে এবং শ্মশানে (অথবা কবরস্থানে) যে সঙ্গে থাকে সে-ই প্রকৃত বন্ধু। বেলাল এর কোনওটাই বাদ দেয়নি। বেলালকে এখানে পেয়ে আমরা সবাই খুশি।

পরদিন সকালে নাস্তাটাস্তা সেরে সদলবলে বেরিয়ে পড়া গেল গ্রামের দিকে। মাদারিপুর শহরটি বেশ সুদৃশ্য ও পরিচ্ছন্ন। একটি বেশ বড় সরোবর আছে, রাস্তাঘাটে তেমন গাড়িঘোড়ার ভিড় নেই। পাকা সড়ক হয়েছে ঢাকা পর্যন্ত, এসব আগে দেখিনি। রাস্তার ধারে-ধারে গ্রামের নাম লেখা। আমাদের গ্রামের মধ্যে অবশ্য বেশি দূর পর্যন্ত গাড়ি চলার পথ নেই, গাড়ি থেকে নেমে উঠতে হল ভ্যান রিকশায়। প্রথম প্রথম সবই অচেনা, যতু গাঙ্গুলির বাড়ি নামে খ্যাত বাড়িটি চেনা গেল, এই বাড়ির পাশ দিয়েই স্কুলে যেতে হত, সে বাড়িটি অনেক বদলে গেছে, গেটের কাছে আগে যেখানে ছিল বাগান, সেখানে এখন একটি মাজার, তেমন সুদৃশ্য নয়। রাজ্জাকদের পরিবার এখন এ-বাড়িতে থাকলেও আগের মতন সুন্দরভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেনি।

এ-বাড়ির পর থেকে সব মনে আছে। মোড়ের মাথায় একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছ, দিনের বেলাতেও তার কাছে দিয়ে যেতে গা ছমছম করত। কারণ, পাশেই শ্মশান। সে গাছের কোটরে-কোটরে অনেক পাখির বাসা, একটি কোটর থেকে ডেকে উঠত তক্ষক। এই গাছটিকে ঘিরে অনেক ভূতের গল্পও প্রচলিত ছিল, ভরত চক্রবর্তী নামে একজন ডাক্তার এই গাছতলা দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ গাছের একটা ডাল নেমে এসে তাকে মারতে শুরু করে। ভরত ডাক্তারের নাম এখনও অনেকে মনে রেখেছে। একবার এক সন্ন্যাসী এসে আস্তানা গেড়েছিলেন, আমাদের চোখের সামনেই তিনি ধুনির আগুন থেকে একটা জ্বলন্ত চ্যালা তুলে মুখে ভরে দিতেন।

বুকের মধ্যে প্রায় ধক করে একটা শব্দ হল। সেই অশ্বত্থ গাছটা নেই। এই গাছ তো বহুদিন বাঁচে! ঝড়েও পড়ে যায় না। তবে কি কেউ কেটে ফেলেছে? রাজ্জাক বলল, সম্ভবত তাই-ই।

শ্মশানটিও নেই, কারণ আর প্রয়োজন নেই।

এখান থেকে যে রাস্তাটি সোজা বামুন পাড়ার দিকে গেছে, সে রাস্তাটির অবস্থাও শোচনীয় বোঝা যায়, এ রাস্তা এখন কেউ ব্যবহার করে না, উঁচু-নীচু, গর্ত ও আগাছায় ছেয়ে গেছে, ভ্যান রিকশাও চলতে পারে না। নেমে পড়ে এবার হন্টন।

এ যেন রহস্য কাহিনির মতন। এরপর আরও কত কী যে দেখব!

এই রাস্তাটির এক পাশে ছিল পাট খেত, অন্য পাশে ধান খেত। ধান খেতের দিকটা নীচু, বর্ষার সময় ওখান দিয়ে নৌকো চলত, এখান থেকে নৌকোতেই গেছি ধুয়াসার নামে একটি গ্রামে। এখন বৈশাখ মাস, মাথার ওপর গনগনে সূর্য, এখন চাষের সময় নয়। দু’দিকে শুধু মাঠ, কিছু-কিছু বাড়িও চোখে পড়ে দূরে দূরে।

এক জায়গায় রাস্তাটার বদলে মাটির স্তূপ জমে আছে, সেটা পেরুতেই আমাদের পাড়া। প্রথম অবলোকনেই মনটা দমে গেল।

