[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৬. ব্রিটিশ মিউজিয়াম একদিনে

ব্রিটিশ মিউজিয়াম একদিনে দেখে ফেলা আর পাঁচ মিনিটে মহাভারত পড়ে শেষ করা একই ব্যাপার। অদ্ভুতকর্মা প্রতিভাবানদের পক্ষেই শুধু তা সম্ভব।

সব কিছুই যে দেখতে হবে, সে রকম মাথার দিব্যি তো কেউ দেয়নি। গপগপ করে গিলে খেলে কোনও খাবারেরই স্বাদ পাওয়া যায় না।

আমি অলসভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পাণ্ডুলিপি বিভাগে, হঠাৎ মনে হল, একটু চা-ফা খেলে মন্দ হয় না। শিল্প নাকি মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলিয়ে দিতে পারে, আমার তো দেখছি উলটো ব্যাপার। দু-একঘণ্টা বাদে-বাদেই চায়ের তেষ্টা পায়। তা ছাড়া এইসব জায়গায় সিগারেট টানা যায় না, মাঝে-মাঝেই বাইরে যাওয়ার ছুতো খুঁজতে হয়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামেই এক জায়গায় স্যার ওয়াল্টার র‍্যালের ছবি দেখে আমি মনে-মনে বলেছিলুম, কেন দাদা তামাকের ধোঁয়া টানার ব্যাপারটা চালু করেছিলে? এখন আমরা ওই নেশার দাস হয়ে গেছি আর রাজ্যের লোক আমাদের ক্যানসারের ভয় দেখাচ্ছে।

রাস্তা খুঁজে ক্যান্টিনে পৌঁছে লন্ডনের বিখ্যাত বিস্বাদ স্যানডুইচ আর ট্যালটেলে চা নিয়ে বসলুম। এত খারাপ খাবার খেয়েও ব্রিটিশ জাতি যে কী করে বিশ্বজয় করেছিল, তা ভাবলে অবাক লাগে। মোগলদের বুঝি, তারা মোগলাই খানা খেয়েছে, সেই রকম জবরদস্ত লড়াইও করেছে। আর ব্রিটিশরা নাকি সমরক্ষেত্রের তাঁবুতেও সন্ধেবেলা পোশাক না বদলে ডাইনিং টেবলে যেত না। ডাইনিং টেবলে গিয়ে যত রাজ্যের আলুনি-আঝালি সেদ্ধ খাবার খেত! লন্ডন শহরের পাড়ায়-পাড়ায় প্রচুর ‘ফিস অ্যান্ড চিপসের’ দোকান দেখতে পাওয়া যায়। মাছ জিনিসটাকেও যে কত অখাদ্য করা যায়, তার প্রমাণ দিয়েছে ইংরেজরা।

বিলিতি চা মানে তো আসলে আমাদেরই বা বাংলাদেশি বা সিংহলি চা। তবু এখানে চা খেয়ে যেন কিছুতেই দেশের মতন স্বাদ পাই না। একমাত্র সিগারেটের স্বাদটা এদেশে ভালো। তাও আমার মতন চার্মিনার খোরদের পক্ষে বেশ মুশকিল। এদেশে চার্মিনার বা সমতুল্য কোনও সিগারেট পাওয়া যায় না।

আমার থেকে দুটো টেবিল দূরে তিনটি ছোঁকরা বসে বেশ জোরে-জোরে কথা বলছে। চেহারা দেখে বোঝা যায় ওরা ভারতীয়, কিন্তু বাঙালি নয়, কারণ ওদের পারস্পরিক ভাষা ইংরেজি। আমার সঙ্গে একবার চোখাচোখি হল কিন্তু আমাকে পাত্তাই দিল না। প্রবাসে ভারতীয় মাত্রই ভারতীয়ের আত্মীয় নয়। অচেনা সাহেবেরা অনেক সময় ডেকে কথা বলে, কিন্তু এক ভারতীয়ের সঙ্গে অন্য ভারতীয়ের দেখা হলে দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।

অনিচ্ছা সত্বেও আমি ওদের আলোচনা শুনছিলুম। যুবক তিনটিই চাকরি করে জার্মানিতে, ছুটিতে বেড়াতে এসেছে, কিন্তু লন্ডন ওদের একটুও ভালো লাগছে না। ওদের কথা শুনে আমি রীতিমতন চমৎকৃত হলুম। লন্ডন ওদের ভালো লাগছে না, কারণ এখানে জিনিসপত্রের দাম অত্যন্ত বেশি, শহরটাও নোংরা, ছোট-ছোট রাস্তা, বড় ভিড়, খাবারদাবারের সুবিধে নেই, হোটেলের ঘরটা খুব ছোট আর বদ্ধ, পাঁচবার ডাকলেও কারুর সাড়া পাওয়া যায় না…। আমি একবার ভাবলুম, ওরা কি কলকাতার বর্ণনা দিচ্ছে?

দ্বিতীয় সিগারেটটি সবে শেষ করেছি, এই সময় দূর থেকে একজন মধ্যবয়সি ভদ্রলোক হেঁটে এলেন আমার দিকে। দু-দিন ধরে বেশ গরম পড়েছে লন্ডনে, আমার মতন যারা সদ্য আগত, তারা প্রায় সবাই শুধু হাওয়াই শার্ট পরে বেরিয়েছে, কিন্তু এই ভদ্রলোকের পরনে পুরোদস্তুর সুট টাই। মুখে পাইপ। আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথমে আপাদমস্তক আমায় নিরীক্ষণ করলেন, তারপর পরিষ্কার বাংলায় বললেন, আপনি..তুমি..নীলু না? দেবপ্রিয়র ভাইপো? তখন থেকে মনে হচ্ছে চেনা-চেনা।

ভদ্রলোকের গায়ের রং এত পরিষ্কার আর হাবভাব এত সাহেবি যে আমি স্প্যানিশ বা ইটালিয়ান ভেবেছিলুম। কিন্তু ওঁর বাংলা উচ্চারণে একটুও টান নেই।

আমি বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো আমি…

উনি বললেন, দেবপ্রিয়র সঙ্গে আমি পড়তুম। তা ছাড়া, তুমি পদ্মনাথ লেনে আমাদের পাশের বাড়িতে খুব আসতে, ভাস্করের বন্ধু ছিলে…তোমাকে হাফ-প্যান্টুল পরা অবস্থায় দেখেছি…

আমি সবিস্ময়ে বললুম, নীতিশদা?

উনি বললেন, ঠিক ধরেছ। তাহলে তোমার সঙ্গে একটু বসি? আমার হাতে আরও মিনিট কুড়ি সময় আছে।

নীতিশদার মাথার চুল কাঁচাপাকা হয়েছে, চোখের নীচে ভাঁজ পড়েছে, কিন্তু চিনতে কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়। চোখ দুটি বেশি ঝকমকে, অতি তীক্ষ্ণনাক, এই রকমই দেখেছি ছেলেবেলায়। নীতিশদার দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল। উনি ঘুড়ি ওড়াতে খুব ভালোবাসতেন এবং ইংরেজির দুর্ধর্ষ ছাত্র ছিলেন। আমরা জানতুম, নীতিশদার প্রথম থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত পুরো হ্যামলেট মুখস্ত। কিন্তু শেষ যতদূর জানতুম, উনি চাকরি করতেন পুণায়।

অবশ্য লন্ডনে এসে যে-কারুর সঙ্গে দেখা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেকোনও সময় যে-কারুর বাবার সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে, এবং তিনি জিগ্যেস করতে পারেন, আরে; তুই এখানে?

অবশ্য, আমার বাবা বেঁচে নেই এই যা। আমার বাবার সঙ্গে অন্তত দেখা হবার সম্ভাবনা নেই লন্ডনে।

নীতিশদা জিগ্যেস করলেন, তুমি এখানে কী করছ?

আমি বললুম, ফ্যাফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

–চাকরি-বাকরি পাওনি?

–না, আছে নাকি আপনার সন্ধানে?

নীতিশদা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে পাইপ ধরালেন। আমি একসময় নীতিশদাকে গুরুজনের মতন সম্রম করতুম, কিন্তু প্রবাসে নিয়ম নাস্তি এই ভেবে ফস করে জ্বেলে ফেললুম আর একটি সিগারেট।

–আপনি এদেশে কতদিন আছেন, নীতিশদা?

–তা বছর বারো হবে। ঠিক হিসেব ধরতে গেলে বারো বছর চার মাস, আমি জুনে এসেছিলুম।

অল্প বয়েস থেকেই যার হ্যামলেট মুখস্ত, তার পক্ষে পুণার বদলে লন্ডনে বসতি নেওয়াই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্যে এত বছর কেটে গেছে?

–তুমি কোন ইয়ারে এসেছ, নীলু?

মাত্র চারদিন আগে।

এবারে আমাকে আর একবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নীতিশদা বললেন, আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, তোমার গায়ে, জামা-কাপড়ে এখনও টাটকা দেশের গন্ধ। সিগারেট টানছও ঠিক কলকাতার ছেলের মতন। তুমি কি এখানে কিছু পড়তে-টড়তে এসেছ নাকি? ব্রিটিশ মিউজিয়ামে মেম্বারশিপ পেয়েছ? সে ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারি।

–আমি এখানে মাত্র দু-চারদিন থাকব।

–কোথায় যাচ্ছ?

–বালটিমোরে। সেখানে বিশ্ব-বখাটে সম্মেলন হচ্ছে, কিংবা বিশ্ব-নিষ্কর্মা সম্মেলনও বলতে পারেন, আমি সেখানে নেমন্তন্ন পেয়েছি।

নীতিশদা একটু হেসে বললেন, অসম্ভব কিছু না, ও দেশে সবই সম্ভব। ওরা বিশ্ব নর্দমা পরিষ্কার থেকে শুরু করে বিশ্বশান্তি পর্যন্ত যাবতীয় অবান্তর জিনিস নিয়েই কনফারেন্স করে। কিছুদিন আগেই শুনলুম, ওখানে বিশ্ব অনিদ্রা রোগীদের একটা সেমিনার হয়ে গেল। সবই বিশ্ব! যাই হোক এখানে একলা বসে আছ, কোনও মেয়ে বন্ধুটন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছ নাকি?

–সেরকম একজনও জোটেনি এখনও। সিগারেট টানতে এসেছি। আপনি?

–আমার চারটের সময় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। কিছুক্ষণ এখানে সময় কাটাতে এসেছি। আমি প্রায়ই আসি। তোমার লন্ডন কেমন লাগছে?

–লন্ডনের অনেক রাস্তাঘাট দেখলে বড্ড এলগিন রোড কিংবা ভবানীপুরের জন্য মন কেমন করে। ঠিক আমাদের ওইসব জায়গার মতন দেখতে, আমাদের মতন দোতলা বাস হেলে দুলে চলে, ছাতা হাতে নিয়ে লোকেরা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকে —

–তুমি ভুল করছ, কলকাতার মতন বাস এখানে চলে না, লন্ডনের দোতলা বাসের গরিব সংস্করণ কলকাতায় চলে। এলগিন রোড-টোড অঞ্চল লন্ডনের অনুকরণে তৈরি।

–তাই বুঝি! ভুলে গিয়েছিলুম।

–তোমরা লন্ডন দেখে মুগ্ধ হও না, জানি। ওই যে ওই টেবিলের ছেলেগুলো তখন থেকে চ্যাঁচাচ্ছে, ওই রকমভাবে লন্ডনের নিন্দে করা…একটুও সভ্যতা বোধ নেই।

–কেন লন্ডনে বসে বুঝি লন্ডনের সমালোচনা করা যায় না?

–তা করুক না, কিন্তু এদেশে আস্তে কথা বলাই নিয়ম, তাও মানবে না? আর ওই রকম ভুল ইংরিজি শুনলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। ওরা জার্মানি থেকে এসেছে…জার্মানিতে যারা চাকরি করে, তারা আজকাল নিজেদের খুব বড়লোক মনে করে। ওরা ভাবে ওদের চেয়ে আমরা অনেক গরিব হয়ে গেছি।

আমার হাসি পেয়ে গেল। বেশ মজার ব্যাপার। ওরা আর আমরা? ওরাও ভারতীয়, নীতিশদাও ভারতীয়। দেশ ছেড়ে বাইরে এসে দশ-বারো বছর থাকবার পর অনেকেই বেশ সৎ মায়ের ভক্ত হয়ে পড়ে। ফ্রান্সের ভারতীয়রা বলে, ইংল্যান্ডটা আবার একটা দেশ নাকি, সর্বক্ষণ প্যাঁচপেচে বৃষ্টি, নয়তো কুয়াশা, ভালো চিজ বা ওয়াইন কিছুই পাওয়া যায় না, হোটেলগুলোতে গলাকাটা দাম…। ইংল্যান্ডের ভারতীয়রা বলে, ফ্রান্স তো শুধু প্যারিস নিয়েই গর্ব করে, একটু ভেতরের দিকে যাও, দেখবে অনেক বাড়িতে এখনও খাটা-পায়খানা রয়েছে….লোকগুলো নিজেদের ভাষা ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো ভাষা বোঝে না, বুঝতেও চায় না। আর কী কঞ্জুস। ফ্রান্সের যে-কোনও মিউজিয়াম বা আর্ট গ্যালারিতে যাও, সব জায়গায় হাত বাড়িয়ে আছে, পয়সা দাও। লন্ডনের টেট গ্যালারি বা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কারুর এক পয়সা দিতে হয়?

সত্মায়ের পক্ষ নিয়ে কথা বললেও এই সব ভারতীয়দের সৎ-ভাইরা কিন্তু কখনও ওদের আপন মনে করে না।

নীতিশদা বললেন, আসল ব্যাপার কী জানো, এইসব ছেলেরা, যারা ফর্টিসেভেনের পর জন্মেছে, তাদের ইংল্যান্ড বা ইংরেজ জাত সম্পর্কে আলাদা কোনও মোহ নেই। আমরা যারা পরাধীন আমলে জন্মেছি, আমাদের মোহই বলো, শ্রদ্ধা-ভক্তি, ভয়, ঘৃণা–এইসব মিলিয়ে একটা অন্যরকম ধারণা আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে আছে এদের সম্পর্কে। আমাদের বাবা-কাকারা এখনও বলেন বিলেত, অর্থাৎ রাজার দেশ, এখনকার ছেলেমেয়েরা বলে লন্ডন। এই যে ট্রাফালগার স্কোয়ার, পিকাডেলি সার্কাস, হাইড পার্ক কর্নার এইসব জায়গা সম্পর্কে ছেলেবেলা থেকে এত পড়েছি যে ছবির মতন সব দেখতে পেতুম, কোনওদিন এসব জায়গায় পা দেব ভাবলেই রোমাঞ্চ হত। এখনকার ছেলেমেয়েদের পক্ষে এগুলো কিছুই না জাস্ট কতকগুলি টুরিস্ট স্পট…।

আমি জিগ্যেস করলুম, নীতিশদা, এখানে প্রথম পা দেওয়ার সময় আপনার যে রোমাঞ্চ হয়েছিল, এই বারো বছর পরেও কি সেই রোমাঞ্চ টিকে আছে?

নীতিশদা বেশ জোর দিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই! লন্ডন আমার কাছে কখনও পুরোনো হয় না। এখন ব্রিটিশ জাতটা একটু নিস্তেজ হয়ে গেছে, পাউন্ডের দাম রোজই হু-হুঁ করে নেমে যাচ্ছে, তবু লন্ডন হচ্ছে লন্ডন। এরকম ওপন সিটি পৃথিবীতে আর একটাও আছে? বিশ্বের যত বড়-বড় জ্ঞানী-গুণী তাদের সবারই স্থান আছে এখানে।

–প্যারিসের লোকেরাও প্যারিস সম্পর্কে এই কথা বলে। যারা নিউইয়র্কে থাকে, তাদের মতে নিউইয়র্কের মতো ওপন সিটি নাকি আর হয় না।

–আরে প্যারিস শহরটাই হচ্ছে কৃত্রিম। শুধু সুন্দর করে সাজানো। ফ্রান্সের বাগানগুলো দেখেছ? একেবারে নিখুঁত না? ওরকম বাগান কি বাস্তব মনে হয়? সব গাছগুলোকে কাঁচি দিয়ে হেঁটে-হেঁটে একেবারে খেলনার মতন করে রাখে। বীভৎস। প্যারিস শহরটাই সন্ধেবেলাকার পরের শহর। দিনের বেলা কী করতে হয় ওরা জানেই না। আর নিউইয়র্ক তো উটকো ব্যাপার, ওরা ভাবে কোনও কিছুই খুব বড় হলে তবে সুন্দর হয়। মানুষের চিন্তায় যা কিছু শ্রেষ্ঠ ফসল, তা তুমি পাবে লন্ডনে। রবি ঠাকুর বলো আর কার্ল মার্কসই বলো, সবাইকেই আসতে হয়েছিল এখানে। এই লন্ডনের রাস্তায়-রাস্তায় গোটাকতক সেঞ্চুরির ইতিহাসের ধুলো মিশে আছে।

–এখন বড্ড বেশি ধুলো জমে গেছে মনে হয় না আপনার?

নীতিশদা বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে, একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, তারপর বললেন, আমার সময় হয়ে গেছে, এবার আমায় উঠতে হবে। একদিন আসবে নাকি আমার ওখানে?

–নিশ্চয়ই, ঠিকানা দিন। বউদি কি বাঙালি, না মেমসাহেব?

নীতিশদা প্রথমে কোটের ভেতরের পকেট থেকে পার্স বার করলেন, তারপর তার থেকে একটা কার্ড নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন, সাড়ে পাঁচটার পর আমি বাড়িতেই থাকি, যে কোনও দিন এসো। বউদি-টউদি কেউ নেই…।

একটু অন্যমনস্কের মতন মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে উনি আবার বললেন, তোমার থাকার জায়গার কোনও অসুবিধে নেই তো? আমার কাছেও এসে থাকতে পারো কয়েকদিন, তবে নিজে রান্না করে খেতে হবে।

–আমার থাকার জায়গা আছে নীতিশদা।

–তা হলে আমি চলি। সম্ভব হলে এসো…বাই-বাই।

নীতিশদা চলে যাওয়ার পর আমিও উঠে পড়লুম। একটা ব্যাপারে খটকা লাগল। নীতিশদা একবারও তো কলকাতার খবর জিগ্যেস করলেন না। সাধারণত অন্য সবাই জিগ্যেস করে, কলকাতার লোডশেডিং-এর বর্তমান পরিস্থিতি, রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি, বাড়ি ভাড়া এবং রান্নার গ্যাস ঠিক মতন পাওয়া যায় কি না, জ্যোতি বসু আর ইন্দিরা গান্ধী ইত্যাদি। অন্তত পুরোনো চেনাশুনো লোকেরা কে কেমন আছে সে সম্পর্কেও নীতিশদার কোনও আগ্রহ নেই!

আরও কিছুক্ষণ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ঘোরাঘুরি করবার পর একটি অভিজ্ঞতা হল।

মিউজিয়ামের দিকটায় বিভিন্ন ঘরে-ঘরে প্রহরী থাকে। তাদের মধ্যে অনেকেই কালো মানুষ। কয়েকজনকে ভারতীয় বলেও মনে হয়। বড্ড বাজে চাকরি, সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শুধু একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা আর লোকজনের হাতের দিকে নজর রাখা। একটুক্ষণের জন্যও বসবার নিয়ম নেই।

সেইরকম একজন প্রহরীকে আমি জিগ্যেস করলুম, মিশরীয় সংগ্রহের দিকটা কোথায়?

প্রহরীটা সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, তুমি কি ভারতবর্ষ থেকে আসছ?

আমি ঘাড় নাড়তেই সে আবার বলল, এখানে কী দেখতে তোমরা আমোএই ব্রিটিশ জাতটা পৃথিবীর সব জায়গা থেকে চুরি করে কিংবা লুট করে এইসব জিনিস নিয়ে এসেছে, তা দেখতে তোমাদের ভালো লাগে? রাগ হয় না।

বেশ অবাকই হলুম আমি। এখানকার প্রহরীর চাকরি করেও এমন কথা বলছে? তা ছাড়া কথা বলছে ইংরেজিতে, অন্য কেউ শুনেও তো ফেলতে পারে!

লোকটি নিজের থেকেই আবার বলল, আমি এসেছি উগান্ডা থেকে। এক সময় আমরা ভারতীয় ছিলুম। এখন আমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট, কিন্তু এদেশের সরকার আমাদের সঙ্গে কীরকম খারাপ ব্যবহার করেছে জানো? আমাকে আসতে দিয়েছে, কিন্তু আমার মা আর ছোট ভাইকে ঢুকতে দেয়নি এদেশে। উগান্ডা থেকে ইদি আমিন আমাদের তাড়াল, ব্রিটিশ সরকারও আমাদের কোনও প্রোটেকশান দিল না..এ জাতটা এত স্বার্থপর…

লোকটির চোখমুখ দিয়ে তিক্ততা আর ঘৃণা ঝরে পড়ছে। আমি বেশ একটু অপ্রস্তুত বোধ করলুম। উগান্ডার ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সমস্যার কথা খবরের কাগজে পড়েছি, তাদের কারুকে আগে চোখে দেখিনি। লোকটি আমায় ছাড়তে চায় না। চাপা গলায় অনবরত ব্রিটিশ জাতির নিন্দে করে যেতে লাগল। তার যোগ্যতা অনেক বেশি থাকলেও সে এখানে একটা বাজে চাকরি পেয়েছে, থাকার জায়গার দারুণ সমস্যা..ছোট ভাইটা মাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কানাডায় আশ্রয় পেয়েছে বটে কিন্তু চাকরির পারমিট জোগাড় করতে পারেনি, তাদের জন্য দুশ্চিন্তা…।

–তোমরা ভারতে ফিরে গেলে না কেন? সেখানে তোমাদের পুরো পরিবারটা একসঙ্গে থাকতে পারতে।

–ভারতে কি চাকরি পাওয়া যায়? সেখানে কে আমাদের খেতে দেবে? রিফিউজিদের প্রতি ভারত সরকার কী রকম ব্যবহার করে তার কিছু-কিছু খবর আমরা শুনেছি, বাংলাদেশ ওয়ারের সময়কার ছবিও দেখেছি…। তুমি বলতে পারো, ভারতে গেলে আমাদের কিছু সুবিধে হবে?

এই লোকটিও একজন রিফিউজি। আমাদের পুরো জীবনটাই কেটে গেল রিফিউজিদের সমস্যা দেখতে-দেখতে। লন্ডনে এসেও নিস্তার নেই। খুব জোর নিয়ে লোকটিকে বলতে পারলুম

যে, ভারতে গেলে ওর সমস্যার সুরাহা হবে। লোকটির পূর্বপুরুষ ছিল গুজরাটি। আমরা গুজরাটি শুনলেই ভাবি ব্যবসায়ী আর ধনী। এই লোকটি উগান্ডার কামপালায় ছিল একটি ব্যাঙ্কের কেরানি ও কবি। ওর দুটি কবিতার বই আছে। এখানে এসে খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে, কবিতা লেখা মাথায় উঠে গেছে।

মিউজিয়ামের একজন শ্বেতাঙ্গ অফিসারকে এদিকে আসতে দেখেও লোকটি সন্ত্রস্ত হল না, বেপরোয়া ভঙ্গিতে আমার কনুই ধরে রেখে বলল, ভাবছি এখানে এই অপমানের মধ্যে থাকার চেয়ে ভারতে গিয়ে আধপেটা খেয়ে থাকাও ভালো। আমেদাবাদ শহরটা কীরকম বলতে পারো? সেখানে কোনও কেরানির চাকরিও পাওয়া যাবে না?

লোকটির কাছ থেকে অতিকষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেলুম অন্যদিকে। জীবন্ত মানুষের সমস্যার কথা শুনলে মিউজিয়াম দেখায় আর মন বসে না।

যে বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি সে সন্ধেবেলা মিউজিয়ামের সামনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে, যথাসময়ে উপস্থিত হলুম তার কাছে। লন্ডনে অসংখ্য বাঙালি, কে আর কজনকে চেনে, তবু আমার বন্ধুটি নীতিশদার নাম শুনে চিনতে পারল। সে বলল, হ্যাঁ, ভদ্রলোক বেশ ভালো মানুষ। কিন্তু এখন বেশ অসুবিধের মধ্যে পড়েছেন। যে কোম্পানিতে উনি চাকরি করতেন, সে কোম্পানিটা উঠে গেছে। এখন পটাপট এরকম অনেক কোম্পানিই উঠে যাচ্ছে। এই ডিপ্রেশানের বাজারে কোনও নতুন চাকরি পাওয়াও মুশকিল। তবে ওই নীতিশবাবু খুব অহংকারী, কারুর কাছে নিজের অসুবিধের কথা বলেন না।

নীতিশদা যে কতটা অহংকারী তা আমিও বুঝতে পারলুম। উনি আমাকে একবারও দেশের অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করেননি। যদি আমি ভেবে ফেলি যে উনি দেশে ফেরার ইচ্ছে পোষণ করছেন। এই স্বর্গপুরী লন্ডন ছেড়ে দেশে ফেরা!