[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০২. আর্ট গ্যালারি কিংবা মিউজিয়াম

আর্ট গ্যালারি কিংবা মিউজিয়াম খুব ভালো জিনিস, কত দেখার জিনিস থাকে, দেখলে কত জ্ঞান বাড়ে, কিন্তু বড় পা ব্যথা করে। আমাদের শরীরের মধ্যে পা দুটিই সবচেয়ে নগণ্য, কখনও আমরা পায়ের প্রতি বিশেষ নজর দিই না। পা দুটো আছে ভারবাহী গাধার মতন, আপন মনে নিজের কাজ করে যাবে, এই রকমই কথা। কিন্তু সেই গাধা দুটো হঠাৎ বিদ্রোহ করলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পও নস্যাৎ হয়ে যায়।

আমারও হল সেই রকম দশা।

হল্যান্ডের আমস্টারডাম যেমন ছবির মতন সুন্দর শহর, সেই রকমই পৃথিবী বিখ্যাত বহু ছবিতে ভরা। আমস্টারডামে এসে শুধু ডাচ চিজ, মাছ ভাজা আর হাইনিকেন বিয়ার খেলেই তো হয় না, ডাচ শিল্পীদের ভুবন-বিজয়ী ছবিগুলি না দেখলে জীবন বৃথা। কোন কোন ছবি দেখব, তা আগেই ঠিক করে এসেছিলুম, কিন্তু দেখা কি অত সোজা!

একে তো দেশ ছেড়ে বিদেশে এলেই আমার মতন লোকের বুকের ভেতরটা সব সময় শুকনো-শুকনো লাগে, এই বুঝি হারিয়ে গেলুম, এই বুঝি হারিয়ে গেলুম মনে হয়। তা ছাড়া, এই সব জায়গায় সব সময় আমাদের পকেটের পয়সা আর সময় খরচ করতে হয় টিপেটিপে। সাহেবদের দেশে ট্যাক্সি চড়বার সৌভাগ্য নিয়ে আমি জন্মাইনি। আমস্টারডাম শহর অপূর্ব, সুশ্রী, ঝকঝকে ট্রাম চলে অবশ্য, কিন্তু একবার চড়বার পরই যখন টিকিটের দাম হিসেব করে দেখি আমাদের দেশের প্রায় দশ টাকার সমান, তখন গা কচকচ করে। সুতরাং পা দুটিই প্রধান ভরসা।

হল্যান্ডের অধিকাংশ লোক ঠিক ততটাই বাংলা জানে, আমি যতটা ডাচ ভাষা জানি। সুতরাং তারা তাদের ভাষা আর আমি আমার ভাষা বললে যথেষ্ট হাস্যকৌতুক হয় বটে, কিন্তু রাস্তা চেনা যায় না। ইংরেজি জানা লোক এদেশের এয়ারপোর্টে কিংবা হোটেলে পাওয়া গেলেও পথে ঘাটে সব সময় তাদের সন্ধান মেলে না। সুতরাং ম্যাপ হাতে নিয়ে ঘুরতে হয় আন্দাজে। তিন-চার চক্কর ঘুরে আসবার পর দেখা যায়, আমি যে মিউজিয়ামটি খুঁজছি, সেটা ঠিক পেছনের রাস্তায়।

দ্রষ্টব্যস্থল খুঁজে পেলেও হাঁটার শেষ হয় না। এক একটা আর্ট গ্যালারি বা মিউজিয়ামে প্রায় পঞ্চাশটি ঘর, সবক’টি ঘর ঘুরে দেখা মানেও তো কয়েক মাইলের পথ। অথচ কোনওটাই বাদ দিতে ইচ্ছে করে না। শুধু ভ্যান গঘের (এখানকার লোকেরা এই নাম অন্যরকম উচ্চারণ করে, আমাদের বাঙালি উচ্চারণই ভালো) ছবি নিয়েই একটি পাঁচতলা বাড়ির আর্ট গ্যালারি, তার সবটাই না দেখলে কি চলে! তারপর মিউনিসিপ্যাল মিউজিয়াম, রেমব্র্যান্ডটের বাড়ি…সকাল থেকে ঘুরতে-ঘুরতে যখন রিজকস মিউজিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ালুম, তখন বুকটা হঠাৎ দমে গেল।