পঞ্চান্ন বছর আগেকার ছবিটা দেখতে পাব না জানতাম, কোনওটাই পাকা বাড়ি ছিল, তাই এতকাল অবিকৃতভাবে টিকে থাকা সম্ভও নয়, অনুমান করেছিলাম, সেইসব বাড়িগুলো সারিয়ে-টারিয়ে নিয়ে কেউ বসবাস করবে। একেবারে খাঁ-খাঁ অবস্থায় পড়ে থাকার বদলে কারও দখল করা বা পুনর্বসতিই তো যুক্তিসঙ্গত। তা তো হয়নি। পুরো পাড়াটিই ধ্বংস হয়ে গেছে, একটি বাড়িরও সামান্যতম অস্তিত্বও নেই। এরকম কী করে, ইচ্ছে করে কেউ পুরো পল্লিটি নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে? তা অসম্ভব নয়, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ব্রাহ্মণদের ওপর রাগ থাকতেই পারে। ছুৎমার্গ ও পাপ-পুণ্যের ভুজুংভাজুং দিয়ে ব্রাহ্মণরা তো এক সময় অন্যদের কম জ্বালায়নি। সেরকম ঘটেছিল কি না, সঙ্গীরা কেউ বলতে পারে না। ব্রাহ্মণ পল্লিটি একেবারে মুছে গেছে এই গ্রামের মানচিত্র থেকে। সমস্ত জায়গাটাই আগাছায় ভরা। যাকে বলে পড়ো জমি। ঘুরে-ঘুরে আমাকে শনাক্ত করতে হল, কোথায় ছিল চৌধুরীদের বাড়ি, কোথায় সেই চ্যাটার্জিদের বাড়ি, যেখানে আমি গোবিন্দ মামার বিয়েতে এসেছিলাম শেষবার। সবই শুধু শূন্যতা। রাজ্জাক কেন জোর করে আমাদের নিয়ে এল এখানে? স্বাতী কী দেখল শ্বশুরের ভিটে। ছোট ভাই অশোক (ডাক নাম বাচ্চু) কিছুই বুঝতে পারছে না।

ঘুরতে-ঘুরতে দেখলাম, একেবারে পেছনের দিকে আমাকের বাড়ির জমিতে কেউ একটা আস্তানা করে আছে। সামনের দিকের ভালো-ভালো জমি থাকতে সে পেছনের দিকে এই জমি কেন বেছে নিল কে জানে। তবু এটা আমাদের জমির সৌভাগ্য, এখনও মানুষের স্পর্শ আছে।

ছেলেবেলায় চোখে সব কিছুই বড়-বড় মনে হয়। যে পুকুরে আমি সাঁতার শিখেছিলাম, সেটাকে মনে হত বিশাল, একবারে পারাপার করা যায় না। সেই পুকুরে নাকি পেঁকির সমান দুটি গজাল মাছ ছিল, যাদের নাম কার্তিক আর গণেশ, কদাচিৎ তারা কুমিরের মতন মাথা তুলে ভাসত, এখন আর সে পুকুরটাকে তেমন বড় মনে হল না। অব্যবহারে মজে গেছে। এখানে সেখান পাড় ভাঙা। এক দিকের যে-বাগানে টিয়াঠুটি আমগাছটা ছিল, সেদিকে গাছপালা কিছু নেই, চেনা কোনও গাই নেই, লেবুবনটা অদৃশ্য।

এক জায়গায় শামিয়ানা টাঙিয়ে কিছু গ্রামের মানুষ অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। অনেককাল পরে এই গ্রামের একটি ছেলে ফিরে এসেছে বলে তাঁদের চোখে কৌতূহল, আগ্রহ এবং অভ্যর্থনা সব মিশে আছে। সবাই আমাদের ডাবের জল বা সরবৎ খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত। বয়স্ক ব্যক্তিরা স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন। লুঙ্গি ও ফতুয়া পরা এক সচ্ছল চেহারার প্রৌঢ় বললেন, আপনার বাপ-জ্যাঠার কথা আমার একটু মনে আছে। আপনারা আছিলেন জমিদার, আমরা আপনেগো প্রজা। কথাটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। আমরা ছিলাম গরিব এবং কুঁড়েঘরবাসী। ঠাকুর্দার আমলে দশ-কুড়ি বিঘে জমি ছিল, তা ভাগ-চাষ হত, এবং শুনেছিলাম চাষিরা সবাই মুসলমান, কোনও চাষি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অবস্থাপন্ন। জমি থাকলেই কি জমিদার হয়? হাত থাকলেই কি হাতিয়ার থাকে? কারও কাছ থেকেই পুরোনো কালের সঠিক বৃত্তান্ত জানা গেল না, তবে আমাকে এই গ্রামের ছেলে হিসেবে ফিরে পেয়ে সবাই যেন খুশি। রির্টান অফ দা প্রডিগাল সান ঠিক বলা যায় না গেলেও আমাদের জন্য ভোজ দিতে অনেকেই আগ্রহী।

দুপুরে রাজ্জাকদের বাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে আছে। প্রচুর মানুষ আমন্ত্রিত, যতু গাঙ্গুলির বাড়িটির স্ট্রাকচারটি খাড়া আছে। কিন্তু বদল হয়েছে অনেক। ফেরার পথে রাস্তার ধারে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির উঠোনে, হাতে একটা পাকা বেল। দেখে মনে হয় গরিবের বাড়ি। সেই মানুষটি তার গাছের বেল আমাকে উপহার দেবে বলে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। এরকম উপহার আমি খুব কমই পেয়েছি ইহজীবনে। হঠাৎ একটু আবেগ এসে যায়। মনে হয়, জন্মস্থান কিংবা জন্মভূমির মাটি-টাটি একেবারেই অবান্তর। মাটির চেয়ে মানুষই তো আসল। মাটি নয়, আমি এখানকার মানুষের টানেই এসেছি। রাজ্জাক হাওলাদার আমার গ্রাম-সহোদর।

