০২. রেড স্কোয়ার দেখেছি

অসংখ্য ছবিতে এবং চলচ্চিত্রে রেড স্কোয়ার দেখেছি। বিভিন্ন দিক থেকে। সুতরাং রেড স্কোয়ারে প্রথম পা দিয়ে তো খুব চেনা মনে হবেই। সারা বছর ধরেই রেড স্কোয়ারে নানান উৎসব ও জমায়েত হয়। আসন্ন মে দিবসের উৎসবের জন্য আজ রেড স্কোয়ারকে বহু পতাকা ও ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। সারগেই কিছু বলবার আগেই আমি একটি চতুষ্কোণ ভবনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললুম, ওইটা তো সেই মাস্যালিয়াম, যেখানে লেনিনের দেহ রাখা আছে?

ক্রেমলিন প্রাসাদের উত্তর-পূর্ব দিকে এই প্রশস্ত চত্বরের নাম রেড স্কোয়ার। আমরা যেদিক দিয়ে ঢুকলুম, সেদিক দিয়ে প্রথমেই পড়ে সেন্ট বেসিলস ক্যাথিড্রাল। ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি এই বিচিত্র আকারের ও নানা রঙের গির্জাটি রাশিয়ান স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এই গির্জার গম্বুজের সংখ্যা ন’টি, প্রত্যেকটিই বিভিন্ন আকৃতির। চমক্কার দেখতে এই গির্জাটিতে খানিকটা যেন বার্মিজ স্থাপত্যের ছাপ আছে বলে মনে হল, কিংবা আমার ভুলও হতে পারে।

সেই গির্জার পাশ দিয়ে একটু এগোলেই ডান পাশে একটা উঁচু বেদির মতন, জারদের আমলে এটা ছিল বধ্যভূমি, সম্রাটদের ইচ্ছাক্রমে যাকে তাকে ওখানে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হত, এখন সেখানে ফুলের মালার স্তূপ।

ক্রেমলিন প্রাসাদের সিংহদ্বারের কাছেই যে সুউচ্চ গম্বুজ, যার চূড়ায় রয়েছে একটি বিশাল তারা, সেই গম্বুজটিই মস্কো শহরের প্রতীক চিহ্ন বলা যায়। সেই গম্বুজে দিয়ে দু যার ঘণ্টাধ্বনি হয়। সেই ধ্বনিতে শোনা যায় ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গানের সুর।

রেড স্কোয়ারে অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করছে সেই ঘণ্টাধ্বনি শোনবার জন্য। অধিকাংশই টুরিস্ট, এদের মধ্যে আমেরিকান টুরিস্টদের আলাদা করে চেনা যায়। অত্যন্ত সুসজ্জিত কয়েকজন পুলিশ সেই ভিড়ের শৃঙ্খলা রক্ষা করছে। সেই পুলিশদের মুখগুলি খুবই গম্ভীর। পুলিশের পোশাক পরে থাকলে বোধহয় হাসি নিষেধ।

লেনিন সমাধিভবনের সামনে বিরাট লম্বা লাইন। সারগেই জিগ্যেস করল, আপনি ভেতরে যেতে চান?

অতবড় লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর বাসনা আমার হল না, আমি বললুম, না, থাক।

সারগেই বলল, এখন শুধু জায়গাটা দেখে নিই, পরে তো এখানে বারবার আসতে হবেই।

রেড স্কোয়ারের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত হেঁটে গেলুম দুজনে। চত্বরটি কবল স্টোন বা খোয়া পাথরে বাঁধানো, প্রাচীন কালে যেমন ছিল, সেইরকমই রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, ছবিতে বা সিনেমায় রেড স্কোয়ারকে যত বিশাল মনে হয়, আসলে কিন্তু তত বড় লাগল না। কল্পনার থেকে বাস্তব সবসময়েই একটু ছোট।

ক্রেমলিন কথাটার মানেই হল দুর্গ। দেয়াল ঘেরা এই অঞ্চলটাই আদি মস্কো, তারপর একে কেন্দ্র করে শহরটা ছড়িয়েছে। এর চারপাশ দিয়েই বেরিয়েছে বড় বড় রাস্তা। এবারে আমরা অন্য একটা রাস্তা ধরে শহর দেখতে দেখতে পৌঁছলুম নভোস্তি প্রেস এজেন্সির কার্যালয়ে।

রাশিয়ান ভাষায় হরফ অনেকগুলিই রোমান হরফের মতন হলেও উচ্চারণে প্রায় কোনও মিলই নেই। রোমান হরফ দেখা চেনা চেনা মনে হলেও রাশিয়ান ভাষা আমরা পড়তে পারি না। সেই জন্যই নভোস্তি প্রেস এজেন্সির আদ্যক্ষর এন পি এ নয়, এ পি এন। এই এ পি এন-এর আমন্ত্রণেই আমি এদেশে অতিথি হয়ে এসেছি।

এ পি এন-এর অফিস ভবনটি প্রকাণ্ড। ঢোকার মুখে কড়া পাহারার ব্যবস্থা। সোভিয়েত দেশ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পরিবেশনের দায়িত্ব এই সংস্থার। সারা পৃথিবীতে রয়েছে এঁদের শাখা, বহু সাময়িক পত্র-পত্রিকা এঁরা পরিচালনা করেন।

সারগেই অনেক সিঁড়ি ঘুরিয়ে আমায় একটি প্রশস্ত কক্ষে এনে বসাল। তারপর পাশের দফতরের এক মহিলা কর্মীকে আমাদের আগমনবার্তা জানিয়ে আমার কাছে এসে বলল, এক্ষুনি যিনি আসবেন, তিনি হলেন ওর বস। তিনি এই দফতরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তিনি স্বয়ং আসছেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। সারগেই-এর গলায় খানিকটা উত্তেজনার আভাস। নতুন চাকরিতে ঢুকেছে, তাই বস সম্পর্কে ওর বেশ একটা ভয়-ভয় সমীহের ভাব আছে বলে মনে হল।

এক মিনিট পরেই যিনি ঘরে ঢুকলেন, তিনি একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। বেশ হাসিখুশি মুখের ভাব, তাঁকে দেখে মোটেই ভয় জাগে না। এঁর নাম সোয়ার্টস ইগর আলেকসেভিচ, ইনি এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক।

সোয়ার্টস সাহেবকে দেখে আমি সসম্ভমে উঠে দাঁড়াতেই তিনি প্রফুল্ল গলায় বললেন, বসুন, বসুন! আপনার বিমানযাত্রা ক্লান্তিকর হয়নি তো? এখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তে?

সোয়ার্টস সাহেব একাধিকবার ভারতে এসেছেন, বেশ কিছুদিন দিল্লিতে থেকে গেছেন, সুতরাং আলাপ-পরিচয়ে প্রাথমিক জড়তাটা সহজেই কাটিয়ে ওঠা গেল।

তিনি আমাকে জিগ্যেস করলেন, আপনি এ দেশে এসে কী কী দেখতে চান বলুন?

আমি বললুম, আমি প্রধানত ভ্রমণকারী, তথ্য সংগ্রাহক নই। আপনাদের দেশে এসেছি, যা যা দেখবার সুযোগ পাব তাই-ই দেখব, আলাদাভাবে কোনও বিশেষ ব্যাপারে কৌতূহল নিয়ে আসিনি।

তিনি বললেন, এক হিসেবে আপনি খুব ভালো সময়েই এসেছেন, আবার খুব খারাপ সময়েও বটে। ভালো, তার কারণ আবহাওয়া এখন চমৎকার। তবে মুশকিল হচ্ছে এখন পরপর ছুটির দিন। তাই অনেক কিছুই বন্ধ থাকবে। তবু যতটা সম্ভব বেশি কিছু দেখাবার জন্য আপনার একটি সফর পরিকল্পনা আমরা তৈরি করে রেখেছি। আপনি ইচ্ছে মতন ঘুরুন, এই সারগেই ছেলেটি আপনার সঙ্গে থাকবে, বিশেষ কিছু ইচ্ছে হলে ওকে জানাবেন। যা জানতে চান জিগ্যেস করবেন। আপনাকে কয়েকটা বইপত্র দিচ্ছি। পড়ে দেখতে পারেন–

মাঝপথে কথা থামিয়ে সোয়ার্টস জিগ্যেস করলেন, চা না কফি খাবেন? চা তো আপনাদের দেশের মতন ভালো নয়।

সকাল থেকে আমি দু-কাপ চা খেয়েছি, তাতে আমি চায়ের কোনও স্বাদই পাইনি। সুতরাং বললুম, কফি!

এ পি এন ভবন থেকে বেরিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মস্কো রাইটার্স ইউনিয়ান।

অনেক কিছু সম্পর্কেই আমাদের একটা পূর্ব ধারণা গড়ে ওঠে। সোভিয়েত দেশের রাইটার্স ইউনিয়ন সম্পর্কে এত বেশি প্রচার ও অপপ্রচার আগে শুনেছি বা পড়েছি যে এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আমার মনে একটা ধাঁধার ভাব ছিল। সরকারি আওতায় কোনও লেখক সমিতি পরিচালনার ব্যাপারটা আমাদের ঠিক যেন মনঃপূত হয় না।

মস্কো লেখক সমিতির কার্যালয়টি কেমন হবে, সে সম্পর্কে আমার মনে আগে থেকেই একটা ছবি আঁকা ছিল। সরকারি বাড়ি, চৌকো চৌকো ঘর, শ্রীহীন দেওয়াল, নেতাদের ছবি, মস্ত বড় টেবিলের চারপাশে শক্ত শক্ত চেয়ার, সব মিলিয়ে গম্ভীর গম্ভীর ব্যাপার। কিন্তু লেখক সমিতি-তে এসে আমি অবাক হলুম। বস্তুত, মস্কোতে পৌঁছে এই প্রথম আমার একটি গভীর বিস্ময় ও আনন্দের ব্যাপার ঘটল।

বিপ্লব-পূর্বকালের কোনও এক ধনাঢ্য মহিলার বিলাস-মহলটিতেই এখন লেখক সমিতির ঘাঁটি। বাড়িটি অপূর্ব। লোহার গেট পেরিয়ে একটি প্রশস্ত চত্বর, পাশে কয়েকটি ছোট-ছোট কটেজ, তারপর সামনের প্রাসাদের মধ্যে অনেকগুলি ঘর, নানারকম গলিপথ ও সুড়ঙ্গ, যেন কোনও গুপ্তপথ দিয়ে আমরা একবার মাটির নীচে নেমে গেলুম আবার ওপরে উঠলুম। একজন মহিলার সঙ্গে আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, তাকে খুঁজে বার করতেই খানিকটা সময় লেগে গেল। আমাদের খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল, তবু তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

দেখামাত্র তিনি হেসে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছেন? আবার দেখা হল।

এঁর নাম মারিয়াম সোলগানিক, ইনি একজন নামকরা লেখিকা এবং লেখক সমিতির পরিচালকদের মধ্যে একজন, ঠিক কোন পদ অলংকৃত করেছেন তা আমার জানা হয়নি। ধারালো, ঝকঝকে পাতলা চেহারা, ইংরেজি বলেন অতি মসৃণভাবে। কিছুদিন আগেই উনি কলকাতা ঘুরে গেছেন, তখন একটি চা-চক্রে দেখা হয়েছিল, ওঁকে আমার মনে আছে, কিন্তু আমাকেও যে উনি চিনতে পারবেন, সেটা খুব আশ্চর্য কথা!

শ্ৰীমতী মারিয়াম সোলগানিক বললেন, চলুন, চা খেতে-খেতে গল্প করা যাক।

সারগেই বলল, আমরা দুপুরে লাঞ্চ খাইনি, আপনাদের এখানে খাওয়াটা সেরে নিতে চাই।

শ্রীমতী মারিয়াম সোলগানিক আবার আমাদের সেই বাড়ির ভেতরকার গুপ্তপথ দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিয়ে চললেন। পুরোনো আমলের বাড়িতে এইরকম পথ থাকে। উনি বললেন, আমরা আসলে পেছন দিক দিয়ে যাচ্ছি, সামনের দিক দিয়ে অনেক সহজে যাওয়া যায়।

কাঠের ফ্লোর লাগানো একটা বড় হলঘরে এসে পৌঁছলুম, যেটা নির্ঘাৎ এক সময়ে নাচ ঘর ছিল। এক পাশ দিয়ে একটা কারুকার্য করা ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। এখানে অনেকগুলো টেবিল সাজানো, কিন্তু সবই শূন্য। দুঃখের বিষয় সেখানে আমাদের খাওয়া হল না, লাঞ্চ আওয়ার পেরিয়ে গেছে বলে সার্ভিস বন্ধ।

শ্রীমতী মারিয়াম সোলগানিক বললেন, তা হলে আর কী করা যাবে, চলুন চা-ই খাওয়া যাক।

আর একটি বড় ঘরে এসে পৌঁছলুম আমরা। এই ঘরখানিও খুব দৃষ্টিনন্দন। সমস্ত দেওয়ালে নানারকম ছবি আঁকা, অধিকাংশই কাঁচা হাতের। লেখকরা আড্ডা দিতে-দিতে যার যা খুশি দেয়ালে আঁকেন। শ্ৰীমতী সোলগানিক বললেন, এর মধ্যে অনেক ছবিতে উত্তর প্রত্যুত্তর আছে। অর্থাৎ একজন লেখক একটা কিছু ছবি এঁকেছেন, অন্য কোনও লেখক পাশে আর একটা ছবি এঁকে উত্তর দেন তার।

আমি জিগ্যেস করলুম, লেখকদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয় না?

–কেন হবে না? প্রায়ই হয়। সব দেশেই লেখকরা তো একই জাতের।

-এখানে কখনও লেখকদের মধ্যে ঘুসাঘুসি হয়েছে?

উনি হেসে বললেন, না। লেখকদের মধ্যে মতবিরোধটা কাগজে-কলমে হওয়াই ভালো।

লেখক ইউনিয়ান একটি স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান। লেনিন ঠিক করে দিয়েছিলেন যে প্রত্যেক প্রকাশক লেখকদের রয়ালটির একটা অংশ এই ইউনিয়ানকে দিতে বাধ্য থাকবে। এমন সমস্ত প্রকাশনালয়ই সরকার পরিচালিত, তারা প্রত্যেকেই টাকা দেয়। সেই টাকায় এই ইউনিয়ানের খরচ চলে। লেখকরা এখানে আড়া, শস্তায় খাওয়া-দাওয়া, সুরাপান ও আলাপ-আলোচনা করতে আসেন। নতুন সদস্য নেওয়ার আগে এখানকার কমিটি সেই লেখকের গুণাগুণ আলোচনা করে দেখে। চেষ্টা করেও কেউ-কেউ এখানকার সদস্য হতে পারেননি, এমন নজিরও আছে। এই লেখক সমিতির পরিচালনায় সারাদেশে আছে অনেকগুলি রাইটার্স হোম, সেগুলি সাধারণত স্বাস্থ্যকর, নিরিবিলি জায়গায়, সদস্য লেখকরা সেই সব রাইটার্স হোমে গিয়ে এক মাস দু-মাস থেকে লিখতে পারেন, নামমাত্র খরচে।

আমি জিগ্যেস করলুম, মনে করুন, কোনও একজন লেখক এই রকম একটা রাইটার্স হোমে গেল, আপনাদের খরচে থেকে এল একমাস, কিন্তু এক লাইনও লিখল না, অর্থাৎ কোনও লেখা তার মাথায় এল না, তা হলে কী হবে?

শ্ৰীমতী সোলগানিক বললেন, একজন লেখক লিখবেন কি লিখবেন না, সেটা তাঁর ইচ্ছে। তাতে আমাদের কী বলবার আছে?

লেখক সমিতির থেকে লেখকদের আরও নানারকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তার মধ্যে একটা হল অনুবাদের ব্যবস্থা করা। অনুবাদের ব্যাপারটা সোভিয়েত দেশে একটা এলাহি কারবার।

শ্রীমতী সোলগানিক বললেন, আপনাদের ভারতবর্ষে যেমন ভাষা সমস্যা আছে, আমাদেরও সেইরকম ছিল। আমরা সেই সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি অনুবাদের মাধ্যমে।

সোভিয়েত ইউনিয়ানে প্রধান ভাষা ৭৭টি। এই প্রত্যেকটি ভাষায়ই আলাদা সাহিত্য আছে। এই সব ভাষার উল্লেখযোগ্য লেখা অনুদিত হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষায়, আবার রাশিয়ান ভাষায় লেখাও অনুদিত হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষায়। তার ফলে একজন আঞ্চলিক ভাষার লেখকও অনায়াসেই সমস্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় পরিচিত হতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা থেকেও অবিরাম অনুবাদ চলছে। অনেক আমেরিকান লেখক সোভিয়েত রাশিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এক একটি বইয়ের অনুবাদ ছাপা হয় প্রাচ পাঁচ লক্ষ করে। রবীন্দ্র রচনাবলিও পাঁচ লক্ষ ছাপা হয়েছে ও অতি দ্রুত ফুরিয়ে গেছে।

বিপ্লবের আগে থেকেই জাতিগতভাবে রাশিয়ানরা দারুণ পড়ুয়া। সম্প্রতিকালের ইউনেস্কোর রিপোর্টেও প্রকাশ যে সারা পৃথিবীতে সোভিয়েত দেশের নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি বই পড়ে। এক হাজার জন শিক্ষিত লোকের মধ্যে ৯৯০ জনেরই বই কেনার অভ্যেস আছে।

আমি বললুম, রাশিয়ানরা খুব বেশি পড়ে তা জানতুম, কিন্তু তারা যে এত অনুবাদও পড়ে, এটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার!

শ্ৰীমতী সোলগানিক আমাকে সংশোধন করে দিয়ে বললেন, রাশিয়ান নয়। বলুন সোভিয়েত পিপল!

এ কথা ঠিক। আমরা সবসময় রাশিয়া বা রাশিয়ান বললেও সোভিয়েত ইউনিয়নে এখন নানান জাতির সমন্বয় এবং এর সীমানাও রাশিয়াকে ছাড়িয়ে অনেকখানি। মূল রুশ ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগ দিয়েছে অন্য অনেকগুলি স্টেট, এখন মোট ১৫টি স্টেট নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ান। এমন অনেক স্টেট আছে, যেমন টাশকেন্ট কিংবা ল্যাটভিয়া, যেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতি রুশদের থেকে অনেক আলাদা। তারা রাশিয়ান নয়, কিন্তু সোভিয়েত নাগরিক।

কিন্তু বাংলায় এখনও আমরা চলিত ভাষায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাশিয়া বলি; সোভিয়েত অধিবাসীর বদলে রাশিয়ায।

শ্রীমতী সোলগানিক মৃদু হাস্যে বললেন, মনে করবেন না যে আমাদের এখানে একবারে ব্ল্যাক মার্কেট নেই! আছে। আমাদের দেশে বই আর অপেরার টিকিটের ব্ল্যাক মার্কেট হয়।

কথাটা বলার সময় তাঁর কণ্ঠে বেশ গর্ব মিশে গেল! তা তো হওয়ারই কথা।

শ্ৰীমতী সোলগানিক আমাকে জিগ্যেস করলেন, কোন কোন সোভিয়েত লেখকের কথা আমি পড়েছি!

আমি লজ্জিতভাবে বললুম, প্রায় কিছুই পড়িনি।

রুশ মহৎ লেখকদের রচনা আমাদের অবশ্য পাঠ্য, টলস্টয়-ডস্টয়েভস্কি-টুর্গেনিভ-এর উপন্যাস আমরা কৈশোর বয়সে থেকে বারবার পড়েছি, গভীর মুগ্ধতা নিয়ে, পুশকিন থেকে ব্লক-মায়াকভস্কির কবিতাও পড়েছি। কিন্তু তারপর সোভিয়েত আমলের লেখকদের সম্পর্কে আমরা, অন্তত আমি, প্রায় অজ্ঞই বলা চলে। সনোকভ ছাড়া আর কোনও নামই চট করে মনে পড়ে না। তার কারণ, আমাদের মিডিয়াগুলি পশ্চিম-শাসিত। ইংরেজি ভাষার প্রতি দাসত্বের জন্য আমরা সবসময় ইংল্যান্ড–আমেরিকার মুখাপেক্ষী। টাইম নিউজউইক যাকে বিশ্ব সংবাদ বলে সেগুলিকেই আমরা মনে করি সাম্প্রতিক বিশ্বের উল্লেখযোগ্য খবর। ওরা পাস্তেরনাক বা সোলঝেনিৎসিনকে নিয়ে শোরগোল শুরু করলে তারপর আমরা ওই লেখকদের কথা জানতে পারি এবং তাদের লেখা পড়তে আগ্রহী হই। এমনকী ইয়েভতুশেংকো ও ভজনেসেনস্কির মতন আধুনিক কালের কবিদের কথাও জেনেছি ওই একই উপায়ে। ওঁদের মার্কিন দেশ সফরের সময় খুব হই চই হয়েছিল বলে। আধুনিক সোভিয়েত লেখকদের প্রতিনিধিত্বমূলক লেখার ভালো ইংরিজি অনুবাদ আমরা সরাসরি বইয়ের দোকানে পাই না। কনসুলেট থেকে মাঝে মাঝে দু-চারটি বই বাড়িতে পাই, সেগুলিকে মনে হয় প্রচারমূলক, পড়তে ইচ্ছে করে না।

এক কাপ চা আগেই ফুরিয়ে গেছে, এরপর নিলাম এক বোতল করে মিনারাল ওয়াটার। সারগেই আমাকে বোঝাল যে এই মিনারাল ওয়াটার পেটের পক্ষে খুব ভালো। শ্ৰীমতী সোলগানিক বললেন, বেশি খাবেন না যেন!

আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল। আরও অনেকক্ষণ চলতে পারত। কিন্তু শ্ৰীমতী সোলগানিকের অন্য কাজ আছে। তিনি বললেন, আবার পরে একদিন আসবেন, আবার গল্প হবে।

বিদায় নেওয়ার সময় তিনি জিগ্যেস করলেন, আপনাদের লেখক সমিতি সম্পর্কে কিছু জানা হল না। আপনাদের সমিতি কীভাবে চলে?

অমি বললুম, আমাদের কোনও লেখক সমিতি নেই।

তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, লেখকদের কোনওরকম ইউনিয়ান নেই?

আমাকে আবার বলতে হল, না। কোনওরকম ইউনিয়ান নেই।

বাঙালি লেখকদের কোনও ইউনিয়নের কথা আমি আগে চিন্তা করিনি। এখন মনে হল, মস্কোর মতন আমাদেরও লেখকদের একটা মিলনস্থান থাকলে বেশ হত! তাহলে মল্লিক প্যালেস কিংবা কুচবিহারের রাজার বাড়ি কিংবা ভাওয়ালের রানির বাড়ি কি সরকার আমাদের দিত? সে আশা দুরাশা! সোভিয়েত ইউনিয়ানের লেখকদের সম্মান অনেক বেশি।

গেটের বাইরে এসে আমাদের গাড়িটি খুঁজে পাওয়া গেল না। সারগেই বলল, আমি তো ভেবেছিলুম আমরা এখানে খেয়ে নেব, তাই ড্রাইভারকেও খেয়ে আসতে বলেছিলুম, সাড়ে চারটের মধ্যে ফেরার কথা। দেখি, গাড়িটা বোধহয় অন্য কোথাও রেখেছে। সুনীলজি, আপনি এই পার্কটায় ততক্ষণ বসুন।

এটাকে ঠিক পার্ক বলা যায় না, রেলিং ঘেরা খানিকটা জায়গা, কয়েকটি বেঞ্চ আর ঘাস-চটা মাটি। দুটি বাচ্চাকে নিয়ে এক বৃদ্ধা বসে আছেন একদিকে। আমি আর একটি বেঞ্চে বসলুম। বাচ্চাগুলি খেলতে-খেলতে একবার আমার কাছে চলে এল। ভাষা জানি না, তাই ওদের সঙ্গে কোনও কথা বলতে পারলুম না, কিন্তু তারা আমায় কী যেন বলছে। বৃদ্ধা দেখছেন আমাকে। মনে হয় দিদিমা এসেছেন তাঁর নাতি-নাতনি নিয়ে। তিনিও আমায় কিছু বললেন, একটি বর্ণও বুঝলুম না। হাত নেড়ে হাসিমুখে আমার অজ্ঞতার কথা জানালুম।

সেই বৃদ্ধ বাচ্চা দুটিকে ডেকে পার্ক থেকে বেরিয়ে যেতেই ঝড় উঠল। প্রথমে ধুলোর ঘূর্ণি, তারপর উড়ে এল অসংখ্য শুকনো পাতা, তারপরই বৃষ্টি।

সারগেই ছুটতে-ছুটতে ফিরে এল। তার উদভ্রান্ত অবস্থা। সে বলল, গাড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না! এদিকে বৃষ্টি এসে গেল!

বৃষ্টির ফোঁটাগুলো খুব বড়-বড়। একটুক্ষণ থাকলেই ভিজে যাব। পার্ক থেকে বেরিয়ে আমি পাশের একটা বাড়ির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দাঁড়ালুম। অত্যন্ত শীতের দেশ বলে এসব জায়গায় প্রায় সব বাড়িতেই দুটো করে দরজা থাকে। প্রথমে একটা ভারী কাঠের দরজা। তারপর একটু ফাঁক দিয়ে একটা কাঁচের দরজা। আমি ওই মাঝখানের জায়গাটায় দাঁড়ালুম। কার বাড়ি জানি না। কাঁচের দরজা দিয়ে দেখে মনে হয় কোনও ডাক্তারের চেম্বার। কাঁচের দরজাটা তালাবন্ধ, ভেতরে কেউ নেই।

সারগেই আবার গাড়ি খুঁজতে গেছে। খানিকক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি আবার বাইরে বেরুতেই শীতের চাবুক খেলুম। বৃষ্টি এবং শনশনে হাওয়ায় তাপমাত্রা হঠাৎ অনেক নেমে গেছে, আমি তাড়াতাড়ি আবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এলুম। আমাদের দেশে এইরকমভাবে কারুর বাড়িতে ঢুকলে নিশ্চয়ই কেউ এসে কড়া গলায় বলত, কী চাই মশাই? এখানে কী করছেন? এদেশে এরকম কেউ বলে না। তবু অস্বস্তি বোধহয়।

সারগেই আবার এসে খুবই লজ্জিতভাবে কাঁচুমাচু গলায় জানাল যে গাড়িটা কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ গাড়িটাকে সে এখানেই রাখতে বলেছে…।

আমি তাকে বললুম, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন? তুমি এখানে দাঁড়াও আমার সঙ্গে। গাড়িটা এসে পড়বে নিশ্চয়ই।

সারগেই সে কথা শুনল না। বৃষ্টি মাথায় করে সে আবার ছুটে গেল। আমি শীত কাটাবার জন্য একটার পর একটা সিগারেট টানতে লাগলুম।

গাড়িটা এল প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে। সারগেই-এর এত বেশি ব্যস্ততার কারণ, কোনও একটা জায়গায় গিয়ে খোঁজ নিতে হবে যে আজ সন্ধেবেলা কোনও ব্যালে অপেরার থিয়েটারের টিকিট পাওয়া যাবে কি না, সেখানে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

গাড়ি চলবার পর সারগেই বলল, ড্রাইভার দেরি করে আসার যে কারণ জানাল, তা প্রায় একটা ডিটেকটিভ বই-এর মতন!

আমি বললুম, তাই নাকি?

সারগেই বলল, ড্রাইভার খেয়ে ফিরে আসছিল…এমন সময় রাস্তায় একটা ঘটনা ঘটে। একটা চোর চুরি করে দৌড়ে পালাচ্ছিল, এমন সময় পুলিশ এই গাড়িটাকে থামিয়ে উঠে পড়ে সেই চোরটাকে ধরবার জন্য।

-তারপর চোরটা ধরা পড়েছে?

–বলছে তো ধরা পড়েছে।

ড্রাইভার ইংরেজি বোঝে না। তবু এখন সে ঘাড় ফিরিয়ে রুশ ভাষায় অনেক কিছু বলতে লাগল সারগেইকে।

সারগেই আমাকে বলল, তা হলেই বুঝতে পারছেন, সুনীলজি। আমাদের দেশেও চোর আছে।

ওর বলার ভঙ্গিতে হো-হো করে হেসে উঠলুম।

নির্দিষ্ট স্থানটিতে এ পি এন-এর একজন প্রতিনিধি তখনও অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। ব্যালের টিকিট পাওয়া যায়নি। অপেরার টিকিট পাওয়া গেছে। তবে বলশয় থিয়েটারে নয়, ক্রেমলিন থিয়েটারে।

প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। মাঝখানে এক ঘণ্টা সময় আছে। সারগেই প্রস্তাব জানাল, এই সময়টায় আমরা কিছু খেয়ে নিতে পারি। সকালে ব্রেক ফাস্ট বেশ হেভি হয়েছিল বলে আমার তখনও খিদে পায়নি। সারগেই বলল যে, অপেরা দেখে বেরুবার পর অনেক দেরি হয়ে যাবে, তখন খাবার পাওয়া যাবে না। তাতেও আমি তখন খেতে রাজি হলুম না। পেট ভরতি থাকলে ঘোরাঘুরি করতে মন লাগে না।

হোটেলে ফিরে মুখ-হাত ধুয়ে এক পেয়ালা করে কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়লুম দুজনে। আসলে সময় বেশি হাতে নেই। ক্রেমলিন থিয়েটার ক্রেমলিন প্রাসাদের মধ্যে, সেদিকে ঢুকতে হয় অন্য এক রাস্তা দিয়ে। এবং গেটের সামনে লম্বা লাইন। কোনওরকম হ্যান্ড ব্যাগ বা ছাতা-টাতা নিয়ে ভেতরে ঢোকার নিয়ম নেই। সারগেই-এর হাতে একটা ব্যাগ ছিল, দ্বাররক্ষী তাকে আটকাল। সেই ব্যাগটা তাকে জমা রেখে আসতে হল বেশ খানিকটা দূরে।

ক্রেমলিন এলাকার মধ্যে অনেকগুলি প্রাসাদ ও গির্জা আছে। থিয়েটার বাড়িটি নতুন। একেবারে অত্যাধুনিক কায়দায় তৈরি। নতুনত্বের একটা দীপ্তি ঠিকরে বেরুচ্ছে। শ্বেত পাথরের মেঝে যেন কাঁচের মতন স্বচ্ছ। মার্কিন দেশে আমি অনেক বড় থিয়েটার হল দেখেছি, তবুও আমি এই থিয়েটার হলটি দেখে মুগ্ধ হলুম। আমরা ভেতরে ঢুকে আসন খুঁজে বসবার সঙ্গে-সঙ্গে অপেরা শুরু হয়ে গেল।