এ যে এক বিশাল প্রাসাদ, এর সবটা এখন দেখতে হবে? পা দুটো যে আর চলতে চাইছে না। পায়েরও যে তেমন দোষ নেই। অথচ আমস্টারডামে এসে রিজকস মিউজিয়াম না দেখা তো মহা পাপের সমান। বেশি ভালো-ভালো জিনিস একদিনে দেখতে নেই, কিন্তু আজকে এখানে ইতি দিয়ে যে আবার কালকে দেখব তারও উপায় নেই, তা হলেই আর একদিন বেশি হোটেল খরচ।

কলকাতার ছেলে, অধিকাংশ সময়ই চটি পরে ঘোরবার অভ্যেস, কিন্তু সাহেবদের দেশে সর্বক্ষণ মোজা আর বুটজুতো পরে থাকতে হয়। পা দুটো চাইছে সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে। আগেকার আমলের পাথরের তৈরি প্রাসাদ, এখানে খালি পায়ে হাঁটতে তবু ভালো লাগত। আমাদের দেশের মন্দির টন্দিরের মতন, এরাও এসব জায়গায় জুতো খুলে ঢোকবার নিয়ম করলে পারে না?

রিজকস মিউজিয়ামে ঢোকবার মুখেই নোটিশ ঝুলছে, ‘চোর ও গাঁট কাটাদের থেকে সাবধান।’ জিনিসটা বেশ চেনা চেনা লাগল। প্রথমেই ছবি দেখতে শুরু না করে ডান দিকে ঢুকে গেলুম রেস্তোরাঁয়। কিছু খাদ্য-পানীয় দিয়ে শরীরকে কিছুটা তোয়াজ করা যাক। কিন্তু ওতে পেট এবং মন সন্তুষ্ট হলেও পা নামের গাধা দুটো খুশি হল না। খাদ্য-পানীয় তো পা পর্যন্ত পৌঁছোয় না। তারা এখনও টনটনে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

রিজকস মিউজিয়ামে ছবির শুরু পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত এসে পৌঁছোতে অনেক ঘর পার হতে হয়। তা ছাড়া আছে মহান শিল্পীদের আলাদা-আলাদা ঘর। এই সব ছবি কি একদিনে সঠিকভাবে দেখা সম্ভব? কিন্তু এই জীবনে আর হয়তো কখনও আমস্টারডামে আসব না, আর দেখাও হবে না।

ভ্রমর যেমন গোটা ফুলটার সৌন্দর্যের তোয়াক্কা করে না, শুধু মধুর সন্ধানে ঠিক মাঝখানটায় ঢুকে যায়, সেই রকমই, অধিকাংশ ভ্রমণকারী রিজকস মিউজিয়ামে এসে প্রথমেই ছুটে যায় রেমব্র্যান্ডন্টের ‘নাইট ওয়াচ’ ছবিখানা দেখতে। এই বিশাল ছবিখানার নাম অনেকেই আগে থেকে শুনে আসে। লুভর-এর যেমন মোনালিজা, রিজকস-এর সেরকম নাইট ওয়াচ। এখানে যে রেমব্র্যান্ডন্টের আরও অনেক ছবি আছে, কিংবা কাছাকাছি ঘরে ভারমিয়ের, গোইয়া, মুরিল্লো এবং ভ্যান ডাইকের দুর্লভ ছবি, তা গ্রাহ্য করে না অনেকেই।

আমারও প্রায় সেই অবস্থাই হল। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘নাইট ওয়াচ’ দেখার পর ভারমিয়ের এর ঘরে সবে মাত্র চোখ বুলোতে শুরু করেছি, এমন সময় আমার পোষা গাধা দুটি বলল, এবার ছুটি দেবে কি না বলো, নইলে কিন্তু তোমায় গাছের ওপর রেখে আমরা তলা থেকে মই কেড়ে নেব!

