[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১৫. উঠেছিলুম শহরের ঠিক হৃৎপিণ্ডের কাছে

উঠেছিলুম শহরের ঠিক হৃৎপিণ্ডের কাছে, প্লাজা হোটেলে। নিউ ইয়র্কের সেরা হোটেলগুলির একটা। আমাদের হিসেবে প্রায় আড়াই শো টাকা শুধু ঘর ভাড়াবলা বাহুল্য, আমি একজনের অতিথি। চৌরঙ্গির সামনের ময়দানের মততা, বিশাল সেন্ট্রাল পার্কের গায়ে এই হোটেল, এলাহি কাণ্ড, প্রাণপণে পুরোনো বনেদিভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা, ঝাড়লণ্ঠনে, এমনকি সামনে কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি পর্যন্ত দাঁড়িয়ে। আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কালো বা তামাটে রঙের লোক নেই বলে একটু অস্বস্তি লাগল–সেই জন্যই লিফটম্যান বা ম্যানেজারের ‘গুডমর্নিং স্যার’ শুনে গম্ভীরভাবে কাঁধ ঝাঁকাতুম।

প্রথম দিন দেখি একটি চটপটে চেহারার ছেলে, আমি যখন ঢুকতে যাচ্ছি, দ্রুত বেরুচ্ছে, চোখে কালো রোদ-চশমা, ছুটে গিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠল, দারোয়ান বেহারারা দরজা খুলে তটস্থ। ছেলেটিকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল, বিশেষত ওর দৌড়োবার ভঙ্গি। পরে মনে পড়ল, ওর নাম পল নিউম্যান, অনেক ছবিতে দেখেছি, হলিউডের উত্তমকুমার। আর একদিন ওই হোটেলের লবিতেই দেখি একজন কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক সপারিষদ দাঁড়িয়ে, চিনতে দেরি হয়নি, স্যার অ্যালেক গিনেস। তার আগের দিনই তাঁকে দেখেছিব্রডওয়ের স্টেজে ‘ডিলান নাটকে ক্ষুব্ধ, মদ্যপ, তরুণ, আত্মহন্তারক ডিলান টমাসের ভূমিকায়।

কয়েকদিন পর আরেক কাণ্ড। বিকেলের দিকে বেরুতে যাচ্ছি, গেটের সামনে কী ভিড়, চেঁচামেচি, পুলিশ–ভয় পেয়ে আমি ভেতরে ফিরে এলুম, আমার পনেরো তলার ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মারলুম নীচে। হাজার হাজার রিনরিনে গলার টিনএজার মেয়ে রং-বেরঙের স্কার্ট দুলিয়ে রইরই করছে। ভিড় সামলাতে পুলিশ হিমসিম। একটু পরে এক লিমুসিন গাড়ি থেকে চারটে রুক্ষু চুলওয়ালা ছোঁড়া নামল, আর অমনি পুলিশের কর্ডন ভেঙে ছুটে এল মেয়েরা। ছোঁকরা চারটের বয়েস কুড়ি বাইশের মধ্যে, হুড়ো কুড়ো মাথা, চুল পড়েছে কপাল পর্যন্ত, নিরীহ বদমাশের মতো তাকাচ্ছে হেসে-হেসে। বুঝলুম, এরা বিটলস, সাম্প্রতিক সামাজিক গুজব, ক্রেজ, এলভিস প্রিসলির চতুগুণ অবতার, উত্তেজনা। গ্রেট ব্রিটেন থেকে আমদানি, স্টেজের ওপর নেচে-কুঁদে, গান গেয়ে লক্ষ লক্ষ ডলার উপায় করছে! কাগজে-কাগজে এদের ছবি এখন।

আমি কবি পল এঙ্গেলের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে বেড়াতে এসেছি। আয়ওয়া-র লিটারারি ওয়ার্কশপের পরিচালক কবি পল এঙ্গেল আমাকে এ শহরের বহু প্রখ্যাত লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। বিস্ময়, আনন্দ, উপভোগ–এই কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে ডুবে আছি। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে আমি একটা অন্য লোক হয়ে গেছি, অন্য জগতে, এক এক সময় আবার পুরোনো অবস্থায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। পল এঙ্গেলের ব্যবহার চির সুহৃদের মতন আন্তরিক, তবু কয়েকদিন পর অকৃতজ্ঞের মতন আমি এঙ্গেলকে বললুম, দ্যাখো এখানে এ হইহুল্লার মধ্যে আমার থাকা হবে না। আমার অসুবিধে হচ্ছে।

অসুবিধে হচ্ছে? ও আমার কথা ঠিক বুঝতে পারল না।

আমি বললুম, আমার ঠাকুরদা ছিলেন পাঠশালার পণ্ডিত, বাবা ছিলেন ইস্কুল মাস্টার, আমি বেকার–আমার কি এসব আরাম বেশিদিন সহ্য হয়? আমার রাত্রে ঘুম হচ্ছে না।

এটা কোনও যুক্তি হল না। ঘুম হচ্ছে না কেন?

