১৪. লুভর মিউজিয়ামেরই পাশে

‘কবি যা আবিষ্কার করে, তা সে জমিয়ে রাখে না;
লিখে ফেলার পর দ্রুত সেটা হারিয়ে ফেলে। সেখানেই
তো তার অভিনবত্ব, তার অসীম, এবং তার দুর্যোগ।’
–রেনে শার

লুভর মিউজিয়ামেরই পাশের এক অংশে চলছিল পিয়ের অগুস্ত রেনোয়া’র একক ধারাবাহিক প্রদর্শনী। একজন বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীর এতগুলি ছবি একসঙ্গে দেখার অভিজ্ঞতা অবিস্মরণীয়।

লুভর প্রাসাদের সামনে যে চত্বর, সেখান দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে মার্গারিট বলল, জানো, বাচ্চা বয়েসে রেনোয়া এখানে খেলা করতেন। রেনোয়া ছিলেন গরিবের ছেলে, ওঁর বাবা ছিলেন একজন সাধারণ দর্জি, ওঁরা এই পাড়াতেই থাকতেন। তখন কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে একদিন ওই ছেলেটির আঁকা ছবি লুভর মিউজিয়ামে টাঙানো হবে।

আমার একটু খটকা লাগল। ইমপ্রেশানিস্ট দলের শিল্পীদের মধ্যে রেনোয়া-ই যে সবচেয়ে গরিব ও সাধারণ পরিবার থেকে এসেছিলেন, সেটা আমার জানা ছিল। কিন্তু গরিবরা এই পাড়ায় থাকত কী করে? এই লুভর এককালে ছিল রাজপ্রাসাদ, সেন্য নদীর ধারের এই এলাকাটা প্যারিসের সবচেয়ে বনেদি অংশ, অদূরেই তুইলারির বাগানে আর একটা রাজপ্রসাদ, এর মাঝখানের অংশে তো ধনী রাজকর্মচারীদের থাকবার কথা। ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেসের পাশে গরিবরা থাকে, এটা কি ভাবা যায়?

মার্গারিট বলল, সেটা তুমি ঠিকই ধরেছ। এখানকার বড় বড় বাড়িগুলোতে বড়লোকরা এবং উচ্চপদস্থ অফিসাররাই থাকতেন এক সময়। তারপর ফরাসি সম্রাটরা যখন ভাসাইতে চলে যান, তখন সেইসব লোকেরাও সেখানে গিয়ে আস্তানা গাড়ে। এখানকার বিশাল হ্যগুলি ক্রমশ মেরামতির অভাবে ঝুরঝুরে হয়ে পড়ে। সেগুলি সংস্কারের জন্য অনেক টাকার দরকার। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফ্রান্সের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তখন সেই ভাঙাচুরো বাড়িগুলিতে গরিবরা আশ্রয় নিয়েছিল। যে-কোনও সময় তাদের মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়তে পারত।

রেনোয়া দর্জির ছেলে হয়েও বাবার পেশা নেননি?

না, অল্প বয়সে রেনোয়া ভালো গান গাইতে পারতেন, একটা গির্জায় বাচ্চা গায়কদের সঙ্গে গলা মেলাতেন। সেই গির্জায় কয়ার মাস্টার ছিলেন শার্ল গুনো, তখন তাঁর নাম কেউ জানত না, কিন্তু পরে ‘ফাউস্ট’-এর সুর দিয়ে তিনি বিশ্ববিখ্যাত হন। সেই গুনো এই ছেলেটির মিষ্টি গলার আওয়াজ শুনে তাকে গানের জগতে টানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই বাচ্চা বয়সে তো বটেই, চিরকালই রেনোয়া ছিলেন লাজুক প্রকৃতির, তিনি ওদিকে গেলেন না। জীবিকার জন্য তেরো বছর বয়েসে ইস্কুল ছেড়ে রেনোয়া একটা পোরসিলিনের কারখানায় অ্যাপ্রেনটিস হলেন। তাঁর কাজ হল পোরসিলিনের কাপ-গেলাস পুষ্পদানিতে ছবি আঁকা।

রেনোয়া হয়তো সারা জীবন সেই কাজই করে যেতেন, তাঁর বিশেষ উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, তাঁর মনোভাব ছিল, যেমন চলছে চলুক! কাপ-ডিস-ঘটিতে ছোট ছোট ফুল-পাখি আঁকতেন, দুপুরে লুভর মিউজিয়ামে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখতেন আর নিজের শখে একটু আধটু অয়েল পেইন্টিং-এর চর্চা করতেন। কিন্তু কিছুদিন বাদে সেই পোরসিলিনের কারখানাটা উঠে গেল! তখন ছাপার যুগ চলে এসেছে। প্রত্যেকটা কাপ-গেলাসে আলাদা করে ছবি হাতে আঁকার বদলে, একটা ছবিই হাজার-হাজার কাপ-গেলাসে ছাপার পদ্ধতি চালু হয়েছে। আধুনিক এই সব কারখানার সঙ্গে পুরোনো কারখানাটি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারল না। বেকার হওয়ার পরেই রেনোয়ার সত্যিকারের শিল্পের দিকে ঝোঁক এল।

ভেতরে ঢুকে আমরা রেনোয়ার একেবারে গোড়ার দিকের আঁকা ছবি দেখতে শুরু করলাম। ‘ডায়না’ নামের ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে মার্গারিট বলল, দ্যাখো, এই ছবিটা যখন এঁকেছিলেন, তখন রেনোয়ার বয়েস ছাব্বিশ!

পাথরের ওপর বসে আছে একটি নগ্ন নারী, হাতে ধনুক, পায়ের কাছে একটা মৃত হরিণ। এখনকার বহু বইতে এই ছবিটা থাকে। অথচ তখনকার সরকারি সালে এই ছবিটা প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই প্রত্যাখাত শিল্পীরাই ইমপ্রেশনিস্ট গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন, রেনোয়া ছিলেন তার এক উল্লেখযোগ্য সদস্য।

মার্গারিট বলল, দ্যাখো, এই যে মেয়েটির শরীর, তা একেবারে বাস্তবের কাছাকাছি, এখনকার যে-কোনও মেয়ের মতন। ওঁর আগেকার শিল্পীরা যখন দেব-দেবীর ছবি আঁকতেন, তখন নগ্ন শরীরের চামড়া এত স্পষ্ট করতেন না, খানিকটা আলোছায়া মিশিয়ে দিতেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে যে আকাশ ও গাছ, তা কিন্তু ইমপ্রেশানিস্টদের মতন স্বাভাবিক, উজ্জ্বল রঙের নয়, এ যেন স্টুডিওতে বসে আঁকা গাছ। সুতরাং এটাকে একটা মিশ্র স্টাইলের ছবি বলা যেতে পারে।

আমি জিগ্যেস করলাম, মার্গারিট, তুমি এত সব জানলে কী করে? তুমি কি ছবি সমালোচনার কোনও কোর্স নিয়েছিলে?

মার্গারিট বলল, যাঃ! এ তো ফ্রান্সের সব ছেলেমেয়েই জানে। ছবি চিনতে শেখা আমাদের এখান শিক্ষার একটা অঙ্গ। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের প্রায়ই লুভর মিউজিয়াম ও আরও অনেক মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়।

আমি আমার স্কুল-কলেজ জীবনে ছবি সম্পর্কে কিছুই শিখিনি। আমাদের ওসব পাটই নেই। কৃত্তিবাস পত্রিকাকে ঘিরে আমরা যখন কবিতা নিয়ে মাতামাতি শুরু করি, তখন আস্তে আস্তে তরুণ শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ হয়। নিখিল বিশ্বাস, যোগেন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার, সুনীল দাস, রবীন মণ্ডল, বিজন চৌধুরী, শর্বরী রায়চৌধুরী, মাধব ভট্টাচার্য চারু খান, ব্রজগোপাল, সনৎ কর, সদা-বিদ্রোহী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। তখন কিছু ছবি দেখেছি, সেই সুবাদে দু-চারটে বইটইও পড়েছি।