সুতরাং অন্যান্য অ-দেখা শিল্পীদের উদ্দেশ্যে সেখান থেকেই প্রণাম জানিয়ে ও ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম, তারপর প্রায় সোজা দৌড়ে গিয়ে হোটেলের বিছানায়।

ঘণ্টা দু-এক বাদে আবার পা দুটি স্ববশে এল। শরীর ও মন ঝরঝরে। আবার নতুন উদ্যোগে কিছু শুরু করা যায়। কালই এই শহর ছেড়ে চলে যাব, আজকের শেষ দিনটা এমনভাবে হোটেলের ঘরে শুয়ে নষ্ট হবে? ঘড়িতে বাজে মাত্র সাতটা, এটা সন্ধে না বিকেল না দুপুর তা বলা মুশকিল। বাইরে ঠিক দুপুরেরই মতন ঝকঝকে রোদ। আমাদের হোটেলের ঘরের জানালার ঠিক সামনেই দুটো বেশ বড় ঝাঁকড়া-চুলো সাইপ্রেস গাছ, ভ্যান গঘের অনেক ছবিতে এই সাইপ্রেস গাছ দেখা যায়, সুতরাং বাইরের দৃশ্যটি ভ্যান গঘের আঁকা একটা ছবি বলেই মনে হয়।

কিছুক্ষণ একটা বই খুলে বসে রইলুম, কিন্তু মনঃসংযোগ হল না। বিদেশের মূল্যবান একটি অপরাহ্ন এমনভাবে নষ্ট করতে ইচ্ছে করে না। আবার বেরিয়ে পড়লুম হোটেল থেকে।

কয়েক পা হাঁটার পর এমনই চমক লাগল যে দাঁড়িয়ে পড়লুম হঠাৎ। স্বপ্ন দেখছি না তো? এটা কি বাস্তব কোনও শহর না রূপকথার একটা পৃষ্ঠা? ঘড়িতে দেখলুম, আটটা বেজে দশ, এখনও আকাশে রয়েছে পরিষ্কার দিনের আলো, এর মধ্যে চতুর্দিকের রাস্তাঘাট একেবারে জনশূন্য। চৌরাস্তার মোড়ে যেদিকে তাকাই, কোথাও একটাও মানুষ নেই, আমি ছাড়া। এ-ও কি সম্ভব? দুপুরবেলা এই পথ দিয়ে গেছি, সেই সব দোকান চিনতে পারছি, কিন্তু কোথাও কোনও প্রাণের চিহ্ন নেই। সব দোকানেই কাঁচের দেওয়াল, ভেতরে আলো জ্বলছে, বাইরে থেকে ভেতরের সব কিছু দেখা যায়, কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা নেই।

কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। খুব মিহি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, বাতাসে শীত-শীত ভাব, আমি শুধু একটা সোয়েটার পরে আছি, ওর ওপরে আর একটা কোনো গরম জামা চাপালে আরাম লাগত, কিন্তু আর কিছু আনিনি আমি। আমার রোমাঞ্চ হল। এত বিখ্যাত এই শহরের এক চৌরাস্তায় আমি দাঁড়িয়ে আছি, চারপাশে বড়-বড় বাড়ি, প্রত্যেক দিকে লাইন করা অজস্র দোকান, অথচ মাত্র সন্ধে আটটায় সব একেবারে নিঃসাড়, একটা মানুষেরও দেখা পাওয়া যায় না।

আমার হোটেলটা শহরের এক প্রান্তে। কিন্তু কল্পনা করা যায় কি যে সন্ধে আটটার সময় টালিগঞ্জ বা দমদমের রাস্তায় একটিও মানুষ নেই?

একটা ট্রামের আওয়াজে চমক ভাঙল। তা হলে ট্রাম চলছে! এখানকার ট্রাম এক-কামরা, আমাদের মতন ফার্স্ট ক্লাস-সেকেন্ড ক্লাস নেই। তাকিয়ে দেখলুম, গোটা ট্রামে ঠিক তিনজন মানুষ বসে আছে। তারপর দেখলুম, গাড়িও চলছে রাস্তা দিয়ে। শহরটা ঘুমিয়ে পড়েনি। মনে পড়ল, এখানকার সমস্ত দোকানপাট ছ’টার সময় বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আর কেউ রাস্তা দিয়ে হাঁটে না। বড়-বড় বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলুম। সমস্ত জানালার পরদা টানা। রাস্তার ধারে বহু গাড়ি পার্ক করা আছে। এই সব গাড়ির ওয়াইপার কেউ চুরি করে না, হেড লাইট খুলে নেয় না! দোকানগুলোর কাঁচের দেওয়াল ভেঙে কেউ চুরি করে না! পথ দিয়ে মানুষ হাঁটে না, তবু দোকানগুলোর মধ্যে আলো জ্বেলে রেখেছে কেন? মোড়ের ফোয়ারা থেকে জল পড়েই যাচ্ছে, কেউ দেখবার নেই, তবুও!

সোজা হাঁটতে লাগলুম আপন মনে। খানিকবাদে কোনও-কোনও দোকানের ভেতর থেকে শব্দ পেতে লাগলুম। সেই সব দোকানের অন্দরমহল বাইরে থেকে দেখা যায় না, গাঢ় রঙের পরদা ফেলা। সাইনবোর্ডে দেখলুম, সেটা একটা বার। অর্থাৎ হোটেল-রেস্তোরাঁ এখনও খোলা। একটা ওই রকম দোকান থেকে পুতুলের মতন সুন্দর দুটি নারী-পুরুষ বেরিয়ে সামনের গাড়িতে উঠল। অর্থাৎ প্রায় কুড়ি মিনিট পরে আমি খুব কাছাকাছি দুজন জীবন্ত মানুষ দেখলুম। নির্জনতা জিনিসটা পাহাড় কিংবা সমুদ্রের ধারে ভালো, কিন্তু কোনও বড় শহরের রাস্তায় এরকম নির্জনতা খুবই অস্বস্তিকর।

খানিকক্ষণ হাঁটার পর মনে হল, আমিও তো কোনও রেস্তোরাঁয় ঢুকে একটুক্ষণ বসলে পারি। তবে ঠিক কোনটায় ঢুকব, তা ঠিক করতে একটু সময় লাগল। যদি আমি ঢোকামাত্র সবাই আমার দিকে তাকায়? একটা রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে ভেতরে এক পা দিয়েও আবার বেরিয়ে এলুম। সেখানে অনেক ছেলেমেয়ে নাচছে। হয়তো ওখানে সবাই সবার চেনা, একমাত্র আমিই হব বাইরের লোক!

আরও একটু হাঁটবার পর, আর একটা মোড়ে এসে মনঃস্থির করে একটা ছোট দোকান দেখে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লুম। ভেতরে আবছা আলো। চোখ সইয়ে নেওয়ার পর বুঝলুম, সেটা একটা ট্যাভার্ন জাতীয় জায়গা, ইংরেজরা যাকে বলে পাব। এক পাশে গোটাচারেক টেবিল, অন্য পাশে লম্বা কাউন্টারের সামনে অনেকগুলো হাই স্টুল, রেকর্ডে বাজনা বাজছে। প্রত্যেক টেবিলেই দুজন করে নারী-পুরুষ বসে আছে বলে আমি গিয়ে বসলুম কাউন্টারের সামনের একটা হাই স্টুলে।

তারপর বারটেন্ডার মহিলার দিকে তাকিয়ে আমি ঠিক ভূত দেখার মতন চমকে উঠলুম। মহিলাকে দেখতে অবিকল আমার ছোট পিসিমার মতন! বছর পঞ্চাশেকের মতন বয়েস হবে, একটু মোটার দিকে চেহারা, নাক-চোখ-ঠোঁটের ভাব এমনকী থুতনিতে পর্যন্ত হুবহু আমার ছোট পিসিমার সঙ্গে মিল। ইনি মেমসাহেব বলে গায়ের রং তো ফর্সা হবেই, তা আমার ছোট পিসিমাও খুব ফরসা ছিলেন। আমার ছোট পিসিমাকে আমি স্মরণকাল থেকেই বিধবা অবস্থায় দেখেছি, সরু কালো পাড়ের ধুতি পরতেন, তাঁকে একটা গাউন পরিয়ে দিলে একদম এই মহিলার মতনই দেখাত।

মহিলা আমার সামনে এসে ডাচ ভাষায় অনেক কিছু বললেন। উত্তরে আমি একটা আঙুল দেখিয়ে বললুম, বিয়ার। মদের নামগুলো আন্তর্জাতিক, বুঝতে কোথাও কারুর অসুবিধে হয় না।

মধ্যবয়স্কা মোটাসোটা মহিলাটি প্রায় নাচের ভঙ্গিতে উড়ে গিয়ে একটা পিপে থেকে এক গেলাস বিয়ার ঢেলে আনলেন, একটা প্লেটে খানিকটা চিজ আর বাদাম আমার সামনে রেখে একগাল হাসি উপহার দিলেন সেই সঙ্গে। যাক, তা হলে আমি এখানে অনধিকারী নই।

বিয়ারের চুমুক দিতে দিতে আড় চোখে পরিবেশটা ভালো করে দেখে নিলুম। কাউন্টারে আমার পাশাপাশি আরও পাঁচ-ছ’জন নারী-পুরুষ বসে আছে, তারা বেশ জোরে-জোরে হাসাহাসি ও গল্প করছে নিজেদের মধ্যে। সবাই সবাইকে চেনে। ঘরের এক দিকের দেওয়ালে একটা রঙিন বোর্ড, মাঝখানে একটা বৃত্ত আঁকা, একটু দূর থেকে একজন মহিলা ও তার এক সঙ্গী পালকের তীর ছুঁড়ে-ছুঁড়ে মারছে সেই বৃত্তের দিকে। একে ডার্ট খেলা বলে, কিন্তু মনে হল যেন এখানে কিছু জুয়ার ব্যাপার আছে। একবার মহিলাটি তাঁর সঙ্গীকে কিছু পয়সা বার করে দিলেন।

আমার পাশেই বসে আছেন এক হাসিখুশি প্রৌঢ় তার পাশে অতিশয় পৃথুলা এক মহিলা। এঁরা স্বামী-স্ত্রী মনে হয়। বারটেন্ডার মহিলাকে এরা নাম ধরে ডাকছে। কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে শুনবার পর বুঝলাম, ওঁর নাম লিলি। আমার সেই পিসিমার নাম ছিল শেফালি। নামেও বেশ মিল আছে দেখছি। আমার ছোট পিসি মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে, হঠাৎ তার জন্য আমার কষ্ট হল। বিধবা অবস্থায় ছোট পিসিমা একটা ম্লান জীবন কাটিয়ে গেলেন, আর এই লিলি কী রকম নাচতে নাচতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

শুধু নাচ নয়, লিলি এক সময় গান গেয়েও উঠল। রেকর্ডে একটা নতুন গান শুরু হতেই লিলি তার সঙ্গে গলা মেলাল, তারপর সেই পাবের সবাই। নিশ্চয়ই খুব একটা চেনা গান, এরা সবাই জানে। বেশ সহজ সুরের গান, অনেকটা আমাদের ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’র মতন। গানটা শেষ হতেই একটা টেবিল থেকে একজন লোক কী একটা রসিকতা করতেই সবাই একেবারে হেসে গড়াগড়ি যেতে লাগল এক সঙ্গে। কাউন্টারের একজন লোক গলা বাড়িয়ে ফটাস করে একটু চুমু দিয়ে ফেলল লিলির ঠোঁটে, আর লিলি কৃত্রিম কোপে একটা কিল মারল সেই লোকটির মাথায়। হায়, আমার ছোট পিসিমাকে কেউ কোনওদিন এইভাবে আদর করেনি। এইটুকু আনন্দ তো আমার ছোট পিসিমা পেতেও পারতেন, কী আর এমন দোষ আছে এতে।

হঠাৎ আমার এই জায়গাটাকে খুব চেনা মনে হল। যেন আগে অনেকবার দেখেছি। জর্জ সিমেনোঁর উপন্যাসে ঠিক এইরকম ছোটখাটো কোনও ট্যাভার্নের মাঝ বয়েসি ফুর্তিবাজ নারী পুরুষের ছবি থাকে। সিমেনোঁ অবশ্য বেলজিয়ামের কথা লিখেছেন, কিন্তু বেলজিয়াম আর হল্যান্ড কাছাকাছি দেশ, প্রায় একইরকম পরিবেশ। আমি যেন সেইরকম একটা উপন্যাসের মাঝখানে ঢুকে পড়েছি।

নাচতে-নাচতে গান গাইতে-গাইতে লিলি একবার আমার খালি গেলাসটা নিয়ে গিয়ে ভরতি করে নিয়ে এল। আমাকে জিগ্যেস করল না, আমি আবার চাই কি না। একটু অবাক চোখে তাকিয়েছি, লিলি আঙুল দিয়ে পাশের লোকটিকে দেখাল। পাশের লোকটি এক আঙুলে নিজের বুকে টোকা মেরে তারপর আমার গেলাসটার দিকে আঙুল ফেরাল, অর্থাৎ সে আমাকে ওই বিয়ার খাওয়াচ্ছে। প্রত্যাখ্যান করা অভদ্রতা, তাই আমি বললুম, থ্যাঙ্ক ইউ। লোকটি তখন একগাদা কথা বলে গেল গড়গড় করে। এক বর্ণ বুঝলাম না। এখানে হাসির ভাষা ছাড়া অন্য কিছু দেওয়া যায় না। তার পাশের মহিলাটি বলল, সে নো নো ইংলিশ। ইউ জাপান!

আমাকে জাপানি বলে কস্মিনকালে কেউ ভুল করতে পারে, এরকম আমার ধারণা ছিল না। হয় আমার নাকটা একটু বোঁচা, তা বলে গায়ের রং তো হলদে নয়। বললুম, নো, আই অ্যাম অ্যান ইন্ডিয়ান।

মহিলাটির ইংরিজির দৌড় খুবই কম। তিনি আমায় জিগ্যেস করলেন, ইন্দোনেশিয়া? সিঙ্গাপুর?

আমি মাথা নেড়ে পুনরুক্তি করলুম।

এবারে তৃতীয় একজন মাথার পেছনে হাত দিয়ে হাতটা নাড়তে-নাড়তে বলল, ইন্ডিয়ান? ইন্ডিয়ান?

অর্থাৎ মাথায় পালকের মুকুট বোঝাচ্ছে? আমাকে আমেরিকার লাল ইন্ডিয়ান ভেবেছে? কেন, আমাদের যে এত বড় একটা দেশ, সে দেশের নাম ওদের মনে পড়ছে না? ভাবতে লাগলুম, আমাদের দেশের কোন প্রতীক আছে যে যা দিয়ে চট করে এদের ভারতবর্ষ বোঝাতে পারি। হাতি? মহারাজা? তাজমহল?

আর একজন লোক জিগ্যেস করল, টুরিস্ট? আফ্রিকা?

এ তো মহা মুশকিলের ব্যাপার দেখছি। এরা কি কখনও ভারতীয় দেখেনি? আমাদের দেশ থেকে তো অনেকেই এখানে বেড়াতে আসে। এই আমস্টারডাম শহরেই তো বেশ কয়েকটি ভারতীয় দোকান দেখেছি। হয়তো এই পাড়ার লোকেরা আমাকেই প্রথম দেখছে। ম্যারি ম্যাকার্থির একটা উপন্যাসে পড়েছিলুম বটে, হল্যান্ডের লোকেরা নিজেদের দেশের বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে খুব কম জানে, তারা বাইরেও খুব কম যায়। আমরা অবশ্য আমাদের দেশের ওলন্দাজ জলদস্যুদের অনেক গল্প পড়েছি, কিন্তু সে তো ইতিহাসের ব্যাপার। এখনকার ওলন্দাজরা নিজেদের দেশের মধ্যে গুটিয়ে রেখেছে।