যে বিছানায় দিনে দুবার চাদর পালটানো হয়, সে বিছানায় শুয়ে সত্যি আমার ঘুম হয় না।

এদিকে এসো জানলার কাছে। দ্যাখো। ও আমাকে বলল। জানলা দিয়ে দেখলুম, যতদূর চোখ যায় হর্মের সারি, আদিগন্ত উঁইফুলের মতো হালকা বরফ পড়ছে, নীচে, সেন্ট্রাল পার্কে রঙিন প্রজাপতির মতো ছেলে-মেয়েরা স্কেটিং করছে অবিরাম, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, কিন্তু এমন দৃশ্য বহুবার বহু ছবিতে দেখেছি।

এরকম দৃশ্য তুমি আর কোথায় পাবে?

আমি মনে-মনে ভাবলুম, কিন্তু এখানে থাকলে আমার শুধু দৃশ্যই দেখা হবে, নিউ ইয়র্ক দেখা হবে না!

ওঃ, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, সে কথা এখনও বলা হয়নি। প্রথম দিন এসেই সন্ধেবেলা ও কাজ সেরে রেখেছিলুম। কী হতাশ হয়েছিলুম প্রথমটায়। লজ্জার কথা কী বলি, গোড়াতে খুঁজেই পাইনি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। লোককে জিগ্যেস করতেও পারিনি, অত বড় বাড়ি যা নাকি তিনশো মাইল দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়, সেটা হারিয়ে গেছে বললে সবাই নিশ্চিত হাসবে। অন্তত গোটা দশেক বাড়িকে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বলে ভুল করেছিলুম, শেষে অতিকষ্টে ম্যাপ দেখে খুঁজে পেলুম। না, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর উচ্চতা একেবারে গুজব না, একশো দুই তলা ঠিকই, আমি নিজে চড়ে দেখেছি। কিন্তু আশেপাশে আরও অনেক সত্তর-আশি তলা বাড়ি থাকলে, ওরা মহিমা ঠিক বোঝা যায় না। ও বাড়িটা যে সত্যি-সত্যি উঁচু তা বুঝতে পারা যায় বহু দূর থেকে কিংবা খুব কাছ থেকে।

তেমনি নিউ ইয়র্কের উঁচু সমাজ। প্রথম দিন-দশেক এঙ্গেল সাহেবের সঙ্গে আমি হোমরা চোমরাদের বাড়িতে খুব ডিনার খেলুম, রকেফেলার পরিবার, অ্যাডলাই স্টিভেনসানের সহধর্মিণী, ‘লাইফ’ পত্রিকার ম্যানেজিং এডিটর, ওমুক তেল কোম্পানির মালিক ইত্যাদি–খাস খানদানি ব্যবস্থার ত্রুটি নেই, সাত-আট কোর্স ডিনার, নানা রকম ওয়াইন, ইংরেজ বাটলার–আমি অকুতোভয় ছিলুম, বাঁধা ধরা ব্যবহার, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে গড়ে পাঁচ রকমের বেশি প্রশ্ন হবে জানতুম, মেয়েরা কেউ মুখে সিগারেট তুললে আগবাড়িয়ে ফটাস করে দেশলাই কাঠি জ্বালতে ভুল হয়নি। মাঝে-মাঝে মুখ লুকিয়ে হাসতুম একা-একা। দিনের বেলা আমি কোথায় খাই যদি জানতে পারত এরা! দিনের বেলায় খাওয়া আমার নিজের খরচে, তখন খুঁজে-খুঁজে যত রাজ্যের সস্তা জায়গায় যেখানে টিপস দিতে হয় না, কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ঘোঁত-ঘোঁত করে স্যান্ডউইচ কিংবা হ্যামবার্গার গেলা যায়।

তবে সব পার্টির সেরা অ্যাস্টর হোটেলের পার্টি। কবিতার ওপর ধনী আমেরিকানদের আজকাল বড় দরদ। সব জায়গাতেই খাওয়ার পর এ নিয়ে কিছু না কিছু আলাপ করা দস্তুর। ‘পোয়েট্রি সোসাইটি অব অ্যামেরিকা’ নামের প্রতিষ্ঠান দেখে কে বলবে পৃথিবীতে কবিতার দুর্দিন। প্রচুর ধনী বুড়োবুড়ি, কলেজের মাস্টার, রিটায়ার্ড কবি আছেন এ প্রতিষ্ঠানে। এদের বাৎসরিক উৎসব উপলক্ষে অ্যাস্টর হোটেলে ডিনার, এবারের উৎসব বেশি জমজমাট, বেশি খুশি–কারণ, সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠান এক মিলিয়ন ডলার চাঁদা পেয়েছে। বিশাল হলঘরে সবাই খেতে বসেছে, টেবিলে সবাইকার নাম লেখা কার্ড আছে আগে থেকে, নিজের নাম খুঁজে নিয়ে আমিও বসলুম, প্রায় হাজারখানেক নারী পুরুষ। সমিতির সভ্যদের জন্যও এ উৎসবে আলাদা পঁচাত্তর টাকা টিকিট, কিন্তু এঙ্গেল সাহেব আমার জন্য নেমন্তন্ন জোগাড় করে দিয়েছিলেন বলে, আমার ফ্রি। প্রধান অতিথি স্টিফেন স্পেন্ডার–আমার নামও সভাপতি মশাই ভারতবর্ষের কবিতা পত্রিকার সম্পাদক বলে বিশেষ অতিথি হিসেবে ঘোষণা করে দিলেন! সেই ঘোষণা শুনে আমার আশেপাশের দু-চারজন চোখ গোল-গোল করে আমার দিকে তাকাতেই আমি ফিসফিস করে বললুম, ওটা অনেকটা ফাঁকা আওয়াজ, বুঝলেন! কবিতার পত্রিকা মানে শ’পাঁচেক কপি ছাপা হয়, যত লোক কেনে তার বেশি বিলি হয়। ভারতবর্ষ তো দূরে থাক কলকাতাতেও আমাকে খুব কম লোক চেনে, মহাশয় মহাশয়াগণ!–এখানে আজ একরাত্রে কবিতার নামে যত টাকা খরচ হচ্ছে, তা দিয়ে কলকাতার তাবৎ কবিদের সংবৎসরের খোরাক জুটে যায়!’ শুনলুম কোথাকার এক ডাচেস, নিঃসন্তান, মরার সময় সেই সোসাইটিকে এক মিলিয়ন ডলার চাঁদা দিয়ে গেছেন। অর্থাৎ তাঁর সমস্ত টাকার কিছুটা তাঁর পোষা বেড়ালের নামে, কিছুটা কবিদের জন্য। এক মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ পঁচাত্তর লাখ টাকা। বুঝলুম, নোবেল প্রাইজে আজকাল এদেশে বিশেষ কোনও খবর হয় না কেন! নোবেল প্রাইজ, কি আর, লাখ পাঁচেক টাকা মাত্র! আমাদের রবীন্দ্রনাথের নাম তো অনেকে শোনেইনি, অনেকে নোবেল প্রাইজেরই নাম শুনেছে কি না সন্দেহ।

