৩০. কবিতাটির নাম শোভাযাত্রা

‘সোনায় মোড়া একটি বৃদ্ধের সঙ্গে একটি দুঃখিত ঘড়ি
রানি পরিশ্রম করছেন একই ইংরেজের সঙ্গে
আর মাছধরা শান্তির জাহাজের সঙ্গে সমুদ্রের অভিভাবক
ব্যঙ্গনাট্যের বীরপুরুষ, তার সঙ্গে মৃত্যুর বোকা হাঁস
কফির সাপের সঙ্গে এক চশমা পরা কারখানা
দড়ির খেলার শিকারির সঙ্গে এক বহুমুন্ডের নর্তকী
ফেনার সৈন্যাধ্যক্ষের সঙ্গে এক অবসরপ্রাপ্ত তামাকের পাইপ
কালো পোশাকে সজ্জিত এক পেছন-নোংরা শিশুর সঙ্গে
একটি নিকার বোকার পরা ভদ্রলোক
ফাঁসিকাঠের গান লেখকের সঙ্গে একটি গায়ক পাখি
বিবেক সংগ্রাহকের সঙ্গে এক সিগারেটের টুকরোর পরিচালক
বাংলাদেশের একটি কচি সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে একটা
ধর্মীয় মঠের বাঘ…’
-–জাক প্রেভের

ওপরের এই কবিতাটি প্রথমে পড়লে মনে হবে, উদ্ভট, অর্থহীন। কিন্তু যদি মনে করিয়ে দেওয়া যায় যে, কবিতাটির নাম শোভাযাত্রা, কোনও এক জায়গায় জড়ো হয়েছে অসংখ্য মানুষ, বিচিত্র তাদের পোশাক ও চরিত্র, কবি সেগুলিই খানিকটা উলটে-পালটে দিয়েছেন, তা হলে বুঝতে আর খুব অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। মূল ভাষায় অনেক রকম শব্দের খেলা থাকে, একই শব্দের প্রয়োগ অনুযায়ী অর্থ বদলে যায়, এসব অন্য ভাষায় আনা প্রায় অসম্ভব। যেমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি, ‘চশমা পরা কারখানাটা আবার কী বস্তু? কারখানার মূল শব্দটা হচ্ছে Moulin, মুল্যা ইংরিজিতে যেমন ‘মিল’। প্যারিসের বিখ্যাত নাইট ক্লাবের নাম মুল্যাঁ রুঝ, তার কারণ ওই লাল রঙের বাড়িটিকে দেখতে একটা উইন্ড মিলের মতন। এই মুল্যাঁ শব্দটার আর একটা মানেও আছে। ‘মুল্যাঁ আ পারোল’ বললে বোঝায় কোনও বকবকানি মেয়ে। তা হলে চশমাটা আর বেমানান হয় না।

খুবই জনপ্রিয় এই কবি নানারকম ইয়ার্কি-ঠাট্টা ও সূক্ষ্ম বিদ্রুপের কবিতা লিখেছেন অনেক। তাঁর বিদ্রুপের প্রধান লক্ষ্য হল পুরুত, অধ্যাপক, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ, অর্থাৎ যাদের হাতে সাধারণ মানুষ নিয়মিতভাবে অত্যাচারিত হয়ে চলেছে। এইসব চরিত্রের উল্লেখ তাঁর অনেক কবিতায় আছে, এবং এই কবিতাটিতে রয়েছে একটি বাঙালি মেয়ের কথা! সে আবার সন্ন্যাসিনী!

মঁ-সাঁ-মিশেল-এর পাহাড়-গির্জা চূড়ায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে-উঠতে বহু রকমের মানুষ দেখতে-দেখতে মনে হচ্ছিল জাক প্ৰেভের-এর ওই কবিতাটির সঙ্গে এখানকার এই চরিত্রের মিছিলের যেন বেশ একটা মিল আছে। নানা জাতের মানুষের মধ্যে কোনও যুবতী বাঙালি সন্ন্যাসিনী নেই বটে, কিন্তু শাড়ি পরা দু’জন বঙ্গললনা তো রয়েছে! অনেকেই ফিরে ফিরে তাকায়। আমি সাহেব বন্ধুদের মুখে শুনেছি, সেলাইবিহীন বারো হাত লম্বা একটা রঙিন কাপড় ভারতীয় মেয়েরা কী করে গায়ে জড়িয়ে রাখে, কখনও হঠাৎ খুলে পড়ে যায় না, এটা তাদের কাছে একটা বিস্ময়।

ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে আমরা উঠে এলাম একেবারে চূড়ায়। এখানে রয়েছে একটি গম্ভীর, সুন্দর মনাস্টারি। আর একটা নাম লা মারভেই, বা বিস্ময়। পবিত্র স্থানকে, তীর্থ স্থানকেও অতি মনোহরভাবে সাজিয়ে রাখার কৃতিত্ব খ্রিস্টানদেরই বেশি প্রাপ্য। অষ্টম শতাব্দীতে এক বিশপ সন্ত মাইকেলকে দৈব-দর্শনের পর এই মনাস্টারিটি বানিয়ে ছিলেন। তারপর এর অনেক রূপান্তর ঘটেছে অবশ্যই। ইংরেজ-ফরাসিদের শতবর্ষের যুদ্ধের সময় এটা খানিকটা দুর্গের কাজ করে। ফরাসি বিপ্লবের সময় যখন গির্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দেওয়া হচ্ছিল, তখন এই মঠটিও বড়ো দুরবস্থায় পড়েছিল। নেপোলিয়ান এমন চমৎকার জায়গাটাকে বানিয়ে ফেলেছিলেন একটা জেলখানা। মাত্র সওয়াশো বছর আগে ফরাসি সরকার এই জায়গাটিকে একটি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ফ্রান্সে যারা বেড়াতে যায়, তাদের কাছে ম-সাঁ-মিশেল অবশ্যদ্রষ্টব্য।

নানার ভাষার টুরিস্ট গাইডরা সব জায়গা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখায়। আমরা গাইড নিইনি, বিশাল বিশাল হলগুলি দেখছিলাম ঘুরে-ঘুরে। বাঙালিদের স্বভাব অনুযায়ী আমি আর বাদল একটু জোরে-জোরে কথা বলছিলাম, একজন এসে আমাদের ধমক দিয়ে গেল। বেশি আওরাজ করলে এখানকার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে হয়। সন্ত মাইকেলের মূর্তি আমাদের দিকে শান্তভাবে চেয়ে আছেন।

একসময় আমরা এসে দাঁড়ালাম বাইরের পাঁচিলের কাছে। অনেক নীচে সমুদ্র। আমরা দেখতে পাচ্ছি আস্তে-আস্তে বড় বড় ঢেউগুলি যেন অতিকায় প্রাণীর মতন ডাঙার দিকে এগোচ্ছে। সরে সরে যাচ্ছে বেলাভূমির পাখির ঝাঁক। এরকম উঁচু জায়গা থেকে আগে কখনও সমুদ্র দেখিনি। সব কিছুর মধ্যে যেন রয়ে গেছে এক কালাতীত মহিমা।

স্বাতী আর কুমকুম নামতে চায় না। তারা আরও অনেকক্ষণ থাকতে চায়। কিন্তু জল বাড়ছে, অসীমের ভয়, তার গাড়িটা না ডুবে যায়। নামার সময় হালকা শরীরে আমরা

তরতরিয়ে নীচে চলে এলাম। এই দ্বীপেই সরু সরু রাস্তার দুপাশে কিছু হোটেল রয়েছে, তার কোনও একটাতে রাত্রি বাস করা যায় কি না, তার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, সবকটাই তীর্থযাত্রীতে ভরতি।

দ্বীপটি ছেড়ে যেতে যেতেও আমরা বরাবর পেছন ফিরে তাকাই। এক এক জায়গা থেকে এক এক রকম দেখায়। দেখে-দেখে আশ মেটে না।

দোভিল-এর কাছে ইংলিশ চ্যানেলের রূপ তেমন দৃষ্টিনন্দন ছিল না, এদিকে ক্রমশ নীল জলরাশির রূপ খুলছে, আমরা যাচ্ছি আটলান্টিকের দিকে।

পথে কাংকাল নামে এক একটা জায়গায় থামা হল। আবার ঝিনুক!

