০৩. রাজার নব বধূ

অপেরাটির নাম, অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘রাজার নব বধূ’। ষোড়শ শতকের আইভান দা টেরিবল-এর আমলের ঘটনা, একটি বিয়োগান্তক প্রণয় কাহিনি। সারগেই আমাকে সংক্ষেপে বিষয়টি বুঝিয়ে দিল, যদিও অপেরা-তে কাহিনির ভূমিকা যৎসামান্য।

আমি প্রথমেই সবিস্ময়ে লক্ষ করলুম মঞ্চসজ্জা। প্রোসেনিয়ামটি প্রকাণ্ড, ধরা যাক আমাদের রবীন্দ্র সদনের প্রায় আড়াই গুণ, মাঝে মাঝেই প্রায় শ’ খানেক অভিনেতা অভিনেত্রী এক সঙ্গে মঞ্চে থাকছেন, তবু মঞ্চটিকে ভিড়ে ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছে না। মঞ্চের ঠিক মাঝখানে একটি মহীরুহ। অসংখ্য ডালপালা ছড়ানো আস্ত একখানা জলজ্যান্ত গাছকে কী করে মঞ্চের ওপরে স্থাপন করা গেল তা ভেবে আমি অবাক হচ্ছিলুম, তারপর খুব নজর করে বুঝলুম, গাছটি সত্যিকারের না, সিনথেটিক, অতি সূক্ষ্ম মাকড়সার জালের মতন তার দিয়ে ডালগুলো ওপর থেকে বাঁধা, তবে তা বোঝা খুবই শক্ত। মঞ্চে এত বড় গাছ আমি আগে কখনও দেখিনি।

মঞ্চের পেছনে বাঁ-দিকে একটা রাস্তা, মনে হয় অনেক দূর থেকে লোকেরা হেঁটে আসছে। মঞ্চের ডেপথ সত্যিই অতখানি না কোনও মায়া সৃষ্টি করা হয়েছে তা আমি ঠিক ধরতে পারলুম না।

আমরা বসেছি সামনের দিকে দামি আসনে। প্রেক্ষাগৃহটি পরিপূর্ণ। মনে হয় যেন পুরুষের চেয়ে মহিলা-দর্শকের সংখ্যা অনেক বেশি। তিন-চারজন করে মহিলা এক সঙ্গে এসে বসেছেন, সঙ্গে কোনও পুরুষ নেই। এমনকী কোনও-কোনও মহিলা একাও এসেছেন বোঝা যায়, কেন না, বিরতির সময়েও কারুর সঙ্গে কোনও কথা বলছেন না। আমাদের পাশেই বসেছেন দুই অসম বয়েসের নারী, ওঁরা এক সঙ্গে এসেছেন, খুব সম্ভবত মাসি-বোনঝির মতন সম্পর্ক। এই ব্যাপারটি একটু অভিনব লাগল, কেননা, পশ্চিমি দেশগুলিতে দেখেছি, পুরুষ-বন্ধু বা স্বামী ছাড়া মেয়েদের একা-একা সিনেমা থিয়েটার দেখার প্রথা নেই।

অপেরাটির নট-নটী বা গায়ক-গায়িকাদের নাম আমি জানি না, সারগেই একটা স্মারক পুস্তিকা এনে দিয়েছে বটে, কিন্তু তা সবই রুশ ভাষায় লেখা। তবে সারগেই জানাল, রানির ভূমিকায় যিনি গাইছেন, তিনি খুবই বিখ্যাত এবং এই অপেরাটি খুব জনপ্রিয়, কয়েকশো রাত চলছে।

প্রথম অঙ্কের বিরতির সময় আমি বাইরে গেলুম সিগারেট টানতে। প্যাকেটটি খোলা মাত্র একজন লোক এসে হাত বাড়িয়ে কিছু বললেন। বুঝলুম সিগারেট চাইছেন। আমি ভারতীয় সিগারেট নিয়ে গেছি, সাগ্রহে প্যাকেটটি বাড়িয়ে দিয়ে বললুম, দেখুন, আপনার ভালো লাগে কি না। ভদ্রলোক ইংরিজি জানেন না, তবে সিগারেট ধরিয়ে তিনি তাঁর মাতৃভাষায় যা বললেন, তাতে অনুমান করলুম তার পছন্দ হয়েছে।

দ্বিতীয় অঙ্কের বিরতির সময় সারগেই আমাকে নিয়ে এল দোতলায়। এখানে রয়েছে একটি ছোট রেস্তোরাঁ, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। এখানে পাওয়া যায় কয়েক রকমের স্যান্ডউইচ আর গরম-গরম সসেজ ভাজা, বিয়ার আর ছোট-ছোট ওয়াইনের বোতল। ভাগ্যিস আগেই ডিনার খেয়ে নিইনি, তাই এখন এই হালকা ধরনের সুখাদ্য দিয়ে নৈশভোজ সেরে নেওয়া গেল।

তৃতীয় অঙ্কটি আমি আর তেমন উপভোগ করতে পারলুম না, আমার ঘুম এসে গেল। ক্রেমলিন প্রাসাদের অভ্যন্তরে সুরম্য থিয়েটার হলে বিখ্যাত রুশ অপেরা দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়া খুবই লজ্জার কথা! এরকম সুযোগ ক’জন পায়? কিন্তু ঘুম এসে গেলে আমি কী করব? ভাষা এক বর্ণ বুঝছি না, অপেরার হাই-পিচের গান বেশিক্ষণ উপভোগ করার মতন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের জ্ঞানও আমার নেই। ক’জন সাহেব ভীমসেন যোশীর গান ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতে পারে? আমি থুতনিতে চিমটি কাটলুম, হাতের নোম টানলুম, বাঁ-হাতের কড়ে আঙুল বেঁকিয়ে ফেললুম, কিছুতেই কিছু হয় না। ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন, এইরকম অবস্থায় ঘুম তাড়ানো কত শক্ত। আশেপাশের লোকরা হয়তো আমাকে দেখছে চুলে-ঢুলে পড়তে। শেষ পর্যন্ত মাথা হেলান দিয়ে দু-হাতের তালুতে মুখ অনেকখানি ঢেকে গভীর মনোযোগের ভঙ্গি করে রইলুম। কে জানে নাক ডেকেছিল কি না!

আশ্চর্য ব্যাপার, শো শেষ হওয়ার পর বাইরে আসতেই ঘুম একেবারে হাওয়া।

গাড়িটা আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সারগেই জিগ্যেস করলো, সুনীলজি, হেঁটে যাবেন? এখান থেকে হোটেল খুব দূর নয়।

আমি তক্ষুনি রাজি। হেঁটে না ঘুরলে কোনও শহরই ভালো করে চেনা যায় না। রাত মোটে পৌনে দশটা। টিপি-টিপি বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু শীত খুব বেশি নয়। ওভারকোটের পকেটে দু-হাত ভরে সাহেবি কায়দায় হাঁটতে লাগলুম।

অন্যান্য পশ্চিমি বড় শহরের তুলনায় মস্কোর রাত্তিরের রাস্তার চাকচিক্য, স্বাভাবিক কারণেই, অনেক কম। রাস্তায় আলো যথেষ্ট আছে, কিন্তু প্যারিস-লন্ডন-নিউ ইয়র্কের রাস্তায় যে অসংখ্য দোকানপাট আর বিজ্ঞাপনের রঙিন ঝলমলে আলো, তা এখানে নেই। সোভিয়েত দেশে কোথাও বিজ্ঞাপন নেই, কারণ সমস্ত ব্যাবসাই এদেশে সরকার পরিচালিত, সুতরাং পণ্যদ্রব্যের ভালো-মন্দ প্রমাণ করার বিজ্ঞাপন-প্রতিযোগিতার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

মিনিট কুড়ির মধ্যেই পৌঁছে গেলুম হোটেলে। দরজার কাছ থেকে সারগেই বিদায় নিল। তাকে যেতে হবে অনেক দূরে।

হোটেলের প্রত্যেক তলায় একজন করে মহিলা বসে থাকেন। হোটেল থেকে আমাকে একটা কার্ড দেওয়া হয়েছে, সেটা জমা দিলে ঘরের চাবি পাওয়া যায়। আমার হাতে চাবিটি তুলে দেওয়ার সময় প্রবীণ মহিলাটি মিষ্টি হেসে কত কী বললেন, হায়, কিছুই বুঝতে পারলুম না। আমি ঘাড় নেড়ে বললুম, পাসিবো, পাসিবো, অর্থাৎ ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!

ঘরে এসে জামা-কাপড় ছাড়ার পর বেশ চাঞ্চল্য বোধ করলুম। এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব? মাত্র রাত দশটায় ঘুমোনো আমার পক্ষে অসম্ভব। অপেরা দেখতে-দেখতে যে ঘুম ভর করেছিল, তা একেবারে উপে গেছে! বাইরের আকাশ পুরোপুরি অন্ধকার নয়। এখন আড্ডা মারতে ইচ্ছে করছে। ঘরে একটা টেলিফোন আছে, তারও তো ব্যবহার করা দরকার। দেশ থেকে মণীন্দ্র য়ায় লিখে দিয়েছেন ননী ভৌমিকের ঠিকানা। কিন্তু ফোন নাম্বার দেননি। নবনীতা দেবসেন তাঁর এক বান্ধবীর জন্য একটি উপহারের পুঁটুলি পাঠিয়ে দিয়েছেন, সঙ্গে আছে সেই বান্ধবীর ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার। বান্ধবীর নাম সায়েলা।

অপারেটরকে প্রথমে জিগ্যেস করলুম, তিনি আমাকে ননী ভৌমিকের ফোন নাম্বার জোগাড় করে দিতে পারেন কি না। তিনি বোধহয় আমার ইংরেজি বুঝতে পারলেন না। তারপর আমি সায়েলার টেলিফোন নাম্বার দিয়ে লাইন ধরে দিতে বললুম।

ওপাশে শোনা গেল একটি পুরুষকণ্ঠ। তিনি বললেন যে সায়েলা এখন একটু ব্যস্ত আছেন, তাঁর সঙ্গে আমার কী দরকার এবং আমি কে?

সায়েলা-কে আমি কখনও চোখে দেখিনি, শুধু এইটুকু জানি, তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা শ্রীপাদ অমৃতপাদ ডাঙ্গের কন্যা। আমি পুরুষকণ্ঠটিকে নবনীতা দেবসেন-এর উপহার বিষয়ে জানালুম। তিনি প্রথমে একটুক্ষণ নবনীতা দেবসেন কে তা চিনতে পারলেন না। আমি নানারকম উচ্চারণে নবনীটা, নবনী-ই-টা এইরকমভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলুম। তাতে বিশেষ কিছু সুবিধে হল না। আমি কালই লেনিনগ্রাড চলে যাব, ফিরব দশদিন বাদে, সুতরাং উপহারটা কাল সকালের মধ্যেই পৌঁছে দিলে আমার পক্ষে সুবিধে হয়। তখন তিনি বললেন যে তাঁর বাড়ি আমার হোটেলের খুবই কাছে, এই রাত্তিরেই তিনি এলে আমার কোনও আপত্তি আছে কি না।

আমি শুনে উৎফুল্ল হলুম। যাক তবু একজনের সঙ্গে গল্প করা যাবে।

মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনি পৌঁছে গেলেন, পুরোদস্তুর সাহেবি কেতায় সজ্জিত একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। তাঁর নাম রাজা আলি। তিনি বললেন যে তাঁর স্ত্রী নবনীতা দেবসেনকে খুব ভালোই চেনেন, তিনিও এখন মনে করতে পেরেছেন, নবনীতা এই তো কিছুদিন আগে মস্কো ঘুরে গেলেন।

পুঁটুলিটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি এদেশে কতদিন আছেন?

তিনি আঠারো…কুড়ি বছর, কী জানি, আই লস্ট কাউন্ট!

কিন্তু রাজা আলির সঙ্গে আমার আড্ডা জমল না। তিনি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, আমিও তেমন তুখোড় কথাবাজ নই। তিনি একবার শুধু জিগ্যেস করলেন, আমি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চিনি কি না। তারপর চুপ। আমি কোনও প্রশ্ন করলে উনি মনোসিলেবলে উত্তর দেন। কিন্তু আমি তো ওঁর ইন্টারভিউ নিতে আসিনি। তা ছাড়া ডাঙ্গে সাহেবের জামাই-কে ঠিক কী কী প্রশ্ন করা যায়, তাও মনে এল না। সুতরাং উনি নিঃশব্দে বসে পাইপ টানতে লাগলেন, আমি টেবিলের কাচটি দেখতে লাগলুম গভীর মনোযোগ দিয়ে।

এক সময় উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা, এবার আমি চলি।

আমি বললুম, শুভ রাত্রি।

হোটেলের অত কাছে ওঁদের বাড়ি অথচ আমাকে একবার চা খাওয়ারও নেমন্তন্ন করলেন না। এটা একটু অস্বাভাবিক, সাধারণত সবাই বলেন। অবশ্য রাজা আলি কুড়ি বছর ধরে মস্কোতে কী করেন ও আমার জানা হয়নি।

তারপর বিছানায় শুয়েও আর ঘুম আসে না। আলো নিভিয়ে ছটফট করতে লাগলুম। ঘুম না-আসার একটা কারণ হল বালিশ। এমন পেল্লায় বালিশ আমি জীবনে দেখিনি। আমাদের সাধারণ ব্যবহার্য বালিশ তিনখানা জোড়া দিলে যা হয়। যেমন মোটা, তেমনি চওড়া। এ শুধু মাথায় দেওয়ার বালিশ নয়, কাঁধ পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। বালিশ বাদ দিয়ে শুলেও ফাঁকাফাঁকা লাগে। চোখ মেলে রেখে অনুভব করতে লাগলুম, পৃথিবীর ঘূর্ণন, রাত্রি গড়িয়ে যাচ্ছে গভীরতর রাত্তিরের দিকে।

শেষ রাতে নিশ্চয়ই ঘুম এসেছিল, তবু জেগে উঠলুম বেশ সকাল সকাল। উঠেই চায়ের অভাব বোধ করলুম। আমরা সবাই অভ্যেসের দাস, ঘুম থেকে উঠেই এক কাপ চা না পেলে সারাদিনের জীবনযাত্রা শুরু করতে পারি না। চা পাব কোথায়? আমার কাছে এক কোপেকও নেই। যখন যা দরকার তা সারগেই কিনে দিচ্ছে। এ দেশের হোটেলে রুম সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে কি না জানি না। নিজের ইচ্ছে মতন হোটেল থেকে কিছু কিনে তারপর বিলে সই করার অধিকার আমার আছে কি না তা-ই বা কে জানে!

সেরকম স্মার্ট লোক হলে নিশ্চয়ই হোটেলের রিসেপশানে ফোন করে একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলত। কিন্তু আমি এসব ব্যাপারে একেবারেই তৎপর নই। মুখটুখ ধুয়ে একখানা বই হাতে করে সারগেই-এর প্রতীক্ষা করতে লাগলুম।

ন’টা আন্দাজ দরজায় করাঘাত। দরজা খুলেই দেখি তিন বঙ্গীয় যুবক-যুবতী। এদের মধ্যে একজন আমার সেই বিমানযাত্রার সঙ্গী সুযোধ য়ায়, অন্য দুজনের নাম সুজিত বসু ও সঙ্ঘমিত্রা দাশগুপ্ত। আমি একলা রয়েছি বলে ওরা সঙ্গ দিতে এসেছে।

সুযোধ জিগ্যেস করল, আপনার ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছে?

আমি বললুম, ব্রেকফাস্টের জন্য ব্যস্ততা নেই, তবে এক কাপ চা জোগাড় করতে পারলে মন্দ হত না।

সুযোধ শুধু যে খুব বিদ্বান তাই-ই নয়, তার ব্যবহারও খুব ব্যক্তিত্বপূর্ণ। সে বলল, শুধু চা কেন, এই ঘরে বসেই আমরা ব্রেকফাস্ট খাব, আমরাও খেয়ে আসিনি। হাঁকডাক দিয়ে তক্ষুনি সেসব ব্যবস্থা করে ফেলল। এক গাদা হ্যামবার্গার ও স্যান্ডউইচ এবং চায়ের অর্ডার দেওয়ার পর দ্বিতীয় চিন্তায় সে আবার বলল, আপনি রাশিয়ায় শ্যাম্পেন খাননি ত? এক বোতল শ্যাম্পেনেরও অর্ডার দেওয়া যাক।

সকাল বেলাতে শ্যাম্পেন? আমি ক্ষীণ আপত্তি জানালেও সুযোধ পাত্তাই দিল না।

সুজিত বসু কবিতা লেখে এবং ফিজিকসে পি-এইচ ডি করছে। সঙ্ঘমিত্রাও পি-এইচ ডি করছে সাইকোলজিতে, সাহিত্য খুব ভালোবাসে। লাজুকতা ভাঙতে একটু সময় লাগল। তারপরেই আড্ডা জমে গেল।

শ্যাম্পেনের বোতল খোলার কায়দাটা রপ্ত করতে হয়। আনাড়ি হাতে ছুটন্ত ছিপি জানলার কাঁচ ভাঙতে পারে, কারুর চোখেটোখে লাগলে গুরুতর ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং শ্যাম্পেনের বোতল খোলার সম্মান ওরা আমাকে দিতে চাইলেও আমি তা প্রত্যাখ্যান করলুম। সুবোধ নিজেই খুলল খুব সাবলীলভাবে। সকালবেলা চা-পানের আগেই সুরার গেলাসে চুমুক দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম।

আমাদের খাওয়াদাওয়ার মধ্য পথে সারগেই এসে হাজির। আমি তখনই বাইরে বেরুবার পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে নেই দেখে সারগেই বেশ ব্যস্তভাবে বলল, এ কী! আপনি এখনও তৈরি হননি? আমাদের যে সাড়ে দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে!

সুবোধ আড্ডার মেজাজে বলল, বসুন, বসুন, সাড়ে দশটার এখন অনেক দেরি।

সুবোধ, সুজিত, সঙ্ঘমিত্রা তিনজনই রুশ ভাষা বেশ ভালো জানে। আমাদের ক্রেমলিন যেতে হবে শুনে ওরা বলল, সে তো গাড়িতে মাত্র আট-দশ মিনিটের রাস্তা। মস্কোতে ট্রাফিক জ্যাম প্রায় হয় না বললেই চলে, সুতরাং ব্যস্ত হওয়ার কী আছে?

সারগেই তবু ছটফট করতে লাগল। অতএব আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে নিয়ে কোট-প্যান্টালুন পরে নিলুম। সারগেই-এর আপত্তি সত্বেও খাদ্য-পানীয়র সব দাম মিটিয়ে দিল সুবোধ। লেনিনগ্রাড থেকে ফিরে ওদের সঙ্গে আবার দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে পড়লুম আমরা দুজনে।

আজ অন্য গাড়ি, যিনি চালাচ্ছেন, তাঁর ফরসা, গোলগাল হাসি-খুশি চেহারা, অনেকটা অভিনেতা পিটার উস্তিনভের মতন। সারগেই এঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল, ইনি এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না, করমর্দনের পর আমাকে একটি রুশ সিগারেট দিলেন, বিনিময়ে আমিও উপহার দিলুম এক প্যাকেট ভারতীয় সিগারেট।

গাড়ি চলতে শুরু করার পর সারগেই আমাকে জিগ্যেস করল, সুনীলজি, কাল রাত্তিরে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

আমি মজা করার জন্য বললুম, কাল রাত্তিরে আমার ঘরে একজন অতিথি এসেছিল।

সারগেই রীতিমতন চমকে গেল। জিগ্যেস করল, অতিথি এসেছিল, আপনার হোটেলের ঘরে? কী করে এল?

আমি বললুম, সম্ভবত হেঁটেই এসেছিল।

-আপনার চেনা কেউ?

–না। জীবনে আগে কখনও দেখিনি।

-সে কি? কে এসেছিল? কেন এসেছিল?

তখন আমি হাসতে-হাসতে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলুম। ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা এস এ ডাঙ্গের নাম সারগেই শুনেছে।

আমরা আজ ক্রেমলিনের প্রধান প্রবেশ পথের বাইরে একটা শিকল-ঘেরা জায়গায় এসে দাঁড়ালুম। এখানে খুব কড়া সিকিউরিটি ব্যবস্থা। এর ভেতরেই সোভিয়েত সরকারি দফতর। এখানে দাঁড়িয়েই ১৯১৮ সালের ১২ মার্চ লেনিন মস্কোকে বিশ্বের প্রথম শ্রমিক কৃষক রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।

ঠিক সাড়ে দশটায় ভেতর থেকে দুজন লোক বেরিয়ে এসে আঙুলের ইশারায় আমাদের ডাকল। সারগেই বলল, দেখলেন তো, সুনীলজি, ঠিক ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে সাড়ে দশটায় আমাদের ডাকা হল। এক মিনিট দেরি হলে ওঁরা ফিরে যেতেন, আমাদের আর ঢোকা হত না। সেই জন্যই আমি আপনাকে তাড়া দিচ্ছিলুম।

সিকিউরিটির দুই ব্যক্তি আমাদের নিয়ে চলল ভেতরে। আমরা যাচ্ছি লেনিনের বাসভবন দেখতে। বিপ্লবের আগে দুশো বছর অবশ্য মস্কো রাশিয়ার রাজধানী ছিল না, তাহলেও ক্রেমলিনের প্রাসাদই ছিল চিরকাল রাজ-ক্ষমতার প্রতীক। এই প্রাসাদের একটি অংশে লেনিন তাঁর এক বোন ও স্ত্রী স্কুপকায়াকে নিয়ে থাকতেন।

লেনিনের জীবনযাত্রা ছিল সাদামাটা। তাঁর ব্যবহৃত থালা-বাসন, পোশাক-পরিচ্ছদ, চেয়ার-টেবিল সবই অবিকল রাখা আছে। রয়েছে লেনিনের পুস্তক-সংগ্রহ। রান্নাঘর ও শয়নকক্ষ ছাড়া বসবার ঘর তিনখানি। লেনিনের লেখার টেবিলের ওপর রয়েছে একটি মূর্তি, এটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। ডারউইন সাহেবের ইভোলিউশান তত্ব বিষয়ক বইয়ের ওপর বসে আছে একটি বাঁদর, তাঁর হাতে একটি মানুষের মাথার খুলি, বাঁদরটি খুব চিন্তিতভাবে সেদিকে চেয়ে আছে।

লেনিনের বাসস্থানে ঘুরতে-ঘুরতে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক এইচ জি ওয়েলস এইখানে এসেছিলেন লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে। লেনিন তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে যুদ্ধবিধ্বস্ত সোভিয়েত দেশের দ্রুত উন্নতি ঘটাবার একমাত্র উপায় সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। Goelro নামে যে বিদ্যুৎ পরিকল্পনা হয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল বিদ্যুতের উৎপাদন আগামী দশ বছরের মধ্যে দশ গুণ বাড়িয়ে ফেলা, বড়-বড় নদীগুলোর ওপর নতুন তিরিশটি পাওয়ার স্টেশন স্থাপন করা।

লেনিনের এই পরিকল্পনাকে এইচ জি ওয়েলসের মনে হয়েছিল অসম্ভব; তিনি লেনিনকে আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘দা ড্রিমার ইন দা ক্রেমলিন’। লেনিনের স্বপ্ন কিন্তু সফল হয়েছিল। বলশয় থিয়েটারে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘কমিউনিজম ইজ সোভিয়েট পাওয়ার প্লাস দা ইলেকট্রিফিকেশন অফ দা হোল কান্ট্রি।’ হায়, আমাদের পশ্চিমবাংলা তথা ভারতবর্ষে বিদ্যুতের কী অবস্থা! উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে ক্রমশই আরও কমে যাচ্ছে।

ক্রেমলিন প্রাসাদের এই অংশে যখন লেনিন বাস করতে আসেন, তখনই তার স্বাস্থ্য ভালো নয়। ১৯১৮ সালে তাকে মেরে ফেলার একটা চেষ্টা হয়েছিল, সেই আঘাত পুরোপুরি সারেনি। তাই নিয়েই তিনি নতুন রাষ্ট্র গড়ার প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন, তার ফলে বিপ্লবের পর ছ’বছরের মধ্যেই তিনি মারা যান।

ক্রেমলিন থেকে বেরিয়ে আমরা গেলুম মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছুটি, তাই ভেতরে যাওয়া হল না। গাড়িতে চার দিকটা একটা চক্কর দিয়ে এলুম। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনটি বিশাল ও সুদৃশ্য, আধুনিক স্থাপত্যের একটা উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যেসব রাস্তা, তাতে রয়েছে সার-সার আপেল গাছ, এখন ছোট-ছোট আপেল ফলে আছে। আমাদের স্কুল-কলেজগুলোর পাশে অন্তত পেয়ারা গাছ লাগাবার কথাও কেউ চিন্তা করে না কেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাটি সুবিশাল। সামনে মস্ত বড় চত্বর। তার পরে মস্কোভা নদী। অনেকগুলি টুরিস্ট বাস এসেছে, অর্থাৎ মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ও রীতিমতন একটি দ্রষ্টব্য ব্যাপার।

আমরা নদীর ধারে এসে দাঁড়ালুম। এই জায়গাটি বেশ উঁচু, এখান থেকে মস্কো শহর অনেকখানি দেখা যায়। নদীর পার ঢালু হয়ে অনেকখানি নেমে গেছে, মাঝে-মাঝে বেশ জঙ্গলের মতন। স্বাস্থ্য-উন্নতিকামীরা অনেকে সেখানে গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া পরে দৌড়চ্ছে। কয়েক জোড়া নব-বিবাহিত দম্পতিকে দেখলুম, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আবহাওয়া ভালো বলে বোধহয় এখন বিয়ের ধূম পড়ে গেছে। বরযাত্রীরা এখানে সঙ্গে করে এনেছে শ্যাম্পেনের বোতল, গেলাস ছাড়াই সবাই বোতল থেকে চুমুক দিচ্ছে। এরই মধ্যে দু-এক জনের অবস্থা বেশ টলটলায়মান মতন মনে হল।

নদীর ধার দিয়ে হাঁটলুম খানিকক্ষণ। এক সময়ে চোখে পড়ল একটি ছোট, পরিত্যক্ত গির্জা। গেটে তালা বন্ধ, বোঝা যায়, বহুদিন অব্যবহৃত।

আরও একটু বেড়াবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময় নেই। লেনিনগ্রাডের প্লেন ধরতে হবে।

হোটেলে ফিরে এসে আমরা লাঞ্চ সেরে নিলুম। সারগেই নিজে ইউক্রাইনের ছেলে। ও বলল, সুনীলজি, আপনি ইউক্রাইনিয়ান বর্স খেয়েছেন? খেয়ে দেখবেন?

আমি সবরকম খাবারই চেখে দেখতে রাজি। বেশ একখানা বড় জামবাটি ভরতি সুপ এল, তার মধ্যে নানারকম মাংসের টুকরো ও সবজি। এইরকম একটু সুপ খেলেই পেট ভরে যায়।

খাওয়া সেরেই সুটকেস নিয়ে ছুট দিলুম এয়ারপোর্টের দিকে। এটা ইন্টারনাল এয়ারপোর্ট। ছুটির মরশুম বলে প্রচণ্ড ভিড়। মস্কো ছেড়ে অনেকেই এখন বেড়াতে যাচ্ছে। সারগেই এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আমাকে ভি আই পি লাউঞ্জে নিয়ে গিয়ে বসাল। সেখানে মাত্র আমরা দুজন। এরকম জায়গায় বসতে কীরকম অস্বস্তি লাগে!

আরও খাতির করে আমাদের দুজনকেই প্রথমে তোলা হল বিমানে। আমার সুটকেসটা বুক না করিয়ে রেখে দেওয়া হল এয়ার হোস্টেসদের হেপাজতে, যাতে পৌঁছবার পর মাল খালাসের জন্য অপেক্ষা করতে না হয়। সিকিউরিটি চেকের সময় একটা বেশ মজা হল। পৃথিবীর সব বিমান বন্দরেই আজকাল এই ব্যবস্থা আছে। একটা মেটাল ডেটেকটার যন্ত্র সারা গায়ে বুলোয় অথবা একটা জায়গা পার হয়ে যেতে হয়, সন্দেহজনক কিছু থাকলে প্যাঁক-প্যাঁক শব্দ হতে থাকে। একজন মহিলা এখানে সিকিউরিটি চেক করছেন। আমার গায়ে যন্ত্রটা ছোঁয়াতেই প্যাঁক-প্যাঁক শব্দ করে উঠল। পকেটে খুচরো পয়সা কিংবা কোমরের বেল্টের মুখটার জন্যও অনেক সময় এই শব্দ হয়। আমার পকেটে পয়সা নেই, বেল্টটা খুলে ফেললুম, তবু যন্ত্রটা ছোঁয়াতেই আবার সেই শব্দ। আমি গায়ের কোটটা খুলে ফেললুম, তবুও শব্দ থামে না। এবারে মহিলাটি হাত দিয়ে আমার গা টিপেটুপে দেখলেন, সন্দেহজনক কিছু নেই। তবে কি যন্ত্রটা খারাপ হয়ে গেল? তিনি নিজের গায়ে যন্ত্রটা বোলালেন, কোনও শব্দ নেই, সারগেই-এর শরীরে বোলালেন, তখনও নিঃশব্দ। কিন্তু আমার গায়ে ছোঁয়াতেই আবার বেশ জোরে প্যাঁক-প্যাঁক করে ডাকতে লাগল।

একে কী বলা যায়, যন্ত্রের কৌতুক ছাড়া?