মাথায় সমস্ত চুল সাদা, স্টিফেন স্পেন্ডার ভিড় ঠেলে আমার কাছে এসে হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি, কলকাতায় আলাপ হয়েছিল।’–একেবারে ডাহা গুল, স্পেন্ডার সাহেব বার-দুয়েক কলকাতায় এসেছিলেন বটে, কিন্তু আমি নগন্য ব্যক্তি আমার সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। যাই হোক, ওটা হজম করে আমিও এক প্রস্থ দিলুম, বললুম, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনার সেই অসুখটা এমন কেমন আছে?’

থতোমতো খেয়ে স্পেন্ডার সাহেব বললেন, ‘ভালো, ভালো খুব ভালো, একেবারে সেরে গেছে, থ্যাঙ্ক ইউ, যামিনী রায়ের কী খবর?

আমি এমনভাবে যামিনী রায়ের বৃত্তান্ত শোনালুম যেন কলকাতায় থাকতে ওঁর সঙ্গে আমার দু বেলা দেখা হত। সলোমন নামে এক পুরোনো কবি বললেন, আমি বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে খুব ভালো জানি, টেগোর আর তরু দত্তর সব লেখা পড়েছি।’ বললুম, ‘ক্ষমা করবেন, টেগোরের সব লেখা আপনার পক্ষে পড়া অসম্ভব, আমার পক্ষেও প্রায় অসম্ভব। আর তরু দত্ত বাঙালি সাহিত্যিক নয়–ওই মেয়েটি বাংলাদেশে জন্মে ইংরেজি ও ফরাসিতে কিছু লেখার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা বাংলা সাহিত্য নয়। আপনি জীবনানন্দ দাশ পড়ার চেষ্টা করুন। না, না, জীবনান্তো নয়, জীবনানন্দ। অবশ্য, ওঁর বেশি লেখা অনুবাদ হয়নি।

আর একজন কবি, নাম ভুলে গেছি, বললেন, বাংলা সাহিত্য মানে কী? তোমাদের রাষ্ট্রভাষা তো হিন্দি, বাংলা তো একটা ডায়ালেক্ট।

আমি বললুম, আপনার এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কিন্তু পরে আপনার সঙ্গে আলাদা দেখা করে এ সম্বন্ধে বলতে পারি। এখানে এতবড় জায়গায় ঠিক সুবিধে হবে না, আমি বক্তৃতা করতে পারি না বিশেষত বেশিক্ষণ ইংরেজিতে বড়-বড় বাক্য আমি একেবারেই ম্যানেজ করতে পারি না, খানিকটা ইংরেজি বলার পরই আমার জল তেষ্টা পায়, কান কটকট করে, বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস আওয়াজ হয়!’ (কান কটকটের ইংরেজি জানি না বলে ওটা আমি ভঙ্গি দিয়ে বুঝিয়েছিলুম!)।

