২৭. নর্মান্ডির পথে

‘যে দৈবাৎ ঢুকে পড়ে কবির নিজস্ব ঘরে, সে জানে না
এ ঘরের প্রতিটি আসবাব তাকে জাদু করতে পারে
চেয়ার আলমারির কাঠে সব ক’টি গ্রন্থি ধরে রাখে
যত বিহঙ্গের গান অরণ্যের বুকে আছে, তারও বেশি।
হঠাৎ টেবিল ল্যাম্প-মেয়েদের মতো তার গ্রীবার ভঙ্গিমা
মসৃণ দেওয়াল থেকে উঁকি দিতে পারে কোনও পড়ন্ত সন্ধ্যায়
চকিতে সে দেবে ডাক নানা বর্ণ নানা জাতি মৌমাছির ঝাঁক
ফুটন্ত ফুলের গুচ্ছে তাজা পাঁউরুটির গন্ধ সে পারে জাগাতে…’
–রেনে গি কাদু

বেশ সকাল সকালই আমরা প্যারিস ছেড়ে রওনা দিলাম নর্মান্ডির পথে।

আবহাওয়া বেশ অনুকুল। এ সব দেশে মেঘলা আকাশ কেউ পছন্দ করে না, রোদ্দুর উঠলেই আনন্দ। রোদ আছে কিন্তু গরম নেই। আমাদের পৌঁছবার কোনও তাড়া নেই। এবারে আমাদের দলটির গঠনই আলাদা। সঙ্গে রয়েছে দুই নারী। শাড়ি পরা নারীরা এখনও এখানে কৌতূহলের বিষয়। কোনও হোটেল-রেস্তোরাঁয় ঢুকলে লোকে তাকাবেই। গাড়ির পেছনের সিটে কুমুকম ও স্বাতী এবং বাদল বসু। সামনের সিটে, অসীমের পাশে আমাকে ম্যাপ খুলে বসতে হয়েছে। ম্যাপ ছাড়া গাড়ি চালানো এ দেশে দুঃসাধ্য, এরকম রাস্তা যে একটু অনমনস্ক হলেই ভুল পথে যাওয়ার সম্ভাবনা।

আমি অসীমের কাছে মাঝেসাঝে বকুনি খাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছি। এবারে ভাস্কর নেই, অসীম ও ভাস্করের মধ্যে ছদ্ম রেষারেষি ও কথার টক্কর চলবে না, ভাস্করের তুলনায় আমি অনেক মিনমিনে। বাদলকে করা হয়েছে ম্যানেজার ও কোষাধ্যক্ষ, আমরা কিছু কিছু চাঁদা ওর কাছে জমা দিয়েছি, যা কিছু খরচ বাদলের হাত দিয়েই হবে।

দক্ষিণ ফ্রান্সের দিকে প্রকৃতি অনেক বেশি সুন্দর ছিল। জঙ্গল, পাহাড়, গিরিখাত ও ভূমধ্যসাগরের গাঢ় নীল জল খুবই দৃষ্টিনন্দন। সেই তুলনায় এই অঞ্চলের প্রকৃতি অনেক রুক্ষ। ধুধু মাঠ, শ্লেট রঙের মাটি।

নৰ্মান্ডির নাম শুনলেই ভাইকিংদের কথা মনে পড়ে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় সেই সব জলদস্যু, যাদের পরিক্রমা এক সময় সারা ইউরোপ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এই ভাইকিংরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেনি, বাহুবল ও দুঃসাহসই ছিল তাদের ধর্ম, সেই জন্য তাদের বলা হত বারবেরিয়ান, হিদেন! রণতরী নিয়ে অকূলে ভেসে পড়ত তারা, তাদের উদ্দেশ্য সোনা ও নারী লুণ্ঠন।

