[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১৪. তাহিতির সমুদ্র পাড়

তাহিতির সমুদ্র পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক ভদ্রমহিলা যেন হঠাৎ ভূত দেখে চমকে উঠলেন। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। আধ-ময়লা, ছেঁড়া পোশাকপরা একজন বুড়ো মতন লোক বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে অবিকল দেখতে পল গগ্যাঁর মতন। কিন্তু তাতে কোনও রকমেই সম্ভব হতে পারে না, কারণ পল গগ্যাঁ মারা গেছেন অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে, ওই তাহিতি দ্বীপেই, অনাহারে-অপমানে, রোগে ভুগে, লোকচক্ষুর আড়ালে। মাসে ১৬ হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে প্যারিস থেকে চলে গিয়েছিলেন পল গগ্যাঁ। পানামায় এসে মাটিকাটা কুলিগিরি করেছেন দীর্ঘকাল, তারপর তাহিতি দ্বীপে এসে নির্জন প্রবাস। সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সংস্রব ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। তাহিতি দ্বীপে তাঁর শেষ জীবনে আঁকা বিশাল ছবি ‘আমরা কে? আমরা কোথা থেকে এসেছি? আমরা কেন এখানে? আমরা কোথায় চলেছি?’ সমস্ত পৃথিবীর চিত্রশিল্পে একটি মহামূল্যবান সম্পদ।

নিজের স্ত্রী আর পাঁচটি ছেলেমেয়েকে জন্মের মতো ত্যাগ করে এসেছিলেন। ছেলেদের দেখার জন্য মাঝেমাঝে ইচ্ছে হত, কিন্তু বউ বিষম বদমেজাজি, রোজগারহীন স্বামীকে অপদার্থ ছাড়া আর কিছু মনে করতেন না। শেষ পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, গগ্যাঁ ওই তাহিতি দ্বীপেরই একটি আদিবাসী মেয়েকে নাম, পাহুরা স্ত্রী হিসেবে অবৈধভাবে গ্রহণ করে একসঙ্গে বসবাস করেন। কিন্তু সে যা হোক, আজ এতদিন পর আবার গগ্যাঁর দেখা পাওয়া অসম্ভব। গগ্যাঁর মৃত্যু খুবই নিশ্চিত, একবার অসার্থক আত্মহত্যার চেষ্টার অল্প কিছুদিন পরই হার্ট ফেল করে মারা যান, একা ঘরে, একটা পা খাটের বাইরে বেরিয়েছিল–যেন শেষ মুহূর্তে আর একবার দাঁড়াতে চেয়েছিলেন।

ভদ্রমহিলা সেই বুড়ো মতন লোকটির কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনার নাম কী? বিশাল কর্কশ গলায় উত্তর এল, ‘শগ্যাঁ’! ভদ্রমহিলা আরও হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন।

আদিবাসী মেয়েটি গগ্যাঁকে একটি ছেলে দিয়েছিল। নাম রেখেছিল, এমিল গঁগ্যা। মৃত্যুর আগে গগ্যাঁ তার ওই পুত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে এক বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন। এমিল কি প্যারিস গিয়ে লেখাপড়া শিখবে? না, গগ্যাঁ নিজেই ঠিক করলেন, ‘সভ্যতা’ নামক দূষিত হাওয়ার সংস্পর্শে তাঁর প্রাকৃতিক সন্তানের যাওয়ার দরকার নেই। সে খোলা আকাশের নীচে আপন স্বভাবে গড়ে উঠুক। সুতরাং, গঁগ্যার মৃত্যুর পর, অন্যান্য আদিবাসী অনাথ বালকদের যা হয়, এমিলেরও তাই হল। সে লেখাপড়া শিখল না, কাজকর্ম কিছুই শিখল না, ছেলেবেলায় রইল টুরিস্টদের ফুটফরমাজ খাটা চাকর, তারপর ক্রমে ক্রমে অশ্লীল ফটোগ্রাফ বিক্রি করা, নিষিদ্ধ প্রমোদের মধ্যম পুরুষ। তারপর এমিলের বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে যখন, তখন তাকে আবিষ্কার করলেন ওই শিল্পরসিকা ফরাসি মহিলা। মহিলার নাম, মাদাম যোসেৎ জিরো।