ওই পোয়েট্রি সোসাইটি পার্টিতে যাই হোক, নানারকম উত্তম উত্তম খাবার ছিল, পানীয়, বক্তৃতা, গান ও আবৃত্তি হল, অনেক কবি অনেক উপহার পেল, কিন্তু কবিতার কোনও ব্যাপার ছিল না। ওই পার্টিতে আমি এক কাণ্ড করেছিলুম। খাবার টেবিলে সাধারণত আমি আদবকায়দার ধার ধারি না, যা স্বাভাবিক মনে হয়, তাই করি। কিন্তু সেদিন ওরকম কেতাদুরস্ত আবহাওয়ায় আমি কীরকম ট্যালা হয়ে গেলুম, ভাবলুম সব ঠিক ঠিক করতে হবে। আমার পাশের চেয়ারে বসেছিলেন এক রূপসি ভদ্রমহিলা, সবুজ সান্ধ্য পোশাক পরা, নামও মিসেস গ্রিন, আমার সঙ্গে হেসে-হেসে দার্জিলিং-এর আবহাওয়া বিষয়ে আলোচনা করছিলেন, আমি আদব-কায়দায় ওকে হুবহু নকল করতে লাগলুম। কখন ন্যাপকিন কোলে রাখতে হবে, কোন হাতে ছুরি কাঁটা, বিনা শব্দে সুপে চুমুক, আইসক্রিমের চামচ ও কফির চামচে পার্থক্য, কোন হাত দিয়ে স্যালাড খেতে হবে–আমি আড়চোখে দেখে-দেখে কপি করে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ দেখি, টেবিলের বাকি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারি না, আমি আড়ষ্ট হয়ে কলার ঠিক করি, বো সোজা করি, জামা প্যান্টের বোতাম ঠিক আছে কি না দেখি, তবু ফিকফিক হাসি থামে না। শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলুম, আমার পাশের ভদ্রমহিলা ন্যাটা, ওঁর দেখাদেখি এতক্ষণ আমিও বাঁ-হতে ছুরি ধরেছিলুম।

এমনিভাবে হাওয়ায় শিমূল ফুলের মতো আমি ভাসতে লাগলুম নিউ ইয়র্কের উঁচু সমাজে। কিছুই ছুঁতে পারিনি। পার্টি থেকে পার্টি, ট্রাম লাইনের মতো বাঁধা কথাবার্তা, আকাশছোঁয়া হোটেল। মাঝেমাঝে দিনের বেলা একা পথে পথে ঘুরতুম। কোনওদিন পথ ভুল করে হারিয়ে যাইনি। হঠাৎ কোথাও পথের মধ্যে থেমে তাকিয়ে থাকতুম ওই বিশাল শহরটার দিকে। সত্যিই বিশাল। ভারতবর্ষে একমাত্র কলকাতার সঙ্গে মিল আছে। সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা ইংরেজদের কাছে কলকাতা সমেত তিনটি গ্রাম বেচে দিয়েছিল মাত্র তেরোশো টাকায়, এই ম্যানহাটান দ্বীপও রেড ইন্ডিয়ানরা ইওরোপীয়দের কাছে বিক্রি করেছিল মাত্র ছাব্বিশ ডলারে। আজ এই শহর শুধু বাণিজ্য নয়, শিল্প ও সাহিত্যের কেন্দ্র। পৃথিবীর নানান দেশের লেখক শিল্পী জমা হচ্ছে এখানে। অসংখ্য আর্ট গ্যালারিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের ছবি। পৃথিবীর সব দেশেই বাছাই করা সিনেমা দেখা যাবে এখানে, থিয়েটার, যে-কোনও বই। যে-কোনও খাবার, যে-কোনও পোশাক, যে-কোনও জাতের মানুষ। কলকাতার মতোই জীবন্ত এই শহর–মাটির তলায় ট্রেন ও আকাশ ঝাঁড় দেওয়া বাড়ির সারি সত্বেও। তবু, আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন ঠিক এ শহরের প্রাণ ছুঁতে পারছি না।

একদিন হোটেলে ফিরে এঙ্গেল সাহেবকে বললুম, আমি চললুম এখান থেকে, গ্রিনইচ ভিলেজে সস্তা থাকার জায়গা পেয়েছি।

তারপর আর বাক্যব্যয় না করে বিদায়।

নাম ভিলেজ, আসলে গ্রিনইচ ভিলেজ নিউ ইয়র্কের একটি পাড়া, আমাদের কলেজ স্ট্রিট পাড়ার মতো। নিউ ইয়র্ক কলেজ ও আশেপাশে বই-এর দোকান, ছোট-ছোট বাড়ি ও রেস্তোরাঁ, যত রাজ্যের লেখক শিল্পী অভিনেতা গাইয়েদের আড্ডা। একটা ছোট্ট হোটেলের এক চিলতে ঘরে উঠলুম, নিজের ইচ্ছে মতো পাঞ্জাবির দোকানে কষা-মাংস কিংবা চিনে হোটেলে ভাত মাছের ঝোল খাই। মাঝেমাঝে টেলিফোন করে এক অ্যামেরিকান কবি বন্ধুকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করি। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলকাতায়, সে এখানে বিষম বিখ্যাত, যে-কোনও পার্টিতে তার নাম করেছি সবাই চিনেছে ও কিছুটা আঁতকে উঠেছে। কিন্তু যেখানেই ফোন করি, শুনি, সে কাল এখানে ছিল, আজ কোথায় জানি না। দু-তিনদিন ঘুরলুম একা ওয়াল স্ট্রিট পেরিয়ে, স্ট্যাচু অব লিবার্টির চক্ষু-সীমায়।

*

আমার হোটেলের ঠিক উলটো দিকে একটা বড় বই-এর দোকান, সেখানে ঘুরঘুর করি, একদিন সাহস করে কাউন্টারে জিগ্যেস করলুম, অ্যালেন গিনসবার্গ কোথায় থাকে বলতে পারেন? লোকটা আমার দিকে মুখ তুলে বলল, আপনার নাম সুনীল সামথিং? ইন্ডিয়া থেকে? এই যে একটা চিঠি আপনার নামে। দোকানের ভেতর দিয়ে সোজা চলে যান, ডানদিকে সিঁড়ি, দোতলায় অ্যালেন গিনসবার্গকে পাবেন।

বুক পর্যন্ত দাড়ি, অবিন্যস্ত চুল, ঠিক কলকাতায় যেমন দেখেছিলাম। তখন দুপুর একটা, সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে অ্যালেন। বলল, ‘আমিও তোমাকে খুঁজছিলাম, আমার থাকার জায়গার ঠিক নেই, এক একদিন এক এক জায়গায় থাকি। এই বই-এর দোকানের মালিক এখানে কয়েকদিন থাকতে দিয়েছে। চলো ওপরে যাই রান্নাঘরে। বিলায়েত খান আর ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের রেকর্ড আছে, শুনবে?’