আমাদের দীঘার আগে জনপুট নামে একটা জায়গা দেখেছি, যেটাকে বলা যায় একটা মৎস্যবন্দর। সে রকম কাংকাল-কেও বলা যায় একটা ঝিনুক-বন্দর, এখানে অনেকেই ঝিনক ধরার কারবার করে। এ ঝিনুকের চেহারা আবার অন্যরকম। সমুদ্র কোথায় যে কী ওগরাবে তার ঠিক নেই। আমরা ছোট-বড় সব কিছুকেই ঝিনুক বলি, কিন্তু সাহেবরা বিভিন্ন আকৃতির আলাদা-আলাদা নাম দিয়েছে। এ ঝিনুকের নাম ইংরিজিতে অয়েস্টার, ফরাসিতে উইত্ৰ (Huitre), লম্বায় প্রায় এক বিঘৎ, ওপরটা এবড়ো-খেবড়ো পাথরের মতন, ভেতরটা মহার্ঘ আয়নার মতন ঝকঝকে। এই ঝিনুকের খোলা অনেকে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখে আর ভেতরের জিনিসটা বেশ মূল্যবান খাদ্য।

রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই, এই ঝিনুক কাঁচা খাওয়ার অতি উত্তম ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। জ্যান্ত ঝিনুক ধরে বড় বড় জালের খাঁচায় ভরে সেগুলিকে ডুবিয়ে রাখা হয় সমুদ্রের হাঁটুজলে। এ রকম খাঁচা দেখা যায় হাজার হাজার। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী জেলেনীরা সেগুলো বিক্রি করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম আমরা কৌতূহলবশে জলের কিনারায় খাঁচার মধ্যে জিওল মাছের মতন পুরে রাখা জ্যান্ত ঝিনুক দেখতে পেলাম। তারপর আমারই প্রথম সাধ হল একটা চেখে দেখার।

স্বাতী চোখ বড় বড় করে বলল, এই তুমি জ্যান্ত ঝিনুক খাবে?

আমি বললাম, ঝিনুক তো চিংড়িমাছের মতনই এক ধরনের জলের পোকা। চিংড়ির গায়ে খোলা আছে, এদের খোলসটা আরও শক্ত এই যা। চিংড়ি মাছ আমরা সবাই আহ্লাদ করে খাই, ঝিনুক খেতে আপত্তির কী আছে?

স্বাতী বলল, চিংড়ি মাছ কি আমরা জ্যান্ত খাই নাকি?

আমি বললাম, অন্য লোকরা যখন জ্যান্ত খায়, তখন খুব একটা অখাদ্য হবে না নিশ্চয়ই। একটু মুখে দিয়ে টেস্ট করে দেখব, খারাপ লাগলে বাকিটা খাব না। আমার যে

কোনও নতুন খাবার পরীক্ষা করতে ভালো লাগে।

অসীম বলল, কী করে খেতে হবে বলে দিচ্ছি। ওই দ্যাখো একটা মেয়ে লেবু বিক্রি করছে। আগে কয়েকটা লেবু কিনে নাও। তারপর ঝিনুক কেনো। তবে বোধহয় একটা দেবে না। এক ডজন কিনতে হবে!

তা শুনেই বাকি সকলে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, অ্যাঁ? এক ডজন? অত কে খাবে? শুধু শুধু পয়সা নষ্ট হবে!

বাদল আমাকে সমর্থন করে বলল, আহা ইচ্ছে হয়েছে যখন, খেয়ে দেখুক না! কতই বা লাগবে!