সকলেরই অল্প-অল্প নেশা হয়েছে। ওরা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, কিন্তু ভাবের আদান প্রদানের কোনও উপায় নেই। লিলিও থুতনিতে আঙুল দিয়ে মাঝে-মাঝে আমার দিকে কৌতূহলে তাকাচ্ছে। এর মধ্যে আরও একজন লোক আর একটি বিয়ার অর্ডার দিল আমার জন্য। প্রতিদান হিসেবে আমিও অর্ডার দিলুম তিনটি বিয়ারের। তারপর মনে পড়ল, বার টেন্ডারদেরও অফার করা যায়। লিলির দিকে আঙুল তুলে জিগ্যেস করলুম, ইউ? ওয়ান?

লিলি একগাল হেসে রাজি হয়ে গেল। আমার মনটা খুব হালকা হয়ে গেল এই জন্য যে, এরা আমাকে গ্রহণ করেছে, বাইরের লোক হিসেবে মুখ ফিরিয়ে রাখেনি।

ভাষা না বুঝেও বেশ মিশে গেলুম ওদের সঙ্গে। একটু বাদে দরজা ঠেলে ঢুকল একজন লম্বা মতন লোক। দু-তিন জন লোক চেঁচিয়ে উঠল, হেংক, ইংলিশ, ইংলিশ!

সেই লোকটি কাউন্টারে এসে লিলিকে একটা ব্র্যান্ডির অর্ডার দিয়ে ওদের কী সব জিগ্যেস করতে লাগল। ওরা আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ইংলিশ, ইংলিশ।

অর্থাৎ হেংক নামের লোকটি ইংরেজি জানে, তার মারফত আমার সঙ্গে কথা হতে পারে।

হেংক আমার দিকে ফিরে বলল, টুরিস্ট? হুইচ কানট্রি?

আমি বললুম, ইন্ডিয়া।

লোকটি বললো, ও, ইন্ডিয়া? হাফ অফ দি পপুলেশান ভেরি পুয়োর, রাইট? নো ফুড, না ড্রিংক, স্টার্ভ, রাইট?

লোকটি পাশ ফিরে এই কথা আবার অন্যদের বোঝাল নিজস্ব ভাষায়। অন্যরা এবার সবাই মাথা ঝাঁকাল। তারা এবার বুঝেছে। পৃথুলা মহিলাটি আমার দিকে চেয়ে বলল, হিন্দু? হিন্দু। নো ইট, ভেরি পুয়োর?

কে যেন ঠাস করে একটা চড় মেরেছে আমার গালে।

হায় আমার জনম দুঃখিনী জননী, পৃথিবীর কাছে এই তার পরিচয়। ভারতের নাম চিনতে পেরেই প্রথমেই ওদের মনে পড়ল ভারতের দারিদ্র্যের কথা? এদেশে এত প্রাচুর্য তাই দারিদ্র্য ওদের কাছে কৌতূহলের বস্তু। আমি একটু আগে ভারতের একটা প্রতীক খুঁজছিলুম, হাত পেতে যদি এদের কাছে ভিক্ষে চাইতুম এরা ঠিক বুঝতে পারত।

হেংক-এর মারফত সবাই জানতে চাইছে ভারত কেন গরিব, সেই সব গরিব্রা কী খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে, আর এদের সঙ্গে ভাব জমাবার ইচ্ছে নেই। ভারতের দারিদ্র্যের কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, কিন্তু লোকে ভারতের শুধু সেই পরিচয়টাই জানবে।

ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটু বাদেই বেরিয়ে পড়লুম সেই পাব থেকে। দশটা বেজে গেছে, এখনও ঠিক মতন অন্ধকার নামেনি। পা দুটো আবার ক্লান্ত লাগছে। গরিব ভারতীয় হয়ে একটু-একটু মন খারাপ নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলুম আস্তে-আস্তে।