২৮. পৌঁছে গেলাম দোভিল

‘বৃষ্টি পড়ছে নারীদের কণ্ঠস্বরে যেন তারা সবাই মৃত এমনকি স্মৃতিতেও
তুমিও বৃষ্টিতে ঝরে পড়েছে আমার জীবনের ছোট ছোট বিন্দু গুলির সঙ্গে অপূর্ব সাক্ষাৎকারে
আর এই দু’পাতোলা মেঘেরা বিশ্বময় কানসর্বস্ব নগর গুলিতে ছড়াচ্ছে হ্রেষা ধ্বনি
শোনো এই বৃষ্টিপাত যখন অনুতাপ আর তাচ্ছিল্য কাঁদছে পুরোনো সঙ্গীতের মতন
শোনো তোমার অস্তিত্বের সমস্ত পারপেনডিকুলারের পতন’
–গিয়ম আপোলিনেয়ার

বিকেলের আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম দোভিল। এই প্রথম সমুদ্রদর্শন হল। একটা সাদামাটা হোটেল ঠিক করে, মালপত্র রেখে, সময় নষ্ট না করে চলে এলাম বেলাভূমিতে।

মানচিত্রের কথা মনে রাখলে একে ঠিক সমুদ্র বলা যায় না। এ তো ইংলিশ চ্যালেন। কত নারী-পুরুষ সাঁতরে পার হয়েছে। এমনকি আমাদের দু-একজন বঙ্গ ললনাও সে কৃতিত্ব অর্জন করেছে। অবশ্য এখানে ইংলিশ চ্যানেল বেশ চওড়া। ক্যালে কিংবা ডানকার্কের কাছ ইংল্যান্ড ও ফরাসিদেশ খুব কাছাকাছি, সাঁতারুরা ওদিকেই পারাপার করে, যাত্রীবাহী জাহাজগুলোও চলে ডোভার আর ক্যালে’র মধ্যে। দোভিল-এ এই দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব সবচেয়ে বেশি, এখানে কোনও বন্দরও নেই।

মানচিত্রে যা-ই থাক, চোখের সামনে যে ঢেউসংকুল জলরাশির পরপর দেখা যায় না, তাই তো সমুদ্র। ইস্তানবুলে গিয়ে আমি বসফরাস প্রণালী প্রতিদিন দুবার করে পার হতাম, স্টিমারে কিংবা ব্রিজের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে, সেটাও তো সমুদ্র। এখানকার ইংলিশ চ্যানেলে চেয়ে বসফরাস অনেক সরু, তবু তার একটা বিশিষ্ট রূপ আছে। কিন্তু এখনকার সমুদ্র যেমন যেন রুক্ষ, জলের রং নীল নয়, কালচে ধরনের, বেলাভূমি মসৃণ বালুকাময় নয়, এবড়ো-খেবড়ো, পাথর ছড়ানো। এখন ভাঁটার সময়, জলরেখা অনেকটা দূরে। ওড়িশার চাঁদিপুরে যেমন সমুদ্রের ঢেউ এক একসময় পান্থনিবাসের দোরগোড়ায় এসে ছলাত ছলাত করে, আবার অন্য সময় এক দেড় মাইল দূরে সরে যায়, নানান চিহ্ন দেখে মনে হল এখানকার সমুদ্রের চরিত্রও সেরকম।

পৃথিবীর নানা জায়গাতেই আমার সমুদ্রদর্শন হয়েছে, ডুব দিয়েছি কয়েকটি মহাসাগরে, কিন্তু এই সামান্য ইংলিশ চ্যানেলের অখ্যাত একটা জায়গায় এসে যে দৃশ্য দেখলাম, তা আর কোথাও দেখিনি। এত ঝিনুক! যেদিকে তাকাই শুধু ঝিনুক! আর এত পাখি!