আমি বিদ্যে ফলাবার জন্য বললাম, আচ্ছা, মার্গারিট, রেনোয়ার আঁকা নারীমূর্তিগুলির মধ্যে খানিকটা রুবেনস-এর প্রভাব নেই।

মার্গারিট উৎসাহের সঙ্গে বলল, ঠিক বলেছ তো! রেনোয়া বলতে গেলে সারাজীবনই টিশিয়ান আর রুবেনস-এর মতন আগেকার মাস্টারদের প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। অথচ মজার ব্যাপার এই, রেনোয়া’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্লদ মোনে ওঁদের একেবারেই পছন্দ করতেন না। মোনে এঁকেছেন উজ্জ্বল আলো ও রং দিয়ে প্রকৃতির ছবি, যে-রকম আগে কেউ আঁকেনি। সেই হিসেবে রেনোয়াকে পুরোপুরি ইমপ্রেশানিস্ট বলাও যায় না। উনি নিজেই এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন এক সময়, সেটা অবশ্য স্বার্থপর কারণে।

হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে, গলার সুর বদল করে মার্গারিট বলল, আমাকে তাড়াতাড়ি আমেরিকায় ফিরতেই হবে। না হলে পরের সেমেস্টারে পড়াবার কাজটা পাব না। তুমি আমার সঙ্গে যাবে না, সুনীল?

আমি বললাম, কী করে যাব? আমি যে টিকিট খরচ করে ফেলেছি। আবার টিকিট কাটার টাকা কোথায় পাব?

মার্গারিট গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, আমি একা ফিরে যাব? আয়ওয়াতে আমি একা থাকব?

আমি খানিকটা দূরে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, তুমি রেনোয়া-কে স্বার্থপর বললে কেন? এই ছবিটা, এই যে একটা পোট্রেট, এই মহিলা কে?

মার্গারিটের মন অমনি আবার ছবির দিকে ঘুরে গেল। আমার পাশে এসে বলল, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই সব শিল্পীদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সে তখন রাজনৈতিক গোলযোগ চলছে, ছবি কেনার লোকও খুব কম, আর এই তরুণ শিল্পীদের তত কেউ পাত্তাই দিত না। মাঝে মাঝে এরা খেতে পেত না পর্যন্ত, তার চেয়েও সাংঘাতিক কথা, এদের রং-তুলি ক্যানভাস কেনার পয়সা পর্যন্ত জুটত না। তুমি ভাবো তো, সুনীল, শিল্পের জন্য এরা আর সব কিছু ছেড়ে এসেছে, অথচ ছবিও আঁকতে পারছে। রেনোয়া এক একদিন তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে রুটি চেয়ে নিয়ে গিয়ে তার বন্ধু ক্লদ মোনে-কে খাওয়াত।

সাত-এর দশকে রেনোয়া অনেকটা পয়সার জন্যই পোট্রেট আঁকার দিকে ঝুঁকে পড়েন। সরকারি সাঁলোতে ছবি টাঙালে তবু খানিকটা পরিচিতি হবে, ছবি বিক্রির সম্ভাবনা দেখা দেবে, সেই জন্য রেনোয়া তাঁর বন্ধু ইমপ্রেশানিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আবার সরকারি উদ্যোগে বাৎসরিক প্রতিযোগিতায় ছবি জমা দিতে লাগলেন। তিনি তাঁর বন্ধুদের আন্দোলনের সঙ্গে খানিকটা বিশ্বাসঘাতকতাই করেছিলেন বলা যায়। রেনোয়া স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন, আমি সরকারি সালোতে ছবি দিচ্ছি নিছক ব্যাবসাগত করণে। সরকারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না!

এই যে চমৎকার পোট্রেটখানা দেখছ, এটা মাদাম সারপেতিয়ের, কী রকম গর্বিত মুখখানা, একবার দেখো! ইনি কে জানো? তখনকার দিনের বিখ্যাত প্রকাশক জর্জ সারপানতিয়ের স্ত্রী। এই মহিলা ছিলেন সেকালের একজন বিখ্যাত হস্টেস, প্যারিসের সমাজের মধ্যমণি হতে চেয়েছিলেন। তুমি এই ধরনের ফরাসি রমনিদের কথা নিশ্চয়ই শুনেছ? এঁরা এঁদের বাড়ির বৈঠকখানায় বিখ্যাত সব লেখক-শিল্পীদের নিয়মিত আপ্যায়ন করতেন। ফরাসি দেশের একটা ট্র্যাডিশন। গরিব শিল্পী রেনোয়া ভিড়ে গেলেন এই উচ্চবিত্ত সমাজে, এই সব নারী-পুরুষদের মুখচ্ছবি এঁকে তাঁর অবস্থা খানিকটা ফিরল। তিনি ফ্যাশনেবল পোট্রেট শিল্পী হিসেবে পরিচিত পেলেন, তবু অতৃপ্তি ছিল তাঁর মনে। এই সময় তিনি ঘুরে বেড়ালেন কিছুটা, দেখলেন আলজিরিয়া, ইতালি; আলজিরিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি আঁকলেন বিরাট ক্যানভাসে আলজিরিয়ায় মুসলমান উৎসব’ কিংবা ‘আলজিরিয়ানদের সাজে ফরাসি রমণীরা’।

আমি জিগ্যেস করলাম, রেনোয়া যে এত নগ্ন নারীদের ছবি এঁকেছিলেন, সেগুলোও বিক্রি হত না?

মার্গারিট হেসে ফেলে বলল, ফরাসিরা সবাই তো নগ্ন মেয়ে আঁকে। তাতে তার আলাদা আকর্ষণ কী আছে? ছবিটা কেমন, সেটাই বড় কথা। আসলে কী জানো, রেনোয়ার যখন চল্লিশ বছর বয়েস, তখন তিনি আলিন শারিগো নামে একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আমার মতে, সেই মেয়েটিকে নিয়ে তিনি যে ছবিগুলো এঁকেছিলেন, সেইসব নারী-প্রতিকৃতির মধ্যেই সত্যিকারের একটা আলাদা ব্যাপার আছে।

আমি বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাঁর পরের দিকের অনেক ছবিতেই একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি। খুব বাচ্চা নয়, সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। যেমন, ‘বাগানে দুটি মেয়ে’, ‘তরুণী স্নানার্থিনী’, কিংবা ‘কিশোরী মেয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।’ সব তো একই মডেল মনে হয়।

মার্গারিট বলল, মেয়েটি তেমন সুন্দরী নয়, নাকটা একটু বোঁচা, চোখ দুটো বেড়ালের মতন, কিন্তু মুখে কি স্বর্গীয় সারল্য, নগ্ন হলেও মনে হয়, এখনও জানে না কুমারীত্ব ভঙ্গ করা কী ব্যাপার। রেনোয়া অবশ্য পরে এই মেয়েটিকে বিয়ে করেছিলেন।

আমি বললাম, মার্গারিট, তোমার নাক বোঁচা নয়, চোখ দুটো বেড়ালের মতন নয়, তবু এই মেয়েটির মুখের আভার সঙ্গে তোমার মুখের মিল আছে।

মার্গারিট আমার স্তুতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, আমাকে যদি দু-চারদিনের মধ্যেই আমেরিকায় চলে যেতে হয়, তাহলে তোমাকে প্যারিস কিংবা ফ্রান্সের অন্যান্য জায়গা কে দেখাবে?