এতদিন পর ভারতীয় রাগসঙ্গীত শুনতে পেয়ে, যাকে বলে বুক জুড়িয়ে গেল। রাগসঙ্গীত যে আমি এত ভালোবাসি আগে কখনও বুঝতে পারিনি। অনেক কনফারেন্সে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি, এখানে রেকর্ডগুলো বারবার শুনতে লাগলুম। অ্যালেন ভাত আর মুরগির মাংস বেঁধেছিল আগের দিন, সেইগুলো গরম করে দুজনে খেলুম। সেই সঙ্গে চমৎকার জমানো দই। অ্যালেনের গায়ে পুরোনো রং-জ্বলা খাঁকি কর্ডের কোট ও প্যান্ট, জিগ্যেস করলুম, ‘ওগুলো কোথায় পেলে, কলকাতায় তো ছিল না?’ শুনলুম, ওর এক বন্ধু শিগগির মারা গেছে, তার বিধবা পুরোনো জামা কাপড়গুলো দিয়ে দিয়েছে অ্যালেনকে। আমি কোথায় উঠেছি, আমাকে জিগ্যেস করল। প্লাজা হোটেল শুনে আঁতকে উঠল, বলল, ‘আমি জন্মেছি এখানে, তিরিশ বছরের বেশি আছি নিউ ইয়র্কে, আজ পর্যন্ত ওসব জায়গায় ঢোকার সুযোগ পাইনি। আর তুমি! নিউ ইয়র্কে আর কী-কী দেখলে বলো!’

আমি আরম্ভ করলুম, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, মেট্রোপলিটান মিউজিয়ম, ইনস্টিটিউট অব মডার্ন আর্ট, ওয়াল স্ট্রিটের স্টক এক্সচেঞ্জ নামক চিড়িয়াখানা, নদীর তলায় লিঙ্কন টানেল, নিগ্রোপাড়া হার্লেম, ইউ এন বিল্ডিং। স্টাচু অব লিবার্টি? হ্যাঁ। রকেফেলার সেন্টার? হ্যাঁ। কোন কোন লোকের সঙ্গে দেখা হল? লিস্টি দিলাম। যেসব লোকের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়েছি, তাদের নাম শুনে ওর চোখ গোল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ছেলেমানুষের মতো বলল, ‘ওখানে কী সব কথাবার্তা হয় বলো তো শুনি, কখনও জানতে পারি না, কিন্তু খুব জানতে ইচ্ছে হয়।’ নানারকম গল্পের পর অ্যালেন বলল, ‘ট্যুরিস্টরা যা দেখে তুমি সবই দেখেছ, এমনকী তার চেয়ে অনেক বেশি, ও সব জায়গায় সবাই ঢোকার সুযোগ সুযোগ পায় না। তুমি দেখেছ উঁচু সমাজের নিউ ইয়র্ক। চলো, তোমাকে আর একরকম নিউ ইয়র্ক দেখাই। কলকাতায় আমি টুরিস্টের মতো ঘুরিনি, আমি দেখেছি চিৎপুর, চিনেবাজার, পোস্তা ওই সবও। চলো, তোমাকে নিউ ইয়র্কের ওসব জায়গা দেখাই!’

খানিকটা বাদে ওর বন্ধু পিটার এল। তিনজনে রাস্তায় বেরুলুম। সারাদিন ঝুরঝুর করে বরফ পড়ছে। গ্রিনইচ ভিলেজের রাস্তায় নানারকম লোক, এখানকার পোশাক তেমন ধোপদুরস্ত নয়, অনেক মেয়েদের মাথায় লম্বা চুল–অবেণীবদ্ধ, ছেলেদের পোশাক রং-বেরং, গলায় টাই নেই–এরা শিল্পী, তাই বেশবাসে এদের ভিন্ন হওয়ার দাবি আছে। বরফে ঢাকা নির্জন ওয়াশিংটন স্কোয়ার পেরিয়ে আসছিলুম। অ্যালেন বলল, ‘এই পার্ক দেখে কার কবিতা মনে পড়ে বলো তো?’ বললুম, ‘পল ভেলেনের কলোক সাঁন্তিমতাল।’ ‘শীতের নির্জন পার্ক চতুর্দিকে ছড়ানো তুষার। দুটি ছায়ামূর্তি এইমাত্র পার হল।–’ আমার দিকে হতচকিত হয়ে তাকাতেই আমি বললুম, ‘না-না, ভয় পাওয়ার দরকার নেই, ভেলেনের এই একটি মাত্র কবিতাই আমি জানি।’