সব সমুদ্রের পেটেই ঝিনুক থাকে। প্রতিটি ঢেউ তীরে এসে কিছু ঝিনুকের উপহার রেখে যায়। পুরীর সমুদ্রে বেড়াতে গিয়ে কে না ঝিনুক কুড়িয়েছে! বাচ্চারা কাঁড়ি-কাঁড়ি ঝিনুক জমায়, তারপর বাড়ি ফেরার সময় সেগুলো সঙ্গে আনতে চাইলে মা-বাবারা আর বোঝা বাড়াতে চায় না। ঝিনুকের মালা, ঝিনুকের তৈরি কত রকম খেলনা বিক্রি হয়। আন্দামানের এক নির্জন দ্বীপে আমি ঝিনুকের সঙ্গে সঙ্গে শখও উঠে আসতে দেখেছি। সেসব ঝিনুকের কত বৈচিত্র্য, রং ও আকৃতির কী নিপুণ শিল্প!

তবু আগেকার দেখা কোনও ঝিনুক-সম্পদের সঙ্গেই এখানকার দৃশ্যের তুলনা চলে। প্রতিটি ঢেউয়ে এখানে যে ঝিনুক উঠে আসছে, তা সব একই রকম, দেখতেও সুন্দর নয়, ওপরটা কালো শ্যাওলার মতন, দু-ইঞ্চি, সাইজের। আমাদের দেশের অনেক পুকুরে এরকম ঝিনুক দেখা যায়। আমরা এই ঝিনুকের খেলার মাঝখানটা ফুটো করে ছুরি বানাতাম, সেই ছুরিতে কাঁচা আম ছুলতাম।

সেই আমাদের চেনা ঝিনুক এখানকার সমুদ্র থেকে উঠে আসছে হাজার হাজর লক্ষ লক্ষ। সংখ্যাটা একটুও বাড়িয়ে বলছি না, কোটি কোটি বললেও অত্যুক্তি হয় না। যেদিকেই তাকাই ঝিনুক ছড়ানো। হাঁটতে গেলে ঝিনুকের ওপর দিয়েই হাঁটতে হবে।

অনেক সমুদ্রের ধারেই ধপধপে সাদা রঙের পাখিদের দেখা যায়। সি গাল! এখানে তাদের খাদ্য এত বেশি বলেই তাদের সংখ্যাও প্রচুর। হাজার হাজার পাখি উড়ছে কিংবা মাটিতে বসে ঝিনুক ঠোকরাচ্ছে। এরই মধ্যে কারুর পোষা একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর তেড়ে যাচ্ছে পাখিদের। দুর্দান্ত ধরনের স্বাস্থ্যবান সেই কুকুর প্রবল বেগে ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু পাখি ধরা কি চাট্টিখানি কথা। পাখিগুলো যেন খেলছে কুকুরটাকে নিয়ে, তাদের। ভয়ডর নেই, কুকুরটা একদম কাছে যাওয়া পর্যন্ত তারা চুপ করে বসে থাকে। তারপর হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যায়, ঘুরতে থাকে কুকুরটার মাথার ওপর। কুকুরটা আবার ছোটে অন্য একটা ঝাঁকের দিকে। ছুটতে ছুটতে কুকুরটা অনেক দূরে একেবারে জলের কিনারা পর্যন্ত চলে যায়। আসন্ন সন্ধ্যায় সূর্য একটু করে নামছে সমুদ্রের বুকে। অতি গাঢ় লাল সূর্য, হাজার হাজার শ্বেত বিহঙ্গ ও একটি ধূসর রঙের সারমেয়, সব মিলিয়ে এক মনোহরণ দৃশ্য।

এই ঝিনুক শুধু পাখিদের খাদ্য নয়, মানুষেরও। কাছাকাছি অঞ্চল থেকে অনেক লোক গাড়ি নিয়ে আসছে, গাড়ি থেকে নামছে পায়ে গাম বুট পরে, হাতে বালতি। যেখানে ঢেউ ভাঙছে, সেই পর্যন্ত চলে গিয়ে তারা বালতিতে ভরছে জ্যান্ত ঝিনুক। বিনা পয়সায় প্রোটিন। ফরাসিতে এই ঝিনুকগুলোকে বলে মুল (Moules), হোটেল-রেস্তোরাঁয় বেশ

