২৯. জাপানে অ্যাটম বোমা

‘থেমে গেছে সব শত্রু এখন ছায়ায় নিয়েছে বাস
প্রিয় প্যারিসের পতনশব্দ শত্রুর মুখে শোনা
ভুলব না আমি লিলির গুচ্ছ গোলাপের নিঃশ্বাস
এবং আমার দুই ভালোবাসা হারিয়েছি ভুলব না…’
–লুই আরাগঁ

জাপানে অ্যাটম বোমা পড়ার আগে যে-ঘটনায় দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়, তা হল নর্মান্ডি অভিযান। নাতসি বাহিনী তখন প্রায় গোটা ইউরোপ অধিকার করে বসে আছে, প্যারিসের বড় বড় অট্টালিকাগুলিতে জার্মান সৈন্যরা আমোদ-প্রমোদের বন্যা ছোটাচ্ছে। সেই সময়ে বোঝা গিয়েছিল, সম্মিলিত মিত্র বাহিনী আকাশ-জল ও স্থলপথে জার্মানদের একেবারে মুখোমুখি সম্মুখ সমরে না নামলে যুদ্ধের নিস্পত্তি হওয়ার কোনও আশা নেই, হিটলারের কবর থেকে বিংশ শতাব্দীর সভ্যতাকে রক্ষা করা যাবে না।

ঠিক কোন জায়গাটা থেকে এই অভিযান শুরু হবে, তা নিয়ে মিত্রপক্ষের রাষ্ট্রনায়ক ও বড় বড় সেনাপতিদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল নৰ্মান্ডির উপকূলই প্রকৃষ্ট স্থান।

আমরা পাঁচজন এখন ঠিক সেই অঞ্চল দিয়েই ঘুরছি। এ যেন আর এক কুরুক্ষেত্র বা পানিপথ বা ওয়াটালু। এতগুলো বছর কেটে গেছে, তবু মুছে যায়নি সেই সাংঘাতিক যুদ্ধের চিহ্ন। সমুদ্রের কিনারা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে চোখে পড়ে ভূগর্ভের বাংকার, ভাঙা ট্যাংক, কামান, আধা ডুবন্ত জাহাজ। কত প্রাণ, কত নিযুত, অর্বুদ টাকা ধ্বংস হয়েছে এখানে অকারণে। হ্যাঁ, অকারণেই তো, নিছক কয়েকটা ক্ষমতা-উন্মাদের খেয়ালে। হিংসা ও মারণাস্ত্রের কী বিপুল বন্দোবস্ত, দেখতে-দেখতে আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি অনুভব করি যে আমরা পরস্পর কোনও কথাই বলছি না।

আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি, ফ্রান্সের ভূমিতে জার্মান সমর-সজ্জা। আগেই বলেছি যে, ক্যালে বন্দরের কাছে ইংলিশ চ্যানেল সবচেয়ে সরু, সুতরাং ইংলন্ডের দিক থেকে ওইখানেই মিত্র ফৌজের সমুদ্র পার হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দু’পক্ষই সমান ধুরন্ধর। জার্মানরা ভাববে, শত্রু আসবে ক্যালের কাছে, এই জন্য মিত্র বাহিনী তাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য বেছে নিল নর্মান্ডির উপকূল। আর জার্মানরা ভাবল, ওরা ভাববে আমরা ক্যালের কাছে অপেক্ষা করব, সুতরাং ওরা ক্যালের দিক দিয়ে কিছুতেই আসবে না। তাই জার্মানরা নর্মান্ডির তটে ওঁত পেতে রইল। শোনা যায়, এই বুদ্ধি স্বয়ং হিটলারের এবং তা সমর্থন করেছিলেন রোমেল।

এখানেই ঘটেছিল মানুষের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সমুদ্র অভিযান। মিত্র পক্ষে স্থল, নৌ এবং বিমানবাহিনী মিলিয়ে সৈন্য সংখ্যা মোট দশ লক্ষ, জলে ভেসেছিল চার হাজার জাহাজ। মিত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আইসেনহাওয়ার, আর নাতসি বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন রোমেল। এই রণ-দুর্মদ রোমেলকে সেনাপতি হিসেবে শত্রুপক্ষও সমীহ করে, আফ্রিকার ফ্রন্টে অদ্ভুত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘মরু শৃগাল’।

