০৯. ভালেন্টিন রাসপুটিনের জন্ম

ভালেন্টিন রাসপুটিনের জন্ম ১৯৩৭ সালে, রাশিয়ান ফেডারেশানে। খ্যাতিমান লেখক। এঁর একটি অতি বিখ্যাত গল্পের নাম ‘ফরাসি শিক্ষা’। গল্পটি এই রকম :

একটি এগারো বছরের ছেলে গ্রাম থেকে শহরে যাচ্ছে পড়াশুনো করতে। ছেলেটির মা বিধবা, ওরা তিন ভাই বোন, ছেলেটিই সবচেয়ে বড়। ওদের অভাবের সংসার। সময়টা হল ১৯৪৮ সাল, যুদ্ধ-পরবর্তী সংকটকাল তখনও চলছে, খাদ্যদ্রব্যের খুব অভাব। গ্রামের স্কুলে ছেলেটি ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে, অন্যান্য ছেলেদের মধ্যে সে-ই ছিল সবচেয়ে মেধাবী। স্কুল লাইব্রেরির সব বই সে পড়ে ফেলেছে। স্টেট লটারি-লোন সাটিফিকেট-এর খবর ছাপা হলে গ্রামের লোকেরা সেই ছাপা কাগজ ওই ছেলেটির কাছে নিয়ে আসত, কারণ সে ঠিকঠাক পড়ে দিতে পারে। সেই জন্যই গ্রামের প্রবীণরা তার মাকে বলত, তোমার এ ছেলেটির বেশ মাথা আছে। একে আরও পড়াও!

সেই জন্যই মা কষ্ট করেও ছেলেকে আরও লেখাপড়া শেখাবার জন্য পাঠালেন শহরে। গ্রাম থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে একটি ছোট শহর। একটি বাড়ির একখানা ছোট ঘরে স্থান পেল সে, সপ্তাহে একবার তার মা একজন লোকের হাত দিয়ে কিছু খাবার পাঠান। খাবার মানে রুটি আর আলু। তাও ও বাড়ির অন্য ছেলেরা চুরি করে নেয় তার খাবার, সপ্তাহের মাঝখানেই ফুরিয়ে যায় তার রুটি আর আলু, তারপর শুধু খিদে, শুধু খিদে।

কয়েক সপ্তাহ বাদে একবার মা দেখতে এলেন ছেলেকে। ছেলেটি কিছুতেই বুঝতে দিল না যে সে কোনওরকম কষ্টে আছে। সে হাসিমুখে মাকে কত রকম মজার গল্প শোনাল। তারপর মা যখন বিদায় নিচ্ছেন, সে আর থাকতে পারল না, গাড়ির পেছন পেছন ছুটতে-ছুটতে কাঁদতে লাগল হাপুস নয়নে। মা গাড়ি থামিয়ে বললেন, তোর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আয়। ছেলেটি তখন উলটো দিকে দৌড় দিল।

স্কুল থেকে ফিরে সন্ধেবেলা সে শুধু বাড়ির কথা ভাবে। ইচ্ছে করে বাড়ি ফিরে যেতে। আবার সে ভাবে, তাকে লেখাপড়া শিখতেই হবে। খালি পেট নিয়ে সে বই খুলে বসে।

গ্রামের স্কুলের ভালো ছেলে কিন্তু শহরে এসে তেমন সুবিধে করতে পারল না। অন্য সাবজেক্টগুলো কোনওক্রমে ম্যানেজ করলেও ফরাসি ভাষার ক্লাসে সে একেবারে নাজেহাল হয়ে যায়। তার গ্রাম্য উচ্চারণে তা অদ্ভুত শোনায়। ফরাসি যিনি পড়ান, তিনি একটি পঁচিশ বছরের তরুণী, তাঁর নাম লিদিয়া মিখাইলোভনা। এই ছেলেটির ফরাসি উচ্চারণ শুনে তিনি শিউরে উঠে চোখ বুজে ফেলেন।

খিদের চোটে ছেলেটির মাথা ঘোরে, মাঝে-মাঝে একটু দুধ খেতে ইচ্ছে করে। তাদের গ্রামে তবু নানারকম ফলমূল পাওয়া যেত, এখানে কিছুই পাওয়া যায় না। নদীতে মাছ ধরার জন্য সারাদিন ছিপ ফেলে বসে থেকে তিনটি পুঁটি মাছ পায় মাত্র। পাড়ার ছেলেরা তাকে খেলতে ডাকে, কিন্তু তার যেতে ইচ্ছে করে না।

একদিন তাকে এ বাড়িরই একটি ছেলে জিগ্যেস করল, তুই ‘ফায়ার্স’ খেলতে যাবি! ছেলেটি জিগ্যেস করল, সেটা কী খেলা?

–পয়সা দিয়ে খেলতে হয়।

-আমার তো পয়সা নেই!

তবু ছেলেটি তাকে নিয়ে যায়। বাড়ির পেছনের ঝোঁপঝাড় ও ছোট একটি টিলা পেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে জড়ো হয়েছে কয়েকটা ছেলে। তারা মাটিতে পয়সা সাজিয়ে দূর থেকে পাথরের টুকরো ছুঁড়ে একরকম খেলা খেলে, যে ঠিকমতন লাগাতে পারবে, সে পয়সাগুলো জিতবে। কয়েকটা উঁচু ক্লাসের ছেলেও রয়েছে এখানে। তাদের মধ্যে একটি ছেলের নাম ভাডিক, সে বেশ লম্বা-চওড়া। সে-ই ওদের নেতা।

এই ছেলেটি কয়েকদিন ধরে খেলাটা লক্ষ করল। তার মনে হল, এটা খুব শক্ত নয়। তারও খেলতে ইচ্ছে হয়। আর কিছুর জন্য নয়; এখান থেকে কিছু পয়সা জিতলে সে দুধ কিনে খেতে পারবে। মায়ের কাছে সে টাকা চাইতে পারে না, কারণ সে জানে, তাদের পরিবার খুব কষ্টে আছে, তা ছাড়া এ বছর ফসল ভালো হয়নি। মায়ের কাছে টাকা নেই বলেই তো মা বাড়ির তৈরি রুটি পাঠিয়ে দেন। তবু মা একবার রুটি আর আলুর নীচে পাঠিয়ে দিলেন একটা পাঁচ রুবলের নোট। ছেলেটি সেই টাকা নিয়ে জুয়া খেলতে গেল।

ছেলেটি খুব সাবধানে কম কম খুচরা পয়সা দিয়ে খেলে। প্রথম দু-তিন দিন সে হারল। তারপর জেতার জন্য মরিয়া হয়ে সে বার করল পাথর ছোঁড়ার একটা নতুন কায়দা। এবার জিততে লাগল সে। তবে সে বেশি লোভ করে না। এক রুবল জিতলেই খেলা ছেড়ে চলে যায়। বাজারে গিয়ে সেই টাকায় দুধ কিনে খায়।

পর পর কয়েকদিন এরকম জেতার পর সেই ভাডিক ওকে চেপে ধরে বলল, কী ব্যাপার! তুই চালাকি পেয়েছিস, রোজ জিতে চলে যাবি? আজ তোকে শেষ পর্যন্ত খেলতেই হবে।

ছেলেটি বলল, আমাকে যে পড়তে যেতে হবে। সেই জন্য আমি বেশিক্ষণ খেলি না।

অন্য ছেলেরা ঠাট্টা করতে লাগল। তাকে বাধ্য করল শেষ পর্যন্ত খেলতে। একবার সে একটা বড় খেলা জিততেই ভাডিক পা দিয়ে চেপে ধরল পয়সাগুলো। ছেলেটি পয়সা তুলতে যেতেই ভাডিক বলল, নিচ্ছিস যে, তোর তো লাগেনি!

ছেলেটি বলল, হ্যাঁ লেগেছে, নিশ্চয়ই লেগেছে। একটা পয়সা উলটে গেছে।

ভাডিক তাকে এক ধাক্কা দিয়ে বলল, আমি বলছি লাগেনি!

ছেলেটি আবার তার দাবি জানাতেই তিন-চারজন মিলে মারতে লাগল তাকে। কেড়ে নিল তার পয়সা। ছেলেটি ওদের সঙ্গে মারামারিতে পারবে না। দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে ছোট টিলাটির ওপর উঠে সে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, হ্যাঁ, আমার লেগেছিল! লেগেছিল! তোরা চুরি করেছিস!

ভাডিক চেঁচিয়ে বলল, তুই খুন হতে চাস?

পরদিন সকালে ছেলেটি দেখল, তার নাকটা ফুলে আলু হয়ে গেছে, চোখের নীচে কালশিটে, কপালে ক্ষত, মুখখানা একেবারে বীভৎস। কী করে স্কুলে যাবে এই অবস্থায়? তবু যেতেই হবে। কারুর কারুর নাক কি এমনিতেই আলুর মতন বড় হয় না? স্কুলে গিয়ে সে মুখ ঢেকে বসে রইল।

কিন্তু প্রথম ক্লাসটাই ফরাসির। লিদিয়া মিখাইলোভনা প্রত্যেক ছাত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে গুড মর্নিং বলেন। এই ছেলেটির কাছে এসে তিনি জিগ্যেস করলেন, তোমার কী হয়েছে?

ছেলেটি বলল, আমি আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিলুম।

ফরাসি শিক্ষিকা বললেন, ইস, খুব লেগেছে দেখছি!

পেছন থেকে একটি ছাত্র বলে দিল, মোটেই পড়ে যায়নি, মিস, ও জুয়া খেলতে গিয়ে মারামারি করেছে।

মিস কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি ছুটির পরে থেকে যাবে।

ছেলেটি ভাবল, মিস নিশ্চয়ই হেডমাস্টারের কাছে নালিশ করবেন। তা হলে স্কুল ছেড়ে চলে যেতে হবে! না, না, সে কিছুতেই বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না।

ছুটির পর একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে লিদিয়া মিখাইলোভনা জিগ্যেস করলেন, তুমি জুয়া খেলো, সত্যি? জেতো না হারো? জেতো? বাঃ, এটা একটা ভালো কথা অন্তত। অনেক টাকা জিতেছ? কী করবে সে টাকা দিয়ে? বই কিনবে? কেক কিনবে?

ছেলেটি বলল, আমি মাত্র এক রুবল জিতেছিলাম।

–এক রুবল? মোটে এক রুবল! তা দিয়ে কী করবে?

–দুধ কিনব।

এই কথা শুনে মিস কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। মিসের তন্বী শরীর, সূক্ষ্ম, শহুরে ধরনের পোশাক, তাঁর নিশ্বাস দিয়ে সুগন্ধ বেরোয়। তিনি অঙ্ক বা ভূগোল পড়ান। না। তিনি পড়ান রহস্যময় ফরাসি ভাষা, সেইজন্য তাঁকেও রহস্যময়ী মনে হয়।

মিসের কাছে ছেলেটি প্রতিজ্ঞা করল, সে আর জুয়া খেলবে না। কিন্তু সময়টা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এ বছর আবার খরা, মা কম-কম আলু পাঠাচ্ছেন। সারাক্ষণ ছেলেটির পেটে ধিকিধিকি করে জ্বলে খিদে। পকেটে আলু নিয়ে সে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, কোথাও একটু আগুন জ্বেলে সে আলু পুড়িয়ে খায়।

শেষ পর্যন্ত আবার সে জুয়ার আড্ডায় গেল, দুদিন বাদে সেখানে সে আবার মার খেল। পরের দিন ঠোঁট, নাক ফোলা অবস্থায় গেল স্কুলে। এমনিতেই তার ফরাসি উচ্চারণ খারাপ, ফোলা ঠোঁটের ফরাসি শুনে লিদিয়া মিখাইলোভনা কানে হাত চাপা দিয়ে বললেন, থামো-থামো!

এবার তিনি ঠিক করলেন, ছেলেটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়াবেন। সারাদিন ছেলেটির বুক দুরুদুর করে। মিসের বাড়ি ঝকঝকে তকতকে, সেখানে সে কোথায় কী ভেঙে ফেলবে! সে এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। লিদিয়া মিখাইলোভনা একটা সাদামাটা হাউস ফ্রক আর গরম ফেল্টের চটি পরে হাঁটেন আস্তে আস্তে, সবকিছুই ছেলেটির কাছে অন্য রকম মনে হয়।

একদিন ছেলেটিকে খেয়ে যেতে বললেন লিদিয়া। ছেলেটি যদিও দারুণ ক্ষুধার্ত, তবু লজ্জায় মরে গেল সে। লিদিয়া মিখাইলোভনা কি সাধারণ মানুষের মতন খাবার খান? তিনি তো সব দিক থেকে অসাধারণ। ছেলেটি কিছুতেই খাওয়ার টেবিলে বসতে রাজি হল না, ছুটে পলিয়ে গেল।

তারপর একদিন ওই ছেলেটির নামে এল একটা পার্সেল। ছেলেটি অবাক। তার মা ছাড়া কে আর কে কী পাঠাবে? অথচ মা তো গ্রামের লোকদের হাত দিয়ে জিনিস পাঠান, ডাকে পাঠিয়ে পয়সা নষ্ট করবেন কেন? দারুণ কৌতূহলে ছেলেটি স্কুলের সিঁড়ির নীচে বসে পার্সেলটি খুলল। সুন্দর কাগজের মোড়ক খুলতে বেরিয়ে পড়ল ম্যাকারোনি। মা কোথা থেকে এত দামি জিনিস পেল? কাঁচাই খেতে শুরু করল সেই ম্যাকাররানি, সেগুলোর তলায় সে দেখতে পেল, দুটো বড়-বড় সাদা মিছরি আর দুটি কেক! এবারে সে বুঝতে পারল। এ জিনিস তার মা পাঠাতেই পারেন না। মা হঠাৎ এত বড়লোক হয়ে গেলে নিশ্চয়ই চিঠি লিখে জানাতেন।

তক্ষুনি সবসুদ্ধ প্যাকেট বন্ধ করে সে ছুটে গেল ফরাসি শিক্ষিকার বাড়িতে। তিনি প্রথমে খুব অবাক হওয়ার ভান করলেন। তারপর লজ্জা পেয়ে জিগ্যেস করলেন, তুমি কী করে বুঝলে, আমিই পাঠিয়েছি? ছেলেটি বলল, তার কারণ, আমরা বাড়িতে কোনওদিন ম্যাকারোনি বা কেক খাইনি। মা এসব জিনিসের কথা জানেই না।

ছেলেটি জোর করে প্যাকেটটা ফেরত দিয়ে গেল। মিসের হাজার অনুরোধও সে নিজে রাজি হল না। সে ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল, যদি খিদের বশে হঠাৎ রাজি হয়ে যায়! সে দৌড়ে পালাল।

পড়ানো কিন্তু বন্ধ হল না। আর কোনওদিন সেই পার্সেলের কথা ওঠেনি। ছেলেটি ফরাসি শিখে গেল কিছুদিনের মধ্যেই।

একদিন মিস জিগ্যেস করলেন, তুমি আর আগের মতন পয়সা নিয়ে খেলো না? ছেলেটি বলল, সে তো এখন বিকেলবেলা এখানেই আটকে থাকে। খেলবে কী করে?

মিস জিগ্যেস করলেন, তোমাদের ওই খেলাটার নিয়মটা কী? ছেলেবেলায় আমিও খেলতুম। ভাবছি সেই একইরকম খেলা কি না। তুমি আমাকে বলো না, ভয় কী?

ছেলেটি খেলার নিয়মকানুন জানাল। মিস বললেন, না, আমরা খেলতুম অন্য খেলা। তুমি সেই খেলা খেলবে আমার সঙ্গে?

ছেলেটি অবাক। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

লিদিয়া মিখাইলোভনা বললেন, কেন, মাস্টারমশাইরা কি মানুষ নয়? আমার কি খেলতে ইচ্ছে করে না? আমি একা একা থাকি, আমার বাড়ি অনেক দূরের এক শহরে, আমি ছেলেবেলায় খুব দুষ্টু ছিলুম, এখনও আমার ইচ্ছে করে খেলতে, মাঝে-মাঝে লাফাতে…কিন্তু পাশেই থাকেন হেডমাস্টার…

তারপর দুজনে খেলতে শুরু করল। পয়সা দিয়ে খেলা। একটু পরে ছেলেটি বুঝতে পারল, মিস তাকে ইচ্ছে করে জিতিয়ে দিতে চাইছে। তখন সে রেগে গিয়ে বলল, আমি খেলব না। মিস এবারে সত্যিকারের খেলা খেলতে লাগলেন।

এর পরদিন থেকে ফরাসি পড়া হয় কুড়ি পঁচিশ মিনিট, তারপরেই শুরু হয় খেলা। কোনওদিন ছেলেটি জেতে, কখনও মিস। মাঝে-মাঝে দুজনে ঠিক সমবয়স্কের মতন ঝগড়া করে। দুজনেই দুজনকে খেলার কৃতিত্বে হারাবার চেষ্টা করে। এমনকী মিস মাঝে মাঝে চোট্টামি করেও জিতবার চেষ্টা করে…

এর মাঝখানে হঠাৎ একদিন এক হুঙ্কার শোনা গেল। হেড মাস্টার! ছাত্র ও শিক্ষিকা তখন হাঁটু গেড়ে মুখোমুখি বসে পয়সা গোনা নিয়ে ঝগড়া করছিল। হেডমাস্টার আগে কয়েকবার দরজায় টোকা দিয়েছেন, ওরা শুনতেই পায়নি। তিনি তাই দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছেন। তিনি বিস্ফারিত চোখে বললেন, ছাত্রের সঙ্গে পয়সা নিয়ে খেলা…জুয়া? এমন অন্যায়, এমন পাপ, এমন বিকৃতি…

তিনদিন পরে লিদিয়া মিখাইলোভনা স্কুল ছেড়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে তিনি ছেলেটিকে বলে গেলেন, তুমি পড়াশুনো চালিয়ে যেও, তোমাকে ওরা কিছু শাস্তি দেবে না, সব দোষ আমি নিজে নিয়েছি…।

কিছুদিন পরে, মধ্য শীতে, ছেলেটির নামে আর একটি পার্সেল এল। তার মধ্যে অনেক ম্যাকারোনি আর তিনটি লাল রঙের আপেল। এর আগে ওইরকম আপেল ছেলেটি শুধু ছবিতেই দেখেছে।

গল্পটিতে ছেলেটির কোনও নাম নেই। ১৯৪৮ সালে লেখকেরও বয়েস ছিল এগারো। খুবই সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাময় গল্প।

আর একটি গল্পের নাম ‘চিন্তা’। লেখকের নাম ভাসিলি শুকশিন, এঁর জন্ম ১৯২৯ সালে, মৃত্যু ১৯৭৪। গল্পটি এইরকম :

রাত্তিরে ঠিক ঘুমোবার সময় শুরু হয় এই উপদ্রব। সারাদিন খেটেখুটে সবাই যখন বিশ্রাম নেবে, সেই সময় রাস্তা দিয়ে দৈত্যের মতন চেহারার নিক মালাশকিন বিকট সরে তার আকরডিয়ন বাজাতে-বাজাতে যাবে। সেই বাজনায় একটুও সুর নেই, যেন অসুরের চিৎকার। যে যতই আপত্তি করুক নিক মালাশকিন বুক ফুলিয়ে চলে। এর বিরুদ্ধে কোনও আইন আছে? আমার অধিকার আছে বাজনা বাজাবার।

যৌথ খামারের চেয়ারম্যান মাতভেই রিয়াজানতসেভ-এর বাড়ি একটা তেরাস্তার মোড়ে। গলি থেকে যখন নিক বাজাতে-বাজাতে আসে, তখনও শোনা যায়, যখন সে মোড় পেরিয়ে যায় তখন বেশি করে শোনা যায়। সে বাজনা শুনেই মাতভেই বিছানায় উঠে বসে বলে, ব্যাটাকে কাল দেখে নেব।! যে-কোনও উপায়ে ওকে আমি যৌথ খামার থেকে পরের দিন সে কিছুই করে না অবশ্য। নিককে দেখলে রাগে গজরায় শুধু। আবার রাত্তিরবেলা মাতভেই বলে, ব্যাটাকে যদি কালই না তাড়াই তো কী বলেছি!

মাতভেই-এর আর ঘুম আসে না। সে সিগাটের ধরায়। আকাশ-পাতাল চিন্তা করে।

সেই রকমই এক রাত্তিরে, নিকের বাজনায় তার মেজাজে খিচড়ে গেছে, আর ঘুম আসছে না, মাঝ আকাশে উঠেছে চাঁদ, বাতাসে বুনো বুনো গন্ধ, এমন সময় মাতভেই-এর মনে পড়ে গেল আর একটি রাত্তিরের কথা। সেটা ছিল গাঢ় অন্ধকার রাত, তার ছোট ভাই কুঝমার সে-রাতে হঠাৎ নিশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়েছিল। কুঝমা সারাদিন খাড়া রোদে মাঠে ঘোড়া-গরু চরাতে গিয়েছিল, কয়েকবার ঝরনার ঠান্ডা জল খেয়েছে, তাই রাত্তিরে ওই কাণ্ড! মাতভেই-এর বয়েস তখন তেরো, তার বাবা তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বললেন, সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়াটা নিয়ে সামনের গ্রাম থেকে খানিকটা দুধ আনতে। গরম দুধ খাওরাতে পারলে কুঝমা সেরে যাবে। মাতভেই ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্ধকার রাত, সামনে কিছু দেখা যায় না, তবু তার ঘোড়া যেন মাটি ছুঁচ্ছে না, বাতাসে ভাসছে। সে তার ভাইয়ের কথা ভাবছে না, সে আকাশ দেখছে না, পৃথিবীর কথা মনে নেই, শুধু তার কানে যে বাতাসের আওয়াজ সেটাই সে অনুভব করেছে। তার শরীরে প্রচণ্ড গতির উল্লাস।

দুধ নিয়ে সে ঠিক সময়ে ফিরে এসেছিল, কিন্তু তার ভাই বাঁচেনি।

আকরডিয়নের বিকট সুর শুনে সেই রাতটার কথা মনে পড়ল কেন? তারপর সাতচল্লিশ বছর কেটে গেছে। আরও কত রাতই তো গেছে। তার বিয়ে হল, যৌথ খামার তৈরি হল, তারপর যুদ্ধ এল। অতীতের মধ্যে সবকিছু মিশে গেছে। সে তার কর্তব্য পালন করে গেছে। তাকে বলা হল যৌথ খামারে যোগ দিতে, সে যোগ দিল। বিয়ের সময় হলে বিয়ে করল। সন্তানের জন্ম দিল। যুদ্ধ এল, সে যুদ্ধ করতে গেল, ফিরে এল আহত হয়ে। তারপর সবাই বলল, মাতভেই, তোমাকে চেয়ারম্যান হতে হবে। সে হয়েও গেল। কাজ, কাজ আর কাজ, সারা জীবন শুধু কাজ। যুদ্ধও একটা কাজ। তার আনন্দ, উত্তেজনা, দুঃখ সবই কাজকে ঘিরে। লোকে যখন ভালোবাসার কথা বলে সে অবাক হয়ে যায়। সে জানে পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে একটা জিনিস আছে, ভালোবাসা নিয়ে গান হয়, লোকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কাঁদে, এমনকী একজন আরেকজনকে গুলিও করে! এই যে নিক, সেও কিনা বলে একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে, তাকে খুশি করবার জন্যই রোজ রাতে বাজনা বাজায়। মাতভেই কি কখনও কারুকে ভালোবেসেছে?

সে তার বউ আলিওনাকে ধাক্কা দিয়ে জাগাল। এই ওঠো, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।

বউ ঘুম চোখে ব্যস্ত হয়ে বলল, কী হয়েছে?

–তুমি কি কখনও ভালোবেসেছ? আমাকে কিংবা অন্য কারুকে?

–আজ বেশি মদ গিলেছ তুমি?

–মোটেই না! যা জিগ্যেস করছি উত্তর দাও। আমাকে তুমি ভালোবেসেছিলে? না এ সবই অভ্যেস? এই বিয়েটিয়ে, একসঙ্গে থাকা।

একটু সময় নেওরার পর বউ বলল, নিশ্চয়ই ভালোবেসেছিলুম। মনে নেই, মিক করোলিয়ভ আমায় বিয়ে করার জন্য কত ঝুলোকুলি করেছে, কিন্তু তার বদলে আমি তোমাকে

-ঠিক আছে, ঘুমোও!

-কাল গরুগুলোকে মাঠে নিয়ে যেও। কাল আমি অন্য মেয়েদের সঙ্গে জাম পাড়তে যাব।

-কোন জমিতে? খামারের জমিতে যদি যাও, তোমাদের সবাইকে দশ রুবল করে ফাইন করে দেব!

আবার মাতভেই ভাবে, সেই রাতটার কথা মনে পড়ল কেন? সেই ঘোড়া ছুটিয়ে দুধ আনতে যাওয়া, তার ভাইয়ের মৃত্যু। এত বছর পরে!

আবার শোনা যাচ্ছে নিক-এর বাজনা। সে ফিরে আসছে। সে তার প্রেমিকাকে খুশি করতে চায়। অথচ এই বাজনা শুনলে মাতভেই-এর গায়ে জ্বালা ধরায়।

এবার সে ভাবল একটি সকালের কথা। সে খালি পায়ে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটছে। সবুজের কোমলতা আর ঠান্ডা শিশির লাগছে তার পায়ে। বিছানায় বসে মাতভেই যেন সত্যিই সেই ঠান্ডাটা অনুভব করল।

তারপর সে ভাবল মৃত্যুর কথা। ঠিক ভয় হল না। বরং বিস্ময়। একদিন সব শেষ হয়ে যাবে, তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কবরে, তারপরেও পৃথিবী ঠিকঠাক চলবে। বড়জোর দশ-পনেরো বছর তার কথা মনে রাখবে কেউ-কেউ। সে বউকে জাগাল।

-এই শোনো, তুমি কি মৃত্যুকে ভয় পাও?

-এই লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?

-যা জিগ্যেস করছি, বলো না।

-কে না পরকালের ঘণ্টার কথা ভাবলে ভয় পায়?

-আমি ভয় পাই না।

-তা হলে ঘুমোও! এত চিন্তার কী আছে?

-তুমি ঘুমোও!

আবার মনে পড়ল সেই রাতটার কথা, সেই ঘোড়ার তীব্র গতি, সেই উল্লাস…। মনে পড়লেই মনটা একটা মিষ্টি অনুভূতিতে ছেয়ে যায়। জীবনের একটা কিছু আছে, যা ছাড়তে ইচ্ছে করে না, ছাড়বার চিন্তা করলে চোখে জল আসে।

তারপর এক রাত্তিরে সে নিকের বাজনার প্রতীক্ষায় বসে রইল। সিগারেট টানতে টানতে অপেক্ষা করতে লাগল, কিন্তু কোনও শব্দ নেই। রাত্রি একেবারে শুনশান। অপেক্ষা করতে-করতে সারারাত কেটে গেল, নিক এল না।

ভোর হতেই বউকে জাগিয়ে সে জিগ্যেস করল, ছেলেটা অসুস্থ নাকি?

বউ বলল, ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এই রোববার বিয়ে।

সেদিন মাতভেই নিজেই নিকের সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইল, কী ব্যাপার, তুমি আর বাজনা বাজাচ্ছ না?

নিক একগাল হেসে বলল, আর আপনাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাব না। নিনা আমায় বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে।

মাতভেই বিরক্ত হয়ে ভাবল, অত হাসির কী আছে? দু’দিন বাদেই তো নিনা তোর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে। ওদের বংশটাই ওরকম!

সাতদিন কেট গেল। রাত্রিগুলো এখন নিস্তব্ধ। কিন্তু মাতভেই-এর আর ঘুম আসেনি। সে উঠে সিগারেট খায়। এক চুমুক হালকা মদ খায়। উঠে বাইরে আসে। সিঁড়ির ওপর বসে থাকে। সমস্ত গ্রাম জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে। বড় বেশি নিস্তব্ধতা।

বেল্লা আখমাদুলিনার জন্ম ১৯৩৭ সাল। তাঁর একটি কবিতার নাম ‘অন্য কিছু’।

আমার এ কী হল, প্রায় গোটা বছর
আমি লিখতে পারিনি একটিও কবিতা
আমার ওষ্ঠে এই যে বোঝা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি
এই বধিরতা–বিষম ভারী হয়ে চেপে বসছে আমার ওপর।
কিন্তু…তুমি বলবে…এই তো বেশ একটা স্তবক
চারটে লাইন, ছন্দ এবং মিলও ঠিকঠাক।
কিন্তু সেটা কথা নয়। এসব তো আমি অনেকদিন ধরে শিখেছি।
শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে কবিতার মতন লাইন তৈরি করা।
এ তো অভ্যাস…আমার এক ধরনের দক্ষতা।
এরকম লেখায় কিছু আসে যায় না। তবে কী, হে ভগবান!
কী যেন বেরিয়ে এসেছিল তখন? মাত্র একটি লাইন তো নয়
অন্য কিছু। কী সেই অন্য কিছু, একেবারে ভুলে গেছি!
সেই যে অন্য কিছু, কেন তার এত কুণ্ঠা।
কখনও সাহসী হলে, বেরিয়ে এসেছিল উজ্জ্বল স্বরের মতন
আমার ওষ্ঠের ওপর নেমে এসেছিল হাসির রেখা হয়ে
অথবা আকস্মিক কান্না–কোনটা চেয়েছিল বেছে নিতে?

ইউন্না মরিটস-এর জন্ম ১৯৩৭-এ। তাঁর একটি নামহীন কবিতা এই রকম :

ঠিক টুং টাং বা ঢং ঢং নয়
নয় একটা দোয়েলের ডাক
একটু কান্না, একটু ঝলকানি, নয় দীর্ঘশ্বাসও
আঙুর খেতের মেঘলা সুখের মধ্যে যেন ছুঁয়ে আছে
অথবা লেবু গাছে বাতাসের শিরশিরানির মধ্যে ফুটে ওঠে।
আমি শুনতে পাই মধ্য রাতে, শুনি খুব ভোরে
 গুমোট ও গরমের উন্মুক্ত প্রান্তরে এবং আমার দরজার বাইরে শীতে
এটা কীসের শব্দ? আমি জানতে চাই, কে এত পবিত্র ও নিষ্পাপ
যে তার আত্মার ভেতর থেকে এমন স্বর তুলে আনতে পারে?
সেই শব্দ আমার কাছে আসে যখন নৌকোয়, অথবা চলন্ত ট্রেনে
এমনকী যখন রুটির দোকানে যাই তখনও আসে আমার পিছু পিছু
তার খোঁজে আমি কাটিয়ে দিলুম আমার কিশোরী জীবন
তারপর আর ফেরার পথ নেই, এদিকে সম্পূর্ণ নিঃসম্বল।
গতকাল আমার এক বন্ধু বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছে।
তাকে জানিয়েছে এক ধূর্ত খবর-শিকারি
আমার আত্মা নাকি একেবারে ঝড়-বিধ্বস্ত হয়ে গেছে
কী একটা শব্দ আমাকে বেঁধে রেখেছে চিরকালের মতন।

রাত জেগে আমি যে কয়েকটি গল্প ও কবিতা পড়লুম, সেগুলোর ভাষাৰ্থ তুলে দিলুম এখানে। এগুলি ষাট ও সত্তরের দশকে লেখা। এগুলি থেকে সাম্প্রতিক সোভিয়েত সাহিত্যের খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়। এই লেখাগুলি আমি পড়লুম ‘ল্যান্ড অফ দা সোভিয়েটস ইন ভার্স অ্যান্ড প্রোজ’ দু খণ্ড থেকে। প্রকাশক প্রোগ্রেসিভ পাবলিশার্স! বই দুটি এতই সুমুদ্রিত যে হাতে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। আগাগোড়া আর্ট পেপারে ছাপা, ভেতরে চমৎকার চমৎকারর ছবি।