২২. ভূমধ্যসাগরই হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ

‘সকলেরই মুখে সূর্যাস্তের কথা
পৃথিবীর এ অঞ্চলে সব পর্যটকরাই
সূর্যাস্ত বিষয়ে কথা বলতে একমত
এমন অসংখ্য বই আছে,
যাতে শুধু সূর্যাস্তেরই বর্ণনা
গ্রীষ্মমণ্ডলের সূর্যাস্ত
হ্যাঁ, সত্যি ভারী চমৎকার
কিন্তু আমি ভালোবাসি সূর্যোদয়
ভোর
আমি একটি প্রত্যুষও হারাই না
আমি ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকি
নগ্ন
আমি একা সূর্যোদয়ের বন্দনা করি
কিন্তু আমি সূর্যোদয়ের বর্ণনা করতে চাই না
আমি আমার ভোরগুলি শুধু
নিজের জন্যই রেখে দেব।’
–ব্লেইজ স্যাঁদরার

পৃথিবীতে যতগুলো সমুদ্র আছে, তাদের মধ্যে ভূমধ্যসাগরই হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ। এশিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপের মাঝখানের এই সমুদ্রের ওপর দিয়েই মানব সভ্যতা অনেকবার পারাপার করেছে। তা ছাড়া এই সমুদ্রটি দেখতে যত সুন্দর, তেমনই উপকারী। এর জল নরডিক রূপসিদের চোখের তারার মতন নীল। এখানে বড় বড় ঢেউ ওঠে না, তাই বিপদের সম্ভাবনা খুবই কম, সেকেলে জাহাজগুলিও এই সমুদ্র অনায়াসে পার হয়ে গেছে। এখনও সন্তরণকারীরা নির্ভাবনায় বহুদূর চলে যায়, মায়েরা তাদের দু-তিন বছরের বাচ্চাদেরও দু’হাতে দুটি বেলুন বেঁধে এই সমুদ্রে ছেড়ে দেয়। হাঙর-কুমিরের মতন হিংস্র প্রাণীদের উৎপাতের কথা কখনও শোনা যায়নি। তার বদলে আছে প্রচুর মাছ, জাল ফেললেই জালভর্তি রুপোলি মাছ উঠে আসে। ভূমধ্যসাগর যেন এক বিশাল, নিরাপদ অ্যাকোরিয়াম।

এই সমুদ্রকে ঘিরে অনেকগুলি দেশ, স্পেইন, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস, টার্কি, সিরিয়া, ইজিপ্ট, লিবিয়া, টিউনিসিয়া, আলজিরিয়া। তবু দক্ষিণ ফ্রান্সের বেলাভূমিই বিশ্ববিখ্যাত, ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা সারা পৃথিবীর বিলাসীদের লীলাভূমি। কাছাকাছি ইতালিয়ান রিভিয়েরা’রও সুনাম আছে। ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা’র আবহাওয়াও একটা বিশেষ আকর্ষণ, কখনও এখানে খুব শীত পড়ে না, তুষারপাত হয় না, আবার গ্রীষ্মকালেও গরমের আঁচ নেই।

পর্যটকরা এখানে টাকা খরচ করতে আসে, তাই সুদীর্ঘ বেলাভূমি সাজানো হয়েছে অতি সুন্দরভাবে। বালির ওপরেই বেঁটে-বেঁটে পাম ও খে জ্বর গাছ, কোথাও ফুলের সমারোহ। যে-জায়গাগুলো শুধু পাথুরে ছিল, সেখানেও জাহাজে করে বালি এনে ফেলা হয়েছে। একসঙ্গে এত হোটেল ও রেস্তোরাঁর সমাবেশও পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি সন্দেহ। আমরা চার বাঙালি এর মধ্যে পয়সার হিসেব করে চলি, দিনের বেলা সস্তার খাবার কিনি কিংবা স্যান্ডুইচ খেয়ে পেট ভরাই, রাত্তিরে বড় বড় হোটেলগুলি এড়িয়ে গলিঘজির মধ্যে ছোট ছোট দোকান, যেখানে স্বামী-স্ত্রী মিলে রান্না করে খাওয়ায়, সেখানে ঢুকে পড়ি। বড় হোটেলের চেয়ে তাদের রান্না অনেকরকম বেশি সুস্বাদু হয়। অসীম ভাস্কর-মৃণাল নিজেদের মধ্যে কিছু একটা চুক্তি করে রেখেছে, আমাকে তারা পয়সা খরচ করার সুযোগই দেয় না।

সকাল থেকেই এখানে চলে স্নানের উৎসব!

রিভিয়েরাতে এসে কেউ ঘরে বসে থাকতে চায় না। সমুদ্রই এখানকার প্রধান-আকর্ষণ, যে-যতক্ষণ পারে সমুদ্রকে উপভোগ করে। সাজ-পোশাকের বালাই নেই, একখানা তোয়ালে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল। কেউ কেউ চার-পাঁচ ঘণ্টা জলের মধ্যে কাটিয়ে দেয়, কেউ খানিকক্ষণ সমুদ্রে গা ভাসিয়ে আবার বালির ওপর শুয়ে থাকে।

আমরা বেলাভূমির নানা অংশ ও ছোট ছোট দ্বীপগুলিতে ঘুরে ঘুরে স্নানের জায়গা বদল করি। যে যেখানে খুশি যেতে পারে, কোনও বাধা নেই। এখানে বিশ্বের বহু ধনীর নিজস্ব বাড়ি আছে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে। এক সময় কেউ কেউ নিজের বাড়ির দরজা থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বেড়া বা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিয়েছিল, যাতে সেই জায়গার সমুদ্রটুকু তাদের নিজস্ব হয়ে যায়, তাদের প্রাইভেসি কেউ নষ্ট না করে। কিন্তু ফরাসি সরকারের আদেশবলে সেই সব বেড়া ও পাঁচিল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কারণ, যে-কোনও সাধারণ মানুষেরই সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটার অধিকার আছে, সমুদ্রের সৌন্দর্যকে কেউ ব্যক্তিগত সম্পত্তি করতে পারবে না। বিখ্যাত চিত্রতারকা ব্রিজিৎ বারদো’র নিজস্ব বাড়ি আছে সাঁ ব্রোপে নামে এক নির্জন অংশে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ব্রিজিৎ বারদো’র নাম শুনলে বুক কাঁপত না, এমন সিনেমা-দর্শক পুরুষের সংখ্যা বিরল। রজার ভাদিমের ছবি ‘অ্যান্ড গড় ক্রিয়েঢেউ উয়োম্যান’ দেখে মনে হয়েছিল ব্রিজিৎ যেন পৃথিবীর নারী-সৌন্দর্যের প্রতীক। আমেরিকায় মেরিলিন মনরো, ইউরোপে ব্রিজিৎ বারদো। মেরিলিন যৌবন থাকতে থাকতেই আত্মহত্যা করে, ব্রিজিৎ যৌবন ফুরোবার আগেই সিনেমা থেকে বিদায় নেয়। গ্রেটা গার্বো যেমন কোনওদিন মা-মাসি-পিসির ভূমিকায় অভিনয় করেনি, নায়িকা থাকতে থাকতেই আত্ম-নির্বাসনে চলে যায়, কোনওদিন আর বাইরের লোকের সামনে দেখা দেয়নি, ব্রিজিৎ বারদোও তেমনি এখানে একটি বাড়িতে আত্মগোপন করে আছে। তার জন্তু জানোয়ারের খুব শখ। মানুষের সঙ্গ পরিহার করে সেই রূপবতী এখন ঘোড়া ও কুকুরদের সঙ্গে সময় কাটায়।

ব্রিজিৎ বারদো’র বাড়ির সামনের পাঁচিলও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছে করলে সেখান দিয়েও হেঁটে যাওয়া যায়, আমরা অবশ্য যাইনি। চতুর্দিকেই অসংখ্য সুন্দরী, আলাদা করে সিনেমার নায়িকাকে দেখার কোনও প্রয়োজন হয় না।

সমুদ্রতীরে সাধারণ মানুষের এই অধিকারের কথা শুনে আমার মনে পড়ে সুইডেনের কথা। স্টকহলমে গিয়ে একটা সুন্দর নিয়মের কথা শুনেছিলাম। প্রকৃতির ওপর সব মানুষের সমান অধিকার। সুইডেনে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ আছে। স্টকহলমের কাছেই নাকি চব্বিশ হাজার। ইচ্ছে করলেই পুরো একটা দ্বীপ কিনে ফেলা যায়। অন্যান্য দেশে যেমন লোকের গাড়ি থাকে, সুইডেনে অনেকের থাকে নিজস্ব মোটর বোট বা লঞ্চ। শহর থেকে নিজস্ব মোটর বোটে, নিজস্ব দ্বীপে তারা ছুটি কাটাতে যায়। কিন্তু এই সব দ্বীপে অন্য যে-কেউই পা দিতে পারবে, কেউ যদি দল বেঁধে কোনও দ্বীপে পিকনিক করতে চায়, মালিক বাধা দিতে পারবে না। এমনকি বাগানের ফুল-ফলও মালিকের একার নয়, সেও তো প্রকৃতির দান, যার ইচ্ছে হবে সেই ফল ছিঁড়ে খেতে পারে। এমনকি রাজার বাগানও ব্যতিক্রম নয়। আমি নিজে স্টকহলমের রাজার বাগানের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে দেখেছি, বহু অফিসযাত্রী সেই বাগানের রাস্তায় শর্টকাট করে। রাজার পুকুরে বাইরে লোক এসে সাঁতার কাটে। অবশ্য ফুল-ফল ছিঁড়তে কারুকে দেখা যায় না, অনেক গাছ থেকে আপেল-আঙুর এমনিই ঝরে পড়ে যায়, কেউ খায় না।

সারাদিন স্নানের পর বিকেলবেলা আমরা পা ছড়িয়ে বসে থাকি বালিতে। ভূমধ্যসাগরের সূর্যাস্ত না দেখে ঘরে ফেরার কোনও মানে হয় না। প্রথমবার প্রবাসবাসের শেষে দেশে ফেরার সময় আমি বিমানে বসে এক সূর্যাস্ত দেখেছিলাম, সেই দৃশ্য আমার মনে আজও জ্বলজ্বল করে। আথেনস থেকে বিমানটি উড়ে যাচ্ছিল কায়রো’র দিকে, এই ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়েই। পাশ্চাত্য ছেড়ে আমি আসছি প্রাচ্যের দিকে, জানলা দিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল পেছনের ইউরোপ যেন প্রবল আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে, আর সামনের প্রাচ্য দেশে জমাট অন্ধকার!

এবারে এখানকার সূর্যাস্তে সেই আগুনের দীপ্তি নেই, সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে গেল সোনালি আভা, সমুদ্রের নীল জলে যেন অন্তরীক্ষ থেকে ঝরে পড়ছে অসংখ্য স্বর্ণময় তীর। কিংবা স্বর্ণরেণুর বৃষ্টি।

অসীম বলল, ভাস্কর, এখানকার সানরাইজ আরও সুন্দর। কিন্তু তোমার তো দেখা হবে না, তুমি আটটার আগে ঘুম থেকে উঠবেই না!

ভাস্কর বলল, সানরাইজ আর সানসেট দুটো একসঙ্গে হজম হবে না ভাই। একটাই যথেষ্ট।

অসীম আবার বলল, জীবনে কখনও কি সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছেড়ে উঠছ?

ভাস্কর বলল, খামোখা ভোরবেলা জাগতে যাব কেন দুঃখে? আমি মেথর না মুদ্দোফরাস?

দুজনের খুনসুটি চলল কিছুক্ষণ। তখন আমার মনে পড়ল ব্লেইজ সাঁদরারের উপরিউদ্ধৃত কবিতাটি। সত্যিই তো, সূর্যাস্তের বর্ণনা যত লোক লিখেছে, সূর্যোদয়ের বর্ণনা সেই তুলনায় অনেক কম। আমাদের মুনি-ঋষিরা লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, গরমের দেশে তবু অনেকে ভোরবেলা ওঠে, কিন্তু এইসব ঠান্ডার দেশে খুব ভোরে কার বা বিছানা ছাড়তে সাধ হয়!

হঠাৎ আর একটা কথাও মনে পড়ল। এই কবিকে নিয়ে মার্গারিটের সঙ্গে আমার প্রায়ই তর্ক হত! ব্লেইজ স্যাঁদরার সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের গুরু, সেইজন্য তাঁকে আমার খুব পছন্দ, কিন্তু মার্গারিট বলত, স্যাঁদরার শুরু হলে কী হয়, তাঁর কবিতা নীরস, কর্কশ! তাঁর চেয়ে পিয়ের রেভার্দি অনেক বড়। আমি আবার বলতাম, পিয়ের রেভার্দি কাপুরুষ। সে কবিতা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল!

পীয়ের রেভার্দির জন্ম এই সাউথ অফ ফ্রান্সেই, গত শতাব্দীর শেষ বছরে। অল্প বয়েসে প্যারিসে গিয়েছিলেন একটা খবরের কাগজে প্রুফ রিডারের চাকরি নিয়ে। তখন শিল্পে চলছে কিউবিস্টদের আন্দোলন, সাহিত্যে ডাডাইস্ট ও সুরিয়ালিস্টদের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। পিয়ের রেভার্দি এর মধ্যে জড়িয়ে গেলেন। হঠাৎ শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, গিয়ম আপোলিনেয়ারের মতন পিয়ের রেভার্দিকেও যুদ্ধে যেতে হল। দুজনেই ফিরে এলেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই, আপলিনেয়ার মাথায় গোলার আঘাত নিয়ে, রেভার্দি ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে। এর কিছুদিন পরে প্রকাশিত হল বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘নর-সুদ’ (উত্তর-দক্ষিণ), রেভার্দি মেতে উঠলেন তা নিয়ে, তিনি তখন সাহিত্য জগতের তরুণ বিপ্লবী। কিন্তু অকস্মাৎ তাঁর মনোজগতে কী পরিবর্তন এল কে জানে। বন্ধুদের সংসর্গ ছেড়ে তিনি ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করলেন, শুধু তাই নয়, তিনি চলে গেলেন এক নির্জন মঠে। লেখা তো বন্ধ করলেন বটেই, অন্য কারুর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখলেন না। পিয়ের রেভার্দি-এর পরেও বেঁচে ছিলেন ৩৪ বছর, কিন্তু সাহিত্যজগৎ থেকে সম্পূর্ণ পলাতক। মার্গারিট গোঁড়া ক্যাথলিক, সেইজন্যই পিয়ের রেভার্দিকে তার খুব পছন্দ ছিল।

এক চিন্তা থেকে অন্য চিন্তা আসে। আমার বুকটা কেঁপে উঠল।

আমি জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা অসীম, ফ্রান্সে যদি কোনও মেয়ে নান বা সন্ন্যাসিনী হয়ে যায়, তা হলে তারা কি বাইরের কোনও লোককে চিঠিপত্রও লিখতে পারে না?

অসীম ধীর স্বরে বলল, তোমার বুঝি সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ছে? মার্গারিট?

আমি বললাম, মার্গারিট বলত, ওদের পরিবার খুব ধর্মভীরু। ওর এক বোন সন্ন্যাসিনী হয়ে মঠে থাকে। ওর বাবা-মা তাতে খুব আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছিলেন। মার্গারিট কবিতা ভালোবাসত খুব, ওয়াইন ভালোবাসত, একটু-আধটু সিগারেটও টানত, সেই জন্য সন্ন্যাসিনী হয়নি, কিন্তু গির্জায় যাওয়া, বিশেষ বিশেষ খ্রিস্টান পরবে উপোস করা বাদ দিত না। আমি পল এঙ্গেলের কাছে যা শুনেছি, কয়েকজন কালো লম্পট ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তারা ওর ওপর শারীরিক অত্যাচার ও চরম আবমাননার পর যদি কোথাও ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যায়, তারপর যদি কোনওক্রমে ও বেঁচে ওঠে, তা হলে

ভাস্কর বলল, তুই দুঃখ পাবি, তবু বলছি, সাধারণত ওরা চান্স নেয় না, একেবারে মেরেই ফেলে, মেরে কোনও এঁদো জলার মধ্যে ফেলে দিয়ে যায়।

আমি বললাম, ওর শরীরটা তো খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুতরাং বেঁচে থাকা একেবারে অসম্ভব কী? ধর যদি বেঁচে থাকে, তা হলে অপমানে, দুঃখে, লজ্জায় ও হয়তো নান হয়ে যেতে পারে। পারে না?

অসীম বলল, তা হতে পারে। ওদের পরিবারে যখন ট্রাডিশান আছে, তাতে এটা অসম্ভব নয়। যদি সে কোনও মঠে গিয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে থাকে, তা হলে সে আর তোমাকে চিঠি লিখবে না। বাইরের কারুর সঙ্গে এ রকম যোগাযোগ ওদের রাখতে নেই।

আমি বললাম, ওর বাবা-মাকে আমি চিঠি লিখেছিলাম। তাঁরা উত্তর দেননি। সেটাও কি এই কারণে হতে পারে? সন্ন্যাসিনীদের সমস্ত পূর্ব পরিচয় একেবারে মুছে ফেলতে হয়?

অসীম বলল, মেয়েটি যদি সন্ন্যাসিনী হয়ে গিয়ে থাকে, তাতেও তো তোমার খুশি হওয়ার কথা। সে বেঁচে আছে। এই ফ্রান্সেরই কোথাও সে আছে।

ভাস্কর বলল, এরপর নানদের কোনও শোভাযাত্রা দেখলেই সুনীল খুব খুঁটিয়ে দেখবে। যদি মেয়েটাকে চিনতে পারে!

অসীম বলল, সুনীল চিনলেও সে মেয়েটি চিনবে না। খুব সম্ভবত সে সুনীলের সঙ্গে একটাও কথা বলবে না।

আমি বললাম, কথা না বলুক, চিনতে না পারুক, তবু সে বেঁচে থাক। আচ্ছা অসীম, মঠে যারা সন্ন্যাসিনী হয়, তারা কি শুধু বাইবেল পড়ে, না অন্য কবিতাও পড়ে? মার্গারিট এমন কবিতা-পাগল ছিল, সব কি ছেড়ে দেওয়া সম্ভব?

অসীম বলল, এত সব আমি জানব কী করে? আমার কি কোনও নান-এর সঙ্গে প্রেম হয়েছে? তবে যতদূর মনে হয়, আধুনিক কতাি-টবিতা ওদের পড়তে দেওয়া হয় না। তাতে চিত্ত-বিক্ষোভ হতে পারে। নান হওয়া তো ছেলেখেলা নয়, সারাজীবনের মতন নিজেকে ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করে দিতে হয়।

ভাস্কর বলল, সাউন্ড অফ মিউজিক সিনেমাটা হওয়ার পর আমরা অ্যাবের ভেতরকার জীবন অনেকটা দেখতে পেয়েছি। কোনও নান যদি জুলি অ্যান্ড্রুজ-এর মতন হয়, গান গাইতে ভালোবাসে, টম বয়ের মতন ছুটোছুটি করে…।

তারপর ভাস্কর সাউন্ড অফ মিউজিকের একটা গানের লাইন গুনগুন করল, হাউ টু সলভ আ প্রবলেম লাইক মারিয়া–

অসীম আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, তুমি ঠিক বলেছ। আমার সঙ্গে ওর আর দেখা না হোক, আমাকে চিনতে পা পারুক দৈবাৎ দেখা হলেও, তবু ও বেঁচে থাক।

সূর্যাস্তের আলো অনেকক্ষণ লেগে থাকে আকাশের গায়ে। পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসার পর আমাদের উঠে পড়তে হল।

অসীম বলল, ভাস্কর, তুমি হোটেলের মালিক আর তার বউকে নেমন্তন্ন করেছ। তোমাকে এখন গিয়ে রান্না করতে হবে, মনে রেখো!

ভাস্কর বলল, সে ভয়ে কম্পিত নয় বীরের হৃদয়! ম্যাজিক দেখাব, ম্যাজিক!

মৃণাল লন্ডনে ভাস্করের প্রতিবেশি। সে জানাল যে ভাস্কর শুধু ওমলেট ছাড়া আর কিছু রান্না করতে জানে, এমন কখনও শোনা যায়নি। ভিক্টোরিয়া কখনও দেশে গেলে ভাস্কর যাতে দিনের পর দিন শুধু টোস্ট আর ওমলেট খেয়ে না কাটায়, সেইজন্য তার প্রতিবেশীরা তাকে প্রত্যেক দিন নেমন্তন্ন করে।

আমিও ভাস্করের বানানো ওমলেট ছাড়া অন্য কিছু কখনও খাইনি। কিছু একটা মাংস আমিও বেঁধে ফেলতে পারি, অসীম কিংবা মৃণালও ভালোই রান্না জানে। কিন্তু অসীম জেদ ধরে আছে, ভাস্করকেই রাঁধতে হবে। কারণ, ভাস্কর আগ বাড়িয়ে হোটেলের মালিককে নেমন্তন্ন করতে গেল কেন? কোথায় হোটেলের মালিক আমাদের খাওয়াবে, তা নয়, এ যে উলটো!

ভাস্করের বক্তব্য এই যে, বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে তোকজনের সঙ্গে মেলামেশা না করলে  লাভ কী? আর হোটেলের মালিক যখন কবি, তখন তার সঙ্গে আড্ডা মারা বিশেষ দরকার। তা ছাড়া, আমরা একবার খাওয়ালে পরদিন হোটেলের মালিকও নিশ্চয়ই আমাদের ভোজ দেবে। নতুন ধরনের কর্সিকান রান্না খাওয়া যাবে!

আমি চুপিচুপি ভাস্করকে বললেন, এখানে একটা গ্রিক দোকান দেখেছি, চল সেখান থেকে রান্না মাংস কিনে নিয়ে যাই। গ্রিক রান্না আর ভারতীয় রান্না অনেকটা এক রকম।

ভাস্কর ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর না। দ্যাখ না কী করি। আদা চাই, অনেকখানি আদা!

সব সুপার মার্কেটেই আদা পাওয়া যায়। আলু, মাংস, পেঁয়াজ আরও কী সব কিনল ভাস্কর। তারপর ফেরা হল হোটেলে।

হোটেলের তরুণ মালিক লুই একটু লাজুক ধরনের। তার স্ত্রী ইংরেজ, বয়েসে খানিকটা বড়, তাকে দেখলে অভিনেত্রী মনে হয়। সত্যি সে স্টেজে কিছুদিন অভিনয় করেছিল, তার মুখখানা অতিশয় ধারালো। লুই নিজের কবিতা পাঠ করতে লজ্জা পায়, তার কবিতা পড়ে শোনাল তার স্ত্রী। লুই আবৃত্তি করলে বোদলেয়ারের কবিতা। আমরা বসে আছি চওড়া বারান্দায়, আমাদের পায়ের কাছে লুটোচ্ছে চাঁদের আলো।

ভাস্কর রান্নাঘরে গিয়ে বিপুল উদ্যমে রান্না শুরু করে দিল। মাঝে মাঝেই বাসনপত্র পড়ে যাওয়ার ঝনঝন, ঠনঠনাৎ শব্দ হচ্ছে। ভাস্কর ঘুরে-ঘুরে এসে কবিতা শুনে যাচ্ছে, গেলাসে ওয়াইন ঢেলে রান্নাঘরে গিয়ে খাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে গেলাস ভরতি করতে। যেন রান্নাটা কোনও ব্যাপারই না!

মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে ভাস্কর হাত ধুয়ে এসে বলল, রান্না কমপ্লিট। ভাত, মাংস, সালাড। আমরা সভয়ে পরস্পরের দিকে তাকালাম। অতিথিরা কী বলবে কে জানে!

আমিই প্রথমে খানিকটা মাংস টেস্ট করলাম। তারপর বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সত্যিই তো ম্যাজিক। অপূর্ব সুন্দর স্বাদ হয়েছে। নুন, ঝাল, মশলা সব ঠিকঠাক।

অতিথি দুজনও ধন্য ধন্য করতে লাগল। সেটা যে নিছক ভদ্রতা নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল তাদের খাওয়ার পরিমাণে। কর্সিকান কবিটি তিনবার মাংস চেয়ে নিল। তার ইংরেজ পত্নী বলল, আমরা এত ভালো রাঁধতে জানি না, তবু তোমরা যদি কাল রাত্তিরে আমাদের কাছে এসে খাও, তা হলে ধন্য হব।

মুখে একটা চুরুট দিয়ে ভাস্কর বীরের মতন ভঙ্গিতে হাসল আমাদের দিকে চেয়ে।