[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২৩. মানস সরোবরের কথা নয়

না, এটা মানস সরোবরের কথা নয়। অতদূর আমি এখনও যাইনি, যাওয়ার ইচ্ছে আছে।

আসামের একটি সংরক্ষিত অরণ্যের নাম মানস। কেউ কেউ বলেন মনাস বা মানাস। কিন্তু মানস নামটিই বেশি প্রচলিত এবং পছন্দসই। ভারতে যে ক’টি সংরক্ষিত বন আছে, তার মধ্যে আয়তনে এটিই সবচেয়ে বড় এবং অনতিগম্য। অনেকদিন থেকে বিশ্বস্ত লোকজনের মুখে এর সৌন্দর্যের কথা শুনেছি, পড়েওছি কিছু জায়গায়, প্রখ্যাত লেখক ই পি জি মানসের বর্ণনায় উচ্ছ্বসিত। বেশ কয়েক বছর ধরে আমি মানস দর্শনের বাসনা মনে মনে পুষে রেখেছি, যদিও জানতাম, একার চেষ্টায় ওখানে যাওয়া সহজ নয়।

সুতরাং অসম সাহিত্য সভার বার্ষিক অধিবেশনে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ পেয়েই সঙ্গে-সঙ্গে ঠিক করে নিলাম, এই সুযোগে মানস ঘুরে আসতে হবে। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আসামের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পরদিন তাঁর দূতের সঙ্গে যোগযোগ হতেই আমার অভিপ্রায়ের কথা জানিয়ে দিলুম। এ বৎসর অসম সাহিত্য সভার অধিবেশন হল অভয়াপুর নামে একটি ক্ষুদ্র শহরে। ম্যাপ খুলে দেখে নিলাম, সেখান থেকে মানস অরণ্য বিরাট দূর নয়।

অসম সাহিত্য সভার তুল্য কোনও প্রতিষ্ঠান আমাদের বাংলায় নেই বলে এর কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের অনেকের সঠিক ধারণা করা সম্ভব হবে না। আসামের যে-কোনও রাজনৈতিক দলের চেয়েও এই সভা বেশি শক্তিশালী এবং জনপ্রিয়। এঁদের বার্ষিক অধিবেশন প্রতি বছরই কোনও এক শহরে হয় না। বেছে নেওয়া হয় আসামের যে-কোনও একটি অঞ্চল, সাহিত্য-সভাটি ধারণ করে বিশাল একটি মেলার আকার, আসে দূর-দূর থেকে গ্রামীণ মানুষ এই এক একটা উৎসবে যোগ দিতে। সভার বক্তৃতা দশ-বারো হাজার মানুষ টু শব্দটি না করে শোনে, সবকিছু না বুঝলেও এটুকু অন্তত বুঝে যায় যে সাহিত্য বলে একটা ব্যাপার আছে, মাতৃভাষার একটা গৌরব আছে। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সরকারি আনুকূল্য প্রায় পুরোপুরি। মুখ্যমন্ত্রী সব কাজ ফেলে দু তিন দিনের জন্য চলে আসেন এবং যে-দিন তাঁর বক্তৃতা থাকে না সেদিনও মঞ্চে দু-তিন ঘণ্টা বসে থেকে শোনেন সবকিছু। অন্যান্য অনেক মন্ত্রী বড়-বড় আমলা এবং রাজনৈতিক নেতারা ঘোরাফেরা করেন সাধারণ অতিথির মতন, দুপুরে কয়েক হাজার অভ্যাগতর সঙ্গে বসেন পংক্তিভোজনে। আসেন আসামের অধিকাংশ লেখক, কবি, শিল্পী, গায়ক। যে-শহরে সাহিত্য সভা হয়, সেখানকার রাস্তাঘাটের ঝটতি উন্নতি হয়ে যায়, তৈরি হয় নতুন বাড়ি-ঘর। সাহিত্যের জন্য আসাম এতটা করে।

*

চারপাশে ছোট-ছোট পাহাড়ে ঘেরা অভয়াপুর শহরটি প্রায় গ্রামের মতন, অত্যন্ত ঝকঝকে সুন্দর। এককালে ছিল ছোট একটি রাজ্য বা জমিদারি, প্রাক্তন রাজাদের বাড়িটিতে এখনও বসতি আছে। এইখানকার মেয়ে বাসন্তী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, তাই প্রবীণেরা এখনও দেশবন্ধুকে অভয়াপুরের জামাই বলে মনে করেন। এই জায়গাটি গোয়ালপাড়া জেলার মধ্যে, এবং গোয়ালপাড়া আর ভুটান রাজ্যের সীমান্তেই মানস অরণ্য।

কথা ছিল, আমার জন্য থাকবে একটি গাড়ি, সঙ্গে যাবেন আরও দু-তিন জন এবং বন বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ অতি উৎসাহী ব্যক্তি। কিন্তু সাহিত্য সভার কাজে অনেকে নিযুক্ত, তা ছাড়া হঠাৎ-ঘোষিত নির্বাচনের জন্যও সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, সুতরাং বন্দোবস্তে অনেক ফাটল দেখা দেয়।

যাঁদের সঙ্গে যাওয়ার কথা, তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না, গাড়ির জোগাড় হয় না ঠিক মতন, আমার তত্বাবধায়ক প্রচারসচিব শ্রী দাশ খানিকটা বিব্রত হয়ে পড়েন। তিনি প্রস্তাব দেন, আমি যদি পরে আবার কখনও আসি, তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন, এবার ঠিক সম্ভব হবে না। কিন্তু আমি যাব ঠিক করেছি, যাবই। অন্তত শেষ পর্যন্ত চেষ্টা দিতে হবে।

শেষ চেষ্টার জন্য অভয়াপুর থেকে শ্রী দাশের গাড়িতে চলে এলাম বরপেটা রোডে। গাড়ি চালাচ্ছিলেন শ্রী দাশ নিজে, তাঁর মুখে চিন্তার রেখা। একা-একা আমায় ছেড়ে দিলে আমার কোনও বিপদ ঘটতে পারে, তিনি ভাবছিলেন। মানসে একা-একা কেউ যায় না। মানসে খাবার দাবারের কোনও ব্যবস্থা নেই। ওখানে হিংস্র জন্তু, বিশেষ করে হাতির উপদ্রব খুব। এরকম জায়গায় একলা কোনও অতিথিকে কেউ পাঠায় না। তবে জেলার অরণ্য-অফিসার শ্রী লাহানকে পাওয়া গেলে আর কোনও চিন্তা নেই, তিনি অতি উৎসাহী মানুষ, তিনি সঙ্গে যাবেন এবং সব ব্যবস্থা করে দেবেন। বরপেটা রোডে শ্রী লাহানের বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া গেল না। তিনি হঠাৎ গৌহাটি চলে গেছেন। শ্রীদাসের মুখ আরও শুষ্ক হল।

আমি কিন্তু মনে-মনে খুশি হয়ে উঠলাম। যত শুনছি আর কোনও সঙ্গী পাওয়া যাবে না, তত আমার উৎসাহ বাড়ছে। আমি একাচোরা মানুষ, একা-একা বেড়াতেই ভালোবাসি।

বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দল বেঁধে অনেক জায়গায় গেছি অবশ্য, কিন্তু কোথাও গিয়ে নতুন কারুর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আমার উৎসাহ কম। আমি সু-আলাপী নই। তা ছাড়া দল বেঁধে দেখা আর এই দেখার স্বাদই আলাদা। মানস অরণ্য আমি আপন মনেই দেখতে চাই। আমার চাই শুধু একটা গাড়ি, কেন না, পায়ে হেঁটে কিছুতেই একদিনে মানসে পৌঁছনো যায় না, সেখান থেকেই অন্তত পঁয়ত্রিশ মাইল রাস্তা।

উলটো দিকে পনেরো-কুড়ি মাইল উজিয়ে আসা হল বরপেটা শহরে। সেখানে শ্রী দাশের জেলা-সহকারীর অফিসে যদি সেই সহকারীকে পাওয়া যায়। তিনিও নেই। সেদিন রবিবার কে কোথায় যাবে ঠিক নেই তো। সেই অফিসে আছে একটি জিপ। জিপই দরকার, জঙ্গলের পাহাড়ি রাস্তায় অ্যামবাসেডর সুবিধাজনক নয়। কিন্তু জিপটা আছে, নেই তার ড্রাইভার। ছুটির দিনে সে ও কোথায় যেন গেছে।

শ্রী দাশ অত্যন্ত ভদ্রতাসম্মত উপায়ে আমাকে নিরস্ত করার আরও অনেক চেষ্টা করলেন। নেহাত আমি অতিথি, তাই রূঢ় কথা বলতে পারেন না। আমিও ততোধিক ভদ্রতার সঙ্গে আমার গোঁয়ার্তুমি প্রকাশ করছিলাম।

আসলে, আমাকে মানস-ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তিনি যে সুচারু বন্দোবস্ত করে উঠতে পারছেন না, এজন্য তিনি লজ্জিত ও আমার নিরাপত্তা বিষয়ে চিন্তিত বোধ করছিলেন। আমি তাঁর ওই লজ্জাটুকুর সুযোগ নিচ্ছিলাম পুরোপুরি। আমি সাহিত্যসভা-টভা এড়িয়ে চলি, যদি না তার সঙ্গে আলাদা ভ্রমণের আনন্দ যুক্ত থাকে। অনেক তেতো ওষুধের অনুপান যেমন মধু।

শ্রী দাশের গাড়িতে, তাঁর পাশে একটি ষোল-সতেরো বছরের ছেলে বসেছিল। শ্রী দাশ তাকে জিগ্যেস করলেন, কী রে, তুই পারবি? ছেলেটি নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল। তিনি বললেন, তাহলে দ্যাখ, জিপটা চালু অবস্থায় আছে কি না।

ছেলেটি নেমে যাওয়ার পর শ্রী দাস আমাকে বললেন, এই ছেলেটি আমার গাড়ি চালায়। কিন্তু ও কোনওদিন জিপ চালায়নি। ওকে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে আপনার?

আমি বললাম, কেন, অসুবিধে কী আছে?

উনি বললেন, যেতে-যেতেই অন্ধকার হয়ে যাবে, রাস্তা খুব খারাপ, এই ছেলেটা কোনওদিন জিপ চালায়নি, যে-কোনও সময় অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে–

আমি বললাম, কিচ্ছু হবে না, কোনও চিন্তা নেই। উনি বললেন, সন্ধের পর রাস্তার ওপর হাতি বসে থাকে।

আমি বললাম চমৎকার! তা হলে তো যেতেই হবে।

শ্রী দাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

বিকেল গাঢ় হয়ে এসেছে। পশ্চিম দিকে লম্বা লম্বা ছায়া। এর মধ্যে সেই ছেলেটি জিপ গাড়িটি বার করে এনেছে রাস্তায়। গাড়িটি থেকে মাঝেমধ্যে অদ্ভুত গর্জন রব বেরুচ্ছে–নতুন সওয়ারিকে পিঠে নিয়ে অবাধ্য ঘোড়া যেমন বিরক্তি প্রকাশ করে! জিপটিকে তেল-জল-মোবিল দিয়ে সুস্থির করতে আরও আধঘণ্টা কাটল, ততক্ষণে পুরোপুরি সন্ধ্যা। চিন্তা ভারাক্রান্ত শ্রী দাশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা এগিয়ে পড়লুম।

ষোলো-সতেরো বছরের অসমিয়া ছেলেটির নাম অতুল ওঝা। সে অত্যন্ত কম কথা বলে। কিংবা জীবনে প্রথম জিপ চালনার দায়িত্ব পেয়ে সে এতই ব্যস্ত যে কথা বলার সময় নেই। আমার সব প্রশ্নের সে শুধু হ্যাঁ বা না উত্তর দেয়!

