১৭. দোভাষীর মারফত বক্তৃতা

দোভাষীর মারফত বক্তৃতা দেওয়া চলতে পারে, সাক্ষাৎকার নেওয়াও সম্ভব, কিন্তু এইভাবে আড্ডা দেওয়া যায় না। বিশেষত খাওয়ার টেবিলে। আমরা রয়েছি তিনজন, এর মধ্যে পারপারা যা বলছে, সারগেই আমাকে তা অনুবাদ করে শোনাচ্ছে। আমি যা যা উত্তর দিচ্ছি, সারগেই-কে তা আবার অনুবাদ করতে হচ্ছে। পারপারা আমার দিকে তাকিয়ে কোনও মজার কথা বললে সারগেই তা শুনে হাসছে, আমি তখন বোকাবোকা মুখ করে তাকিয়ে থাকি, তারপর অনুবাদ শুনে হাসতে হয়। গন্ডারকে কাতুকুতু দিলে সে নাকি সাতদিন পরে হাসে, এ যেন অনেকটা সেই ব্যাপার। সারগেই নিজে কোনও কথা বলতে চাইলে একবার বলে রুশ ভাষায়, আর একবার আমার দিকে ফিরে ইংরিজিতে।

খানিকটা ভদকা পানের পর অবশ্য অনুবাদের ঝামেলা অনেকটা চুকে যায়। তখন আমি পারপারার কথা সরাসরি অনেকটা বুঝতে পারি। ইশারা-ইঙ্গিতেও অনেকটা কাজ চলে। সারগেই খাদ্য-পানীয় দুটোই কম খায়, স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সতর্ক; ওর চেহারা বেশ ছিপছিপে, তবু ওর ধারণা মোটা হয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগেই সারগেই আমাকে বলেছিল, খুব শীতের সময় বাড়ি থেকে কম বেরুনো হয়, বসে-বসেই সময় কাটাতে হয় বেশি, তাই শীতের পর তার ট্রাউজার্সের কোমর আঁট হয়ে যায়।

পারপারা বেশ দিলদরিয়া ধরনের মানুষ, এবং খুবই কবিতাপ্রেমিক। কবিতা প্রসঙ্গে নানা কথা বলতে বলতে ভদকা পান চলতে লাগল। সেইসঙ্গে নানারকম খাদ্য। লেনিনগ্রাদে আমি একদিন ক্যাভিয়ের সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলুম, সেদিন হোটেলে ক্যাভিয়ের বিশেষ ছিল না। তারপর আমি অন্যত্র ক্যাভিয়ের খেয়েছি, কিন্তু আজ সারগেই আমাকে আশ মিটিয়ে ক্যাভিয়ের খাওরাবে ঠিক করেছে। দু-প্লেট ক্যাভিয়ের আনানো হয়েছে, এবং তা শুধু আমাকেই খেতে হবে। আমি কালো রঙের ক্যাভিয়েরই আগে দেখেছি, কমলা রঙেরও যে হয় আগে জানতুম না।

যতদূর জানি, কাস্পিয়ান হ্রদের স্টার্জন মাছের পেটেই শুধু এরকম ডিম হয়। মাছগুলি বিরাট বিরাট, সেই তুলনায় ডিমের পরিমাণ কম। সেই জন্যই এই ডিমের দাম খুব বেশি। সারা পৃথিবীতেই ক্যাভিয়ের একটি অতি শৌখিন খাবার হিসেবে পরিচিত। তবে এই মাছের ডিমই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ কি না, তা আমি বলতে পারি না, এটা ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন, তা ছাড়া আস্বাদ রপ্ত করারও একটা ব্যাপার আছে। অনেক বাঙালিই হয়তো বলবেন, পদ্মার ইলিশের ডিমের কোনও তুলনা নেই। অবশ্য স্টার্জন মাছের এই ডিমের বৈশিষ্ট্য হল এর দানাগুলো বড়-বড়, এবং ভেতরটা রসাল। ক্যাভিয়ের আমার বেশ প্রিয়, কিন্তু তা বলে দু-প্লেট খেতে হবে? পারপারা আর সারগেই বলতে লাগল, আপনারা দেশে তো এ জিনিস পাবেন না, আপনিই খান, আমরা তো প্রায়ই খেতে পারি।

আমি বললুম, আপনারা আমার দেশে আসুন, ইলিশ মাছের ডিম খাওয়াব।

ইলিশ মাছ কীরকম দেখতে হয়, তা ওরা দুজনেই জানে না। ইলিশ নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা আছে, তা দু-লাইন শুনিয়ে মাছটির বর্ণনা দিলুম, তারপর বললুম, ইলিশ মাছ খুব বড় হয় না বটে, কিন্তু ডিম হয় অনেকখানি করে।

পারপারা কখনও ভারতে আসেননি, আসবার খুব ইচ্ছে আছে। ওঁর শুধু শখ হিমালয় পাহাড় দেখা। আমি বললুম, কলকাতায় চলে আসুন, আমি দাজিলিং নিয়ে যাব। দার্জিলিং এর নাম শুনেছেন?

ওরা দুজনেই বলল, দার্জিলিং তো বিশ্ববিখ্যাত জায়গা।

মাঝে মাঝে টুকটাক কবিতা সম্পর্কে আলোচনা, পরিবেশটি হল শিল্পীদের মিলনকেন্দ্র এবং নানারকম সুখাদ্য, সব মিলিয়ে দুপুরটি কাটল চমৎকার। পারপারা কারুকার্য করা খাপ সমেত একটা ছোট ছুরি দিলেন আমাকে। বললেন, আমাদের বন্ধুত্বের চিহ্ন হিসেবে এই সামান্য জিনিসটি আপনাকে নিতে হবে!

আমি অভিভূত হয়ে গেলুম একেবারে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার পরিচয়! আমার কাছে দেওয়ার মতন কিছুই ছিল না। আমি লজ্জিতভাবে সেকথা জানাতেই পারপারা বললেন, আমি যখন আপনার দেশে যাব, তখন নিশ্চয়ই কিছু নিয়ে আসব আপনার কাছ থেকে।

বিদায় নেওয়ার সময় পারপারা আনাতোলি আনতোলিয়েভিচ খুব আন্তরিকভাবে আমার হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিলেন। ভাষার ব্যবধান থাকলেও দুজন মানুষের কাছাকাছি আসতে যে বাধা হয় না, আবার তার প্রমাণ পাওয়া গেল।

আরও কয়েকটি জায়গা ঘুরে হোটেলে ফিরে দেখি সুবোধ রায় বসে আছে। সে সারগেইকে বলল, অনেক লোক অপেক্ষা করছে, সুনীলদাকে না নিয়ে গেলে চলবেই না।

আমাদের সারাদিনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট মোটামুটি শেষ, তাই সারগেই আপত্তি জানাল না। সুযোধ সারগেইকেও নেমন্তন্ন জানাল, কিন্তু সারগেই নিজের বাড়ি ফিরে যেতে চায়। ও বেশ কয়েকদিন বাড়িছাড়া, সেইজন্য আমিও ওকে ফিরে যেতে বলুলম। সরকারি গাড়িও ছেড়ে দিতে হল।

সুযোধরা থাকে বহু দূরে। দুজনে হাঁটতে-হাঁটতে ট্যাক্সি খুঁজতে লাগলুম। সন্ধে প্রায় সাতটা বাজে। সন্ধে না বলে বিকেল বলাই ভালো, কারণ আকাশে যথেষ্ট আলো রয়েছে। সুবোধ জানাল যে এই সময়ে ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল। রাস্তায় অফিস ফেরত ভিড়।

কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে, কিন্তু হেঁটে অতদূর যাওয়া যাবে না। সুযোধ বলল, মেট্রোতে যেতে আপনার আপত্তি আছে? কিছুটা এগিয়ে যাওয়া যায়।

আপত্তির তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না, আমি সাগ্রহে রাজি হলুম। সরকারি অতিথি হলে সবসময় গাড়ি চড়ে ঘুরতে হয়। এর আগে একদিন ক্রেমলিন থেকে ফেরার পথে শর্টকাট করার জন্য একটি মেট্রো স্টেশনে নেমে উলটো দিকের রাস্তায় উঠেছিলুম, আজ প্রথম মস্কোর মেট্রোতে চাপার সুযোগ হল।

পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশের ভূ-নিম্ন ট্রেন দেখেছি আমি, মস্কোর মেট্রো আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে। স্টেশনগুলির বিরাটত্ব এবং সৌন্দর্য এই দুটোই একসঙ্গে বিস্মিত করে। স্টেশনগুলি নিছক ফাংকশনাল নয়, নানারকম ভাস্কর্য ও আলোর বাহার দিয়ে সাজানো। গ্রানাইট ও মার্বেল পাথরে রয়েছে শিল্পীদের হাতের স্পর্শ।

মস্কোর মেট্রো রেল তৈরি শুরু হয়েছিল পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে। এখন এই শহরেই ১১৫টি স্টেশন এবং লাইন পাতা আছে ১৯৩ কিলোমিটার জুড়ে।

মেট্রো রেলে বেশ খানিকটা পথ আসবার পর আবার ওপরে উঠে সুবোধ গাড়ি জোগাড় করে ফেলল। ননী ভৌমিককে নিয়ে যাওয়ার কথা আছে, তিনি বাড়িতে অপেক্ষা করছেন।

এখনকার পাঠকরা অনেকেই হয়তো ননী ভৌমিকের লেখা পড়েননি, কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল দুর্ধর্ষ ছোটগল্প লেখক হিসেবে। তাঁর ‘ধান কানা’ নামে একটি গল্পের বই পড়ে আমার ছাত্র বয়েসে মুগ্ধ হয়েছি। তারও আগে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর একটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছিল। খুব বেশি লেখেননি তিনি। বহুঁকাল ধরেই মস্কোতে আছেন অনুবাদের কাজ নিয়ে।

ননী ভৌমিক তৈরি হয়েই ছিলেন, কিন্তু আমাদের দেখে বললেন, আপনারা এসেছেন, কিছু দিয়ে তো আতিথ্য করতেই হবে!

সুযোধ বলল, না ননীদা চলুন, অন্য অনেকে অপেক্ষা করছে। আমরা খুব দেরি করে ফেলেছি!

তবু খুব চটপট একটা করে ভদকা পান করা গেল। ননী ভৌমিকের ছেলে সদ্য মিলিটারি সার্ভিস শেষ করে এসেছে, আলাপ হল তার সঙ্গে। সে এখন বেশ লম্বা-চওড়া জোয়ান, এই ছেলেটিই একবার অল্প বয়েসে কলকাতায় এসে হারিয়ে গিয়েছিল, গল্প। শুনেছি।

ননী ভৌমিককে আমি কলকাতায় দেখেছি দু-একবার, কিন্তু ভালো পরিচয় ছিল না। গাড়িতে যেতে-যেতে বললুম, আপনি দুর্দান্ত সব গল্প লিখেছেন, এখন আর লেখেন না কেন? আমাদের অনুরোধ, আবার লিখুন। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নাঃ, আমার দ্বারা আর লেখা হবে না। আমার লেখা শেষ হয়ে গেছে!

গাড়ি যেখানে থামল, সেই পাড়ায় অনেক বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী দেখতে পেলুম, কালো রঙের যুবক-যুবতী অনেক। কাছেই প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়। বহু দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। কাছাকাছি অনেকগুলি হস্টেল।

সুবোধের অ্যাপার্টমেন্টে জড়ো হয়েছে অনেক বাঙালি নারী-পুরুষ। অনেকেই ছাত্রছাত্রী। সুজিত আর সংঘমিত্রার সঙ্গে আগেই পরিচয় হয়েছিল। ওদের কেউ-কেউ এক-একটা জিনিস রান্না করে এনেছে, সব মিলিয়ে অনেক খাবার। সুবোধ সাজিয়ে রেখেছে শ্যাম্পেন ও ভদকার বোতল। সুযোধকে কারা যেন একটা বড় অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু আমি তা নাকচ করে দিয়েছি, আমার এইরকম ঘরোয়া আসারই পছন্দ। অবিলম্বে আড্ডা জমে গেল।

শ্যাম্পেনের গেলাস শেষ হতে না হতেই কেউ ঢেলে দিচ্ছে আবার, আমি মনে-মনে একটু ভয় পাচ্ছি। দুপুর থেকেই যথেষ্ট ভদকা সেবন হয়েছে, এবার হঠাৎ না জ্ঞানটা চলে যায়। কিন্তু ননী ভৌমিক আমাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকজন আমাকে অনুরোধ জানাল কবিতা পড়ে শোনাবার জন্য। ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমি বললুম, কোনও কবিতার বই তো সঙ্গে আনিনি! কোথা থেকে বেরিয়ে পড়ল গোটা দু-এক কবিতার বই। এই সুদূর মস্কোতেও কেউ বাংলা কবিতার বই সঙ্গে করে এনেছে, এটা দেখে আমার মনটা বেশ ভিজে ভিজে হয়ে গেল।

উপস্থিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে দু-একজন বেশ ভালো গান করে। শুরু হয়ে গেল গান। প্রায় সবই রবীন্দ্রসঙ্গীত। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ এতগুলো গান লিখে গিয়েছিলেন, নইলে বাঙালি জাতটার কী অবস্থা হত। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া আমাদের আর কোনও গানই নেই।

রাত্রি বাড়ছে আর করবার মনে পড়ছে আমাকে কাল ভোরেই এয়ারপোর্ট ছুটতে হবে। হুস করে, যেন চোখের নিমেষে কেটে গেল দুটি সপ্তাহ। বাঙালিরা অনেকেই বলতে লাগলেন, মস্কোতে আপনি বড় কম দিন থাকলেন, এখানে আপনার আরও কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাওয়া উচিত ছিল!

আমি বললুম, সে যাই হোক, শেষ সন্ধেটি আমার চমৎকার কাটল।

অনেক রাতে ট্যাক্সিতে আমায় হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেল সুবোধ আর কয়েকজন। জামা-প্যান্ট না ছেড়েই ঘুমিয়ে পড়লুম আমি। ঠিক যেন পরের মুহূর্তেই ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন।

না, এক মুহূর্ত নয়, এর মধ্যে রাত কেটে গেছে। হোটেলের অপারেটর আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আমার প্লেন ধরতে হবে। এই ব্যবস্থাটা কে করে গেল? নিশ্চয়ই সুবোধ। এভাবে জাগিয়ে না দিলে হয়তো আমার ঘুম ভাঙত না। সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে, আর মোটেই সময় নেই।

|||||||||| বাক্স গুছোবার কোনও ব্যাপার নেই, জামা-কাপড় যেখানে যা ছড়িয়েছিল সব দলামোচা করে ভরে দিলুম। পাশপোর্ট আর টিকিট ঠিক থাকলেই হল। এয়ারপোর্টে কি আমাকে একাই যেতে হবে?

মোজা পায়ে দিয়ে জুতোর ফিতে বাঁধতে শুরু করেছি, এমন সময় সারগেই এসে হাজির। ওর বাড়ি অনেক দূরে, ওকে আরও অনেক ভোরে উঠতে হয়েছে।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে বেশি সময় পাওয়া গেল না। সিকিউরিটি চেকের ডাক পড়ে গেল। সারগেই-এর ধারণা ছিল ওর পরিচয়পত্র দেখালে ওকে সিকিউরিটি এলাকার মধ্যে ঢুকতে দেবে, তা হলে আরও কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে। কিন্তু গম্ভীর চেহারার রক্ষীরা অনুরোধ করলেও ফল হল না কিছু। সুতরাং আমাদের বিদায়পর্ব হল অতি সংক্ষিপ্ত। সারগেই আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, সুনীলজি, মনে রাখবেন আমাদের কথা, চিঠি লিখবেন, আবার কখনও এদেশে এলে ফোন করবেন…

আমি বললুম, নিশ্চয় মনে থাকবে তোমার কথা! আমাদের দেশে কখনও এলে নিশ্চয়ই খবর দিও!

তারপরেই আমি চলে গেলুম চোখের আড়ালে।