দামে বিক্রি হয়। হঠাৎ কখনও এই ঝিনুকের মধ্যে মুক্তোও পাওয়া যেতে পারে। সেইজন্যই তো সমুদ্রের আর এক নাম রত্নাকর। তবে, এত লক্ষ লক্ষ ঝিনুকের মধ্যে কোনওটায় মুক্তো আছে কি না তা কে ভেঙে দেখবে! এখানকার অনেক হোটেল রেস্তোরাঁর লোকেরাও বালতি ভরে-ভরে ঝিনুক নিয়ে যাচ্ছে, কোনও খরচই নেই। এদিকের হোটেলে খুব পাখির মাংসের রোস্টও পাওয়া যায়। সেগুলো কি সিগাল? ছররা বন্দুক দিয়ে কয়েক ডজন সিগাল যখন তখন মারা যায়।

অসীম দু-তিন রকম ক্যামেরা এনেছে, ক্যামেরা বদলে বদলে ছবি তুলছে মন দিয়ে। ফটোগ্রাফিতে তার বিশেষ ঝোঁক। সে তার ছবি প্রতিযোগিতায় পাঠায়। অসীম যখন ছবি তোলে তখন বিশেষ কথা বলে না, যেন ধ্যানে মগ্ন থাকে। আমরা ঘুরছি একদিকে, অসীম অন্যদিকে, প্যান্ট গুটিয়ে নিয়েছে হাঁটু পর্যন্ত, জল-কাদা ভেঙে ভেঙে সে চলে যাচ্ছে কিনার পর্যন্ত, উড়ন্ত পাখি ও শিকারি কুকুরের দৃশ্যটি সে অনেক অ্যাঙ্গেল থেকে তুলল।

সাধারণত কোনও পুরোনো ভাঙা বাড়ি, মাঠের মধ্যে একলা গাছ, ঝুলন্ত মাকড়সা, ফড়িং-এর ওড়াউড়ি, এই সব দেখলেই অসীম তার ক্যামেরা যার করে চোখে লাগায়। বাদল অনেক সময় ঠাট্টা করে বলে, এই যে রায়দা, আপনার ক্যামেরায় বুঝি মানুষের ছবি ওঠে না? আমরা যে রয়েছি, একসঙ্গে ঘুরছি, এর কোনও ছবি তোলা যায় না?

অসীম ভুরু কুঁচকে বলে, ধ্যাত মশাই, আপনাদের চেহারায় ছবি তোলার কী আছে? স্বাতী তখন বলে, আমরা দেখতে খারাপ, তাই অসীমবাবু পাত্তা দিচ্ছেন না।

অসীম তখন হাসতে শুরু করে। তবু কিন্তু ক্যামেরার লেন্স ফেরায় না আমাদের দিকে। আবার সে কুকুর কিংবা পাখি ধরতে যায়।

কখনও কখনও অবশ্য অসীমের দয়া হয়। আমাদের না জানিয়ে একটু দূর থেকে ক্যামেরা ফিরিয়ে ক্লিক ক্লিক করে। কাছে এসে বলে, দেখি, পাশাপাশি দাঁড়ান তো। এতই যখন ইচ্ছে, আপনাদের, একটা ছবি তুলে দিই।

যে-কোনও কারণেই হোক, সেই সব ছবি ঠিক প্রাইজ পাওয়ার উপযুক্ত হয় না।

সন্ধের মুখে বৃষ্টি নামল। প্রথমে খুব গুড়িগুড়ি। যেন আমাদের ঘরে ফেরার সময় দিচ্ছে। আকাশের অবস্থা মোটেই ভালো নয়, যাকে বলে বিদ্যুৎ-বজ্রপাত সহ বৃষ্টি, তার সম্ভাবনা যথেষ্ট। ফেরার পথে আমরা কয়েকটা খড়ের চালের বাড়ি দেখলাম। ঠিক আমাদের গ্রামের গরিব মানুষদের বাড়ির মতন। অসীম জানাল, এদেশের অত্যন্ত বড়লোকরাই এরকম শখের খড়ের চাল দেওয়া বাড়ি বানায়। বাইরেটা যতই সামান্য দেখাক, ভেতরটা গরম রাখার ব্যবস্থা ও অন্যান্য আধুনিক সরঞ্জাম তো রাখতেই হবে, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়। তখন আমার মনে পড়ল, আমেরিকার একটি শহরে আমি খাপরার চাল দেওয়া মাটির বাড়ি দেখেছিলাম। পুরুলিয়া কিংবা বিহারে যেরকম বাড়ি খুব দেখা যায়। সেগুলোও আসলে খুব শখের বাড়ি, খুবই ব্যয়বহুল! কী আজব শখ!

রাত্তিরে রেস্তোরাঁয় গিয়ে আমি প্রথমেই দাবি তুললাম, ঝিনুক খেতে হবে!

মেনিউ-তে ঝিনুকের নানারকম পদ আছে, তার মধ্যে ওয়াইন দিয়ে সেদ্ধ করা মূল পদটিই অসীম সুপারিশ করল। কিন্তু মুশকিল হল কুমকুমকে নিয়ে। সে খাবে না।

পশ্চিম জগতে বেড়াতে যাওয়ার আগে অনেকে প্রতিজ্ঞা করে, গোরুর মাংস আর মদ কিছুতেই ছোঁবে না। কিন্তু এই দুটি বস্তুই এড়ানো প্রায় অসম্ভব বলা যেতে পারে। কতরকম রান্নার মধ্যে যে ওয়াইন, শ্যাম্পেন কিংবা কনিয়াক থাকে, তার ইয়ত্তা নেই। আইসক্রিম, কেক, চকোলেট, বিস্কুটের মধ্যেও থাকে। আর গোরুর মাংস যে কোথায় মিশে আছে, তাও ধরবার উপায় নেই। এমনকি অতি নিরীহ আলুভাজা, সেটাও ভাজা হতে পারে এমন লার্ড দিয়ে, যা বিশুদ্ধ গোরুর চর্বি। ঘি-ও যেমন গোরুর চর্বি, সেটা অবশ্য পাওয়া যায় জ্যান্ত গোরুর কাছ থেকে। অনেকে হ্যামবার্গার খায় এই ভেবে যে শুয়োরের মাংস হিন্দুর কাছে নিষিদ্ধ মাংস নয়, কিন্তু হ্যামবার্গারের সঙ্গে হ্যামের কোনও সম্পর্ক নেই। হ্যামবুর্গ শহরের নামে প্রচলিত এই খাদ্যটির মাঝখানে থাকে এক চাকা গোমাংসা

আমাদের শাস্ত্রকাররা অতি বাস্তববাদী ছিলেন, তাঁরা বলে গেছেন যস্মিন দেশে যদাচারঃ। কিংবা, প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। একালে অনেকে এই সব শাস্ত্রবচন মানতে চায় না বলেই যত বিপত্তি।

কুমকুম ঝিনুক খাবে না বলে নিল এক বাটি সুপ। তার এক চামচ মুখে ঠেকিয়েই সে শিউরে উঠল। একটা কী রকম গন্ধ লাগছে! ওই সুপও তার মুখে রুচবে না। সত্যি কথা বলতে কী, প্রথমবার আমেরিকা গিয়ে প্রথম এক দোকানের সুপে চুমুক দিয়ে আমারও এরকম গা গুলিয়ে উঠেছিল। কী রকম যেন একটা গন্ধ, একেবারে অচেনা, আমাদের স্বাদের সঙ্গে মেলে না। তারপর আস্তে-আস্তে অভ্যেস হয়ে গেল, পরে আমি সেধে-সেধে বাটি বাটি সুপ খেতাম।

কুমকুম সুপও খাবে না, তা হলে কী খাবে? বাদলের মুখ কাঁচুমাচু। বউ কিছু না খেলে সে নিজে খায় কী করে?

কুমকুম অবশ্য ঘাবড়াবার পাত্রী নয়। চারপাশের সব কিছু খুঁটিয়ে লক্ষ করা তার স্বভাব। সে এর মধ্যেই দেখে নিয়েছে যে দুরের একটা টেবিলে একজন লোক একটা বেশ লম্বা মাছ ভাজা খাচ্ছে। সে বলল, আমিও তো মাছ খেতে পারি। শুধু মাছ হলেই চলবে। তার সঙ্গে রুটি মাখন খেয়ে নেব!

কুমকুমের জন্য অর্ডার দেওয়া হল ট্রাউট মাছ। সেই মাছের সঙ্গে ফাউ হিসেবে এলো খানিকটা ফুটফুটে সাদা ভাত। ব্যস, মাছ আর ভাত, বাঙালির আর কী চাই?

আমাদের জন্য ঝিনুক এল বেতের বাস্কেটে, বেশ কয়েক ডজন, যেন একটা ঝিনুকের পাহাড়। সেগুলো আস্তই রয়েছে, ছাড়িয়ে খেতে হবে। আরম্ভ করে দিলাম। ওয়াইনে জারিত হয়ে অপূর্ব স্বাদ।

অসীম একটা গল্প শোনাল। একজন আশাবাদী মানুষের গল্প। সেই লোকটি একটা দামি রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছে। চার-পাঁচ রকম ভালো ভালো ডিশের পর কয়েক ডজন এই ঝিনুকের অর্ডার দিল। খেল খুব তৃপ্তি করে। তারপর বেয়ারা বিল নিয়ে আসতেই সে এক গাল হেসে বলল, পয়সা তো নেই! তখন সেখানকার ম্যানেজার এসে বলল, এটা কী ব্যাপার, আপনার কাছে পয়সা নেই তবু আপনি এত টাকা দামের খাবারের অর্ডার দিলেন কেন? লোকটি বলল, আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, এতগুলো ঝিনুক খেতে-খেতে একটা একটার মধ্যে মুক্তো পেয়ে যাবেই। তখন সেই মুক্তো দিয়েই দাম শোধ হয়ে যাবে!

আমাদের টেবিলে অসীম, বাদল ও স্বাতী একসময় হাত গুটিয়ে নিলেও আমি ছাড়লাম। একটার পর একটা ঝিনুক খেয়েই চলেছি। স্বাতী বারবার বলতে লাগল, আর খেও না, অসুখ করবে, তবু আমি কর্ণপাত করছি না। পয়সা দিয়ে কেনা জিনিস ফেলে দিতে গায়ে লাগে, খেতেও ভালো লাগছে, তা ছাড়া সেই আশাবাদী লোকটার মতন মনে হচ্ছে, যদি শেষ ঝিনুকটার মধ্যে একটা মুক্তো জুটে যায়!

রাত্তির ন’টার মধ্যে খাওয়াদাওয়া শেষ। আমাদের রাত দশটার আগে খিদেই পায় না। কিন্তু এসব জায়গায় রাত দশটায় ঢুকলে কোনও রেস্তোরাঁয় খাবারই পাওয়া যাবে না। রাত্তিরের দিকে আরও একবার বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বৃষ্টি থামেনি।

হোটেলের তিনতলায় উঠে একঘরে সবাই বসে আড্ডা মারতে লাগলাম কিছুক্ষণ। হোটেলটি বেশ বড় হলেও অনেক ঘর খালি। নিজেদের গলার আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যায় না। চতুর্দিক শুনশান করছে এরই মধ্যে।

এক সময় জানলা খুলে বাইরের বৃষ্টি দেখতে গিয়ে হঠাৎ আমার আপোলিনেয়ারের বৃষ্টির কবিতা মনে পড়ল।

বুদ্ধদেব বসু একবার আমাকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, আমার মুশকিল কী জানো, কোথাও বৃষ্টি দেখলে আমার রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গানের লাইন মনে পড়ে, রোদ্দুরের মাধুর্য দেখলে মনে পড়ে বোদলেয়ারের কবিতা, সমুদ্র দেখলে মনে পড়ে শেকসপিয়ারের লাইন, মেঘের গুরুগুরু শুনলে মনে পড়ে কালিদাস। প্রকৃতির যে-কোনও সৌন্দর্য দেখলেই আমার মুগ্ধতার মধ্যে পূর্ববর্তী বড় বড় কবিদের অনুভূতি এসে পড়ে।

আমার অবশ্য এরকম মনে হয় না। বুদ্ধদেব বসুর বিপুল পড়াশুনো ছিল, বিশ্বসাহিত্য তাঁর নখাগ্রে, সেই তুলনায় আমি নিছক এক গোষ্পদ, পড়াশুনো করিনি কিছুই। তবু যে আপোলিনেয়ারের কবিতাটা হঠাৎ মনে পড়ল, তার কারণ, সমুদ্রের ধারে কোথাও একটা জোরালো ফ্লাড লাইট জ্বলছে, সেই আলোয় বৃষ্টির ধারাগুলি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আর আপোলিনেয়ারের কবিতাটিও বৃষ্টির ধারার মতন। বৃষ্টির বর্ণনার জন্য নয়, চাক্ষুষ মিল!

আপোলিনেয়ার নানারকম আকারের কবিতা লিখেছেন, হৃৎপিণ্ডের মতন, মুকুটের মতন, ওভাল আয়নার মতন, গির্জার মতন, আকাশের তারার মতন। সেই কালে বরফির মতন, পিরামিডের মতন অক্ষর সাজিয়েও লিখেছেন কেউ কেউ। কবিতার একটা চাক্ষুষ আবেদনও আছে। এমনিতেই যে কবিতায় কখনও বড় লাইন, কখনও ছোট লাইন লেখা হয়, সেগুলো কেন বড় বা কেন ঘোট, তার কোনও যুক্তি নেই। কবি তাঁর কবিতাটিকে যে-রকম ছবির মতন দেখতে চান, সেই রকমই লেখেন। অনেক কবিই এই সব ব্যাপারে খুব স্পর্শকাতর। কারুর বড় লাইন যদি ছাপার সময় ভেঙে দেওয়া হয় কিংবা ছোট লাইন জুড়ে যায় অন্য লাইনের সঙ্গে তা হলে সেই কবি দারুণ চটে যান। পাঠক কিছুই ধরতে পারলেও কবির মনে হয় কবিতাটার মহা সর্বনাশ হয়ে গেছে। কোনও কোনও কবি ছাপার ব্যাপারে দারুণ খুঁতখুঁতে, কেউ আবার উদাসীন। বুদ্ধদেব বসু নিজের যে-কোনও লেখার প্রুফ দেখতেন তিন-চার বার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একটা শব্দেরও সামান্য হেরফের হলে মহা ক্রুদ্ধ হতেন, আবার জীবনানন্দ দাশ লাইন ভাঙা নিয়ে আপত্তি জানাতেন না, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রুফ দেখার ধার ধারে না! জয় গোস্বামী তার একটি কবিতার সাতটি কমা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল, একটি কমাও এদিক-ওদিক হলে যেন তার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। সেই কমার তদারকি করতে রানাঘাট থেকে পত্রিকার দফতরে ছুটে এসেছে অনেকবার।

আবার অনেক কবি দাঁড়ি-কমা-কোলন কিছুই ব্যবহার করেন না। কামিংস লাইনের শুরুতেও ইংরিজি বড় হাতের অক্ষর পর্যন্ত ব্যবহার করতেন না। আপোলিনেয়ারের ‘আলকুল’ নামে কাব্যগ্রন্থটির সমালোচনা করতে গিয়ে আঁরি মারতিনো লিখেছিলেন, এই দুশো পৃষ্ঠার বইটিতে কেউ একটাও ফুলস্টপ তো দূরের কথা, একটা কমা পর্যন্ত খুঁজে পাবে না!

সেই সমালোচনার উত্তর দিতে গিয়ে আপোলিনেয়ার বলেছিলেন, কবিতায় পাংকচুয়েশান একেবারে অপ্রয়োজনীয়, কবিতার ছন্দ এবং যেভাবে লাইনগুলো ভাঙা হয়, সেই তো আসল পাংকচুয়েশান। বৃষ্টি বা হৃৎপিণ্ড বা তারার আকৃতির কবিতা লেখার সমর্থনে আপলিনেয়ার বলেছিলেন, এগুলো হচ্ছে ক্যালিগ্রাফ, মুক্ত ছন্দের কবিতা এবং ছাপার টাইপ সাজাবার যে নিখুঁত পর্যায়ে এসেছে তারই ভাবরূপ। অক্ষর, টাইপোগ্রাফির আয়ুর শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে, এরপর থেকে সিনেমা ও গ্রামোফোনই সব প্রকাশ মাধ্যম দখল করে নেবে। আপোলিনেয়ার এ কথা লিখেছিলেন ১৯১৮ সালে, তিনি টেলিভিশন ও ভি সি আর-এর যুগের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। ছাপার অক্ষর এখনও দুর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব করছে।

আপোলিনেয়ার ছিলেন মার্গারিটের প্রিয় কবি। সে আমাকে জোর করে ওঁর কিছু কিছু ছোট কবিতা মুখস্থ করিয়েছিল। অনেক বছর কেটে গেছে, আমি মনে করার চেষ্টা করলাম তার কিছু এখনও মনে আছে কি না। বিসতেয়ার নামে এই কবির একটি বই আছে, বার সবকটি কবিতাই পশু-পাখি-পতঙ্গের নামে। প্রজাপতি বিষয়ক একটি কবিতায় এরকম একটি লাইন ছিল, পভর পোয়েত, ত্রাভাইয়ে। অর্থাৎ, গুটি পোকারা অনেক খাটাখাটনি করে যেমন একদিন প্রজাপতি হয়, তেমনি গরিব কবিরা, তোমরাও খাটো, খাটো, পরিশ্রম করো!

লাইনটা মনে পড়ামাত্র আমি যেন মার্গারিটের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমি কখনও বিছানায় একখানা বই নিয়ে শুয়ে আলস্য করলে মার্গারিট এসে বলত, এই, এখনও শুয়ে আছ। পভর পোয়েত ত্রাভাইয়ে! অনেককালে আগে, সেই আয়ওয়া শহরে, কোনও একদিন হয়তো বরফ পড়ছে, রাস্তাগুলো সাদা হয়ে গেছে, আমার একটু একটু মন খারাপ, আমি সারাদিন বাইরে বেরোইনি, রান্নাবান্নাও করিনি, জানলার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তুষারপাতও দেখছি না, আমি তাকিয়ে আছি কলকাতার দিকে। মার্গারিট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাস নিয়ে ফিরল, বাইরের পাপোশে একটুক্ষণ ধুপধাপ করে ঝেড়ে ফেলত পায়ের বরফ, তারপর দরজা খুলল চাবি দিয়ে। আমাকে দেখেই বুঝতে পারল, জিগ্যেস করল, কী হয়েছে, সুনীল, মন খারাপ? তারপরই ঝরঝর করে হেসে ফেলে বলল, তুমি প্রজাপতি হতে চাও না? পভর পোয়েত ত্রাভাইয়ে!

হঠাৎ বাজ পড়ার শব্দে চমকে উঠে বাস্তবে ফিরে এলাম। বৃষ্টি খুব বেড়েছে, সেই সঙ্গে শনশন করছে ঝড়, লকলকে বিদ্যুতের শিখা চিরে দিচ্ছে আকাশ। এবার আমার অন্য একটি রাতের কথা মনে পড়ল। সেই রাতটাতেও এরকম প্রবল ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত চলছিল। ১৯৪৪ সালের ৬ জুন!