৩৪. পৃথিবীর সম্ভাব্য ধ্বংসের কথা

‘একদিন এই পৃথিবী আর কিছুই থাকবে না
শুধু এক অন্ধ অবস্থান, যেখানে শুধু
বিভ্রান্ত দিন আর রাত্রি ঘোরে
বিশাল আকাশের নীচে যেখানে ছিল অ্যান্ডিজ পর্বতমালা
সেখানে একটি পাহাড়ও নেই, এমনকি একটা গিরিখাতও না

পৃথিবীর সমস্ত প্রাসাদ ও বাড়িগুলির মধ্যে
শুধু টিকে থাকবে একটি মাত্র বারান্দা
এবং সেই বিশ্বের মানবজাতির মানচিত্রে
শুধু একটি বিষাদ, যার মাথায় আচ্ছাদন নেই।
ভূতপূর্ব আটলান্টিক মহাসাগরের চিহ্ন থাকবে
বাতাসের সামান্য লবণাক্ত স্বাদে
একটা মায়াময় উড়ন্ত মাছ জানবে না
সমুদ্র কেমন দেখতে ছিল।

১৯০৫ সালের এক কুপে’তে বসে
(চারটে চাকা আছে, কিন্তু রাস্তা নেই)
অতীত কালের তিনটি যুবতী কন্যা,
তখনও রয়ে গেছে, কিন্তু শরীর নেই, শুধু বাষ্প,
জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকবে বাইরে
আর ভাববে, প্যারিস বেশি দূর নয়
তারা প্রশ্বাসে নেবে বাতাসের দুর্গন্ধ
যাতে গলা বন্ধ হয়ে আসে।

একদা যেখানে অরণ্য ছিল, সেখানে ভেসে উঠবে
একটা পাখির গান, কেউ তাকে
দেখতে পাবে না, বুঝতে পারবে না, শুনতেও পাবে না
শুধু ঈশ্বর শুনবেন মন দিয়ে, এবং বলবেন :
আরে, এ যে একটা বউ কথা কও!’
–জুল সুপরভই

আজকাল বায়ুদূষণ, প্রকৃতির সর্বনাশ ও পৃথিবীর সম্ভাব্য ধ্বংসের কথা নিয়ে খুব আলোচনা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে দিকে-দিকে আলোচনা চলছে, আমেরিকা থেকে জাপানে, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পশ্চিম বাংলায়। এই বিষয়েই একজন কবি বেদনাময় গাঁথা রচনা করে গেছেন কতকাল, যখন এ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের কোনও চেতনাই জাগেনি।

জুল সুপরভই-এর জন্ম সুদূর উরুগুয়ে’তে মন্টভিডিও শহরে। ঝুল বারান্দার ঝুল আর জুলজুল করে তাকানোর জুল মিশিয়ে যা হয়, সেইরকম তাঁর নামের উচ্চারণ। আমাদের বাংলায়, জ আর ঝ-এর মাঝামাঝি কোনও অক্ষর নেই। বুদ্ধদেব বসু বরিস পাস্টেরনাকের ‘ডক্তর জিভাগো’ কিংবা ‘ডক্টর ঝিভাগো’ উপন্যাসের অনুবাদের সময় মাঝামাঝি একটা অক্ষর তৈরি করিয়েছিলেন, ‘জ’-এর তলায় ফুটকি, কিন্তু প্রেসওয়ালারা সেটি আর চালাতে চাইলেন না।

অল্প বয়েসেই বাবা-মা মারা যাওয়ায় জুল সুপরভই চলে আসেন ফ্রান্সে। পরবর্তীকালে আবার ফিরে যান দক্ষিণ আমেরিকায়। ফরাসিদের ভাষা সম্পর্কে এমনই গর্ব যে স্বদেশ থেকে বহু দূরে থাকলেও মাতৃভাষার চর্চা করতে ভোলে না। সে তো আমি মার্গারিটকেই দেখেছি, আমেরিকায় থাকলেও সে ফরাসি কবিতাতে সর্বক্ষণ মগ্ন থাকত। জুল সুপরভই এর স্বাস্থ্য বরাবরই রুগণ, তবু তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং ছটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। এই কবিতাটি পড়লে মনে হয়, তাঁর মনে সন্দেহ জেগেছিল, তাঁর সন্তানরা কি সুস্থ পৃথিবীর নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারবে?

চমৎকার এক সকালবেলা গাড়ি করে যাচ্ছি আমরা, ঝকঝকে দিন, চারদিকে সুমহান প্রকতি। হঠাৎ এই কবিতাটি আমার মনে জাগে। এই সন্দর পৃথিবীটাকে মানুষই ধ্বংস করে দেবে? মানুষের আরামের জন্যই তৈরি হয়েছে কলকারখানা, সেখানে উৎপন্ন হয়েছে মোটর গাড়ি, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, এই সব বিলাসদ্রব্যগুলো আসলে মানুষকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এদের বিষবাষ্পে ভবিষ্যতের বাতাস দারুণ বিষাক্ত হয়ে যাবে। পরমাণু অস্ত্রগুলোর বিস্ফোরণে যে-কোনও দিন চুরমার হয়ে যেতে পারে মানুষের গড়া সভ্যতা। এত কাব্য, এত সঙ্গীত, এত শিল্প, এত ভালোবাসা, ব্যর্থ হয়ে যাবে সব কিছু। এই কবি লিখেছেন, মানুষের সব ঘর বাড়ি চূর্ণ হয়ে যাবে। শুধু থাকবে একটি মাত্র বারান্দা। একটি বিদেহী পাখির গান ভাসবে হাওয়ায়, তা শোনার জন্য কেউ থাকবে না। শুধু ঈশ্বর শুনে চিনতে পারবেন!

জুল সুপরভই-এর মধ্যে কথা ভাবতে ভাবতে আর একজন কবির কথা মনে পড়ে। তার নামও জুল। জুল লাফর্গ। নামের মিল তো আছে বটেই, তা ছাড়াও এই ফরাসি কবিরও জন্ম হয়েছিল উরুগুয়ে’তে, মন্টভিডিও শহরে। বিস্ময়কর এই কবি, বেঁচেছিলেন মাত্র সাতাশ বছর। এঁর একটি কবিতার কয়েকটি লাইন আমার খুব প্রিয়। খুব সংক্ষেপে আমি নিজেকে দিয়ে দিতে চাইছিলাম এই বলে যে, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’, তখনই এই যন্ত্রণাময় উপলব্ধি হল, আসলে তো আমি আমার নিজের অধিকারী নই।

দশটি ভাইবোনের অন্যতম, এই জুল লাফর্গ মাত্র সাতাশ বছর বয়েসের মধ্যেই অনেক রকম কাণ্ড করে গেছেন। ফরাসি ভাষায় কবিতা লিখেছেন সমস্ত রকম প্রথা ভেঙে, যেগুলি আজও আগ্রহের সঙ্গে নোক পড়ে; ইমপ্রেশানিস্ট শিল্পীরা যখন আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তখন লাফৰ্গ ছিলেন তাঁদের প্রবল সমর্থক, তাঁর কবিতাতেও শিল্পের ওই ধারাটির যেন ছায়া পড়েছে। জার্মান ভাষা লিখেছিলেন বিশেষ করে জার্মান দর্শন গভীরভাবে জানার জন্য, জার্মানিতে গিয়ে পাঁচ বছর সম্রাজ্ঞী অগাস্টাকে বই পড়ে শুনিয়েছেন। এদিকে শরীরে বাসা বেঁধেছিল তখনকার দুরারোগ্য টি বি রোগ। মাত্র সাতাশ বছরের জীবনে, অসুস্থ শরীর নিয়ে এত সব কাজ কী করে সম্ভব? ফরাসি দেশে অতি অল্প বয়েসেই যেন প্রতিভার স্ফুরণ হয়। জোয়ান অব আর্ক উনিশ বছরের মধ্যেই ইতিহাসে এতখানি স্থান করে নিয়েছেন। আঠারো বছর বয়েসে যাবো যে কবিতা লিখেছে, তা নিয়ে পৃথিবীর বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও গবেষণা হয়। কর্সিকা দ্বীপের এক নির্যাতিত পরিবারের সন্তান নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ফরাসি দেশের সৈন্যবাহিনীর প্রধান হয়ে উঠেছিলেন নিতান্ত তরুণ বয়েসেই।

ভাস্কর আমাকে জিগ্যেস করল, কবি বোদলেয়ার কতদিন বেঁচে ছিলেন রে?

আমি বললুম, খুব বেশি না। ছেচল্লিশ বছর, তাও শেষের দিকের কয়েকটা বছর খুবই খারাপ অবস্থা ছিল।

ভাস্কর আবার বলল, তুই সেই আগেরবার বলেছিলি, বোদলেয়ার একই দিয়ে মাকে সাতখানা চিঠি লিখেছিলেন, চিঠি লেখার ওয়াল্ড রেকর্ড! এই বোদলেয়ারেরই একখানা কবিতার বই নিয়ে মামলা হয়েছিল না? বইটার নাম মনে আছে, ‘লেস ফ্লাওয়ারস দু ম্যাল’!

অসীম গম্ভীরভাবে সংশোধন করে দিল, ‘লে ফ্লর দু মাল’।

ভাস্কর বলল, ওই একই হল। তোমাদের ফরাসিতে যে কখন লে, লা কিংবা লু হবে তা বুঝতে মাথা ফেটে যায়।

আমি হাসতে লাগলাম। লু-টা ভাস্করের আবিষ্কার! বাদলও হাসিতে যোগ দিল, সে ফরাসি ভাষা সম্পর্কে ভাস্করের এই ধরনের স্পর্ধিত মন্তব্যে বেশ মজা পায়। বাদলও এক বিন্দু ফরাসি জানে না। যদিও দোকান-টোকানে ঢুকে সে বেশ কাজ চালিয়ে দেয়। আমার আবার অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী! যেটুকু শিখেছিলাম তাও চর্চার অভাবে প্রায় ভুলে মেরে দিয়েছি, তবু মাঝে মাঝে বিদ্যে ফলাতে যাই।

অসীম বলল, না-জানাটা দোষের কিছু নয়। শুধু শুধু ভুল বলবে কেন? ইংরিজিতে বলল। বোদলেয়ারের ওই কবিতার বইটার নাম ইংরিজিতে ‘দা ফ্লাওয়ার্স অফ ইভল’। বাংলায় কে যেন অনুবাদ করেছিলেন, ‘অশিব পুষ্প’, সেটাও মোটামুটি ঠিক আছে।

ভাস্কর জিগ্যেস করল, মামলাটার কী হয়েছিল?

অসীম বলেছিল, হেরে গিয়েছিল। তারপর, বোদলেয়ার ক্ষমা চেয়েছিল। আর কী হবে! কবিরা বড় বড় কথা বলে, অ্যান্টি এস্টাব্লিশমেন্ট, অ্যান্টি গভর্নমেন্ট আরও কত কী। কিন্তু চাপে পড়লেই হাঁটু মুড়ে বসে হাত জোড় করে। কী সুনীল, তাই না?

অসীম কবিতা পড়তে ভালোবাসে, কবিতার বই কেনে, অনেক আধুনিক বাঙালি কবিদের বইও রেখেছে নিজের সংগ্রহে, কবিদের সম্পর্কে তার দুর্বলতা আছে, তবু মাঝে মাঝে খোঁচা মারতে ছাড়ে না। এর প্রতিক্রিয়াটা দেখে সে আনন্দ পায়। নিরীহ কবিদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ।

আমি অসীমের স্বভাব জানি বলেই মিটিমিটি হেসে বললাম, বোদলেয়ার তো ক্ষমা চাননি, দয়া চেয়েছিলেন।

বাদল ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল, দুটোর মধ্যে তফাত কী হল?

আমি বললাম, বোদলেয়ারের বই নিষিদ্ধ করার হুকুম দিয়েছিলেন এক বিচারক। আর ববাদলেয়ার দয়া ভিক্ষা করেছিলেন এক রমণীর কাছে। একজন কবি এক নারীর কাছে দয়া তো চাইতেই পারে। সব কবিরাই তো মেয়েদের কাছ থেকে দয়া পাওয়ার জন্য ব্যাকুল।

এবার অসীমও হাসতে লাগল। সে ব্যাপারটা জানে, আমার কথার মারপ্যাঁচ সে ধরতে পেরেছে।

ভাস্কর বলল, হেঁয়ালি করিস না। কার কাছে দয়া চেয়েছিল? মেয়েটা কে?

বোদলেয়ারের ‘লে ফ্লর দু মাল’ কাব্যগ্রন্থটি যখন ছাপা হয় তখন কবির বয়েস ছাব্বিশ। কবি হিসেবে তেমন বিখ্যাত নন যতটা পরিচিত এডগার অ্যালান পো’র রচনার অনুবাদক হিসেবে।

কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর তরুণ সাহিত্যিক ও পরিচিত মহলে খুব আলোড়ন হয় ও অনেক প্রশংসা পায়, কিন্তু বড়-বড় পত্র-পত্রিকায় সাংঘাতিক নিন্দে বেরুতে থাকে। ‘ল্য ফিগারো’র মতন প্রভাবশালী পত্রিকায় তীব্র আক্রমণ করা হল। অন্য একটা পত্রিকায় লেখা হল যে কবিতাগুলো এমনই জঘন্য যে দু-এক লাইন উদ্ধৃতিও দেওয়া যায় না। বোদলেয়ারের নামে অভিযোগ : ধর্মীয় অবমাননা এবং অশ্লীলতা।

সেই সময়ে ফ্লবেয়ার-এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘মাদাম বোভারি’ নিয়েও অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা উঠেছিল। কিন্তু লেখকের পক্ষের এক দুর্ধর্ষ উকিলের সওয়ালে বিচারক কোনও সাজা দিতে পারেননি। বোদলেয়ারের বইটি নিয়ে যখন প্রচুর নিন্দা-মন্দ বেরুতে

এবং যথাসময়ে বইটি আদালতে অভিযুক্ত হল, তখন বোদলেয়ার বেশ খুশিই হয়েছিলেন। বড় বড় কাগজের খুব কড়া সমালোচনাও তো এক ধরনের প্রচার, আদালতে মামলা উঠলে বহু লোকে কবির নাম জেনে যাবে। বোদলেয়ারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আদালতে মামলা শেষ পর্যন্ত টিকবে না, ‘মাদাম বোভারির মতন তাঁর ‘অশিব পুষ্প’ও ছাড়া পেয়ে যাবে।

যে বছর আমাদের দেশে সিপাহি বিদ্রোহ হয়, সেই বছরে ১৫ অগাস্ট প্যারিসে বোদলেয়ারের নামে মামলা ওঠে। সেটা ছিল একটা ছুটির দিন, প্রচুর অল্প বয়েসি কবি লেখক ও ছাত্ররা এসে আদালতে ভিড় করেছিল, মেয়েরাও ছিল অনেকে। সবাই ভেবেছিল, অশ্লীলতার মামলা, নিশ্চয়ই প্রচুর রসালো কথাবার্তা শোনা যাবে। বোদলেয়ারের ওই কবিতার বইটি ছাপা হয়েছিল এক হাজার কপি, প্রথম বাঁধানো হয়েছিল মাত্র একশো, দাম দু ফ্রাংক, তখনকার পক্ষে বেশ বেশি দাম। অর্থাৎ কিছু সমালোচক ও বন্ধু বান্ধব ছাড়া বইটি তখনও বিশেষ কেউ পড়েনি!

দীর্ঘ সওয়াল জবাবের পর বোদলেয়ার হেরে গেলেন!

ধর্মীয় অবমাননার দায়ে বোদলেয়ারের কারাদণ্ড হতে পারত। কিন্তু বিচারক সে দায় থেকে বোদলেয়ারকে মুক্তি দিলেন। কিন্তু তিনি য়ায় দিলেন যে ওই বইয়ের ছ’টি কবিতা অত্যন্ত অশ্লীল, জনসাধারণের পাঠের অযোগ্য সম্পূর্ণ বইটাকে বাজেয়াপ্ত করা হল না, কিন্তু ওই ছ’খানা কবিতা বাদ দিয়ে আবার ছাপতে হবে। এই অশ্লীল কবিতাগুলি লেখা ও প্রকাশ করার জন্য বোদলেয়ারের জরিমানা হল তিনশো ফ্রাংক, আর প্রকাশক ও মুদ্রাকরের জরিমানা একশো ফ্রাংক করে।

তৎকালীন উত্তপ্ত নীতিবাগিশ আবহাওয়ায় বেশ লঘুদণ্ডই বলতে হবে।

বিচারের পর প্রথম কিছুদিন বোদলেয়ার উত্তেজিতভাবে বলে বেড়াতে লাগলেন, আমি আদালতের য়ায় মানি না। আমার বই ওইভাবেই বিক্রি হবে, গোপনে গোপনে, তারপর যা হয় তোক দেখা যাবে! আমি যা লিখেছি, বেশ করেছি!

কিন্তু কবির এই সাহসের আড়ম্বর চুপসে গেল কিছুদিনের মধ্যেই। প্রকাশক তাঁর কথা মানল না। তাঁর বইয়ের ওই ছ-খানা কবিতার পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিক্রি হতে লাগল। নিজের কাব্যগ্রন্থের সেই দশা দেখে কবি শিউরে উঠতেন। বইটা ছাপার জন্য কত যত্ন ও কষ্ট স্বীকার করেছিলেন, তিনি, ছাপার ব্যাপারে দারুণ খুঁতখুঁতে ছিলেন, প্রুফ দেখেছেন পাঁচ মাস ধরে, টাইপ ফেস, কাগজ, বাঁধাই সব দিকে ছিল তাঁর মনোযোগ, সেই বইয়ের এমন ছিন্নভিন্ন অবস্থায় প্রকাশকের সঙ্গে ঝগড়া করতে গেলে তাঁর আর কোনও বই ছাপার আশাই থাকবে না।

এর কয়েকজন শুভার্থীর পরামর্শে বোদলেয়ার এক দয়ার আবেদন করলেন ফ্রান্সের সম্রাজ্ঞী ইউজেনি’র কাছে। অতি কাতর ও আবেগপূর্ণ সেই আবেদনপত্রের ভাষা।

সম্রাজ্ঞী ইউজেনি সে আবেদন একেবারে উপেক্ষা করেননি। জরিমানার তিনশো ফ্রাংক কমিয়ে পঞ্চাশ ফ্রাংক করে দিলেন। ছ’টি কবিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েই গেল। সেই নিষেধাজ্ঞা তার পরেও প্রায় একশো বছর ধরে জারি ছিল।

সংক্ষেপে আমি এই কাহিনি শোনাবার পর ভাস্কর মন্তব্য করল, কি কিস ছিল রে ওই রানিটা! আর মাত্র ওই পঞ্চাশ ফ্রাংক কমাতে পারল না?

কাল রাত্তিরে ভাস্কর হেঁচকিতে বেশ কষ্ট পেরেছে। হোটেলের ঘরে আমাদের আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল, ভাস্কর নিজেই গল্প জমাচ্ছিল, হঠাৎ শুরু হয়ে গেল হেঁচকি। তারপর আর থামেই না। আমি লক্ষ করছিলাম, ঘুমের মধ্যেও ও কেঁপে-কেঁপে উঠছে।

আজ সকাল থেকে ভাস্কর বেশ ভালো আছে। মেজাজ বেশ প্রসন্ন। আমরা হোটেলটা ছেড়ে দিয়ে এসেছি। ঠিক হয়েছে, সারাদিন ঘোরাঘুরির পর সন্ধেবেলা নতুন হোটেল খোঁজা যাবে। গাড়ি চলেছে লোয়ার নদীর ধার ঘেঁষে।

ভাস্কর কিছু একটা দুষ্টুমির জন্য উশখুশ করছে মাঝে মাঝে। এক সময় সে বলল, অসীম, গাড়িটা থামাও না একবার। অনেকক্ষণ সাহিত্য আলোচনা হয়েছে, গলা শুকিনে গেছে। এক বোতল পেরনো কেনা যাক। ফরাসি দেশের এই একটা ব্যাপার বেশ ভালো, সকালবেলা অনেকে খানিকটা পেরনো খেয়ে নেয়। দু’ঢোক পেরনো খেলে শরীরটা স্নিগ্ধ হয়ে যায়।

পেরনো একরকম মৌরির সুরা। এমনিতে স্বচ্ছ রঙের, কিন্তু তাতে জল মেশালেই দুধের মতন সাদা হয়ে যায়।

অসীম ধমক দিয়ে বলল, সকালবেলাতেই মদের চিন্তা! কাল শরীর খারাপ হয়েছিল, মনে নেই? এখন হবে না।

ভাস্করও সমান মেজাজ দেখিয়ে বলল, তুমি কি আমার গার্জেন নাকি? আমার ইচ্ছে হয়েছে খাব। তুমি গাড়ি থামাবে কি না!

অসীম বলল, ছেলেমানুষি কোরো না ভাস্কর, এখনও দোকান খোলেনি!

আমি আর বাদল নিরপেক্ষ, নীরব শ্রোতা। আমরা দুজনেই ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। ভাস্করের স্বাধীনতা আছে মৌরির সুরা পানের ইচ্ছে প্রকাশ করার, আর অসীমেরও স্বাধীনতা আছে তাতে বাধা দেওয়ার। আসলে এটা ওদের ছদ্ম ঝগড়া। ভাস্কর যদি বলত, আজ সকালে আমি কিছুতেই পেরনো খাব না, তাহলে অসীম একটা বোতল জোগাড় করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত।

ভাস্কর মাঝে মাঝে বলতে লাগল, ওঃ, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেল। খানিকটা রেড ওয়াইনও যদি অন্তত পাওয়া যেত।

আর অসীম শহরের দিক সম্পূর্ণ এড়িয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলতে লাগল, দোকান খোলেনি, দোকান খোলেনি। জল খাও!

আমি জানলা দিয়ে নদী দেখতে লাগলাম।

এক সময় মনে হল, এখানকার দৃশ্যের সঙ্গে আমাদের দেশের তফাতটা কী? আমেরিকাতেও আমার এরকম মাঝে মাঝে মনে হয়েছে। ওদের শহরগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের শহরগুলোর ঠিক তুলনা চলে না। কিন্তু শহরের বাইরের ফাঁকা জায়গায়, প্রকৃতির মধ্যে খুব একটা অমিল নেই। ডি এল রায়ের সেই লাইন, বিলেত দেশটাও মাটির, নয়কো সোনা রুপো, খুব খাঁটি সত্যি। লোয়ার নদী আমাদের দেশের যে-কোনও মাঝারি আকারের নদীর মতনই, একদিকে ফসলের খেত, আর এক পারে রাস্তা। দু’পাশে তেমন গাছপালা নেই, তাই বাংলা বলে মনে হয় না, কিন্তু বিহারের কোনও কোনও জায়গা হতে পারে অনায়াসে, বিশেষত নদীর মধ্যে বড় বড় পাথরের চাঁই দেখে আরও মনে হয়।

এই গাড়িটা বিহারের কোনও নদীর ধার দিয়েই যাচ্ছে, এমন মনে করা যেতে পারত, কিন্তু রাস্তাটা দেখলেই মনে হয়, এটা ভারতবর্ষ হতে পারে না। এদেশে সারা দেশজোড়া অসংখ্য মসৃণ রাস্তা। কোনও একটা জায়গারও ট্রাফিক বাতি ভাঙাচোরা কিংবা অকেজো নয়। সব সময় অসংখ্য গাড়ি চলছে, গাড়ির সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, তবু যে রাস্তাগুলো ভাঙে না, তার কারণ সারা বছর জুড়েই রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা। এরকম রাস্তার অবস্থায় পৌঁছতে আমাদের দেশের আরও কত বছর লাগবে?

আরও একটা লক্ষণীয় বিষয়, ফ্রান্সের ছোট ছোট গ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়েও আমি এ পর্যন্ত একটাও জরাজীর্ণ, জোড়াতাপ্পি দেওয়া কিংবা খুব গরিবের বাড়ি দেখতে পাইনি। দেশের সাধারণ অবস্থা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে কোনও লোকই হতদরিদ্র নয়। বড় বড় শহরে, এমনকি প্যারিসেও গরিবদের ব্যারাক আছে, নেশাখোর, ভবঘুরে, ভিখিরি আছে, কিন্তু গ্রামে সেরকম কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। গ্রামের এই উন্নতি দেখেই দেশের অর্থনীতির জোরটা টের পাওয়া যায়। কোনও বাড়িই অসুন্দর নয়, এটাও একটা সামগ্রিক রুচির ব্যাপার।

প্রকৃতির দিক থেকে ওসব দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের বিশেষ তফাত নেই, মানুষের ব্যবস্থাপনারই প্রবল ব্যবধান!

ছোটখাটো পাহাড়ি এলাকা দিয়ে যেতে-যেতে ভাস্কর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, থামো, থামো!

পাহাড়ের গায়ে গায়ে কয়েকটি গুহা। এই জায়গাটা আমাদের চেনা, কয়েক বছর আগে আরেকবার এসেছিলাম। এই গুহাগুলিতে রয়েছে ওয়াইনের ডিপো। এখানে পাইকারি হারে ব্যারেল ব্যারেল লাল কিংবা সাদা ওয়াইন বিক্রি হয়। যে-কেউ ঢুকলেই ওরা চেখে দেখবার জন্য একটা-দুটো বোতল খুলে দেয়, সঙ্গে সসেজ আলুভাজা। চেখে দেখবার পর পছন্দ না হলে চলে যাও অন্য দোকানে। পয়সা লাগবে না। আগেরবার এসে আমরা কয়েকটা দোকান ঘুরে-ঘুরে বেশ খানিকটা করে বিনা পয়সার ওয়াইন চেখেছিলাম, পরে অসীম চক্ষুলজ্জায় কয়েক বোতল কিনেছিল।

এর অসীমকে থামতেই হল, কিন্তু একটা গুহার ভেতরে ঢুকে মনে হল, এই কয়েক বছরেই পরিবেশ বদলে গেছে। আগেরবার দোকানের মালিক-মালিকানীরা আগ্রহ করে ডেকে বসিয়ে নতুন ওয়াইন দিয়েছিল দু-তিন রকম। এখন জায়গাটা টুরিস্ট-অধ্যুষিত। আর টুরিস্টদের মধ্যে আমেরিকানদেরও বেশি আদর। তারা কিছুই বিনা পয়সায় নিতে জানে না। এক গেলাস ওয়াইন চেখেই কয়েক ডলার ফেলে দেয়। টুরিস্টরা অনেকেই রসিক হয় না বলে নিকৃষ্ট জাতীয় ওয়াইনও চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ভাস্কর এতক্ষণ তৃষ্ণায় ছটফট করছিল, খুব উৎসাহ নিয়ে এখানে ঢুকল, তারপর এক গেলাস রেড ওয়াইন নিয়ে খানিকটা চুমুক দিয়েই থু থু করে ফেলে দিল। মুখ ভিরকুট্টি করে বলল, থার্ড ক্লাস! এত বাজে ওয়াইন মানুষে খেতে পারে!

যতই তৃষ্ণা থাক, ভাস্কর বনেদিয়ানা ছাড়বে না, উন্নতমানের জিনিস ছাড়া তার জিভে রুচবে না। আমরা তবু খানিকটা করে খেলাম, তেমন খারাপ লাগল না, ভাস্কর দূরে দাঁড়িয়ে রইল।