প্রকাশকের সমর্থন পেলে লেখকের আর ভয় কী! আমি বীরদর্পে এগিয়ে গেলাম।

যে-মেয়েটি লেবু বিক্রি করছে, সে সবচেয়ে সুন্দরী। ঠিক যেন রূপকথার ফুলওয়ালি। আসলে সে রূপসি নয়, তার নাক-ঠোঁট ল্যাপা-পোঁছা যাকে বলে, কিন্তু মুখখানা অদ্ভুত সারল্যমাখা, মাথার চুল একটা গোলাপি রঙের স্কার্ফ দিয়ে বাঁধা, গভীর বিস্ময়ে সে দেখছে আমাদের। সমুদ্রের ধারে তাকে খুব মানিয়ে গেছে।

ঢাকাই রাজভোগ সাইজের দু’খান পাতিলেবু কিনলাম চার টাকায়।

এবার গেলাম ঝিনুকের দর করতে। বিভিন্ন খাঁচায় বিভিন্ন সাইজের ঝিনুক। সবচেয়ে বড়গুলোর দামই বেশি। খাব যখন ঠিক করেছি, সবচেয়ে ভালোটাই খাব। এক ডজন ছত্রিশ টাকা।

অসীম বলল, দোকানে গিয়ে খেলে এর দশগুণ দাম পড়ত, এখানে জেলেদের কাছ থেকে কেনা বলেই অনেক সস্তা পড়ছে।

জেলেনি একটা ছুরি দিয়ে মাঝখানে চাড় দিয়ে ঝিনুকের মুখ খুলে দিল। ভেতরের প্রাণীটা নড়াচড়া করছে। তার ওপর কয়েক ফোঁটা লেবুর রস ফেলতেই সেটা মরে যায়।

যেন খুব একটা নিষ্ঠুর কাজ করা হচ্ছে, এই ভঙ্গিতে স্বাতী বলল, ইস!

আমি বললাম, জ্যান্ত কই মাছ যখন বঁটি দিয়ে কাটা হয়, তখন কি কেউ ইস বলে? মরা কই মাছ কেউ কেনে না কেন?

জেলেনি একটা কাঠের চামচও দিল। সেটা দিয়ে তুলে খানিকটা মুখে দিলাম। অন্যরা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে, যেন আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি। আমি বললাম, অপূর্ব! অপূর্ব!

সত্যিই তাই। আসল ঝিনুকটির স্বাদ নোনতা, তার সঙ্গে লেবুর রস মিশেছে। টক নোনতার মিশ্রণ আমার সব সময় প্রিয়। লেবুর আচার, কাঁচা আম মাখা, নুন-তেঁতুল এগুলোর কথা মনে এলেই জিভে জল আসে। একটা শেষ করেই আমি বললাম, আর একটা দাও।

অসীম হাসছে। দু’দশকের বেশি এদেশে থেকে সে প্রায় ফরাসি বনে গেছে, সে তো জানেই এটা অতি উত্তম খাদ্য। আগে অন্যদের কিছু বলেনি। এর সেও খেতে শুরু করল।

আমি বাদলকে জিগ্যেস করলাম, কী, চলবে না?

বাদল আমতা-আমতা করে একটা নিল বটে, মুখেও দিল, কিন্তু খুব যেন উপভোগ করল না।

স্বাতী ছোঁবেই না জানিয়ে দিয়েছে। কারণ খোলার ভেতরে জিনিসটাকে দেখতে হড়হড়ে, সিকনির মতন, দেখেই তার ঘেন্না লাগছে।

কুমকুমও খাবেই না ধরে রেখেছিলাম, তবু জিগ্যেস করলাম, তুমিও ভয় পাচ্ছ?

কুমকুম বলল, সে মোটেই ভয় পায় না। এত মানুষ খাচ্ছে যখন, তখন ভয় পাওয়ার কী আছে?

একটা ঝিনুক তুলে দেওয়া হল কুমকুমের হাতে। সে দিব্যি খেয়ে বিল। আর একটা নিতেও তার আপত্তি নেই।

আমি বললাম, এই, তুমি তা হলে আগের দিন ওই ঝিনুকগুলো খাওনি কেন?

কুমকুম হেসে বলল, ওগুলো যে ওয়াইন-মোয়াইন দিয়ে সেদ্ধ করা ছিল!

দেখতে দেখতে এক ডজন শেষ। আমি বললাম, লাগাও আরও এক ডজন!

তারপর আরও এক ডজন!

বাদল রণে ভঙ্গ দিয়েছে, কুমকুম, অসীম ও আমি চালিয়ে যাচ্ছি। ময়দানে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়ার মতন, সমুদ্রের ধারে এই ঝিনুক খাওয়ার নেশা লেগে গেল আমার।

আমাদের খাওয়ার পর্ব চলছে, এমন সময় একটা টুরিস্ট বাস এসে থাকল কাছেই। সামনের লেখা দেখে বোঝা যায় বাসটা আসছে ইতালি থেকে। বাস থেকে একদল নারী পুরুষ নামল। আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে তারা অবাক। ছুরির চাড় দিয়ে এক একটা ঝিনুক খোলা হচ্ছে, তাতে লেবুর রস মিশিয়ে চামচে দিয়ে সুরুত করে খেয়ে ফেলছি। ওদের কয়েকজন এগিয়ে এসে চোখ গোল গোল করে দেখল, তারপর একজন জিগ্যেস করল, তোমরা এসব কী করছ?

বোঝা গেল, ওরা যেখান থেকে এসেছে, ইতালির সেই সমুদ্রে এরকম অয়েস্টার বা উইত্র ওঠে না, ওরা ঝিনুক খেতে জানে না। কিংবা ওরা বোধহয় ভাবছে, শুধু ভারতীয়রাই এ রকম কাঁচা ঝিনুক খায়।

আমি একজনকে বললাম, খেয়ে দ্যাখো না, খুব ভালো!

এরপর মনে হল, ওই ইতালিয়ানদের দলেও একজন করে স্বাতী-কুমকুম-অসীম বাদল-সুনীল আছে। কোনও মেয়ে ঠোঁট উলটে ঘেন্না প্রকাশ করল, কেউ বলল, একটু চেখে দেখতে পারি, কেউ মতামতই প্রকাশ করল না, কেউ বেশি উৎসাহ দেখাল। প্রথমে একজন দুজন আরম্ভ করল। তারপর গুটি গুটি করে এগিয়ে এসে অন্য কয়েকজনও যোগ দিল, আমাদের দিকে মাথা নেড়ে-নেড়ে বলল, ভালো! ভালো! ইতালিয়ানদের সেখানে রেখে আমরা ফিরে এলাম গাড়িতে।

সন্ধে হয়ে এসেছে। পাতলা একটা চাদরের মতন অন্ধকার নেমে আসছে সমুদ্রের জলে। আকাশের এখানে-ওখানে রঙের ঝিলিক। এই নিরিবিলি ক্ষুদ্র বন্দরটিতে ক্রমশ শব্দ কমে যাচ্ছে। হোটেল পাওয়া যায় সর্বত্র, আমার ইচ্ছে হল এখানেই কোথাও থেকে যেতে। স্বাতী সঙ্গে সঙ্গে বলল, তুমি এখানে থেকে বুঝি আরও ঝিনুক খেতে চাও? তা চলবে না!

অসীমও একেবারেই রাজি নয়। অন্তত আরও পাঁচ জায়গা গিয়ে অন্তত পনেরোটা হোটেল না দেখে সে সিদ্ধান্ত নেবে না। অসীমের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে এইটি উপরি পাওনা। থাকা হয় একটি হোটেলে, কিন্তু দেখা হয় অনেক।

সমুদ্রের ধারে ধারে পরপর ছোট ছোট শহর, তার মধ্যে একটা অপেক্ষাকৃত বড় জায়গা সাঁ মালো, সেখানে এমন একটি হোটেল পছন্দ হল, যেটি সমুদ্রের একেবারে গায়ে। হোটেলের একদিকের দরজা সমুদ্রের দিকে, অন্যদিকের দরজা শহরে। পাশাপাশি এত হোটেল দেখলে বোঝা যায়, এখানে খুবই টরিস্টের সমাগম হয়, কিন্তু এখন হালকা সময়।

সারাদিন গাড়ি চালিয়ে অসীমের ক্লান্তি ও অবসাদ আসা স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে আমরা কেউ তাকে সাহায্য করতে পারব না, বাদল ভালো গাড়ি চালায় বটে কিন্তু রাস্তার ডান পাশ দিয়ে গাড়ি চালাবার অভ্যেস তার নেই, সেইজন্য অসীম ভরসা করে তার হাতে স্টিয়ারিং ছাড়বে না। অসীম অবশ্য এতখানি গাড়ি চালাবার পরেও বিরক্তি প্রকাশ করে না, স্নান-টান সেরে আবার ফিটফাট হয়ে আসে। আমাদের হোটেলে রান্নার ব্যবস্থা নেই, আমরা পায়ে হেঁটে রেস্তোরাঁ খুঁজতে বেরোই।

খুব সাজানো-গোছানো, বড় রেস্তোরাঁর বদলে ছোটখাটো কোনও জায়গাই আমাদের পছন্দ হয়। সাধারণত একজোড়া স্বামী-স্ত্রী এইরকম ছোট দোকান চালায়। তারাই রান্না করে, তারাই পরিবেশ করে এবং কাছে এসে গল্পগুজব করে। আমাদের দেশের বড়ো হোটেল রেস্তোরাঁগুলিতে সবাই বেশি গম্ভীর। বেয়ারা-স্টুয়ার্ড থেকে আরম্ভ করে ম্যানেজার পর্যন্ত সবাইকেই কেউ যেন হাসতে নিষেধ করে দিয়েছে, তাদের বিনয়ের মধ্যেও ভুরু-তোলা ভাব। আমরা যেখানে এলাম, সেই রেস্তোরাঁটা চালায় এক গ্রিক দম্পতি, তারা দুজনেই আমাদের টেবিলে শাড়ি পরা নারী দুটিকে দেখে নানা রকম গল্প জুড়ে দিল।

খাদ্যতালিকাটি দেখে-দেখে অসীম আমাদের বুঝিয়ে দেয় কোনটা কী ব্যাপার। কুমকুম তার নামের সঙ্গে প্রায় মিলিয়ে কুশকুশ নামে একটা খাবার খুব পছন্দ করে ফেলেছে। কুশকুশ পেলে সে আর কিছু খায় না। মধ্যপ্রাচ্যের এই খাবারটি ফ্রান্সে বেশ জনপ্রিয়। নানারকম সবজি-মেশানো ভাতের মতন একটা জিনিস, খুব সম্ভবত সজির ভাত। বাদল আর আমি এক একদিন এক এক রকম মাছ বা মাংস রান্না অসীমের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ে দেখি। স্বাতী কিন্তু অসীমের নির্দেশ মানে না, সে নিজেরটা নিজেই বেছে নেয় তালিকা দেখে। অসীম সেটা বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে, না না, ওটা আপনার ভালো লাগবে না। ওটা টিপিক্যাল একটা ফরাসি রান্না। চিজের গন্ধ লাগবে! স্বাতী তবু বলে, হ্যাঁ আমি এটাই নেব। গ্রিক মালিকানী স্বাতীর পছন্দের তারিফ করে বলে, মাদমোয়জেল খুব ভালো বেছেছেন, ওটাই সবচেয়ে ভালো, আমাদের ঘরের তৈরি চিজের রান্না। তার সঙ্গে মাইয়োনেজ।

অসীম তার ভুল ভাঙিয়ে বলে, উনি মাদমোয়াজেল নন, মাদাম, ওই যে ওই মহাশয়ের স্ত্রী।

গ্রিক মালিকানী খানিকটা অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকায়। তারপর একটা বিচিত্র ভঙ্গি করে বলে, আপনার চেয়ে আপনার স্ত্রীর রুচি অনেক উন্নত।

আমি মনে-মনে বললাম, তুমি তো জানো না, এই মেয়েটি আগের জন্মে ফরাসি মেয়ে ছিল!

নিছক খাওয়াদওয়াই হয় না, এই সব রেস্তোরাঁর পরিবেশও মনে গেঁথে যায়।

এর পরেও আমরা হোটেলে না ফিরে বেড়াতে লাগলাম সমুদ্রের ধার দিয়ে। বেলাভূমি থেকে কিনারার রাস্তাটা বেশ উঁচু। যত দূর চোখ যায় সমুদ্রের পাড় পাথর দিয়ে বাঁধানো। মাঝে মাঝে সিঁড়ি নেমে এসেছে। এতখানি সমুদ্র-উপকূল বাঁধাতে কত খরচ লাগে! আমাদের দেশে কোথাও এরকম নেই। সমুদ্রের ঢেউ রাস্তার ধারে এসে ধাক্কা মারলেও ক্ষতি নেই, অত উঁচু পাথরের বাঁধ ভাঙবে না।

কিছুক্ষণ পর সমুদ্রের সঙ্গে আমাদের একটা লুকোচুরি খেলা শুরু হয়ে গেল। বালির ওপর দিয়ে আমরা অনেকটা হেঁটে গিয়েছিলাম, জল ছিল বেশ দূরে, ক্রমে এগিয়ে আসতে লাগল ঢেউ, আমরা এক এক জায়গায় বসি, আবার পিছিয়ে যাই। ক্রমে যেন ঢেউ তাড়া করতে লাগল। আমরা দৌড়োলাম, উঠে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে। ছলাত ছলাত শব্দ শুনে মনে হয়, ঢেউগুলো খেলাচ্ছলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে চাইছে। কিন্তু জল কতটা উঠতে পারে তা হিসেব করেই এরা পাথরের বাঁধ বানিয়েছে।

রাত্রি গাঢ় হলে জলের ওপর কুয়াশা কুয়াশা ভাবটা কেটে যায়। তখন চোখে পড়ে সর্বাঙ্গ আলো-ঝলমল জাহাজ। প্রথম জাহাজটি দেখে অদ্ভুত উত্তেজনা হয়। ছেলেবেলায় সন্ধের আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা খুঁজতাম। একটি, দুটি, তিনটি।

বম্বের সমুদ্রতীরে কিংবা ডায়মন্ড হারবারের গঙ্গায় রাত্রির জাহাজ দুটি-একটি মাত্র। রাত্রির জাহাজের রূপই আলাদা, কেমন যেন অলীক মনে হয়। এখানে জাহাজ চলাচল অনেক বেশি। এক সময় বহু দূর বিস্তৃত অন্ধকারের মধ্যে দশ-বারোটি এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকে। যেন জলধির বুকে হীরের গাছ।

সাঁ মালো-তে আমরা থেকে গেলাম দু-তিনদিন। এখানে দর্শনীয় স্থান তেমন নেই। সমুদ্রই বিশেষ দ্রষ্টব্য। এখানে আসবার আগে উত্তর ফ্রান্সের সাঁ মালো নামে কোনও জায়গার নামও জানতাম না, দক্ষিণ ফ্রান্সের নিস, আন্তিব, কান-এর মতন এর কোনও খ্যাতি নেই, তবু শান্ত, নির্জন স্থানটির ওপর কেমন যেন মায়া পড়ে গেল। সারাদিন প্রায় কিছুই করি না। শুধু আড়া। নিরুপদ্রব আড্ডার মতন এমন ভালো জিনিস আর হয় না, মাথা পরিষ্কার হয়ে যায়। ফেরার পথে আমরা অন্য রাস্তা ধরলাম। মাঝখানে শারত্রের বিখ্যাত গির্জায় একবার উঁকি মেরে সোজা প্যারিস। শরত্রের গির্জার বর্ণনা দিলাম না, একবারের যাত্রায় সাঁ মিশেল-এর মতন একটিই যথেষ্ট।