পিটার সারা আমেরিকায় একমাত্র লোক যে বরফের ওপর দিয়ে মোজা ছাড়া শুধু হাওয়াই চটি (কলকাতায় কেনা) পরে হাঁটতে পারে। লোকে বলে, ওটা একটা বেড়াল, শীত গ্রীষ্ম বোধ নেই। আমি জিগ্যেস করলুম, ‘সত্যি তোমার শীত করে না পিটার?’ ও বলল, ‘সুনীল, তোমার মনে আছে, কলকাতায় যখন তোমাকে জিগ্যেস করেছিলুম, জুন মাসের গরমে পিচের রাস্তায় রিকশাওয়ালারা খালি পায়ে হাঁটে কি করে? তুমি বলেছিলে, অভ্যেস হয়ে গেছে।’

অমন বিচিত্র পোশাক গ্রিনইচ ভিলেজের, তবু ওদের দুজনের অতবড় দাড়ি ও এলোমোলো বেমানান জামা-কাপড় দেখে এখানেও লোকে হাসে, যেমন কলকাতায় হাসত। পাড়ার মোড়ে মোড়ে বসা ছেলেরা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওরে পাগলারা, ভোর হয়ে গেছে, এখনও দাড়ি কামাবার কথা। মনে নেই তোদের?’ অথবা ‘ওরে, তোদের গালে ও কীসের জঙ্গল রে?’ অ্যালেন কোনও উত্তর দেয় না, কিন্তু পিটার মাঝেমাঝে হেসে জবাব দেয়, ‘পয়সা নেই ভাই, তাই কামাতে পারিনি।’ অথবা ‘আমি ইন্ডিয়ান সাধু!’ এরপর যে কটা বাংলা-হিন্দি শব্দ জানে এক নিশ্বাসে বলে দেয়, ‘নমস্কার, সব ঠিক হ্যায়, দাম কিতনা, আচ্ছা, আমি ভালো আছি, সারেগামা পাধানিসা!’

যত হাঁটতে লাগলুম ততই জাঁকজমক বিরল হয়ে এল। অথচ সেটাও নিউইয়র্ক। ম্যানহাটান দ্বীপ। ও দিকটাকে বলে লোয়ার ইস্ট সাইড। রাস্তাগুলো ভাঙাচোরা, এখানে সেখানে জল-কাদা জমেছে। ছেঁড়া জামাপরা লোক, পোর্টুরিকান, নিগ্রো, ইহুদি অঞ্চল। এই প্রথম দেখলুম দোকানে কাটা মাংস ঝুলছে। মোড়ে মোড়ে জটলা করছে বেকার ছেলের দল। এবং অবিশ্বাস্য হলেও, মাঝে-মাঝে সাদা চামড়ার ভিখিরি, মেয়ে ও পুরুষ। যতবার ভিখিরিদের পয়সা দিচ্ছি, অ্যালেন ও পিটার হাসছে। বলছে, ‘তুমি ইন্ডিয়ান হয়েও আমেরিকানদের ভিক্ষে দিয়ে একটা নিষ্ঠুর আনন্দ পাচ্ছ, না?’ ঠেলাগাড়িতে সস্তা মালপত্র সাজিয়ে ফিরিওয়ালা হাকছে লে-লে বাবু ছ’আনা। কোথায় গেল সব সুপার মার্কেট।

আমরা যাচ্ছিলুম অ্যালেন ও পিটারের ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে। ভাড়া নিয়ে নিজেরাই ঘর রং করছে, দরজা জানলা সারাচ্ছে। একটা অন্ধকার গলি দিয়ে ঢুকলুম, ছ’তলা বাড়ি কিন্তু লিফট নেই, নড়বড়ে রেলিং, নোংরা সিঁড়ি, দেওয়ালে অসভ্য কথা লেখা, আমাদের উত্তর কলকাতার যাচ্ছেতাই ভাড়া-বাড়িগুলোর তুলনায় কোনও অংশে ভালো নয়। শেষ পর্যন্ত ওদের ঘর দেখে আমি হতাশ হয়ে প্রায় মাটিতে বসে পড়লুম। অ্যালেন বলল, ‘তুমি ছমাস আমেরিকায় থেকে সত্যি আমেরিকান হয়ে গেছ! কলকাতায় অনেকের বাড়ি কি আমি দেখিনি? এর চেয়ে ভালো নয়!’

‘যদিও এ কথা ঠিক’, অ্যালেন বলল, ‘আমেরিকায় ঠিক না খেয়ে লোকে মরে না। বেকার ভাতা ইত্যাদি আছে। অপর্যাপ্ত সম্পদের দেশে একটু চেষ্টা করলেই যথেষ্ট টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু গরিব আর বড়লোকদের মাঝখানের তফাত ভয়ংকর বেশি। তা ছাড়া স্লামে থাকা যাদের স্বভাব, তারা চিরকাল স্লামেই থাকবে–স্লাম বা অট্টালিকা কোথায় বেশি সুখ, কে জানে? আমার মতো যারা, তারা চাকরিবাকরি করে সময় নষ্ট করতে চায় না, সমস্ত জীবনটাই শিল্পের জন্য ব্যয় করতে চায়, তাই তাদের দারিদ্র্য। কিন্তু শুধু কবিতা লিখে বেঁচে থাকাই তোমাদের অসম্ভব! এখানে সেটা অসম্ভব না। লেখা থেকে যদি আমার বেশি টাকা আয় হয়, আমিও ভালো বাড়িতে উঠে যাব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়িতে থাকতে আমারও ইচ্ছে হয়!’

সন্ধে হয়ে আসার পর আমরা বেরুলুম। তুমি সাবওয়ে চেপেছ একবারও? আমি জিজ্ঞাসিত হলুম। (সাবওয়ে অর্থাৎ মাটির তলায় ট্রেন, প্যারিসে যার নাম মেট্রো, লন্ডনে টিউব), সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলুম পাতালে–দুপাশের প্লাটফর্ম ঝকঝক করছে নিওন আলোয়, কোথাও হাওয়ার কষ্ট নেই, আশ্চর্য কলকাতায় এমন ট্রেন নেই কেন?’ অ্যালেন জিগ্যেস করল, তৎক্ষণাৎ পিটার জুড়ে দিল, ‘তা হলে কী চমৎকার শোওয়ার জায়গা হত ভিখিরি কিংবা রিফিউজিদের।’

ট্রেনের অনেক লোক অবাক হয়ে দেখছিল ওই বিচিত্র যুগল মূর্তিকে, অনেকে হাসাহাসি করছিল। অ্যালেন গুনগুন করে ভৈরবীর সুর ভাঁজছিল, পিটারের মাথায় কাশীর লাল টুপি। একজন বুড়ো ভদ্রলোক অনেকক্ষণ তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, ‘আহা, দেখে মনে হয় যেন বাইবেলের যুগ থেকে উঠে এসেছে।’ অ্যালেন বলল, ‘সকলেই সেখান থেকে।’ আমি মজা করার জন্য জিগ্যেস করলুম, ‘আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে, আমি কোথা থেকে এসেছি?’ আমাকে অবাক করে ভদ্রলোক বললেন, ‘মহাভারতের যুগ থেকে!’ আলাপ হল, শুনলুম, গাড়ির এককোণে পুরোনো ওভারকোট পরে বসে থাকা ওই বৃদ্ধটি যুদ্ধের আগে জাপানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন কিছুদিনের জন্য।

পাতাল ফুঁড়ে আবার উঠলুম মতে! বরফপড়া তখনও থামেনি। রাত্রের গ্রিনইচ ভিলেজ সত্যিকারের জাগ্রত! এখানে ওখানে জ্যাজ ও নানারকম বিদেশি (এদের ভাষায় এক্সটিক) গান বাজনার আওয়াজ। আমরা গুনগুন করে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ গাইছিলুম, খানিকটা পরে অ্যালেন বেশ গলা ছেড়ে গাইতে লাগল, নির্ভুল সুর, উচ্চারণ খানিকটা হিন্দি ঘেঁষা।

গ্রিনইচ ভিলেজ এখন টুরিস্টদের ভিড়ে ভরে গেছে। নিউইয়র্কের অবশ্যদ্রষ্টব্য জায়গার গাইডবুকে এখন গ্রিনইচ ভিলেজেরও নাম। দেশ বিদেশের লোক এখানে আসে কবি-শিল্পীদের পাগলামি দেখতে। তাই বহু নকল শিল্পীতে এখানকার কাফে রেস্তোরাঁ ভরে গেছে। আসল লোকেরা ক্রমশ এখান থেকে সরে যাচ্ছে। ওই বারে ডিলান টমাস তার আত্মহত্যার শেষ মদ্যপান করেছিল, এই পন শপে এফ স্কট ফিটজেরাল্ড তার জামাকাপড় বাঁধা দিয়েছিল। কামিংস থাকত ওই বাড়িতে, এইখানে হেমিংওয়ে আড্ডা দিত–এসব দেখতে-দেখতে যাচ্ছি–হঠাৎ এক বিশ্ববিখ্যাত লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল পথে, অ্যালেনকে দেখে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন আমাদের সঙ্গে, আলাপ হল, স্যালভাডোর ডালি। প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে গেছে, লাল রঙের কোট গায়ে, মোম দিয়ে পাকানো গোঁফ, পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে দ্বিতীয় প্রিয় শিল্পকে চাক্ষুষ দেখে খানিকটা হতাশ হলুম, না দেখলেই ভালো হত। পৃথিবীতে যারা টাকা তৈরি করে –স্যালভাডোর ডালি এখন তাদের কাছে কিছুটা আত্মসমর্পণ করেছেন।

‘বিনে পয়সার কফি খাবে সুনীল?’ পিটার জিগ্যেস করল। এখানে গোপনে অবাধ গাঁজা মেরুয়ানা, মেস্কালিন, হাসিস ইত্যাদি মাদক নেশার অবাধ প্রচলন। শিল্পীদের সেসব অভ্যেস ছাড়ানোর জন্য স্যালভেশন আর্মি ফ্রি কফি এবং বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছে! পিটার বলল, ‘চলো, আগে আমরা ফ্রি কফি খেয়ে আসি, তারপর গাঁজা খাব।’

কাফে রেস্তোরাঁগুলো ভিড়ে ভরা। জায়গা পাওয়া যায় না। খুঁজে খুঁজে গেলুম আসল জায়গাগুলোতে, ছোট-ছোট দোকান, নড়বড়ে কাঠের চেয়ার, ছেলেমেয়েরা এক কাপ কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছে, মাঝে-মাঝে কেউ কেউ চেঁচিয়ে কবিতা পড়ছে, ছোটোখাটো সাহিত্য পত্রিকা বিলি হচ্ছে–হাতবদল হচ্ছে, এ ওর মুখ থেকে কাড়াকাড়ি করছে সিগারেট–অবিকল আমাদের কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের আবহাওয়া। খালি তফাত, এদের মধ্যে অনেক সুন্দরী বালিকা আছে। আমাদের কলকাতার সুন্দরী মেয়েদের আর কবিতায় কোনও উৎসাহ নেই, আমি ফিসফিস করে একজনকে বললুম।

যেখানেই যাই, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে অজস্র প্রশ্ন, কৌতূহল, আন্তরিক জিজ্ঞাসা এখানে–উঁচু সমাজের মতো ধরাবাঁধা নয়। ‘আমি আগামী বছর যাচ্ছি ভারতবর্ষে, তখন তোমার সঙ্গে দেখা হবে’,কেউ বলল ‘জীবনে যখনই পারি, অন্তত হেঁটেও যাব ভারতবর্ষে’, আরেকজন।

কলকাতায় আমরা বিটনিকদের সম্বন্ধে যা শুনেছিলুম, তাঁর অধিকাংশই ভুল। যারা বিটনিক হিসেবে সেজে আছে তাদের অধিকাংশই বাজে লেখক, শৌখিন, অভিনেতা, প্রচার-কার্তিকেয়। আসল লেখক ও শিল্পীরা লুকিয়ে আছে প্রায় চারদিকে, দারিদ্র্যে ও পীড়নে, প্রাণপণে লড়ছে সামাজিক অসমীচীনতার বিরুদ্ধে, সেন্সরের অপবিচারের বিরুদ্ধে। গ্রেগরি করসো–শান্তির জন্য উন্মুখ। নিগ্রো কবি লি রয় জোন্স, সাদা কালোর নির্বোধ লড়াই নিয়ে হাসছে। গেলুম আধুনিক শিল্পীদের কাছে, ছোট্ট অন্ধকারে ঘরে তিন চারজনে ঠাসাঠাসি করে থাকে, দেয়াল ভরতি বিশাল বিশাল ক্যানভাস, কবে খ্যাতি আসবে, এমনকি কোনওদিন কোনও একজিবিশানের সুযোগ পাবে কি না পরোয়া নেই, দুঃসাহসী রং নিয়ে খেলছে, খাদ্য শুধু ভাত, নুন আর সেদ্ধ মাংস।

হলিউডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে একদল। ‘আমেরিকার ছবিতে সেক্স আর কস্টিউম ছাড়া আমাদের কিছু নেই; ছি ছি।’ নিজেরা কো-অপারেটিভ করে ফিল্ম তুলছে তারা। নানা রাস্তা, গলি ও সিঁড়ি পেরিয়ে হঠাৎ কোনও ঘরে ঢুকে, প্রোজেক্টার মেশিন, ছড়ানো ফিলম, ফ্ল্যাশ লাইট, বাজনা–মনে হয় কোনও অন্য রাজ্যে এলুম। ওই একই ঘর–স্টুডিও, অফিস, শোওয়ার জায়গা। ‘আমরা সাহিত্য, শিল্প এবং ফিলমকে এক পর্যায়ে আনতে চেষ্টা করছি, কবিরা এখানে কাহিনি শিখছে, শিল্পীরা শিখছে ক্যামেরা, আমরা সবাই চোখ ব্যবহার করছি।’

তুমি যোগ জানো?–না। তুমি প্রাণায়াম জানো?–না। তুমি ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গেয়ে শোনাবে?–জানি না। তুমি আমাদের কিছুটা বেদান্ত বোঝাবে?–না, আমি নিজেই ভালো করে বুঝিনি। অন্য অনেক জায়গায় কিছুটা জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোমরা খাঁটি লোক, তোমাদের সঙ্গে চালাকি করব না। আমিও খাঁটি লোক।

কয়েকদিনের মধ্যে আমি সেইসব জ্বলন্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এক হয়ে মিশে গেলুম। বাজে, ভ্যাজাল ও চালিয়াতদের চিনে নিতে দেরি হল না। ‘তুমি কেন হোটেলে আছ, আমাদের সঙ্গে এসে থাকো।’ একজন তরুণ কবি বলল আমাকে, তৎক্ষণাৎ হোটেল থেকে সুটকেস নিয়ে গেলুম তার বাড়িতে। ছাদের চিলেকোঠা দুটি, ভাঙা, অন্ধকার, মাথার ওপর অ্যাসবেশটাসের ছাউনি। একটা ঘর একটা পত্রিকার অফিস, সে ঘরে দুটি ছেলেমেয়ে শোয়। বাকি ঘরের খাটে দুজনে শুলো, আমি ও অ্যালেন ও পিটার মাটিতে কম্বল বিছিয়ে। মাঝেমাঝে একটা ভাঙা জানালা দিয়ে হু-হুঁ করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে–তাড়াতাড়ি উঠে সেটায় সোয়েটার কিংবা কম্ভর্টার দিয়ে গর্ত ববাজানো হতে লাগল। ‘কী সুনীল, অসুবিধে হবে না তো?’ অ্যালেন জিগ্যেস করল।

আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে আমি বললুম, ‘কলকাতায় আমার নিজের থাকার বাড়িটাও অবিকল এইরকম।’