এমিলকে দেখতে যে হুবহু তার বাবার মতো, তা ঠিক নয়। তবে, তার মুখ দেখলেই গগ্যাঁর কথা মনে পড়ে। পিতার চেহারার সঙ্গে যেমন অমন মিল, তেমন পিতার প্রতিভার কিছু কি ও পেয়েছে?–এই ভেবে ভদ্রমহিলা এমিলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিজের সঙ্গে আমেরিকায় নিয়ে এলেন। তারপর তার সামনে রাখলেন রং-তুলি ক্যানভাস। জীবনে কোনওদিন ওসব ছোঁয়নি এমিল। তিন বছরের মধ্যে এমিল গগ্যাঁ হয়ে উঠলেন একজন প্রসিদ্ধ শিল্পী।

এমিলের বাবা পল গগ্যাঁরও শিল্পী-জীবনের শুরু ওইরকম আকস্মিকভাবে। পল গগ্যাঁও কোনওদিন ভাবেননি তিনি শিল্পী হবেন, শেয়ার মার্কেটের অফিসে বড় চাকরি করতেন, তাঁর স্ত্রীও স্বপ্নেও কোনওদিন স্বামী ওই দুর্মতির কথা কল্পনা করেননি। সব ছেড়েছুঁড়ে শুধু শিল্পী হওয়ার জন্যই আত্মনিয়োগ করেছিলেন যে টানে, হয়তো তারই নাম ‘প্রেরণা’। শিল্পী হিসেবে গগ্যাঁ সমস্ত বিশ্বে তুলনারহিত। তাঁর ছেলে এমিলও কত বড় শিল্পী হবেন তা এখনও বলা যায় না –কারণ এমিল শুরু করেছে বড় দেরিতে, ৬২ বছর বয়সে, ওর বাবার মৃত্যুই হয়েছিল ৫৫ বছরে। কিন্তু এই বয়সে এমিলের চিত্তের সুপ্ত সুকুমারবৃত্তির উন্মেষ সত্যিই বিস্ময়কর। এমিল গগ্যাঁর ছবির একাধিক প্রদর্শনী হয়ে গেছে লন্ডনে, শিকাগোতে, ক্যালিফোর্নিয়ায়।

* * * *

শিকাগোতে এক প্রদর্শনীতে, আমার সঙ্গে এমিল গগ্যাঁর দেখা হয়েছিল। হৃষ্টপুষ্ট মানুষটি, হো-হো করে হাসে, তিন বছরে একটুও ইংরেজি শেখেনি। ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে কথা বলে। শুনলাম, ছবি আঁকা সম্বন্ধে খুবই মনোযোগী হয়ে উঠেছে সে, অত্যন্ত যত্ন করে ড্রয়িং শিখছে, সেই সঙ্গে ভাস্কর্য। কিন্তু রং-এর ব্যবহার তার নিজস্ব, রীতিবিরুদ্ধ এবং টাটকা শিল্প সম্ভাবনাময়। অতিরিক্ত মদ্যপানের স্বভাব ছিল তার, সেটা আস্তে-আস্তে কমিয়ে ফেলেছে। ওর বাবা ছিলেন ঈশ্বরে অবিশ্বাসী, এমিল কিন্তু গোঁড়া ক্যাথলিক। নিয়মিত গির্জায় যায়। আমেরিকার দুটো জিনিস খুব পছন্দ : হট ডগ (এক ধরনের সস্তা খাবার) এবং মেয়েরা। কথায়-কথায় সে বলে, ‘হট ডগ এবং মেয়েরা দীর্ঘজীবী হোক!’ ওর সঙ্গে একটা আধটা কথা বলতে আমার খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ভাষায় কুললাচ্ছিল না। অতিকষ্টে আমার যাবতীয় ফরাসিজ্ঞান আহরণ করে ওকে জিগ্যেস করলুম, ‘আপনার বাবার কথা আপনার একটুও মনে আছে?’ আমার এবং ওর উচ্চারণের এত তফাত যে, ও বোধহয় কিছুই বুঝতে পারল না। এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আমার কাঁধে ওর বিশাল থাবায় দুই চাপড় দিয়ে বলল, ‘চমৎকার। চমৎকার!’