১৮. উত্তর কলকাতার টাউন স্কুলে

‘নর্তকীরা নাচে। নাচ
নিজে কখনও নাচে না
নাচের ঠিক কেন্দ্রস্থলে গতিশূন্য হয়ে থাকে নাচ
রণক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে গতিশূন্য হয়ে থাকে যুদ্ধ…’
–জাক ওদিব্যারতি

উত্তর কলকাতার টাউন স্কুলে আমার সহপাঠী ছিল ভাস্কর দত্ত। ক্লাস থ্রি-ফোর থেকে আমরা একসঙ্গে বর্ধিত হয়েছি। কলেজে এসে আমাদের স্ট্রিম আলাদা হয়ে গেল বটে, কিন্তু ভাস্করের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রইল। আমাদের স্কুল-কলেজ জীবনের বন্ধুদের একটা ঘননিবদ্ধ দল ছিল, আশুতোষ ঘোষ, উৎপল রায়চৌধুরী, সত্যময় মুখার্জি এবং আরও কয়েকজন, আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতে যেতাম ভাস্করের বাড়িতে। ভাস্কর কলকাতার বনেদি বাড়ির ছেলে, ওদের বাড়িতে একটা বৈঠকখানা কালচার ছিল। আমরা তাস খেলা কিংবা সাহিত্য-রাজনীতি নিয়ে তর্কাতর্কি করতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, আর মাঝে মাঝেই বাড়ির ভেতর থেকে চা-জলখাবার চলে আসত।

তারপর আমি কৃত্তিবাস পত্রিকা চালানো এবং লেখালেখির জগতে অনেকখানি চলে আসার পর অন্য একটি বন্ধু গোষ্ঠী তৈরি হয়। স্কুল-কলেজের বন্ধুরা কিছুটা দূরে সরে যায় আস্তে আস্তে, তারা যে বার জীবিকাতেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু ভাস্কর এই লেখক-গোষ্ঠীর মধ্যেও মিশে গেল। সে কিন্তু লেখে না। তার ভাষাজ্ঞান ও সাহিত্য-জ্ঞান যথেষ্ট। কবিতার প্রতি তার বিশেষ ভালোবাসা আছে, কিন্তু ইচ্ছে করেই সে লেখালেখির লাইনে একেবারেই এল না। এক সময় ভাস্করের বাড়িটাই ছিল কৃত্তিবাস পত্রিকার অফিস, কাগজ ছাপার ব্যাপারে সে বিশেষ উদ্যোগী, কিন্তু কখনো সে নিজের কবিতা ছাপানোর দুর্বলতা প্রকাশ করেনি। সে আমলে বহু তরুণ লেখক-লেখিকা ভাস্করকে বিশিষ্ট বন্ধু বলে গণ্য করত।

আমাদের ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম লন্ডন গিয়েছিলেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, উচ্চশিক্ষার্থে। তিনি ফিরে এলেন দু’তিন বছরর মধ্যেই। তারপর দৈবাৎ আমি। আমিও সাত রাজ্য ঘুরে ড্যাং ড্যাং করে ফিরে এলাম এক সময়ে। তখন ভাস্কর বলল, তা হলে আমিও একবার বিলেতটা ঘুরে আসি, ওখানে আমার নামে একটা রাস্তা করে আসব। এখানকার চাকরি ছেড়ে ভাস্কর চলে গেল লন্ডনে, তারপর কিছুদিন বাদে সে ডেকে নিল উৎপলকুমার বসুকে। এক সময় উৎপলও প্রত্যাবর্তন করল স্বদেশে, কিন্তু ভাস্করের আর ফেরা হল না।

অনেকদিন ভাস্করের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, কিন্তু যেদিন দেখা হল, মনে হল যেন আগের রাত্রেই এক সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর ছাড়াছাড়ি হয়েছিল। উত্তর কলকাতার সেই আড্ডাবাজ মেজাজটি ভাস্করের অবিকল একই রয়ে গেছে। ওদেশের চাকরিতে অনেক আগে থেকে বলে-কয়ে না রাখলে ছুটি নেওয়া যায় না। কিন্তু ভাস্কর যে-কোনওদিন বলতে পারে, দূর ছাই আজ আর অফিস যাব না! বিলেত-আমেরিকায় পাশ বালিশ বা কোল বালিশ নামে কোনও বস্তু নেই, কিন্তু ভাস্কর পাশ বালিশ, কান বালিশ, পা-বালিশ নিয়ে শোয়। ইংল্যান্ডে তার প্রায় দু’যুগ কেটে গেল, কিন্তু ওদেশের অনেক নিয়মকানুন সে মানে না, মাঝে মাঝে তার মধ্যে থেকে একটা দুরন্ত বালকের রূপ বেরিয়ে আসে।

ভাস্করের স্ত্রীর নাম ভিকটোরিয়া। নতুন কেউ দেখা করতে এসে হয়তো বাইরের ঘরে বসে গল্প করছে, ভাস্কর বলল, আমি ভিকটোরিয়াকে ডাকছি, অমনি সেই লোকটি ভাবে, এই রে, এবারে বুঝি একজন মেমসাহেব আসবে, তার সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলতে হবে! আসলে ভিকটোরিয়া খুবই বাঙালি এবং হুগুলির মেয়ে। ফরসা ফুটফুটে রং বলে তার ঠাকুমা-দিদিমারা তাকে ছোটবেলায় আদর করে রানি ভিকটোরিয়া বলে ডাকত। ভিকটোরিয়া কখনও কিছু খুব রাগ করে বলতে গেলেও হেসে ফেলে, আর সেই জন্যই তার অবাধ্য স্বামীটি যা খুশি করার প্রশ্রয় পায়। ভিকটোরিয়া নিজেও চাকরি করে। ভোরবেলা উঠে তাকে অফিস যেতে হয়, তবু বাড়িতে কোনও অতিথি এলে সে অন্তত দশ রকম ব্যঞ্জন না খাইয়ে ছাড়ে না। ভাস্করের মতে, ভিকটোরিয়া এক-একদিন এত বেশি রান্না করে যে ভাস্করকে হ্যাপোর রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে তোক ডাকতে হয় বাড়িতে এনে খাওয়াবার জন্য। আমরা অবশ্য নিজেরাই দেখেছি, ভাস্কর এক একদিন ভিকটোরিয়াকে কিছু না জানিয়ে বাইরে থেকে গোটা তিরিশেক লোককে বাড়িতে খাওয়ার নেমন্তন্ন করে আসে।

প্যারিস থেকে লন্ডনে এসে ভাস্করদের সঙ্গে হইচই করে কাটানো গেল কয়েকটা দিন। প্যারিসের অসীম রায়ের সঙ্গে ভাস্করের পরিচয় ছিল না, আমাদের সূত্রে যোগাযোগ হল, তারপর থেকে বেশ কয়েক বছর প্যারিসই হল আমাদের আড়ার একটা কেন্দ্র।

সেবারে আমেরিকা ও কানাডায় প্রচুর ঘোরাঘুরি করে দেশে ফিরে আসার কিছুদিন পরই আমি সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিদর্শনের একটা নেমন্তন্ন পেলাম। আশির দশকে এসে হঠাৎ যেন বিশ্বের অনেকগুলি দেশের দরজা খুলে গেল আমার জন্য। কোনওরকম চেষ্টা করতে হয় না। বাড়ি ফিরে নানা রকম চিঠিপত্রের মধ্যে আচমকা এক একখানা বিদেশি আমন্ত্রণপত্র পেয়ে যাই। ভ্রমণ আমার নেশা, সাঁওতাল পরগনা, উড়িষ্যার জঙ্গল, আসামের পাহাড়ে যখন তখন বেড়াতে যেতে আমার যেমন ভালো লাগে, তেমনি পৃথিবীর যে-কোনও অদেখা দেশের ডাক পেলেই আমি লাফিয়ে উঠি। একটা দেশে নেমন্তন্ন পেলে, কাছাকাছি দু-তিনটে দেশ নিজের উদ্যোগে ঘুরে আসি। প্রবল শীত কিংবা চরম গ্রীষ্মেও আমি অকুতোভয়, শূন্যের নীচে চল্লিশ ডিগ্রি ঠান্ডার জায়গাতেও আমি গেছি, আর একবার ইস্তানবুলের এক হোটেলের ঘরে গরমের জ্বালায় আমি এমন ঘামছিলাম, যে মনে হচ্ছিল আমার শরীরের অর্ধেকটাই গলে জল হয়ে যাচ্ছে। বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া জার্মানি, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, এমনকি টার্কি কিংবা কেনিয়া গেলেও মনে হয়, একবার ফ্রান্স ছুঁয়ে গেলে হয় না। আমি এ পর্যন্ত বহু দেশ থেকে আমন্ত্রণ পেলেও ফ্রান্স থেকে কখনও পাইনি, কিন্তু ফ্রান্সেই গেছি সবচেয়ে বেশিবার। মার্গারিট আমাকে প্রথমে ফ্রান্সে নিয়ে গিয়েছিল, সে দেশ এখনও যেন আমাকে চুম্বকের মতো টানে।

রাশিয়া যাওয়ার সময় ভাবলাম, ওদের টিকিটের সঙ্গে সামান্য কিছু জুড়ে দিলেই তো ফ্রান্স ঘুরে আসা যায়। অসীম রায়ের সঙ্গে এর মধ্যে আমার আপনি থেকে তুমি’র সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, তাকে সেই মর্মে চিঠি দিতেই সে উৎসাহের সঙ্গে জানাল, ঠিক আছে, চলে এসো, আমি ছুটি নিয়ে রাখব, গাড়ি করে বেশ দূরে কোথাও বেড়াবার পরিকল্পনা করা যাবে।

সেখান থেকে প্যারিস যাব শুনে রাশিয়াতে বেশ কয়েকজন সাহেব বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত দু -এক মুহূর্ত। যেন চোখে মুখে একটা ঈর্ষার ভাৰ। কেউ কেউ মশকরা করে বলেছিল, প্যারিস যাচ্ছ, দেখো, হারিয়ে যেও না যেন! বী গুড!

মস্কো থেকে প্যারিসে উড়ে এসে দেখি সেখানে আগে থেকেই ভাস্কর বসে আছে, সঙ্গে তার এক বন্ধু মৃণাল চৌধুরী। এই মৃণাল বর্ধমানের এক জমিদার বাড়ির ছেলে, এখন লন্ডনপ্রবাসী; তার স্বভাবে একটুও জমিদারি মেজাজ নেই, অতি বিনীত, ভদ্র ও নির্ভরযোগ্য মানুষ।

প্রথম দুদিন কাটল কোথায়-কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে, সেই আলোচনায়। অনেক ম্যাপ দেখা, অনেক জল্পনা। চারজনের এই দলটির দলপতি কে হবে, তা নিয়ে একটা সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা চলল ভাস্কর আর অসীমের মধ্যে। অসীম গাড়ি চালাবে, নেতৃত্বে তারই কার, কিন্তু যে-কোনও পরিবেশে ভাস্কর তার ব্যক্তিত্ব জাহির করতেই অভ্যস্ত। দেশে থাকতে আমরা যখন ধলভূমগড় কিংবা চাইবাসার দিকে বেড়াতে গেছি, তখন ভাস্করই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলপতি হয়েছে। কিন্তু এখানে মুশকিল এই, ভাস্কর ফরাসি ভাষা একবর্ণ জানে না ফ্রান্সের রাস্তাঘাট সম্পর্কেও তার কোনও ধারণা নেই।

অসীম নির্দেশ দিল বেরুতে হবে খুব ভোরবেলা, শেষ য়াতে উঠে তৈরি হয়ে নিতে হবে সবাইকে। ভাস্কর সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠল, কেন, অত তাড়া কীসের? আমরা প্লেন ধরতে যাচ্ছি না, কোথাও ঠিক সময়ে পৌঁছোবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। এসেছি আরাম করে বেড়াতে হুড়োহুড়ি করতে যাব কেন? ব্রেকফাস্ট ও তিন কাপ চা খেয়ে বেরুব!

আমাদেরও সেরকমই ইচ্ছে, তাই প্রথম রাউন্ডেই হেরে গেল অসীম।

অসীমের বাড়ির গেট ছাড়িয়ে গাড়িটা রাস্তায় পড়ল প্রায় দশটার সময়। চমৎকার রোদ্দুরে ধোওয়া দিন। এসব দেশে রোদ দেখলেই মন মেজাজ ভালো হয়ে যায়। আমি লক্ষ করেছি, রোদ্দুরের সঙ্গে আমার বেশ ভাব আছে, যখন যেদেশে গেছি, রোদ পেয়েছি। এমনকি একবার সুইডেন গিয়েছিলাম অক্টোবর মাসে, সবাই বলেছিল, ওই সময় সুইডেনে সব সময় বৃষ্টি আর কুয়াশা, দিনের বেলাতেও রাস্তা দেখা যায় না, গাড়িগুলো ফগ লাইট জ্বেলে চলে। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমি প্রায় দিন দশেক স্টকহলমে রইলাম, মাঝে মাঝে কয়েক পশলা বৃষ্টি ছাড়া আকাশ পরিষ্কার, দুপুরবেলা ঝকঝকে, সেখানকার অনেকেই বলেছে, এমন নাকি বহু বছর হয়নি। রোদ্দুরের সঙ্গে আমার এমনই বন্ধুত্ব যে দু-দুবার আমি চেরাপুঞ্জি গেছি, একবারও বৃষ্টি দেখিনি!

ঠিক হয়েছে যে, প্যারিস থেকে বেরিয়ে আমরা ফ্রান্সের দক্ষিণ দিকে নেমে যাব। বড় রাস্তা না ধরে, ছোট ছোট রাস্তা দিয়ে যাব গ্রামের পথে, রাত্তির হয়ে গেলে যে জায়গাটা পছন্দ হবে, সেখানে কোনও হোটেলে উঠে পড়ব। দুপুরবেলা রুটি, মাখন, চিজ, সসেজ, পাতে, ওয়াইন আর কিছু ফল কিনে নিয়ে রাস্তার ধারেই কোনও গাছতলায় পিকনিক হবে। রাত্তিরবেলা কোনও রেস্তোরাঁয় গিয়ে টেবিল-চেয়ারে বসে খাওয়া হবে খাঁটি ফরাসি ডিনার।

পশ্চিম দেশগুলিতে গাড়ির ড্রাইভারদের তো বটেই, ড্রাইভারের পাশে যে বসে তাকেও সিট বেল্ট বাঁধতে হয়। আমি ওই জন্য পারতপক্ষে, সামনের সিটে বসি না। অভ্যেস নেই, বলেই সিট বেল্ট বাঁধলে কেমন যেন বন্দি বন্দি লাগে। আমি আগেভাগেই পেছনের দরজা খুলে উঠে বসেছিলাম, মৃণালও আমার সঙ্গে, ভাস্কর অসীমের পাশে। দূরপাল্লার যাত্রায় একজন ন্যাভিগেটর লাগে, ম্যাপ ছাড়া উপায় নেই। ভাস্কর কোলের ওপর একটা ম্যাপ খুলে বসেছে, বাঁ হাতের আঙুলের ফাঁকে একটা চুরুট। সেটা জ্বালানো হয়নি। অসীম রায়ের গাড়িতে চাপতে গেলে কয়েকটা নিয়ম মানতে হয়। অসীম নিজে যদিও একজন স্মোকার, কিন্তু তার গাড়িতে চলন্ত অবস্থায় কেউ সিগারেট খেতে পারবে না। কোনও এক সময় তার গাড়িতে অতি হাওয়ার বেগে কারুর হাত থেকে সিগারেট ছিটকে গিয়ে পড়েছিল অন্য একজনের গায়ে। সেই থেকে তার গাড়িতে সিগারেট নিষিদ্ধ। ভাস্কর নিয়মিত ধূমপান করে না, কিন্তু কখনও কখনও ব্যক্তিত্ব বাড়াবার জন্য সে হাতে একটা জ্বলন্ত সিগার রাখতে ভালোবাসে।

খানিক দূর যাওয়ার পর অসীম জিগ্যেস করল, ভাস্কর, দ্যাখো তো ভাই, সাঁশেরে: কোন দিকে?

ভাস্কর ঝুঁকে পড়ে ম্যাপ দেখতে লাগল।

এক মিনিট যায়, দু-মিনিট যায়, ভাস্কর আর কোনও কথা বলে না।

অসীম অস্থিরভাবে বলল, কী হল? সামনে ক্রসিং আসছে, কোন দিকে যাব?

ভাস্কর বলল, সাশেঁরো, কই ওই নামে তো কোনও জায়গা দেখছি না?

অসীম নিজেই ম্যাপটা টেনে নিয়ে একটু দেখে বলল, এই তো। এটা কী?

ভাস্কর বলল, এটা আমি আগেই দেখেছি। কিন্তু এটা তো সেইন্ট চেরন।

অসীম বলল, এটা ইংল্যান্ড নয়। মনে রাখবে, সেন্ট ফরাসিতে হয় সাঁ, আর সিএইচ এর উচ্চারণ শ।

ভাস্কর বলল, আর যেখানে সেখানে একটা করে চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে দিলেই হয়, তাই তো!

অসীম ভাস্করের দিকে করুণার চোখে তাকাল। যেন ভাস্কর একটি অবোধ শিশু। আরও খানিকটা বাদে অসীম আবার জিগ্যেস করল, ভাস্কর, চট করে দেখো তো, শারতর ডান দিকে, না বাঁ দিকে।

ভাস্কর আবার গভীর মনোযোগের সঙ্গে মানচিত্র দেখতে লাগল। সম্পূর্ণ নিঃশব্দ।

অসীম তাড়া দিয়ে বলল, ম্যাপটা ভালো করে দ্যাখো। তোমাকে সামনে বসিয়েছি কী জন্য?

ভাস্কর বলল, দূর ছাই, এই ম্যাপে নেই, অন্য ম্যাপে আছে বোধহয়।

অসীম ম্যাপটা নিয়ে আঙুল দেখিয়ে বলল, এই যে এত বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে, তাও দেখতে পাচ্ছ না!

ভাস্কর বলল, এটা তো দেখছি চারট্রেস!

অসীম বলল, একটু আগেই বললুম, সি-এইচ হবে শ!

ভাস্কর বলল, শারট্রেস! কিন্তু তুমি যে জাঁ পল সার্ত্রর না কী যেন বললে!

অসীম বলল, ওঃ! এত বছর ইংলন্ডে রইলে ভাস্কর, সামান্য একটু ফরাসিও কী শেখোনি?

ভাস্কর উস্মার সঙ্গে বলল, কী দুঃখে শিখতে যাব? এ দেশে স্ট্রিট সাইনের কোনও মাথামুণ্ডু নেই, আগে থেকে কিছু বোঝা যায় না। এদেশের উচিত ইংল্যান্ডে গিয়ে শিখে আসা। আমাদের ওখানে যে-কোনও মোড়ের দশ মাইল আগে থেকে সব রাস্তা দেখিয়ে দেয়, চোখ বুজে গাড়ি চালানো যায়। আর এদেশের ড্রাইভারগুলোও তো দেখছি গাড়লের মতন গাড়ি চালায়, কেউ কারুকে রাস্তা ছাড়ে না।

অসীম এ কথায় একটও রাগ না করে হো-হো করে হেসে উঠে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাস্করকে খুব জব্দ করা গেছে, অ্যা। এখানে গাড়ি থামিয়ে একটা বিড়ি খেয়ে নেওয়া যাক।

গাড়ি থামতেই ভাস্কর দরজা খুলে বলল, আমি পেছনে বসব, মৃণাল ভালো ন্যাভিগেটর হতে পারব।

পেছনের সিটে আসা মানেই নেতৃত্বপদ থেকে ভাস্করের পতন।

আধ ঘণ্টাটাক মনমরা হয়ে রইল ভাস্কর। তারপর হঠাৎই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল তার ব্যক্তিত্ব। বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাস্কর বলল, বাঃ, এই জায়গাটা বেশ সুন্দর তো। দারুণ সবুজ! অসীম, আমরা এখানেই কোথাও থেমে দুপুরের খাবার

অসীম বলল, আর একটু এগিয়ে যাই, সামনে আরও ভালো জায়গা পাওয়া যাবে!

ভাস্কর বলল, এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এখানে গাড়ি থামাও! ওই তো সামনেই একটা খাবার-দাবারের দোকান আছে দেখতে পাচ্ছ না!

খানিকক্ষণ তর্ক-বিতর্কের পর অসীমকে মেনে নিতেই হল, ভাস্করের জয় হল।

জায়গাটা খুবই নিরিবিলি এবং সুন্দর। একটু দূরেই মাঝারি ধরনের একটা সুপার মার্কেট, পাশে একটা পেট্রোল পাম্প। পথে একটা জলাশয় দেখে এসেছি, এখান থেকে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে গিয়ে আমরা সেই জলাশয়ের ধারে পিকনিকে বসব।

বাজার করার ভার ভাস্কর আর মৃণালের ওপর, ওরা চলে গেল দোকানে। অসীম পেট্রোল পাম্পে গেল কিছু একটা দেখাতে। দলের মধ্যে আমিই বলতে গেলে নিষ্কর্মা।

এক প্যাকেট সিগারেট কেনার জন্য একটা কাফের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও আমি রাস্তার ধারে জায়গাটার নাম দেখে থমকে দাঁড়ালাম। জায়গাটার নাম লুদ। লুদাঁ? এই নাম যে আমার খুব চেনা। এই নামে কি একাধিক জায়গা থাকতে পারে? আর একটা বড় রোড সাইন দেখলাম, এই জেলার নাম পোয়াতিয়ে। আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। পোয়াতিয়ে জেলার দাঁ, এটাই তো মার্গারিটের গ্রাম! কী অদ্ভুত যোগাযোগ, এই লুদ তেই আমাদের গাড়ি থামল।

সুপার মার্কেটের সামনে কিছু নারী-পুরুষ যাতায়াত করছে। ওদের মধ্যে মার্গারিট থাকতে পারে না? একজন মহিলা দোকান থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলছেন, অনেকটা মার্গারিটের মতনই তো দেখতে। এখানে হঠাৎ মার্গারিটের দেখা পাওয়া একেবারেই কি অসম্ভব?

পল এঙ্গেল দ্বিতীয়বার যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন তিনি মার্গারিটের পুরো খবর প্রথমে কিছুতেই বলতে চাননি। একদিন আমি পল এঙ্গেলকে গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারে একটা বাংলা সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ইংরিজি সাব টাইটেল ছিল। কিন্তু এমনই অদৃষ্ট, কিছুতেই সেই ফিলমটা পুরো দেখানো গেল না। তখন কলকাতা শহরে লোডশেডিং নামে ব্যাপারটা সবে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসেছে, সিনেমা দেখতে-দেখতে তিনবার আলো নিভল আর জ্বলল, তারপর মাঝামাঝি জায়গায় এসে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল।

সেখান থেকে বেরিয়ে ঘুটঘুঁটে কালো রাস্তা দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম গড়িয়াহাট ব্রিজের দিকে। এক সময় আমি ওঁর হাত চেপে ধরে বললাম, পল, সত্যি করে বলো তো, মার্গারিটের কী হয়েছে? যতই মর্মান্তিক হোক আমি শুনতে চাই। তুমি বলো!

পল এঙ্গেল তবু খানিকটা দ্বিধা করে বললেন, আমি ঠিক জানি না, যতটা শুনেছি, খুবই দুঃখের ব্যাপার, তুমি তো জানো, মেয়েটি কত সরল ছিল! একদিন সন্ধেবেলা সে কোনও একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, এমন সময় তার পাশে একটা গাড়ি থামে। কয়েকজন কালোলোক ছিল সেই গাড়িতে, খুব সম্ভব নেশাগ্রস্ত। তারা মার্গারিটকে একটা ঠিকানার কথা জিগ্যেস করে, তারপর সেই জায়গাটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য মার্গারিটকে গাড়িতে তুলে নেয়। ওইরকম অবস্থায় কোনও মেয়েরই অপরিচিতদের গাড়িতে ওঠা উচিত নয়! কিন্তু মার্গারিট ওদের বিশ্বাস করেছিল। ওরা সেই বিশ্বাসের মূল্য দেয়নি।

আমি প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিগ্যেস করেছিলাম, তারপর?

পল এঙ্গেল বলেছিলেন, তারপর আর কিছু নেই। সেই থেকে মার্গারিট অদৃশ্য হয়ে যায়। ওই লোকগুলি খুব সম্ভবত মেয়েটিকে

আমি বললাম, কেন? এমন হতে পারে না, ওদের মধ্যে কোনও একজন নিগ্রোকে, মানে, কালো লোককে ওর পছন্দ হয়ে গেছে, তাকে বিয়ে করে মার্গারিট ওদের সঙ্গেই কোথাও আছে?

পল এঙ্গেল বললেন, সেটা খুবই আনলাইকলি। কোনও শ্বেতাঙ্গ মেয়ের পক্ষে একজন কালোলোককে বিয়ে করা এমন কিছু অভিনব ব্যাপার নয়। আজকাল অনেকেই তো করে। সেরকম হলে ওরা গোপন রাখবে কেন? মার্গারিট তার বন্ধু-বান্ধবদের এটা নিশ্চয়ই জানাত। না, সুনীল, আমার মনে হয়, সে আর নেই।

আমি তবু জোর দিয়ে বলেছিলাম, পুলিশ তার খোঁজ করেনি? পুলিশ কিছু জানতে পারেনি?

পল এঙ্গেল বললেন, পুলিশ অনেক তোলপাড় করেছে, খবরের কাগজে তিন চারদিন হইচই হয়েছে। কিন্তু মার্গারিটের শরীরটাও পাওয়া যায়নি। সে অদৃশ্য হয়ে গেছে, বললাম না?

একটু থেমে পল এঙ্গেল বললেন, এসবই আমার শোনা কথা। আমার ভুলও হতে পারে।

এরকম দুঃসংবাদ কেউ ভুল শোনে না। তা ছাড়া ঘটনাটা মার্গারিটের চরিত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। আমেরিকায় কালো মানুষরা নিপীড়িত ও নির্যাতিত বলে তাদের প্রতি মার্গারিটের বেশি বেশি সহানুভূতি ছিল, সে আগ বাড়িয়ে তাদের উপকার করতে যেত। কিন্তু তাদের মধ্যে মাতাল, গুণ্ডা খুনিও তো কম নয়। শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের সর্বনাশ করতেও তারা অনেকে উৎসুক। আয়ওয়াতে আমার একদিনের ঘটনা মনে আছে। মার্গারিট তিনজন দৈত্যাকৃতি কালো মানুষকে নিয়ে এসেছিল। তারা রাস্তায় মার্গারিটকে কোনও একটা কফির দোকানের কথা জিগ্যেস করেছিল, মার্গারিট তাদের কফি খাওয়াতে চায়।

আমার স্পষ্ট মনে হয়েছিল, লোকগুলোর মতলব ভালো ছিল না, তাদের মুখে মদের গন্ধ, চোখে ধূর্ত দৃষ্টি। তারা ভেবেছিল, মার্গারিট একা থাকে, ঘরের মধ্যে আমাকে বসে থাকতে দেখে তারা ঈষৎ বিচলিত হয়েছিল। আমাকে তারা মোটেই পছন্দ করেনি, আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলেনি, ইচ্ছে করলে তারা সেদিন আমাকেও খুন করে রেখে যেতে পারত।

মার্গারিট হারিয়ে গেছে, তার শরীরটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি?

ওরা সাধারণত তাই করে, কোনও চিহ্ন রাখতে চায় না। হয়তো জঙ্গলের মধ্যে কোনও নোংরা ডোবার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে। এরকম বীভৎস কাণ্ড হয়েছিল বলেই কি মার্গারিটের বাবা-মা আমার চিঠির উত্তর দেননি? ওঁরাও কি আর বেঁচে আছেন এতদিন?

এমনও তো হতে পারে, মার্গারিটকে ওরা প্রাণে মারতে পারেনি, মার্গারিটের শরীর বিকৃত, বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে। সেই জন্যই সে চেনাশুনো কারুর সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেনি! তাহলে কি আমাকেও চিঠি লিখবে না? আমার সঙ্গে তো তার শরীরের সম্পর্ক ছিল না!

এই সেই লুদা। মার্গারিট বলেছিল, লুদ একটা গ্রাম, কিন্তু এখন আর তেমন গ্রাম বলে মনে হয় না! সুপার মার্কেট আছে, প্রচুর গাড়ি, তবে গাছপালাও প্রচুর। মার্গারিটের বাড়ির ঠিকানাটাও মনে নেই, লিখেও আনিনি। মার্গারিটের চেহারা যতই বদলে যাক, আমি ঠিক চিনতে পারব। তার কণ্ঠস্বর এখনও আমার কানে বাজে। সুপার মার্কেটের সামনে যেখানে গাড়িগুলি পার্ক করা, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোনও মহিলাকেই মার্গারিটের মতন মনে হয় না, কেউ আমার দিকে তাকায় না। কারুকে গিয়ে মার্গারিট বিষয়ে প্রশ্ন করাটা বোধহয় অতি নাটকীয় হয়ে যাবে!

আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি তত দাঁড়িয়েই আছি। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে যেন একটা গাছ হয়ে যাচ্ছি। এই লুদা গ্রামে এক সময় মার্গারিট খেলা করত, এখানেই সে বালিকা বয়েস থেকে কৈশোরে পৌঁছেছিল। সামনের দিকে একটা চার্চের পাশ দিয়ে ছোট রাস্তা চলে গেছে, এই রাস্তা দিয়ে সে হেঁটেছে বহুবার। এখানকার মেয়ে হয়ে সে কবিতা ও কবিদের এত ভালোবাসতে শিখল কী করে? সব সময় সে একটা শিল্পের ঘোরের মধ্যে থাকত, বাস্তবজ্ঞান ছিল না একেবারেই। এরকম একটা নিষ্পাপ মেয়েকে এই পৃথিবী বাঁচতে দিল না? সত্যিই মার্গারিট একেবারে হারিয়ে গেছে, এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তার শরীরটা আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এখানে অন্য যেসব তরুণীদের দেখছি, তারা কেমন যেন সদা ব্যস্ত, সংসারী ধরনের। কেউ কেউ বেশ রূপসি, কিন্তু কারুকেই মার্গারিটের মতন কাব্য-পাগল মনে হয় না। হঠাৎ কোনও গাড়ির আড়াল থেকে মার্গারিট এসে আমার সামনে দাঁড়াল, মেঘলা রাতের জ্যোৎস্নার মতন হাসল, পৃথিবীতে এমন মিরাকল কি ঘটতে পারে না?

পেছন থেকে ভাস্কর এসে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে আমার ঘোর ভাঙাল।

ভাস্কর মার্গারিটের প্রসঙ্গ কিছুটা জানত। অসীমকে সংক্ষেপে জানালাম।

ভাস্কর বলল, ওদের পদবি ছিল ম্যাতিউ, চলো, লোকদের জিগ্যেস করে ম্যাতিউদের বাড়িতে একবার খোঁজ নেওয়া যাক।

অসীম এর ঘোর বিরুদ্ধে। কুড়ি বছর পরে কোনও মহিলার খোঁজ করতে হঠাৎ তাদের বাড়িতে যাওয়া যায় না। অসীমের দৃঢ় ধারণা, সে মেয়েটি বেঁচে থাকতে পারে না। যদি কোনওক্রমে সে বেঁচেও থাকে, তা হলে ও এতগুলো বছর সে যখন কোনও যোগাযোগ রাখেনি, তখন জোর করে তার সন্ধান করতে যাওয়াও অসভ্যতা!

ভাস্কর তবু বলল, মেয়েটার বাড়ি অন্তত দেখে আসতে দোষ কী? ভাস্কর এগিয়ে গিয়ে একজন বৃদ্ধ লোককে জিগ্যেস করল, এখানে ম্যাতিউ পরিবারের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারেন?

বৃদ্ধটি সাদা চোখে তাকিয়ে রইলেন। ভাস্করের ইংরিজি এক বর্ণ বুঝতে পারেননি।

অসীম বলল, এটা কি একটা পশ্চিমবাংলার গণ্ডগ্রাম? ঠিকানা ছাড়া বাড়ি খোঁজা যায়?

ভাস্কর তবু ছাড়বে না। পেট্রোল পাম্পে গিয়ে টেলিফোন গাইড দেখল। সুদ্যাঁ একটা গ্রাম হলেও এখানে প্রত্যেক বাড়িতে ফোন আছে, গাইডে দেখা গেল ম্যাতিউ নামে দশ এগায়ো জন। তাদের বিভিন্ন ঠিকানা।

অসীম বলল, এখন কি এদের প্রত্যেকের বাড়ি ঘুরে-ঘুরে একটি মেয়ের খোঁজ করা যায়? বিশেষত, মেয়েটি যদি বহুকাল আগে হারিয়ে গিয়ে থাকে,

আমার দিকে তাকিয়ে অসীম বলল, মার্গারিট হঠাৎ তোমাকে চিঠি লেখা বন্ধ করেছিল, এটা অস্বাভাবিক, অন্তত ক্রিসমাস কার্ড পাঠাতই, নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে…

আমি চুপ করে রইলাম। যদি ঠিকানা খুঁজে পাওয়াও যায়, তবু মার্গারিটের বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আমার মন সায় দিচ্ছিল না।

অসীম জোর দিয়ে বলল, আমরা এখানে খাব না। এখানে বসে থাকলে সুনীলের আরও মন খারাপ হবে। চলো ভাস্কর, আমরা আরও এগিয়ে যাই!