যাত্রার আগে কয়েকটি তথ্য আমরা সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। বরপেটা রোডের বাজারে রাত্রির আহার সেরে পরের দিনের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে। কেন না, তারপর মাইল পঁচিশেকের মধ্যে আর কোনও দোকান নেই। চেক পোস্ট থেকে প্রায় মাইল পনেরো দূরে ঘন অরণ্যের মধ্যে ডাক বাংলোতে খাদ্যব্যবস্থা রাখা সম্ভব হয় না। তবে বাংলোতে আমার নামে একটা ঘর আগে থেকেই রিজার্ভ করা আছে, সে জন্য চৌকিদার আমাকে ফেরাবে না, এবং আমি সঙ্গে চাল ডাল নিয়ে গেলে সে রান্না করে দেবে। মানস অরণ্যে দর্শনার্থী অধিকাংশই সাহেব হয়, তারা সঙ্গে টিনের কৌটোয় খাদ্য ও পাঁউরুটি নিয়ে যায়। ডাকবাংলোয় আলো নেই, আমাদের মোমবাতিও নিতে হবে সঙ্গে করে। বরপেটা রোড বাজারে পৌঁছোবার আগেই নিকষ কালো রাস্তায় জিপ গাড়িটা দু-বার হেঁচকি তুলে থেমে গেল। আমি সচকিতে ওঝাকে জিগ্যেস করলাম, কী হল?

সে কোনও উত্তর না দিয়ে নেমে গিয়ে বনেট খুলল। আমি নিজেও কখনও জিপ চালাইনি, গাড়ির যন্ত্রপাতি বিষয়ে কিছু বুঝি না। ছেলেটির পাশে গিয়ে এমনই উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলুম। ফিনফিনে ধারালো হাওয়ায় বেশ শীত। কলকাতায় এই সময় শীত অনেক কমে গেছে বলে বেশি কিছু গরম বস্ত্র আনিনি। সিগারেট ধরিয়ে ঘন-ঘন টান দিতে লাগলুম। এতক্ষণ আমি বেশ মজাই পাচ্ছিলুম সব কিছুতেই, কিন্তু রাস্তার মধ্যে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়াটা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, মাঝেমাঝে দু-একটা ভারী চেহারার গাড়ি যাচ্ছে এদিক-ওদিক দিয়ে, আমার ভয় হল, এই অন্ধকারে কোনও লরি হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে জিপটি আমাদের ঘাড়ের ওপর ফেলে না দেয়। ছেলেটি আমাদের গাড়ির ব্যাকলাইট জ্বেলে রাখেনি। সেটা জ্বেলে দিয়ে জিগ্যেস করলাম, কী হে ওঝা, এ গাড়ি যাবে তো?

সে বলল, হ্যাঁ, যাবে।

আবার কিছুক্ষণ খুটকাট।

এক এক সময় মনে হয়, গাড়িরও বুঝি প্রাণ আছে। অন্তত ইচ্ছা-অনিচ্ছা শক্তি আছেই। এই জিপটা বোধহয় তার নিজের ড্রাইভার ছাড়া অন্য কারুর হাতে যেতে চাইছে না। বিশেষত এই রকম একটা বাচ্চা ছেলের হাতে। নইলে, জিপটার বেশ নতুন-নতুন চেহারা, হঠাৎ এরকম পঙ্গু হওয়ার কথা নয়।

ছেলেটিও জেদি কম নয় কিন্তু, লেগে রইল অনেকক্ষণ, এবং শেষ পর্যন্ত কিছু আওয়াজও বার করে ছাড়ল। এবার সে আমাকে জিগ্যেস করল, আমি স্টিয়ারিং-এ বসে সুইচ দিয়ে অ্যাকসিলেটর পা দিয়ে বসতে পারব কি না। এটুকু আমি পারি। সেরকম বসবার পর, কয়েকবারের চেষ্টায় ইঞ্জিন আবার গর্জন করে উঠল। তার ফলে, বরপেটা রোড বাজারে পৌঁছতে আমাদের সাড়ে সাতটা বেজে গেল।

একটা ছোট হোটেলে ঢুকে আমরা দুজনে খেয়ে নিলাম গরম গরম ভাত আর মাংস। অত্যন্ত সুখাদ্য। যাঁরা পাঁঠার মাংস খেতে ভালোবাসেন, তাঁরা এইসব দূরের ছোটখাটো জায়গায় মাছ ডিম বা মুরগি না চেয়ে মটন কারিই চাইবেন। কারণ এইসব জায়গায় পাওয়া যায় নরম কচি পাঁঠার ঝোল তার স্বাদই আলাদা। কলকাতার বাজারে ওঠে শুধু ধেড়ে ধেড়ে ছাগল আর রাম ছাগল।

রাত্রির খাওয়া সেরে নিয়ে পরের দিনের জন্য বাজার। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ সব এক কিলো করে। ডিম পাওয়া গেল না, মাখনও না। ঠিক আছে, একদিন নিরামিষেই চালাতে হবে। এক ডজন মোম কেনার পর একটা টর্চও কিনে ফেললাম। সিগারেট দেশলাইয়ের স্টকও রইল।

একটা জিনিস নিতে ভুলে গিয়েছিলাম, গাড়িতে ওঠার পরও ওঝাকে আবার পাঠালাম দোকানে! কয়েকটা কাঁচালঙ্কা যা সঙ্গে না থাকলে আমি খাদ্যে কোনও স্বাদই পাই না।

এবারেও গাড়ি স্টার্ট নিতে চাইল না। অ্যাকসিলেটরে চাপ দিলে খানিকটা ঘ্যাসঘেসে শব্দ করেই থেমে যায়। গাড়িটি সত্যিই বেয়াদপি করছে। লোকালয়ের মধ্যে গাড়ি খারাপ হলেই কিছু কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে। অনেকে অযাচিতভাবে আমাকে জিগ্যেস করল, কোথায় যাবেন?

আমি মানস যাব শুনে কেউ-কেউ ভুরু তুলল। মানসে তো কেউ রাত্তিরবেলা যায় না, ঢুকতেই দেয় না ভেতরে।

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, আমার জন্য ব্যবস্থা আছে। আমাকে ঢুকতে দেবে।

তখন দু-একজন বলল, এরপর রাস্তা খুব খারাপ। আর কোনও মানুষজন বা দোকানপাট নেই। গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে খুব বিপদে পড়বেন।

ওরা এমনভাবে কথা বলছে, যেন এখানেই সভ্য জগতের শেষ। এরপর শুধু অরণ্য প্রকৃতির রাজ্য।

খানিকটা পরে অবশ্য আমরাও অনেকটা সেরকমই মনে হল। লোকজনের সামনে আত্মসম্মান রক্ষা করার জন্যে গাড়িটা একটু বাদেই চলতে শুরু করেছিল। কাছাকাছি একটা রেল লাইন পেরিয়ে যাওয়ার অল্প কিছু পরেই পথ গৃহ-বিরল হয়ে এল, তারপর দুপাশে শুধু ধূধূ মাঠ। পথের অবস্থা সাংঘাতিক। পথটা এককালে কেউ পাকা করে বানিয়েছিল, তারপর এর কথা একদম ভুলে গেছে। মাঝে-মাঝেই প্রকাণ্ড গর্ত, ঠিক ঘোড়ার পিঠে সওয়ারের মতন লাফাতে লাফাতে চলেছি।

দুপাশ খোলা জিপ। হু-হুঁ করা ঠান্ডা হাওয়ায় আমার হাত-পা আড়ষ্ট করে দিচ্ছে একেবারে। গায়ে শুধু একটা পাতলা সোয়েটার। ব্যাগে এক বোতল ব্র্যান্ডি ছিল, সেটা খুলে কয়েকবার কাঁচা চুমুক দিতেই হাত পায়ের সাড়া একটু ফিরে এল।

জিপ গাড়িটি সত্যিই বড় বেয়াদপ। বেশ বড় কোনও একটা গর্ত লাফাবার পরই হঠাৎ স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। গিয়ার বদলাবার সময় মড়মড় মড়াৎ করে বীভৎস শব্দ ওঠে। যেন সে আমাদের নিয়ে যেতে খুবই অনিচ্ছুক। রেলগাড়ির চলার শব্দের যেমন অনেক রকম ভাষা আছে, তেমনি এই জিপ গাড়িটির গর্জনের মধ্যেও ফুটে ওঠে একটা কথা। ‘এখনও ফেরো, এখনও ফেরো’। কিন্তু কিশোর ড্রাইভারটি কিছুতেই অবদমিত হয় না। যতবার স্টার্ট থামে, ততবার সে লাফিয়ে নেমে গিয়ে বনেট খুলে কীসের যেন টুং টাং শব্দ করে। সে আগে কখনও জিপ না চালালেই বা, জিপের যন্ত্রপাতি ঘাঁটাঘাঁটি করতে তার কোনও দ্বিধা নেই। প্রতিবারই জিপটা একটু পরে চলতে বাধ্য হয়। সেইজন্য আমার আর ভয় করে না। মনে হয়, হাতে একটা চাবুক থাকলে ঘোড়ার মতন, এই জিপটিকে বারবার ছপটি মেরে শায়েস্তা করা যেত।

জেনে এসেছি, এর পর আমাদের যেতে হবে একটা চা বাগানের ঠিক মাঝখান দিয়ে। দুপাশে চা গাছের সারি দেখে বুঝলাম, আর বেশি দেরি নেই, চা বাগানটা পেরুলেই আমরা জঙ্গলের চেকপোস্টে পৌঁছে যাব। সেখানে যখন এলাম, তখন রাত ঠিক ন’টা।

চেকপোস্টে তালা ঝুলছে, পাশে একট বড় বোর্ডে এই মর্মে নোটিশ লেখা আছে যে সন্ধে ছ’টার পর আর কারুকে এই অরণ্যে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। সেটা দেখায় বিচলিত বোধ করলুম না আমি। ওরকম অনেক লেখা থাকে, সবাই সবকিছু মানে না।

কাছেই ফরেস্ট অফিস, সেখানে ড্রাইভার ছেলেটিকে পাঠালাম গেটম্যানকে ডেকে আনবার জন্য। এখানে আরও কয়েকটি বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত চা-বাগান সংক্রান্ত লোকেরা থাকে। একজন লোক গান গাইতে গাইতে পায়চারি করছে রাস্তায়। টপ্পা অঙ্গের গান। সম্ভবত শীতের জন্য লোকটির গলায় টপ্পার কাজ বেশি খেলছিল। আমিও গুনগুন করে একটা গান ধরলাম। ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না’ গানটার ‘তোমায়’ জায়গাটার কাজ আমার গলায় আসে না, কিন্তু এখন বেশ পেরে গেলাম। আহা, কেউ শুনল না!

ওঝা ফিরে এল বেশ খানিকক্ষণ পরে। মুখ শুকনো করে জানাল, গেটকিপার বলছে, এখন গেট খুলবে না।

আমি বিরক্তভবে বললাম, এখন খুলবে না তো কখন খুলবে।

–সারারাত খুলবে না, কাল সকালে খুলবে।

–সারারাত তাহলে আমরা এখানে বসে থাকব নাকি? চলো, আমি যাচ্ছি ওর কাছে। টপ্পা গায়কটি এবার গান থামিয়ে পাশে এসে বলল, গেট খুললেও তো আপনি যেতে পারবেন না। হাতি মহারাজ আটকে দেবে!

আমি বললাম, হাতি জিপ গাড়িকে কী করবে? পাশ দিয়ে চলে যাব।

লোকটি বলল, সরু রাস্তা, হাতির পাল ওই রাস্তা দিয়ে যেতে ভালোবাসে, ঠিক এই সময় রোজ বেরোয়–আপনি গাড়ি ঘোরাতে পারবেন না। হঠাৎ ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে!

পথের উটকো লোকেদের কথা আমি একদম বিশ্বাস করি না, কিছু লোক সব সময়েই আলটপকা উপদেশ দিতে আসে।

আর কোনও উত্তর না দিয়ে ড্রাইভার ছেলেটির সঙ্গে আমি গেলাম গেটকিপারের ঘরে!

গেটকিপার নিতান্ত হেলাফেরার লোক নয়। প্যান্ট সার্ট পরা, দু-একটা ইংরিজি বলে, তার ঘরে একটা রেডিও টেলিফোনের সেট আছে। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সে আমার প্রস্তাব একেবারে উড়িয়েই দিল। বলল, অসম্ভব, এত রাতে আমরা কারুকে যেতে দিই না, আপনি যেতে পারবেনই না। সাতদিন আগে হাতি একটা লোককে মেরে ফেলেছে। ভুটানের ডি এফ ও সাহেব রাত্তিরের দিকে দুবার যেতে গিয়েও ফিরে এসেছেন।

আমি বললাম, আমরা তো আর জঙ্গলের মধ্যে রাত্তিরবেলা ঘুরতে যাচ্ছি না! সোজা গিয়ে বাংলোতে উঠব। বাংলোতে আজ রাত্তিরের জন্য আমার ঘর রিজার্ভ করা আছে।

লোকটি বলল, এখান থেকে বাংলো একুশ কিলোমিটার দূরে। পুরোটা পথ আপনাকে যেতে হবে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, এর মধ্যে কোনও এক জায়গায় হাতি রাস্তা আটকে দিলেই আর কোনও যাওয়ার উপায় নেই। আপনি গাড়ি ঘোরাতেও পারবেন না। মারা পড়বেন। আজ ফিরে যান, কাল সকালে আসবেন!

আমি একটু দমে গেলাম, এত দূর এসে ফিরে যাব? এখন আবার বরপেটা শহরে ফিরতে হলে ঘণ্টা দু-এক লেগে যাবে। অত রাত্রে যেখানে গিয়েই বা থাকবো কোথায়, কারুকে তো চিনি না। সারারাত জিপের মধ্যে কাটাতে হবে, এই শীতের মধ্যে? তার চেয়ে ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়াই ভালো। যে-কোনও কারণেই হোক, হাতি সম্পর্কে খুব ভয় জাগছে না মনের মধ্যে। অতবড় একটা জানোয়ারকে দূর থেকে দেখে কোনওভাবে নিশ্চয়ই পালিয়ে বাঁচা যাবে।

এইসব জায়গায় কয়েকটা বড়-বড় নাম উচ্চারণ করলে অনেক সময় কাজ দেয়। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, আমি আসামের হোম মিনিস্টারের গেস্ট। চিফ কনজারভেটার অব ফরেস্টের কাছে আমার বন্ধু আমার নামে চিঠি লিখেছেন, আমি আজ অসম সাহিত্য সভায়…

ফল হল একেবারে উলটো। লোকটি বলল, আপনি গভর্নমেন্টের গেস্ট বলেই তো এত চিন্তা করছি। আপনি যে আসবেন, সেকথা আর টি-তে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই দেখুন না, আমার খাতায় আপনার নাম লেখা আছে। কিন্তু আপনার প্রাণের দায়িত্ব কে নেবে? আপনার কিছু হলে আমাদের কৈফিয়ৎ দিতে হবে।

আমি বললাম, আপনাদের কাছে পটকা থাকে না?

লোকটি অবাক হয়ে বলল, পটকা? পটকা কি?

এর আগে একবার উত্তরবঙ্গেও জঙ্গলে একরকম পথজুড়ে হাতি চলাচলের কথা শুনেছিলাম। রাজা-ভাত-খাওয়া ছাড়িয়ে জয়ন্তী নদীর ওপরে যে বন, তার ভেতরের রাস্তার ওপর দিয়ে এক এক সময় পারাপার করে পঞ্চাশ ষাটটা হাতির পাল। এদিকে, বক্সাইট না ডলোমাইট কী যেন আনবার জন্য ওই রাস্তা দিয়ে কিছু ট্রাকও যায়। হাতির পালের মুখোমুখি পড়ে গেলে ট্রাক থেকে দুম দাম করে পটকা ফাটানো হয়। সেই আওয়াজে হাতির পাল সরে যায়। বুঝলাম, এখানে সেরকম কোনও ব্যবস্থা নেই।

বললাম, আমার প্রাণের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। সে কথা আমি লিখে দিয়ে যেতে রাজি আছি। এতদূর এসে আমি ফিরে যাব না।

লোকটি দু-এক মিনিট চুপ করে রইল। তারপর অসন্তুষ্টভাবে বলল, রেঞ্জার সাহেব এখনও ফেরেননি, তিনি থাকলে দায়িত্ব নিতে পারতেন। আমি একা…তা ছাড়া…

এবার সে ড্রাইভার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, তা ছাড়া এইটুকু একটা ছেলেকে নিয়ে আপনি ওই সাংঘাতিক রাস্তায় যাবেন? এ তো পারবেই না যেতে! এই ছোঁকরা, তুই যেতে পারবি?

আমি দম বন্ধ করে অতুল ওঝার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই বিপদের সম্ভাবনার কথাটা আমার মনেই পড়েনি। এ যদি রাজি না হয়, তা হলে আমার আর কোনও আশাই নেই!

অতুল ওঝা বীরের মতন উত্তর দিল, হ্যাঁ আমি সাহেবকে ঠিক পৌঁছে দিতে পারব। আমি ভয় পাই না।

আমি বুক খালি করা একটা নিশ্বাস ছাড়লাম। ছেলেটিকে আমার মনে হল বন্ধুর মতন। সেই সঙ্গে মনে হল, ভাগ্যিস, কোনও পুরোনো অভিজ্ঞ ড্রাইভারকে পাওয়া যায়নি। অনেকদিন ধরে সরকারি চাকরি করছে, এমন কোনও ড্রাইভার হয়তো এই অবস্থায় যেতে রাজি হত না। বহুদিন চাকরি করতে-করতে কীরকম যেন একটা ক্ষয়াটে ঘূণধরা মন হয়ে যায়। তখন ‘ডিউটি’ ছাড়া আর কিছু সম্পর্কেই উৎসাহ থাকে না। নিছক চাকরির খাতিরে কেন একজন ড্রাইভার আমাকে এরকম ঝুঁকির রাস্তায় নিয়ে যাবে এই রাত্তিরে। সে অনায়াসেই বলতে পারত, না স্যার পারব না, আমি এখন বাড়ি গিয়ে ঘুমবো! জোর করার কোনও উপায় ছিল না আমার, কারণ আমি অতিথি মাত্র, সরকারি কেউকেটা তো নই!

অতুল ওঝার কাঁধে হাত দিয়ে আমি ফিরে এলাম। গেটম্যান অনিচ্ছার সঙ্গে তালা খুলে দিয়ে বলল, আমি আধঘণ্টা অপেক্ষা করব। খানিকটা গিয়ে বেগতিক দেখলে ফিরে আসবেন। তার পরে এলে কিন্তু আমায় আর পাবেন না। আমার ডিউটি ওভার হয়ে গেছে।

আমি বললাম, ঠিক আছে, জেনে রাখলাম, ধন্যবাদ! অতুল ওঝা বয়েসে প্রায় কিশোর হলেও বেশ বুদ্ধিমান, তা এই সময় বুঝলাম। সে জিপটার স্টার্ট বন্ধ করেনি। এতক্ষণ ধরে জিপটা ধকধক করেছে। এই সময়, গেটম্যানের সামনেই যদি জিপটা স্টার্ট নিয়ে গোলমাল করত, তাহলে অপমানের একশেষ হতে হত নিশ্চয়ই। তার বদলে, গেট পেরিয়ে সামনের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল জিপটা।

গেট পেরুবার সঙ্গে-সঙ্গেই অন্যরকম অনুভূতি হয় এখন আমরা জঙ্গলের মধ্যে। যদিও সেখানে তেমন কিছু জঙ্গল নেই। সেটা পূর্ণিমার কাছাকাছি রাত, ফিকে জ্যোৎস্নায় দেখা যায়, চারপাশে প্রায় ফাঁকা মাঠ, এখানে ওখানে দু-একটা গাছ। তবু তো এক ঘোষিত অরণ্যের মধ্যে এসে পড়েছি, এ জায়গাটা বাইরের থেকে আলাদা।

প্রায় দু-কিলোমিটার পথ পার হওয়ার পর জঙ্গল শুরু হয়। তাও এমন কিছু নয়, রাস্তার দুপাশে বড়-বড় ঘাস, এখানে সেখানে ছড়ানো গাছপালা। দেখলে কোনও ভয়ের অনুভূতি হয় না। রাস্তা বেশ খারাপ, মাঝেমাঝে কাঠের ব্রিজ।

ব্রিজগুলোর চেহারা সুবিধাজনক নয়, দুপাশে দুটো কাঠের পাটাতন যার ওপর দিয়ে গাড়ি যাওয়ার কথা। অনভ্যস্ত হাতে আমার ড্রাইভার এক একবার সেই পাটাতন থেকে বিচ্যুত হচ্ছে আর শব্দ উঠছে ঘটঘটাং।

আমি অতুল ওঝার কাঁধে হাত রেখে জিগ্যেস করলাম, তুমি এ রাস্তায় আগে কখনও এসেছ। সে বলল, না স্যার।

–এরকম জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ি চালিয়েছ কখনও?

–না, সাব!

–ভয় করছে?

–না, সাব!

–আমরা ঠিক পৌঁছে যাব, কী বলে?

–হ্যাঁ, সাব। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে হেড লাইটের আলোয় রাস্তার ওপরেই দুটো চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। ঠিক সচেতনভাবে নয়, অচেতনভাবেই বোধহয় আমি দেখে নিলাম চোখ দুটির উচ্চতা কতখানি। খুব বেশি নয়। এবং কাছাকাছি আরও কয়েকটি চোখ।

আর একটু কাছে আসবার পর দেখা গেল কয়েকটি চিত্রল হরিণ ও একটি বড় সম্বর। হরিণগুলি জিপ গাড়িটার দিকে চেয়ে দেখল দু-তিন পলক, তারপর এক পলক ফেলার চেয়েও কম সময় তাদের সেই বিখ্যাত ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠে, বায়ুতে সাঁতার কেটে অদৃশ্য হয়ে গেল পাশের অন্ধকারে। সম্বরটি দাঁড়িয়েই আছে, দুটি সরল নির্বোধ চোখ, আমরা যখন খুব কাছে, যখন প্রায় একটা লাঠি বাড়িয়েই তাকে ছোঁয়া যায়, সেই সময় তার ঘোর ভাঙল, পেছন ফিরেই উন্মত্তের মতন লাফিয়ে পড়ল একটা ঝোপে, হুড়মুড় করে শব্দ হল।

এরপর দেখতে পেলাম কয়েকটি ময়ূর। তারা লীলায়িত ভঙ্গিতে রাস্তা পার হচ্ছিল, আলোয় তাদের পালকের বর্ণসম্ভার চকিতে ঠিকরে ওঠে, তারা প্রত্যেকেই গ্রীবা ঘুরিয়ে একবার তাকায় গাড়ির দিকে। কী অসম্ভব ত্রুর ভয়াল তাদের চোখ! রাত্রিবেলা যে-কোনও জন্তু জানোয়ারের চোখই অন্যরকম হয়ে যায়। সাধারণ কোনও বিড়াল বা বা গরুর চোখও অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ আলোয় অচেনা নিষ্ঠুর হয়ে যায়। রাত্রিবেলা মোষের চোখের চেয়ে উজ্জ্বল কোনও জিনিস আমি এ পর্যন্ত দেখিনি। ময়ূরের চোখও অন্যরকম। এদের চোখের মধ্যে থেকে যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠে একরকমের বেগুনি ধরনের আলো।

এক ধরনের পাখির চোখেও এরকম আলো দেখলাম। শুধু এই জঙ্গলে নয়। এর আগেও রাত্রির ড্রাইভে বাইরের ফাঁকা রাস্তায় এই ধরনের পাখি চোখে পড়ে। এরা রাস্তায় শুয়ে থাকতে ভালোবাসে। এগুলো কী পাখি? বাদুড় নয়, গায়ের রং গাঢ় খয়েরি, ডানা মেলে শুয়ে থাকে পিচের রাস্তায়, চোখ দুটি আগুনের ফুলকির মতন, গাড়ি খুব কাছে এলে এরা ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যায়।

আরও কয়েকটি হরিণ ও সম্বর পার হয়ে এলাম। হরিণ যতই সুন্দর প্রাণী হোক, রাত্রিবেলা তারা আমাদের মুগ্ধ করে না। রাত্তিরবেলা দলবেঁধে সংরক্ষিত অরণ্যে ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার অনেক আছে। প্রত্যেকবারই দেখেছি, কেউ হরিণ পছন্দ করে না। কারণ ঘুরতে-ঘুরতে হরিণ বা বুনো শুয়োরই বেশি চোখে পড়ে, বারবার। কেউ-কেউ বিরক্তির সঙ্গে বলে ওঠে, ‘আঃ হরিণ দেখতে দেখতে চোখ পচে গেল।’ কেন না, তখন সকলেরই আগ্রহ আরও কোনও বড় জানোয়ারের জন্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাদের দেখা পাওয়া যায় না। আপাতত আমাদের অধীর অপেক্ষা যেমন হাতির জন্য।

খানিক পরে পাশের ঝোঁপ থেকে দুটি বেশ বড় প্রাণী বেরিয়ে এসে আমাদের গাড়ির ঠিক সামনের দিকে ছুটতে লাগল। জিপের চেয়েও তাদের ছোটার গতি বেশি দ্রুত। প্রথমে বেশ চমকে ও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল গন্ডার। সেই রকমই দেহের আকার। জলদাপাড়া ও কাজিরাঙ্গার মতন মানসেও বেশ কিছু এক-খড়গ গন্ডারের বাস। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরে ভুল ভাঙলো। গন্ডার নয়, মোষের মতন কোনও জানোয়ার, কারণ খড়গ নেই, বিরাট পাকানো শিং। হতে পারে বাইসন, নাও হতে পারে, বন-গরু হওয়াও বিচিত্র নয়, শুনেছি বন-মোরগের মতন বন-গরুও আছে এ তল্লাটে। এদের মাথা দুটি আমরা ভালো করে দেখতে পেলাম না, কিছুক্ষণ আমাদের সামনে রেস দিয়ে ওরা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

এরপর দশ-পনেরো মিনিট আর কিছু নেই। একটা পাখি পর্যন্ত না। সব দিক নিঃসাড়, নিঃশব্দ। রাত দশটা বেজে গেছে। রাস্তার সামনের দিকে তাকলে মনে হয় যেন একটা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে চলেছি। দুপাশের বড়-বড় গাছ ওপরের দিকে গোল হয়ে এসে মিলে গেছে, রাস্তার দুপাশে উঁচু উঁচু ঘাস। এগুলোকেই বোধহয় এলিফ্যান্ট গ্রাস বলে।

রাস্তা ফাঁকা দেখে ওঝা বেশ জোরে চালাচ্ছে। ছেলেটির আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই। কিন্তু আমি ওকে একটু সংযত হতে বললাম। হঠাৎ একটা শায়িত হাতির গায়ে ধাক্কা মারা কোনও কাজের কথা নয়। তখন আর কোনও উপায়ই থাকবে না। তা ছাড়া রাস্তা এত খারাপ যে দুর্ঘটনায় মরার সম্ভাবনাই বেশি।

শীতের জন্যই কি না জানি না, হঠাৎ শরীরে একটা শিহরন জাগল, আর কোনও জন্তু জানোয়ারের দেখা পাচ্ছি না বলেই যেন মনে হচ্ছে, আমরা এবারেই সবচেয়ে বিপদের এলাকায় এসেছি। ভয় ও অস্বস্তি কাটাবার জন্য ব্র্যান্ডির বোতল থেকে আর একটা লম্বা চুমুক দিলাম। চোখ দুটি যথাসম্ভব খর করে সামনের দিকে স্থির। দূরের ঝুপসি-ঝুপসি গাছপালাকে মনে হচ্ছে হাততর পাল। যেন, যে-কোনও মুহূর্তে আমাদের পথ আটকে যাবে।

হঠাৎ মনে হল, আমি যাচ্ছি কেন? এতগুলি লোক নিষেধ করেছে যখন, তখন নিশ্চিত কিছুটা প্রাণের ঝুঁকি আছে। পথ জুড়ে যদি হাতির পাল শুয়ে থাকে তাহলে এখন কী করব? অর্ধেকের বেশি রাস্তা পার হয়ে এসেছি। এখন আর ফেরার উপায় নেই। রাস্তার অবস্থা ক্রমশ আরও শোচনীয় হচ্ছে, বিরাট-বিরাট গর্তে চাকা পড়ে লগবগ করছে স্টিয়ারিং। একবার পাশ দিয়ে গড়িয়ে গেলেই শেষ। তাহলে এত ঝুঁকি নিয়ে এলাম কেন? আমি তো কোনও দুঃসাহসী অভিযাত্রী নই, সাধারণ ভ্রমণকারী মাত্র। রাত্তিরটা নিরাপদে কাটিয়ে কাল সকালে নিশ্চিন্তে নির্ভরযোগ্য ড্রাইভার নিয়েই তো আসা যেতে পারত। তাতে দিনের আলোয় প্রাণ বাঁচিয়ে প্রকৃতি দর্শন হত। কিংবা, কাল সকালেও যদি আসবার অসুবিধে থাকত, এ যাত্রায় হত না মানস ভ্রমণ, তাতেই বা কি ক্ষতি এমন? এ জীবনে কত কিছুই তো দেখা হয়নি। আমার মনের একটা অংশ আর একটা অংশকে খুব জেদিভাবে প্রশ্ন করতে লাগল, কেন যাচ্ছি? এমনভাবে যাওয়ার কী মানে হয়, উত্তর দাও। অনেকক্ষণ কোনও উত্তর আসে না। তাতে অস্বস্তি আরও বাড়ে। তারপর মরিয়াভাবে একটা উত্তর পেয়ে যাই। অস্ফুটভাবে বলি, যাচ্ছি, তার কারণ না-যাওয়ারও কোনও মানে হয় না।

এরপর ভেতরটা বেশ হালকা হয়ে যায়। এভারেস্টের শিখর আরোহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন অভিযাত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তুমি বারবার ওখানে যাও কেন? উত্তরে তিনি, সেই বিখ্যাত অভিযাত্রীর নাম মালোরি, সংক্ষেপে জানিয়েছিলেন, ‘বিকজ ইট ইজ দেয়ার!’ আমার উত্তরটাও অনেকটা সেইরকম ভেবে আমি নিজের কাছেই একটু অহংকার দেখাই। এর আগেও তো কত জঙ্গলে গেছি, কতরকম ব্যবস্থা ট্যবস্থা করে, মানসে নিশ্চয়ই এইরকম ভাবেই আমার যাওয়ার কথা ছিল? তা ছাড়া অনিশ্চয়তা বরাবরই আমার প্রিয়।

মাঝেমাঝে কাঠের সেতু পেরুতে হচ্ছে। সেতুগুলোর অবস্থাও সাংঘাতিক, মনে হয় যেকোনও মুহূর্তে সবশুছু ভেঙে পড়বে। এইরকম চতুর্থ সেতুটি পেরিয়ে রাস্তাটি সবেমাত্র বাঁক নিয়েছে, এই সময় সারা জঙ্গল কাঁপিয়ে শব্দ হল উম ম ম আঁ আঁ–যেন একটা বাজ পড়ল! খুব কাছ থেকে এবং এত অসম্ভব জোরে সেই শব্দ যে মনে হল তা আমার বুকে প্রবল ধাক্কা মেরে আমার হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দিয়েছে। ভয়ে আমি চোখ বুজে ফেললাম।

চিড়িয়াখানায় বাঘের ডাক শুনেছি আগে। কিন্তু নিস্তব্ধ জঙ্গলে তার ভয়াবহ জোর যেন একশো গুণ বেশি। তা ছাড়া এমনই আকস্মিক। বাঘের কথা আমি একবারও চিন্তা করিনি তাই কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার ভয়-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল, মনে হল যেন আমি মরে গেছি। এবং এত জোরালো শব্দের প্রতিক্রিয়া এই যে তারপর কিছুক্ষণ মনে হয়, পৃথিবীতে আর কোনও শব্দই নেই। সব শব্দ মৃত্যুতে নীরব।

আবার চোখ মেলেই পাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, ওঝার মুখ একেবারে ফ্যাকাসে, স্টিয়ারিং এর ওপর তার একটুও দখল নেই, জিপটা এঁকেবেঁকে পাশের দিকে গড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে গেল। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম স্টিয়ারিং-এর ওপর। ডান-পা বাড়িয়ে ওঝার পায়ের ওপর দিয়েই এক লাথি কষলাম ব্রেকে।

গাড়িটা থামতেই দ্বিতীয়বার আকাশ ফাটিয়ে বাঘটা ডাকল। এবার আরও জোরে। মনে হয় পঁচিশ ত্রিশ গজ দূরেই বাঘটা রয়েছে। বাঁ-পাশের জঙ্গলে।

বীর বালকটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। দ্বিতীয়বার বাঘটা ডাকতেই সে হুড়মুড়িয়ে আমার কোলে মাথা গুঁজল। আমিও মাথা নীচু করে ফেললাম কেন তা জানি না। আমরা হাতির জন্য চিন্তিত ছিলাম, বাঘের কথা মনেও স্থান দিইনি, তাই ভয়টা কাটানোর কোনও উপায়ই মনে এল না। সম্পূর্ণ শরীরটা কাঁপছে।

খোলা জিপ, বাঘটা আক্রমণ করলে আমাদের বাঁচার কোনও উপায়ই নেই। অস্ত্র বলতে শুধু আমার হাতের ব্রান্ডির বোতল। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম, বাঘটা আসুক, আমাদের খেয়ে নিক।

কিন্তু বাঘটা খোলা জায়গায় এল না। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে তীব্র চোখে আমাদের দেখছে। যে-কোনও মুহূর্তে লাফিয়ে পড়বে।

নির্বোধের মতন আমরা গাড়ি থামিয়ে সেখানে চুপচাপ বসে রইলাম দু-তিন মিনিট, যাতে বাঘটার কোনও রকম অসুবিধেই না হয়। বাঘের গর্জনের মধ্যেই বোধহয় এরকম মৃত্যুচুম্বক থাকে। তারপর অতিকষ্টে সেই ঘোর কাটিয়ে আমাদের বেঁচে থাকার চিন্তা ফিরে এল। বুঝলাম, থেমে যাওয়ার চেয়ে এগিয়ে যাওয়া সব সময়ই ভালো। চলন্ত গাড়িতে আমরা তবু খানিকক্ষণ বেশি বাঁচব। যেখানে পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, সেখানে সামনে এগোতেই হবে।

জিপ গাড়িটাও নিশ্চয়ই বাঘের ডাক শুনে ভয় পেয়েছিল। কারণ এবার সে স্টার্ট দিতে একটুও দেরি করল না। সেখানে যদি জিপটা আবার গণ্ডগোল করত, তাহলে এ কাহিনি নিশ্চয়ই অন্যরকম হত। কিন্তু এবার অ্যাক্সিলেটারে চাপ দিতেই জিপটা ব্যস্ত হয়ে সামনের দিকে দৌড়াল। ওঝার সঙ্গে আমিও ধরে রাখলাম স্টিয়ারিং। গাড়ি চলল মাঝারি গতিতে।

বাঘটা সামনে এল না, আর ডাকলও না। এবং এক হিসেবে সে আমাদের বাঁচিয়ে দিল। বোধহয় তার জন্যই আমাদের বিপদ কেটে গেল, এরপর আর কোনওরকম জন্তু-জানোয়ারই চোখে পড়ল না। যদিও বাঘের পরপর দু-বার গর্জন শুনে যে ভয় পেয়েছিলাম, তা কাটতে সময় লাগল যথেষ্ট। বেশ কিছুক্ষণ মাথাটা দুর্বল হয়ে রইল।

আরও আধঘণ্টা পর পথের ওপর একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। ‘ওয়ে টু আপার বাংলো’। তার পাশে লেখা, অরণ্যের স্তব্ধতা নষ্ট করবেন না। ডানদিকে ঘুরে একটা টিলার ওপরে বাংলোয় পৌঁছে গেলাম। হাত-পায়ের জড়তা ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে একটা বড় নিশ্বাস নিলাম। শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছি দেখে বেশ খুশি ভাব হল। বেঁচে থাকার অমলিন আনন্দ।

হাঁক-ডাক করে তোলা হল চৌকিদারকে। সে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। ঘুমের থেকেও বেশি বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে সে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। এগারোটা বেজে গেছে, এত রাত্রে কেউ কোনওদিন তাকে ডেকে তোলেনি। আমরা বে-আইনি আগন্তুক।

আমি তাকে আশ্বস্ত করলুম যে আমাদের খাবার-দাবারের কিছু দরকার নেই। বাংলোর একটি ঘর আমার নামে রিজার্ভ করা আছে, সেটি খুলে দিলেই চলবে।

চৌকিদার জিগ্যেস করল, আপনারা এ সময় এলেন কী করে? হাতিতে রাস্তা আটকায়নি?

আমি গম্ভীরভবে বললাম, না, হাতি কিছু করেনি। কিন্তু বাঘের কথা কেউ আমাকে বলেনি কেন?

বরপেটাতেও বলেনি, চেকপোস্টেও বলেনি। শুধু হাতির ভয় দেখিয়েছে। যদি জানতাম রাস্তায় বাঘ পড়বে, তাহলে আমি আসতাম না। বাঘের সঙ্গে চালাকি চলে না। কেন কেউ বলেনি?

চৌকিদার বললো, বাঘ? চার নম্বর ব্রিজটার কাছাকাছি?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

চৌকিদার বললো, এখানে চার-পাঁচটা বাঘ মাঝে-মাঝে আসে একসঙ্গে।

একটা নয়। চার-পাঁচটা? কিন্তু সে ব্যাপারে কেউ আমাকে সাবধান কয়ে দেয়নি কেন?

চৌকিদার বলল, ওরা এ পর্যন্ত কোনও মানুষ মারেনি। মানুষ দেখলে সরে যায়। আমিও কয়েকবার দেখেছি।

কোন বাঘ মানুষ মারবে আর কোন বাঘ মারবে না, গভীর রাত্রে জঙ্গলের মধ্যে সে বিচার করার সাধ্য আমার নেই। ডাক শুনেই বুকের অতি পরিচিত শব্দটা থামবার উপক্রম হয়েছিল। এবং পিলে পর্যন্ত চমকে যাওয়া কাকে বলে, সেই তখনই বুঝেছিলাম।

বাংলোটি প্রকাণ্ড। দোতলা অন্তত আটখানা ঘর। চৌকিদার আমার ঘরটা খুলে দিল। এরপর তার শুধু আর একটা কাজ বাকি।

আগে থেকেই আমার জানা ছিল যে ভোর পাঁচটায় পোষা হাতির পিঠে চেপে এখানে জঙ্গলে ঘোরার ব্যবস্থা আছে। ঠিক সেই সময় সেই হাতি আনবার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে এখনই।

চৌকিদার বলল, কিন্তু সে তো আগে থেকেই খবর দিয়ে রাখতে হয়। তা ছাড়া আপনি একা…আপনার একার জন্য হাতি…

আমি বললাম, হ্যাঁ আমার একার জন্যই হাতির ব্যবস্থা করতে হবে। যা খরচ লাগে আমি দেব।

তারপর তার কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, ভাই, আগে থেকে খবর দিয়ে আসতে পারিনি, কিন্তু এসে যখন পড়েছি তোমার অতিথি হয়ে, কষ্ট করে একটা ব্যবস্থা করে দাও।

লোকটি গজগজানি ধরনের নয়। শান্ত মুখেই রাজি হল। তাকে এখন কিছু দূরে মাহুতের ঝোঁপড়িতে গিয়ে খবর দিতে হবে। আমি বললাম, আর একটা কাজ, ভোর পাঁচটার যদি আমার ঘুম না ভাঙে, একটু ডেকে দিও, আর সেই সঙ্গে যদি এককাপ চা…

সে বলল, সঙ্গে চা-চিনি-দুধ এনেছেন?

এই রে, আর সবই তো বাজার করে এনেছি, চা কেনার কথা মনেই ছিল না। ভোরবেলা এককাপ চা না পেলে কী করে চলবে?

চৌকিদার বলল, তার কাছে শুধু চা-পাতা আছে। দুধ-চিনি নেই। আমি বললাম, তাই-ই সই। শুধু লিকার গরম গরম–

চৌকিদার চলে গেল। ড্রাইভার ওঝাও গেল তার সঙ্গে। তারপর আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলাম। এতবড় বাংলোটিতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বাকি সব ঘর তালাবন্ধ।

এতখানি রাস্তা লম্ভমান জিপে চড়ে এসে বেশ ক্লান্ত লাগছে। জামাকাপড় ছেড়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। চমৎকার নরম বিছানা, নতুন মশারি ও কম্বল। কাল ভোরে উঠতে হবে।

কিন্তু আধঘণ্টা শুয়ে থাকার পরও আমার ঘুম এল না। এতবড় একটা বাড়িতে আমি একা।

ভাগ্যিস আমার সঙ্গে আর কেউ আসেনি এ যাত্রায়। কত দুর্লভ এই একাকিত্ব। শহরে সব সময় মানুষ, সব সময় কেউ না কেউ, সব সময়ে আমাকে থাকতে হয় নিজের পরিচয়ে। আমি কারুর বন্ধু, কারুর ভাই, কারুর কাছে দেনাদার, কারুর কাছে কৃপাপ্রার্থী। এখানে এই মুহূর্তে আমি কেউ না। আমি শুধু আমি।

এরকম রাতটা ঘুমিয়ে নষ্ট করবার কোনও মানে হয় না।

কাঁচের গ্লাসের ব্র্যান্ডি ঢেলে সেটা হাতে নিয়ে উঠে এলাম দোতালায়। হঠাৎ যেন আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। অসাধারণ জ্যোৎস্না ফুটে আছে দিগন্ত জুড়ে। সামনের দিকে যতদূর তাকাই অরণ্য। যেন সত্যিই আমি পৃথিবীর সমস্ত ইটে গড়া সভ্যতা ছাড়িয়ে চলে এসেছি, এরপর বাকি পৃথিবী জোড়া অরণ্য রাজ্য। আমার ডান পাশে একটা বিশাল চওড়া নদী। এই নদীর নাম মানস। মানস সরোবর থেকে নেমে এসে এই নদী এখানে পড়েছে সমতলে, তাই সব সময় সমুদ্রের মতন গর্জমান।

বাংলোর ওপরতলায় একটি বেশ প্রশস্ত কাঁচের ঘর। সেখান থেকে দেখা যায় নদীর ওপারের স্তব্ধ অন্ধকার বনভূমি। বহুদূর থেকে দুটি পাখি একটানে ডেকে চলেছে, টিউ…টিউ…টিউ। রাতে কোন পাখি ডাকে আমি জানি না। এমন মধুর সুরেলা স্বরও তো কখনও শুনিনি। মাঝে-মাঝে বন থেকে আর একটা শব্দ আসছে, এটা ধোপার কাপড় কাচার শব্দের মতন অবিকল। এটা নিশ্চিত কোনও জানোয়ারের ডাক। এত রাতে জঙ্গলের মধ্যে বসে কে আর কাপড় কাচবে। কোন জানোয়ার জানি না।

জ্যোৎস্নার মধ্যে আমি নিজেই একটি ছায়ামূর্তি হয়ে সারা বাংলোটি ঘুরে দেখলাম। হাওয়ায় কোনও জানলা একবার খোলে আর বন্ধ হয়। একটা শুকনো পাতা উড়ে এসে বারান্দায় পড়ে হঠাৎ আপন মনে ঘুরে-ঘুরে খেলা শুরু করে। আমি তন্ময় হয়ে সেই খেলা দেখি। যেন বহুদিন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে, একদিন রাত্রি সাড়ে বারোটায় মানস ডাকবাংলোয় একটি শুকনো পাতা এইভাবে উড়ে এসে খেলা দেখাবে এবং আমি তা দেখব।

ডাক বাংলোটির সামনে ধাপ ধাপ ফুলের বাগান নেমে গেছে নীচের দিকে। ঘোরানো পথ চলে গেছে নদীপ্রান্তে। বাংলো থেকে বেরিয়ে এসে সেই পথ ধরলাম। রাতচরা পাখি দুটি এখনও ডেকে চলেছে, শোনা যাচ্ছে কাপড় কাচার শব্দ। আমার একটু একটু গা ছমছম করছে। কিন্তু ভয়েরও একটা নেশা আছে। যেমন রাত্রির আছে আলাদা জীবন। সচরাচর তো তার সন্ধান পাই না, তাই পা টিপেটিপে এগিয়ে চললাম। বাঘের জন্যই বেশি ভয় এবং এই ভয় বহু শতাব্দীর। তবে বাংলোর এত কাছে নিশ্চয়ই বাঘ আসবে না। যদিও বা আসে, একটু আগে চৌকিদারের মুখে শুনলাম, এখানকার বাঘ এ পর্যন্ত মানুষ মারেনি। তাহলে আমাকেই বা প্রথম মারবে কেন? কোনও ব্যাপারই প্রথম হওয়ার যোগ্যতা নেই আমার।

সম্পূর্ণ অচেনা জায়গা, অচেনা অন্ধকার, অচেনা পথ। একবার ভাবলাম আসবার সময় একটা টর্চ কিনেছিলাম তো! কিন্তু ফিরে গিয়ে সেটা নিয়ে আসার ইচ্ছে হল না। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে মনে হয় যে টর্চের আলোও শব্দ করে উঠবে।

কয়েকবার সামান্য হোঁচট খেতে খেতেও সামলে নিয়ে পৌঁছে গেলাম নদীর কিনারে। নদীর জল এমন সাদা যে, মনে হয় জমাট জ্যোৎস্নার ধারা। একটু ঝুঁকে সেই নদীর জলে হাত দিতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে হাত সরিয়ে নিলাম। পাহাড়ি নদী সম্পর্কে আমার যথেষ্ট পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। কোথাও-কোথাও স্রোত এতই প্রবল হয় যে, ঝোঁক সামলানো যায় না, টেনে নিয়ে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম সেখানে। সাধারণ পাহাড়ি নদীর চেয়ে অনেক বেশি প্রশস্ত এলাকায় মানস নদী। তাও শেষ-শীতকাল। বর্ষায় এর রূপ আরও খুলবে। ওপারের ঘন অন্ধকার অরণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মনে হয়, ওদিকের সাদা বালির চড়ায় নড়াচড়া করছে একটি প্রাণী। মানুষ? না, হতে পারে না। বাঘ কিংবা হাতিও নয়, তার চেয়ে ছোট। হতে পারে কোনও কুকুর, শেয়াল বা হরিণ। ভালো করে দেখা যায় না, তবু আমার হরিণী বলে মেনে নিতেই সাধ হল। আমি নিজের কাছে আবার জোর দিয়ে বললাম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই হরিণী।

হরিণীটি সম্ভবত জলপান করতে এসেছিল, বেশি দেরি করল না, চট করে আবার আঁধারে মিলিয়ে গেল। তবু সে তার ক্ষণিক উপস্থিতিতে যেন ধন্য করে দিয়ে গেল আমাকে। এই নির্জন প্রদেশে সে আমার সঙ্গিনী ছিল। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। এমন জ্যোৎস্না বোধ হয় আমি ইহজীবনে আর কখনও দেখিনি। এই শান্ত নীরবতায় তা যেন উদ্ভাসিত হয়েছে সহস্রগুণ বেশি। এই অরণ্যের মধ্যে চন্দ্রকিরণে ভেসে যাওয়া একা এক নদী, তার পাশে একজন একা মানুষ–এই দৃশ্যটি যেন বহু হাজার বছরের পুরোনো। এবং আমার চতুষ্পর্শের যে রূপ, তার মধ্যে আমি যেন এক নারীসৌন্দর্যের আভাস পাই। এই জ্যোৎস্নার যে-কোনও উপমাই নারী। এই স্তব্ধ গহন বনভূমির উপমাও নারী। আমার কাছে নারীসৌন্দর্যই সব সৌন্দর্যের সার। তাই প্রকৃতির কাছে এসেও আমি বাস্তব কোনও নারীর সান্নিধ্য টের পাই। এই জ্যোৎস্নালোক, তার হাস্য, এই আঁধার অরণ্য, তার রহস্যময়তা।

সত্যিই আমি জন্মরোমান্টিক, আমি না মরলে আমার এই দোষ শুধরোবে না!

