[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৩৭. একটা ক্যামেরা না কিনলেই নয়

এবারে একটা ক্যামেরা না কিনলেই নয়। এত জায়গায় ঘোরাঘুরি করছি, এসব ছবিতে ধরে রাখলে পরে সে সব ছবির দিকে তাকিয়ে বেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলা যাবে। সকলেই সে রকম করে। যেকোনও বিখ্যাত জায়গাতে গেলেই দেখি অন্য সবাই ক্যামেরা বার করে ঝিলিক মারতে শুরু করেছে। আমার ক্যামেরা নেই, তাই একটু বোকাবোকা লাগে। শুধু তাই নয়, অন্য কারুর ক্যামেরার ফোকাসের মধ্যে ঘোরাফেরা করছি কি না, সে ভেবেও সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। আমার মতন এলেবেলে লোকের ছবি অন্য কেউ তুলবেই বা কেন।

আমি অনেক পাহাড়ে-জঙ্গলে গেছি বটে, কিন্তু বন্দুক-পিস্তল বা ক্যামেরা কখনও ব্যবহার করিনি। সঙ্গে অতিরিক্ত কোনও জিনিসপত্র রাখার অভ্যেসই আমার নেই।

বেশ ছেলেবেলায় আমার বন্ধু আশু আমায় একবার ছবি তোলার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। তার ছিল ক্যামেরার নেশা, তার নিজেরও ছিল বেশ দামি-দামি কয়েকটা ক্যামেরা। আমাকে হাত পাকাবার জন্য সে একটা বক্স ক্যামেরা দিয়েছিল। আমি তা দিয়ে মনুমেন্ট, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, দক্ষিণেশ্বরের মন্দির ইত্যাদি তুলেছিলাম সারা দিন ঘুরে। পরে দেখা গেল, বারো খানা ফিলমের একটাও ওঠেনি। এটা নাকি ব্যর্থতার একটা বিশ্ব রেকর্ড। একেবারে নভিসরাও বক্স ক্যামেরায় বারো খানার মধ্যে ছ’খানা তুলতে পারে। সেই থেকে আমি আর ক্যামেরায় হাত দিইনি।

কিন্তু বিদেশে ঘোরাঘুরির সময় একটা ক্যামেরার অভাব খুবই বোধ করতে লাগলুম। মাস তিনেক ধরে দোনামনা করার পর একদিন ভাবলুম, নাঃ, এবারে একটা কিনতেই হয়।

ছবি তোলার ব্যাপারটা আজকাল অনেক সহজ হয়ে এসেছে। অ্যাপারচার, ফোকাস ঠিক করা, আলো মাপামাপির দরকার হয় না। কিংবা হয়তো এখনও দরকার হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তো আমার নেই, কোনও রকম কাজ চালানো ছবি তোলার জন্য অনেক সহজ ক্যামেরা বেরিয়েছে।

সবচেয়ে সহজ হচ্ছে পোলারয়েড ক্যামেরা। চোখের সামনে ক্যামেরাটি ধরে শাটার টেপো, আর সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসবে ছবি, একেবারে হাতে গরম। দোকানে যাওয়ার ঝঞ্ঝাটও নেই। কিন্তু এ ক্যামেরা এদেশে একেবারে বাচ্চারা ব্যবহার করে। জয়তীদি-দীপকদার ছ’বছরের মেয়ে ছুটকি এই ক্যামেরায় পটাপট ছবি তুলত। সুতরাং রাস্তায়-ঘাটে ওই রকম ক্যামেরা আমার হাতে দেখলে লোকে হাসবে।

সস্তায় আরও নানা ধরনের ইনস্টোম্যাটিক ক্যামেরা পাওয়া যায়, যাতে ছবি তোলা খুবই অনায়াসের ব্যাপার, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সে রকম ক্যামেরা দেশে নিয়ে গেলে একেবারে অকেজো হয়ে যাবে। ওদের ফিলম বা ব্যাটারি আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। আজকাল অধিকাংশ ক্যামেরাতেই নানা রকম ব্যাটারির কারসাজি থাকে।

বিখ্যাত, দামি যেসব ক্যামেরার নাম শুনলে আমাদের দেশের অনেক শৌখিন ফটোগ্রাফারের চোখ চকচক করে ওঠে, সেরকম কোনও ক্যামেরা কেনার সাধ্যও আমার নেই, ইচ্ছেও নেই। এখনকার পরিচিতরা আমায় পরামর্শ দিয়েছিল, মাঝারি দামের মধ্যে মজবুত ক্যামেরা যদি কিনতে চাও, তা হলে ইন্ডিয়ান দোকান থেকে কিনো। কারণ, ওরা বলতে পারবে, কোন ক্যামেরার ফিলম বা ব্যাটারি দেশে পাওয়া যাবে, দরকার হলে মেরামতও করা যাবে।

গিয়েছিলুম নিউইয়র্কের সেরকম একাধিক দোকানে। এদেশের ‘ইন্ডিয়ান’ দোকানগুলির প্রায় অধিকাংশেরই মালিক পাকিস্তানি। এত দূর দেশে ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা অনেক ব্যাপারেই একরকম। সবাই যে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ, সেই একাত্মতা এখানে এলে ভালো করে বোঝা যায়।

কিন্তু ওই সব ‘ইন্ডিয়ান’ দোকানে মাঝারি বলেই যে-সব ক্যামেরা আমাকে দেখিয়েছে, তার দাম আমার পকেটের সাধ্যের বাইরে। পারলে হয়তো আমি অতি সস্তায় কোনও সেকেন্ডহ্যান্ড ক্যামেরাই কিনে ফেলতুম, কিন্তু যেহেতু ওভারকোট আর ক্যামেরা এক নয়, তাই ঠিক ভরসা হয় না তবে, ওয়াশিংটনে থাকবার সময় একটা ক্যামেরার দোকানে অবিশ্বাস্য রকমের রিডাকশান সেল-এর বিজ্ঞাপন দেখে ঢুকে পড়েছিলুম। কোনও জিনিস দোকানে বেশি দিন জমে গেলেই এরা এরকম করে। সুতরাং রমেনদার কাছ থেকে নৈতিক সমর্থন নিয়ে নতুনের প্রায় অর্ধেক দামে কিনে ফেললুম একখানা ক্যামেরা। অলিমপাস টু। ছোটখাট্টো স্মার্ট চেহারা, কলকবজার বিশেষ ঝামেলা নেই, এমনকী ভুল-প্রতিষেধক কয়েকটি ব্যবস্থাও আছে। দোকানদারের কাছ থেকেই শিখে নিলুম নিয়মকানুন। সেই সঙ্গে পেলুম আরও অনেক ছাপানো কাগজপত্র, যা পড়লে প্রচুর জ্ঞান লাভ হয়। মোদ্দা কথা, এ ক্যামেরায় অন্ধও ছবি তুলতে পারে।

পৃথিবীর ঠিক উলটো দিকে বলেই এ দেশে অনেক ব্যাপারও উলটো। আমাদের দেশে কালো-সাদা ছবিরই চল এখনও বেশি, রঙিন ছবির ফিলমের দামও বেশি আর পরিস্ফুটন ও ছাপানোতেও অনেক ঝকমারি। আর এ দেশে সাদা-কালো ফিলম অতি দুর্লভ, যদি বা পাওয়াও যায়, তার ডেভলপিং-প্রিন্টিং-এর খরচ রঙিনের চেয়ে অনেক বেশি, অনেক জায়গায় সাদা কালো ছবি ফোঁটানো ও ছাপানোর ব্যবস্থাই নেই। সুতরাং আমি ভরে নিলুম রঙিন ফিলম।

একটা ক্যামেরা হাতে থাকার সুবিধে এই যে রাস্তায় ঘাটে যখন তখন এক চোখ টেপা যায়। ভদ্রসমাজে এক চোখ টেপার অধিকার শুধু ফটোগ্রাফারদেরই আছে। তা ছাড়া এক গাদা লোকের সামনে হঠাৎ ঝপাং করে হাঁটু গেড়ে বসা যায়, কোনও বিখ্যাত দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে একটা ক্যামেরা খুলে অনায়াসেই কাছাকাছি লোকদের সরে দাঁড়াতে বলতে পারা যায়।

প্রথম দফায় অতি উৎসাহে বারোখানা ছবি তুলে ফেললুম মাত্র দুদিনে। নদীর ছবি, গাছের ছবি, সূর্যাস্তের ছবি, পার্কে সুন্দরী মেয়েদের নাচের ছবি, অর্থাৎ যা-যা তুলতে হয় আর কি! এদেশে অনেক ক্যামেরার দোকানে একদিনের মধ্যেই, এমনকী এক ঘন্টার মধ্যে নেগেটিভ ফোঁটানো ও ছাপানো হয়ে যায়। সেরকম এক দোকানে আমার রোলটি জমা দিয়ে এলুম।

পরদিন ছবি আনতে গিয়েই চমক। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে এক ভাবুক ও দার্শনিক চেহারার যুবক। আমার রসিদ দেখাতেই সে অনেকগুলি খামের মধ্য থেকে আমার খামটি খুঁজে বার করে আনল। তারপর সেটি খুলে সে ছবিগুলো দেখতে লাগল গভীর মনোযোগ দিয়ে। ছবিগুলো সে দেখে আর এক একবার আমার মুখের দিকে তাকায়। আস্তে-আস্তে তার ললাটে ফুটে ওঠে বিস্ময় ও চিন্তার ঢেউ।

আমার বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। ব্যাপার কী, এবারেও কি আমার একটাও ছবি ওঠেনি? জাপানের বিখ্যাত অলিমপাস টু ক্যামেরা দিয়েও কি এতখানি ব্যর্থতা সম্ভব? কিংবা, আমি এমনই ভালো ছবি তুলে ফেলেছি যে এই যুবকটি বিশ্বাসই করতে পারছে না।

ছেলেটি অস্ফুটভাবে বলল, স্ট্রেঞ্জ! ভেরি স্ট্রেঞ্জ।

আমি আবার ফাঁপরে পড়লুম। না হয় আমার ছবিগুলো খারাপ হয়েছে, কিংবা একটাও ওঠেনি, তাতে স্ট্রেঞ্জ বলার কী আছে?

আমি পকেটে হাত দিয়ে বললুম, কত দিতে হবে?

ছেলেটি বলল, তোমার ক্যামেরাটা একটু দেখতে পারি কি?

আমি ঝোলা থেকে ক্যামেরাটা বার করে দিলুম ওর হাতে। সে ক্যামেরাটা নেড়ে চেড়ে, ভেতরটা খুলে দেখে বলল, এটা তো ঠিকই আছে মনে হচ্ছে।

আমি এবারে বুক ঠুকে জিগ্যেস করলুম, আমার ছবিগুলো ঠিক নেই বুঝি?

সে খানিকটা ইতস্তত করে বলল না, মানে, ছবিগুলো ঠিকই আছে, কিন্তু রঙের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না, তুমি বরং নিজেই দ্যাখো।

আমি খামটা টেনে নিয়ে ছবিগুলো ছড়িয়ে ফেললুম। অদ্ভুত ব্যাপার! অলৌকিক! আমার তোলা নদী, গাছ, সূর্যাস্ত, পার্কে মেয়েদের নাচ–সবই উঠেছে, সবাইকেই চেনা যায়, কিন্তু সকলেরই রং শুধু হলদে! গাছ-নদী-মেয়েরা তো বটেই, এমনকী সূর্যাস্ত পর্যন্ত হলুদ। আজকালকার রঙিন ছবিতে লাল-নীল-গোলাপি ইত্যাদি সব রংই ফোটে, আমার ছবি শুধু হলুদ কেন?

যুবকটির মুখের দিকে তাকাতেই সে বলল, আমি আগে কখনও এরকম দেখিনি। ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছি না।

আমাদের দেশে ব্যাঙ্কের চেক ফেরত দেওয়ার সময় যেমন একটি ছাপানো কাগজ দেয়, অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটাতে টিক দেওয়া থাকে। এরাও ছবি ছাপানোর সঙ্গে দেয় সেই রকম একটা ছাপানো কাগজ, কিন্তু আমারটাতে কোনও ছাপানো কারণেই দাগ দেওয়া নেই, তলায় হাতে লেখা আছে। সম্ভবত রোলটা ক্যামেরায় ভরার সময় কিছু গন্ডগোল হয়ে থাকবে। অর্থাৎ আমার ছবির খুঁতের আসল কারণটা এরা ধরতে পারেনি, ব্যাপারটা অভিনব।

ছেলেটি অপরাধীর মতন বলল, হয় সব রং আসবে, অথবা ছবিগুলো কালো হয়ে যাবে, কিন্তু শুধু হলদে রংটা কী করে এল…

কিছুকাল আগে একটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ফিলম খুব হইচই তুলেছিল। ফিলমটির নাম ‘আই অ্যাম কিউরিয়াস–ইয়োলো।’ টাইম সাপ্তাহিকে ছবিটির সমালোচনার হেডিং দেওয়া হয়েছিল, ‘আই অ্যাম ফিউরিয়াস রেড।’ এই হলদে ছবিগুলো দেখে আমারও টাইম পত্রিকার সমালোচকের মতন মনের অবস্থা। পল গগ্যাঁ হলদে রঙের মেয়ে এঁকেছেন। কিন্তু ফটোতে শুধু হলদে রঙের মেয়ে যে এত খারাপ দেখায় তা আমি কি আগে জানতুম! হলদে রঙের গাছও অতি বিকট ব্যাপার।

আমি বললুম, ওসব আমি জানি না। তোমরা আবার ভালো করে প্রিন্ট করে দাও।

ছেলেটি বিনীতভাবে বলল, তোমার এই নেগেটিভে নতুন করে প্রিন্ট করলে আর ভালো করা যাবে না। তুমি বরং আর একটা রোল তুলে দিয়ে যাও, সেটা আমরা বিনা পয়সায় করে দেব।

কিন্তু ততদিনে সেই শহর ছেড়ে আমি চলে গেছি।

তা বলে আমি হতোদ্যম হয়ে ছবি তোলায় ইস্তফা দিলুম না, আবার নতুন রোল ভরে নিলুম ক্যামেরায়। আবার ছবি তুলতে লাগলুম ঝপাঝপ।

দ্বিতীয় রোলটি ডেভেলপ করতে দিলুম বস্টনে। এবারে আর কোনওরকম এদিক ওদিক নয়, সবক’টি ছবিই উঠেছে। সেটা আমার কৃতিত্ব না হোক, জাপানি ক্যামেরার কৃতিত্ব তো বটেই। লাল-নীল-সবুজ-হলদে সব রংগুলোও ঠিকঠাক। তবে ছবিগুলো একটু ঝাঁপসা- ঝাঁপসা, কিন্তু সে দোষ আমার নয়, সব সময় ঝিরিঝিরি বরফ পড়লে আমি কী করব? দোষটা আকাশের।

সুতরাং ছবি তোলার ব্যাপারে আমার বেশ একটা আত্মবিশ্বাস জন্মে গেল। এখন আমি মাটিতে শুয়ে কিংবা রেলিং-এর ওপরে দাঁড়িয়ে নতুন নতুন কায়দায় অস্থিরকে শাশ্বত করে রাখি। অন্ধকারেও পরোয়া নেই, ফ্ল্যাশ আছে। এমন স্পর্শকাতর শাটার যে একটু আঙুলের ছোঁয়া লাগতে না লাগতেই সেটা পড়ে যায়। ফলে আমার বুট জুতোর ছবি, আমার বাঁ-হাতের তিনটি আঙুলের ছবি, গাড়ির চাকার অর্ধেকটার ছবি, এমনকী নিছক শূন্যতার ছবিও উঠে গেল বেশ কয়েকটা। এ হল নিউ ওয়েভ ফটোগ্রাফি! কোনও বিখ্যাত ফটোগ্রাফার শুধু একজোড়া বুট জুতোর ছবি তোলার কথা কখনও স্বপ্নেও ভেবেছে? ভ্যান গঘ সেই কবে বুট জুতোর ছবি এঁকেছিলেন, তারপর এতদিন পরে আমি সেরকম ছবি ক্যামেরায় তুললুম।

বস্টন থেকে আবার ফিরে এসেছি নিউ ইয়র্কে। গত মাসের নিউ ইয়র্ক ছিল শুধু আমার নিজের চোখে দেখা, এবারে ক্যামেরার চোখে। আগেরবারে আমি ছিলুম স্বাধীন, যখন যেখানে খুশি গেছি। এবারে আমার মধ্যে একটু বেশ টুরিস্টের মতন ভাব এসেছে, অবশ্য-দ্রষ্টব্য স্থানগুলো আর না দেখলেই নয়।

যেমন এর আগে যতবার নিউ ইয়র্কে এসেছি, কোনওবারই স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখা হয়নি। ওই মর্মর মহিলাটিকে দূর থেকেই স্তুতি জানিয়েছি। কিন্তু এবারে মনে হল, ওর কাছে গিয়ে আমার নিজের হাতে ছবি তোলা অবশ্য কর্তব্য।

কাছাকাছি যাওয়ার ঝামেলা আছে। হাডসন নদীর ওপর একটা ছোট দ্বীপে আছে ওই বিশ্ববিখ্যাত মূর্তিটি। ম্যানহাটানের হৃৎপিণ্ডের কাছে একটা পার্ক, সেখান থেকেও দূরবিনে দেখা যায়, অথবা ফেরি স্টিমারে কাছাকাছি যাওয়া যায়। আমি এসে পড়েছি রবিবারে, ফেরির জন্য লম্বা লাইন। কিছুক্ষণ একটা বেঞ্চে বসে রইলুম। একবার গেলুম একটা দোকানে কফি হ্যামবার্গার খেয়ে আসতে, তখনও লাইন খুব বড়। অত বড় লাইনে দাঁড়াবার ধৈর্য আমার নেই। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছি।

হঠাৎ খেয়াল হল, ক্যামেরা? যাঃ! সেটা তো নেই। এর মধ্যে কোথায় যেন ফেলে এসেছি। কোথায়? যে-বেঞ্চটায় বসেছিলুম একটু আগে, সেখানে নিশ্চয়ই। দৌড়োতে-দৌড়তে গেলুম সেদিকে।

কাছাকাছি গিয়েই একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। যাক, পাওয়া গেছে। এক জোড়া তরুণ দম্পতি দাঁড়িয়ে আছে, স্বামীটির হাতে আমার ক্যামেরা, তার স্ত্রী নদীর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে পোজ দিয়ে আছে। তা তুলছে তুলুক না। আমি ঠিকানা জেনে নিয়ে পরে ওদের ছবির কপি পাঠিয়ে দেব।

ওরা দু-তিনখানা ছবি তোলার পর আমি কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালুম। স্বামীটি আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাতেই আমি হেসে বললুম, ভুল করে আমার ক্যামেরাটা ফেলে গিয়েছিলুম, অলিমপাস টু।

ছেলেটি ততোধিক ভুরু কুঁচকে বলল, কী বলছ?কার ক্যামেরা?

আমি বললুম, তোমার হাতে অলিমপাস টু দেখছি, মানে আমিও আমারটা ফেলে গেছি, ওটা কি তোমার?

ছেলেটি বলল, নিশ্চয়ই।

বলেই সে একটা অতি সুদৃশ্য কেসের মধ্যে ক্যামেরাটা ভরে ফেলল। তা হলে কি আমি আমারটা এখানে ফেলিনি? স্টিমার ফেরির কাউন্টারের কাছে? ওখানে একবার খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম।

আবার দৌড়োলুম সেদিকে। সেখানেও একজন লোকের হাতে অলিমপাস টু। এবারে সতর্ক হয়ে জিগ্যেস করলুম, আমি এখানে একটা ক্যামেরা ফেলে গেছি, এই খানিকটা আগে।

লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে নিজের ক্যামেরাটা লুকিয়ে ফেলল।

সেই লাইনে আরও দু-তিন জনের হাতে আমি দেখলুম ওই একই ক্যামেরা। এখানেও নিশ্চয়ই ফিফটি পারসেন্ট রিডাকশন সেল দিচ্ছে।

শেষ চেষ্টা হিসেবে গেলুম কফির দোকানে। তার কাউন্টারের ওপর জ্বলজ্বল করছে আর একটা অলিমপাস টু। আমি অবশ্য কাউন্টারে দাঁড়াইনি, টেবিলে বসেছিলুম, তবে ওখানে ক্যামেরাটা গেল কী করে? কোনও সহৃদয় লোক বোধহয় ওটা পেয়ে এখানে রেখে গেছে।

দোকানদারকে কিছু জিগ্যেস না করে ক্যামেরাটা তুলে নিয়েই বেরিয়ে গেলুম গটগট করে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাথরুম থেকে একটা লোক বেরিয়ে কী যেন বলতে লাগল, আমি আর তাতে কান না দিয়ে হাঁটতে লাগলুম জোরে জোরে। একেবারে পার্ক ছেড়ে বাস স্টপের দিকে।

পরের দিন সেই ছবির রোল ডেভেলপ করে আবার একটি সাংঘাতিক চমক। ওর একটা ছবিও আমার তোলা নয়। সব অচেনা নারী পুরুষ ও অদেখা দৃশ্য।

কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে ভাবলুম, কী আর করা যাবে!

মানুষের জীবনটাই নশ্বর, নিছক কিছু ছবি আমার তোলা কিংবা অন্য কারুর, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আর কী হবে!