দু-পক্ষই প্রস্তুত। উনিশশো চুয়াল্লিশ সালের মে মাসেই যে-কোনওদিন চরম লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। দু-দিকের গুপ্তচররাই দারুণভাবে সক্রিয়। সঠিক দিনক্ষণটি জানা যুদ্ধের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়।

কথা ছিল, ব্রিটিশ বেতারে একদিন নানা অনুষ্ঠানের মাঝখানে পল ভেরলেইনের দু’ লাইন কবিতা পাঠ হবে, সেই মুহূর্তেই শুরু হবে অভিযান। এটাই কোড। এও যেন এক পরিহাস। এক দুর্বল, অসহায় কবি, প্রায় সারাজীবনই যাঁর কেটেছে দারিদ্র্যে, যিনি লিখে গেছেন প্রধানত প্রকৃতির কাব্য, এক বৃষ্টিমুখর শরতের দিন, জ্যোৎস্নাময় রাত, গাছ থেকে খসে পড়া একটা শুকনো পাতা, উদ্যান দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুটি নারী-পুরুষ, এইসব সামান্য বিষয় থেকে তিনি খুঁজে নিয়েছেন সৌন্দর্য, সেই কবির রচনা ব্যবহৃত হল এক প্রবল বিধ্বংসী যুদ্ধে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে কবিতা ও ছবির কিছুটা ভূমিকা ছিল। ছবি নিয়ে কম কাড়াকাড়ি হয়নি। আগেকার যুদ্ধে বিজয়ীরা সোনা ও নারী লুণ্ঠন করত, এই যুদ্ধে প্রচুর ছবি লুঠ হয়েছে। জার্মান পক্ষে গোয়েরিং, গোয়েবলসের মতন যাদের ভুরুর সামান্য উত্তোলনে হাজার হাজার ইহুদির প্রাণ হরণ করা হয়েছে, তারাও ছবির সমঝদার ছিল। ফ্রান্স থেকে ট্রেন বোঝাই করে জার্মানিতে ছবি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা এবং জাতীয় শিল্প রক্ষায় বদ্ধপরিকর ফরাসিদের সেই ট্রেনটাকে ভুল পথে ঘুরিয়ে দেওয়া, এমনকি রাতারাতি স্টেশনের নাম পালটে দেওয়া নিয়ে এক মর্মস্পর্শী কাহিনি আছে।

জার্মান সেনাপতিরা মানুষ খুন করতে দ্বিধাহীন, কত শহর-বন্দর বোমা মেরে ধূলিসাৎ র দিয়েছে, অথচ তারা ভালো ছবির মর্ম বুঝত, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। যারা শিল্পকে ভালোবাসে, তারা কি ধ্বংসকেও ভালোবাসতে পারে? স্বয়ং হিটলারেরও ছবি আঁকার বাতিক ছিল। প্রথম যৌবনে হিটলার এক আর্ট স্কুলে ভরতি হতে গিয়েও সুযোগ পায়নি। সেই আর্টস্কুলের পরিচালক যদি অ্যাডলফ হিটলার নামে এক দুর্বল তরুণ শিল্পীকে শিক্ষার সুযোগ দিতেন, বলা যায় না, তা হলে পৃথিবীর ইতিহাসটা বোধহয় অন্যরকম হত!

নর্মান্ডি অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল অপারেশন ওভারলর্ড। মাইলের পর মাইল ইস্পাত-কংক্রিটের দুর্ভেদ্য বাংকার বানিয়ে, সৈন্য সাজিয়ে রোমেল বসে ছিলেন অধীর প্রতীক্ষায়। গুপ্তচররা খবর আনল, জুনের পাঁচ তারিখে আক্রমণ হবেই, কিন্তু সেদিনটা খুব দুর্যোগপূর্ণ, ঝোড়ো বাতাসে সমুদ্রের ঢেউ উত্তাল, সেদিন কোনও জাহাজ দেখা গেল না। জানা গেল যে, পরের দিন আবহাওয়া আরও খারাপ হবে, ঝড়-বৃষ্টি এমন প্রবল হবে যে কিছু চোখে দেখা যাবে না। সুতরাং সেই আবহাওয়ায় নৌ-অভিযান অবাস্তব। জার্মান করে দিয়েছে, অথচ ত

