২৪. মনাকো থেকে ফেরার পথে

‘এই ঘেরা চত্বরগুলোয় কে কোনটার মালিক? কার
পাহাড়ের একেবারে চূড়া পর্যন্ত ঢেকে থাকা
সুস্থির দেওয়ালগুলি, হলুদ গম, অ্যামন্ড বৃক্ষেরা?
এই সুন্দর সম্পত্তিটি কি তোমার, তোমার
এই বাড়ি, চমৎকার একটা পুকুর
উঠোনে যে শিশুটি কাঁদছে, সেও?
আহা, কে নিজের হাতে ধরে রাখতে পারে
ভেঙে পড়া সব দেওয়াল, অবিনশ্বর কুসুম
টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া জমিদারি, শুকিনে যাওয়া
কুয়ো
লতা পাতা গজিয়ে যাওয়া বিস্তৃত কবরখানায়
কে পড়বে মৃত পরিবারের সব কটা নাম?
এবং বাতাস, পাথর, মৃত্যু, এসব কার?’
–আদ্রেঁ ফ্রেনো

মনাকো থেকে ফেরার পথে ভাস্করের হঠাৎ হেঁচকি উঠতে লাগল। প্রথমে আমরা তেমন কিছু গুরুত্ব দিইনি। হেঁচকি কেন যে যখন তখন আরম্ভ হয় তা কে জানে, আবার একটু বাদে থেমেও যায়। ভাস্কর একটা মজার গল্প আরম্ভ করেছিল, তার মাঝখানে হেঁচকির শব্দে বাধা পড়তে লাগল। অসীম বলল, জল খাও, ভাস্কর, জল খাও ভালো করে! তোমরা ইংল্যান্ডের লোকেরা শুধু কোলড ড্রিংকস আর বোতলের পেরিয়ের ওয়াটার খাও, এমনি জল খেতে ভুলেই গেছ!

আমি একবার আমেরিকার টি ভি দেখে হেঁচকির কয়েকটা চমৎকার টোটকা শিখেছিলাম। ওদেশে টিভি’র অনেকগুলি চ্যানেলে বহু রকম বাণিজ্যিক অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু একটা থাকে পাবলিক নেট ওয়ার্ক। সেটা সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিক, তাতে কোনও বিজ্ঞাপন থাকে না। বড় বড় কোম্পানির চাঁদায় এটা চলে, এতে থাকে দেশি-বিদেশি নানারকম ভালো ভালো অনুষ্ঠান, বেশ কিছু আকর্ষণীয় শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান। মাঝে মাঝে দু’ এক মিনিটের জন্য কিছু কিছু অসুখ সম্পর্কেও বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

তাতেই দেখেছিলাম যে হঠাৎ খুব হেঁচকি উঠলে দু’ চামচ চিনি খেয়ে নিতে হয়। তাতে কাজ হয় ম্যাজিকের মতন। যারা চিনি খায় না, বা হাতের কাছে চিনি না থাকলে দু-তিনটে বিস্কুট গুঁড়ো করে এক সঙ্গে মুখে ফেলে দিলেও একই কাজ হবে। আমি নিজে পরীক্ষা করে এই টোটকার সুফল পেয়েছি প্রত্যেকবার। শুধু জল খেলে হেঁচকি কমতে চায় না, জল খাওয়ার সময় নাক টিপে ধরে দম বন্ধ করে থাকা দরকার।

ভাস্করের ওপর এই সব কটি টোটকা পরীক্ষা করেও কোনও কাজ হল না, তার হেঁচকি বাড়তেই লাগল। শরীর খারাপ হলে কোনও সুন্দর দৃশ্যই চোখে পড়ে না। ভাস্করের জন্য আমরা উৎকণ্ঠিত, তাতে সে বেশ বিরক্ত, ওই অবস্থাতেও সে জোর করে হাসি গল্প ও জানলার বাইরে মনোযোগ ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগল। যারা প্রকৃত ভদ্রলোক ও যাদের খাঁটি রসবোধ থাকে, তারা কক্ষনো নিজেদের শরীর খারাপ কিংবা অসুখ-বিসুখ নিয়ে অন্যদের বিব্রত করতে চায় না।

হোটেলে ফিরে আসার পর ভাস্করকে একটু শুয়ে থাকতে বলা হল। সে কিছুতেই শুনবে না, আমরা প্রায় জোর করেই তাকে শোয়ালাম। দেখা গেল, তাতে হেঁচকির প্রাবল্য বাড়ছে। উঠে এসে ভাস্কর বলল, বুঝেছি, এ কিছু না! খুব অ্যাসিডিটি হয়েছে, দুপুরের হোয়াইট ওয়াইনটা বড় টক টক ছিল। এই বলে দু-তিন রকম অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট মট মট করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল ভাস্কর, তাতেও কাজ হল না কিছু।

সন্ধের দিকে আমরা বেশ বিচলিত হয়ে পড়লাম। ভাস্করের হেঁচকি এমন বেড়েছে যে ভালো করে কথাই বলতে পারছে না। ঠিক হেঁচকি না, এ যেন ঢেঁকুর আর হেঁচকির মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। এরকম আগে কখনও দেখিনি। এক সময় ভাস্কর ছুটে গিয়ে বাথরুমে বমি করল।

অসীম বলল, চলো, কাল সকালেই ফিরে যাই। ভাস্করকে যদি ডাক্তার দেখাতে, হয়, প্যারিসেই সুবিধে।

আমি ও মৃণাল সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। এখানে আরও দু-একদিন হেসে খেলে থেকে গেলে মন্দ হত না। সস্তায় পছন্দমতন হোটেল পাওয়া গিয়েছিল, আবহাওয়াও খুব সুন্দর। কিন্তু আমাদের দলের মধ্যে ভাস্করই নানারকম পাগলামি ও গালগল্পে সব সময় জমিয়ে রাখে।

পরদিন বেশ ভোর ভোরই বেরিয়ে পড়া গেল।

এবার ধরা হল অন্য রাস্তা। অটো রুট। চওড়া এই মসৃণ পথে গাড়ি ছোটে একশো কুড়ি কিলোমিটার স্পিডে। আমেরিকার রাস্তায় পঞ্চান্ন মাইলের বেশি স্পিডে গাড়ি চালালেই ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশ ক্যাঁক করে চেপে ধরে। ফ্রান্সে তখনও সে বালাই ছিল না। এই অটো রুট ধরে সন্ধের মধ্যেই প্যারিস পৌঁছে যাওয়ার কথা। আসবার পথে আমাদের দু’রাত কিংবা তিন রাত হোটেলে কাটাতে হয়েছিল, ফেরার সময় সে খরচ নেই বটে, কিন্তু কিছুদূর অন্তর অন্তর টোল দিতে হয়, তাও কম নয়, এক একবার সত্তর-আশি টাকা। গাড়ির চালকদের কাছ থেকে এত বেশি পয়সা নেয় বলেই এরা রাস্তাগুলো এত নিখুঁত রাখে। সব সময় দেখা যায়, কোথাও না কোথাও মেরামত কিংবা নতুন করে সাজাবার পালা চলছে।

অটো রুটগুলো কোনও বাধা মানে না বটে, এমনকি এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ও ব্রিজ দিয়ে জোড়া, তবে ট্রাফিক জ্যাম হতেই পারে যে-কোনও সময়। এত চওড়া রাস্তা, কিন্তু গাড়িও তো হাজার হাজার।

ট্রাফিক জ্যামে গাড়ির গতি মন্থর হলে আমি স্বস্তি বোধ করি। দিনের বেলা দু’ধারের দৃশ্য না দেখতে পেলে গাড়ি চড়ার আনন্দই মাটি। উল্কার বেগে গাড়ি ছুটলে কিছুই দেখি না।

অটো রুট দিয়ে যারা গাড়ি চালায় তারা দৃশ্য-শ্য নিয়ে মাথা ঘামায় না, তাদের শুধু তাড়াতাড়ি পৌঁছবার ব্যস্ততা। গতি কমাতে হলে তারা বিরক্ত হয়।

এক জায়গায় গাড়ি একেবারে স্থির হয়ে গেল, সামনে অসংখ্য গাড়ি থেমে আছে। অসীম ছটফট করছে, আমি বললাম, বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নাও।

অসীম ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, এখানে তো শুধু মাঠ, দেখবার কী আছে? তবু যদি একটা সুন্দর জায়গায় থামতে হত।

আমি ঠিক গুছিয়ে উত্তর দিতে পারলাম না। তবে আমার মনের মধ্যে যে কথা গুঞ্জরিত হল, তা হচ্ছে এই : দৃশ্য সব সময় সুন্দর হওয়ার তো দরকার নেই। অনেকখানি বিস্তীর্ণ মাঠের শূন্যতাও একটা দৃশ্য। একটা দুটো ন্যাড়া গাছও দৃশ্য। এক পাল গরুও দৃশ্য। এসব নিয়ে কবিত্ব করার দরকার নেই, কিন্তু এই সব ছবিও আমাদের মাথার মধ্যে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিক্রিয়া থেকে অন্যরকম একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এদেশে শহুরে মানুষ আজকাল সব সময় কৃত্রিম জিনিস দেখে। গাড়ি টেলিফোন-ফ্রিজ-টিভি-সানমাইকার টেবিল, চিনে মাটির বাসন, কংক্রিটের বাড়ি, কলম পেন্সিল বই! এয়ার কন্ডিশনড ঘর। এয়ার কন্ডিশনড গাড়ি। এর মধ্যে প্রকৃতির কোনও এলিমেন্টাল ব্যাপার নেই। এমনকি আমাদের দেশেও একবার এক হোমরাচোমরা অফিসারের ঘরে গিয়ে লক্ষ করেছিলাম, সেখানে সব কিছুই মানুষের ও মেশিনের তৈরি, প্রকৃতির কাছ থেকে সরাসরি পাওয়া একটা কিছুও নেই। মাত্র পঞ্চাশ ষাট বছর আমরা এইভাবে প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হয়েছি, আমাদের চোখ কি এই জন্য তৈরি হয়েছে? একটা কারখানার ছবির চেয়ে সাধারণ একটা পাহাড়ের ছবি তা হলে এখনও আমাদের আকৃষ্ট করে কেন? পাহাড় তো ফালতু, তা থেকে আর কী পাওয়া যাবে, কারখানাই তো আমাদের সব কিছু দেয়।

কৃত্রিমতার জন্য মানুষের চোখ এখনও তৈরি হয়নি। এখনও অনেকটা জল, ফাঁকা মাঠ কিংবা দু-চারটে গাছ দেখলে আমাদের চোখের আরাম হয়। এর প্রভাব হয়তো তক্ষুনি বোঝা যায় না, কিন্তু মাথার মধ্যে কাজ করে যায়।

সুতরাং দৃশ্য মানেই ক্যালেন্ডারের সুন্দর ছবি হওয়ার দরকার নেই।

ভাস্কর ঘুমিয়ে পড়েছে। তার হেঁচকি এখন বন্ধ বলে আমরা স্বস্তি বোধ করছি।

আমি আর অসীম নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। সামনে অসংখ্য গাড়ির নিশ্চল ঢেউ। দু চার কিলোমিটার আগে কিছু একটা ঘটেছে বোধহয়। অনেকেই গাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

সিগারেট ধরিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে খানিকটা হাঁটতেই একটা বাড়ি চোখে পড়ল। আমি খানিকটা কৌতূহলের সঙ্গে তাকিয়ে রইলাম। এ বাড়িটা যেন এখানে থাকার কথা নয়। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে, একেবারে ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটা সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। কোনও কারখানা, বা অফিসবাড়ি নয়। কারুর শখের বসতবাড়ি, সামনে বাগান, গেটের দুপাশে দুটি নগ্ন নারীমূর্তি, মাঝখানে একটা লিলি পুলের ওপর সুন্দর ছোট্ট ব্রিজ।

কাছাকাছি আট দশ মাইলের মধ্যে কোনও জনবসতি নেই, এখানে হঠাৎ এরকম একটা একলা বাড়ি থাকার মানে কী?

আমার প্রশ্ন শুনে অসীম বলল, কেন, কেউ কি ফাঁকা জায়গায় থাকার জন্য বাড়ি বানাতে পারে না? অনেক সময় বুড়ো-বুড়িরা থাকে!

আমি বললাম, ইলেকট্রিক, জলের লাইন, সেসবও না হয় এসব দেশে ব্যবস্থা হয়ে যায়, কিন্তু চোর ডাকাতেরও কি ভয় নেই?

অসীম বলল, চোর-ডাকাতদের খুব মুশকিল হয়ে গেছে আজকাল। বাড়িতে কেউ গয়না-গাঁটি রাখে না। ব্যাংকে থাকে। ক্যাশ টাকাও কেউ রাখে না। কয়েকখানা ক্রেডিট কার্ড রাখলেই কাজ চলে যায়। চোরেরা কী নেবে?

আমি বললাম, ফ্রিজ, টিভি এই সব কিছু দামি জিনিস তো থাকেই।

অসীম বলল, ওসব জিনিস গরিব দেশের চোরেরা নিতে পারে। এখানে পুরোনো ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদির রিসেল ভ্যালু খুব কম। এখন একমাত্র দামি জিনিস হল মেয়েদের যৌবন। সেজন্যই তো বললাম, ফাঁকা জায়গায় শুধু বুড়ো-বুড়িরাই থাকতে সাহস করে।

বাড়িটাকে দেখে মনে হয়, অনেকদিন এখানে কেউ থাকেনি। গেটে তালা। সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ। পর্চে পড়ে আছে এলোমেলোভাবে কিছু পুরোনো কাগজ।

অসীম বলল, হয়তো বুড়ো-বুড়ি বন্ধ করে কিছুদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে গেছে।

আমার অন্যরকম মনে হয়। হয়তো এখানে এককালে কোনও শৌখিন মানুষের সংসার ছিল। স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে চলে গেছে শহরে, তারা কেন পড়ে থাকতে যাবে এই ধাধধাড়া গোবিন্দপুরে, যাবা-মায়েরাও মরে হেজে গেছে কবে, বন্ধ।

ঘরগুলোর মধ্যে রয়ে গেছে শুধু তাদের দীর্ঘশ্বাস। এখানে এই বাড়ি আর কেউ কিনবে না, আস্তে আস্তে খসে পড়বে জানলা-দরজা। পাথরের নগ্ন নারীমূর্তি দুটোর হাত আর নাক ভাঙবে, চোখ অন্ধ হবে।

বাড়িটার পেছন দিকে, খানিকটা দূরে একটা টিলা। সেখানে কয়েক সারি গাছ। খুব একটা রোদ নেই আজ, ছায়া ছায়া ভাব। দৃশ্যটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। এক একদিন এরকম হয়, কোনও অচেনা জায়গায় এসেও মনে হয়, আগে দেখেছি। কোনও অচেনা মানুষ সম্পর্কেও মনে হয়, ঠিক এরকম একজনের সঙ্গে আগে কথা বলেছি।

এই অটো রুট দিয়ে আমি আগে কখনও যাইনি। অপ্রত্যাশিত ট্রাফিক জ্যাম না হলে এখানে থামারও কোনও প্রশ্নই উঠত না। তবু এই অকিঞ্চিৎকর দৃশ্যটা চেনা মনে হল কেন?

আমি এক সময় বিড়বিড় করে বলে উঠলাম, কামিল পিসারো!

অসীম বলল, কী?

আমি বললাম, ঠিক এরকমই একটা ল্যান্ডস্কেপ আছে না কামিল পিসারোর আঁকা? ব্যাক গ্রাউন্ডে টিলা, গাছের সারি, সামনের দিকে একটা বাড়ি, কি যেন ছবিটার নাম?

অসীম বলল, হ্যাঁ, আছে এরকম ছবি। দাঁড়াও, নামটা বলছি। রোড টু দা হার্মিটেজ। সেখানে অবশ্য একটা বাড়ি নয়, আরও দু-চারটে ঘোট ঘোট ঘর। পাশের দিকে একটা বেশ বড় গাছ।

আমি বললাম, তোমার তো বেশ মনে আছে ছবিটা।

অসীম বলল, পিসারো অতি সাধারণ সব গ্রাম্য দৃশ্যের ছবি আঁকতেন। তবু একবার দেখলেই মনে থেকে যায়।

আমি বললাম, পিসাররা যেসব ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেন, দৃশ্য হিসেবে সেগুলোর সত্যিই কোনও মূল্য নেই। কিন্তু দিনের আলোর স্বাভাবিক রং ব্যবহার করে তিনি যে-সব ছবি এঁকে গেছেন, সেগুলো প্রথম দেখলে মনে হয় কোনও অসাধারণত্ব নেই, তাঁর সমসাময়িক দেগা, রেনোয়া কিংবা সেজান-এর ছবি অনেক বেশি মৌলিক এবং নাটকীয়, তবু পিসারোর ছবি মনে একটা ছাপ ফেলে যায়।

অসীম বলল, পিসারোই তো ওপন এয়ারে ছবি আঁকার জন্য সে সময় একটা আন্দোলন চালিয়েছিল। সেজান অনেক বেশি বিখ্যাত হয়েছিল, সেজান-এর মতন অহংকারী এবং দুর্মুখও কিন্তু পিসারোর কাছে শিষ্যের মতন ল্যান্ডস্কেপ আঁকা শিখেছিল। পিসারো মানুষটা ছিল সাধুর মতন, শান্ত মেজাজ, তখনকার আর্টিস্টদের মধ্যে অনেকের মধ্যেই ঝগড়া ছিল, এ ওর মুখ দেখত না, কিন্তু পিসারোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল সকলেরই। পিসারো সম্পর্কে একটা মজার গল্প শুনবে?

দূরে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ হতেই আর গল্প হল না, আমরা দৌড় লাগালাম। সমস্ত গাড়িই আবার শম্বুক গতিতে এগোতে লাগল বটে, কিন্তু সন্ধের মধ্যে প্যারিসে পৌঁছবার আশা দুরাশা।

অসীম বলল, মুশকিল হচ্ছে, আজ রবিবার তো। যারা উইক এন্ডের ছুটি কাটাতে শুক্রবার প্যারিস ছেড়ে বেরিয়েছিল, সবাই আজ ফিরছে।

গাড়ির সংখ্যা দেখলে মনে হয়, অন্তত কয়েক লাখ মানুষ সপ্তাহান্তে ছুটি কাটাতে শহর থেকে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তাও তো এই একটাই নয়, আরও বিভিন্ন দিকে আছে অটো রুট। আমার ধারণা, যারা মাসের পর মাস শহর ছেড়ে বাইরে যায় না, তাদের মাথার গোলমাল হতে বাধ্য।

জেগে ওঠার পর ভাস্করের আবার হেঁচকি শুরু হয়েছে। ভাস্কর তো সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, আরও তিন চারদিন ছুটি আছে, সাউথ অফ ফ্রান্সের রিভিয়েরা ছেড়ে প্যারিসে যাওয়ার কোনও মানে হয়? চলো ফিরি। ওই হোটেলটায় আবার জায়গা পাওয়া যাবে। আরও কিছু সুন্দরী মেয়ে দেখলেই আমার হেঁচকি ঠিক হয়ে যাবে!

প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য আমি জিগ্যেস করলাম, অসীম, তুমি কামিল পিসারো সম্পর্কে কী যেন একটা গল্প বলতে যাচ্ছিলে?

অসীম আমার দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝল, তারপর বলল, ও হ্যাঁ, সেই গল্পটা। একটা সুন্দরী মেয়ের গল্প। ভাস্কর, তুমি তো জানোই, ইমপ্রেসানিস্টরা এক সময় কী রকম গরিব ছিল, কত রকম কষ্ট সহ্য করেছে। এর মধ্যে পিসাররাকে সহ্য করতে হয়েছে চরম দারিদ্র্য, কারণ তাঁর ল্যান্ডস্কেপ বিক্রি হতই না প্রায়। একবার ইউজিন মুরে নামের একজন লোক, তার একটা কেকপেস্ট্রির দোকান ছিল, সে পিসারোকে সাহায্য করবার জন্য পিসারোর একটা ছবি লটারি করবে ঠিক করল। এক টাকার টিকিট, তাতে যদি চার-পাঁচশো টাকা ওঠে, সেটাই পিসারোর লাভ, তখন তার বাড়িতে একেবারে না খেতে পাওয়ার অবস্থা। কিন্তু এই এক টাকার টিকিটও বিশেষ কেউ কিনতে চায় না। তিরিশ চল্লিশখানা বিক্রি হলেও লটারির কথা যখন ঘোষণা করা হয়েছে, তখন করতেই হবে, যদিও ওই কটা টাকায় রঙের দামও ওঠে না। লটারি হল, জিতল সেই পাড়ারই একটা সুন্দরী মেয়ে। যুবতী, আর বেশ ফচকে ধরনের। সে ছবিটা উলটে-পালটে দেখে জিভ উলটে বলল, মাগো! এ ছবি কে নেবে?

দোকানদারকে সে বলল, এই ছবিটার বদলে আমাকে একটা ক্রিম বান দাও না!

ছবির বদলে সে একটা মিষ্টি রুটি নিয়ে চলে গেল।

ভাস্কর বলল, পাগলি! সে মেয়েটা ওই ছবিটা রাখলে আজ তার নাতি-পুতিরা লাখ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারত!

বাকি পথ শিল্পীদের বিষয়ে গল্প করতে-করতে এলাম। অসীমের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোতে বেশ রাত হয়ে গেল। শেষের দিকে ভাস্করের হেঁচকি বেড়ে গেল বেশ। ভাস্কর অবশ্য একটুও না ঘাবড়ে বলল, বুঝেছি, পর পর কয়েকটা রাত ভালো ঘুম হয়নি। সেইজন্য এই ব্যাপার। আজ ঘুমের ওষুধ খেতে হবে।

পরদিন ভাস্কর বেশ স্বাভাবিক রইল। ও ডাক্তার-টাক্তার দেখাতে চায় না। ফরাসি ডাক্তারের ভাষা বুঝতে পারবে না। নিজেও কিছু বোঝাতে পারবে না। ভুল ওষুধ খেয়ে মারা পড়বে নাকি! নিজেই সে ইচ্ছেমতন ওষুধ খেতে লাগল।

প্যারিসে কাফে-রেস্তোরাঁয় পূর্ব পরিচিতদের কারুর সঙ্গে দেখা হলে আমাদের কাছে সাউথ অফ ফ্রান্সের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি শুনতে চায়। অনেকের ধারণা, ওখানকার ভ্রমণ বেশ ব্যয়বহুল, আমরা বেশ সস্তায় সেরে এসেছি শুনে তারা অবাক হয়। ভ্যারনার ল্যামবারসি নামে একজন বেলজিয়ান কবি আমাদের নাম দিয়েছে, বেঙ্গলি মাফিয়া। চারজন পুরুষ মানুষ এক সঙ্গে দিনের পর দিন গাড়িতে করে ঘুরছে, এরকম দৃশ্য এসব দেশে প্রায় দেখাই যায় না। দুজন পুরুষ ও দুজন নারীই স্বাভাবিক। একমাত্র খুনে গুণ্ডারাই নারীবর্জিত হয় অনেক সময়।

প্রীতি ও বিকাশ সান্যালের বাড়িতে এক সন্ধেবেলা। যতবারই প্যারিসে আসি, এ দম্পতির কাছে নেমন্তন্ন একেবারে বাঁধা। দুজনেই আড্ডা দিতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন, নেমন্তন্ন করেন আরও অনেককে। প্যারিসের বাঙালিদের একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছি। প্রায় সকলেই উচ্চশিক্ষিত, নিছক সাধারণ চাকরি করতে কেউ ফ্রান্সে আসে না। কেউ বিজ্ঞান গবেষক, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, বা বিশেষ ধরনের টেকিনিশিয়ান, কেউ সমাজতাত্বিক, কিন্তু এঁরা সকলেই ফরাসি শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে খবর রাখেন। এটা বোধহয় ফরাসি দেশের জল হাওয়ার গুণ। অন্যত্র এমন দেখিনি। এখানকার আড্ডার আলোচনাও একটু উচ্চস্তরের, রসিকতাগুলি সূক্ষ্ম, কেউ একটাও অনার্য শব্দ ব্যবহার করেন না। এরই মধ্যে ভাস্কর একটি মূর্তিমান ব্যতিক্রম। ভাস্কর কবিতা ভালোবাসে, ছবি দেখা ওর নেশা, কিন্তু কথাবার্তায় তথাকথিত ইনটেলেকচুয়াল সাজতে একেবারেই রাজি নয়, উত্তর কলকাতায় কাঁচা বাংলা যখন তখন বেরিয়ে আসে, যাকে খুব আপন আপন মনে করে, তাকে শালা বলে সম্বোধন করে। প্রীতি ও বিকাশের বাড়িতে ভাস্কর শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও শরৎকুমার মুখোঁপাধ্যায়ের সঙ্গে তার কলকাতার চিনে পাড়ায় কয়েকটি এমন অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি শুরু করে দিল যে বিশিষ্ট অতিথিরা আঁতকে উঠলেন প্রথমে, তারপর বেশ উপভোগ করতে লাগলেন। তাঁদের অভিজ্ঞতায় এসব একেবারে নতুন।

গল্পের মাঝপথে ভাস্করের হঠাৎ আবার খুব হেঁচকি উঠতে শুরু করল। সে ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তার যে বেশ কষ্ট হচ্ছে, তা বোঝা যায়।

অগত্যা পরের দিন ভাস্কর আর মৃণালকে প্রায় জোর করেই পাঠিয়ে দেওয়া হল লন্ডনে। আমার বিমানের রিজার্ভেশান আরও দিন তিনেক পরে, আমাকে থেকে যেতে হবে। অসীমও অফিস যেতে শুরু করল, দুপুরে আমি সম্পূর্ণ একা। তাতে আমার কোনও অসুবিধে নেই। রাস্তাঘাট মোটামুটি চেনা আছে। ইচ্ছে করলেই যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ানো যায়। এ শহরে আকর্ষণের কোনও অভাব হয় না। ছবির প্রদর্শনী লেগেই আছে। এবার আমার মাথায় কামিল পিসাররা গেঁথে গেছে। আমি বিভিন্ন গ্যালারিতে গিয়ে তার ছবি দেখছি।

দুপুরবেলা সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়কেও পাওয়া যায়। তার অফিস থেকে কেটে পড়ার কোনও অসুবিধে নেই বোধহয়। ইংরেজরা না-বলে ছুটি নেওয়াকে বলে ফ্রেঞ্চ লিভ। ফরাসিদের নাকি এ অভ্যেস আছেই।

সুপ্রিয় ছবি-বিশেষজ্ঞ, কোন গ্যালারিতে কোন ছবি আছে, সব তার নখদর্পণে। প্রকাণ্ড একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সে সারা প্যারিসে চষে বেড়ায়। কোথায় সস্তায় অত্যুত্তম খাবার পাওয়া যায়, সে ব্যাপারেও আমি সব সময় সুপ্রিয়-অনুসরণকারী।

একদিন দুপুরবেলা সুপ্রিয় বলল, চলো, আলবার্তো মোরাভিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাবে? তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। হঠাৎ আমি আলবার্তো মোরাভিয়ার সঙ্গে আলাপ করতে যাব কেন? অত বিখ্যাত লেখকদের ধারে-কাছে যেতে আমার মোটেই ইচ্ছে করে না।

সুপ্রিয় বলল, ইতালিয়ান দূতাবাসে মোরাভিয়া গির্জার কাঁচে আঁকা ছবি বিষয়ে বক্তৃতা দেবেন, আমার কাছে দুটো কার্ড আছে, সেখানে গেলেই আলাপ হবে।

আমি বললাম, আমার কোনও দরকার নেই, সুপ্রিয়। মোরাভিয়ার দু-চারটে উপন্যাস ও গল্প এক সময় ভালো লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু মানুষটি সম্পর্কে আমার কোনওই আকর্ষণ নেই। প্রথম কথা, তিনি নিশ্চিত এখন বেশ বুড়ো। দ্বিতীয় কথা, ভারত সম্পর্কে তাঁর কোনও ভালো ধারণা নেই, রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে দিল্লি গিয়ে তিনি বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছুই জানি না, তাজমহল দেখতে এসেছি। তাহলে আমি মোরাভিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাব কেন?

সুপ্রিয় বলল, তুমি এই কথা বলছ? তোমাদের কলকতায় অমুক প্রবন্ধ লেখক একবার প্যারিসে এসে জাঁ পল সাত্রের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। সার্জ-কে চিঠি লেখা হল, উনি দেখা করতে রাজি হলেন না। তারপর যে কাফেতে সাত্র রোজ সকালে যেতেন সেখানে আমি ওই বাঙালি প্রবন্ধ লেখককে একদিন নিয়ে গেলাম। সাত্র তাঁকে পাত্তাই দিলেন না, বসতেও বললেন না, টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে দু-চারটে কথা বলে বিদায় করে দিলেন। তারপর দেখি, সেই প্রবন্ধকার দেশে ফিরে সাত্র-এর ওপর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছেন।

সুপ্রিয়র কথা শুনে মনে হয়, জাঁ পল সার্ত, সিমোন দ্য বোভোয়া, রেনে শার, আলবার্তো মোরাভিয়া ইত্যাদি বিখ্যাত বহু ব্যক্তির সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে, তুই তুকারির সম্পর্ক। আমি বললাম, আমার ভাই কোনও খ্যাতিমান লেখকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি আসি স্রেফ বেড়াতে।

অনেকক্ষণ তর্কবিতর্ক করেও হার মানতে হল সুপ্রিয়র কাছে। অগত্যা যেতে হল তার সঙ্গে ইতালিয়ান দূতাবাসে। সেখানে গিয়ে অবশ্য এক আকস্মিক নতুন অভিজ্ঞতা হল। বৃদ্ধ আলবার্তো মোরাভিয়ার বদলে আলাপ হল এক অত্যন্ত আকর্ষণীয়া মহিলা শিল্পীর সঙ্গে।