তুষারপাতের মধ্যে সেদিনের সেই কবিতা পাঠ

তুষারপাতের মধ্যে সেদিনের সেই কবিতা পাঠ

শ্ৰীমতী নূপুর লাহিড়ি এক আশ্চর্য মহিলা। এরকম জীবনীশক্তিতে ভরপুর, তেজি, কোমল, নানা গুণের অধিকারিণী রমণী আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। সিকি শতাব্দীরও বেশি বিদেশবাসিনী হয়েও প্রাক্তন স্বদেশ, বিশেষত কলকাতা শহর সম্পর্কে টান তাঁর একটুও কমেনি।

এরকম অবশ্য আরও অনেক বাঙালিই আছেন দেশান্তরে যাঁরা মাঝে-মাঝেই তাঁদের বাল্য-কৈশোরের লীলাভূমি সম্পর্কে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন, ফিরে আসেন বছরে অন্তত একবার। সাধারণত পশ্চিমি দেশের শীতের প্রাবল্যের কারণে আমাদের এখানকার মৃদু ঠান্ডাই অনেকের পছন্দ। শীতকালে যাঁরা দলে দলে এখানে চলে আসেন, তাঁদের নাম দেওয়া হয়েছে শীতের পাখি।

কিন্তু এই স্মৃতিকাতরতা বা নস্টালজিয়া অনেকটাই ব্যক্তিগত। বিদেশে যাঁরা প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছেন এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছেন, তার সুফল জন্মভূমিতে বিশেষ টের পাওয়া যায় না। কেউ কেউ অবশ্য গ্রামের স্কুলের সংস্কারের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য করেন, কেউ কেউ হয়তো গরিব আত্মীয়স্বজনকে কিছু ছিটেফোঁটাও দিয়ে থাকেন। মেদিনীপুরের এক অখ্যাত গরিব পরিবারের ছেলে মণি ভৌমিক আমেরিকায় বৈজ্ঞানিক হিসেবে বেশ কয়েকটি পেটেন্ট নিয়েছেন, বিপুল অর্থেরও অধিকারী হয়েছেন, তিনি এখন মেধাবী, গরিব ছাত্রছাত্রীদের জন্য এখানে প্রতি বৎসর অনেকগুলি স্কলারশিপেরও ব্যবস্থা করেছেন, এরকম দৃষ্টান্তও আছে। অর্মত্য সেনের প্রাচী প্রতিষ্ঠানের কথাও সবাই জানেন। তবু এগুলিকেও ব্যতিক্রমই বলা যায়। অনেকে কিছুই করেন না।

আবার এ কথাও ঠিক, বিদেশে অবস্থানকারীদের সকলকেই টাকার গাছ ধরে নিয়ে আমাদের স্থানীয় অনেক আসল না নকল প্রতিষ্ঠান আর্থিক সাহায্যের জন্য ঝুলোঝুলি করে তাঁদের বিরক্তির উৎপাদন করেন। কে আসল, কে নকল তা ঠিক করতে না পেরে প্রবাসীরা সকলের থেকেই রক্ষা করেন দূরত্ব।

নূপুর লাহিড়ির দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই আলাদা।

প্রথমদিকে প্রথম কিছু বছর নূপুর ব্যস্ত নিজের যোগ্যতা অর্জন এবং ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা নিয়ে।

এদেশ থেকে ডাক্তারি পাস করে গিয়েছিলেন নূপুর, বিয়েও হয় এক বাঙালি ডাক্তারের সঙ্গে। জন্ম হল দুটি সন্তানের, বাচ্চা বয়েসে তাদের লালন-পালনের ভার নিয়েও নূপুর নিজের চিকিৎসকের কাজ ছাড়েননি।

ক্রমে সেই ছেলে দুটি সাবালক হল। ওদেশে তারপর আর ছেলেরা বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে না।

একজন হল ডাক্তার, অন্যজন গেল গান-বাজনা ও অভিনয়ের দিকে। দুজনেই সার্থক। এখানে আর-একটি বিস্ময়ের কথাও জানানো দরকার। দুটি প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের জননী। হলেও নূপুরের কিন্তু বয়স বাড়ল না। সে যে শুধু পূর্ণ যুবতী তাই-ই নয়। সে সদাচঞ্চলা।

পারিবারিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে নূপুর একদিন তার স্বামীর কাছ থেকে চাইল স্বাধীনতা। সে তার জীবনকে অন্যভাবে পল্লবিত করতে আগ্রহী। কিশোরী নূপুর গান শিখেছিল, একটু-আধটু লেখার চর্চাও ছিল, মাঝখানে বহু বছর সেসব ভুলে থাকতে হয়েছে। এবার সে আবার শিল্প-সংস্কৃতির দিকে ফিরে যেতে চায়।

বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেল স্বামীর সঙ্গে। চিকিৎসক হিসেবে তার কিছুটা প্রতিষ্ঠা ছিলই। তাতে সে আরও মনোযোগ দিয়ে গড়ে তুলল প্রতিপত্তি। কিনল একটা অট্টালিকাসম গৃহ, তার বেসমেন্টেই শ-খানেক মানুষ সমবেত হতে পারে নানান উৎসবে।

কলকাতায় নপুরদের বাড়িতে ছিল সাহিত্য ও গানবাজনার পরিবেশ। তার বাবা। একজন বিশিষ্ট লেখক, নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। ভ্রমণসাহিত্যে তাঁর স্থায়ী আসন আছে। একসময় ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, তাঁর ‘শংকর-নর্মদা’। তাঁর ‘খাজুরাহো চান্দেল্ল স্মৃতি’ নামে একটি গ্রন্থ আমার বিশেষ প্রিয়। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ও ছিল। একদিন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাইয়েও ছিলেন। নূপুরকে অবশ্য তখন দেখিনি।

সেই বাড়ির মেয়ে হয়ে নূপুর বিদেশে স্বাধীন জীবনযাত্রা শুরু করার পর মন দিল সংস্কৃতিচর্চায়। গানবাজনা তো শুরু করলই; নিজে গান লিখে সুরও দিল। তার প্রথমদিকের সেরকম একটি গান বিবাহ প্রথারই বিরুদ্ধে; ‘ভালো যদি বাসো সখী, সিঁদুর পরো না!’

নিজের বাড়িতে নূপুর স্থাপন করল একটা লাইব্রেরি। তাতে বাংলা বই ছাড়াও রইল নানান ভারতীয় সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ। তার উদ্দেশ্য, শুধু বাঙালিরা নয় উৎসাহী আমেরিকানরাও যাতে সেই লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারে।

নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকায় গেলেন এই মেয়ের কাছে। বাবা সেখানে বসে লিখবেন, তাই নূপুর একটি সুদৃশ্য ঘরে টেবিল চেয়ার পর্যন্ত সাজিয়ে রেখেছিল। কিন্তু নির্মলচন্দ্র অকস্মাৎ সেখানে শেষ নিশ্বাস খরচ করে ফেলেন। বাবার স্মৃতিতেই নূপুরের সেই লাইব্রেরি। নূপুর লেখালেখিও শুরু করে নতুনভাবে। তার কয়েকটি কবিতা মুদ্রিত হয়েছে ‘দেশ’ পত্রিকায় এবং ‘কৃত্তিবাস’ ত্রৈমাসিকে।

নূপুর আর-একটি খুব উচ্চাকাঙ্খী পরিকল্পনা নিয়ে ফেলে। এদেশ থেকে যেসব গায়ক-গায়িকা, নাট্যদল বা লেখক-লেখিকারা মাঝে-মাঝে

আমন্ত্রিত হয়ে ওদেশে যান, তাঁদের দর্শক-শ্রোতা অধিকাংশই বাঙালি। সাহেব-মেম প্রায় থাকেই না বলতে গেলে। নেহাত বিবাহসূত্রে ছাড়া অর্থাৎ কারুর মেম-বউ বা সাহেব স্বামী। সে বেচারিরা ভাবলেশহীন মুখে বসে থাকে, ভাষার ব্যবধানের জন্য।

নূপুর ঠিক করল, পশ্চিমবাংলা থেকে এক-একটি সাংস্কৃতিক দল সে নিয়ে যাবে ওদেশে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে এবং অনুষ্ঠান এমনভাবে সাজাবে যাতে ইংরেজিভাষীরাও অংশগ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ সে বাঙালির সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে চায় ওদেশে। এ কথা তো সত্যি, ওদেশের বহু শিক্ষিত ব্যক্তিও বাংলা ভাষা সম্পর্কে কিছুই জানে না। এই প্রজন্মের আমেরিকানরা ভুলে গেছে রবীন্দ্রনাথের নামও।

এই উদ্দেশ্যে স্থাপিত হল বেঙ্গল ফাউন্ডেশান’। পরিকল্পনা ও অর্থব্যয় সবই নূপুরেরই। তার উদবোধন উপলক্ষে কলকাতা থেকে যাবে প্রায় দশজনের একটি দল, কিছুটা নাটক, আবৃত্তি গান, কবিতা পাঠ সব মিলিয়ে। সে নির্বাচন করল অধিকাংশ তরুণ শিল্পীদের, তবে দলটির নেতৃত্ব দেবে ততটা তরুণ নয় এমন একজন। কিংবা বলা যায় মনে-মনে তরুণ হলেও চেহারা বা বয়েসে আর তরুণ নয়, অর্থাৎ আমি।

নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে হিসেবে নয়, সে-পরিচয় আমি অনেক পরে জেনেছি, এমনিই এক ব্যক্তিত্বময়ী, আকর্ষনীয়া রমণী হিসেবে নূপুর একদিন কলকাতায় আমার বাড়িতে আসে আলাপ-পরিচয় করার জন্য। প্রথম আলাপের পরই তার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। চিকিৎসক হিসেবে সে মনস্তত্ববিদ, সুতরাং চিকিৎসার কারণে তার শরণাপন্ন এখনও হতে হয়নি আমাকে, কিন্তু তার সঙ্গে থেকেছি অনেক গান বাজনার আসরে। এদেশে আর ওদেশেও।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশান প্রতিষ্ঠার চিন্তায় একেবারে মেতে উঠল নূপুর। নামি চিকিৎসক। সুতরাং ব্যস্ততা তো থাকবেই। একটি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। তা ছাড়া নিজস্ব চেম্বারও আছে। এর বাইরে সময় পেলেই সে গান গায়, ছবি আঁকে, লেখে, আডড়া দেয়, পুরুষদের সঙ্গে কড়া জাতীয় পানীয় গ্রহণে সঙ্গ দিতেও তার আপত্তি নেই। এবং মাত্র দু-ঘণ্টার নোটিশে সে কুড়িজন অতিথিকেও নানা জাতীয় সুখাদ্য নিজে রান্না করে খাওয়াতে পারে।

আসন্ন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদবোধন অনুষ্ঠান সার্থক করার জন্য তাকে সাহায্য করতেও এগিয়ে এল অনেকে। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় তার এক বন্ধুর কথা, সে জন্ম-জার্মান কিন্তু এখন আমেরিকাবাসী, দীর্ঘকায়, সুপুরুষ, মধ্যবয়েসি এই মানুষটি অতি মধুরভাষী এবং কতরকম গুণের যে অধিকারী তা বলে শেষ করা যায় না। বাঁশি, পিয়ানো ইত্যাদি কুড়ি-পঁচিশরকমের বাজনা সে বাজাতে পারে সাবলীলভাবে, ছবি আঁকা ও কম্পিউটার গ্রাফিকসে সে দক্ষ, তার নাম এন্ডর। এই নামটিতেই বৈশিষ্ট্য আছে। ইংরেজি করলে হয় অ্যান্ড অর, বাংলায় এবং অথবা। এই নামটিতেই বেন প্রতিফলিত তার জীবনদর্শন। এবং আর অথবা, এই নিয়েই তো মানুষের জীবন।

বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখে নিয়েছে এন্ডর, মূল বাংলায় বইটই না দেখে গেয়ে যায়। আমেরিকানদের বাংলা কালচারে দীক্ষিত করার যে ব্রত নিয়েছে নূপুর, তার প্রথম সার্থক নিদর্শন এই এন্ডর। পায়ের ওপর পা দিয়ে সে যখন বাঁশি বাজায়, তাকে মনে হয় ফরসা কেষ্টঠাকুরটি!

এ ছাড়া রয়েছেন মীনাক্ষী ও জ্যোতির্ময় দত্ত। নতুন প্রজন্মের পাঠকরা সম্ভবত জানেন না যে মীনাক্ষী বুদ্ধদেব বসুর জ্যেষ্ঠা কন্যা, তার লেখার হাতটিও চমৎকার। জ্যোতির্ময় দত্ত আমেরিকায় যাওয়ার আগে অনেকবার ঝড় তুলেছে বাংলা সাহিত্যে। লিখেছে সম্পূর্ণ আলাদা স্বাদের কবিতা, লিখেছে নাটক, অসাধারণ ভ্রমণকাহিনি (তার অতল পাথরের সাগর যাত্রা’ নামে একটি লেখা আমার মতে বাংলা গদ্যের একটি অসাধারণ নিদর্শন), প্রচুর প্রবন্ধ এবং সম্পাদনা করেছে একদা বিখ্যাত ‘কলকাতা’ পত্রিকা। কবি বিনয় মজুমদার সম্পর্কে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে জ্যোতিই তাকে প্রথমে নিয়ে আসে উৎসাহী পাঠকদের গোচরে। আমেরিকায় গিয়ে জ্যোতি ইংরেজি সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ায় বাংলা সাহিত্যের খুবই ক্ষতি হয়েছে।

গৌতম দত্তের কথা অন্য একটি লেখায় উল্লেখ করেছি। ওদেশে সকলকেই নিজের কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। জীবিকার জন্য যে কাজ তারপরে আর অন্য অকাজের জন্য উৎসাহ থাকে না অনেকেরই। তবু কারুর কারুর মাথায় পোকা থাকে। তাদের উৎসাহও অদম্য। তারা নিজেকে নানা দিকে ছড়িয়ে না দিয়ে পারে না। আমার সৌভাগ্যবশত এইসব মানুষদের সঙ্গেই আমার সৌহার্দ হয়।

গৌতম দত্ত অনেকদিন মেতেছিল থিয়েটার নিয়ে, এখন তাকে টেনেছে কবিতার চুম্বক। অবশ্য থিয়েটারও সে ছাড়েনি। এখন আমি যে-সময়কার কথা লিখছি (১৯৯৭ সাল) তার কয়েক বছর পর গৌতম যে একটি বাংলা নাটক আমেরিকায় সাতটি শহরে অভিনয়ের বিশাল উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা বাংলা নাটকের ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সে-সম্পর্কে আমার কিছু লেখা শিষ্টাচারসম্মত নয়, হয়তো অন্য কেউ পরে লিখবে। সত্যিই বাংলা নাটক নিয়ে অমন কাণ্ড দূর বিদেশে আগে কখনও ঘটেনি।

করবী এবং অধ্যাপক মণি নাগও নূপুরের কর্মকাণ্ডের উৎসাহ দেন। রয়েছেন এরকম আরও বেশ কয়েকজন। ধ্রুব কুণ্ডু, যার কথা আগে লিখেছি, সে-ও প্রায় সর্বক্ষণ সাহায্য করেছে।

এদিকে কলকাতায় আমন্ত্রিতদের মধ্যে সাজো-সাজো রব পড়ে গেছে। এরা প্রায় কেউই আগে আমেরিকায় যায়নি। সকলেই অতিরিক্ত শীতবস্ত্র কিনে ফেলেছে। প্রত্যেকের টিকিটের ব্যবস্থা করেছে নূপুর, ওখানকার আতিথ্যের তো প্রশ্নই ওঠে না।

যাত্রার দিন খুব এগিয়ে এসেছে, এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত! আমেরিকায় উপদূতাবাস সকলেরই ভিসা প্রত্যাখ্যান করেছে!

এই ভিসা পাওয়া অনেকটা লটারির মতন। কখন যে ওঁদের কী মর্জি হয়, তা বলা মুশকিল। বিশেষত অল্পবয়েসি যুবক-যুবতিদের সম্পর্কে ওঁদের ঘোর সন্দেহ, একবার গেলে বুঝি আর ফিরবে না। অবিবাহিত কিংবা বেকাররাও এই সন্দেহ তালিকাভুক্ত। আর বারা মস্ত শিল্পী, তাদের ব্যাপারেও ওখানকার শিল্পীদের ইউনিয়নের অনুমতি লাগে। সে অনেক ঝামেলা।

মোট কথা, অনেক চেষ্টা করেও অন্যদের মিলল না ভিসা।

বাকি রইলাম, সবে ধন নীলমণি, আমি!

আমাদের ছাত্র বয়েসে জ্যোতি ভট্টাচার্য নামে একজন ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েও আগুনঝরানো বক্তৃতা দিতেন। ওয়ার্কাস পার্টি নামে একটি দলও খুলেছিলেন, কিছুদিনের জন্য সেই দলের নেতা হিসেবে তিনি মন্ত্রীও হয়েছিলেন প্রথম যুক্তফ্রন্টে। তাঁর সম্পর্কে বলা হত, ওই দলের নেতা আছে কিন্তু কর্মী নেই একজনও!

আমারও সেই অবস্থা! বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য একটি দলের নেতা হিসেবে আমার আমেরিকায় যাওয়ার কথা, কিন্তু আমাকে বিমানে চাপতে হল একা, দলের আর কেউ নেই। স্বাতীও সঙ্গে এল না কারণ, সেই বছরেরই গোড়ায় একসঙ্গে বিদেশে গিয়েছিলাম, এই সময়ে স্বাতী কোনও ব্যাপারে ব্যস্ত।

খুব সম্ভবত আমাকে একা দেখে নূপুর নিরাশ হয়েছিল। কিন্তু কী আর করা যাবে!

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা উৎসবের অবশ্য কোনও ত্রুটি রাখেনি নূপুর। অনেকগুলি প্রোগ্রাম ঠিক হয়ে আছে। নিছক বাঙালিদের অনুষ্ঠান নয়। বাংলা সংস্কৃতিনির্ভর আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া আছে তাতে। কিছু আমেরিকান ছেলেমেয়ের সঙ্গে বাঙালি ছেলেমেয়েরা মিলে কোরাসে গেয়েছে বাংলা গান, ছোট ছোট স্ক্রিপ্ট, আবৃত্তি এবং চমৎকার মিশ্র নাচ।

আমার জন্য নির্ধারিত ছিল উদবোধন করা এবং সংক্ষিপ্ত ভাষণ। কিন্তু কবিতা পাঠ ছাড়া কি কোনও বাংলা অনুষ্ঠান হতে পারে। শেষ দিনে আমাকে পড়তে হল অনেকগুলি কবিতা।

নূপুর থাকে নিউ জার্সির প্রিন্সটন শহরে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিখ্যাত। আইনস্টাইন শেষের অনেকগুলি বছর এখানেই যুক্ত ছিলেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি হলে অনুষ্ঠান।

দুপুর থেকেই বইছিল ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া। বিকেলের দিকে শুরু হল ঝিরঝিরি তুষারপাত। বাড়ির জানলায় বসে প্রথম দিনের এই তুষারপাত দেখতে বেশ ভালোই লাগে, গাছের ডালাপালায় জুই ফুলের মতন জমতে থাকে শ্বেত বিন্দু, কিন্তু এসময় নেহাত প্রয়োজন ছাড়া বেরুতে ইচ্ছে করে না। তাহলে আজ অনুষ্ঠান দেখতে শুনতে ক’জন আসবে?

গুটি-গুটি আসতে লাগল কিছু মানুষ। এসব দেশে বৃষ্টির মতন তুষারপাতের সময় ছাতা মাথায় কেউ রাস্তা দিয়ে আসে না, সকলেই আসে গাড়িতে। গাড়ি জমতে লাগল ক্রমে ক্রমে। শেষ পর্যন্ত হল পুরোপুরি ভরতি হল না বটে, কিন্তু অর্ধেকেরও বেশি আসন পূর্ণ হল। তার মধ্যে শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গিনীর সংখ্যাও কম নয়।

বলাই বাহুল্য, আমার কবিতা পাঠ সবচেয়ে শেষে। অন্যান্য অনুষ্ঠান ছাড়াও কাছাকাছি আরও কয়েকজনের কবিতা পাঠও ছিল। দু-একবার সিগারেট টানার জন্য আমাকে বাইরে আসতেই হয়। বাইরে হু-হুঁ হাওয়ায় শীতে একেবারে হাড় কাঁপিয়ে দেয়।

একবার ধ্রুব কুণ্ডু কাছে এসে বলল, সুনীলদা, এত ঠান্ডায় কাঁপতে-কাঁপতে কবিতা পড়বেন কী করে? গা-গরম করা দরকার। আসুন আমার সঙ্গে।

গাড়ি খানিকটা দূরে রাখতে হয়। দৌড়ে গেলাম সেদিকে। গাড়ির মধ্যে উঠে বসলে আর শীত লাগে না। ধ্রুবর গাড়িতে অতি উৎকৃষ্ট স্কচ এবং ব্র্যান্ডির ব্যবস্থা থাকে।

ধ্রুব বলল, বাকি বারা আসেনি, তাদেরও সবার হয়ে আপনাকে পড়তে হবে। ভালো করে চাঙ্গা হয়ে নিন।

কয়েক চুমুকেই শরীর বেশ তপ্ত হয়ে গেল এবং পাঠের সময় গলা একেবারে পরিষ্কার।

বেশ কয়েকটা কবিতা পড়েছিলাম। একজন কারুর অনুরোধে একেবারে শেষকালে পড়তে হল, ‘নীরা হারিয়ে যেও না’, খানিকটা দীর্ঘ কবিতা, তাই সেটা পড়তে আমার সংকোচ হচ্ছিল, তবু পড়তেই হল।

তারপরেই সাঙ্গ হল সভা।

বেরিয়ে আসছি, ভবানী মুখোপাধ্যায়, যে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, আবার ভালো গান গায়, সে বলল, সুনীলদা, নীরার শেষ কবিতাটার শেষ লাইনে যে ‘অমৃত খুকি’ লিখেছেন, ওইটার জন্যই কবিতাটা…

কবিতা পাঠের শেষে কোনও কোনও জায়গায় কোনও একজনের এরকম একটা উক্তি বহুকাল মনে থাকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *