০৭. বছর প্রায় ঘুরে এল

‘কুমারী, উত্তর দাও তুমি
যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার
আমার হৃদয় মৃদু ঝোঁকে
চাপ দেয় তোমার হৃদয়ে
যদি দেখি কখনও তোমার
রূপান্তরে কোনও অস্থিরতা
তবে সেই অস্থিরতা এই;
তোমাকে প্রেমের আগে আমি
তোমার প্রেমকে ভালোবাসি।’
–রেনে গি কাদু

বছর প্রায় ঘুরে এল। এপ্রিলে রাস্তায় পাশের বরফ ভেদ করে উঁকি মারল একটা ছোট্ট ফুলগাছের চারা। এত ঠান্ডার মধ্যেও এই গাছ কী করে এত কাল ঘুমিয়ে ছিল, আবার বেঁচে উঠল, ভাবতে আশ্চর্য লাগে। বরফ গলে যাওয়ার পরেই দেখা যায় সেখানে অনেক রঙের ঘাসফুল। এত ছোট, এত সুন্দর অথচ কী তেজী এই ফুলগুলি!

কাগজে কলমে এপ্রিল মাস এখানে বসন্ত, কিন্তু তখনও শীত যায় না। মে মাসে এক একদিন দুপুরে বেশ ঝকঝকে রোদ, তার মধ্যেই এক ঝাঁক পায়রার মতন ঝটাপট করে বৃষ্টি এসে যায়। বৃষ্টির পরেই হিমেল বাতাস। কোথাও কোথাও মে মাসেও তুষারপাতের খবর শোনা যায়। তবু চেরি গাছগুলোতে থোকা থোকা ফুল এসেছে। পপলার গাছগুলি দীপ্তিময় সবুজ। নদীতে ফিরে এসেছে স্রোত, তার পাশে পাশে ঝুঁকে আছে উইলো গাছ।

পেট্রোল শব্দটি এখানে অপরিচিত, তার বদলে বলে গ্যাসোলিন বা গ্যাস। হঠাৎ জুন মাসে এখানে গ্যাসের দাম কমে গেল। আমার বাড়ির ঠিক সামনেই গ্যাস স্টেশনে (অর্থাৎ পেট্রোল পাম্পে) বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো, ‘টু স্টেন্টস অফ পার গ্যাল!’ গ্যাল মানে গ্যালন। এদেশে এরা অনেক কিছুকেই ছোট ছোট করে বলে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়কে বলে স্কুল, যুব তাঁকে বলে বেবি, বাঘকে বলে ক্যাট।

আমাদের দেশে কোনও জিনিসের দাম কমলে আমরা খুশি হই, এরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। অকস্মাৎ গ্যাসের দাম কমল কেন, তা হলে কি দেশের অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিয়েছে? তখন এক গ্যালন গ্যাসের স্বাভাবিক দাম ছিল পঁচিশ সেন্ট, অর্থাৎ এক টাকা পঁচিশ পয়সা, তার থেকেও দু’ সেন্ট অর্থাৎ দশ পয়সা কমে যাওয়া তো সাংঘাতিক ব্যাপার। সত্যিই সেই ধাক্কায় একটা জমজমাট ডিপার্টমেন্টাল স্টোরস ঝাঁপ ফেলে বন্ধ হয়ে গেল। গ্যাসের দাম কমার সঙ্গে একটা জামা-কাপড়-বাসনপত্র ইত্যাদির দোকান উঠে যাওরার কী সম্পর্ক তো অবশ্য আমার বোধগম্য নয়। এ যেন কপালে এসে লাগল তির, রক্ত পড়তে লাগল হাঁটু দিয়ে।

পল এঙ্গেলের সহকারী মার্ক এই সময় বিশেষ উৎসাহ নিয়ে আমাকে গাড়ি চালানো শেখাতে লাগল। মার্ক-এর গাড়িটি একটা হলুদ রঙের ফোর্ড, বাইরের চেহারাটি অটুট, চলেও বেশ ভালো। দু-তিন দিন ফাঁকা রাস্তায় ত্যাড়াবাঁকাভাবে গাড়িটা চালাতে আমার বেশ মজাই লাগছিল। মার্ক আমার কাঁধ চাপড়ে উৎসাহ দিয়ে বলল, এই তো অনেকটা হয়ে গেছে, আর কয়েকটা দিন প্র্যাকটিস করলেই তুমি ড্রাইভিং টেস্ট পাশ করে যাবে!

আমি বললাম, যাঃ, আমার গাড়িই নেই, শুধু শুধু পয়সা খরচ করে ড্রাইভিং টেস্ট দিতে যাব কেন?

মার্ক বলল, তুমি এতদিন এদেশে আছ, তোমার গাড়ি নেই কেন? তোমার বান্ধবী রাগারাগি করে না? কিনে ফ্যালো, চটপট একটা গাড়ি কিনে ফ্যালো। কতই বা দাম পড়বে! তুমি আমার এই গাড়িটা কিনতে চাও? আমি পঞ্চাশ ডলারে দিয়ে দিতে পারি।

আমি হতবাক। এই উদ্দেশ্য নিয়ে মার্ক আমাকে গাড়ি চালানো শেখাচ্ছে। ওর স্বার্থ আছে। মার্ক নিশ্চয়ই এই গাড়িটার বদলে একটা হাল ফ্যাশানের নতুন গাড়ি কিনতে চায়। এদেশে পুরোনো গাড়ি বিক্রি করা তখন খুব শক্ত ছিল। যেখানে সেখানে গাড়ি গড়িয়ে ফেলে দিত, তাও ধরা পড়ে গেলে মুশকিল। সেই জন্য দিকে দিকে তৈরি হয়েছিল অটোমোবিল গ্রেভ ইয়ার্ড। মানুষের কবরখানার মতনই লোকে পয়সা দিয়ে পুরোনো গাড়ি জমা করে আসত সেখানে। একটুও ভাঙেনি, নষ্ট হয়নি, এমন শত শত গাড়ি সেখানে ধ্বংস হওরার প্রতীক্ষায় পড়ে থাকত।

মার্ক আবার বলল, কিনতে চাও তো বলো, আজই তোমায় গাড়িটা দিয়ে দিতে পারি পঞ্চাশ ডলারে। তেলের দাম কমে গেছে, এখন গাড়ি চালাতে তোমার খরচও বেশি পড়বে না।

আমার বুকটা একবার ধক করে উঠেছিল। এত সস্তায় একটা চালু গাড়ি! পঞ্চাশ ডলার মানে তখনকার হিসেব মাত্র আড়াইশো টাকা। আমাদের দেশে এরকম একটা গাড়ির দাম বেশ কয়েক হাজার টাকা তো হবেই। বেশ ধনীরাই এরকম গাড়ি চড়ে। এখানে পঞ্চাশ ডলার আমি অনায়াসে খরচ করতে পারি, তার বিনিময়ে একটা নিজস্ব গাড়ি হবে।

তারপরেই ইচ্ছে করেছিল ঠাস করে নিজের গালে একটা চড় কষাতে। গাড়ির লোভ! এর পরে ইচ্ছে করবে বাড়ি কিনতে। তারপর মেম বউ। তারপর পায়ের নীচে শেকড় গজাতে আর বাকি থাকবে কী?

মার্ককে বললাম, দুঃখিত, তুমি শুধু শুধু কয়েকটা দিন নষ্ট করলে, আমার গাড়ি কেনার কোনও বাসনাই নেই। তুমি আমাকে এটা বিনা পয়সায় দিলেও আমি নেব না!

দেশে ফেরার জন্য একসময় যে মন উচাটন হয়েছিল, তা কি আস্তে-আস্তে কমে আসছে? এখনও প্রত্যেকদিন কয়েকবার জপ করি ফিরে যাব, ফিরে যাব, কিন্তু সেরকম কোনও উদ্যোগ তো নেওয়া হচ্ছে না। কারণ, মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মার্গারিট নাম্নী তরুণীটি। ঝট করে দেশে ফিরে গেলে মার্গারিটকে চিরতরে ছাড়তে হবে, কিন্তু সেটা যে ভাবতেই পারি না কিছুতেই!

এখন প্রতিদিন বেশ কয়েক ঘণ্টা মার্গারিট আর আমি একসঙ্গে কাটাই। আমার ঘরে, টেবিলের দু’দিকের দুই চেয়ারে বসে আমরা নিজস্ব পড়াশুনো বা লেখালেখি করি। আমার রান্নাঘরটাও দুজনের। অর্ধেক বাঙালি রান্না ও বাকিটা ফরাসি খাবারে আমরা লাঞ্চ-ডিনার সারি। মার্গারিট আমাকে ফরাসি শেখায়, আমি ওকে শেখাই বাংলা। মাঝে মাঝে বাইরের লোকের সামনেও আমাদের ইংরিজি-বাংলা-ফরাসি গুলিয়ে যায়। টেলিফোনে কারুকে ইংরিজিতে ও-কে বলার বদলে আমি ভুল করে বলে ফেলি, দাকর, দাকর! আর মার্গারিট বলে ফেলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে! প্রয়োজনীয় কোনও কিছু খুঁজে না পেলে আমি বলি, ম্যারদ! আর মার্গারিট বলে, দূর ছাই! এই ‘দূর ছাই’ ওর খুব পছন্দ। অনেক সময় কিছু কেনাকাটি করতে গিয়ে দোকানদারের মুখের ওপরেও মার্গারিট বলে ওঠে, দূর ছাই! সেই ফরাসি ওষ্ঠে দূর ছাই বড় সুমিষ্ট শোনায়।

এর মধ্যে মার্গারিটের ভগবানও আমার প্রতি সদয় হয়েছেন, যদিও সবটা নয়, একটুখানি।

মাসের প্রথমে মার্গারিট যা মাইনে পায় এবং আমি যা স্কলারশিপ পাই, সব টাকা রাখা হয় একট ড্রয়ারে। বেহিসেৰিভাবে দুজনে ইচ্ছে মতন তার থেকে খরচ করি, প্রায়ই বন্ধু বান্ধবদের ডেকে খাওয়াই, অনেকক্ষণ আড্ডা হয়। মাসের শেষে টাকা পয়সা ফুরিয়ে গেলে আমরা অন্য কারুর বাড়িতে বিনা নিমন্ত্রণে ঠিক ডিনার টাইমে হাজির হই এবং গালে হাত দিয়ে নিরীহ মুখে বসে থাকি। আমাদের পোলিশ বন্ধু ক্রিস্তফ এর মধ্যেই বেশ টাকা জমিয়েছে, তার কাছে যখন তখন ধার পাওয়া যায়। ক্রিস্তফের কাছে এক প্যাকেট সিগারেট ও আধ ঠোঙা চিনি চাইতে গেলে ও বলে, সিগারেটটা ফেরত দিতে হবে না, কিন্তু চিনিটা ফেরত দিও! ওদের দেশে চিনির খুব অনটন!

এর মধ্যে আমি রাইটার্স ওয়ার্কশপে অনুবাদের কাজ বিশেষ কিছু না করলেও নিজস্ব লেখালেখি শুরু করেছিলাম বেশ প্রবলভাবেই। ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’ বইয়ের অধিকাংশ কবিতাই সেই কয়েক মাসে লেখা। যদিও অতদূরের এক জায়গায় বসে লিখছি, কিন্তু বিদেশের কোনও প্রসঙ্গ আসেনি সেই সব কবিতায়, কেন আসেনি, তাও তো আশ্চর্য ব্যাপার। কবিত লেখার সময় আমি মনেপ্রাণে দেশে ফিরে যাই। ‘কৃত্তিবাস পত্রিকা আমার আত্মার একটা টুকরোর সমান। আমি হঠাৎ বিদেশে চলে আসায় এই পত্রিকার ভার নিয়েছিলেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, তাঁকে সাহায্য করতেন প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু। কৃত্তিবাসের খবরাখবরের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম, তার জন্য লেখা পাঠাতাম নিয়মিত।

এই সময় আমি একটা গদ্য রচনাও শুরু করি।

মার্গারিট আর আমি পালা করে কখনও কোনও ভারতীয় কাহিনি, কখনও কোনও ফরাসি বা ইউরোপীয় কাহিনি শোনাতাম পরস্পরকে। আমি ওর কাছে বিস্তৃতভাবে রাধাকৃষ্ণের কাহিনি বর্ণনা করার পর ও আমাকে শুনিয়েছিল ত্রিস্তান ও ইসল্টের প্রেম বিরহ গাথা, এই বিশ্ববিখ্যাত প্রেম কাহিনিটি বাংলায় তখনও পর্যন্ত অপরিচিত ছিল। একসময় ইওরোপের দেশে দেশে ক্ৰবাদুররা এই আখ্যান গেয়ে গেয়ে বেড়াত। পশ্চিমি সাহিত্যে অসংখ্যবার এর উল্লেখ আছে। প্রেমিক, বীর, যোদ্ধা, বীণাবাদক, দক্ষ নাবিক, আবার ব্যর্থ প্রেমিক ও ভিখারী ত্ৰিস্তানের চরিত্রের কোনও তুলনা নেই। টেনিসন, ম্যাথু অনল্ড, সুইনবার্ন, টমাস হার্ডি প্রমুখ লিখেছেন এই দুঃখী ত্ৰিস্তান ও তার প্রেমিকা সোনালি ইসল্টকে নিয়ে, ভাগনার রচনা করেছেন অমর গীতিনাট্য।

আমার মনে হয়েছিল বাঙালি পাঠকদেরও এ কাহিনি জানা উচিত। আমি লিখতে শুরু করলাম, মার্গারিটের তাতে কী দারুণ উৎসাহ। সে অনেক বইপত্র নিয়ে আসে, নানাবিধ উপাদান সংগ্রহ করে দেয়। ফরাসি ভাষায় জোসেফ বেদিয়ে ত্ৰিস্তান কাহিনির সব কটি ভাষ্য মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছিলেন, মার্গারিট তার সারাংশ আমায় শোনায়। একই সঙ্গে নতুন কিছু জানা, পড়া ও লেখার সমন্বয় হলে তা বড়ই আনন্দদায়ক হয়। সারা দিয়ে দু-তিন পাতা লিখতে পারলেও মনে হয় দিনটা সার্থক। বেশ একটা ঘোরের মধ্যে দিনগুলোতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে ‘সোনালি-দুঃখ’ নাম দিয়ে সেই পুরো কাহিনিটিই আমার লেখা হয়ে গেল। বলতে গেলে সেটাই আমার প্রথম পূর্ণাঙ্গ গদ্য রচনা।

মার্গারিটের বন্ধুত্ব প্রায় সর্বগ্রাসী। সে নিজের মুখেই স্বীকার করত, তার খুব হিংসে; আমাকে অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে একলা মিশতে দেখলেই তার রাগ হয়। সুতরাং একমাত্র পল এঙ্গেলের স্ত্রী মেরি ছাড়া আর কোনও মার্কিন মহিলাকে আমার ভালোভাবে জানার সুযোগই হয়নি। মাঝে মাঝে পল এঙ্গেলের বাড়িতে আমাকে যেতেই হত, এ ছাড়া আমরা দুজনকে নিয়েই মগ্ন ছিলাম।

অকস্মাৎ মার্গারিটের দেশ থেকে টেলিগ্রাম এল, তার মা খুব অসুস্থ। মার্গারিট কান্নাকাটি করল খানিকক্ষণ, তারপর ঠিক করল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে মায়ের কাছে পৌঁছতেই হবে। তখন মাসের শেষ, আমাদের দুজনের হাতেই টাকা নেই, তবু কোনওক্রমে ব্যাংক থেকে ধার পাওয়া গেল, টিকিট সংগ্রহ হল, আমি মার্গারিটকে তুলে দিয়ে এলাম এয়ারপোর্টে। বিশ্ববিদ্যালয় ও অনেক কাজ ফেলে যাচ্ছে, ওকে দু-সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসতেই হবে।

সত্যি কথা বলতে কি, মার্গারিট চলে যাওয়ায় আমি সাময়িকভাবে মুক্তির স্বাদ পেরেছিলাম। ও আমাকে বড় বেশি ঘিরে রেখেছিল। যে দেশে এসেছি, সে দেশটাকে খোলা চোখে ভালো করে দেখতেও পারিনি। যে-কোনও বন্ধন, এমনকি ভালোবাসার বন্ধনও এক এক সময় অসহ্য লাগে।

এবার আমি শুরু করলাম ভ্রমণ। শিকাগো, লস এঞ্জেলিস, সানফ্রান্সিসকো, বার্কলে, অ্যারিজোনান মরুভূমি, মেক্সিকোর প্রান্ত শহর। একা একাই ঘুরি, কোথাও কোনও বাঙালিকে চিনি না, পল এঙ্গেলের রেফারেন্সে দু-একটা বড় শহরে আমেরিকান অধ্যাপক বা লেখকদের কাছে আতিথ্য নিই। সানফ্রান্সিসকোতে দেখা হল অ্যালেন গিনসবার্গের বন্ধু কবি লরেন্স ফেলিংগেটির সঙ্গে। দীর্ঘকায় সেই প্রৌঢ়টি আলাপের তৃতীয় বাক্যেই আমাকে জিগ্যেস করল, আমাকে ভারতবর্ষে নিয়ে যাবে? অ্যালেন কলকাতায় থেকেছে, বারাণসীর গঙ্গা দেখেছে, আমি কেন পারব না?

মার্গারিটের ঠিক সময়ে ফেরা হল না। সপ্তাহে সে আমাকে তিনখানা চিঠি লেখে, এর মধ্যে দু’বার লং ডিসটেন্স টেলিফোনেও কথা হয়েছে। তার মায়ের ব্যাধি বেশ কঠিন, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে না উঠলে মার্গারিটের ফেরার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। প্রত্যেকটি চিঠিতে এবং টেলিফোনেও মার্গারিট জিগ্যেস করেছিল, সুনীল, তোমার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে?

মাসখানেক কেটে যাওয়ার পর আমি এক অন্যরকম আলোড়ন টের পেলাম। আমার এই নবলব্ধ মুক্তিও তো আমি ঠিক উপভোগ করতে পারছি না। সবসময় একটা অস্থিরতা। মার্গারিটের সান্নিধ্য ছাড়া আর সব কিছুই আমার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে।

পল এঙ্গেল একদিন খাবার নেমন্তন্ন করে জিগ্যেস করলেন, তুমি আগামী সেমেস্টার থেকে আমাদের বিভাগে সহকারী হিসেবে যোগ দেবে? মার্ক চলে যাচ্ছে, সেই জায়গায় তোমাকে নিতে পারি। তোমার উপার্জন খানিকটা বৃদ্ধি পাবে!

আমি দুম করে বলে ফেললাম, আমিও চলে যাব। আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না!

পল চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, চলে যাবে? কেন, এখানে তোমার কীসের অসুবিধে হচ্ছে?

আমি কাঁচুমাচুভাবে বললাম, না, এখানে কোনওই অসুবিধে নেই। প্রচুর আরামে আছি। কারুর কাছে থেকে কখনও মন্দ ব্যবহার পাইনি। তবু আমাকে ফিরে যেতে হবে।

পল বললেন, দেশে তো তোমার স্ত্রী নেই, তবে কার জন্য ফিরবে? তোমার চাকরিও নেই, ফিরে গেলে খাবে কী?

আমি বললাম, আমি বাংলায় লেখালিখি করতে চাই, আমার কি নিজের দেশের মানুষের মধ্যেই ফিরে যাওয়া উচিত নয়?

পল বললেন, ইন্ডিয়াতে কি শুধু লেখালেখি করে সংসার চালানো যায়?

আমি বললাম, খুবই কষ্টকর নিশ্চয়ই। তবু তো একটা ঝুঁকি নিতেই হবে।

পল বললেন, তবু তুমি আমার একটা কথা শোনো। তুমি আর এক বছর অন্তত এখানেই থেকে যাও। এখানে বসেও লেখালেখি করার অনেক সময় পাবে। এর মধ্যে দেশে চিঠিপত্র লিখে দ্যাখো, সেখানে কোনও জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারো কি না। সেরকম যদি কিছু পাও, তারপর চলে যেও!

পল এঙ্গেলের স্ত্রী মেরি আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। সব সময় প্যান্ট-শার্ট পরেন, ছোট্টখাট্টো বালকের মতন তাঁর চেহারা। রান্নাঘর থেকে এসে সব শুনে মেরি জোর দিয়ে বললেন, না, না, ও কোথায় যাবে? এই দুষ্টু ছেলেটাকে আমি কোথাও যেতে দেব না!

আমার গালে গাল ঠেকিয়ে মেরি আরও আদর করে বললেন, এ ছেলেটাকে আমি আমার পোষ্যপুত্র করে রেখে দেব!

সেদিনকার মতন কথা ওখানেই থেমে রইল। কিন্তু আমি আমার মন ঠিক করে ফেলেছি।

সে-বছর আমার মতন যে-এগারোজন বিদেশি লেখক-লেখিকা যোগ দিয়েছিল আয়ওরার ওয়ার্কশপে, তাদের মধ্যে সাতজনই আরও এক বছর অন্তত থেকে যাওরার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল এর মধ্যেই। সেই ষাটের দশকের গোড়ায় আমেরিকান চাকরির সুযোগ ছিল প্রচুর, বিদেশিদের ব্যাপারে বিশেষ কড়াকড়িও ছিল না। সারা বিশ্ব থেকে দলে দলে ছেলেমেয়েরা ছুটে যাচ্ছে সেই দেশে। আমিই বোকার মতন উলটো স্রোতে সাঁতার কাটতে চাইছি।

আমার সংকল্পের কথা কারুকে জানালাম না। গোপনে গোপনে ব্যবস্থা করতে লাগলাম, মিটিয়ে দিলাম যার কাছে যা ছিল ধার। খরচ বাঁচাবার অছিলায় এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে ডর্মিটরিতে চলে যাব বলে মার্গারিটের জিনিসপত্র রেখে দিলাম ত্রিস্তফের ঘরে। ত্রিস্তফ এর মধ্যে এত টাকা জমিয়ে ফেলেছে যে দেশ থেকে সে আনিয়েছে তার স্ত্রীকে। সেই পোলিশ মহিলা একবর্ণ ইংরিজি জানেন না, তাঁর সঙ্গে আমরা বোবার মতন হাত-পা নেড়ে কথা বলি। ওয়ারসতে ক্রিস্তফ একটা অনুবাদ সংস্থায় চাকরি করত, সেখান থেকে আরও ছ’মাসের ছুটি আদায় করে নিয়েছিল, সুতরাং ওরা দুজনেই এখানে থাকবে আপাতত।

পল আমার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। একদিন একটা ফর্ম দেখিয়ে বললেন, এইখানে সই করো।

আমি কাঁচুমাচু মুখে জানালাম, আমি কালই চলে যেতে চাই।

পল চুপ করে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তিনি খানিকটা আঘাত পেয়েছিলেন ঠিকই। যে-কোনও কারণেই হোক, অন্যান্য বিদেশি লেখক-লেখিকাদের তুলনায় পল আমার প্রতি একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব করতেন। সেবারে ওই দলটির মধ্যে আমিই ছিলাম কনিষ্ঠতম, তা ছাড়া ভারত সম্পর্কে দলের খানিকটা মোহ ছিল। পল আমাদের কলকতার আড্ডা দেখেছেন, ওখানে প্রায়ই সেই সব গল্প করতেন। অন্যান্য সদস্যরা আমাকে অনেক সময় ঠাট্টা করে বলত, পল দেখছি তোমার কথা বলতে শুরু করলে আর থামেনই না! এড্রিয়ান মিচেল নামে একজন ব্রিটিশ লোক ঠোঁট উলটে বলেছিল, এখানে দেখছি পলই একমাত্র আমেরিকান, যার মুখে কলকাতায় প্রশংসা শুনতে পাই! তাহেরে শফরজাদে নামে একটি ইরানি মেয়ে বলেছিল, তুমি ভারতীয়, তুমি নিশ্চয়ই জাদু জানো। নইলে পল আর মেরি শুধু তোমাকেই এত ঘন ঘন নেমন্তন্ন করে কেন?

দুঃখিত হলেও পল আমাকে আর বাধা দেননি। তিনি আমার মনোভাব বুঝেছিলেন। তিনি বললেন, মানুষের একটাই তো মাত্র ছোট্ট জীবন, যার যেটা ভালো লাগে সেটাই তো করা উচিত।

আমার কাছে একটা রাউন্ড দা ওয়ার্ল্ড বিমান-টিকিট ছিল আগে থেকেই, তাতে আমি পৃথিবীর যে-কোনও দেশে যখন খুশি নামতে পারি। তখন ভিসারও কড়াকড়ি ছিল না এমন। এক দেশ থেকে অন্য দেশের ভিসা সংগ্রহ করা যেত কয়েক মিনিটে। এমনকি অনেক দেশের এয়ারপোর্টে নেমেও ভিসা পাওয়া যেত। কানাডা, পশ্চিম জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে, ইংল্যান্ডে তো বটেই, আমাদের ভিসার প্রয়োজনই হত না। পৃথিবীটা তখনও অনেকটা সরল ছিল।

বাড়িওয়ালাকে নোটিস দিয়ে রেখেছিলাম আগেই। কিন্তু জিনিসপত্রের কী হবে? এর মধ্যে আমার নিজস্ব অনেক জিনিসও জমে গেছে। ভালো ভালো কম্বল, বিছানার চাদর, টেবিল ল্যাম্প, অত্যাধুনিক ইস্ত্রি, কত রকম গেলাস, কাপ-সসার, রান্নাঘরের অতি সুদৃশ্য সব থালা বাসন, যা দেশে পাওয়া যায় না, আরও কত কী! এগুলো কী করে নেওয়া হবে? অনেকে এসব ছোট ছোট প্যাকেট বানিয়ে জাহাজ ডেকে দেশে পাঠিয়ে দেয়, দু-তিন মাস বাদে পৌঁছয়। এখন বসে বসে কে এত সব প্যাকেট বানাবে? আমার অস্থির অস্থির লাগছে। তারপর এক সময় মনে হল, ধু! ফিরব দমদমের দু’খানা ঘরের ফ্ল্যাটে, সেখানে এত সব আবর্জনা বাড়িয়ে কী হবে? থাক, সব পড়ে থাক! মার্গারিট আমার পাশে থাকলে ঠিক এই একই কথা বলত।

আয়ওয়া থেকে যখন বিমানে চাপতে যাচ্ছি, পল এঙ্গেল আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আবার দেখা হবে! আমি তাঁর প্রতি প্রবল টান অনুভব করলেও ভরসা করে এর পুনরুক্তি করতে পারিনি।

এই মহাদেশ ত্যাগ করার আগে কয়েকটা দিন থেকে যেতে হবে নিউ ইয়র্কে। ওই অঞ্চলটা ভালো করে ঘোরা হয়নি। যদিও মার্গারিটের দেখার জন্য ছটফট করছি, কিন্তু নিউ ইয়র্কেও রয়েছে অ্যালেন গিনসবার্গ। সে এর মধ্যে অনেকবার টেলিফোনে বলেছে, চলে এসো, চলে এসো।