এই অপরূপ রাত্রিকে একটি নারী হিসাবে কল্পনা করে আমি রীতিমতন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি, এত শীতের মধ্যেও আমার শরীরে উত্তাপ জেগে ওঠে। বিছানা থেকে কম্বলটা উঠিয়ে এনেছিলাম, সেটা গা থেকে খুলে ফেলে আমি আমার সম্মুখবর্তী শূন্যতাকে আলিঙ্গন করি এবং প্রগাঢ় চুম্বন দিই। চুম্বনটি বেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়। এমনকী শুয়েও পড়ি বালির ওপরে এবং রীতিমতন প্রণয় খেলা শুরু হয়ে যায়।

এর আগে কখনও প্রকৃতির সঙ্গে এত নিবিড়ভাবে প্রণয় আমার হয়নি। প্রকৃতিকেও এমন বহু ইপ্সিতা, সম্পূর্ণ নারী হিসেবে আমি পাইনি কখনও। আমি তার শরীরের গন্ধ নিই, বারবার গরম আদর দিই তার ওষ্ঠে, তার শরীরের সঙ্গে শরীর মেশাই।

আবেশে কখন একটু তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে শরীর কেঁপে উঠল। ভয়ে কিংবা শীতে। আর যাই হোক, এখানে ঘুমিয়ে থাকা যায় না। ঘড়িতে দেখলাম, দুটো পাঁচ। রাত্রির তৃতীয় প্রহরে বেশি করে শীত নামে। প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে আমি উঠে পড়লাম। এখনও ঘণ্টা আড়াই বিছানায় শুয়ে আরাম করা যেতে পারে।

ঠিক পৌনে পাঁচটার সময় চৌকিদার চা এনে আমাকে জাগিয়ে তোলে। আমি জড়তা কাটিয়ে তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে পড়ি। আলস্য করতে গেলেই আলো ফুটে যাবে। তাড়াতাড়ি মুখটুখ ধুয়ে দৌড়োলাম। এবার টর্চটা সঙ্গে নিতে ভুল হল না।

ডাকবাংলো থেকে রাস্তাটা নেমে গেছে একটা বাঁধের মতন হয়ে। তারই মাঝামাঝি জায়গায় একটা উঁচু সিমেন্টের মঞ্চ তৈরি করা। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার ড্রাইভার ওঝাও চোখ ডলতে ডলতে উঠে এসেছ। সেও জঙ্গল দেখবে।

কাছেই দুটো হাতি বাঁধা, একটি বেশ বড়, আর একটা বাচ্চা। অন্ধকারের মধ্যে সে দুটি জমাট অন্ধকার হয়ে আছে। তাদের গায়ে টর্চের আলো ফেললে কান লটপট করে। এরই কোনও একটাতে যেতে হবে। কিন্তু মাহুত কোথায়?

মিনিট দশেক পরে মাহুত এল তৃতীয় হাতি নিয়ে। এই হাতিটির আকার মাঝারি। মাহুতের চেহারাটি দেখে বেশ পছন্দ হল। আজকাল অনেক কিছুই ঠিক-ঠাক মেলে না। রাখাল বলতেই যে ছবিটা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, সেরকম রাখাল মাঠে-ঘাটে দেখা যায় না। গয়লানিদের যে রকম ছবি আঁকা হয় সেরকম গয়লানি বহুদিন দেখিনি। সেদিক থেকে এই হাতিটাকে তো হাতির মতন দেখতে বটেই, মাহুতটিও অবিকল মাহুতের মতন। কুচকুচে কালো এবং ছিপছিপে মেদবর্জিত শরীরের একটি যুবক মাথায় পাগড়ি, কোমরে ছুরি গোঁজা ও হাতে ডাঙস। যে কোনও কথা বলল না, ইশারায় আমাকে হাতির পিঠে চেপে বসার কথা জানাল।

হাতির পিঠে হাওদা নেই। একটা দুটো তোশক ফেলে তার ওপর মোটা দড়ি বাঁধা। ঘোড়ার পিঠে বসার মতন এখানেও বসতে হবে দুদিকে ঝুলিয়ে। কিন্তু ঘোড়ার দু-দিকে পা ঝোলানো আর হাতির দুদিকে পা ঝোলানো কি এক কথা হল? পা দুটি বিসদৃশ অবস্থায় থাকে এবং একটু পরেই বেশ ব্যথা করে। দড়িটাও শক্ত করে ধরে থাকতে হয়। নইলে যেকোনও মুহূর্তে টাল খেয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

রাস্তা পেরিয়ে হাতি ঢুকল বনের মধ্যে। তখন সবেমাত্র অন্ধকার পাতলা হতে শুরু করেছে। একটু পরেই বুঝলাম, হাতি যেখান দিয়ে চলেছে, সেখানে গাড়ি-টাড়ি তো দূরের কথা, পায়ে হেঁটেও মানুষের পক্ষে যাতায়াত সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ দুর্ভেদ্য জঙ্গল, গাছে গাছে কোনও ফাঁক নেই বললেই চলে, তা ছাড়া রয়েছে লতাপাতার ঝোঁপ। কিন্তু হাতির গতির মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব আছে, সে কিছু মানে না, মাঝারি সাইজের গাছও সে মট মটাং করে ভেঙে ফেলে। আমরা মাথা নীচু করে মাথা বাঁচাই। এই সময় মনে হল, কাল রাত্রে আসবার সময় পথের দুধারে এরকম অনেক আধভাঙা গাছ দেখেছি, সেগুলি তবে হাতিরই কীর্তি।

ভোরের প্রথম সিগারেটটা ধরালেই বেশ কিছুক্ষণ কাশি হওয়ার কথা। স্মােকারদের এই এক অভিশাপ। কিন্তু সিগারেট ধরিয়েও আমি জোর করে মুখ চেপে রইলাম। কিছুতেই কোনও শব্দ করা চলবে না। সমস্ত বনে হাতির পায়ে চলার শব্দ ছাড়া আর একটাই শব্দ হচ্ছে শুধু। একটা বনমোরগের ডাক। তীক্ষ্ণস্বরটা ভেসে আসছে একটা ঘন ঝোঁপ থেকে। আমরা সেইদিকেই এগোচ্ছি। ভোরবেলা প্রথম সূর্যালোকের বার্তা দিকে দিকে ঘোষণা করার দায়িত্ব এই মোরগজাতিকে কে দিয়েছে কে জানে! আর কোনও পাখির ডাক এখনও শোনা যাচ্ছে। সেই রাত পাখি দুটিও বুঝি এখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

ঝোপটার কাছে আসতেই ঝটপটিয়ে বেরিয়ে এল বন মোরগটা, অসম্ভব গাঢ় লাল আর হলুদ তার পাখনার রং, আমাদের দিকে একবার ক্রদ্ধ দৃষ্টি মেলে সে উড়ে গেল অনেক দূরে। যেন মাঝপথে বিঘ্ন ঘটানো হয়েছে তার সঙ্গীতের। তারপর আর কোনও শব্দ নেই।

হাতিটা মাঝেমাঝে কোনও ছোট টিলার ওপর দিকে উঠছে। কখনও নেমে যাচ্ছে কোনও শুকনো নদীগর্ভে। সেই সময় দুহাতে দড়ি আঁকড়ে ধরে দেহের ভারসাম্য রাখতে হয়। হাত আলগা হলেই ধপাস। সমতলে চলার সময় এত জোর লাগে না।

পোষা হাতির পিঠে চেপে বনের মদ্যে ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার আরও হয়েছে কয়েকবার। তখন সঙ্গে অনেক লোক। দু-তিনটে হাতি, এবং কেউ না কেউ কথাবার্তা বলে ফেলেছে। কিন্তু এবার মাহুতকে নিয়ে আমরা মাত্র তিনজন, এবং আধঘণ্টা হয়ে গেল তবু টু শব্দটি পর্যন্ত করিনি। এই স্তব্ধতাটাও উপভোগ্য।

ক্রমশ কয়েকটি হরিণ ও সম্বর দেখা দিতে লাগল। চিত্রল হরিণগুলিই বড় সুন্দর, দেখলে আশ্রমমৃগের কথাই মনে হয়। আজ সকালের আলোয় শুধু সম্বর নয়, হরিণগুলিও আমরা খুব কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত পালাচ্ছে না। প্রথমে এর কারণ ভেবে অবাক হয়েছিলাম। হরিণগুলিও কি টুরিস্ট দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে? অপেক্ষা করছে কখন আমি ক্যামেরা বার করব? তত টুরিস্ট তো এখানে আসে না। একটু পরেই কারণটা সম্যক বুঝলাম। জঙ্গলে হাতির পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই, এই আওয়াজ হরিণদের চেনা এবং নিরামিষাশী হাতি সম্পর্কে তাদের কোনও ভয় থাকার কথাও নয়। তারপর হঠাৎ যখন তারা হাতির পিঠে কয়েকটি দু-পেয়ে ভয়াবহ প্রাণীকে দেখছে, তখনই তারা পালাচ্ছে। হরিণের পলায়নদৃশ্য সত্যি দেখবার মতন। বিস্মিত হয়ে তারা লাফিয়ে উঠছে শূন্যে, তারপর সময়কে সময়হীনতায় এনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আর সম্বরের পলায়নটা একটা জবরজং ব্যাপার, পেছন ফিরতেই অনেক সময় লেগে যায়। আহা, বেচারা সম্বরগুলো এই জন্যই এত সহজে শিকৃত হয়।

আর একটু দূর যাওয়ার পর মাঝে-মাঝেই একটা শব্দ কানে আসতে লাগল। এই পরিবেশে অ-মানানসই। অনেকটা যেন রেলের পুরোনো কয়লা-ইঞ্জিনের মতন। ঘ্যাস-ঘ্যাস, ঘ্যাস-ঘ্যাস! যতবার শব্দটা শুনি, ততবার চমকে উঠি।

কাছাকাছি কি কোনও রেল লাইন আছে? তা হলে আর এমনকী দুর্ভেদ্য অরণ্য! মাহুতকে সে কথাটা জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আবার সেই শব্দ হল ঠিক মাথার ওপরে।

দেখলাম, শকুনের চেয়েও বড় আকারের দুটি পাখি, হলদে আর কালো রঙের, উড়ে যাচ্ছে কাছের গাছ থেকে দূরের গাছে। উড়ন্ত এত বড় কোনও পাখি আমি আগে কখনও দেখিনি। একটু পরেই, আরও কয়েকটি দেখেই চিনতে পারলাম। ধনেশ পাখি ওগুলো, এখানে রয়েছে শয়ে শয়ে। সে বড় বিচিত্র দৃশ্য। তাদের ডানায় অবিকল রেল ইঞ্জিনের শব্দ।

নিস্তব্ধ, অতি আগ্রহী, অধীর মন ও চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছি সামনে। মাঝে-মাঝে কোনও জীবন্ত প্রাণী দেখলেই মনে হয় কিছু যেন একটা পেলাম। এক সময় মাহুতকে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলাম, গন্ডার নেই? গন্ডার কোথায়?

মাহুত বলল, আছে সাহেব, বহুৎ। কিন্তু এই সময় পাহাড়ের ওপর দিকে উঠে যায়। মাঝেমাঝে দেখা যায়–পরশুদিন আমি দুটো দেখেছি।

আমি তাকে গন্ডার খোঁজার জন্য তাগিদ দিলাম। সে হাতিকে চালনা করল বন-বা দাঁড় ভেদ করে, অন্যদিকে। তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে গন্ডার পাওয়া গেল না। তখন বেশ নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম, যেন সবটাই ব্যর্থ হয়ে গেল, তারপর নিজেকে এক ধমক দিলাম।

অরণ্যে এসে অনেক সময়ই অরণ্য দেখাই হয় না। ছেলেমানুষের মতন শুধু জন্তু-জানোয়ার দেখার ইচ্ছেই জাগে। আমারও এরকম হয়! গন্ডার না দেখলে কী এমন ক্ষতি হবে? গন্ডার কি কখনও দেখিনি? শুধু চিড়িয়াখানাতেই নয়, উত্তর বাংলার জলদাপাড়াতেও আমার অরণ্যচারী গন্ডার দর্শন হয়ে গেছে আগে। এখানেও শুধু গন্ডারের জন্য ছোটাছুটি করে কী লাভ? গন্ডারের চিন্তা যেই মনে থেকে মুছে ফেললাম, অমনি সমগ্র অরণ্যটাই আমার চোখের সামনে জাজ্বল্যমান হয়ে উঠল।

ইতিমধ্যে সন্তর্পণে খুব কোমল ও বিনীত সূর্য উঠেছে। এটা সেই ধরনের দুর্লভ একটি ভোর, যখন প্রথম সূর্যের আলো ঠিকরে লাগে চাঁদের গায়ে। আমার সামনের দিকে সূর্য, ঘাড় ফিরিয়ে একবার চাঁদকেও দেখে নিলাম। মনে হয়, এমন যে দেখলাম, এর জন্য নিশ্চয়ই আমার অনেক সুকৃতি জমা ছিল। থোকা থোকা সাদা ফুল ভোরের আলোয় হঠাৎ রক্তিম মনে হয়। ওড়িশার সিমলিপাল জঙ্গলে এক জায়গায় দেখেছিলাম শুধু অজস্র হালকা ভায়োলেট রঙের ফুল, আর কোনও রঙের ফুল নেই! এক বন্ধু বলেছিলেন, ভূতলে তামা থাকলে নাকি সেখানকার ফুল ওইরকম বেগুনি হয়ে যায়। মানস অরণ্যে বেগুনি ফুল নেই, শুধু সাদা, আর কিছু কিছু টকটকে লাল। কোনওটারই নাম জানি না।

ফুলের চেয়েও এই জঙ্গলে পাখির সমারোহই বেশি। বন-মোরগরা তাদের কর্তব্য সাঙ্গ করেছে। এখন অসংখ্য জাতের পাখি তাদের আলাদা আলাদা সুরে শুরু করে দিয়েছে উষার বন্দনা। যেন অরণ্যের শিখরে শিখরে একটা গানের জলসা বসে গেছে।

মাঝে মাঝেই ছোট ছোট জলাশয়। সেরকম একটির কাছে পৌঁছতেই দেখলাম, পিঠটা কালচে আর বুকের কাছটা সাদা রঙের একজাতীয় হাঁস ঝাঁক বেঁধে দারুণ জোরে এসে জলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েই উঠে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে, চক্রাকারে বাতাস কেটে ঘুরে এসে তারা আবার ওইরকম ভাবে জল ছুঁচ্ছে। এটা কি একটা খেলা? নাকি শীতের জন্য স্নান করতে এসেও ওরা বেশিক্ষণ জলে থাকতে পারছে না? এত ভোরে স্নান না করলেই বা কি দোষ ছিল? আবার অন্য একটি ডোবায় অন্যরকম। সেখানে খয়েরি রঙের একটু আলাদা চেহারার কয়েকশো হাঁস নিশ্চিন্তে জলে ভেসে আছে। এদের শীতবোধ নেই? আমাদের হাতিটি অবলীলাক্রমে সেই ডোবাটিতে নেমে পড়তেই ফরফর করে অসংখ্য প্রজাপতির মতন তারা উড়ে গেল। ভাগ্যিস ডোবাটিতে হাতিটির হাঁটুজল।

ডোবাটি পেরিয়ে খানিকটা যাওয়ার পর খানিকটা প্রশস্ত প্রান্তর। তার একেবারে শেষ সীমায় গোটা ছয়েক মোষের মতন প্রাণী গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ঘরোয়া সভা করছে। মাহুতটি উত্তেজিতভাবে বলল, সার বাইসন! প্রাণীগুলি বেশ দূরে এবং ওদিকটায় ঠিক মতন আলো পড়েনি বলে আমি ভালোমতন দেখতে পাচ্ছি না। বললাম, আর একটু কাছে চলো না। মাহুতটি রাজি হল না। আমিও অবশ্য খুব পীড়াপীড়ি করলাম না তাকে। জঙ্গলের নিয়ম সে-ই ভালো বোঝে। কাল রাত্রেও বুঝতে পারিনি, আজ সকালেও তেমন মোষের তুলনায় বাইসনের আলাদা কী বৈশিষ্ট্য তা ঠিক অনুধাবন করতে পারা গেল না।

হাতির মুখ ফিরিয়ে মাহুত জিগ্যেস করল, এবার ফিরব। বেলা হয়ে গেছে আর বিশেষ কিছু দেখা যাবে না।

আমি একটু জোর করলে সে হয়তো আরও ঘুরতে রাজি হত। কিন্তু আমারই উৎসাহ কমে গেছে। হাতির দু’দিকে পা ছড়িয়ে বসার জন্য একটা পায়ে রীতিমতন আড়ষ্ট ব্যথা। এ ছাড়া ঘণ্টা দুয়েক ধরে দড়ি আঁকড়ে থাকার জন্য ঘষে গেছে হাতের তালু। হাতিটা যখন হুড়মুড় করে জলাডোবায় নামে কিংবা উঁচুতে ওঠে, তখন যে-কোনও মুহূর্তে পড়ে যাওয়ার ভয় হয়। বললাম, চলো।

ফিরছিলাম অন্যদিক দিয়ে। এক সময় জঙ্গলের মধ্যকার যে পথ দিয়ে আমরা কাল জিপে এসেছি, সেটা পার হতে হল। এবং তার একটু পরেই পেছন থেকে অতুল ওঝা আমার পিঠে একটা খোঁচা মেরে বলল, সাব। ডাইনে–

ডানদিকে তাকাতেই আমি একটি বিশাল দৃশ্য দেখতে পেলাম। একটি অতিকায় দাঁতালো হাতি, তার সাদা দাঁত ঝকঝক করছে রোদে এবং নিউ থিয়েটার্সের প্রতীক চিহ্নের মতন সে শুড়টা উঁচু করে আছে।

সেটিকে দেখে আমাদের বাহন এবং মাহুত দুজনেই বেশ চঞ্চল হয়ে উঠল। মাহুত ডাঙস কষাতেই আমাদের হাতিটা দ্রুতগতিতে একটা ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে স্থির হয়ে রইল। সেখানটা রীতিমতন অন্ধকার।

আমি অতি চুপিচুপি জিগ্যেস করলাম, কী হল?

মাহুত বলল, ওই হাতিটা একলা ঘোরে, ওটা বড় বদমাশ, গুন্ডা–

একলা হাতিটা যে বিপজ্জনক তা আমার জানা ছিল। সুতরাং বেশ খানিকটা রোমাঞ্চিত হয়ে ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম তাকে।

গুন্ডা হাতিটা কিন্তু আমাদের দেখতে পেয়েছিল। আমাদের পলায়নকালে সে মাথা ঘুরিয়ে তার খুদে চোখে তাকিয়েছিল কয়েক পলক। কিন্তু সম্ভবত তার মেজাজ এখন প্রসন্ন। সে খুব মন্থরগতিতে হাঁটতে লাগল। ঠিক যেন মনে হয়, বড়বাবু মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন। চোখের সামনে মাত্র পঁচিশ-ত্রিশ গজ দূরে একটি জলজ্যান্ত দাঁতালো গুন্ডা হাতিকে আমি দেখতে পাচ্ছি, এটাকে যেন একটা অবিশ্বাস্য সত্য বলে মনে হয়।

মাহুত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শালা রোডের দিকে যাচ্ছে। এই শালা যখন তখন রোডের ওপর শুয়ে থাকে। তখন মানুষ যেতে পারে না।

তাহলে কাল রাত্তিতে এই হাতি মহারাজের জন্যই সবাই আমাদের ভয় দেখাচ্ছিল? আমি পেছন ফিরে অতুল ওঝার দিকে তাকালাম। সেও আমার দিকে চেয়ে হাসল।

কিন্তু হাতিটা রাস্তার ওপরেই শুয়ে থাকে কেন? অন্য কোথাও শুতে পারে না?

মাহুত যা বলল, তাতে বোঝা গেল যে অতবড় একটা হাতির শুয়ে থাকার মতন ফাঁকা জায়গা এই জঙ্গলে বেশি নেই। সেই তুলনায় রাস্তাটাই ফাঁকা, সেটাই ওদের বিশ্রামের জায়গা।

গুন্ডা হাতিটা দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়ার পর আমরা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে ফেরা-পথ ধরলাম। এবং বাংলোয় পৌঁছোবার আগে গন্ডার না দেখার ক্ষতিপূরণ হয়ে গেল আরও দুটি হাতির পাল দেখে। এক-এক দলে দশ-বারোটা হাতি, বুড়ো বাচ্চা মিলিয়ে। একটি দল একটা জলাশয়ে নেমে গরু-মোষের মতন স্নান করছে! হাতিরা বেশ কৌতুকপ্রবণ। এ ওর গায়ে জল ছিটিয়ে মেতে আছে খেলায়। আমরা পাশ দিয়ে চলে গেলুম। হৃক্ষেপও করল না।

বাংলোয় ফিরে এক কাপ দুধ-চিনিহীন চায়ের অর্ডার করলাম চৌকিদারকে। গায়ের ব্যথা মারবার জন্য বিছানায় গিয়ে একটু শুয়েছি, অমনি শুনলাম, নারীর কলকণ্ঠ। সঙ্গে সঙ্গে আবার চলে এলাম বাইরে। ঝলমলে রঙিন পোশাক পরা কয়েকটি ভুটিয়া মেয়ে পিঠে একরাশ বোঝা নিয়ে বাংলোর গা-ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছেনদীর দিকে। আমার দিকে তারা কৌতূহলের সঙ্গে তাকাল, হঠাৎ একটু থমকে দাঁড়িয়ে তারপর আকস্মিক হাসির ঝিলিক দিয়ে আবার চলে গেল।

কাল রাত্রে ভেবেছিলাম, চৌকিদার ও আমার ড্রাইভারকে বাদ দিলে এই জঙ্গলে সম্পূর্ণ একা কিন্তু মানুষ কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাচ্ছে?

শুধু চা নয়, কয়েকটা বিস্কুটও জোগাড় করে এনেছে অতুল ওঝা। তার কাছ থেকে কিছু খবর পেলাম। এবং একটু পরে, এজন তরুণ বিট অফিসার এসে আমায় সবকিছু জানাল। এই মানস নদীর ওপারেই ভুটান রাজ্য। এমনকী নদীর এপারেও কিছুটা অংশ ভুটানের এলাকায়। ওদিকে কাছাকাছি কোনও শহর বা বাজার নেই। তাই ভুটানিরা এদিকে আসে বাজার করতে, অনেক সময় দুদিন তিনদিনের পথ হেঁটে ওরা বাজার করে আনে।

আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, তাহলে এই নদী পার হওয়া যায়? ওপারে আমরাও যেতে পারি? কোনও বাধা নেই?

বিট অফিসারটি বললেন, না, না, কোনও বাধা নেই। সবাই যেতে পারে।

তৎক্ষণাৎ আমি ওপারে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লুম।

কাল রাত্রে আমি নদীর কিনারে যেখানে এসেছিলাম, তার পাশ দিয়েই রাস্তা চলে গেছে উজানের দিকে। খানিক দূরে খেয়াঘাট। স্বচ্ছ, নীলবর্ণ জল। তাকিয়ে থাকলে মাছেদের খেলা দেখা যায়। এই জায়গাটি ট্রাউট ফিশিং-এর জন্য বিখ্যাত, তাই সাহেবদের কাছে আকর্ষণীয়। ছিপ থাকলে আমিও বসে যেতাম। কিছুদিন আগেই নাকি এখান থেকে একজন ত্রিশ কেজি ওজনের একটি মাছ ধরেছে।

মানস নদী বেশ খরস্রোতা বলেই পার হওয়ার কায়দাও আলাদা। সরাসরি এপার-ওপার করা যায় না। নদীর গা দিয়েই লাঠি ঠেলে-ঠেলে বেশ খানিকটা উজিয়ে যেতে হয়। তারপর স্রোতের মধ্যে এসে কোণাকুণি খানিকটা পিছিয়ে এসে ওপারে ওঠা যায়।

এপারেও নিবিড় বন। কিছুক্ষণ সেই বিট অফিসার ও স্থানীয় কিছু লোকের লোকের সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালাম। এখানে সেই কাপড়- কাঁচার মতন শব্দটির রহস্যের মীমাংসা হল। দু একবার সে-রকম শব্দ হতেই আমি বিট অফিসারটির দিকে তাকালাম। সে বলল, ও হচ্ছে বার্কিং ডিয়ারের ডাক। এই জঙ্গলে খুব আছে। ওরা দিনে-রাত্রে সবসময় ডাকে।

বিট অফিসারটি আর একটি দুর্লভ জিনিস আমাকে দেখাবার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করল। বনে বনে প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুরে তা দেখতে পেলাম। ডজনখানেক গোল্ডেন লাঙ্গুর। এরা এক জাতের হনুমান। মুখ কালো দারুণ লম্বা লেজ আর গায়ের রং ঝকঝকে সোনালি। খুব উঁচু গাছের মগডালে এরা থাকে দেখলাম, গায়ে রোদ পড়লেই প্রায় চোখ ঝলসানো সোনালি আভা বেরোয় এদের গা থেকে। এই জাতের হনুমান এখন অবলুপ্তির পথে। সব সমেত বারো কি চোদ্দোটি হনুমানের সেই দলটির দিকে তাকিয়ে বড় বিষণ্ণ মায়া বোধ করলাম। এরা ধ্বংস সামনে নিয়ে বসে আছে।

