০৬. নিভা নদীর ওপর বৃষ্টিপাতের দৃশ্য

একে ছুটির দিন, তার ওপর বৃষ্টি পড়ছে। এখন কোথাও যাওয়ার নেই, বসে-বসে আলস্য করতেই ইচ্ছে করে। বেশ বেলা করে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে আমি আর সারগেই বসে আছি হোটেলের দোতলার লবিতে। সামনের দেওয়ালটি পুরো কাঁচের তৈরি। সেই জন্য এখানে বসে-বসেই নিভা নদীর ওপর বৃষ্টিপাতের দৃশ্য উপভোগ করা যায়।

বৃষ্টির জন্য অনেকেই বাইরে বেরুতে পারেনি। এখানকার আবহাওয়া বেশ উপভোগ্য হলেও বৃষ্টি পড়লেই কনকনে শীত পড়ে। এখন মে মাস। কলকাতায় অসহ্য গরম, আর এখানে আমি কোট, সোয়েটার পরে বসে আছি।

সারগেই জিগ্যেস করল, সুনীলজি, বৃষ্টি থামলে বিকেলে কোথায় যাওয়া যায়?

আমি বললুম, লেনিনগ্রাডে এসে আমি আর যাই দেখি বা না দেখি, হারমিটেজ মিউজিয়াম দেখবই!

সারগেই বলল, হ্যাঁ, ওই মিউজিয়াম তো নিশ্চয়ই দেখব। কালকেও সময় আছে।

লবিতে আর যে ক’জন লোক বসে আছে, তাদের মধ্যে একজন ভারতীয়। সেই দিকে আঙুল তুলে সারগেই জিগ্যেস করল, ওই ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক কি বেঙ্গলি?

ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আগে দু-একবার চোখাচোখি হয়েছে, উনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক। প্রবাসে সবসময় বিদেশি ভাষা বলতে-বলতে কখনও হঠাৎ মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ পেলে বেশ আরাম হয়। কিন্তু একজন ভারতীয়ের সঙ্গে আর একজন ভারতীয়ের দেখা হলেই সে সুখ পাওয়া যায় না। ওই ভদ্রলোকটি দক্ষিণ ভারতের কোনও রাজ্যের, আমরা পরস্পরের ভাষা একবর্ণ বুঝব না। কথা বলতে হবে কষ্টকল্পিত ইংরিজিতেই।

আমি সারগেইকে বললুম, উনি দক্ষিণ ভারতীয়, তবে কোন রাজ্যের তা জানি না। সারগেই উঠে গিয়ে ভদ্রলোককে তামিল ভাষায় কী যেন জিগ্যেস করল। তিনি প্রায় ভূত দেখার মতন চমকে উঠলেন।

সারগেই ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে এল আমাদের টেবিলে। আনন্দের আতিশয্যে ভদ্রলোক অনেক গল্প জুড়ে দিলেন সারগেই-এর সঙ্গে। আমি বোবা হয়ে বসে রইলুম।

তারপর সারগেই আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ করিয়ে দিল। ভদ্রলোকের নাম শ্রীযুক্ত সুব্রহ্মণ্যীয়ম, তিনি অঙ্কের পণ্ডিত, ক্যানাডার কোনও শহরে অধ্যাপনা করেন। লেনিনগ্রাডের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় মাসের জন্য একটি সেমিনারে যোগ দিতে এসেছেন। তিনি নিরামিষ খান বলে খাবারদাবারে কিছু অসুবিধে হচ্ছে এবং একাতিত্ব ভোগ করছেন। সারগেইকে পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত।

সারগেই-এর মুখে আমার পরিচয় শুনে তিনি জানালেন যে তিনিও কবিতা লেখেন। তাঁর তামিল ভাষায় লেখা কবিতার ইংরেজি অনুবাদও তাঁর সঙ্গেই আছে। হাত-ব্যাগ খুলে তিনি সাইক্লোস্টাইল করা কবিতা বার করে দিলেন।

সেই কবিতা কয়েক লাইন পড়েই আমি চোখ তুলে নিলুম। ধর্মীয় বিষয়বস্তু ও উচ্চ দার্শনিকভাবের ব্যাপার, খটোমটো ইংরেজিতে লেখা। এই ধরনের রচনা সম্পর্কে আমি কোনও আগ্রহ বোধ করি না।

সারগেই ও শ্রীযুক্ত সুব্রহ্মণ্যীয়ম গল্প করতে লাগলেন। আমি চুপ করে বসে রইলুম খানিক্ষণ। তারপর ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলুম নিজের ঘরে।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়েই চলেছে। নিভা নদীটি বেশ চওড়া, বৃষ্টিতে তাকে বেশ উচ্ছল দেখাচ্ছে। সব নদীই নিশ্চয়ই বৃষ্টি পছন্দ করে। বৃষ্টি তো নদীর খাদ্য। মাঝে মাঝে লঞ্চ যাচ্ছে। এসব দেশে কাঠের নৌকো উঠে গেছে বহুদিন, তবু কল্পনায় আমি যেন একটা নিঃসঙ্গ পাল তোলা নৌকো দেখতে পাই। এই পাশ্চাত্য নগরীতে বসেও আমার মন চলে যায় পদ্মানদীর প্রান্তে।

প্রকৃতির কোনও সুন্দর দৃশ্য পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি দেখা ঠিক নয়। তাতে সমগ্রের বদলে অংশের দিকে চোখ চলে যায়। জানলার কাছ থেকে সরে এসে আমি টিভি খুললুম। মোট তিনটি চ্যানেল। একটিতে হচ্ছে একটি ছোটদের ফিলম। একটিতে হচ্ছে কনসার্ট, আর একটিতে খেলাধুলো। এরা গান-বাজনা খুব ভালোবাসে। যখনই টিভি খুলি, তখনই কোনও-কোনও চ্যানেলে উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত শুনতে পাই। রুশ ভাষায় যখন খবর হয়, তখন ভাষা বুঝতে না পারলেও মাঝে-মাঝে ইন্ডিয়া, ইন্দিরা গান্ধি, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব এইসব শব্দ কানে আছে। প্রায় প্রতিদিনই ভারতের উল্লেখ, এটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার। পশ্চিমি দেশগুলিতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ টিভি খবর শুনলে মনে হয় ভারত নামে কোনও দেশেরই অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে।

হঠাৎ মনে হল তিন-চারদিন আমি কোনও খবরের কাগজ পড়িনি। ইংরিজি কাগজ এখানে বেশ দুর্লভ, খোঁজও করিনি আমি। কিন্তু কয়েকদিন খবরের কাগজ না পড়ায় আমার শরীর বা আত্মার কোনও ক্ষতি হয়েছে বলে তো মনে হয় না।

খানিকবাদে সারগেই এসে দুষ্টু হেসে বলল, ওই দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক সন্ধেবেলা আপনার ঘরে এসে কিছু কবিতা পড়ে শোনাতে চান। আপনি কি ইন্টারেস্টেড?

আমি বললুম, সন্ধেবেলা তো আমরা হোটেলে থাকব না!

-সন্ধেবেলা কোথায় যাব?

–কোনও পার্কে বসে আকাশ দেখব। সারগেই হো-হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, তামিল ভাষাতে এখন অনেক ভালো কবিতা লেখা হয়। কিন্তু এই ভদ্রলোক খুব প্রাচীনপন্থী।

আমি বললুম, বহুদিন দেশের বাইরে আছেন, তাই আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে যোগ নেই।

তখন সারগেই আমায় কিছু কিছু আধুনিক তামিল কবিতা তর্জমা করে শোনাল। সেগুলো বেশ লাগল আমার।

আমি বললুম, তুমিও তো কবিতা লেখো। এবারে কিছু কবিতা শোনাও!

প্রথমে বেশ লজ্জা পেয়ে গেল সারগেই। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু আমি ছাড়ব কেন? শেষ পর্যন্ত কিছু-কিছু লাইন শোনাতে লাগল। ওর বেশ কল্পনাশক্তি আছে। ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েও কিছু কবিতা লিখেছে সারগেই। তার মধ্যে একটি কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে পুঁটে। ভারতের গ্রামে-গঞ্জে-শহরের দেওয়ালে-দেওয়ালে দেখতে পাওয়া যায় খুঁটে। সেইসব ঘুঁটের মধ্যে যে পাঁচটা আঙুলের ছাপ পড়ে, সেটাই আকৃষ্ট করেছে সারগেইকে। যেন ওপরের দিকে বাড়ানো হাজার-হাজার হাত। নীরব, অথচ কিছু বলতে চায়।

সারগেই-এর কবিতা কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, এখনও কোনও বই বেরোয়নি। বই যার করা সহজ নয়। আমাদের দেশে তরুণ কবিরা অনেকেই নিজের খরচে বই ছাপে। কিংবা অনেক ছোট প্রকাশক আছে, তাদের মধ্যে যদি কেউ ইচ্ছে করে তো ছাপিয়ে দিতে পারে। এ দেশে ব্যক্তিগত মালিকানায় কোনও প্রকাশনায় নেই। কবিরা তাদের পাণ্ডুলিপি জমা দেয় সরকারি প্রকাশনালয়ে। সেখানকার বিশেষজ্ঞরা যদি মনোনীত করেন, তবে বই ছাপা হয়। সেজন্য সময় লাগে। অবশ্য পত্র-পত্রিকাতে লেখার সময়ই যদি কারুর কবিতা খুব বিখ্যাত হয়ে যায়, তবে তার বই নিশ্চয়ই ছাপা হয় তাড়াতাড়ি। ইয়েফতুশেংকোর খ্যাতি যখন আমাদের কাছে পৌঁছেছে তখন তার বয়েস কুড়ি-একুশ।

পরদিন আমরা গেলুম একটি যুব পত্রিকার দফতরে। ঠিকানা খুঁজে পেতে খানিকটা ঝামেলা হল। তার ফলে অবশ্য লেনিনগ্রাড শহরটি অনেকখানি দেখা হয়ে গেল।

গত মহাযুদ্ধে এই লেনিনগ্রাড শহরে যে সাংঘাতিক লড়াই হয়েছিল এবং এখানকার নাগরিকরা অসীম সাহস আর মনোবল দেখিয়েছিল, তা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরকাল লেখা থাকবে। নাতসি বাহিনী এই শহরটি অবরুদ্ধ করে রেখেছিল ৯০০ দিন, তবু লেনিনগ্রাডের পতন হয়নি। নিয়মিত বোমা ও কামানের গোলা বর্ষণ হয়েছে, স্থলপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ফলে খাদ্যদ্রব্য ফুরিয়ে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত অনেকে নাকি কুকুর-বেড়াল পর্যন্ত খেয়েছে, তবু এখানকার নাগরিকরা নাতসি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। শুধু অনাহারেই সেবার ছ’লক্ষ নারী-পুরুষের মৃত্যু হয়েছিল।

সেই যুদ্ধের কোনও চিহ্নই এখন নেই। কোনও ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে না। বড়-বড় পার্ক, সুন্দর সুন্দর বাড়ি, চওড়া রাস্তা ও মাঝে-মাঝেই দৃষ্টি কেড়ে নেবার মতন ভাস্কর্য। লেনিনগ্রাডের নাগরিকরাও বেশ সুসজ্জিত, অনেক মহিলার অঙ্গে ফ্যাসনেবল পোশাক, জিনস পরিহিত যুবকদেরও দেখা যায়।

লেনিনগ্রাডে কিছু কিছু পুরোনো পাড়াও রয়েছে। এখানকার বাড়িগুলো ব্যারাকবাড়ির মতন; রাস্তা দিয়ে ট্রাম চলে, ট্রাম লাইন থাকলেই সেইসব রাস্তা কিছুটা ভাঙা ভাঙা হয়। এখানে সেখানে জল জমে থাকে। এই এলাকায় বেশ একটা কলকাতার সঙ্গে মিল খুঁজে পেলুম। নিউ ইয়র্ক শহরেও বেশ কয়েকটা রাস্তা আছে এরকম, ভাঙা-ভাঙা, পাশে জঞ্জাল জমে থাকা, ও মানুষের ভিড় দেখে কলকাতার কথা মনে পড়েছিল আমার। পৃথিবীর যেখানেই যাই, কলকাতার সঙ্গে মিল খুঁজি।

যুব পত্রিকাটির অফিস কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিক রাস্তায় এসেছি, ঠিক নম্বরের বাড়ির সামনে এসেছি, কিন্তু সেখানে কোনও পত্রিকা অফিস নেই। সারগেই একটুতেই নার্ভাস হয়ে যায়, সে ছোটাছুটি করতে লাগল। এদেশে সবাই খুব ঘড়ির কাঁটা মেনে চলে। আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। সারগেই একটা টেলিফোন বুথে ঢুকে টেলিফোন গাইড দেখে ঠিকানাটা চেক করে এল। ঠিকই আছে, তা হলে পত্রিকার অফিসটা গেল কোথায়? রাস্তায় দু-একজন পথচারীকে জিগ্যেস করা হল, তাঁরা কোনও সাহায্য করতে পারলেন না। দু-একজন মনে হল পত্রিকাটির নামই শোনেননি। রাস্তায় এ সময় অধিকাংশই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তারা যুব-পত্রিকা পড়েন না!

শেষ পর্যন্ত হদিশ পাওয়া গেল। আমাদের কাছে যে ঠিকানা লেখা আছে, ঠিক তার পাশের বাড়িতেই পত্রিকা অফিসটি কিছুদিন আগে উঠে গেছে। আমরা সে বাড়ির সামনে দিয়েই কয়েকবার ঘুরে গেছি। শীতের মধ্যেই সারগেই-এর কপালে প্রায় ঘাম জমে গিয়েছিল, এবারে সে নিশ্চিন্ত হল।

পত্রিকাটির নাম ‘‘অরোরা’। সারা দেশের স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা এখানে লেখা পাঠাতে পারে। এইরকম পত্রিকা থেকেই নতুন-নতুন সাহিত্য-প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়। এঁদের নিজস্ব প্রেস আছে, প্রচার সংখ্যা আড়াই লক্ষ’র বেশি।

কলেজ জীবনে আমিও কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা-পত্রিকা সম্পাদনা করেছি, প্রথম দিকে বেশ কয়েক বছর তাতে শুধু তরুণ লেখকদের রচনা ছাপা হত, এবং আমাদের মুদ্রণ সংখ্যা কোনওক্রমে টেনেটুনে এক সময় আড়াই হাজার পর্যন্ত উঠেছিল। সে পত্রিকা চালাবার জন্য আমাদের কখনও কখনও ভিক্ষে পর্যন্ত করতে হত। বন্ধু-বান্ধবরাই ঘাড়ে করে সে পত্রিকা পৌঁছে দিত স্টলে স্টলে, লেখকদের সম্মান-দক্ষিণা দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না। শিল্পীরাও বিনা পয়সায় এঁকে দিতেন মলাট। সেই জন্যই এখানকার যুব পত্রিকার পরিচালনা ব্যবস্থা জানবার জন্য আমার আগ্রহ ছিল।

এ দেশে পত্রিকার খরচ তোলার ব্যাপারে বিজ্ঞাপনের জন্য ঘোরাঘুরি ও হ্যাংলামির প্রয়োজন হয় না, ছাপার খরচ জোগাড় করার দুশ্চিন্তা নেই। কারণ সরকারই এর পৃষ্ঠপোষক। সোভিয়েত ইউনিয়ানে যে-কোনও পত্র-পত্রিকায় কোনও লেখা ছাপা হলেই লেখককে টাকা দেওয়া হয়। পত্রিকার প্রচার সংখ্যা অনুযায়ী টাকার অঙ্ক বাড়ে কমে। এদেশের একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় একটি মাত্র ছোট গল্প লিখে সাত-আট হাজার টাকা (আমাদের হিসেবে পাওয়া আশ্চর্য কিছু নয়। পত্র-পত্রিকার সংখ্যা অনেক, সেই জন্য যার কিছুমাত্র সাহিত্য-প্রতিভা আছে, তার পক্ষেই আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাওয়া সহজ।

অরোরা পত্রিকার সম্পাদক কিন্তু অল্পবয়েসি যুবক নয়। টাক-মাথা একজন ভদ্রলোক। তিনি ইংরিজি জানেন না, কথাবার্তা চলছিল সারগেই-এর মাধ্যমে। নানান আলাপ আলোচনার পর আমি জিগ্যেস করলুম, আপনারা যে রচনা নির্বাচন করেন, তার কি কোনও গাইড লাইন আছে? আপনারা কি বিষয়বস্তু ঠিক করে দেন?

তিনি হেসে বললেন, না, যার যা খুশি লিখতে পারে। তবে, আমাদের তরুণ লেখকরা সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য, শ্রমিক-কৃষক ঐক্য, সম-ভ্রাতৃত্ব, বিশ্বশান্তি এসব বিষয়েই লেখে।

আমি বললুম, সে তো বটেই। সব কবিই এসব চায়। কিন্তু তরুণ বয়েসে একটা বিদ্রোহের মনোভাব থাকে, বিশেষত আগেকার লেখকরা যা লিখেছেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থাকে, কোনও-কোনও মূল্যবোধকে ভাঙতেও চায়।

তিনি বললেন, সেরকম কেউ এখানে লেখে না।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সে কী! এখানে তরুণ লেখকদের মধ্যে অন্য কোনও বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা, কিংবা ফর্ম ভাঙার ঝোঁক নেই?

তিনি বললেন, কেউ সেরকম লিখলে আমরা তাদের চিঠি লিখে জানাই কোথায় কোথায় ভুল হচ্ছে, তাদের পরামর্শ দিই।

আমি বললুম, কাল রাত্রেই আমি বেল্লা আখমাদুলিনা-র একটি কবিতা পড়েছি, তার নাম ‘সামথিং এলস’, চমৎকার কবিতা! এই কবিতাটির সেরকম কোনও বিষয়বস্তুই নেই, কবিতা লিখতে না পারার দুঃখ নিয়ে লেখা। এটাই তো একটা নতুন ফর্ম, পুরোনো ফর্মের প্রতিবাদ!

সম্পাদক মশাই আবার জোর দিয়ে বললেন, আমাদের নতুন লেখকরা যাতে আদর্শবাদ, সম-ভ্রাতৃত্ব, বিশ্বশান্তি নিয়ে লেখে, সেটাই আমরা চাই…।

সম্পাদক মশাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি আমার ঠিক মনঃপূত হল না। যেন তিনি একটি উঁচু আসনে বসে তরুণ লেখকদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। অবশ্য এমনও হতে পারে, ভাষার ব্যবধানের জন্য আমরা পরস্পরের বক্তব্য ঠিক বোঝাতে পারিনি।

চা খেয়ে আমরা বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালুম। আমাদের পাশেই আর একজন অত্যন্ত রূপবান যুবক আগাগোড়া চুপ করে বসেছিল। আমি ভেবেছিলুম সে ইংরেজি জানে না। তার সঙ্গে করমর্দন করতে যেতেই সে নিখুঁত ইংরেজি উচ্চারণে বলল, চলুন, আমি আপনাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছি।

এই যুবকটি এখানকার এ পি এন অফিসের একজন কর্মী। এত সুন্দর চেহারা, ওকে চলচ্চিত্রের নায়ক হলেই যেন মানাত। ওর ব্যবহারও খুবই ভদ্র। সে আমাকে জিগ্যেস করল, লেনিনগ্রাড আপনার কেমন লাগল?

আমি বললুম, খুবই তো ভালো লাগছে। মে-দিবসের প্যারেড দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু এত বড় শহর, এখানে কত কী দেখার আছে, কিন্তু অনেক কিছুই দেখা হল না। তাই একটা অতৃপ্তি থেকে যাচ্ছে।

যুবকটি বলল, নিশ্চয়ই এখানে অনেক কিছু দেখবার আছে। তবে এখন ছুটির সময় চলছে, তা ছাড়া বৃষ্টি পড়ছে।

সারগেই বলল, আজ সন্ধেবেলাতেই আমাদের চলে যেতে হবে।

আমি বললুম, হারমিটেজ মিউজিয়াম কিন্তু দেখতেই হবে।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করা সম্ভব নয়। আমরা একটা ট্যাক্সি ধরে নিলুম।

হারমিটেজ মিউজিয়ামটিকে কেউ-কেউ ফরাসি কায়দায় ‘অ্যারমিতাঝ’ বলে। আমি ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’ স্মরণ করে চট করে বিদেশি উচ্চারণের অনুকরণে সাহস পাই না, ইংরিজিতে সন্তুষ্ট থাকি।

এই হারমিটেজ মিউজিয়াম উইন্টার প্যালেসের সংলগ্ন, সেটাও এখন মিউজিয়াম। এই দুটি প্রাসাদ মিলে যে মিউজিয়াম তা বিশ্বে বৃহত্তম। এর পুরোটা সাতদিনেও দেখে শেষ করা বোধহয় সম্ভব নয়, আমাদের হাতে আছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা।

সারগেই বলল, এই মিউজিয়ামে অনেক ভারতীয় ঐতিহাসিক জিনিসপত্তর আছে শুনেছি, চলুন আগে সেগুলো দেখে নিই।

আমি বললুম, সারগেই, আমি ইন্ডোলজিস্ট নই। আমাদের দেশেই যা ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি আছে, তার অনেক কিছুই এখনও দেখা হয়নি। বিদেশে এসে ভারতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার আগ্রহ আমার নেই। এত বড় মিউজিয়ামে এদিক-ওদিক

ঘুরি করতে গেলে ক্লান্ত হয়ে যাব। আমি কি দেখব তা আগেই ঠিক করে রেখেছি। আমি জানি, ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের কিছু ভালো কালেকশান আছে এখানে, আমি শুধু সেগুলিই দেখতে চাই, যা পৃথিবীর আর অন্য কোথাও দেখা বাবে না।

সারগেই একটু কৌতূহলী চোখে তাকাল আমার দিকে। তারপর জিগ্যেস করল, ফরাসি ছবি সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহ হল কী করে? আপনারা কি আপনাদের দেশে ওরিজিনাল ছবি দেখতে পান?

আমি হেসে বললুম, না, আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। আমাদের দেশে যারা ফিলমে উৎসাহী, বার্গমান, ফেলিনি, গদার, বনুয়েল, ওয়াইদা, কুরোশোওয়ার নাম তাদের মুখে-মুখে, তাদের সব ছবির কাহিনি ও ট্রিটমেন্টের অভিনবত্ব তাদের মুখস্থ, যদিও ওঁদের ফিলম দেখার সুযোগ নেই। কালেভদ্রে যে দু-চারটি ছবি দেখানো হয় তাও দশ-পনেরো বছরের পুরোনো। যারা শিল্প ভালোবাসে, তারা মাতিস, পিকাসো, ব্রাক, রুয়ো, মার্ক শাগাল-এর নামে প্রায় উন্মাদ, যদিও ওঁদের ওরিজিনাল ছবি প্রায় কেউ-ই দেখেনি। কিন্তু সেটা কি দোষের? আমাদের গরিব দেশ বলে পৃথিবীর শিল্প-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ফসলগুলি আমাদের কাছে পৌঁছয় না। কিন্তু শ্রেষ্ঠ জিনিস সম্পর্কে আমাদের যে আগ্রহ ও কৌতূহল আছে, সেটা কি কম কথা?

সারগেই বলল, সত্যি খুব আশ্চর্য ব্যাপার!

মিউজিয়ামে ঢুকে অন্যান্য ভালো ভালো জিনিস বাদ দিয়ে আমরা চলে এলুম ছবির ঘরের দিকে।

জারদের আমলেই মূল্যবান ছবির সংগ্রহ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাসিরা তস্করবৃত্তি করে নানান দেশ থেকে যেসব বিখ্যাত ছবি নিজেরা কুক্ষিগত করে রেখেছিল, বার্লিন জয়ের পর রেড আর্মি তার অনেকগুলি দখল করে নেয়। সব মিলিয়ে এখানে বহু ছবির দুর্লভ সমাবেশ।

ঘুরতে-ঘুরতে আমি চমৎকৃত হয়ে গেলুম সারগেই-এর ছবি সম্পর্কে জ্ঞান দেখে। মাত্র বাইশ বছর তার বয়েস, কিন্তু সে গত শতাব্দীর ছবির জগতের নানান আন্দোলন, প্রত্যেক শিল্পীর আলাদা বৈশিষ্ট্যের কথা জানে। আমার থেকে অনেক বেশিই জানে। আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছিল, সে আমাকে ডেকে দুই দেয়াল ভরতি দেগা-র অনেকগুলি ছবি দেখাল। মোনে ও মানের ছবি বোঝাল আলাদা করে। আমি দেখতে চাইছিলুম ক্যান্ডিনস্কির ছবি, তার খোঁজে সে ঘুরতে লাগল এঘর ওঘর।

এইসব ছবি বিশেষ মূল্যবান এই কারণে যে এইসব ছবির প্রিন্টও খুব দুর্লভ।

সারগেই একবার আমাকে ডেকে জিগ্যেস করল, আপনার টিনটেরেট্টোর ছবি ভালো লাগে না? এই দেখুন

আমার মজা লাগল। একটি কিশোরপাঠ্য গোয়েন্দা কাহিনি লিখে আমাদের দেশে টিনটেরোট্টোকে নতুন করে জনপ্রিয় করেছেন সত্যজিৎ রায়। এখানে টিনটেরেট্টোর একাধিক ছবি আছে। তার মধ্যে একটি আবার যিশুরা

কখন দু-ঘণ্টা পার হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। সারগেই আমাকে মাঝে মাঝে তাড়া দিচ্ছে, আমাদের সন্ধের সময় ট্রেন ধরতে হবে। আরও অনেক ছবি দেখা বাকি, সেইজন্য একটু দ্রুত পা চালাতে হল। এক সময় একটি নারীর ভাস্কর্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। শিল্পীর নাম আমার চেনা নয়। কিন্তু মূর্তিটি অপূর্ব!

তারপর এক সময় আমি সারগেইকে হারিয়ে ফেললুম।