পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশে কবিতা

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশে কবিতা

আমার বাড়িতে একটা কমপিউটার আছে বটে, কিন্তু তার সামনে আমার প্রায় বসাই হয় না। যদিও এই আশ্চর্য যন্ত্রটি বিষয়ে আমার বিস্ময়ের সীমা নেই।

কমপিউটারের মধ্যে রয়েছে এক বিশাল আশ্চর্য জগৎ, যার নাম ইন্টারনেট। এই অফুরন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার কে বা কারা এর মধ্যে জমা করে রাখে? কিছুদিন আগে লিলিথ নামে বাইবেল-পূর্ব এক রমণী বিষয়ে কিছু তথ্য জানার দরকার হয়েছিল। কয়েক বছর আগে হলে লাইব্রেরিতে গিয়ে কত বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে হত। এখন ঘরে বসে, কমপিউটারকে জিগ্যেস করতেই ফরফর করে পাতার পরে পাতা তথ্য বেরিয়ে এল। কটা লোকই বা লিলিথ সম্পর্কে আগ্রহী? তবু কে এত তথ্য জুগিয়ে রাখে?

আমার মুশকিল এই, সকালবেলা একবার লেখার টেবিলে বসলে আর উঠে গিয়ে কমপিউটারের টেবিলে বসা হয় না। আর একবার কমপিউটারের টেবিলে প্রথমেই বসলে আর উঠে আসা যায় না লেখার টেবিলে। আমার দুর্ভাগ্য এই, আমাকে সারাবছর প্রায় প্রত্যেক দিনই কিছু না কিছু লিখতে হয়। তাই কমপিউটার উপেক্ষিত থাকে।

কিন্তু এখন অধিকাংশ চিঠিও তো আসে ই-মেইলে। ডাকে চিঠি আসা অনেক কমে গেছে। স্বাতী মাঝে-মাঝে কমপিউটারে বসে ই-মেইল চেক করে। কিংবা আমার বাড়িতে কমপিউটার জানা বর্ণালি রায় নামে একটি মেয়ে মাঝে-মাঝে আসে। সে আবার ‘যাপন চিত্র’ নামে একটি উচ্চাঙ্গের লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক। তাকে বলি, আমার ই মেইলগুলো খুলে দেখে দাও তো!

এ বছর অগস্ট মাসে, বর্ণালি আমার বাড়ির কম্পিউটারে বসে বলল, সুনীলদা, নিউজিল্যান্ড থেকে আপনার একটা কবিসম্মেলনের আমন্ত্রণ এসেছে। বেশ বড় চিঠি!

রন রিডেল (Ron Riddell) নামে একজন লিখেছে, গত বছর থেকে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন শহরে একটি আন্তর্জাতিক কমিসম্মেলন শুরু হয়েছে। এই দ্বিতীয় পর্বে সেখানে আমার আমন্ত্রণ।

কী করে এই ভদ্রলোক আমার ই-মেইল ঠিকানা জানলেন?

পরবর্তী চিঠিতেই সেটা পরিষ্কার হল।

চার বছর আগে আমি গিয়েছিলাম দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়াতে মাদলেইন শহরে একটি আন্তর্জাতিক কাব্য উৎসবে যোগ দিতে। মাদলেইন ছোট শহর, কিন্তু সেখানকার কাব্য উৎসবটি প্রকৃতপক্ষেই আন্তর্জাতিক এবং আমি এত বিশাল আয়োজনের কবিতাকেন্দ্রিক উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও দেখিনি। অন্তত আশিটি দেশের শতাধিক কবি এসেছিলেন সেখানে, উৎসব চলেছিল বারো দিন ধরে। সে উৎসবের কথা অন্য কোনও সময়ে লেখা যাবে।

সেই উৎসবে রন রিডেলও এসেছিলেন নিউজিল্যান্ড থেকে এবং তিনি আমাকে মনে রেখেছেন। এখানে আমি লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি, আমি কিন্তু তাঁকে মনে রাখতে পারিনি। সেখানকার অনেকেই পরে আমাকে বৈদ্যুতিন চিঠিপত্র লিখেছে, উত্তর দেওয়া হয়নি আমার। গদ্য লেখা যে আমার সময় অনেকটা খেয়ে নেয়!

আমি রন রিডেল-এর আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম দুটি কারণে। যে-দেশ দেখিনি, সে-দেশে যাওয়ার যে-কোনও সুযোগ পেলেই আমি লাফিয়ে উঠি। ইহজীবনে পৃথিবীর বহু দেশই ঘুরে এসেছি বটে, তবু এখনও বলতে ইচ্ছে হয়, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!

কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করে এসেছি খুব ভালোভাবে। কিন্তু তখন নিউজিল্যান্ড যাওয়া হয়নি। এ সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না।

দ্বিতীয় কারণ, সময়টা আমার পক্ষে খুবই সুবিধেজনক।

গ্রীষ্ম ও বর্ষার মাসগুলিতে শারদীয় সংখ্যার গল্প-উপন্যাস লিখতে-লিখতে একেবারে প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। মাথার মধ্যে শুধু গজগজ করে গদ্য, অন্য কিছুই তখন উপভোগ করা যায় না। টানতে হয় প্রায় শরৎকাল পর্যন্ত। তার মধ্যে বিদেশ যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। দু-একবার এইরকম সময়েও যেতে হয়েছে, তখন দেখেছি, গদ্যময় মস্তিষ্কে ভ্রমণ কিংবা কাব্য কোনওটাই ঠিক উপভোগ করা যায় না।

দেশ পত্রিকায় উপন্যাস জমা দেওয়ার শেষ তারিখের পরেও যে চরম শেষ তারিখ, নিউজিল্যান্ডের কবিতা উৎসব শুরু হবে তার ঠিক তিনদিন পরে। অর্থাৎ এটা যেন অনে পরিশ্রমের পর একটা বিশেষ পুরস্কার। মুক্ত মনে উপভোগ করার মতন ছুটি।

কলকাতা থেকে আকাশপথে লন্ডন যেতে লাগে সাড়ে দশ ঘণ্টা, নিউজিল্যান্ড তার থেকেও দূরে। সিঙ্গাপুর যেতে চার ঘণ্টা, তারপর সেখান থেকে আবার সাড়ে ন’ঘণ্টা। মাঝখানে সিঙ্গাপুরে অপেক্ষা করতে হয় অনেক ঘণ্টা, অর্থাৎ প্রায় দেড় দিন লেগে যায়।

নিউজিল্যান্ডের নাম শুনলেই সবাই বলে, দেশটা খুব সুন্দর। হ্যাঁ, প্রকৃতির দিক থেকে সুন্দর তো বটেই, ঘোট ঘোট পাহাড়, প্রচুর গাছপালা আর চারদিকে সমুদ্র। এরকম সুন্দর জায়গা পৃথিবীর অন্যত্রও আছে। আমাদের দেশেও আছে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বৈশিষ্ট্য এই, গোটা দেশটাই এরকম। কোথাও রুক্ষতা নেই।

নিউজিল্যান্ডের অন্য বৈশিষ্ট্য এই যে মানুষগুলি ভারী ভদ্র ও খোলামেলা, গোটা দেশে আমি একজনকেও কখনও কর্কশ ব্যবহার করতে দেখিনি। শুধু আমার সঙ্গে নয়, পথেঘাটেও শুনিনি। একটা দেশকে চেনা যায়, সেখানকার ট্যাক্সিচালকদের ব্যবহারে। নিউজিল্যান্ডের ট্যাক্সিচালকরা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ।

আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একটা হোটেলে। এইসব ধনী দেশে পুরোনো আমলের হোটেলগুলিকে পুরোনো চেহারাতেই রেখে দেওয়া হয়, ভেতরের ব্যবস্থা অত্যাধুনিক। তবু হোটেলটি আমার পছন্দ হল না, কারণ, কোথাও সিগারেট খাওয়ার উপায় নেই এমনকি নিজের ঘরে বসে লুকিয়েও খাওয়া যাবে না। স্মোক অ্যালার্ম দেওয়া আছে। আর দরজার গায়ে লেখা আছে, তোমার যদি খুব সিগারেট টানতে ইচ্ছে করে ঘরের মধ্যে, টানো। তাহলে তোমার এই ঘরের দেওয়ালের আবার রং করা, বিছানায় চাদর, বালিশের ওয়াড় ইত্যাদি বদল করার খরচ দিতে হবে! দেখেই আক্কেল গুড়ুম! সে খরচ কত কে জানে! সিঙ্গাপুরে বিমানবন্দরের মধ্যেই একটা হোটেলে রাত কাটাতে হয়েছিল, সে ঘরে সরাসরি লেখা আছে, ধূমপানের জরিমানা চার হাজার ডলার!

নিউজিল্যান্ডের এই কাব্য-উৎসবটি সবেমাত্র শুরু হয়েছে এক বছর আগে। এইরকম বৃহৎ কর্মকাণ্ড চালাবার মতন পাকা অভিজ্ঞতা এখনও হয়নি। প্রধান পরিচালক রন রিডেল নিজে একজন কবি তো বটেই, খানিকটা আলাভোলা স্বভাবের। দীর্ঘকায় মানুষটির প্রসন্ন মুখখানি দেখলেই বোঝা যায়, এইসব মানুষ যতটা ভাবুক প্রকৃতির, ততটা সংগঠক নয় এবং সেই কারণেই প্রথম থেকে তার সঙ্গে আমার ভাব জমে যায়। সারে টোরেস নামে মহিলাটি তার স্ত্রী না জীবনসঙ্গিনী, তা ঠিক বোঝা গেল না, একসঙ্গে থাকে কিন্তু মহিলাটি তার পদবি বদলায়নি। প্রথম দেখা হতেই সারে এমনভাবে আমাকে সুনীল বলে ডেকে উঠল, যেন আমার সঙ্গে কতদিনের চেনা! কলম্বিয়াতে এর সঙ্গেও দেখা হয়েছিল, অথচ আমার মনে ছিল না এর মুখ।

সারে বরং অনেকটা গোছানো স্বভাবের, সব ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব তার। এই কাব্য উৎসবে কোনও সরকারি কিংবা বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেই, এই দুজনই উদ্যোগ নিয়ে কয়েকটি স্পনসর জোগাড় করেছে, সাহায্য করছে কিছু তরুণ কবি। নিউজিল্যান্ড প্রধানত খেলাধুলোর জন্যই বিখ্যাত, নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যও উৎপাদন করে, তবু কিছু অত্যুৎসাহী কাব্যপ্রেমীও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা দেশে। স্বভাবে বাঙালি কবিদের সঙ্গে বিশেষ তফাত নেই, কোথাও প্রত্যেককে দুটি করে কবিতা পাঠ করার জন্য অনুরোধ জানালেও কয়েকজন চক্ষুলজ্জা বর্জন করে চার-পাঁচটা পড়ে যায়। কেউ-কেউ, আর একটা ছোট কবিতার কথা বলে তিন-চার পাতার কবিতা শোনাতে ছাড়ে না।

কবিতা পাঠের আসর হয় কোনও বড় জায়গায় নয়, বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে, কোনও লাইব্রেরিতে বা মিউজিয়ামে বা ছবির প্রদর্শনীর সঙ্গে। এক-একটি অনুষ্ঠানে বড়জোর সাত-আটজন কবি, মোট সময় একঘণ্টা-সোয়া ঘণ্টা। দীর্ঘক্ষণ ধরে কবিতা পাঠের রেওয়াজ এসব দেশে থাকে না, শ্রোতাদেরও সময় নেই। কোনও অনুষ্ঠানেই শ্রোতার সংখ্যা একশো-দেড়শোর বেশি নয়। একটি গ্রন্থাগারে শ্রোতার সংখ্যা ছিল বড়জোর তিরিশজন, অধিকাংশ রমণী, তবে তাদের গভীর মনোযোগ, আগ্রহ ও কৌতূহল টের পাওয়া যায়।

এখানে বলে নেওয়া ভালো, এ দেশে অনেকেই বাংলা ভাষার অস্তিত্বের কথাই জানে না। উপস্থিত কবিদের তালিকায় আমার নামের পাশে লেখা ছিল হিন্দি কবি। আমি পৌঁছে প্রথমেই আপত্তি জানাতে ওরা কাঁচুমাচু হয়ে বলেছিল, ওদের ধারণা ভারতের সব কবিই হিন্দি কবি! সুতরাং প্রত্যেকটি আসরে কবিতা পাঠের আগে আমাকে বাংলা ভাষা সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিতে হত। অনেকেই রবীন্দ্রনাথেরও নাম জানে না, যে দু চারজন জানে, তাদেরও ধারণা, রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতেই লিখেছেন। কেউ-কেউ ঠাকুর উচ্চারণ করে টাগোরে!

বিভিন্ন সময়ে কবিদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে আমাকে সচেতন হতেই হল দুটি ব্যাপারে। এই দুটি ব্যাপারে আমি অন্য সব কবিদের চেয়ে আলাদা। প্রথমত গায়ের রং। আমন্ত্রিত আর সব কবিরাই শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গিনী। আফ্রিকা বা এশিয়ার কোনও দেশ থেকে আর কেউ আসেনি। কালো বা খয়েরি রঙের আমিই একমাত্র! আর, আমি তো তরুণ কবিটি নই, সকলের চেয়ে আমার বয়েস বেশি। আমার বয়েসি কবিরা বোধহয় হুট করে একা-একা দূর বিদেশে যায় না!

সব কবির কথা তো বলা যাবে না, দু’জন কবির কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এখানে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে একটি সুইডিশ কবির রচনা। তার বয়েস উনচল্লিশ, এখনও তরুণীই বলা যায়, লাজুক ও স্বল্পভাষিণী, কিন্তু তার কবিতা খুবই তেজি। তেজি মানে ঝাঁজালো নয়, বাস্তব ও পরাবাস্তবতার মিশ্রণে দুঃসাহসিনী। তার নাম কেরিন বেলসান, সে উপন্যাস লিখেও নাম করেছে। তার কবিতার কয়েকটি লাইন :

She is your window now : perhaps you can see heaven
Through that window
Perhaps you are flying—
I wish for nothing higher
You kiss my madness once more
Then go to her:
I stand here naked with the shallow stones…

অন্য কবিটি এসেছেন এস্টোনিয়া থেকে। ইউরোপের একটি ছোট্ট দেশ এস্টোনিয়া, সে দেশ সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। এই কবি বেশ দীর্ঘকায়, মুখভরতি দাড়ি গোঁফ, ইংরেজি বলে খুব আস্তে-আস্তে, প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল আমার চেয়েও বয়েসে অনেক বড়, কিন্তু আলাপ করার পর জানতে পারলাম, আসলে তিনি ছ’বছরের ছোট, কিন্তু বুড়োর মতন দেখায়। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি হকচকিয়ে গেলাম।

ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে জানেন অনেক কিছুই, উপনিষদ ও কালিদাসের কাব্য মুখস্থ বলতে পারেন, রবীন্দ্রনাথও পড়েছেন।

এর কবিতা বেশ লম্বা-লম্বা। তবে এর একটি কবিতায় বিষয়বস্তু সম্পর্কে যা লিখেছেন, তা খুব কৌতূহল-উদ্দীপক।

I lived among selqups in Western Siberia 1964-1965. It was a wild place . There was 1500km to the nearest railway station and 900 km to the nearest road .

Local people had seen a car on the cinema screen only. At winter there was quite often -35 to -45 by Celsius . On the coldest day it was -55. Local selqups were hunters and fishers.

Fresh warm blood of reindeers mixed with spiritus vini was the favourite drink. Several species of fish were eaten raw.

I collected selqupian folklore on the tapes.

এই কবির সঙ্গে আমার বেশ ভাব জমে গিয়েছিল।

আমি পৃথিবীর যে-দেশেই যাই, দু-চারজন বাঙালির সঙ্গে ঠিক দেখা হয়ে যায়। পশ্চিমবাংলার বাঙালি না হলেও বাংলাদেশি থাকবেই। তাদের আন্তরিকতা ও আতিথেয়তাও খুব বেশি, আমাকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে যায়, বিরিয়ানি খাওয়াবেই।

এই নিউজিল্যান্ডই একমাত্র দ্বিতীয় দেশ, যেখানে একজনও বাঙালির দেখা পাইনি। কিছু বাঙালি অবশ্যই আছে, কেউ খবর পায়নি।

টানা ন’দিন আমি একটাও বাংলা কথা বলিনি।

না, বলেছি দু-চারটি কথা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। খুব গোপন কথা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *