৩৫. শননসো প্রাসাদ

‘এসো তবে আমরা ভালোবাসি, এসো ভালোবাসি
ধাবমান প্রহরকে উপভোগ করি দ্রুত
মানুষের কোনও বন্দর নেই
সময়ের কোনও তটরেখা নেই
শুধু বয়ে চলে, আমরাও পার হয়ে যাই!’
–আলফঁস দ্য লামারতিন

পৃথিবীর নানান দেশে এ পর্যন্ত আমি যত দেখেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণযোগ্য হচ্ছে শননসো (Chenonceau) প্রাসাদ। যদি কেউ বলে, নদীর ওপর বাড়ি, তাহলে মনে হবে কোনও নদীর খুব ধার ঘেঁষে বাড়ি, ছায়া পড়ে নদীর জলে। শননসো তো নয়। এই প্রাসাদটির স্থাপত্য-পরিকল্পনাই অতি অভিনব। সামনের দরজাটি নদীর এক পারে, পেছনের দরজা দিয়ে বেরুলে দেখা যায় নদীর অন্য পারে পৌঁছে গেছি। এবং এ বড়ির তলা দিয়ে নৌকো, স্টিমার, গাদাবোট দিব্যি পার হয়ে যায়।

নদীটি অবশ্য লোয়ার নয়। তারই এক শাখা নদী, নাম শের। বাংলা মতে এটা একটা পুরুষ নদী। এর নামের অর্থ প্রিয়। নারী হলে নাম হতে শেরি। মাঝারি আকারের ছিমছাম, শান্ত নদীটি বেশ মনোরম।

দুপুরের একটু আগে আমরা পৌঁছলাম এই নদীতীরে। নদীর এক দিকে সুসজ্জিত উদ্যান, বড় বেশি সুসজ্জিত, আমার এই ধরনের বাগান পছন্দ হয় না, বরং নদীর ওপারের এলোমেলো গ্রাম্য প্রকৃতি দেখলে চোখ জুড়োয়। শননসো প্রাসাদটিকে দূর থেকে, ডান পাশ ও বাঁ পাশ থেকে এবং কাছাকাছি গিয়ে আলাদা আলাদা রকমের দেখায়।

অন্যান্য প্রাসাদের সঙ্গে এই প্রাসাদটির আর একটি পার্থক্য এই যে এটির নির্মাণ, পরিবর্ধন ও অঙ্গসজ্জার সঙ্গে বেশ কয়েকজন মহিলার নাম জড়িত। স্থপতি ও মিস্তিরিরা অবশ্যই পুরুষ ছিল, তবু প্রাসাদটি যেন কয়েকটি নারীর স্বপ্ন দিয়ে গড়া।

এর ইতিহাস প্রায় পাঁচ সাতশো বছরের। আগে ছিল একটা ছোটখাটো দুর্গ, ষোড়শ শতাব্দীতে নর্মান্ডির এক ট্যাক্স কালেক্টর সেই দুর্গ এবং তার সংলগ্ন জমিদারিটি কিনে নেয়। তার স্ত্রী ক্যাথরিনের প্রখর সৌন্দর্যবোধ ছিল, তার নির্দেশেই পুরোনো দুর্গটি ভেঙে সেখানে তৈরি হয় এক নতুন হ্য, তখন ইতালির রেনেশাঁস-এর প্রভাব পড়েছে ফ্রান্সে, এর নির্মাণ-পরিকল্পনাও ইতালিয়ানদের কাছ থেকে ধার করা। ক্যাথরিন মনের আনন্দে বাড়িটি সাজাচ্ছিল, স্বামীর কাছ থেকে যখন-তখন দাবি করত অঢেল টাকা, সেই টাকা যে কোথা থেকে আসছে তার খবর রাখত না। সুন্দরী স্ত্রীর বিলাস-বাসনা পূরণ করতে গিয়ে ট্যাক্স কালেক্টরটি দুর্নীতির আশ্রয় নিতে বাধ্য হল, এক সময় ধরাও পড়ে গেল। রাজকোষ তঞ্চকতার দায়ে জড়িয়ে পড়ার পর এই প্রাসাদ ও জমিদারি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হল। কিনে নিলেন রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া। ক্যাথরিনের মনের অবস্থা তখন কীরকম হয়েছিল ইতিহাস তা লিখে রাখেনি।

রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া শামবর প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন, সুরম্য ভবনের দিকে তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল, লোয়ার নদীর দু’পারের অনেকগুলি শাহতা’র সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত। তিনি শননসো রক্ষা করেছিলেন কিন্তু তাঁর বংশধর দ্বিতীয় অঁরি (অথবা হেনরি এটা দান করলেন তাঁর রক্ষিতা দিয়ান ন্য পোয়াতিয়ের-কে। রাজার রক্ষিতা, সতরাং টাকার অভাব নেই, দিয়ান এই বাড়িটাকে বাড়াতে লাগলেন ইচ্ছেমতন, তাঁর আমলেই বাড়ির এক পাশ থেকে সেতু তৈরি হল নদীর ওপরে। রাজকোষের অবস্থা তখন তেমন ভালো ছিল না, তাই রাজা দ্বিতীয় অঁরি তাঁর রক্ষিতার মনোরঞ্জনের জন্য নতুন নতুন কর বসাতে লাগলেন, তার মধ্যে গির্জার ঘণ্টার মতন সব ধরনের ঘণ্টার ওপরও কর। সেকালের প্রখ্যাত লেখক রাবেলে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘এ রাজ্যের সব কটা ঘণ্টা রাজা তাঁর ঘোটকীর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন।’ দিয়ানের ছিল খুব গাছপালার শখ, বহু জায়গা থেকে গাছ এনে তিনি সাজিয়েছেন উদ্যানটি।

রাজামশাই মারা যেতেই তাঁর বৈধ পত্নী ক্যাথরিন মেদিচি তাঁর চক্ষুশূল ওই রক্ষিতাটিকে বিদায় করে দিলেন শননসো প্রাসাদ থেকে। ক্যাথরিন দ্য মেদিচি অতি উঁদে মহিলা ছিলেন, তাঁর সমস্ত কীর্তিকাহিনী লিখতে গেলে সাত কাণ্ড হয়ে যাবে, সে দিকে আর যাচ্ছি না। এক দিকে যেমন তিনি প্রাসাদটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করার দিকে মন দিলেন, তেমনি তাঁর আমলেই এখানে হয়েছে আড়ম্বর, বিলাসিতা ও বেলেল্লাপনার চূড়ান্ত। আগে যে সেতুটি তৈরি হয়েছিল, ক্যাথরিন দ্য মেদিচি সেটিকে বানালেন দোতলা, ওপরের তলায় হল দুশো ষাট ফিট লম্বা এক গ্যালারি, এবারেই প্রাসাদটি নদীর এক তীর থেকে অন্য তীরে বিস্তৃত হল। মাঝে মাঝে বিশিষ্ট অতিথিরা এলে এখানে সারা রাত ধরে নাচ-গান, হইহল্লা, সুরার স্রোতে অবগাহন এবং ব্যভিচার চলত। যে-বার মেরি স্টুয়ার্ট এসেছিলেন, সেবার এক হাজার নারী-পুরুষকে বিভিন্ন পোশাকে সাজিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর অভ্যর্থনার জন্য। বিখ্যাত কবি সার-কে দিয়ে তিনি সেই উপলক্ষে কবিতা রচনা করিয়েছিলেন।

এই প্রাসাদের তলা দিয়ে যে নদী বইছে, তার স্রোতের মতন সময়ও বয়ে যায়। ক্যাথরিন দ্য মেদিচির বিলাস-বৈভবের দিনও ফুরিয়ে গেল এক সময়। তাঁর ছেলে রাজা তৃতীয় অঁরি খুন হলেন হঠাৎ, তিনিও আর বেশিদিন বাঁচলেন না, প্রাসাদটি দিয়ে গেলেন তাঁর বিধবা পুত্রবধূ লুইসকে। হঠাৎ যেন এখানকার আবহাওয়া সম্পূর্ণ বদলে গেল। বিধবা হলেই যে রানিরা সব ভোগ বাসনা মুছে, ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে যান তা তো নয়, অনেকেই বিলাসিতা ও লাম্পট্য চালিয়ে যান আরও অনেক গুণ, কিন্তু লুইস এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। তাঁর স্বভাব তাঁর শাশুড়ির ঠিক উলটো। তিনি সমস্ত উৎসব আড়ম্বর বন্ধ করে দিলেন। ফরাসি রাজ পরিবারের শোকের পোশাক সাদা, রানি লুইস এর পর বাকি জীবন শ্বেত বসন ছাড়া আর কিছুই পরেননি। স্থানীয় লোকের কাছে তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘শ্বেতবসনা রানি’। তাঁর ঘরে ঝুলত কালো রঙের পরদা, তাঁর বিছানা, চেয়ার-টেবিল, সমস্ত আসবাব কালো ভেলভেট দিয়ে মোড়া। অবিকল সেই ঘরটিতে সেই শোকসন্তপ্ত রমণীর চিহ্ন রয়ে গেছে। জীবনের অবশিষ্ট এগারো বছর তিনি নির্জনে শুধু প্রার্থনা, সেলাই ও বই পড়ে কাটিয়েছেন।

হাত ঘুরতে-ঘুরতে এই শাতোটি চলে আসে মাদাম দুপচাঁ নামে আর এক মহিলার হাতে। বিলাস-ব্যভিচারের দিকে এই রমণীর ঝোঁক ছিল না, এঁর রুচি ছিল শিল্প সাহিত্যে। মাদাম দুপচাঁ এখানে একটি সাঁলো পরিচালনা করতেন। এই সাঁলো নামে ব্যাপারটি আমাদের দেশে অজ্ঞাত। ফরাসি দেশের কোনও কোনও অভিজাত পরিবারের মহিলা নিজের বাড়িতে কবি, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের নিয়মিত আড়ার ব্যবস্থা করতেন। সেখানে আমন্ত্রিতদের খাদ্য, পানীয় ও সব রকম আতিথ্য দিয়ে অভ্যর্থনা করা হত। শিল্প সাহিত্য নিয়ে নানারকম তর্ক-বিতর্ক ও হাস্য-পরিহাস হত, সেই বিদগ্ধজনদের মধ্যমণি হয়ে থাকতেন গৃহস্বামিনী। অনেক দুঃস্থ শিল্পী-কবি এই সব রমণীদের কাছে উপকৃত হয়েছেন, কেউ কেউ সৃষ্টির প্রেরণা পেয়েছেন। আমাদের দেশে বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় নবরত্ন ছিল, রাজা-রাজড়ারা অনেকেই সভাপতি রাখতেন, গত শতাব্দীর বড়লোকেরা মোসাহেব পুষতেন, কিন্তু কোনও মহিলা নিজের বাড়িতে শিল্পী সাহিত্যিকদের নিয়ে আড্ডার আসর বসিয়েছেন, এমন শোনা যায়নি।

মাদাম দুপ্যাঁ এখানে তাঁর ছেলের জন্য একজন গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন, পরবর্তীকালে যিনি বিশ্ববিখ্যাত হন। জাঁ জাঁক রুসো! এখানে বসেই রুসো তাঁর শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব ও একটি উপন্যাস লেখেন। রুসো তাঁর আত্মজীবনী ‘কনফেসানস’-এও শননসো’র দিনগুলির উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ওই চমৎকার জায়গাটিতে আমাদের খুব ভালো সময় কেটেছিল। খাওয়াদাওয়া হতে দারুণ। খেয়েদেয়ে আমি পাদরিদের মতন মোটা হয়ে গিয়েছিলাম।’

মাদাম দুপ্যাঁ আর যেসব বিখ্যাত ব্যক্তিদের নেমন্তন্ন করতেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ভলতের, আমরা যাঁকে বলি ভলতেয়ার। রুসো এবং ভলতেয়ার একই সঙ্গে ওই সাঁলোতে উপস্থিত ছিলেন কি না তা আমি অনেক বই খোঁজাখুঁজি করেও জানতে পারিনি। তা হলে, ওঁদের দু’জনের কথোপকথন নিশ্চিত খুব আকর্ষণীয় হত। এঁরা ছিলেন পরস্পরের ঘোর শত্রু!

বিখ্যাত শিল্পী ও লেখকদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত কিংবা নিছক ঈর্ষাপ্রসূত ঝগড়া অনেক সময় অন্যদের কাছে মজার লাগে। ফরাসি দেশে ইমপ্রেশানিস্ট শিল্পীগোষ্ঠীর অভ্যুত্থানের আগে দুই প্রধান শিল্পী ছিলেন অ্যাগ্রে (Ingre) এবং দেলাক্রোয়া (Delacroix), দুজনেই পেয়েছিলেন সার্থকতা এবং রাজকীয় সম্মান। প্যারিস শহরেই দুজনে ছিলেন, অনেক সভা-সমিতিতে ওঁদের দেখাও হয়েছে কিন্তু কেউ কারুর সঙ্গে একটা কথাও বলতেন না। রুসো আর ভলতেয়ারের ঝগড়ার সঙ্গে তুলনা করা যায় আমাদের দেশের বঙ্কিম ও বিদ্যাসাগরের। একই সময়ের এঁরা দুই মহীরুহ, দুজনেই শ্রদ্ধেয়, অথচ এঁদের মধ্যে মিল হয়নি। শুধু মতপার্থক্য নয়, ব্যক্তিগত আক্রমণও হয়েছে, বঙ্কিম প্রকারান্তরে বিদ্যাসাগরকে মূর্খ বলেছেন।

বঙ্কিম ছিলেন রুসোর ভক্ত। ভলতেয়ার আমাদের দেশের কারুকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন কি না জানি না। ফরাসি বিপ্লবের আগে রুসো এবং ভলতেয়ার দুজনেই শুধু লেখক হিসেবেই নয়, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব; দুজনেই রাজরোষে পড়েছিলেন, দুজনেই সাধারণ মানুষের মুক্তিসন্ধানী। দিদরো’র নেতৃত্বে ‘বিশ্বকোষ’ প্রকাশ ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে দুজনেই কোনও এক সময়ে যুক্ত হয়েছিলেন, দুজনেই পরে দূরে সরে যান। রুসো এক সময় ছিলেন ক্যালভিনিস্ট, পরে তিনি আত্মার অনিশ্চয়তা এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাসে ফিরে যান। রুসোর মতে, নাস্তিকতা বড়লোকদের বিলাসিতা। গরিব লোকদের নানানরকম ধর্মীয় উপকথা এবং ধর্মসঙ্গীত অবলম্বন করে বাঁচতে হয়। ভলতেয়ার ধর্ম জিনিসটাকে ঘৃণা করতেন, ধর্মের নামে নানাবিধ ব্যবসায়ের দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, তবে তিনি ঈশ্বরকে মানতেন, যিনি সমস্ত ধর্মের ঊর্ধ্বে, যিনি পৃথিবীর জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের ঈশ্বর। গির্জার সঙ্গে বহুবার ঝগড়া করলেও জীবনের একেবারে শেষ বছরে ভলতেয়ার পাদরিদের কাছে প্রথাগত ধর্মাচরণের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। না হলে মৃত্যুর পর কোনও কবরখানায় তাঁর স্থান হবে না, তাঁর শরীরটা ফেলে দেওয়া হবে ভাগাড়ে, এই চিন্তায় ভলতেয়ার বিচলিত হয়েছিলেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, ভলতেয়ার ভবিষ্যৎ মানব জাতির জন্য একটা ছোট্ট ঘোষণাপত্র রেখে যান। তাতে লিখেছিলেন :

ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি রেখে, বন্ধুদের ভালোবেসে, শত্রুদের ঘৃণা না করে, কুসংস্কারের প্রতি বিরাগ নিয়ে আমি মারা যাচ্ছি।

রুসো ও ভলতেয়ারের এরকম অনেক মিল থাকলেও তাঁরা পরস্পরকে সহ্য করতে পারতেন না। রুসো নামে আরও দু’জন লোকের ওপর ভলতেয়ার আগে থেকেই রেগে ছিলেন। জাঁ জাঁক রুসো যে আলাদা, তৃতীয় একজন রুসো, তা জানার পরেও ভলতেয়ার ওঁর রচনার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হননি। রুসো ভলতেয়ারকে তাঁর লেখা ‘মানুষের মধ্যে অসাম্যের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত প্রস্তাব’ বইটি পাঠান মতামতের জন্য। উত্তরে ভলতেয়ারের চিঠিখানা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

তিনি লিখেছিলেন,

মহাশয়, মনুষ্যজাতির বিরুদ্ধে আপনার নতুন বইটি আমি পেয়েছি। আমাদের জানোয়ার বানাবার জন্য এতটা ধীশক্তি কেউ আর কখনও ব্যয় করেননি, এবং আপনার পুস্তকটি পড়লে চার পায়ে হাঁটার ইচ্ছে জাগে। তবে কি না, ষাট বছরেরও অধিককাল ধরে অভ্যেসটা না থাকায় আমার পক্ষে তা ফের শুরু করা দুর্ভাগ্যক্রমে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। আর এ ব্যাপারে যারা আপনার এবং আমার চেয়ে যোগ্য, তাদের প্রতি এই পদ্ধতিতে হাঁটার ভার দিচ্ছি।…

(ফরাসি ভাষাবিদ শ্রী পুষ্কর দাশগুপ্ত ভলতেয়ার সম্পর্কে একটি মূল্যবান বই রচনা করেছেন। ‘ভলতের জাদিগ ও অন্যান্য উপাখ্যান’ থেকে এই চিঠির অনুবাদ গ্রহণ করেছি আমি।)

ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে জানি। তবে এই দুই লেখক সম্পর্কে আর একটুখানি বলেই এই প্রসঙ্গ শেষ করছি। ভলতেয়ার এবং রুসো এই দুজনেরই সমাধি হয় আলাদা আলাদা দুটি গ্রামে। ফরাসি বিপ্লবের পর বিশেষ সম্মান জানাবার জন্য এঁদের দুজনেরই হাড়গোড় তুলে এনে প্যারিস শহরের বিশিষ্ট সমাধিভবন পঁতেয়োঁ-তে (Pantheon) সুদৃশ্য শবাধারে রাখা হয়। গুজব আছে, রাত্তিরের দিকে তেয়োঁ-তে ঢুকলে এখনও এঁদের ঝগড়া শোনা যায়।

শননসো প্রাসাদটি নদীর ওপর বিস্তৃত হলেও খুব বিশাল নয়। সবগুলি ঘর ঘুরে দেখতে ক্লান্তি আসে না। বিশেষত এখানে কিছু ভালো ছবি আছে। অন্যান্য শাতোগুলোতে বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি প্রায় দেখাই যায় না। আগে যা ছিল, তাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্যারিসে। একটু নামকরা শিল্পীদের ছবিরই এখন অসম্ভব দাম। এখানে দেখা গেল ভ্যান লু’র ‘তিন রমণী’, একটি ঘরের সিলিং অঙ্কিত করেছেন রুবেনস। এক একটা ঘরের জায়গা দিয়ে দেখা যায় নদী। খুব জাঁকজমকপূর্ণ ঘরগুলি দেখতে দেখতে হঠাৎ বাইরের নিরাভরণ প্রকৃতির দিকে মুখ ফেরালে চোখের বেশ আরাম হয়।

শুধু দ্রষ্টব্য জিনিসগুলি দেখাই নয়, একটা জায়গায় কিছুক্ষণ অলসভাবে কাটালে তবে তার সৌন্দর্য ঠিকমতন হৃদয়ঙ্গম করা যায়। শননসসা প্রাসাদের বাইরেও আমরা শুয়ে বসে কাটালাম কিছুক্ষণ। কিছু খাবার কিনে খাওয়া হল মাঠে বসে। তারপর আমরা বেরুলাম হোটেল খুঁজতে।

প্রায় দু’ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে অসীম যে হোটেলটি পছন্দ করল, সেটাই যে এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। হোটেলটি বেশ অগোছালো অবস্থায় রয়েছে, সম্ভবত মালিক বদল হয়েছে কিছুদিন আগে, বাগানটিতে চূড়ান্ত অযত্নের ছাপ। খাট-বিছানাও ঠিকঠাক নেই বলে মালিকানি প্রথম আমাদের থাকতে দিতে রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু আমরা এক প্রকার জোর করেই নিলাম। তার কারণ, হোটেলটির অবস্থান অতি চমৎকার জায়গায়। বড় রাস্তার খুব কাছেই একটা টিলার ওপরে হোটেল, রাস্তার ওপরেই লোয়ার নদী। ঘরে শুয়ে দেখা যায়। কাছাকাছি অন্য বাড়ি নেই বলে খুব নিরিবিলি। মনে হয় যেন হোটেল নয়, নদীর ধারে এক বাংলো। ভাড়াও বেশ সস্তা, আমরা এরপর এখানেই তিন চারদিন থেকে যাব ঠিক করলাম।

একসঙ্গে বেড়াতে বেরুলে দলের সবার মধ্যে একটা মিল দরকার। একজন কেউ বাতিকগ্রস্ত হলেই অনেক আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। কারুর যদি খাদ্যের ব্যাপারে খুঁতখুর্তুনি থাকে, কেউ যদি হাঁটতে রাজি না হয়, কারুর যদি জিনিসপত্র কেনার বাতিক থাকে, তাহলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমাদের এই দলটির চারজনের চরিত্র একেবারে আলাদা, প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত বেশ উগ্র, তবু আমরা একটা নিখুঁত টিম। ভ্রমণের ব্যাপারে একজন কোনও ইচ্ছে প্রকাশ করলেই অন্য তিনজন সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেয়। ভাস্কর যদি একদিন বেশি হাঁটাহাঁটি করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে, তা হলে আমরা ধরেই নিই যে পরের দিন ও দ্বিগুণ উৎসাহ দেখাবে। চলন্ত গাড়িতে যেতে-যেতে বাদল যদি একদিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, আমরা ওই বাড়িটা দেখতে যাব না? অসীম সঙ্গে সঙ্গে সদিকে গাড়ি ঘোরায়। অসীম হোটেল খোঁজার জন্য বহু সময় ব্যয় করলেও আমরা জেনে গেছি, শেষ পর্যন্ত ওর পছন্দটা অতীব প্রশংসার যোগ্য হবেই।

হোটেলটায় জিনিসপত্র রাখার পর ভাস্কর জিগ্যেস করল, এখানে কাছাকাছি দেখার মতন সবচেয়ে ভালো জিনিস কী আছে রে?

আমি অসীমের দিকে তাকিয়ে বললাম, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বাড়ি, তাই না?

ভাস্কর সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে বলল, চল, এক্ষুনি সেটা দেখে আসি।

বাদল জিগ্যেস করল, তা হলে জুতো খুলব না তো?

অসীম বলল, লিওনার্দোর বাড়ি দেখতে অনেকটা সময় লাগবে, ভাস্কর। এখন সন্ধে হয়ে এসেছে। কাল সকালে যাওয়াই ভালো। কাছেই আমবোয়াজ শহর, চলো সেই শহরে গিয়ে এমনি কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই। সবসময় যে নামকরা কিছু দেখতেই হবে তার কি মানে আছে?

ভাস্কর তাতেই রাজি, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জলি গুড আইডিয়া। চলো!

আমবোয়াজ শহরের প্রান্তে এসে গাড়িটা রাখা হল নদীর ধারে। তারপর আমরা হাঁটতে লাগলাম। সন্ধে হয়ে এসেছে, ম্লান আলো ছড়িয়ে আছে নদীর ওপরে। এখানে নদীর ধারে মানুষজনকে গুলতানি করতে দেখা যায় না। দু-এক জোড়া নারী-পুরুষ হাঁটছে হাত-ধরাধরি করে।

নদীপ্রান্ত ছেড়ে আমরা ঢুকে পড়লাম শহরে। আমবোয়াজ আর কী শহর, জনসংখ্যা অতি নগণ্য, আমাদের একটা বড় গ্রামেও এর চেয়ে বেশি লোক থাকে। তবু এখানকার সব পথঘাট বাঁধানো, দু-ধারে অজস্র দোকান। কাফে-রেস্তোরাঁ ছাড়া অন্য সব দোকানই ছ’টার পর বন্ধ হয়ে যায়, কাঁচের ভেতর দিয়ে দোকানগুলো দেখতে দেখতে হাঁটতেই ভালো লাগে।

কিছুদূর যাওরার পর হঠাৎ মনে হয়, এই রাস্তা দিয়ে একদিন লিওনার্দো দা ভিঞ্চিও নিশ্চয়ই হেঁটেছিলেন।