সেই ভাইকিংদের একটি দল ফ্রান্সের উত্তর উপকূলে এক সময় বসতি স্থাপন করে। নবম শতাব্দীতে। অনেক যুদ্ধবিগ্রহ সত্বেও তারা এই জায়গার দখল ছাড়েনি। পরে এই এলাকাটির নাম হয় নর্মান্ডি, সেই দুর্ধর্ষ জলসরা ক্রমে খ্রিস্টধর্ম বরণ করে নেয়, ফরাসি ভাষাও গ্রহণ করে এবং তাদের নাম হয় নর্মান।

এই নর্মানদের শ্রেষ্ঠ বীর উইলিয়াম দা কংকারার সাগর পেরিয়ে গিয়ে ইংল্যান্ড জয় করেছিলেন। নর্মান শাসন ছড়িয়ে পড়ে স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং আয়ার্ল্যান্ডে। নর্মান শাসনে ব্রিটিশ জাতি সুসভ্য হয়। পরে অবশ্য ইংরেজরাও ফ্রান্স আক্রমণ ও দখল করেছে অনেকবার। এই নর্মান্ডিই প্রধান রণক্ষেত্র এবং বহুবার হাত বদল হয়েছে।

ইতিহাসের সেইসব চিহ্ন এখন বিশেষ চোখে পড়ে না।

ঘণ্টা কয়েক চলার পরেই গাড়ির কী যেন একটা গণ্ডগোল শুরু হল। প্রত্যেকবারই বেড়াতে বেরুবার আগে অসীম তার গাড়ি ভালো করে দেখিয়ে-টেখিয়ে, সার্ভিস করে নেয়, তবু যন্ত্রপাতির কথা তো বলা যায় না। আমি গাড়ি বিষয়ে কিছু জানি না, গাড়িটা চলছে ঠিকই, কোথাও কিছু একটা শব্দ হচ্ছে, সেটা সারিয়ে না নিলে বেশি গোলমাল হতে পারে।

বাদলও একজন গাড়ির এক্সপার্ট, সে বলল, হ্যাঁ, একটা শব্দ হচ্ছে বটে, কিন্তু ওতে কোনও অসুবিধে হবে না, সে বলল, হ্যাঁ, একটা শব্দ হচ্ছে বটে, কিন্তু ওতে কোনও অসুবিধে হবে না, রাত্তিরে যেখানে থাকব, সেখানে দেখিয়ে নিলেই হবে।

অসীম বলল, হ্যাঁ, তা ঠিক, পরে দেখালেও চলবে।

এই বলেই সে ধাঁ করে একটা পেট্রল পাম্পের মধ্যে গাড়ি ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর খোঁজ করল মেকানিকের।

সেখানে কোনও মেকানিক নেই, তারা বলে দিল পাঁচ-দশ মাইল দূরের আর একটা কোনও পাম্পে যেতে। দ্বিতীয় পাম্পে গিয়ে জানা গেল, সেখানে অন্য দিন একজন মেকানিক থাকে বটে, কিন্তু আজ রবিবার বলে তার ছুটি। তারা আবার আর একটি জায়গার সন্ধান দিল।

এইরকমভাবে আমরা সাতখানা পেট্রল পাম্প ও গ্যারাজে ঢু মারলাম, কিন্তু রবিবার দিন কিছুতেই মেকানিক পাওয়া যাবে না। রবিবার দিন কারুর সাংঘাতিক অসুখ হলেও ডাক্তার পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

গাড়িখানার অসুখ বিষয়ে বাদল ও অসীমের সামান্য মতভেদ হতে লাগল। বাদলের মতে, এক্ষুনি গাড়িটার কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই। আর মেকানিক পাওয়া যাচ্ছে না। বলেই অসীমের আরও জেদ চেপে যাচ্ছে, আজ দেখাতেই হবে।

দু’জন মহিলার মতন, আমারও এ বিষয়ে কোনও মতামত দেওয়ার অধিকার নেই। গাড়িখানা দিব্যি চলছে এটাই দেখতে পাচ্ছি। চলাই তো গাড়ির জীবনের লক্ষণ। যদিও সন্ত কবীর বলেছেন, গাড়ি মানে যার গেড়ে বসে থাকার কথা, কিন্তু বিস্ময় এই যে, ‘চলতি কা নাম গাড়ি’।

প্রায় পঞ্চাশ মাইল এ গ্যারাজে সে গ্যারেজে ঘোরাঘুরি করার পর একটি বন্ধ কারখানার দারোয়ানের কাছে খবর পাওয়া গেল যে কাছেই একজন মেকানিকের বাড়ি, সে রবিবারেও কাজ করে।

লোকটি নিশ্চয়ই খুবই দরিদ্র কিংবা বিদেশি!

খুঁজে বার করা হল তার বাড়ি। সে লোকটি কালি-ঝুলি মাখা ওভারঅল পরে ছিল। বাড়িতেই কাজ করছিল কিছু। আমার সন্দেহ সত্য, লোকটি ফরাসি নয়, খুব সম্ভবত ইতালিয়ান অথবা গ্রিক।

অসীমের প্রস্তাব শুনে সে প্রথমেই বলল, দেড়শো ফ্রাংক লাগবে।

তারপর গাড়ির সামনের ডালাটা তুলে সে এক মিনিট পর্যবেক্ষণ করল, কয়েকবার ফু দিল, হাতের ন্যাকড়া দিয়ে মুছে দিল কী যেন। ডালাটা নামিয়ে দিয়ে চাঁটি মেরে বলল, ঠিক আছে!

পাঁচ মিনিটও সময় ব্যয় করেনি, তার জন্য দেড়শো ফ্রাংক! বাদল আগেই তো আমি বলেছিলুম জাতীয় একটা হাসি দিতে যেতেই অসীম গম্ভীরভাবে বলল, গাড়িটা সত্যিই বেশি খারাপ হয়ে গেলে বুঝি আপনি খুশি হতেন?

আমি মনে মনে ভাবলাম, বাদল এই প্রথম অসীমের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছে, প্রথম প্রথম কয়েকবার তো বকুনি খাবেই। ক্রমশ সে নিজেই বুঝে যাবে, কী করে উলটো প্যাঁচে অসীমকে টিট করতে হয়।

মেকানিকটিকে দেড়শো ফ্রাংক দেওয়া এই জন্য সার্থক যে এর পর শব্দটা থেমে গেল, অসীমের মনের খচখচানি ঘুচে গেল এবং বাকি রাস্তায় একবারও গাড়িটা কোনও গণ্ডগোল করল না।

ম্যাপে মনোযোগ দিয়ে রাস্তা দেখতে-দেখতে আমি অসীমকে জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা, আমরা কি ব্রিটানির দিকেও যাব? নর্মান্ডির পরেই তো ব্রিটানি দেখতে পাচ্ছি।

অসীম বলল, ব্রিটানি তো অনেক দূর হয়ে যাবে। সেখানে কেন যেতে চাও!

আমি বললাম, রেনে কাদু নামে একজনের একটা কবিতা খুব ভালো লেগেছিল। কবিতাটির নাম খুব সম্ভবত ‘কবির ঘর’। রেনে কাদু ব্রিটানিতে থাকতেন। একবার তাহলে তাঁর বাড়িটা দেখে আসতাম।

অসীম জিগ্যেস করল, রেনে কাদু, খুব বড় কবি?

আমি বললাম, তেমন একটা বিখ্যাত নয়। কিন্তু ওঁর ঠান্ডা মতন কবিতা আর ওঁর জীবনটা বেশ লাগে। এ যুগে অধিকাংশ কবিই কোনও এক সময় শহরে চলে যায়, এখন তো শহরগুলোই সাহিত্যের কেন্দ্র। কিন্তু রেনে কাদু বরাবর গ্রামেই রয়ে গেলেন, বি এ পাশও করতে পারেননি, একটা ইস্কুলে মাস্টারি করতেন, আর নিরিবিলিতে কবিতা লিখতেন। এক সময় আমারও বাসনা ছিল, কোনও গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করব আর শুধু কবিতা লিখব। সারা জীবনে তিন চারখানা কবিতার বই যার করতে পারলেই যথেষ্ট।

অসীম হেসে বলল, সবার কি সব শখ মেটে। সময় পেলে ব্রিটানিতে যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সেখানে তুমি রেনে কাদু’র বাড়িটা খুঁজে পাবে কি না খুব সন্দেহ আছে। ব্রিটানি তো বিরাট এলাকা।

আমি বললাম, নর্মান্ডি নামটার মধ্যেই যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ। ব্রিটানির সৌন্দর্যের খ্যাতি আছে। অনেক লেখায় পড়েছি।

অসীম বলল, ব্রিটানিতেও যুদ্ধ কম হয়নি। তবে, সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সমর-অভিযান কোথায় হয়েছিল, তা তুমি জানো?

আমি বললাম, যারা একটু-আধটু ইতিহাস পড়েছে তারা সবাই জানে। আচ্ছা, ব্রিটানিতে কি পল গগ্যাঁ থাকতেন এক সময়? তাহিতি দ্বীপে যখন পল গগ্যাঁ মৃত্যুশয্যায়, তখনও তার মনে পড়ত ব্রিটানির কথা! তিনি শেষ যে ছবিটা আঁকার চেষ্টা করেছিলেন সেটার নাম ‘ব্রিটানির তুষার’ না?

অসীম ভুরু কুঁচকে বলল, ব্রিটানির তুষার? না, তা তো হতে পারে না! ব্রিটানিতে কি বরফ পড়ে নাকি? না তো, তোমার ভুল হচ্ছে।

আমারও খটকা লাগল। নিশ্চয়ই আমার ভুল। কিন্তু কেন যেন ‘ব্রিটানির তুষার’ আমার মাথায় গেঁথে আছে। ভুলটা না ভাঙলেই বা ক্ষতি কী!

পেছন থেকে মহিলাদের একজন বলল, এখন একটু চা কিংবা কফি খাওয়ার জন্য থামলে হয় না?

গাড়িটা যাচ্ছে একটা ছোট্ট শহরের মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি অনেক কাফে ও রেস্তোরাঁ। একই কফি রেস্তোরাঁয় খেলে দাম বেশি, কাফেতে সস্তা।

অসীম বলল, হ্যাঁ, একটা ভালো দোকান দেখে থামতে হবে।

অসীমের ভালো দোকান বলতে কী বোঝায়, তা আন্দাজ করা শিবের বাবারও অসাধ্য। বেশ ভালো ভালো দোকান পেরিয়ে যাচ্ছে, দেখতে সুন্দর দোকান, পার্কিং-এর জায়গা আছে এমন দোকান, সবই পার হয়ে গেল অসীম, শহর ছাড়িয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল, একই রাস্তায় চক্কর মারল, তারপর সে এমন একটা জায়গায় থামল, যেখানকার বিশেষ নির্বাচনযোগ্যতা যে কী তা আমরা কেউ বুঝলাম না।

অসীম কিন্তু সস্তা খোঁজে না, তবে সে কী যে খোঁজে, তা কেউ জানে না। বড় রাস্তার ওপরের খুব বেশি সাজানো গোছানো দোকান তার পছন্দ নয়, আবার একেবারে নিরিবিলি জায়গাতেও সে থামতে চায় না। রোতিসেরি নামে দোকানে এক ধরনের ঝলসানো মুরগি পাওয়া যায় সে রকম একটা মুরগি দেখে স্বাতীর একবার খাবার সাধ হয়েছিল। অসীম বলেছিল, দাঁড়ান, আপনাকে খুব ভালো একটা জায়গায় ওই মুরগি খাওয়াব! তারপর পাঁচ ছ’দিন ধরে ফ্রান্সের অনেকখানি অঞ্চলে ঘোরাঘুরি হল, ওইরকম রোতিসেরি কত পেরিয়ে গেল, কোনওটাই অসীমের পছন্দ নয়, স্বাতীর আর সেটা খাওয়াই হল না। আজও স্বাতী সেই মুরগির প্রসঙ্গ তুলে অসীমকে খোঁচা দেয়।

এই সব ছোটখাট জায়গার কাফেতে বেশ গরম গরম ক্রোয়াশ কিংবা প্যান কেক পাওয়া যায়। তার সঙ্গে কফি খুব জমে। চলন্ত গাড়িতে সিগারেট টানার উপায় নেই বলে এই সময়টা আমরা আরাম করে সিগারেট ধরাই। যার যা ইচ্ছে মতন খাওয়া, দাম দেবে বাদল। প্রথম প্রথম পয়সা মেটাতে গিয়ে বাদল অস্বস্তিতে পড়ত। ফরাসি এক দুই যে জানে না, সে হঠাৎ টাকা দেওয়ার সময় দিজ উইথ কিংবা কাতর ভ্যাঁ শুনলে কী বুঝবে? কিন্তু বাদল চালাক ছেলে, কাফে-রেস্তোরাঁর কাউন্টারে কিংবা পেট্রল পাম্পের মেশিনের দিকে সে খর দৃষ্টি রাখে, টাকার অঙ্কটা সেখানে দেখে নেয় টপ করে।

আজ আর বেশি দূর যাওয়া যাবে না, আমিই প্রস্তাব তুললাম, এবার রাত্রিবাসের জন্য হোটেল ঠিক করা হোক। কারণ, জানি তো, সে জন্যও প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় ব্যয় হবে। ভাস্কর নেই, কেই বা ভিটো দেবে অসীমের ওপর।

মাত্র গোটা দশেক হোটেল ঘোরার পর একটি হোটেল পছন্দ হল। চতুর্দিকে ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি, কিছুই দেখবার নেই। যাই হোক, একটা রাত্তিরের মোটে মামলা।

কিন্তু হোটেলটি যে খুব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তা বোঝা গেল পরদিন সকালবেলা।

এসব হোটেলে এক রাতের অতিথিরা আসে বেশি। সকালবেলা ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমাদের ব্যস্ততা নেই, তা ছাড়া মহিলাদের স্নানপর্ব সারতে অনেক সময় লাগে। আমরা ব্রেকফাস্ট খাবার পর একটি ঘরে বসে গল্প করছি। এক বুড়ি আমাদের ব্রেকফাস্ট সার্ভ করেছে। কাউন্টারেও আর এক বৃদ্ধাকে দেখেছি।

কুমকুম বলল, ওই দুই বুড়ি দুই বোন!

বুড়িদের সঙ্গে তার একটাও কথা হয়নি, তবু কুমকুম বুঝল কী করে? বুড়িরা এক বর্ণ ইংরিজি জানে না, অসীমের মাধ্যম ছাড়া তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করারও কোনও উপায় নেই। কুমকুম বেশি কথা বলে না, কিন্তু সব কিছু লক্ষ করে। বুড়ি দু’জনের চেহারায়ও তেমন মিল নেই। তবু ওদের ভাবভঙ্গি দেখে কুমকুম ঠিকই আন্দাজ করেছে, অসীম বুড়িদের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিল, তারা সত্যিই দু’ বোন।

আরও একজন বৃদ্ধা আমাদের বিছানা-টিছানা পরিষ্কার করে দিয়ে গেল। সে-ও অন্য দু’জনের সহোদরা না হলেও কিছু একটা আত্মীয়। এই তিন বৃদ্ধার কারুরই বয়েস সত্তরের কম নয়। আর কোনও পুরুষ নেই, তিন বুড়ি এই হোটেল চালাচ্ছে।

সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নয়, পশ্চিমি দেশগুলির ভোগ্যপণ্যের বিপুল সমারোহের জন্যও নয়, সুন্দর সুন্দর বাড়ি আর চকচকে রাস্তার জন্যও নয়, এইসব দেশের মেয়েদের আত্মনির্ভরতা দেখলেই মনে হয়, আমাদের দেশ কত পিছিয়ে আছে। একটা গোটা হোটেল চালাবার জন্যও কোনও পুরুষের সাহায্য লাগে না, তিন বুড়িই যথেষ্ট। আর আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা আঁতুরঘর আর রান্নাঘর থেকে বেশি দূর যেতেই পারেননি।

শাড়ি পরা কুমকুম ও স্বা তাঁকে দেখে বুড়িরা খুবই কৌতূহলী, মাঝে মাঝে কলকল করে কত কী বলে যাচ্ছে, ওরা কিছুই বুঝছে না। তবে এরাও হাসছে, ওরাও হাসছে। হাসির মতন এমন সর্বজনবোধ্য ভাবা আর হয় না।

স্বাতী এক বৃদ্ধাকে একটি উপহার দিতে চাইল। একট ব্রোচ, ওপরের দিকটা ছুরির আকারের। হোটেলের মালিক আর খদ্দেরের মধ্যে উপহার দেওয়ার সম্পর্ক হয় না সাধারণত। বৃদ্ধাটি খানিকটা প্রতিবাদের সুরে কী যেন বলতে লাগল অসীমকে। এই রে, বৃদ্ধা কিছু মনে করেছে নাকি?

অসীম বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা। বৃদ্ধা খুবই মুগ্ধ হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে কেউ যেমন রুমাল উপহার নেয় না, প্রেমিকাও প্রেমিককে রুমালের বিনিময়ে পয়সা দেয়, সে রকম ওদেরও নিয়ম, কারুর কাছ থেকে বিনা পয়সায় ছুরি নিতে নেই। বুড়ি তার দাম দেবেই, স্বাতীও নেবে না। শেষ পর্যন্ত সেই বুড়ি পুরোনো আমলের একটা এক পয়সা খুঁজে যার করল কোথা থেকে।

শুধু তাই নয়, বৃদ্ধ আমাদের সবাইকেই উপহার দিল কয়েকটি ছোট ছোট ফ্রান্সের পতাকা।

গাড়িতে আমাদের মালপত্র তোলা হচ্ছে, আমাদের বিদায় দেওয়ার জন্য দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে দুই বৃদ্ধা। হঠাৎ মনে হতে পারে, আমরা যেন কোনও আত্মীয়ের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মাসি-পিসিরা। এদের মুখ সেইরকমই স্নেহময়।

বাদল বলল, বেশ বাড়ি-বাড়ির মতন লাগল, তাই না?

স্বাতী বলল, এখানে আর দু-একটা দিন থেকে গেলে হয় না?

অসীম হেসে বলল, এতই ভালো লেগে গেছে? কিন্তু শহরের মধ্যে একটা হোটেলে কাটাবার জন্য তো আমরা বেড়াতে বেরোইনি!

আগের যার দক্ষিণ ফ্রান্সের দিকে যাওয়ার পথে লাস্কোতে আমরা এক চাষির বাড়িতে উঠেছিলাম। সেবারে সকালবেলা সেখান থেকে আমাদের প্রায় বিতাড়িত হতে হয়েছিল। গাড়ি চালাতে শুরু করার পর আমি সেই গল্প শোনালাম অন্যদের। সেবারের তুলনায় এবায়ের অভিজ্ঞতা কত অন্যরকম। আমাদের সেই হেনস্থার কাহিনি শুনে দুই মহিলা খুব হাসতে লাগল। যেন তারা বলতে চায়, বেশ হয়েছে! আমাদের না নিয়ে বেরিয়েছিলে, তাই তো ওইরকম অবস্থা!