আমি বললাম, তুমি চলে গেলে আমার তো এখানে আর থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমিও ফিরে যাব।

মার্গারিট তবু অবুঝের মতন প্রশ্ন করল, কোথায় ফিরে যাবে?

আমি বললাম, আমার ফিরে যাওয়ার একমাত্র জায়গা আমার দেশে। তা ছাড়া আর কোথায় যাব বলো!

মার্গারিট বলল, কলকাতায়? আর আমি যাব আয়ওয়া-তে, মাঝখানে বিশাল দূরত্ব, আমি থাকব কী করে, সুনীল?

এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই বলেই আমি পালটা প্রশ্ন করলাম, পিয়ের অগুস্ত রেনোয়া অনেকদিন বেঁচে ছিলেন, তাই না? শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের ছবির সমাদর দেখে গিয়েছিলেন?

মার্গারিট পরে আছে একটা গোলাপি রঙের ড্রেস। বুকের কাছে ফ্রিল দেওয়া। শীত নেই বলে ও প্যান্টি হোস পরে না, নগ্ন পা। চুলগুলো যথারীতি এলোমেলো, দু’ চোখে সব সময় পাখির মতো বিস্ময়।

রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে ও একটু সময় নিল। তারপর বলল, হ্যাঁ, রেনোয়া বেঁচে ছিলেন অনেকদিন, শেষ বয়সে ভোগ করেছেন খ্যাতি, সেই দর্জির ছেলে অনেক টাকা পয়সা পেয়েছিলেন, বাড়ি কিনেছিলেন সাউথ অফ ফ্রান্সে। কিন্তু কষ্টও পেয়েছেন খুব। একবার সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিলেন, তার থেকে আর্থারাইটিস আর প্রচণ্ড বাত হয়ে যায়। ডান হাত নাড়তে পারতেন না ভালো করে। কিন্তু ছবি আঁকার নেশা ছাড়তে পারেননি কিছুতেই। আঙুল অচল, তবু ডান হাতে একটা ব্রাশ বেঁধে নিয়ে আঁকতেন ছবি, যন্ত্রণায় তাঁর মুখ কুঁকড়ে যেত, তবু থামতেন না। একবার নাকি একজন কে বলেছিলেন, যথেষ্ট তো হয়েছে, অনেক ছবি রেখে যাচ্ছেন। এখন এত কষ্ট পাচ্ছেন, আর আঁকার কী দরকার? রেনোয়া এর উত্তরে বলেছিলেন, সব যন্ত্রণাই এক সময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু শিল্প থাকে।

দ্যাখো, তাঁর মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে আঁকা স্নানার্থিনীদের আর একটা বড় ছবি। ১৯১৮ সালে, রেনোয়া তখন খুবই অসুস্থ, তাঁর ছেলে যুদ্ধে সাংঘাতিভাবে আহত হয়েছে, কিন্তু এই ছবিতে কি সেই সব কষ্টের কোনও চিহ্ন আছে?

একজন মাত্র শিল্পীর এই প্রদর্শনী আমরা দেখেছিলাম প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় ধরে। মাঝখানে একবার খাবার জন্য বেরিয়ে আবার ফিরে এসেছি। এইরকমভাবে যে প্রতিটি ছবির কাছে বারবার ফিরে আসতে হয়, তার ফলে সেই ছবি মনের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়, তা আমার আগে জানা ছিল না। একটুও ক্লান্ত বোধ করিনি, সে কি মার্গারিটের সাহচর্যের জন্য? এ কথা ঠিক, একা হলে এতক্ষণ ধরে ছবি দেখার ধৈর্য আমার থাকত না।

মোট তিনদিন লুভর মিউজিয়ামে গেছি, কিন্তু আমি বিশ্ববিখ্যাত ‘মোনালিসা’ দেখিনি। অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য। মার্গারিট আমাকে দেখতে দেয়নি। যাবতীয় টুরিস্টরা লুভর মিউজিয়ামে এসেই ‘মোনালিসা’ দেখার জন্য পিঁপড়ের মতো সারি দিয়ে ছোটে, এটা মার্গারিট সহ্য করতে পারে না। ‘মোনালিসা’ ছবিটার ওপর ওর কোনও রাগ নেই, কিন্তু দর্শকদের এই গ্রাম্যপনা তার দু’চক্ষের বিষ। ইতালিয়ান ছবির অন্য ঘরগুলি ভালো করে দেখলে কি লিওনার্দোর ওই একটি ছবির মর্ম বোঝা যায়? দূর থেকে কয়েকবারই দেখেছি, ‘মোনালিসা’ ছবির সামনেই সব সময় সাংঘাতিক ভিড়।

মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে খানিকবাদে আমরা গেলাম ‘শেকসপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি নামে বইয়ের দোকানটি দেখতে। তেমন বড় কিছু দোকান নয়, কিন্তু ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। এখানে এক সময় আসতেন বিখ্যাত সব লেখকরা। শিল্পীদের মতনই এক সময় দেশ-বিদেশের লেখকরাও এসে জমায়েত হতেন প্যারিসে। লিখতেন অন্য ভাষায়, কিন্তু এই মোহময়ী নগরীর পরিমণ্ডল তাঁদের প্রেরণা জোগাত। শোনা যায়, এই দোকানে বসেই আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও তাঁর বন্ধুদের সম্পর্কে গারট্রুড বলেছিলেন, ইউ আর আ লস্ট জেনারেশান!

নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে আমরা নতরদাম গির্জার চাতালে এসে বসলাম। ঘড়িতে সন্ধে সাতটা, কিন্তু আকাশ ঝকঝকে নীল, গির্জার চূড়ায় যে বিশাল ঘণ্টাটি ধরে কোয়াসিমোদো দুলেছিল, সেটার ওপর ঠিকরে পড়েছে রোদ। এখানে শরৎকালে অন্ধকার বেশ দেরিতে নামে।

আমরা প্রতিদিনের আবহাওয়া নিয়ে মাথা ঘামাই না। কিন্তু পশ্চিম দেশের এরা নির্মল আকাশ, রোদ-ঝলমলে দিন ও শীতহীন বাতাস পেলে ছেলেমানুষের মতন উল্লসিত হয়, সেই আনন্দ সারা শরীরে উপভোগ করে।

মার্গারিট বলল, এখন প্যারিসের দিনগুলো চমৎকার, এর মধ্যে আমেরিকা চলে যাওয়ার কোনও মানে হয়? আচ্ছা সুনীল, আমি যদি না যাই? একটা সেমেস্টার আমার পড়াশুনো আর পড়ানো বাদ দিলে কী হয়? তা হলে আমরা দুজনে আরও ভালো করে প্যারিস দেখতে পারব, তোমাকে নিয়ে নরমান্ডি যাব, লোয়ার নদীর উপত্যকার অনেক ভালো ভালো সাড়তা দেখাব!

আমি বললাম, তুমি একটা সেমেস্টার ছেড়ে দেবে? এই চার-পাঁচ মাস আমি ফ্রান্সে থাকব? টাকা পাব কোথায়?

মার্গারিট বলল, তোমার অত টাকার চিন্তা বারবার দরকার কী? ও ঠিক জুটে যাবে! এমন সোনালি রোদের দিনগুলো ছেড়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

আমি বললাম, আয়ওয়া-তে এই সময় ঝকঝকে রোদ পাবে!

মার্গারিট রেগে গিয়ে বলল, আমেরিকার রোদ আর প্যারিসের রোদ কি এক? এখানকার রোদের আলাদা রং, আলাদা গন্ধ, তুমি টের পাও না?

আমি সিগারেট ধরাবার ছলে খানিকটা সময় নিয়ে বললাম, ভালো কথা মনে পড়েছে। আচ্ছা মার্গারিট, সেদিন মোনিকের বাড়িতে রাত্তিরে আড্ডায় আমি জিগ্যেস করেছিলাম, সে যুগের কবি-সাহিত্যিকরা যে সব তরুণ শিল্পী পরীক্ষামূলক ছবি আঁকছে, স্টুডিও ছেড়ে চলে যাচ্ছে প্রকৃতির মধ্যে, রঙের মধ্যে রং না মিশিয়ে উজ্জ্বলতা আনছে, তাদের সাহায্য করেছিলেন কি না। আমি ভিক্তর হুগো’র নাম করতেই পিয়ের হো-হো করে হেসে উঠল। তুমি আর মোনিক-ও হাসছিল। কেন? তোমরা ভিক্তর হুগোকে বড় লেখক মনে করো না?

মার্গারিট হেসে বলল, ‘অবশ্যই য়ুগো খুব বড় লেখক। তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্ব ফরাসি সাহিত্যের অনেকখানি জুড়ে আছে। কিন্তু তুমি যে-সময়টার কথা বললে, সেই সময়টায় য়ুগো নানারকম পাগলামি করছিলেন। সে খুব মজার ব্যাপার।

কী ধরনের পাগলামি?

তখন ফোটোগ্রাফ চালু হয়ে গেছে। ভিকতর যুগোর সেই সময়কার একটা ছবি পাওয়া যায়, চিন্তাচ্ছন্ন মুখে বসে আছেন। তিনি নিজেই সেই ছবির তলায় ক্যাপশান লিখেছিলেন, ‘ভিকতর যুগো ঈশ্বরের সঙ্গে সংলাপরত’। তিনি খুব প্ল্যানচেট করতেন তা জানো? একবার নাকি স্বয়ং মৃত্যু এসে দেখা দিয়ে যুগো-কে একটা নতুন লেখার নির্দেশ দিয়েছিল। য়ুগো নিজেকে যিশুর মতন একজন অবতার বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন। ভয়ংকর আত্মম্ভরিতা তাঁকে পেয়ে বসেছিল, নিজেই নিজের নতুন নাম দিয়েছিলেন ‘ওলিমপিয়ো’।

তুমি প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করো?

ধ্যাৎ, ওসব বাজে ব্যাপার। কোনও খাঁটি ক্যাথলিক এই সব হেরাসি মানতে পারে না। য়ুগোর তখন মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওঁর ছেলে শার্ল হত মিডিয়াম, সে সাহিত্য টাহিত্যর ধার ধারত না, কিন্তু প্ল্যানচেটের সময় সে নাকি গড় গড় করে য়ুগোর মতন নতুন কবিতা বলে যেত। এই প্ল্যানচেটের সময় শেকসপিয়র আসতেন বারবার।

তাই নাকি? শেকসপিয়র কী ভাষায় কথা বলতেন হুগোর সঙ্গে?

অবশ্যই ফরাসিতে। কারণ য়ুগো কিংবা শার্ল কেউই ইংরিজি জানত না। শেকসপীয়র মৃত্যুর পর ফরাসি ভাষা শিখে নিয়েছিলেন ধরে নিতে হবে।

শেকসপিয়র সূক্ষ্ম শরীরে এসে এই ফরাসি লেখককে কী বলতেন, তার কোনও রেকর্ড আছে?

সেইটার জন্যই তো সবাই হাসে। শেকসপিয়র এসে দারুণ প্রশংসা করতেন য়ুগো’র লেখার। একদিন বলেছিলেন, যুগোর নতুন লেখা পৃথিবীতে প্রকাশিত হলেই স্বর্গে সব লেখকরা সেই রচনা সম্পর্কে দারুণ কৌতূহলী হয়ে পড়েন। শেকসপিয়র সেটা পাঠ করেন জোরে জোরে, অন্যরা তাঁকে ঘিরে বসে শোনেন। একদিন দান্তে কেঁদে ফেলেছিলেন প্রেমের বর্ণনা শুনে, ইসকিলাস আবেগে কাঁপছিলেন, আর সারভেনতিস আঙুল তুলে মলিয়ের-কে বলেছিলেন, এই, চুপ করো, শুনতে দাও! বুঝে দ্যাখ্যো কাণ্ড! শেকসপীয়র নাকি জানিয়েছিলেন, পৃথিবীতে তাঁর পর ভিক্তর য়ুগোই সবচেয়ে বড় কবি!

বিখ্যাত লেখকদের খামখেয়ালিপনার গল্প শুনতে-শুনতে আমিও হাসতে লাগলাম।

হঠাৎ মার্গারিট জিগ্যেস করল, আচ্ছা সুনীল, তোমাদের কলকাতায় এই সময় ভালো রোদ ওঠে?

আমি বললাম, আমাদের দেশে আর যত কিছুরই অভাব থাকুক, রোদ্দুরের কোনও অভাব নেই। সারা বছরই রোদ।

আমি আমেরিকায় না গিয়ে, তোমার সঙ্গে কলকাতায় যেতে পারি না?

তা কী করে হবে, মার্গারিট। তোমার পি-এইচ-ডি শেষ করবে না? তা ছাড়া কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তোমাকে রাখব কোথায়? আমি ফিরে যাচ্ছি বেকার অবস্থায়। এরপর কীভাবে খরচ চালাব তার কোনও ঠিক নেই। আমাদের বাড়িতে এমন জায়গাও নেই যে তোমার জন্য একটা ঘর দিতে পারব। না, মার্গারিট, আমার সঙ্গে নিয়ে গেলে তোমাকে বেশ একটা বিপদের মধ্যে ফেলা হবে।

ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেল একটা ধাঁধার মতন। মার্গারিটের আমেরিকায় ফিরে যাওয়া খুবই দরকার, কিন্তু ও আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়, সেটা সম্ভব নয়। মার্গারিট একটা সেমেস্টার নষ্ট করে আরও চার-পাঁচ মাস কাটাতে চায় ফ্রান্সে, কিন্তু আমি অন্যদের গলগ্রহ হয়ে থাকব কী করে? মার্গারিটকে কলকাতায় নিয়ে আসাও একটা অবাস্তব ব্যাপার। তা হলে?

মার্গারিট নতমুখে নরম গলায় বলল, তোমার কলকাতায় ফিরে যাওয়া খুব দরকার, তাই না?

আমি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, আমাকে তো কিছু একটা কাজ করতে হবে? বাংলা ভাষায় লেখালেখি ছাড়া আর আর কোনও কাজ যে আমার ভালো লাগে না। আর কোনও কাজ বোধহয় আমি পারবও না। তোমাকেও পি-এইচ-ডি শেষ করতেই হবে, এটা আমার আদেশ।

পরদিন আমরা প্রায় পাশাপাশি দুটি এয়ার লাইন্স অফিসে আমাদের টিকিট কনফার্মড করতে গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, প্যান অ্যাম এবং এয়ার ফ্রান্স জানাল, দু-জায়গাতেই ঠিক পরের দিন একটা করে সিট খালি আছে, তার পরের দিন দশেকের মধ্যে মার্গারিট সিট পেলেও আমি পাব না। সুতরাং একই দিনে, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আমরা উড়ে যাব সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে, পৃথিবীর দুই প্রান্তে।

সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা দেখতে গেলাম জাক তাতি’র একটা মজার সিনেমা। মসিয়ো হুলোর হলিডে। দুজনে খুব হাসলাম প্রাণ খুলে।

বিমানবন্দরে মার্গারিটের কাছ থেকে আমার বিদায় নেওয়ার দৃশ্যটির বর্ণনা আমি এখানে আর দিতে চাই না।