একটি কুড়ি-একুশ বছরের ছেলে আমার পাশ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে অকৃত্রিম কৌতূহলে প্রশ্ন করল, আপনারা এই গ্রামের বাড়িঘর ছেলে চলে গেলেন কেন? এর আমি কী উত্তর দেব? এই প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়েই পুরোনো ইতিহাস জানে না। না জানুক ক্ষতি নেই। ইতিহাস তো ধুয়ে খাবে না। বর্তমানের বাস্তবতাই বড় কথা। এবং অতীতের অশান্তির কথা ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতের শান্তির চিন্তাই স্বাস্থ্যকর। এবং যে বিশেষজ্ঞরা ইতিহাস নিয়ে চর্চা করবেন, তাঁরা যাতে কোনওক্রমেই ইতিহাসকে বিকৃত হতে না দেন, সেটাই কাম্য।

ছেলেটি বলল, আপনি আসুন, আমাদের বাড়িতে থাকবেন, যত দিন খুশি, আপনার কী লাগবে বলুন? আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললুম অবশ্যই আসব, আমার বিশেষ কিছু লাগে না, শুধু ডাল-ভাত পেলেই যথেষ্ট, আর সঙ্গে যদি একখানা বেগুনভাজা পাই তো তাতেই দারুণ আহ্লাদ হয়।

এই ছেলেটির মতন প্রস্তাব আমাকে আরও কয়েকজন দিয়েছে।

বীরমোহন উচ্চবিদ্যালয়ে কিছু একটা সভার আয়োজন হয়েছিল, প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে সেখানে আমারও আমন্ত্রণ। মাত্র এক বছর আমি পড়েছি এই স্কুলে, ১৯৪৩ সাল, বিশ্বযুদ্ধ চলছে, যুদ্ধের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক না থাকলেও ব্রিটিশ শাসকদের তৈরি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ

চলছে সারা বাংলা জুড়ে। বাবা তখন কলকাতায়, ও শিশু ভাইবোনদের সমেত আমরা গ্রামে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। হাফ প্যান্ট ও চেন লাগানো গেঞ্জি পরে স্কুলে আসতাম হেঁটে, খুব বর্ষায় নৌকোয়। স্কুল বাড়িটি এখন বড় ও বিস্তৃত হয়েছে, তবু মূল অংশটি চিনতে পারি। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রায়বাহাদুর রাজকুমার চট্টোপাধ্যায় যখন এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন এই অঞ্চলে আর ভালো স্কুল ছিল না। আমার বাবা এই স্কুল থেকে পাস করেই কলকাতার কলেজে পড়তে গেছেন।

মঞ্চে বিভিন্ন বক্তা নানা বিষয়ে বলছেন। কবি দুলাল সরকার একটি কবিতাও পড়ে ফেললেন, আমি অধমনস্ক হয়ে শুনেছি আর বসে-বসে ভাবছি সেইসব দিনের কথা, যখন ভাতের বদলে সারাদিন আলুসেদ্ধ খেয়ে কাটাতে হত। স্কুলেও প্যান্টের পকেটে আলুসেদ্ধ নিয়ে আসতাম, সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড়ের সময় হঠাৎ-হঠাৎ আলু ছোঁড়ছুড়ি শুরু হয়ে যেত। যুদ্ধের নকলে, হ্যান্ড গ্রেনেড বর্ষণের মতন।

এই স্কুলের পেছনে একটি সুপ্রসন্ন দিঘির কথাও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তবে, স্মৃতিতে তার আকার যত বড় ছিল, আসলে ততটা নয়। আমার শৈশবে দিঘিটি ছিল প্রায় নতুন। জল কাকচক্ষু টলটলে, সুন্দর বাঁধানো ঘাট, মাঝখানে ফুটে থাকত কয়েকটি পদ্মফুল। এখন দিঘিটি বুড়ি হয়েছে, সংস্কারের অভাবে ঘাটলাটা ভাঙা-ভাঙা। পানিও তত পরিষ্কার নয়। এখন বোধ হয় আর গ্রামের মানুষ সরাসরি পুকুরের পানি খায় না। আমাদের সময় খেতে হত, তাই পুকুরকে পরিচ্ছন্ন রাখা ও যত্ন নিতে হত।

সভার পর একটি লাইব্রেরির উদ্বোধন এবং বৃক্ষরোপণ। অন্যদের সঙ্গে আমিও গাছের চারা পুঁতে দিলাম। আশা করি যখন আমি আর ধরাধামে থাকব না, তখনও এই গাছটি থেকে যাবে। সব গাছের সঙ্গেই বাতাসের ফিসফিসানির একটা ভাষা আছে। সেই ভাষায় থেকে যায় সময়ের প্রকৃত ইতিহাস, মানুষ তো বোঝে না।

অন্য গ্রা, আমগ্রাম

পরিকল্পনা রাজ্জাকের, ব্যবস্থপনা সব বারি সাহেবের। দুজনেই সদা ব্যস্ত, তবে দুজনের স্বভাবের তফাত আছে। রাজ্জাক সবসময় অস্থির, আর বারি সাহেব ধীরস্থির। মাঝবয়েসি এই মানুষটি বেশ সুপুরুষ, কথা বলেন নীচু গলায়। আমি যদি চুপিচুপি গ্রাম দেখতে আসতাম, তা হলে অন্য ব্যাপার হত। কিন্তু যেহেতু আমাদের আনা হয়েছে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, তাই প্রচুর মানুষের সমাগম হচ্ছে। সেইসব ঝক্কি ঝামেলা সামলানো, সকলের খাবারদারের ব্যবস্থা করার দায়িত্বও দুজনের, রাজ্জাক তো আমাদের সঙ্গে এই অতিথিশালাতেই থাকছে, বারি সাহেব সকালেই নিজের বাড়ি থেকে চলে আসেন অন্য কাজকর্ম ফেলে, থাকেন অনেক রাত পর্যন্ত।

