১৩. এই সেই ব্যাঙ্কুইট হল

‘বেলাভূমির ওপর দরজাগুলি খোলা, দরজাগুলি ভোলা নির্বাসনে
চাবিগুলি রয়েছে লাইট হাউসের লোকদের কাছে
এবং প্রবেশদ্বার পাথরের চক্রের ওপর ভেঙে পড়েছে রোদ
হে বন্ধু, এই বালুকাবেলায় তোমার কাঁচের বাড়িটি আমাকে দিয়ে যাও…’
–সাঁ জন পার্স

এই সেই ব্যাঙ্কুইট হল! কী আশ্চ না, আজ ১ অক্টোবর! আর এক ১ অকটোবরে এই ব্যাঙ্কুইট হলে দারুণ খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল, তারপর থেকেই বলতে গেলে এ দেশের ইতিহাস বদলে গিয়েছিল।

মার্গারিট অতি উৎসাহে, কলস্বরে আমাকে টুকরো টুকরো ইতিহাসের কাহিনি শোনালেও আমি তেমন আগ্রহ বোধ করছিলাম না। ভার্সাই-এর রাজপ্রাসাদ দেখতে এসে খানিক পরেই আমার ক্লান্তি এসে গেল। তার একটা কারণ ভিড়, বড় বেশি ভিড়, আজ ছুটির দিন বলে এখানে গিসগিস করছে মানুষ। এত বড় প্রাসাদটাও ভরতি হয়ে গেছে কয়েক হাজার মানুষে, লাইন করে ঢুকতে হচ্ছে প্রতিটি ঘরে। কোনও কোনও দলের সঙ্গে রয়েছে গাইড, তারা জার্মান-ইটালিয়ান-ইংরিজিতে অনেক কিছু বোঝাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি।

এত ভিড়ের মধ্যেও মার্গারিট ও আমি পরস্পরকে নিয়ে আলাদা হয়ে থাকতে পারতাম। কিন্তু কাল রাত থেকে আমার মেজাজ কিছুটা বিগড়ে গেছে। মানিক তার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিয়েছে, তাই কাল সন্ধেবেলা আমাদের বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে উঠে যেতে হয়েছে মার্গারিটের আর এক বান্ধবী মারি দোমিয়ে’র বাড়িতে। এটা অ্যাপার্টমেন্ট নয়, একটা পুরো বাড়ি, মমার্ত অঞ্চলে। বেশ সুন্দর কাঠের বাড়ি, সামনে একটু বাগান। এই এলাকাটা খানিকটা উঁচু, এখান থেকে প্যারিসের অনেকখানি দেখা যায়। রাত্রের আলো ঝলমল নগরীর রূপ জানলা দিয়েই চোখে পড়ে। তবু সে বাড়িতে ঢুকে খানিকক্ষণের মধ্যেই আমার অস্বস্তি হতে লাগল। এখানে একেবারে পারিবারিক আবহাওয়া, মারির স্বামী এবং দুটি ছেলেমেয়ে রয়েছে, এবং একজন বৃদ্ধা, তাঁর পরিচয়টা ঠিক বোঝা গেল না। ছেলেমেয়ে দুটি হস্টেলে থাকে। ছুটিতে এসেছে। মোনিকের বাড়িতে আমরা ছিলাম স্বাধীনভাবে, নিজেরা রান্না করে খেতাম। যত রাত পর্যন্ত ইচ্ছে আড্ডা দিতাম, কিন্তু একটা অপরিচিত সংসারে এসে সেরকম করা যায় না। মারির স্বামী গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, ভদ্রতার অভাব নেই, কিন্তু সে আমাদের এরকম উড়ে এসে জুড়ে বসা পছন্দ করেছে কি না, তা বোঝা দুষ্কর!

মার্গারিটকে আমি বললাম, এখন তো আমি কিছু টাকা পেয়েছি, সস্তার হোটেলে থাকতে পারি। কিন্তু মার্গারিট কিছুতেই রাজি নয়। শুধু মাথা গোঁজার জায়গার জন্য আমার পয়সা খরচ করা চলবে না। এই নিয়ে মার্গারিটের সঙ্গে আমার সামান্য ঝগড়াও হয়ে গেল।

মেজাজটা ভালো নেই বলেই ভালো ভালো জিনিস আজ উপভোগ করতে পারছি না। ভার্সাই প্রাসাদে খানিকক্ষণ ঘোরার পর মনে হল, দূর ছাই, এমনকি আর দেখার আছে, এখানে না এলেও চলত! আজ আমার বারবার দেশের কথা মনে পড়ছে।

মার্গারিট বলল, জানো, ১ অক্টোবর এখানে একটা বিরাট ভোজসভা হয়েছিল। প্যারিসে তখন বাস্তিল কারাগার ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। উন্মত্ত জনতা যাকে তাকে শাস্তি দিয়ে তার ছিন্নমুণ্ড বর্শায় গেঁথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুরু হয়ে গেছে ফরাসি বিপ্লব, রাজতন্ত্র টলমল করছে। ফরাসি দেশের পতাকার রং আগে ছিল সাদা, জনতার ইচ্ছেতেই তাতে তখন যুক্ত হয়েছে লাল ও নীল রং। সম্রাট ষোড়শ লুই সে সময় সপরিবারে রয়েছেন এই ভাসাইতে, বেশ অসহায় অবস্থায়। এরই মধ্যে একটি সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী এসে উপস্থিত হল এখানে। তাতেই বিপ্লবের বিরুদ্ধবাদীরা মনে করল, রাজতন্ত্র এর নিরাপদ, সম্রাটের গায়ে কেউ আর হাত দিতে পারবে না। সেনাবাহিনীর অফিসারদের খাতির করার জন্য বিরাট ভোজ হল। রাজা ও রানি দুজনেই সেখানে উপস্থিত। সকলের কাছে বিলোনো হলো সাদা পতাকা। বিপ্লবীদের তেরঙ্গা ঝাণ্ডা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে সবাই হো-হো করতে লাগল।

মার্গারিটকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম, খুব সিগারেট টানতে ইচ্ছে করছে, চলো, এখান থেকে একটু বাইরে যাই।

ভিড় এড়িয়ে আমরা একটা বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। মার্গারিটকে ঐতিহাসিক স্মৃতি পেয়ে বসেছে। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে বাইরের বাগান দেখছ, এইসব জায়গায়, ভার্সাইয়ের সব রাস্তা-ঘাটে সেই পয়সা অকটোবরের পরের এক রাতে শুয়ে ছিল হাজার-হাজার মানুষ। এই রাজবাড়ির ভোজসভার কথা রটে গিয়েছিল প্যারিসে, ওদিকে সেখানে তখন কোনও খাদ্য নেই। বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসে রুটি দাবি করেছিল। অক্টোবরের পাঁচ তারিখে প্যারিসের বিক্ষুব্ধ জনতা ঠিক করল, তারা ভার্সাইয়ে এসে রাজার কাছে বলবে, আমাদের খাদ্য দাও, নইলে তুমি নিপাত যাও!

প্যারিস থেকে হেঁটে চলে এলো সেই বিশাল ক্ষুধার্ত ও ক্রুদ্ধ মানুষের মিছিল। তাদের মধ্যে নারী ছিল কয়েক হাজার। রাজা ষোড়শ লুই প্রত্যেক দিন শিকার করতে যান, সেদিনও শিকার থেকে ফিরে এসে দেখলেন ভার্সাই প্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে মারমুখী জনতা।

আমি জিগ্যেস করলাম, সেইদিনই বুঝি রানি মারি আঁতোয়ানেৎ বলেছিলেন, ওরা রুটি খেতে পাচ্ছে না। তা হলে তার বদলে কেক খায় না কেন?

মার্গারিট চোখ বড় বড় করে বলল, না, না, ও কথাটা ভুল। মারি আঁতোয়ানেৎ কোনওদিনই ও-কথা বলেননি। ও বেচারার নামে ভুল করে ওই কথাটা চলে আসছে।

আমি বললাম, সেদিন এখানে অনেক রক্তপাত হয়েছিল!

মার্গারিট বলল, খুব বেশি হতে পারত। রাজার রক্ষীবাহিনী গুলি চালিয়েছিল, এদিকে বিদ্রোহী জনগণের সংখ্যা প্রায় কুড়ি হাজার, তাদের অনেকেই তো সশস্ত্র। কুড়ি হাজার মানুষকে কি মেরে ফেলা যায়? এর মধ্যে এসে পড়লেন জাতীয় রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার লাফাইয়েৎ। এই লাফাইয়েৎ জনতার চোখে হিরো। আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় ইনি নিজে থেকেই ফ্রান্স থেকে অত দূরে চলে গিয়েছিলেন আমেরিকানদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করতে। লাফাইয়েৎ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করলেন জনতাকে, রাজাও ব্যালকনিতে এসে (এমনও হতে পারে, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকেই) দর্শন দিয়ে রুটি সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

তারপর সবাই ঘুমোতে চলে গেল। ভোররাতের দিকে আবার কয়েকশো লোক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল প্রাসাদের মধ্যে। অতর্কিত অসতর্ক রাজকীয় রক্ষীদের কচুকাটা করতে করতে তারা উঠতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। ওই দ্যাখো, ওই যে রানির ঘর, প্রায় ওই পর্যন্ত এসে পড়েছিল তারা। এবারেও লাফাইয়েৎ এলেন ত্রাণকর্তার ভূমিকায়। প্রায় নিজের প্রাণ বিপন্ন করে দু-পক্ষকে থামালেন। কী রকম এক একটা ইতিহাসের মুহূর্তে ভেবে দ্যাখো। আর একটু দেরি হলেই হয়তো সেই লোকগুলো এই প্রাসাদেই রাজা-রানিকে শেষ করে ফেলত।

পরদিন সকালে দাবি উঠল, শুধু রুটির প্রতিশ্রুতি দিলে হবে না, রাজাকে ভার্সাই ছেড়ে এই জনতার সঙ্গেই প্যারিসে যেতে হবে! রাজা-রানি একবার পালাবার কথা ভেবেও নিরস্ত হলেন। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল, জল-কাদার রাস্তা দিয়ে রাজা সপরিবারে চললেন প্যারিসের দিকে। তাঁর জুড়ি গাড়ির পাশে-পাশে মাঝে-মাঝে দেখা যাচ্ছে এক-একটা লোকের হাতের বর্শার ডগায় কোনও রাজরক্ষীর ছিন্ন মুণ্ডু। রাজা-রানি আর কোনওদিন ভার্সাইতে ফিরে আসেননি।

এরপর আমরা আরও কয়েকটি ঘর ঘুরে দেখে উদ্যানে এসে বসলাম। রাজা-রানিদের শয়নকক্ষ, খাবার ঘর, বসবার ঘরে আজকাল জনগণের অবাধ প্রবেশ অধিকার। সেইসব ঘর দেখে মনে হয় না, আগেকার রাজা-রানিরা খুব একটা আরামে থাকতেন এখনকার তুলনায়। আজকালকার টাটা-বিড়লা কিংবা ফোর্ড-রকফেলার প্রমুখ নিশ্চয়ই সিরাজউদ্দৌলা, সাজাহান, নেপোলিয়ান, রানি ভিকটোরিয়ার তুলনায় অনেক বেশি বিলাসী জীবন কাটান। কারণ, আগেকার ওঁরা এয়ার কণ্ডিশনিং পাননি, কল খুললেই পাননি ঠাণ্ড গরম জল এক সঙ্গে। লিফটের বদলে কত সিঁড়িই না ভাঙতে হয়েছে সারা জীবনে।

ভার্সাইয়ের বাগান এখন অনেকের কাছে দর্শনীয়, কিন্তু আমার ভালো লাগেনি। ফরাসিদের বাগান বড় বেশি বেশি সাজানো। কোথাও একটাও স্বাভাবিক গাছ নেই। সব গাছ কেটেকুটে নানারকম আকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফুলের বাগানগুলিকে দেওয়া হয়েছে জ্যামিতিক আকৃতি। গাছপালার ওপর এত বেশি ছুরি-কাঁচি চালানো দেখলে আমার কষ্ট হয়।

একটু পরে আমি বললাম, মার্গারিট, এখানে এসে তোমার ফরাসি বিপ্লবের কথা মনে পড়ছে, এটা স্বাভাবিক। আমার কিন্তু মনে পড়ছে অন্য বিষয়। ভার্সাই চুক্তির কথা তুমি জানো? সেটা ফরাসি বিপ্লবের ছ’ বছর আগেকার কথা। ভারতবর্ষে তখন ইংরেজ আর ফরাসিদের মধ্যে খুব লড়াই চলছে। আমাদের দেশটাকে তখন এই দুই শক্তির মধ্যে কে কতটা ভাগাভাগি করে নেবে, তা ঠিক হয়নি। অবশ্য ইংরেজদের কূটনীতি ও রণকৌশল ছিল ফরাসিদের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো। যাই হোক, ভারতের মাটিতে যাতে এই দুই পক্ষ অযথা শক্তিক্ষয় না করে, সেই জন্য ভার্সাইতে হয়েছিল একটা শান্তি চুক্তি। ইংরেজরা ফরাসিদের ছেড়ে দিল পণ্ডিচেরি, মাহে এবং সুরাটের খানিকটা অংশ। ভারতীয়রা কিছু জানলই না যে তাদের ভাগ্য ভাগাভাগি হচ্ছে ভার্সাইয়ের প্রাসাদে।

মার্গারিট বলল, ইতিহাসে পড়েছি, দক্ষিণ ভারতে হায়দার আলি নামে একজন নবাব ছিল, সে ফরাসিদের সাহায্য নিয়ে হিন্দুস্থান থেকে ইংরেজদের পুরোপুরি হটিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু হায়দার আলি হঠাৎ মারা গেলেন, তাঁর ছেলে টিপপু সাহিব…

আমি বললাম, এই ভার্সাইয়ের সঙ্গে আমাদের বাংলা কবিতারও খানিকটা যোগ আছে। আমাদের একজন বাঙালি কবি এখানে কিছুদিন ছিলেন, এখানে বসে লিখেছেন, তাঁর নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত!

রাজা-রাজড়ার কাহিনির চেয়ে কবিদের সম্পর্কেই মার্গারিটের উৎসাহ অনেক বেশি। সে বলল, বাঙালি কবি, তার নাম মাইকেল? নিশ্চয়ই ক্রিশ্চিয়ান, সে বাংলায় কবিতা লিখেছে?

আমি বললাম, হ্যাঁ, তিনি খাঁটি বাঙালির ছেলে খ্রিস্টান হয়ে ইংরিজিতে লিখতে শুরু করেছিলেন। তারপর বাংলা ভাষায় ফিরে আসেন এবং আমাদের বাংলা সাহিত্যে বিরাট একটা পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ভার্সাইতে এসেছিলেন ফরাসি বিপ্লবের অনেক আগে, অন্তত বছর পঁচিশেক আগে।

মার্গারিট জিগ্যেস করল, সে হঠাৎ ভার্সাইতে থাকতে এসেছিল কেন! একজন বিদেশির পক্ষে প্যারিসে থাকাই তো স্বাভাবিক ছিল।

আমি বললাম, সেটা আমি জানি না। খুব সম্ভবত প্যারিসের চেয়ে ভার্সাইতে বাড়ি ভাড়া ও জিনিসপত্রের দাম কম ছিল সেকালে। মাইকেলের দারুণ অর্থকষ্ট চলছিল তখন, সঙ্গে বউ ছেলে মেয়ে। এক একদিন তাঁরা কিছুই খেতে পাননি। ধার শোধ করতে না পারার জন্য মাইকেলের জেলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

যেন মাইকেল নামের কবিটি এখনও জীবিত, যেন তার ছেলেমেয়েরা আজই খেতে পাচ্ছে না, এইরকম একটা দৃশ্য ভেবে নিয়ে মার্গারিটের চোখ-মুখ করুণ হয়ে এল। সে বেদনাময় গলায় বলল, একজন কবিকে এত কষ্ট সহ্য করতে হবে, ছেলেমেয়েরা উপবাসী থাকবে, ইস, পৃথিবীটা এমন খারাপ জায়গা।

আমি বললাম, না, পৃথিবীটা খুব খারাপ জায়গা নয়। তোমারই মতন কোনও দয়াবতী ফরাসি মহিলা এই কবি পরিবারটির দুর্দশা দেখে গোপনে অনেক সাহায্য করেছিলেন, চুপি চুপি ওদের বাড়ির দরজার কাছে দুধ আর রুটি রেখে যেতেন।

এরপর মাইকেলের পুরো জীবন কাহিনিটি আমাকে শোনাতে হল। শুধু তাই নয়, মাইকেলের কবিতাও সে শুনতে চায়, আমি মেঘনাদবধকাব্য থেকে আবৃত্তি করলাম কয়েকটি লাইন। হঠাৎ কীরকম মুড এসে গেল। বাংলা শব্দের ঝংকার যেন মধুবর্ষণ করল আমার কানে, অনেকদিন তো এরকম উচ্চকণ্ঠে বাংলা পড়িনি। আমি গড় গড় করে অনেকখানি বলে যেতে লাগলাম, সেই দুর্বোধ্য শব্দাবলিই মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল মার্গারিট!

একটু পরে সে জিগ্যেস করল, মাইকেলের পর তুমিই দ্বিতীয় বাঙালি কবি এই ভার্সাইতে এলে?

আমি বললাম, ভ্যাট। আরও কত কবি এসেছেন। বাঙালি লেখকরা অনেকেই ফরাসি দেশ ঘুরে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ আসেননি? তবে, মাইকেলের পর আমিই দ্বিতীয় গরিব বাঙালি কবি এখানে এসেছি বলতে পারো! মাইকেল এখানে প্রায় কপর্দকশূন্য হয়েছিলেন একসময়, তাঁর স্ত্রী কান্নাকাটি করছিলেন, হঠাৎ কলকাতা থেকে বিদ্যাসাগর নামে একজন বিরাট মানুষের কাছ থেকে টাকা এল মানি অর্ডারে। আমিও তিন দিন আগে একেবারে নিঃস্ব ছিলাম, তাই না?

ভার্সাইতে মাইকেল যে বাড়িতে ছিলেন, এই কয়েক বছর আগে ফ্রান্সের বাঙালিরা সে বাড়িতে একটা নাম ফলক বসিয়ে দিয়েছেন। আমি যাওয়ার সময় সেটা ছিল না, আমি অবশ্য মাইকেলের সে বাড়ি খোঁজার চেষ্টাও করিনি।

ভার্সাই থেকে ফিরে আমরা তুইলারি প্রাসাদের বাগানে কাটালাম কিছুক্ষণ। রাজা যোড়শ লুইও ভার্সাই ছেড়ে এসে এখানে উঠেছিলেন। এ বাড়িট রাজা-রানির জন্য তৈরি ছিল না, প্রথম রাতটা তাদের ধুলো ঝেড়ে ঝেড়ে শুতে হয়েছিল। আমরা অবশ্য বাড়িটার মধ্যে আর গেলাম না। একদিনের মধ্যে দুটো রাজবাড়ি হজম করা যায় না।

এখান থেকে আবার মারির বাড়িতে ফিরে যেতে হবে ভেবেই আমার মনটা খচখচ করতে লাগল। হয়তো ওরা খুবই ভালো ব্যবহার করবে, তবু এরকম আতিথ্য আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমাকে শুতে দেওয়া হয়েছে বৈঠকখানায়। এ দেশের পক্ষে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রায় সব বৈঠকখানাতেই একটা সোফা-কাম-বেড় থাকে, আমেরিকায় যাকে বলে ড্যাভেনপোর্ট। দিনের বেলা সোফা, রাত্তিরে সেটা খুলে নিলেই বিছানা। কিন্তু আমাকে সক্কালবেলা ঘুম থেকেই উঠেই বিছানা গুটিয়ে ঘরখানা ফিটফাট করতে হবে, দিনের বেলা ইচ্ছে হলেও বিছানায় গড়ানো যাবে না। এরকম শয়ন-ব্যবস্থায় প্রাইভেসিও থাকে না।

প্যারিসে দু-দশ ঘর বাঙালি আছে নিশ্চয়ই। তাদের কারুর কাছে চাইলে কি আশ্রয় পাওয়া যেত না? কিন্তু আমি একজনকেও চিনি না!

মার্গারিট কিছুতেই আমার অস্বস্তির কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না। আমি কিছু বলতে গেলেই ও বলে, তুমি ভুল করছ, সুনীল, আমরা মারির বাড়িতে জোর করে উঠিনি। ওর বাড়িতে থাকি না বলে ও কতবার রাগারাগি করেছে। ও নিজেই বিশেষ করে তোমাকে নেমন্তন্ন করেছে, মারি ভারতীয় যোগব্যায়াম সম্পর্কে খুব আগ্রহী। ও একবর্ণও ইংরিজি জানে না বলে তোমার সঙ্গে ঠিক মতন কথা বলতে পারছে না। আর দু-একদিনের মধ্যে আড়ষ্টতা কেটে যাবে, তখন দেখবে, তোমাকে যোগব্যায়াম সম্পর্কে প্রশ্ন করে কান ঝালাপালা করে দেবে।

হায় রে, আমি মারিকে যোগব্যায়াম শেখাব! ও বিষয়ে আমি কিছু জানি না!

আমি বললাম, মার্গারিট, তোমার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কী হল? চলো, তোমাদের বাড়িতে গিয়ে দু-একদিন থেকে আসি। হোক না গ্রাম, আমার গ্রাম খুব পছন্দ। আমি নিজেও তো গ্রামের ছেলে!