সেনানায়করা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল। শোনা যায় যে, ৬ জুন কিছুতেই আক্রমণ হতে পারে না ভেবে রোমেল ফ্রন্ট ত্যাগ করেছিলেন। তিনি গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন প্যারিস, তাঁর বউয়ের জন্মদিনে উপহার দেওয়ার জন্য এক জোড়া জুতো কিনতে। সেই রাতে, সেই চরম দুর্যোগের মধ্যেই নর্মান্ডির উপকূলে ব্রিটিশ-আমেরিকান-কেনেডিয়ান ফরাসি যৌথ ফৌজ নেমে পড়ল। শুরু হয়ে গেল লড়াই।

এই যুদ্ধে পরাজয়ের মূলে কারণ প্যানজার বিমান বাহিনী পাঠাতে হিটলারের দ্বিধা। নর্মান্ডি উপকূলে রোমেলের সেনাপতিত্বে জার্মান প্রতিরোধ শক্তি মোটেই দুর্বল ছিল না। কিন্তু হাতাহাতি যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই মিত্রপক্ষের বিমান বাহিনী অনেক দূরত্ব পর্যন্ত উড়ে গিয়ে জার্মানদের সাপ্লাই লাইন ছিন্ন করে দিল। পূর্ব পরিকল্পনা মতন ধ্বংস করে দেওয়া হল গুরুত্বপূর্ণ সেতু, রেললাইন ও সড়ক। বিমান থেকে বোমা বর্ষণে স্বয়ং সেনাপতি রোমেল গাড়ি উলটে আহত হলেন।

আড়াই মাস পরে আইসেনহাওয়ারের বাহিনী মার্চ করে ঢুকল প্যারিস শহরে। জার্মান কবল থেকে প্যারিস মুক্ত হল পঁচিশে অগাস্ট। বিশ্ববিখ্যাত রূপসি এই নগরীতে কখনও বোমাবর্ষণ হয়নি, জার্মানরা এর কোনও ক্ষতি করেনি।

সেনাপতি রোমেলও এরপর বেশিদিন বাঁচেননি। বোমার আঘাত থেকে সুস্থ হয়ে উঠলেও তিনি জড়িয়ে পড়লেন এক হিটলার বিরোধী ষড়যন্ত্রে। জার্মানির কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক ও কয়েকটি সেনানায়ক জার্মানপক্ষে যুদ্ধের অধধাগতি দেখে হিটলারকে খুন করে বার্লিনে একটি অস্থায়ী সরকার স্থাপনের সংকল্প নিয়েছিল গোপনে। কর্নেল স্টেফেনবার্গ ব্রিফকেসের মধ্যে একটা বোমা লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে রেখে এলেন হিটলারের চেয়ারের তলায়। কিন্তু জার্মানির পাপের ভারা পূর্ণ হতে আরও কিছুদিন বাকি ছিল, আরও কিছুদিন হিটলারের উৎপাত সহ্য করা ছিল এই পৃথিবীর নিয়তি। বোমাটা ফাটল ঠিকই, তবু হিটলারের গায়ে আঁচড় লাগল না। যুদ্ধের সেই দুঃসময়েও হিটলার প্রতিশোধ নিতে দ্বিধা করেনি, শত শত অফিসারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। রোমেলের প্রতি হিটলার সামান্য দয়া দেখিয়েছিল অবশ্য। রোমেলের বাড়িতে হিটলারের দু’জন দূত গিয়ে জানায় যে, রোমেল যদি স্বেচ্ছায় বিষ খেতে রাজি থাকেন তা হলে কেউ কিছু জানবে না। আর তা না হলে রোমেলকে গুলি করে মারা হবে, তার বউ-ছেলে-মেয়েদের বিশ্বাসঘাতকের পরিবার হিসেবে নিক্ষেপ করা হবে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। নিজের বাড়ির বাগানে গিয়ে রোমেল বিষ খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন।

হিটলারের নাতসিবাহিনীর পতন হতে আর বেশি দিন লাগেনি। প্রকৃতপক্ষে জার্মানির পরাজয় সূচিত হয় এই নর্মান্ডি উপকূলেই।

ঘুরতে-ঘুরতে আমরা এলাম আরোমাঁস নামে একটি জায়গায়। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা সংগ্রহশালা আছে। যুদ্ধের সময়কার বহু ছবি, বহু প্রতীক, অস্ত্রশস্ত্র ও সৈনিকদের ব্যবহার করা জিনিসপত্র সাজানো, তবে বর্ণনায় শুধুই মিত্রপক্ষের জয়গাথা, রোমেল কিংবা অন্য কোনও জার্মান সেনানীর উল্লেখমাত্র নেই।

বাদল এক সময় বলল, যথেষ্ট যুদ্ধ হয়েছে ভাই, আর ভালো লাগছে না!

কুমকুম আর স্বাতী সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানাল। সুদূর ইতিহাসের অনেক দুর্গ কিংবা রাজপ্রাসাদ দেখলে আমাদের রোমাঞ্চ হয়, আমরা সাধ করে দেখতে যাই। যদিও সেই সব জায়গাতেও অনেক যুদ্ধ ও ধ্বংসলীলা চলেছে এক সময়। কিন্তু এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বড়ই কাছাকাছি সময়ের, এর বীভৎসতা আমাদের স্মৃতিতে এখনও দগদগে হয়ে আছে। তা ছাড়া বিশাল কোনও দুর্গ কিংবা রাজপ্রাসাদের একটা দৃশ্যত মহিমা আছে, বাংকার, সুড়ঙ্গ, ভাঙা জেটি ও আধো-ভোবা জাহাজে তো নেই। বেশিক্ষণ এখানে ঘোরাঘুরি করতে ভালো লাগার কথা নয়।

সুতরাং আমরা ঠিক করলাম, এবার যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে আমরা যাব একটা পবিত্র স্থানে। সমুদ্র উপকূল ছেড়ে আমাদের গাড়ি ঘুরল স্থলভূমির দিকে। সাঁ লো, কুতাঁস, গ্রাভিল, অভরাঁস এই সব ছোট ঘোট শহর পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম ম-সাঁ-মিশেল-এর কাছাকাছি। আবার সমুদ্রতীর।

-সাঁ-মিশেল-এর মানে সন্ত মাইকেলের পাহাড়। সত্যি সেটা একটা পাহাড়, অনেক সময় স্থলভাগের সঙ্গে জুড়ে থাকে, আবার কোনও কোনও সময় সমুদ্র এসে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তখন সেটা হয়ে যায় সমুদ্রের মধ্যে একটা পাহাড়-দ্বীপ, এবং এই গোটা পাহাড়টাই একটা গির্জা। স্থাপত্যকীর্তি হিসেবে বিশ্বের একটি বিস্ময়।

গাড়ি রাখতে হয় অনেকটা দূরে। মাঝখানের জায়গাটা সমুদ্র তার জিভ দিয়ে হঠাৎ কখন চেটে নেবে, তার কোনও ঠিক নেই। এমনও হয়েছে, সমুদ্রের স্রোতে বেশ কিছু গাড়ি ভেসে যাচ্ছে। গাড়ি পার্ক করতে অসীমকে বেশ হিমসিম খেতে হল। এটা শুধু দর্শনীয় স্থান নয়, তীর্থস্থান। প্রতিদিন বহু মানুষ আসে, তাই গাড়িতে গাড়িতে ধূল পরিমাণ।

এখন ভাটার সময়। জল সরে গেলেও পাহাড়ের সামনের মাটি ভিজে ভিজে। জুতো রেখে আসা হয়েছে গাড়িতে। প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকার সময় অসীম বলল, অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হবে কিন্তু, পারবে তো।

অসীমের ধারণা আমরা যারা বিদেশে থাকি না, তারা অলস প্রকৃতর। ধারণাটা খুব একটা মিথ্যে নয়, আমরা আলস্য ভালোবাসি তো বটেই। আমাদের তুলনায় এদেশে যারা সচ্ছল অবস্থায় থাকে, তাদের যথেষ্ট খাটতে হয়। কিন্তু বেড়াতে বেরুলে আমরা অকুতোভয়। মহিলা দুটির খুবই উৎসাহ। পাহাড়ে ওঠার সময় মনে মনে ভাবি, ওঃ, নামবার সময় কী আরামই না লাগবে! এই চিন্তা করলেই ওঠার পরিশ্রম বা কষ্ট অনেকটা কমে যায়।

আমাদের দেশে পাহাড়ের মাথায় মন্দির তো আকছার। বিহারে প্রত্যেক পাহাড়ের চুড়াতেই নৈবেদ্যর ওপর গুঁজিয়ার মতন একটা করে মন্দির থাকে। বহু সিঁড়ি ভেঙে ওপরে মন্দিরে গিয়ে পুজো দেওয়া ও পুণ্য অর্জন করা আমাদের তীর্থযাত্রীদের অবশ্যকর্তব্য। নেপালে আছে এরকম সিডি ভাঙা মন্দির। দক্ষিণ ভারতে আছে শ্রাবণবেলগোলা। কিন্তু আগে যা হয়েছে হয়েছে, গত এক হাজার বছরে আমাদের দেশে আর তেমন বিস্ময়কর, সুন্দর মন্দির তৈরি হয়েছে কই? পুণ্য অর্জনের প্রবল স্পৃহা না থাকলে হাজার-দু’হাজার সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের ওপর উঠে মন্দিরগুলো দেখলে মনে হয় পণ্ডশ্রম!

মঁ-সাঁ-মিশেল গড়া হয়েছিল বহু প্রাচীন কালে। শুধু গির্জা হিসেবে নয়। দু-একবার দুর্গ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। রাজশক্তির সঙ্গে যাজকদের লড়াইয়ের সময় কোনও রাজা এটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারেননি। বহু শতাব্দী ধরে এটাকে সাজানো হয়েছে। যারা একেবারে চূড়ায় উঠতে পারবে না, তাদের জন্যও বিভিন্ন ধাপে দর্শনীয় রয়েছে অনেক কিছু। তীর্থের পুণ্য এবং প্রকৃতিদর্শন একসঙ্গে হতে পারে। প্রত্যেক ধাপেই গির্জার একটি অংশ, রঙিন চিত্রিত কাঁচের দেওয়াল, যিশু ও কুমারী মেরির অনেক রকমের মূর্তি। তীর্থ যাত্রীদের মন সাধারণত দ্রব অবস্থায় থাকে, তাদের যে-কোনও জিনিস গছিয়ে দেওয়া অনেক সহজ। এখানে নানান খাবারের দোকান ও সস্তার খেলনার দোকান রয়েছে। কিছু কিছু অভিনব বস্তুও পাওয়া যায়। কুমকুম বেছে বেছে একটা পাথরের পুতুল কিনে ফেলল, দিয়ে ও রাতে যেটার রং বদলে যায়। সে কিন্তু ঠকেনি, ছাতা মাথায় ইস্কুলযাত্রী বালকের সেই মূর্তিটি আজও রং বদলায়। স্বাতী ওর থেকেও ভালো কিছু কেনবার ইচ্ছেয় তখন কিনল না, শেষ পর্যন্ত আর কিছু কেনাই হল না।

মঁ-সাঁ-মিশেল-এর এমন চমৎকার পরিবেশে আমাদের একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা ঘটে গেল।

এখানে পৃথিবীর বহু দেশ থেকে নানা জাতের মানুষ আসে। এরই মধ্যে এক দীর্ঘাঙ্গিনী মহিলা আমাদের দেখে খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ালেন, তারপর কাছে এসে বললেন, তোমরা ভারতীয়? কলকাতা থেকে এসেছ?

আমরাও অবাক। আমাদের চেহারায় ভারতীয় ছাপ স্পষ্ট হলেও কী করে বোঝা গেল আমরা কলকাতা থেকে এসেছি?

আমরা সম্মতি জানাতেই মহিলাটি হাতের একটা বই তুলে দেখিয়ে ঝাঁজালো গলায় বললেন, আমি লাপিয়ের-এর লেখা ‘দা সিটি অফ জয়’ বইখানা পড়ছি। কলকাতা একটা গরিব আর ভিখিরিদের শহর। মাদার টেরিজা সেখানে গরিবদের সেবা করে চলেছেন, তোমরা তাঁকে সাহায্য না করে বিদেশে বেড়াতে এসেছ কেন?

মহিলা এমন জোরে জোরে বললেন যে, আশপাশের অনেকে কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তিনি কথা বলছেন ঝড়ের বেগে ফরাসি ভাষায়, তাই তাঁকে উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হল না। নইলে বলার ছিল অনেক। এই লাপিয়ের-এর মতন সস্তাজাতের লেখকরা কলকাতাকে বিষয়বস্তু বেছে নেয়, এর দারিদ্র্য বিক্রি করার জন্য। ইদানীং দারিদ্র্যের বর্ণনা পড়ে ধনী শ্বেতাঙ্গরা মেসোকিস্টিক আনন্দ পায়। লাপিয়ের-এর বইখানা পড়লে মনে হয় কলকাতায় কুষ্ঠরোগী, রিক্সাওয়ালা ও শ্বেতাঙ্গ স্বেচ্ছাসেবক-সেবিকাদের মধ্যমণি মাদার টেরিজা ছাড়া আর কিছু নেই। মাদার টেরিজা আমাদের সকলেরই পরম শ্রদ্ধেয়া, তিনি মূর্তিমতী করুণা, অনাথ-আতুরদের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু তাঁর সংস্থাই একমাত্র কলকাতার দুঃস্থদের সেবা করছে, এমন যে একটা রটনা হয়েছে পৃথিবীতে, এরকম মিথ্যে আর হয় না। রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ও আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজগুলি তুচ্ছ? বেশি দিন আগের কথা নয়, গত শতাব্দীতেই লন্ডনে বারবনিতার সংখ্যা ছিল আশি হাজার, রাজা চতুর্থ হেনরি যখন প্যারিস আক্রমণ করে তখন প্যারিসের এক লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ভিখিরির সংখ্যাই ছিল তিরিশ হাজার। আজও নিউ ইয়র্ক শহরে ভিখিরি ও ভবঘুরের সংখ্যা দিল্লির চেয়ে কম নয়। এরকম আরও অনেক পরিসংখ্যান দেওয়া যায়। কিন্তু আমরা ওইসব দেশের এরকম শুধু খারাপ দিকটা তো কখনও দেখি না।

আমার ভাষায় না কুলোলেও অসীম এবার মুখ খুলল। অসীম আমাদের কাছে দেশের অনেক সমালোচনা করলেও অন্যদের মুখে দেশের নিন্দে শুনলে চটে ওঠে। কারুকে অপমান করতে গেলে তার মুখের চেহারা হয়ে যায় অত্যন্ত ভদ্র ও বিনীত। প্রতিটি শব্দ বলে মেপে মেপে। লম্বা শরীরটাকে যেন আরও খানিকটা উন্নত করে মহিলার সামনে বলে দাঁড়িয়ে অসীম বলল, বঁ ঝুর মাদাম, আপনি ফরাসি দেশের কোন অঞ্চল থেকে আসছেন? আপনি কলকাতা সম্পর্কে একটা বই পড়ছেন, খুব ভালো কথা। আপনি কি ভারত বিষয়ে আর কোনও বই পড়েছেন? আপনি কি রোমাঁ রলাঁর নাম শুনেছেন?

ভদ্রমহিলার থতমতো ভাব দেখেই বোঝা গেল, উনি সস্তা সাহিত্য ছাড়া কিছু পড়েন না।

অসীম আমাদের দেখিয়ে বলল, এঁদের মধ্যে একজন বাংলা ভাষার লেখক ও আর একজন খুব বড় প্রকাশক। আপনার কি ধারণা আছে, বাংলা ভাষায় কত লোক কথা বলে? ফরাসিদের অন্তত দ্বিগুণ। এঁদের তুলনায় ফরাসিদেশের অনেক সামান্য লেখক বা প্রকাশক যখন যেখানে খুশি যায়, তা হলে এঁরা আপনার দেশে আসতে পারবেন না কেন?

ভদ্রমহিলা অসীমের মুখে নির্ভেজাল ফরাসি শুনেই হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, এই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর খুঁজে না পেয়ে তো- তো করতে করতে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।

যেন কিছুই হয়নি, এই ভঙ্গিতে অসীম বলল, চলো, এবার একটু কফি খেয়ে নেওয়া যাক।

আমি ভাবলাম, ভাগ্যিস এই সময় ভাস্কর নেই। তা হলে ও নিশ্চয়ই মহিলাটিকে কাঁদিয়ে ছাড়ত। থাক, যতটুকু হয়েছে, তাই-ই যথেষ্ট।