রাজ্জাকের শ্বশুরবাড়ি শরিয়তপুরে। বেশি দূরে নয়, ঘণ্টা দেড়েকের রাস্তা, ফরিদা সেখান থেকে রোজ আসে। স্বাতীর কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না তার খোঁজ-খবর নেয়। একদিন তো সবাই মিলে তাদের বাড়িতে খেতে যেতেই হবে, তার আগে আমগ্রাম ঘুরে আসা দরকার।

ছোটবেলায় যেমন অনেক ছোট জিনিসকেও বড় দেখায়, তেমনই অনেক কাছের জিনিসকেও সুদূর মনে হয়। বাল্য বয়সে মনে হত, আমাদের মাইজপাড়া থেকে আমার মায়ের মামাবাড়ি, যা বকলমে আমারও মামাবাড়ি, সেই আমগ্রাম যেন অনেক দূরে। এখন হুশ করে গাড়িতে সেখানে পৌঁছনো যায়। অবশ্য তখন তো গাড়ির রাস্তাও ছিল না, গাড়িও ছিল না, যেতে হত নৌকায়, তাতে অনেক সময় লাগে। তখন পূর্ব বাংলা ছিল নদীনালার দেশ। সেই সব নদী ও জলপথ গেল কোথায়? নদীগুলির বড়ই শীর্ণ দশা। একসময় আড়িয়াল খাঁ নদীকে মনে হত দুর্দান্ত তেজি, এখন অতি সাধারণ ও সরু। যদিও এখন প্রখর গ্রীষ্ম, অনেক জলধারাই শুকিয়ে যায়, তবে বর্ষার সময়ও এইসব পাকা নাস্তা ডুবে যায় না শুনলাম।

নদীগুলির এই দৈন্যদশার জন্য এখানে অনেকে ফারাক্কার বাঁধকে দায়ী করেন। তা সত্যি হতেও পারে। এখন তো অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ফারাক্কায় অতবড় বাঁধ দেওয়া ভুল হয়েছে, পশ্চিমবাংলার পক্ষেও। পৃথিবীর সমস্ত নদীর বাঁধই ভুল এবং অন্যায়। পৃথিবীর সব নদীই বন্ধনদশার জন্য রুগণ। পশ্চিমবাংলার গঙ্গার কী করুণ দশা, গ্রীষ্মকালে দক্ষিণেশ্বরের কাছে মাঝগঙ্গায় চর জেগে ওঠে, সেখানে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে। এ বীভৎস দৃশ্য আমাদের অল্প বয়েসে অকল্পনীয় ছিল। গঙ্গার এই দশার জন্য কলকাতা বন্দরটাও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।

আমগ্রাম যাওয়ার পথে একটি গ্রন্থাগার ও একটি মেয়েদের স্কুল ছুঁয়ে যেতে হল। গ্রন্থাগারটিতে বেলালের জন্য একটি বিস্ময়ের চমক অপেক্ষা করছিল। গ্রন্থাগারটির নাম মাদারিপুর এম এম হাফিজ মেমোরিয়াল লাইব্রেরি, কামালউজ্জামান সাহেব আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলেন, হঠাৎ বেলাল জানতে পারল যে এই এম এম হাফিজ মানে মহিউদ্দিন মাহমুদ হাফিজ তার আপন মামাত ভাই বাবলু। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল বাবলু। ষাটের দশকে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল, এস ডি ও হিসেবে প্রথম পোস্টিং হয় মাদারিপুরে। একবার এখানে প্রলয়ের মতন প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা আঘাত হানে, তখন এই সুদর্শন, তরুণ এস ডি ও অক্লান্ত পরিশ্রমে সবদিক সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয় সে। এরই মধ্যে হঠাৎ সামান্য একটি টিনের খোঁচা খেয়ে তার ধনুষ্টঙ্কার হয়। অকালে নষ্ট হয়ে যায় এই মূল্যবান জীবন। বাবলু তখন সদ্য বিবাহিত। মাদারিপুরের মানুষ তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত এই লাইব্রেরির নাম রেখেছে। বেলাল অভিভূত হয়ে রইল কিছুক্ষণ।

মেয়েদের স্কুলটির রাজৈর গ্রামে। রাজৈর, চরমুগুরিয়া, টেকের হাট, এইসব নামগুলি স্মৃতির মধ্যে ঠংঠং শব্দ করে, কিন্তু কোনও চিত্র নেই। গ্রামের মধ্যে এমন সুদৃশ্য স্কুল দেখব, আশা করিনি। ছাত্রীরা সুশৃঙ্খলভাবে নানারকম ক্রীড়া দেখাল। স্কুলটি পরিচালনা করেন শ্রীমতি যোগমায়া দেবী। ভদ্রমহিলা জ্বর হয়েছে, তবু তিনি এসেছেন এবং ছোটাছুটি করলেন। স্কুলটির জন্য তাঁর ব্যাকুল ভালোবাসা অনুভব করা যায়।

এখানে ব্যবস্থাপনায় ছিলেন একজন ভারী আকর্ষণীয় ব্যক্তি, চেহারায়, নামে ও ব্যবহারে। এঁর নাম সুরুজ বাঙালি, সাধারণ বাঙালিদের তুলনায় অনেক লম্বা, অনেক ভিড়ের মধ্যেও তাঁর উঁচু মাথা চোখে পড়বেই, গমগমে কণ্ঠস্বর। এঁর পরিচয় কিংবা অমন নাম দিয়েছেন কেন, তা জানা হয়নি। তবে আমাদের বাসস্থানে প্রতিদিনই লোডশেডিং হয়। এক সন্ধেবেলা বাইরের পুকুরের ধারে বসে গল্প করছি, হঠাৎ সুরুজ বাঙালি এসে কিছু একটা গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে আমাকে টেনে নিয়ে চললেন অন্যদের থেকে আলাদা করে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, গোপন কথা বলছেন না। দোতলায় আমাদের নির্দিষ্ট ঘরের কাছে এসে বললেন, আলোর থেকে অন্ধকারই তত বেশি ভালো, তাই না? এরকম অন্ধকারে আপনার মতন মানুষদের একা থাকা উচিত।

ঠিক সেই মুহূর্তে আলো জ্বলে উঠল। সুরুজ বাঙালি খুব নিরাশ হলেন মনে হল।

ইস্কুল থেকে বেরিয়ে গাড়ি চলল আমগ্রামের পথে। নৌকোয় ছাড়া কখনও আসিনি। তাই কিছুই চিনতে পারি না। সেই রহস্য কাহিনির মতনই ভাবছি, মামা-বাড়ি গিয়ে কী দেখব, নিজেদের গ্রামের মতন পড়ো জমি, না অন্য কিছু? গোবিন্দ গাঙ্গুলিদের একটা পাকা বাড়ি ছিল তা একেবারে ধ্বংস হওয়ার কথা নয়। গাড়ি এসে থামল এক জায়গায়। সঙ্গীরা বলল, এই তে এসে গেছি, তখন আমার মনে হল, নিশ্চয়ই ভুল জায়গায় এসেছি। সামনে এ তো অন্য বাড়ি, নতুন বাড়ি।

ছবিটি ছিল এইরকম, একটা একতলা পাকা বাড়ির পেছনের উঠোনের দুপাশে ছিল আরও সারি-সারি টিনের চালের বাড়ি। আর সামনের দিকে স্থায়ী আটচালা, অর্থাৎ আটটি স্তম্ভের ওপর ত্রিপল ঢাকা, সেখানে যাত্রা-থিয়েটার ও সভাসমিতি হত, তার একদিকে পূজা মণ্ডপ, অন্যদিকে পাকা মন্দির গৃহদেবতার। সেসব কোথায়? নতুন বাড়িটির পাশ দিয়ে একটু এগোতেই সারা শরীর বটের চারা জড়ানো ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি দেখেই চিনতে পারলাম। এরপর সব বোঝা গেল। আটচালা, পূজা মণ্ডপ অবশ্যই থাকার কথা নয়। গ্রামের সচ্ছল পরিবারের বাড়ি সংলগ্ন অনেকখানি জমি ও বাগান থাকেই, সেইসব জায়গায় নতুন বাড়ি উঠে গেছে, তাই চেনা যাচ্ছিল না।

পাকা বাড়িটির বিশেষ কিছু বদল হয়নি, শুধু কিছুটা কালের চিহ্ন লেগেছে। পেছনের বাড়িগুলো নেই, উঠোনটা ছোট হয়ে গেছে, এই উঠোনেই তৈরি আঁতুড়ঘর আমার প্রকৃত জন্মস্থান। বর্ষাকালে জন্ম, কলেরা, ম্যালেরিয়া কিংবা সাপের কামড় না খেয়েও কী করে বেঁচে রইলাম কে জানে।

ছাদের ওপর একটা ঘর আছে। আমার ধারণা ছিল, ওই ঘরে মা ও আমি কখনও থেকেছি। স্মৃতির মধ্যেও অনেক ভেজাল ঢুকে পড়ে। ওপরে উঠে দেখলাম, সে ঘরটি এতই ছোট যে বাসযোগ্য নয়। হয়তো কিছু জিনিসপত্র থাকত, হয়তো চোর-পুলিশ খেলার সময় কখনও এই ঘরে লুকিয়েছি। ছাদ থেকেই দেখা গেল পুকুরটা, ওখানে ছিপ ফেলে অনেক মাছ ধরেছি। না, অনেক মাছি ধরি-নি, অনেকদিনের মাছ ধরতে বসেছি।

এক তো প্রচণ্ড রোদ, তায় প্রচুর কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে গেছে, তাই সব জায়গা ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। এক জায়গায় চেয়ার পেতে বসলাম। স্বা তাঁকে বোঝাচ্ছি এটা সেটা। বাছুর ধারণা, ওর অস্পষ্ট স্মৃতি আছে, ও একবার জলে পড়ে গিয়েছিল। ও শেষ এসেছিল তিন-চার বছর বয়েসে, তবু এই স্মৃতি সত্যি হতেও পারে। ওর একটু জলে পড়ার প্রবণতা আছে। একবার কাশীতে গঙ্গায় প্রায় ডুবতে বসেছিল।

এই বাড়ির সংলগ্ন দিঘির একদিকে ছিল নমঃশুদ্র পল্লি, আর একদিকে খ্রিস্টান পল্লি। তারা এখনও আছেন অনেকে। মাইজপাড়ার তুলনায় আমগাঁ অনেক সমৃদ্ধ গ্রাম, অনেক বিশিষ্ট পরিবারের বাস ছিল, কিছু কিছু পরিবার রয়ে গেছেন। এ গ্রামের বর্তমান চেহারাও ছন্নছাড়া নয়।

অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দেখতে এসেছেন আমাদের, বিশেষত স্বা তাঁকে। সে তো এ গ্রামের নাতবউ। মাইজ পাড়ার কেউই বাবা-জ্যাঠা বা আমাকে চিনতে পারেনি। এখানে তবু মাঝে-মাঝে পরিবারের ঝিলিক পাওয়া যাচ্ছে। এক একজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দাবি করতে লাগলেন, কারও বয়েস বিরানব্বই, কারও বয়েস একশো দশ। এইসব গ্রামদেশে বয়েসের সঠিক হিসেব রাখা কঠিন। তবে তাঁরা যথেষ্ট প্রাচীন তে বটেই। কেউ-কেউ গোবিন্দ গাঙ্গুলিকে চিনতেন। কেউ বা তাঁর বাবা-কাকাকেও দেখেছেন। বাড়ির অন্যান্য ছেলে ও মেয়েদের কথা বলতে-বলতে একজন বললেন, যতন নামে একটা ফটফটে মেয়ে ছিল, তখন আমার সত্যিকারের চমক লাগল। আমার মায়ের নাম মীরা, ডাকনাম যতন। এই নাম বোধহয় হিন্দু-মুসলমান দু’তরফেই হয় (অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর বিখ্যাত গল্প ‘যতন বিবি’) মায়ের মামাতো-পিসতুতো ভাই-বোনরা (তাদের সংখ্যা অনেক। তাঁকে ডাকত রাঙাদি, খুব ফরসা গায়ের রঙের জন্য। দিদিমা-দাদামশাইরা ডাকতেন যতন! আমি সেই যতনের ছেলে শুনে এক বৃদ্ধা আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন। সেই স্পর্শে অনেক পুরোনো স্নেহের স্নিগ্ধতা।

এই সম্পত্তির বর্তমান মালি সাবেক ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট জলিল ব্যাপারীর পরিবার। তাদের ছেলেমেয়েরা প্রায় জোর করেই আমাদের নিয়ে বসাল তাদের নতুন বাড়িতে। সেখানে পাখার হাওয়া আছে। ফুলের তোড়া, ডাবের জল ও সরবত এনে নানাবিধ আপ্যায়ন। এক বৃদ্ধ ধরে বসলেন, অতিথি হিসেবে আমাদের অন্ন গ্রহণ করতেই হবে দুপুরে। আমাদের তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু বারি সাহেব কানে-কানে জানালেন, আমাদের আহারের সব ব্যবস্থা হয়ে আছে স্থানীয় গ্রন্থাগারে। সেখানে অপেক্ষা করছেন অনেকে।

অন্দরমহলের মহিলাদের কাছ থেকে একটি শাড়ি উপহার এল স্বাতীর জন্য। সে এ গ্রামের নাতবউ, এর প্রথম এসেছে, তাকে তো একটা কিছু দিয়ে আশীর্বাদ করতে হয়। মামারা কেউ নেই, কিন্তু আশীর্বাদ করার মতন মানুষ আছে।

মুক্তিযুদ্ধে জাদুঘর

রাজ্জাক লম্বা প্রোগ্রাম বানিয়ে রেখেছে। তার থেকে একটি দিনও সে বাদ দিতে রাজি নয়। এই সময় কলকাতায় আনন্দ পুরস্কার উৎসব হয়, পরপর দুবছর সে উৎসবে আমার থাকা হচ্ছে না।

এই অতিথিশালায় আমরা থিতু হয়ে গেছি। এ কথা ঠিক, কোনও এক স্থানে টানা কয়েকদিন থাকলে সেই স্থানটির প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিত বোঝা যায়, শরীরেও অনুভব করা যায় পরিবেশ। মাদারিপুর শহরটি স্বাতীর বেশ পছন্দ হয়ে গেল। সে দু-একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই এখানে ওখানে যায়। আমি বেশি বেরোবার সুযোগ পাই না, অনেক মানুষ আসে দেখাসাক্ষাৎ করতে। তরুণ কবি কিংবা উচ্চপদস্থ আমলা, প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা বা সমাজসেবক। পরিচয় হয় কাজি আবদুস সবুর, ফরহাদ, খান মোহাম্মদ শহিদ, মনজুরুল হক, আলমগীর প্রমুখ অনেকের সঙ্গে।

আমি রাজ্জাককে গ্রাম-সহোদর বলে সম্বোধন করেছি বলে একজন কৌতুক করে বলল–এর পর ওর নাম হয়ে যাবে রাজ্জাক গঙ্গোপাধ্যায়। আমার নামও কি সুনীল হাওলাদার হতে পারে না? মন্দ শোনাচ্ছে না তো!

দুলাল সরকার রোজই আসে। তার মুখখানি ম্লান দেখি। শশীকর নামে একটি কলেজের সে অধ্যাপক। সেখানকার প্রভাষক পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুলাল ও আর কয়েকজনের কিছু কিছু অভিযোগ আছে। সেগুলি আমি শুনতে চাই না, আমার কিছু করণীয় নেই। পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘুদের নানান সমস্যা থাকে, কোনও-কোনও দেশে তা বেশি প্রকট। যত দিন ধর্ম, গায়ের রং জাতি-পরিচয়ে মানুষের বিচার হবে, ততদিন এইসব সমস্যা থাকবেই। কিছুতেই মানুষ এই ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। আর যেখানে রাষ্ট্রশক্তি এই ক্ষুদ্রতার মদত দেয়, সেখানে হিংসা, ঘৃণা, অবিশ্বাস লাগামছাড়া হয়ে যায়। আক্রমণ ও প্রতিশোধের পালা চলতেই থাকে। যেমন চলছে। ভারতে।

সব ধর্মের সঙ্গেই হিংসার ওতপ্রোত সম্পর্ক বলে কোনও ধর্মের প্রতিই আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। তবে ধর্ম সম্পর্কে আমার উগ্র মতামত এখন আর আমি প্রকাশ করি না। চুপ করে থাকি। তবু শুধু নামটার জন্যই আমাকে কেউ কোনও ধর্মে দেগে দেয়, তখন বড় মনকষ্ট হয়। এবারেই একটা নদীর ওপর ফেরি পার হওয়ার সময়, সারা মুখ গোঁফদাড়িতে ভরা একজন মোল্লা ধরনের যুবক আমার কাছে এসে অটোগ্রাফ চাইল। পাশে দাঁড়ানো রাজ্জাক জিগ্যেস করল, আপনি এনাকে চেনেন? লোকটি বলল, চিনি। হিন্দু রাইটারদের মধ্যে আমি এনার লেখা খুব পছন্দ করি।

আমার গালে যেন কেউ ঠাস করে একটা চড় কষাল। হিন্দু রাইটার! সারাজীবন ধরে যে এত লেখালেখি করলাম, তা শুধু হিন্দু রাইটার হওয়ার জন্য, বাঙালি লেখক হতে পারলাম না। লোকটি সরলভাবেই কথাটি বলেছিল, কিন্তু সে যে আমার মনে কী দাগা দিয়ে গেল, তা জানল না। নাম নিয়েই যত গণ্ডগোল। এই জন্যই আমাদের বিশ্ব-যাযাবর বন্ধু মোস্তাফা কামাল ওয়াহিদ বলে, তার নতুন নাম হবে, আকাশ-বাতাস!

কাছাকাছি একজন লেখককে পেলে ইস্কুল-কলেজ থেকে তাঁকে ডাকাডাকি করবে, এটা স্বাভাবিক। যেতে হল এরকম কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আবার অনেক বাড়িতে দাওয়াতও গ্রহণ করতে হয়, তাই সব সময় তাড়াহুড়ো থাকে। কোথাও এমনও হয়, সময়ের অভাবে কোনও স্কুলের সামনে গাড়ি থামে, অপেক্ষমাণ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দু চারটি কথা বসেই বিদায় নিতে হয়, ভেতরে আর যাওয়া হয় না। এটা আমার মোটেই পছন্দ নয়, তাড়াহুড়ো আমার শরীরে সয় না। কিন্তু এখানে আমার সময়-নির্ঘণ্ট অন্যের হাতে।

এমনকি শরিয়তপুরে যাওয়ার পথে একদিন কাশীপুর হিন্দুপাড়া প্রাইমারি স্কুলের সামনে মাত্র দু-মিনিট থামতে না থামতেই রাজ্জাক তাড়া দিতে লাগল, আর একটুও দেরি করা যাবে না। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ফরিদার বড় বোন শিরীন আখতার। নিজের শ্যালিকার অনুরোধও উপেক্ষা করতে পারে, রাজ্জাকের এত সাহস? জানি না সে পরে শ্যালিকার হাতের কানমলা খেয়েছিল কি না!

রাজ্জাকের শ্বশুরবাড়িতে আমরা নেমন্তন্ন খেতে যাব বলে কমোড়ওয়ালা নতুন বাথরুম বানানো হয়েছে। থাকব তো মোটে কয়েক ঘণ্টা। শ্বশুরবাড়িতে রাজ্জাকের বেশ দাপট আছে বোঝা যায়। অতিভোজনের পর আমার ঘুম পাবে বলে একটি আলাদা ঘরে বিছানাও পাতা রয়েছে। অপূর্ব সব রান্না, কিন্তু পদের আধিক্যের জন্য সব ক’টির সুবিচার করা যায় না। শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক শ্যালিকা ও তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে পরিবারটি বেশ আনন্দমুখরিত। গাছপালা-ঘেরা বাড়ি। শুয়ে-শুয়ে সিগারেট টানতে টানতে আমি মনে-মনে আওড়াতে লাগলাম জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতাঃ

শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে
মাথা রেখে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের
খেতে
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার,–চোখে
তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাদের আশ্বাস পেয়ে অবসাদে পেকে
ওঠে ধান
দেহের স্বাদের কথা কয়…

পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনও মিল নেই, তবু এইভাবেই কবিতার লাইন মনে আসে। বিশেষ ভালোলাগা থেকে। চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ’, এ উপমা আমার সাতপুরুষের কেউ লিখতে পারবে না।

শেষের আগের দিক একটা কোনও বড় কলেজে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে নানারকম আয়োজনের খবর আসছিল কানে। নির্দিষ্ট দিনটিতে দেখি রাজ্জাক আর বারি সাহেব আমাকে এড়িয়ে-এড়িয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে ফিসফিস করছে নিজেদের মধ্যে। আরও অনেকে আসছে, সকলেই সেই ফিসফিসানিতে যোগ দিচ্ছে। এক সময় রাজ্জাক কুণ্ঠিতভাবে জানাল যে ওই কলেজের দিকে আমার না-যাওয়াই ভালো। আমরা অন্য কোথাও যাব বেড়াতে।

কেন সে অনুষ্ঠান বাতিল হল, তা আমি জানতে চাইনি। হয়তো স্থানীয় কোনও দলাদলি, তাতে মাথা গলাবার আবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। মানুষের জীবনটা এত ছোট, তার মধ্যে অপ্রিয় বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয়! বরং বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আমোদ-আহ্বাদ করতে কত সুসময় উপভোগ করা যায়।

সেরকমই বিমল আনন্দ পেলাম ঢাকা পৌঁছে প্রথম রাতেই। ঢাকায় যদিও আমার অনেক বন্ধুর বাড়িতেই ওঠার পাকা আমন্ত্রণ আছে। কিন্তু এবারে রাজ্জাক আর কোথাও যেতে দেবে না, তার দোসর রেজাউল করিম তালুকদার আগে থেকেই হোটেলে ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ঢাকা পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল।

হোটেলে মালপত্র রেখেই ছুটতে হল ফারুক হায়দারের বাড়িতে। ফারুক অনেক দিনের বন্ধু, বহু বছর ছিল লন্ডনে, প্রথমে সেখানেই দেখা। মনে আছে, লন্ডনে কোনও একটি বাড়িতে আমন্ত্রণ রক্ষার জন্য ফারুক আমার জন্য শ্যফার ড্রিভন গাড়ি পাঠিয়েছিল। ওসব দেশে এটা দারুণ কেতার ব্যাপার। এক গোঁড়া মুসলমান পরিবারে রাত্রিবাস করছিলাম। সে বাড়িতে সুরা পানের সুবিধে নেই, আমি মনে-মনে সংযমের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম, ফারুক কোথা থেকে একটা বোতল এনে বলেছিল, ঘরের মধ্যে বসে খাবেন, তাতে কেউ আপত্তি করবে না।

অবশ্য এসবই যৌবনের কথা। এখন আমরা দুজনেই কিছুটা স্থিতধী হয়েছি। ফারুক এখন প্রধানত ঢাকাতেই থাকে। তার বাড়িতে এই রাতের আমন্ত্রণ পূর্বনির্ধারিত, কারণ পরের দিনই সে চলে যাবে বিদেশে। আরও অনেকেই এসেছেন, আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে গান। ফারুকের অসম্ভব সঙ্গীত-প্রীতি। গাযের মাঝখানে যাতে যতি না পড়ে তাই আলাপ পরিচয়ের বদলে আমরা বসে গেলাম গানের আসরে। খুবই উৎকৃষ্ট গান, শুনতে শুনতেই অনুভব করা যায়, বড় শহরে পৌঁছে গেছি। গান দিয়ে বোঝা যায় নাগরিকতা।

হঠাৎ একদিন সকালবেলা ঢাকার প্রথম সংবাদপত্রে দেখি, বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ুন আহমেদ, প্রথম পৃষ্ঠায় একটি রসস্নিগ্ধ রচনা লিখেছে আমারই গ্রাম-দর্শন বিষয়ে। এবং হুমায়ুন প্রস্তাব করেছে, আমাকে যেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। হুমায়ূন আমার সম্পর্কে এরকম চিন্তা করেছে বলেই আমি অভিভূত ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করি। কিন্তু ওইসব নাগরিকতার ঝঞ্ঝাটের মধ্যে আমি যেতে চাই না। মনে-মনে তো আমি বিশ্বনাগরিক আছিই, ঠিক সময়ে, সহজে ভিসা পেলেই হল।

ঢাকায় প্রচুর বন্ধুবান্ধব, প্রচুর দাওয়াত। বেলাল মাদারিপুর থেকে আগে চলে এসেছিল, এখানে আবার দেখা। এবং রবিউল হুসাইনের সঙ্গে গাজি সাহাবুদ্দিনের বাড়িতে পরপর আডড়া, হুমায়ূন আহমেদ ও প্রণব ভট্টের বাড়িতে আহারের আগে গান ও পান, সৈয়দ আল ফারুকের উদ্যোগে সাহিত্যবাসর, এসবের আর বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। এবারে ঢাকায় আসার মূল উদ্দেশ্য, রাজ্জাকের ‘বাকি রয়ে গেছে কিছু’র উদ্বোধন হবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। সে মাইজপাড়া গ্রামের ছেলে, আর একজন মাইজপাড়ার মানুষকে দিয়ে বইটি উদ্বোধন করাতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আমি প্রতিবারই আসি, এবারের অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থা করেছেন রাইটার্স ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ। এসেছেন অনেক বিদ্বজ্জন। শিল্পী, কবি গায়কা-গায়িকা, এবং এখন বয়েস হয়ে-যাওয়া কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।

বসে-বসে সকলের ভাষণ শুনছি, আর মনে হচ্ছে, আমি তো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিইনি, আমি অন্য দেশের নাগরিক, যুদ্ধবিদ্যাও শিখিনি। কিন্তু আমারই গ্রামের ছেলে রাজ্জাক তার ভাইদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেজন্য গর্ববোধ করতে পারি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *