[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১৭. একটার পর একটা পাহাড় ডিঙিয়ে

আমরা চলেছি একটার পর একটা পাহাড় ডিঙিয়ে, উপত্যকার মাঝখান দিয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরের ধারে-ধারে কোস্ট রেঞ্জ, অন্যদিকে কাসকেড রেঞ্জ আর সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালা, এর মাঝখানের উপত্যকাতেই প্রধান জনবসতি।

প্রকৃতি এখানে খুবই উদার আর উন্মুক্ত। আমরা এখানে সমুদ্র দেখিনি বটে কিন্তু মাঝে-মাঝে এক একটা হ্রদ দেখেই সমুদ্র বলে ভ্রম হয়। আর সেই সব হ্রদের নামও কত মজার, গুজ লেক, ক্লিয়ার লেক, হনি লেক, পিরামিড লেক, মোজেজ লেক ইত্যাদি। এক সময় এখানে আগ্নেয়গিরিও ছিল, কারণ একটি বিশাল হ্রদের নাম ক্রেটার লেক।

মাঝে-মাঝেই পার হতে হয় নদী। কিন্তু নদীগুলোর নাম জানতে না পারলে বড় অস্বস্তি লাগে। একটা নদীর বুকের ওপর দিয়ে বেয়াদপের মতন গাড়ি চালিয়ে চলে গেলুম, সেই নদীটির নামও জানলুম না, তাকে কোনও ধন্যবাদও দিলুম না, এ বড় অন্যায়। এর মধ্যে একটা নদীর নাম পেলুম স্নেক। আর বিশাল কলমবিয়া নদীকে চিনতেও কোনও ভুল হওয়ার কথা নয়। পাসকো নামের জায়গাটা ছাড়িয়ে কলমবিয়া নদীর তীরে আমরা একটু থামলুম। আর কোনও কারণে নয়, সেই নদীকে একটু সম্মান জানাবার জন্য।

প্রকৃতির সুন্দর জায়গাগুলিকে এরা আরও বেশি আকর্ষণীয় করে রাখে। কত রকম থাকবার জায়গা আর নানান যানবাহনের সুযোগ। দশ-পনেরো মাইল দূর থেকেই অনেক রকম প্রলুব্ধকর বিজ্ঞপ্তি। এই রকম রয়েছে অনেকগুলি ন্যাশনাল পার্ক আর ঝরনা আর পার্বত্য নিবাসের খবর।

চিলকুইন নামে একটা চমৎকার জায়গায় আমরা মধ্যাহ্নভোজ সেরে আবার যাত্রা শুরু করতেই ক্ল্যামাথ ফলসের অনেক রকম নিশানা দেখা যেতে লাগল পথের পাশে। এটা বেশ নাম করা জলপ্রপাত, ওই নামে একটা মস্ত বড় হ্রদও আছে। এমন নিবিড় জঙ্গল ঘেরা পথ যে ওই দিকে মন টানে।

দীপকদা জিগ্যেস করলেন যাবে নাকি ক্ল্যামাথ ফলসে? তবে ওখানে একদিন থাকতে হবে, সব দেখতে অনেক সময় লাগবে।

আমরা সবাই রাজি, কিন্তু একটা ছোট অসুবিধে দেখা দিল। জিয়া আর প্রিয়া নাম্নী বালিকাদুটিকে ডিজনিল্যান্ড দেখাবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, ওরা সে জন্য অধৈর্য হয়ে উঠেছে। পুরো দুটো দিন কেটে গেছে গাড়িতে, ওই বয়সে সর্বক্ষণ গাড়ির মধ্যে চুপচাপ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে কেনই বা ভালো লাগবে!

সুতরাং আমরা ঠিক করলুম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্যালিফোর্নিয়ায় ঢুকে পড়াই ভালো।

আজ শনিবার, তাই পথে গাড়ির ভিড় অনেক বেশি। অনেক গাড়ির মাথায় তাঁবু কিংবা নৌকো চাপানো। কেউ-কেউ গাড়ির সঙ্গে টেনে নিয়ে চলেছে একটা ট্রেলার, অর্থাৎ নিজের শয়নকক্ষটি সঙ্গে নিয়েই বেড়াতে বেরিয়েছে। যেটা অদ্ভুত লাগে, সেটা হল বেশিরভাগ গাড়িই চালাচ্ছে কোনও নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা, এরা একলা একলা বেড়াতে যায়, কোনও সঙ্গী জোটেনি। কোনও কোনও গাড়িতে রয়েছে শুধু দুটি বা তিনটি মেয়ে, তাদের কোনও পুরুষ বন্ধু নেই।

ইচ্ছে করেই কি না কে জানে, দীপকদা পথ ভুল করে চলে এলেন ক্ল্যামাথ ফলসের কাছাকাছি। জিয়া আর প্রিয়া ঠিক বুঝতে পেরে আপত্তি জানাল। এত কম বয়েসে নিছক প্রকৃতি মন টানে না। আমরা ক্ল্যামাথ হ্রদের এক পাশে এক চক্কর মেরে আবার অন্য পথ ধরলুম।

পাহাড় থেকে রাস্তা নেমে এল সমতলে। বনরাজিও বিরল হয়ে এল ক্রমশ। জায়গাটার নাম উইড। নামের সঙ্গে খুব মিল আছে পরিবেশের। দুপাশে খয়েরি রঙের আগাছা শুধু, এই রকমই মাইলের পর মাইল। রীতিমতন এক ঘেয়ে। এইরকম জায়গা দিয়ে যেতে-যেতে ঘুম পেয়ে যায়। শুধু দীপকদার ঘুমোবার উপায় নেই, সারা পথ ওঁকে একাই গাড়ি চালাতে হচ্ছে। যেমন খাওয়া, সেইরকম ঘুম সম্পর্কেও বিশেষ আগ্রহ নেই দীপকদার। সারাদিনের এত ধকলের পর রাত্রে যেখানে আমরা থাকি, সেখানে পৌঁছেও দীপকদা ঘুমের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন না। তখন হাত-পা ছড়িয়ে অন্তত ঘণ্টা দুয়েক আজ্ঞা না দিলে তাঁর চলে না।

জয়তীদি হঠাৎ বলে উঠলেন, ওই দ্যাখো শাস্তা!

আমরা চমকে উঠলুম। শাস্তা, তার মানে মাউন্ট শাস্তা, তা হলে তো আমরা ক্যালিফোর্নিয়ায় ঢুকে পড়েছি।

আমি জিগ্যেস করলুম, ক্যালিফোর্নিয়ার চেক পোস্ট পড়ল না? কোনও ঝঞ্ঝাট হল না?

আমরা আসবার পথেই বারবার শুনে আসছিলুম, ক্যালিফোর্নিয়ার চেকপোস্টে নাকি অনেক ঝঞ্ঝাট হবে। বাক্স-প্যাঁটরা সব খুলে দেখবে।

কিছুদিন ধরেই কাগজে পত্রে খবরের নায়ক হয়েছে ভূমধ্যসাগরের মাছি, যার সংক্ষিপ্ত নাম মেড-ফ্লাই। ভূমধ্যসাগর থেকে নাকি এক ঝাঁক দুষ্টপ্রকৃতির মাছি উড়ে এসে এখানকার সব ফল বিষাক্ত করে দিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যটিরই আর এক নাম অরেঞ্জ স্টেট। এখানকার আঙুর খুব বিখ্যাত। ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়াইন এখন ফরাসি ওয়াইনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। সুতরাং ওই মাছির উপদ্রবে হইহই পড়ে গেছে এখানে, মাছি দমন করার কতরকম প্রস্তাবই শোনা যাচ্ছে। এমনকী বিখ্যাত কলামনিস্ট আর্ট বুখওয়াল্ডও এক দারুণ মজার রচনা লিখে ফেলেছেন এই মাছি বিষয়ে। যাই হোক, এইসব কারণেই, বাইরের কোনও রাজ্য থেকে আর কোনওরকম বিষাক্ত ফল যাতে এখানে না ঢুকতে পারে, সেই জন্য সীমান্তে খুব কড়াকড়ি চলছে। আমাদের সঙ্গে যে কলা আর আপেল ছিল, তা সব শেষ করে ফেলতে হয়েছে সকালেই। মেজদি বারবার আমাদের বলছিলেন, কলা খাও। কলা খাও, শিগগির।

জয়তীদি বললেন, চেক পোস্ট তো কখন পেরিয়ে এসেছি, তোমরা তখন ঘুমোচ্ছিলে।

–বাক্সটাক্স খোলেনি!

–নাঃ! আমি বললুম আমাদের সঙ্গে ফল টল কিছু নেই, তাই শুনেই ছেড়ে দিল।

আমি বললুম, দেখা যাচ্ছে সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র!

জয়তীদি এমন একটা ভঙ্গি করলেন, যার অর্থ, ছেলেমানুষ হয়ে আর অত পাকামি করতে হবে না!

দীপকদা বললেন, দ্যাখো, এবার মাউন্ট শাস্তা খুব ভালো করে দেখা যাচ্ছে।

মাউন্ট শাস্তার চূড়াটি সত্যি বড় সুন্দর। ঠিক মনে হয়, একটা সাদা রঙের টুপি পরে আছে। এই পাহাড়টির উচ্চতা চোদ্দো হাজার ফিটের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। আমরা হিমালয়ের দেশের লোক, আমাদের কাছে চোদ্দ হাজার ফিটের পাহাড় তো নিছক ছেলেমানুষ।

কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার এই পাহাড়টির বৈশিষ্ট্য এই যে, এর মাথায় সারাবছর বরফ থাকে, সেইজন্য এই গ্রীষ্মেও এর মাথায় সাদা টুপি।

ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যটিকেই অবশ্য চির বসন্তের দেশ বলা যায়। পাহাড়, জঙ্গল এমনকী এক প্রান্তে মরুভূমি থাকলেও ক্যালিফোর্নিয়ার অধিকাংশ জায়গাতেই সারা বছর বড় মনোরম আবহাওয়া, বেশি গরমও নেই, শীতও নেই। গাছপালাও আমাদের অনেকটা চেনা। দুদিকের দুই রাস্তার মাঝখানে চোখে পড়ে দোপাটি ফুলের গাছ। অজস্র ফুল ফুটে থেকে আপনা-আপনি ঝরে যায়।

রাস্তাটা গেছে মাউন্ট শাস্তার পাশ দিয়ে ঘুরে-ঘুরে। এক-এক জায়গা থেকে পাহাড়টিকে এক এক রকম দেখায়। কোনও সময় বেশ রোগা, কোনও সময় হৃষ্টপুষ্ট। মাথার টুপিটা কখনও গোল, কখনও মেক্সিকানদের মতন, আবার কখনও গান্ধি টুপির মতন। পাহাড়ের কোলে-কোলে নির্জন সবুজ উপত্যকা দেখলেই আমার মন কেমন করে। যেন এইখানে একটা কুটির বেঁধে আমার থেকে যাওয়ার কথা ছিল। চুপচাপ, অনেক দিন। কিন্তু থাকা হয় না, এই সব জায়গা স্মৃতিতে ছবি হয়ে যায়।

খুব ভালো করে মাউন্ট শাস্তাকে দেখবার জন্য আমরা এক জায়গায় থামলুম। খাড়া পাহাড়ের এক পাশ অনেকখানি ঢালু হয়ে নেমে গেছে, নীচে এক জলাশয়, সেটা নদী, না হ্রদ না কোনও বাঁধ তা বোঝবার উপায় নেই। একেবারে জনশূন্য স্থান, শুধু রয়েছে একটা টেলিফোন বুথ আর একটা ময়লা ফেলার জায়গা। স্থানটির রম্যতার জন্য এখানে অনেকেই গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ বসতে চাইবে। খাবারদাবারের প্যাকেট ও টিন যেখানে-সেখানে ফেলে যাতে নোংরা করা না হয়, তার জন্য প্রায়ই নোটিশ থাকে যে যেখানে-সেখানে ওই সব ফেললে পাঁচশো ডলার ফাইন হবে। বিশেষ কেউ তা মানে না অবশ্য। এখানে সেখানে বিয়ারের টিন গড়াতে দেখা যায়।

শুরু হল ছবি তোলার পালা। দীপকদা ছবি তোলার ব্যাপারে একজন শিল্পী, তাঁর ক্যামেরায় নানারকম লেন্স, অনেক ভেবে চিন্তে তিনি একখানা দুখানা ছবি তোলেন মাত্র। কিন্তু এদেশের বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও ফটাফট ছবি তুলতে পারে। যেমন জিয়ার আছে পোলারয়েড ক্যামেরা, সে

পটপট করে শাটার টিপছে আর অমনি হাতে গরম রঙিন ছবি বেরিয়ে আসছে। এমনকী সাত বছরের মেয়ে প্রিয়াও ওই ক্যামেরায় ছবি তুলে ফেলল কয়েকখানা।

জয়তীদি বললেন, বড্ড ভালো লাগছে জায়গাটা, তাই না?

দীপকদা বললেন, বেশি ভালো লাগা ভালো নয়। তা হলে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না।

মেজদি বললেন, সত্যিই আমার এ জায়গাটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।

আমি একটু দূরে বসেছিলুম। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বললুম, সাপ! সাপ! র‍্যাটল স্নেক।

অমনি একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। প্রথমে সবাই নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়ার পর আবার কাছে এল। র‍্যাটল স্নেকটিকে দেখা গেল না, আমি পুরোপুরি বানিয়ে বলেছি কিনা তা-ও ঠিক বোঝা গেল না। আমি অবশ্য বারবার বলতে লাগলুম, আমি র‍্যাটল স্নেকটার লেজের দিকের শুকনো হাড়ের খটাখট শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি।

যাই হোক, সাপের নাম উচ্চারণ করার পর জায়গাটার মাধুর্য অনেকটা নষ্ট হয়ে এল। অবশ্য বেলাও চলে এসেছে, আলো শুষে নিচ্ছে আকাশ। আবার শুরু হল যাত্রা।

গাড়ি চেপে যাওয়ায় যদিও শারীরিক পরিশ্রম কিছুই নেই, তবু খিদে পায় ঘনঘন। মনে হয় খাইয়াটাই এক মাত্র কাজ। অন্ধকার নামবার পরই আমাদের মনের মধ্যে একটা খাইখাই রব ওঠে। আমরা কোন শহরে যাওয়ার জন্য থামব, তা আমরা পছন্দ করতে শুরু করি। ইচ্ছে করলে কোনও বড় শহরের মধ্যেই না ঢুকে হাজার দেড়হাজার মাইল চলে যাওয়া যায়। আবার ইচ্ছে করলেই বাইপাস দিয়ে ঢুকে পড়া যায় যে-কোনও শহরে।

দীপকদার গাড়িতে তেল ফুরিয়ে গেছে, তাই ঢুকে পড়লেন একটা শহরে। শহরটির নাম রেডিং। কস্মিনকালেও এ জায়গাটার নাম আগে শুনিনি, কিন্তু এখানেই আমাদের খাদ্য বরাদ্দ ছিল। গাড়ির খিদে ও আমাদের খিদে এক সঙ্গেই মিটিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা এখানে নেমে

পড়লুম।

কোন দোকানে খাব, এটা ঠিক করাও একটা খেলার মতন। দোকানের সংখ্যা অনেক, সেই জন্যই পছন্দ করা দুষ্কর। এই রেডিং-এর মতন একটা নাম-না-জানা জায়গাতেও পাশাপাশি অন্তত কুড়ি-পঁচিশটা ভোজনালয়। টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছিল বলে আমরা বেশি বাছাই না করে সামনের একটা চিনে দোকান দেখে ঢুকে পড়লুম। এমনিতেই কলকাতার মানুষদের চিনে খাবারের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে, এখানে এসে আমরা অনেকদিন ওই খাবার খাইনি।

দোকানটিতে ঢুকে প্রায় তাজ্জব হওয়ার মতন অবস্থা। এই ধাধধাড়া গোবিন্দপুরে এত বড় চিনে হোটেল? মনে করুন বেলমুড়ি কিংবা মানকুণ্ডুর মতন জায়গায় পাঁচশো লোকের এক সঙ্গে খাবারের মতন চিনে রেস্তোরাঁ। কলকাতাতেও এত বড় দোকান আজও হয়নি। অবশ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় চিনে অধিবাসীর সংখ্যা অনেক এবং চিনের সঙ্গে বর্তমান আঁতাত হওয়ার আগে থেকেই আমেরিকানরা চিনে খাবারের খুব ভক্ত। তা হলেও এত বড় দোকান দেখে চমকে যেতেই হয়।

দোকানটি তিনটি অংশে ভাগ করা, এর মধ্যে যে-যে অংশে মদ পাওয়া যায়, সেখানে বাচ্চাদের প্রবেশ নিষেধ বলে আমরা বসলুম সর্বসাধারণের এলাকায়। সেখানেও অন্তত পঞ্চাশটি টেবিল, কিন্তু প্রায় সবগুলোই খালি। প্রায় রাজকীয় খাতির পেলুম আমরা। একাধিক পরিচারিকা বারবার আমাদের তদারকি করে গেল। খাবারগুলোও বেশ ভালো, তবে আমাদের কলকাতার মতন নয়। কলকাতার চিনে খাবার সত্যিই অপূর্ব।

বিল মেটাবার সময় আমি যথারীতি পুরোনো কায়দায় পকেটে হাত ঢুকিয়ে, ‘আমি দিই, আমি দিই’ বলতে থাকি, হাতটা আর পকেট থেকে বেরোয় না, তার মধ্যেই জয়তীদি ধমক দিয়ে বলেন, তুমি ছেলে মানুষ, খবরদার দেবে না…। দীপকদাই দিয়ে দেন টাকাটা। আমি কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, আপনারা কি আমায় একবারও সুযোগ দেবেন না।

খুচরো ফেরত আসবার সময় প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এল সাতখানা বেশ বড় সাইজের করবী ফুলের বিচি। দেখেই চিনতে পারলুম, ওগুলো হল ফরচুন কুকি। এর আগে অন্য কোনও দোকানে ফরচুন কুকি দেয়নি। ওগুলো আসলে বিস্কুটে তৈরি, ভাঙলে ভেতরে টুকরো কাগজ পাওয়া যায়, তাতে সেদিনের ভাগ্য লেখা থাকে।

ছোটদের দাবি আগে, তাই প্রিয়া প্রথমে একটা তুলে নিয়ে ভাঙল। তাতে লেখা আছে, তুমি যা স্বপ্ন দেখবে, তাই সত্যি হবে। আমরা হাততালি দিলুম। এবার খুলল জিয়া। তার ভাগ্যলিপিঃ আগামী কালকের দিনটি তোমার জীবনের একটা চমৎকার দিন। শিবাজি রায় পেল :ঘর ছেড়ে বেশিদিন দূরে থেকো না। মেজদিরটা, যা হারিয়ে যায় তার জন্য দুঃখ করে লাভ নেই, নতুন কিছু শিগগির পেয়ে যাবে। জয়তীদির খুব তাড়াতাড়ি তুমি একটা সুখবর পাবে।

আমারটা অতি সাধারণ এবং খুব সত্যিও বটে:তোমার বন্ধু ভাগ্য খুব ভালো।

দীপকদা হাসতে-হাসতে বললেন, দ্যাখো, আমি কী পেয়েছি! এ যে সত্যিই ভবিষ্যত্বাণী।

আমরা সবাই দীপকদার কাগজটা দেখলুম : যদি আজ কোথাও যাত্রা শুরু করে থাকো, তা হলে মাঝপথে থেমো না, এগিয়ে চল!

দীপকদা বললেন, তার মানে আমাকে রাত্তিরে থামতে বারণ করছে। তা হলে কি সারা রাত গাড়ি চালাব?

এই নিয়ে একটুক্ষণ বিতর্ক হল। দীপকদার ইচ্ছে সারারাত গাড়ি চালিয়ে যতদূর সম্ভব এগিয়ে যাওয়া। জয়তীদি বললেন তোমার স্ট্রেন হবে। মেজদি বললেন, বাচ্চাদের কষ্ট হবে। বাচ্চারা না না বলে উঠল।

শেষ পর্যন্ত ফরচুন কুকির নির্দেশই মান্য করা হবে ঠিক হল। গাড়ির পেছনের দিকে জিয়া আর প্রিয়ার শোওয়ার জায়গা করে দেওয়া হল। আমরা সারারাত গল্প করতে করতে যাব। আমাদের ঘুমোলে চলবে না।

শিবাজি গাড়িতে উঠেই ঘোষণা করল : চলন্ত গাড়িতে আমি কক্ষনও ঘুমোই না।

বলেই ঘুমিয়ে পড়ল সঙ্গে-সঙ্গে। তারপর চোখ জুড়িয়ে এল মেজদির। একটু বাদে জয়তীদিরই মাথাটা ঝুঁকে এল বুকের ওপরে।

দীপকদা এক মনে, একরকম স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছেন, আমি মাঝে-মাঝে ওঁকে সিগারেট এগিয়ে দিচ্ছি আর বাইরের অন্ধকার দেখছি। রাস্তায় অনেক গাড়ি। দূর পাল্লার যাত্রায় অনেকেই নাইট ড্রাইভিং পছন্দ করে। দুদিকের রাস্তায় এক দিকে উজ্জ্বল হেড লাইটের মিছিল, অন্য দিকে লাল ব্যাক লাইট। এ দেশে গুন্ডামি বদমাইশি খুনোখুনি হচ্ছে অহরহ, কিন্তু সারারাত রাস্তায় গাড়ির মধ্যে থাকায় কোনও বিপদ নেই, এটা আশ্চর্য না?

লেখকদের অনেক সুবিধে। আমি অনায়াসে এর পর লিখতে পারতুম যে পেছনের সিটে অন্যরা সবাই ঘুমোলেও আমি সারারাত বীরের মতন জেগে রইলুম দীপকদার পাশে। কেউ অবিশ্বাস করত না।

কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে, হঠাৎ এক গুচ্ছ হাসির শব্দে, আমি চমকে উঠলুম এক সঙ্গে। অন্যরা সবাই অনেক আগে জেগে উঠেছে, শুধু আমিই কাত হয়ে এমন ঘুমোচ্ছিলুম যে অনেক ডাকাডাকিতেও উঠিনি। শেষ পর্যন্ত একজন রুমাল পাকিয়ে আমার কানে সুড়সুড়ি দিতেই…।

বাইরে তাকিয়ে দেখি প্রায় ভোর হয়ে এসেছে।