মার্গারিটের মা-যাবা আমার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করবেন, সে বিষয়ে ও এখনও নিশ্চিন্ত নয়। তাই মার্গারিট ও ব্যাপারে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে না। রোজই একবার ফোন করে বাড়িতে, এর মধ্যে আমার কথা উল্লেখ করেছে কি না কে জানে?

রাত্তিরে আমার অস্বস্তি বেড়ে গেল আরও বেশি। মার্গারিটের বান্ধবী মারিই রান্না করে আমাদের খাওয়াল নানারকম। কথায় কথায় জানা গেল, সে আবার গর্ভবতী। মার্গারিটেরই সমবয়েসি সে, অথচ এর মধ্যে দুটির পর তৃতীয় সন্তানের জননী হতে চলেছে, বোধহয় এটা যোগব্যায়ামের সুফল। এই অবস্থায় আমাদের জন্য তাকে বাড়তি পরিশ্রম করতে

ওদের বাড়িতে নিজস্ব সেলার আছে, সেখানে নানারকম ওয়াইনের স্টক। মারির গম্ভীর প্রকৃতির স্বামীটি ওয়াইন খেতে ও খাওয়াতে বেশ ভালোবাসে। পানাহার বেশ ভালোই হলো বটে, কিন্তু মোনিকের বাড়িতে যে চমৎকার আজ্ঞা হত, সেই মজা এখানে একেবারেই পাওয়া গেল না। মারি গল্প করতে লাগল তার কলেজ জীবন ও চেনাশুনো লোকদের সম্পর্কে, যাদের আমি বিন্দুমাত্র চিনি না। ওদের রসিকতাগুলো প্রাইভেট জোকস পর্যায়ের, ওরা যখন হাসে তখন আমি হাসতেও পারি না, আবার মুখ গম্ভীর করে বসে থাকলে বোকা বোকা লাগে। তা ছাড়া ফরাসি মেয়েরা নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলে, তখন অনেকটা বাঙালি মেয়েদের মতনই এমন ঝড়ের বেগে কলকল স্বরে সব কিছু বলে সে বাইরের লোকের পক্ষে বোঝা দুঃসাধ্য!

সকালবেলা মার্গারিট আবার ফোন করলে তার মা-বাবাকে। তারপর আমাকে বলল, আজ মায়ের কাছে খুব বকুনি খেলাম।

আমি ভয় পেয়ে জিগ্যেস করলাম, এই রে, আমার কথা বলেছ বুঝি।

মার্গারিট বলল, না, সে জন্য নয়। আয়ওয়া থেকে একটা টেলিগ্রাম এসেছে। ওখানে ইউনিভার্সিটিতে নতুন সেমেস্টার শুরু হয়ে গেছে। আমি এখনও নাম রেজিস্ট্রি করিনি। ওরা জানতে চেয়েছে, আমি এই সেমেস্টারেও পড়তে চাই কি না। দেরি করলে আমার নাম কেটে দেবে। মা তাই জানতে চেয়েছে, আমি শুধু শুধু এতদিন প্যারিসে বসে আছি কেন?

আমি বললাম, তা হলে তো তোমাকে আমেরিকায় ফিরতেই হবে।

মার্গারিট একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ও কথা পরে চিন্তা করা যাবে। আজ আমাদের রেনোয়ার একক প্রদর্শনী দেখতে যাওয়ার কথা। চলল, চলো, আর দেরি কোরো না।

আমরা বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে।

মার্গারিটের সঙ্গে আমার সংলাপ আমি যেভাবে লিখছি, এটা সঠিক নয়। আমাদের মধ্যে ছিল তুই-তুকারির সম্পর্ক। ইংরিজিতে তুই-তুমি আপনি’র ব্যাপার নেই। সব ইউ দিয়ে সেরে নেওয়া হয়। ফরাসিতে কিন্তু আছে তু আর ভু। এর মধ্যে তু একেবারে তুই এরই মতন শোনায়, হিন্দিতেও তো তু মানে তুই। আমি মার্গারিটের সঙ্গে যখন দু-চারটে বাংলা কথা বলতাম, তখনও তাকে তুই-ই বলতাম। সুতরাং শেষের দু’টি সংলাপ আসলে ছিল এরকম:

এই খুকি, তা হলে তো তোকে এবার আমেরিকায় ফিরতেই হবে!

সে কথা পরে ভেবে দেখব। সুনীল, আর দেরি করিস না, চটপট তৈরি হয়ে নে, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে!