০৪. গ্রামের নাম লুদ

‘‘আমাদের এ জীবনে যেহেতু এসেছি আমি এক আগন্তুক
শুধুই তোমার সঙ্গে কথা বলি অজানা ভাষায়
কেননা তুমিই বুঝি হতে পার একমাত্র আমার স্বদেশ
আমার বসন্ত, টুকরো খড়কুটোর বাসা, বৃষ্টিপাত বৃক্ষশাখে’
–পিলিপ জাকোতে

ফরাসি দেশের পোয়াতিয়ে অঞ্চলের একটি গ্রামের নাম লুদ। সেই গ্রামের মেয়ে মার্গারিট ম্যাতিউ। আমিও পূর্ব বাংলার ফরিদপুরের মাইজপাড়া গ্রামের ছেলে। আমাদের দেখা হয়ে গেল সুদূর মধ্য আমেরিকার এক ক্ষুদ্র শহরে। এ এক বিচিত্র যোগাযোগ।

লুদাঁ গ্রামের ইস্কুলে লেখাপড়া শেষ করে মার্গারিট তার বান্ধবী এলেন-এর সঙ্গে চলে এল প্যারিসে। এলেন-এর নামের বানান অবশ্য হেলেন। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ফরাসিরা কিছুতেই ‘এইচ’ অক্ষরটা উচ্চারণ করতে চায় না। অথচ ‘আর’ অক্ষরটা উচ্চারণ করার সময় তার মধ্যে খানিকটা ‘হ’ মিশিয়ে দেয়।

দুই বান্ধবী প্যারিসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো করছিল, এর মধ্যে এলেন এক গ্রিক যুবকের প্রেমে পড়ে বিয়ে করে ফেলল। আর মার্গারিট পোস্ট ডক্টরেট করতে চলে এল আমেরিকায়। ফরাসি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করার জন্য খোদ ফরাসি দেশ ছেড়ে আমেরিকায় আসাটা অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু আমেরিকাতেই পড়াশুনো চালিয়ে যেতে যেতে অর্থ উপার্জনের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। নানারকম অ্যাসিস্টেন্টশিপ পাওয়া যায়। মার্গারিট এখানে রিসার্চ স্কলার আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের অধ্যাপিকা। আমেরিকার সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষার আলাদা বিভাগ আছে। আয়ওয়ার ফরাসি বিভাগের যিনি প্রধান, সেই মসিউ অ্যাসপেল একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত, তিনিও ফরাসি দেশ ছেড়ে এখানে চাকরি নিয়ে এসেছেন, তার কারণ মাইনে অনেক বেশি।

আমি ফরাসি ভাষা জানি না, ফরাসি সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞানও যৎসামান্য, আর মার্গারিট বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ, রবীন্দ্রনাথের নামটা শুধু জানে, তাঁর কোনও লেখাই পড়েনি। তবু আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

আরও অনেক ব্যাপারে আমাদের প্রচণ্ড অমিল। মার্গারিট গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারের সন্তান, তার অন্য দু-বোন মঠের সন্ন্যাসিনী হয়েছে। এমন পরিবার থেকে বেরিয়ে এসে সে যে লেখাপড়ার চর্চা করছে, সেটাই আশ্চর্য ব্যাপার। অবশ্য তার মা-যাবা ও ধর্মের প্রতি টানা রয়ে গেছে যথেষ্ট, সে প্রতি রবিবার গির্জায় যায়, মন বেশি উতলা হলে অন্য দিনেও যায় এবং মুসলমানদের রোজা রাখার মতন, সেও ‘লেনত’-এর সময় সারাদিন উপোস করে থাকে। আর আমি পৈতে ছাড়া, গরু-খাওয়া বামুন, ভগবান নিয়ে কোনওদিন মাথা ঘামাইনি, যে কোনও ধর্মীয় আচার-আচরণ ও বিধিনিষেধ আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। আমার ধর্ম আমার যুক্তি। মানুষের ধর্ম মানবতাবাদ। নিতান্ত আত্মরক্ষার কারণে ছাড়া অন্য কোনও মানুষকে আঘাত করা উচিত নয়, এটাই আমার একমাত্র পালনীয় নীতি। আমি এখন অনেক সহনশীল হয়েছি, অন্যের ব্যাপারে বিশেষ মন্তব্য করি না, কিন্তু সেই বয়েসে, উগ্র নাস্তিকতায় যে-কোনও কারুর ধর্মীয় বাড়াবাড়ি দেখলে উপহাস করতে ছাড়তাম না। মার্গারিটকেও বিদ্রূপ করেছি অনেকবার। মার্গারিট শান্তভাবে বলত, তুমি যত চাও নাস্তিক হতে পারো, আমার একার বিশ্বাসই দুজনের সমান। চার্চে গিয়ে আমি তোমার নামেও প্রার্থনা করব।

ওইটুকু শহর আয়ওয়া, সেখানেও নানান ডিনোমিনেশানের বেশ কয়েকটি চার্চ। প্রতি রবিবার সকালে প্রত্যেকটিতে বেশ ভিড় হয়। তখন বলা হত যে, আমেরিকানরা নিয়মিত গির্জায় যায় কিন্তু আসলে ধর্মপরায়ণ নয়। আর ইংরেজরা গির্জায় যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ধর্ম মানে। আমার বাড়ির কাছেই ছিল একটা গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ, তার সুমধুর ঘণ্টাধ্বনি আমি ঘরে বসে বসে উপভোগ করি, আর মাঝে মাঝে সন্ধেবেলা সেই গির্জার উদ্যান থেকে ফুল চুরি করে আনি। ফুল চুরির ব্যাপারে মার্গারিটেরও কোনও গ্লানি বোধ ছিল না! কিছুদিন পরে অবশ্য ফুল বিষয়ে আমার মত বদলে যায়। শুধু গির্জার বাগান থেকেই নয়, যে কোনও গাছ থেকেই ফুল ছিঁড়তে আমার খারাপ লাগে। মনে হয়, ঘরের মধ্যে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার বদলে গাছের ফুল গাছেই মানায়। এ বিষয়ে বার্নার্ড শ’ এর একটি উক্তি আমার মনে খুব দাগ কেটেছিল। শ’ বলেছিলেন, আমি ছোট ছেলেমেয়েদেরও খুব ভালোবাসি, তা বলে তাদের মুণ্ডু কেটে ঘরে সাজিয়ে রাখি না! চৌষট্টি সাল থেকে আর কখনও ফুল ছিড়িনি। এখন কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির মৃতদেহে ফুলের মালার স্থূপ দেখলে বিরক্তিতে আমার গা জ্বলে যায়!

মার্গারিট বার্নার্ড শ’কে মোটেই বড় লেখক মনে করত না। সেই জন্য সে ওই উক্তিটা গ্রাহ্য করেনি, সে তবু ফুল নিয়ে আসত মাঝে মাঝে। মার্গারিট সব বিষয়েই উগ্র ফরাসি, ব্রিটিশদের কোনও কিছুই ভালো দেখত না সে। ইংরেজরা আবার ছবি আঁকতে জানে নাকি? কনস্টেবল আর টার্নার ছাড়া ওদের আর গর্ব করার মতন কোনও পেইন্টার আছে? ওরা বেনের জাত, গান-বাজনা কিছু জানে না। একটাও বড় কোনও কমপোজার আছে ওদের দেশে? আর সাহিত্য? বিশ্বের বাজারে ওরা অনেক বই বিক্রি করে বটে, কিন্তু ফরাসি সাহিত্যের রথী-মহারথীদের তুলনায় ওদের কে আছে? এক ওই শেকসপিয়রকে নিয়ে চারশো বছর ধরে মাতামাতি করছে। আমাদের রাসিনও কম বড় নাট্যকার নন, তুমি যদি পড়ো তাহলে বুঝবে। কবিতা নিয়ে কত আন্দোলন হয়েছে ফরাসি দেশে, সে তুলনায় ইংরেজরা কী করেছে?

ইংরেজ ফরাসিদের লড়াই বেশ কয়েক শতাব্দীর ঘটনা। মার্গারিটের সঙ্গে আমার তর্ক করার কোনও প্রশ্ন ওঠে না, কারণ আমি ইংরেজদের ধামাধরা নই। ইংরেজদের নিন্দে করার সময় মার্গারিটের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে, কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়ায়, ছটফট করে, তা দেখে আমি হাসি খুব।

একদিন মার্গারিট জিগ্যেস করল, তুমি আমার আগে আর কোনও ফরাসি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছ?

আমি ওকে কলকাতায় আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ-এর তরুণী শিক্ষয়িত্রীদের গল্প বলি। তা ছাড়া কলকাতা তখনও একটা আন্তর্জাতিক শহর, বহু বিদেশিরা আসত, কলকাতার দ্রষ্টব্য স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস (দেওয়ালে কী সুন্দর ফ্রেস্কো ছিল তখন!)। একবার তিনটি ফরাসি মেয়ে আমাদের টেবিলে বসে গল্প করে গিয়েছিল সারা সন্ধে। অনেক ছেলেবেলায় আমি একবার চন্দননগরে গিয়েছিলাম, তখনও ওই শহরটা ছিল ফরাসি-কলোনি, খাঁটি ফরাসিদের বেশ কয়েকটি দোকান ছিল, এক দিদিমার বয়েসি ফরাসি মহিলা দোকানদারনি আমার গাল টিপে দিয়েছিলেন।

চন্দননগরের নাম শুনে মার্গারিট উত্তেজিত হয়ে বলল, উই, উই, স্যান্দারনাগার, স্যান্দারনাগার! সেটা বুঝি কলকাতার কাছেই? ইস, সুনীল, দুশো বছর আগে ফরাসিরা যদি বুদ্ধি করে ইন্ডিয়াটা জিতে নিত ইংরেজদের কাছ থেকে, তা হলে তোমরা ওই বিচ্ছিরি ইংরিজি কালচারের বদলে কত উন্নত একটা কালচারের ঘনিষ্ঠ হতো

আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, অ্যাই! তোমারও বুঝি কলোনিয়াল মেন্টালিটি আছে? তুমি আমার কাছে মেমসাহেব হতে চাও!

মার্গারিট একটু লজ্জা পেয়ে বলল, তা নয়, তা নয়, আমি যেকোনও জাতির ওপরেই অন্য জাতের আধিপত্য ঘেন্না করি। কিন্তু সেই সময়, দুশো বছর আগে, ইউরোপীয় লুঠেরাদের সঙ্গে লড়াই করার মতন ক্ষমতা তো ভারতবর্ষের ছিল না। কেউ না কেউ ওই দেশটা জয় করে নিতই। সেইজন্যই বলছি, ইংরেজদের বদলে ফরাসিরাও তো নিতে পারত! চন্দননগরে আমাদের সেনাপতি দুপ্লে, তিনি বড় বীর ছিলেন, ইচ্ছে করলে ক্লাইভকে ছাতু করে দিতে পারতেন, কিন্তু তখন প্যারিসে নানারকম বিশৃঙ্খলা চলছে, মেইন ল্যান্ড থেকে দুপ্লেকে কোনও সাহায্যই পাঠানো হল না! কী দুর্ভাগ্য!

আমি বললাম, নেপোলিয়নেরও তো ভারত জয় করার খুব ইচ্ছে ছিল! মার্গারিট বলল, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই জানো, বাচ্চা বয়েসে বোনাপার্ট যখন ক্যাডেট কলেজে ছাত্র, তখন থেকেই ভারত সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ছিল, ভারত নিয়ে পড়াশুনো করেছিলেন, তোমাদের ব্রাহ্মণদের মধ্যে কতরকম জাতপাতের ভেদ, তাও তিনি জানতেন।

আমি বললাম, নেপোলিয়ান যখন ইজিপ্ট অভিযানে গিয়েছিলেন, তখন তো উনি কোরান পাঠ করেছিলেন জাহাজে বসে। সেখানকার মুসলমানদের মন জয় করবার জন্য তিনি তখন কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিতেন নিজের সুবিধেমতন। ইজিপ্টে গিয়ে উনি একটা নতুন নামও নিয়েছিলেন না? সুলতান এল কেবির!

মার্গারিট অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, তুমি এটাও জানো? কী করে জানলে?

আমি বললাম, এমিল লুডউইগের লেখা নেপোলিয়ানের জীবনী পড়লেই জানা যায়। সে বই কে না পড়েছে!

মার্গারিট বলল, ফরাসি বিপ্লবের সময় তো চার্চের অধিকার নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, বড় বড় নেতারা সবাই নাস্তিক হয়ে পড়েছিলেন, তোমার মতন! ফরাসি দেশে তখন কোনও ধর্ম ছিল না। নেপোলিয়ান ইজিপ্টে গিয়ে সেটা কাজে লাগিয়েছিলেন, খ্রিস্টান বিদ্বেষী মুসলমানদের কাছে গিয়ে বললেন, দ্যাখো, ইসলামের সঙ্গে আমাদের বিশেষ তফাত নেই। বাইবেলের মতন কোরানের বাণীও আমরা মেনে নিতে পারি। তবে উনি ইজিপ্টে যাওয়ার সময়ই ঠিক করে নিয়েছিলেন, ওই জায়গাটাকে কেন্দ্র করে প্রাচ্যের দিকে এগোবেন। আসলে নেপোলিয়ান তো ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ কর্সিকার লোক, সুতরাং তাঁকে হাফ ওরিয়েন্টাল বলতে পারো। ভারত ছিল ওঁর অবসেশান। উনি ঠিক করেছিলেন, ইজিপ্টে পনেরো হাজার সৈন্য রেখে, আর তিরিশ হাজার সৈন্য নিয়ে আলেকজান্দারের মতন, পারস্যের ভেতর দিয়ে ভারতে পৌঁছবেন। এই জন্য বুদ্ধি করে তিনি পারস্যের শাহের সঙ্গে যুদ্ধ না করে, তাঁর দেশের ওপর দিনে শুধু গমনাগমনের অধিকার চেয়েছিলেন। সকলেরই প্রধান শত্রু ইংরেজ, সতরাং নেপোলিয়ান চেয়েছিলেন একটা ইংরেজ-বিরোধী সম্মিলিত শক্তি গড়ে তুলতে।

আমি বললাম, নেপোলিয়ান আমাদের টিপু সুলতানকেও চিঠি লিখেছিলেন জানি। মার্গারিট হাততালি দিনে বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, টিপু, টিপু সাহিব!

বেশ কিছুক্ষণ ধরে উচ্ছ্বসিতভাবে নেপোলিয়ান সম্পর্কে কথা বলে যাচ্ছিল মার্গারিট, আমি তাকে এক সময় খানিকটা রূঢ়ভাবেই থামিয়ে দিই। অনেক রম্য-ইতিহাসে, ফিলমে নেপোলিয়ানকে একটি রোমান্টিক চরিত্র বানানো হয়েছে, ‘মেরি ওয়ালেউস্কা’ নামে একটা হলিউডের ছবিতে চার্লস বয়ার অপূর্ব অভিনয় করে নেপোলিয়ানকে এক ট্র্যাজিক স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেব ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তবু আমি কোনওকালেই নেপোলিয়ানের ভক্ত নই। ইতিহাসের এই সব বিখ্যাত চরিত্রগুলি তো আসলে বিখ্যাত খুনী। নেপোলিয়ানও এক রক্তলোলুপ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, স্বৈরাচারী ছাড়া আর কী! হিটলারের সঙ্গে তাঁর তফাত অতি সামান্য।

আমি মার্গারিটকে জিগ্যেস করলাম, তোমরা ফরাসিরা বুঝি নেপোলিয়ানকে এখনও খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করো?

একটু থতোমতো খেয়ে মার্গারিট বলল, না। আমরা, অন্তত আমি, ভালোবাসি বোনাপার্টকে। যে বোনাপার্ট ছিলেন সেনাপতি ও কনসাল, যিনি ফরাসি দেশে প্রথম আইন-শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যিনি দর্শন-কাব্য-সাহিত্য-শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কিন্তু যেদিন থেকে তিনি শুধু নেপোলিয়ান হলেন, সেদিন থেকে তাঁকে আর পছন্দ করতে পারি না।

আমি বললাম, অর্থাৎ যেদিন থেকে তিনি সম্রাট হলেন! পোপের সামনে নেপোলিয়ান রাজমুকুটটা নিজেই নিজের মাথায় পরে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই মুকুটটা তাঁর দিকে কে এগিয়ে দিয়েছিল? তোমরা ফরাসিরাই দাওনি? তাঁর নামে নতুন যে মুদ্রা বেরোয়, তাতে ‘প্রজাতন্ত্রের সংবিধানসম্মত সম্রাট’ লেখা ছিল না? সোনার পাথরবাটি! কাঁঠালের আমসত্ব! প্রজাতন্ত্রের আবার সম্রাট!

মার্গারিট হাসতে-হাসতে বলল, ওটা উনি নিজেই লিখিয়েছিলেন। আসলে উনি বরাবরই ছিলেন ছেলেমানুষ! জানো, করোনেশানের সময় উনি ওঁর ভাই জোসেফকে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ইস, আজ যদি যাবা বেঁচে থাকতেন! বাবা যদি আমাকে এই মুকুটপরা অবস্থায় দেখতেন!

মার্গারিট যাই বলুক, যে নেপোলিয়ান ফরাসি জাতটাকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই মানুষটি সম্পর্কে ফরাসিদের এখনও বেশ দুর্বলতা আছে মনে হয়। হিটলারও তো এই একই স্বপ্ন দেখিয়ে জার্মান জাতটাকে চুপ করিয়ে রেখেছিলেন। দেশপ্রেম অতি অন্ধ কুসংস্কার!

মার্গারিট আমেরিকানদেরও খুব বিরোধী। যখন তখন মার্কিনিদের চুটিয়ে নিন্দে করে। ফরাসিদের তুলনায় আমেরিকানরা যেন কোনও ব্যাপারেই নখের যোগ্য নয়। আমরা দুজনেই আমেরিকানদের পয়সায় খাচ্ছি-দাচ্ছি, আবার সেই দেশে থেকেই তাদের নিন্দে করছি ঘরের মধ্যে বসে। অবশ্য আমেরিকানদের নিন্দে ঘরের মধ্যে গোপনে করার দরকার হয় না, প্রকাশ্যেই যা খুশি বলা যায়, আমেরিকান ছেলেমেয়েরা সেই সব শুনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ইটস আ ফ্রি কানট্রি!

শুধু মার্গারিট নয়, সেই ষাটের দশক পর্যন্ত অধিকাংশ ফরাসিই ছিল উগ্র আমেরিকান বিদ্বেষী। তার একটা সহজবোধ্য কারণও আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতি তখনও দগদগে হয়ে আছে। অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস, ফিলম-নাটকই যুদ্ধের পটভূমিকায়। স্বাভাবিক কারণেই হলিউডের ফিলমগুলিতে আমেরিকানদের শৌর্য-বীর্যই বড় করে দেখানো হয়, যেমন সোভিয়েত ফিলমগুলিতে থাকে শুধু সোভিয়েত বাহিনীর বিজয় অভিযান।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রায় শুরুতেই জার্মানির থাপ্পড় খেয়ে ফ্রান্স ধরাশায়ী হয়েছিল। বেশ কয়েকটা বছর ফ্রান্সের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছিল নাতসি বাহিনী। এইরকম সময়ে যা হয়, কিছু ফরাসি জার্মানদের পা চেটেছে, সেনাপতি দ্য গল পালিয়ে গিয়ে ইংল্যান্ডে বসে গঠন করেছেন প্রবাসী সরকার আর দুঃসাহসী দেশপ্রেমিক ফরাসিরা দেশের মধ্য থেকেই গোপনে গোপনে চালিয়েছে রেজিস্টান্স মুভমেন্ট বা মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু ফরাসি দেশ জার্মানদের কবল থেকে প্রকৃতপক্ষে মুক্ত হয় নর্মান্ডিতে মিত্রবাহিনী অবতরণের পর। যে মিত্রবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিল আমেরিকা। বিজয়ীর গরিমা নিয়ে মার্কিন সৈন্যরা প্রবেশ করে প্যারিসে। এই জয়-কাহিনি আমেরিকায় গল্প-উপন্যাস চলচ্চিত্রে ঢাকঢোল পিটিয়ে বারবার তো বলা হবেই। কিন্তু এজন্যে ফরাসিরা কি চিরকাল আমেরিকানদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে? আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কৃতজ্ঞতা অতি দুর্লভ বস্তু। কোনও বড় দেশ কোনও ছোট দেশের উপকার করলে অচিরেই সেই ছোট দেশটি বড় দেশের শত্রু হয়ে ওঠে। সামরিক শত্রুতা যেখানে সম্ভব নয়, সেখানে নিন্দে-গালাগালির বন্যা বয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ড-হাঙ্গেরি-চেকোশ্লোভাকিয়া-বুলগেরিয়া ইত্যাদি দেশগুলিকে মুক্ত করলেও সেখানে খুব বেশিদিন জনপ্রিয় থাকেনি। আয়ওয়াতে আমি যে বাড়িতে থাকি, সে বাড়িরই দোতলায় রয়েছে এক পোলিশ লেখক, তার নাম ত্রিস্তফ জারজেস্কি। বয়েস পঁয়তিরিশ-ছত্রিশ হবে, কিন্তু মাথার চুল ধপধপে সাদা, সেইজন্যই বোধ হয় সব সময় টুপি পরে থাকে। ত্রিস্তফ অত্যন্ত বিনয়ী ও আদব-কায়দা দুরস্ত। প্রত্যেকবার দেখা হলে সে করমর্দনের জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, মার্গারিটকে দেখলে সে মাথার থেকে টুপি খুলে, শরীর একটু বেকিয়ে গ্রিট করে। মার্গারিট এলে আমার ঘরে সে মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে আসে। ক্রিস্তফ এমনিতে সাবধানী ধরনের মানুষ, প্রকাশ্যে একটাও বেফাঁস কথা বলে না। কিন্তু মার্গারিট যখন আমেরিকানদের নিন্দে করে, তখন সে মুচকি মুচকি হাসে, তারপর বলে, রুশ সৈন্যরা আমাদের দেশে কী করেছে শুনবে? তারপর সে এমন সব রুশ-বিরোধী রসিকতা শোনায় যা শুনলে চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম। ওদের দেশের পার্টির কর্তাব্যক্তিরা এই সব রসিকতা শুনলে নিশ্চিত ক্ৰিস্তফ-কে জেলে দিত। রসিকতার ফল যে কত মারাত্মক হতে পারে তার প্রমাণ আছে প্রখ্যাত চেক লেখক মিলান কুন্দেরার ‘দা জোক’ নামের উপন্যাসে। প্রাগ শহরে কলেজের একটি ছাত্র ইয়ার্কি করে তার বান্ধবীকে একটি পোস্টকার্ড লিখেছিল, তার মধ্যে ছিল ট্রটস্কির নাম। সেখানে ট্রটস্কি মানে লেনিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রটস্কি নন, শরীরের একটি গোপন অঙ্গ। সেই পোস্টকার্ড ইউনিয়ানের এক কট্টর সেক্রেটারির হাতে পড়েছিল, সে কিছুতেই রসিকাতাটা বুঝতে চাইল না। সামান্য একটা পোস্টকার্ড উপলক্ষ করে ওই ছেলেটি ও তার বান্ধবী, দুজনেরই বাকি জীবন ধ্বংস হয়ে গেল।

নভেম্বরের শেষ থেকেই তুষারপাত শুরু হয়ে গেল। মাঝে মাঝে শোঁ-শোঁ বাতাসে রাস্তার ধারের উইলো গাছগুলো কাঁদে। এখানে ঠিক কবে থেকে তুষারপাত শুরু হবে, তা নিয়ে টিভিতে, খবরে কাগজে প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয়। অনেক রকম পুরস্কার থাকে। মার্গারিট প্রত্যেকবার সে প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েও কিছু পায়নি। নভেম্বরেই তুষারপাত ফ্রান্সে হয়তো দুর্লভ ঘটনা, তাই সে ঠিক আন্দাজ করতে পারে না। এখানে প্রথম দিনটি ছিল খুবই রোদ্দুর ঝকঝকে, সুপারমার্কেট থেকে মাংস-আনাজপত্র কিনে বড় বড় ঠোঙা হাতে আমি হেঁটে ফিরছিলাম; পরিষ্কার আকাশ, হঠাৎ আলো কমে এল, খুব ছোট ছোট পাখির পালকের মতন দুলতে-দুলতে নামতে লাগল তুষার। দৃশ্য হিসেবে সত্যি অপরূপ। আকাশে কোথায় জমে ছিল এত তুষার? মার্গারিট আমার পাশে পাশে হাঁটছিল, তার ঠোঙাগুলো মাটিতে নামিয়ে রেখে সে আনন্দে কবিতা আবৃত্তি শুরু করে।

আমি একবার বয়েজ স্কাউটদের সঙ্গে কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে খিলান মার্গে তুষারপাত দেখেছি। সুতরাং এ অভিজ্ঞতা আমার কাছে একেবারে নতুন নয়। কিন্তু যেটা আমার কাছে একেবারে অভিনব, তা হল নদী জমে যাওয়া। কালো রঙের আয়ওয়া নদী একটু একটু করে সাদা হতে শুরু করল। তারপর এক সময়ে একেবারে জমাট বরফ, পুরো নদীটাই যেন একটা রাস্তা, কেউ কেউ তার ওপর ছোটাছুটি করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজিরা দেওয়ার দায়-দায়িত্ব নেই, তাই সকালের দিকে তুষারপাত শুরু হলে আমি আর বিছানা ছেড়ে উঠিই না, চওড়া কাঁচের জানলা দিয়ে প্রকৃতি দেখি! মার্গারিটকে খুব সকালবেলা ক্লাস নিতে যেতে হয়। ক্যাম্পাস থেকে ওর হস্টেলটা খানিকটা দূরে, বরং আমার বাড়িটাই বেশ কাছে। মাঝে দু-একটা পিরিয়ড অফ থাকলে মার্গারিট ছুটে চলে আসে আমার অ্যাপার্টমেন্টে। ওকে একটা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েছি। আমাকে শুয়ে থাকতে দেখলে ও ছদ্ম-ঈর্ষায় বলে, ইস কী মজা তোমার! কেল ভি! তুমি প্রস্তের মতন দুপুরের আগে বিছানা ছাড়ো না!

মার্গারিট আমাকে চা-কফি বানিয়ে দেয়। কোনও কোনওদিন এসে বলে, আজ ব্রেকফাস্ট খাবারও সময় পাইনি, খুব খিদে পেয়েছে, আমাকে কী খাওয়াবে?

আমি তড়াক করে উটে পড়ে বলি, দাঁড়াও, খুব ভালো ওমলেট বানাতে শুরু করেছি। তোমাকে আজ মস্ত বড় একটা ওমলেট খাওয়াব!

মার্গারিট চোখ বড় বড় করে বলল, মস্ত বড় ওমলেট? পেলিক্যানের ডিমের নাকি?

আমি বললাম, না, পেলিকানের ডিম কোথায় পাব?

মার্গারিট বলল, তুমি কবি স্রোবেয়ার দেনোর নাম শুনেছ? খুব ভালো কবি ছিলেন, মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। রেজিটাল মুভমেন্টে ছিলেন, ধরা পড়ে জার্মানি কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে ছিলেন। তাঁর বেশ মজার একটা কবিতা আছে শুনবে?

ক্যাপটেন জোনাথন আঠারো বছর বয়সে
দূর প্রাচ্যের এক দ্বীপে ধরলেন এক পেলিকান
জোনাথনের সেই পেলিক্যান একদিন সকালে
ডিম পাড়ল একটা ধপধপে সাদা, এবং কী আশ্চর্য
তার থেকে বেরিয়ে এল ঠিক আগেরটার মতন এক পেলিকান
এই দ্বিতীয় পেলিকানটাও যথাসময়ে
একটা সাদ ডিম পাড়ল, এবং তার থেকে
অবধারিতভাবেই এল আর একটি এবং এইরকম চলতেই থাকল…

এই পর্যন্ত বলার পর থেমে গিয়ে মার্গারিট জিগ্যেস করল, এর পর কী বলো তো? আমি ভুরু তুলে রইলাম। মার্গারিট হাসতে-হাসতে বলল শেষটাই তো আসল!

এই ব্যাপারটা চলতে পারে বহুকাল ধরেই
যদি না কেউ মাঝপথে একটা ওমলেট বানিয়ে নেয়।

রান্নাঘরের গ্যাস স্টোভের সামনে দাঁড়িয়ে মার্গারিট আমাকে কবিতা কিংবা ফরাসি দেশের নানান গল্প শোনায়। আমেরিকায় পৌঁছবার দু-তিন মাসের মধ্যেও মার্কিন সাহিত্য বা সংস্কৃতির সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয় ঘটল না। কিন্তু মার্গারিটের সুবাদে আমার অদেখা দেশ ফ্রান্স সম্পর্কে আমার অনেক কিছু জানার সুযোগ হল। আমাকে ফরাসি ভাষা শেখাবার জন্যও মার্গারিট বদ্ধপরিকর।

এরই মধ্যে একদিন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমার পোলিশ বন্ধু ত্রিস্তফ বলল, সুনীল, আজ ইউনিয়ন ক্যান্টিনে একটা অদ্ভুত কথা শুনলাম। একজন বলল, সুনীল নামে ওই ইন্ডিয়ান ছেলেটা মার্গারিট ম্যাতিউর পাল্লায় পড়েছে? এরপর ও বুঝবে ঠ্যালা! কেন এ কথা বলল বলো তো?

শুনে আমার যতটা না বিস্ময়, তার চেয়েও বেশি রাগ হল। মার্গারিট সম্পর্কে এরকম উক্তির মানে কী? মার্গারিটের স্বভাব অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও স্বার্থের লেশমাত্র নেই। অন্যদের অনেক উপকার করতেও আমি ওকে দেখেছি। ও কখনও মিথ্যে কথা বলে না, একটু পাগলি ধরনের, একটু টেম্পারামেন্টাল ঠিকই, কিন্তু কোনওরকম প্রবঞ্চনা ওর চরিত্রে থাকতেই পারে না। আমি মানুষ চিনি না?

তখন আমার মনে পড়ল, পল এঙ্গেলের একজন সহকারী, মার্ক ডগলাস নামে এক তরুণ লেখক দু-তিন দিন আগে আমায় জিগ্যেস করেছিল, ফরাসি ডিপার্টমেন্টের মার্গারিট তোমার বান্ধবী? এই প্রশ্নের সঙ্গে খানিকটা কৌতুক এবং অনেকটা বিস্ময় ফুটে উঠেছিল মার্কের মুখে।

এখানে ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। কারুর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কেউ কোনও মন্তব্যও করে না। তবু মার্গারিট সম্পর্কে এরকম প্রশ্ন, এমন বিস্ময় কেন?