এই বনেও ধনেশ পাখির সংখ্যা প্রচুর। এক-এক সময় চেনা যায় যুগল ধনেশ-ধনেশী লম্বা ডানা আছড়ে নদী পার হয়ে চলে যাচ্ছে। ডাকবাংলোর চৌকিদার বলেছিল, কয়েকদিন আগে দিনে-দুপুরে সে একটি বাঘকেও নদী সাঁতরে এদিকে আসতে দেখেছে। জন্তু-জানোয়াররা এখনও সীমান্ত মানতে শেখেনি। মানস নদীর দু-দিকের অরণ্যের নামই মানস। তাই অরণ্য ও পশুদের সংরক্ষণের যৌথ দায়িত্ব নিয়েছেন ভারত ও ভুটান সরকার।

বিট অফিসারটি শহরের ছেলে, নতুন চাকরিতে ঢুকেছে, অবিবাহিত, জঙ্গলে সে একলা থাকে। কী করে তার সময় কাটে? কিছু বই আছে তার সঙ্গী, তা ছাড়া এরই মধ্যে অরণ্য তার ভালো লেগে গেছে। অরণ্যে সবচেয়ে যা তার ভালো লাগে, সে আমাকে বলল, তা হল অরণ্যের স্তব্ধতা। ‘বুঝলেন, এই যে নদীর স্রোতের শব্দ, এটাও সেই স্তব্ধতারই অঙ্গ।’ আমার সন্দেহ হল, সে কবিতা লেখে।

ভুটানের দিকে কয়েকটি বাড়িঘর আছে। কিছু কিছু কাট-কাটার ব্যাপারও রয়েছে। রয়েছে ভূটানের রাজার একটি সুদৃশ্য বাড়ি। দু-পাঁচ বছরের মধ্যেও তার তালা খোলা হয় না। আর একটি বাংলো রয়েছে এদিকে। এখন কেউ নেই। নদীর এপার-ওপারে ভারত-ভুটানের দুটি বাংলোতেই এখন আমিই একমাত্র অধীশ্বর। বিট অফিসারটি বলল, আমি ইচ্ছে করলে ভুটানের বাংলোতেও এসে থাকতে পারি। সেরকম ব্যবস্থা করা যায়।

কারা আসে এখানে? উত্তর পাওয়া খুব শক্ত নয়, সাহেবরা। ভারতের দিকে যে আটখানি ঘরওয়ালা বিশাল বাংলোটি প্রস্তুত, সেটিও তো সাহেবদের মুখ চেয়েই। আমাদের দেশে পর্যটনের সব কিছুই তো সাহেব নির্ভর। ভিখারির জাত, সবসময় কোল পেতে বসে আছি, কখন দয়া করে কোনও সাহেব-দেবতা আসবে। এসো সাহেব, বসো সাহেব, যো-হুঁ জ্বর সাহেব, একটু ফরেন এক্সচেঞ্জের ঝুমঝুমি বাজাও তো সাহেব–এই তো আমাদের পর্যটন উন্নয়নের মন্ত্র

এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতেই আর একটি আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়ল। নদীর খুব কাছে একটি খড়ের চালের কুঁড়েঘর। তার কাছেই একটা গাছের গুঁড়িতে একটা তক্তা সাঁটা, সেটাতে খড়ি দিয়ে ইংরেজিতে লেখা ‘বার’। আমি স্তম্ভিতভাবে বললাম, এখানে বার?

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। বার রীতিমতন খোলা। কোমরে ভোজালি খুঁজে ভুটানের জাতীয় পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে বার-টেন্ডার। অপরূপ সারল্যে উদ্ভাসিত তার মুখ।

বিট অফিসারটি একটু অপ্রসন্নভাবে বলল চলুন, এখানে দেখবার কিছু নেই, এদিকে পাহাড়ের কাছে অনেক পাখি আছে। বুঝলাম সে একটু নীতিবাতিকগ্রস্ত। আমি হেসে বললুম, ‘একজন যখন এমন নির্জন জায়গায় বার খুলে রেখেছে, তখন কারুকে তো সেটা পেট্রোনাইজ করতেই হবে।’

সে বুঝল না, বলল, চলুন, চলুন! তখন আমি তাকে বিদায় জানালুম। সে প্রকৃতি দর্শনে গেল, আমি রয়ে গেলাম সেখানেই।

কিন্তু আমার বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। সেই খড়ের ঘরের বারে পরপর সাজানো রয়েছে শুধু স্কচ হুইস্কির বোতল। এখানে স্কচ হুইস্কি? বিট অফিসার ও আমি ছাড়া আর একটিও প্যান্ট-শার্ট পরা লোক নেই সেখানে। দাম জিগ্যেস করলাম। কলকাতার তুলনায় খুবই সস্তা হলেও এমন সস্তা নয় যে জঙ্গলের মানুষ কিনতে পারবে। তাদের আয়ত্তের যথেষ্ট বাইরে। তবে, কে খায় এসব?

উত্তর সেই একই। আমাদের মতন দুর্বল দোনা-মোনা নীতি নেই ভুটান সরকারের।

তাঁদের টুরিস্ট বাংলো থাকলেই সঙ্গে বার থাকবে। এই সুদূর জঙ্গলে, যেখানে হয়তো বছরে একবার দুবার সাহেবরা আসে, তাদের জন্য। এবং মানুষ থাক বা না থাক বার-টেন্ডার ঠিক তার দোকান খুলে রাখে। পাহাড়ি মানুষরা তাকিয়ে দেখে চলে যায়।

জানি বাঙালি লেখকদের শুধু লেবুর জল খাওয়াই নিয়ম। কোনও সাহেবসুবোর পার্টিতে লেখকের নিজের উপস্থিতি বর্ণনা দিতে গেলে অনিবার্যভাবে এই লাইনটি এসে পড়ে, ‘না, আমার চলে না।’

শরৎচন্দ্র মদ খাওয়ার কমপিটিশান দিতে গিয়ে এক সাহেবকে মেরে ফেলেছিলেন, কিন্তু নিজের লেখার মধ্যে কোথাও সেকথা স্বীকার করেননি।

আমি ওসব বুঝি না। এইরকম পরিবেশে আমি কোনোদিন কোনও স্কচ হুইস্কির দোকান দেখিনি। এখানে স্বাদ নিশ্চয়ই আলাদা হবে। সেদিকে এগিয়ে গেলাম।

কয়েকটি জ্যান্ত গাছকে মাঝখান থেকে কেটে ফেলা হয়েছে, গুঁড়িগুলোই এখন বসবার জায়গা। চমৎকার ব্যবস্থা। একপাত্র ‘কালো-সাদা’-র অর্ডার দিলাম। সুশ্রী বারম্যানটি আমরা দিকে পানীয় সমেত গেলাস এগিয়ে দিতে, আমি বললাম হোড়া পানি হোগা? সে তরতর করে ছুটে গিয়ে নদী থেকে এক বোতল জল নিয়ে এলে। সেই পবিত্র মানস সরোবরের জল মিশিয়ে স্কচ পান করতে-করতে আমি মুচকি হাসতে লাগলাম। আমি এইসব মজা একা-একা বেশ উপভোগ করি।

মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক টিয়াপাখি। নদীর ধারে রাস্তা দিয়ে উঠে এল সাত আটটি ভুটানি যুবতী। তাদের পোশাকে সবুজ ও লাল রঙের প্রাধান্য। তদের দিকে তাকালে তারা চোখ সরায় না, হঠাৎ হঠাৎ হেসে ওঠে। টিয়াপাখির ঠোঁটের রঙের সঙ্গে তাদের ঠোঁটের মিল আছে। একটু পরেই তারা জঙ্গলের মধ্যে মিশে যায়। আবার আর একটি দল জল থেকে উঠে আসে। একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে ঘন জঙ্গলের মধ্য থেকে একটি বার্কিং ডিয়ার অনাবশ্যকভাবে ডেকে ওঠে দুবার। দুটি সারস ধরনের পাখি মানসের ঠিক মাঝখানে জলের কাছেই গোল হয়ে ঘুরছে, ঢেউয়ে ভেঙে যাচ্ছে তাদের ছায়া।

মাথার টুপিতে লম্বা একটা ধনেশ পাখির পালক গোঁজা এক বুড়ো আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তার মুখে সহস্র ভাঁজ। সে আমাকে বলল, সেলাম সাব! আমিও বললাম, সেলাম। সে আবার বলল, সেলাম। আমিও। সে-ও আবার। এই খেলাটা আমি জানি। গহন অরণ্য হোক বা ধূ ধূ করা মরুভূমি হোক, যেখানেই পানশালা আছে, সেখানেই এরকম একটি চরিত্র থাকবেই। বৃদ্ধটি আমার গেলাসের দিকে সতৃষ্ণভাবে তাকিয়ে।

আমি বললাম, ওরে বাবা, বড্ড দামি জিনিস। তোমায় বেশি খাওয়াতে পারব না। আচ্ছা দাও ওকে এক পেগ।

সে তৎক্ষণাৎ আমার পাশের কাটা-গাছের গুঁড়িতে বসে পড়ে বলল, সাহেব, শের দেখবে? আমি তোমাকে শের দেখাতে পারি। আর রাইনো, সাব, এক এক শিং রাইনো, পাইথন, ইতনা মোটা–

বুঝলাম, অ্যামেরিকান টুরিস্টদের সে এইভাবে ভোলায়। আমি বললাম, আমার কিছু দরকার নেই। কিন্তু তোমাকে বেশি খাওয়াতে পারব না।

তিন পাত্তর খেয়েই আমি উঠে পড়লাম। লোকটি বড় বেশি কথা বলছিল। কিন্তু মানুষের কণ্ঠস্বর আমার পছন্দ হচ্ছিল না তখন।

নদীর ধার দিয়ে একা একা হাঁটতে লাগলাম ওপরের দিকে। নানা আকারের পাথর ছড়ানো। ভাবতে ভালো লাগে যে, এইসব পাথর এসেছে শ-শ মাইল দূরের মানস সরোবর থেকে। কয়েকটি পাথর কুড়িয়ে নিই, রং ও আকৃতি দেখে সংগ্রহ করতে করতে দু-হাত ভরে যায়। এসব কিছুই জমানো যায় না, তাই আবার একটি একটি করে ছুঁড়ে দিই জলের মধ্যে। একটা পাথরও নদীর এপার থেকে ওপারে পৌঁছে দিতে পারি না।

এক জায়গায় পাতলা জঙ্গল দেখে বসে পড়লাম। বেশ চড়া হয়ে রোদ উঠলেও এখানে গাছের ছায়া। পরিষ্কার বালি। আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ি। দুপাশে গম্ভীর পাহাড় আমাকে দেখছে। জঙ্গল থেকে যে-কোনও সময় যে-কোনও একটি জন্তুর বেরিয়ে আসা বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু ভয় আসে না। শুয়ে শুয়ে দেখি পাখিদের ওড়াউড়ি। কী অদ্ভুত তীব্র নীল এখানকার আকাশ। মানস সরোবর কীরকম, এই আকাশের মতন? একদিন যেতে হবে।

হাত থেকে খসে পড়ে সিগারেট, ঘুম আসে। মনে হয়, এখানেই শুয়ে থাকব, আর কোনওদিন কোথাও যাব না। বহুদিন আগে আমি এখানেই ছিলাম, কেন দূরে চলে গিয়েছিলাম ভুল করে? আর ভুল করব না। পাতার ফাঁক দিয়ে একটি রোদের রেখা এসে পড়ায় আমি দু’হাতে চোখে চাপা দিই।

আমার এই অরণ্যবৈরাগ্য মাত্র দেড়ঘণ্টা স্থায়ী হয়। অতুল ওঝা ঠিক আমাকে খুঁজে বার করেছে। ডাকবাংলোতে ততক্ষণে খিচুড়ি রান্না তৈরি বলে সে আমাকে তাড়া দেয়।

আমিও উঠে পড়ি। এবার ফিরতে হবে। ফিরতে তো হয়ই।