[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১২. বিদেশে ভিখিরি ছিল

 ‘হ্যাঁরে, বিদেশে ভিখিরি ছিল?’ মা জিগ্যেস করেছিলেন।

‘–কেন, আমিই তো ছিলাম! তবে আমি একা নয়। আরও ছিল। শিকাগোর রাস্তায় যে লম্বা মতন লোকটা কানের কাছে ফিসফিস করত, ও. কে.?

যে-কোনও নতুন লোকেরই শিকাগো শহরে প্রথমে কয়েকটা দিন ভয়-ভয় করবে। এমন সব রোমাঞ্চকর গল্প শিকাগো শহরের সম্পর্কে আগে শুনেছি, বিখ্যাত গুন্ডা আল-কাপনের জায়গা, যেখানে দিনে-দুপুরে ডাকাতি হত। এখন অতটা হয় না ঠিকই, কিন্তু একেবারেই নিরুপদ্রব পৃথিবীর কোনও বড় শহরই নয়, প্রায়ই মারাত্মক দুঃসাহসী হত্যাকাণ্ডের খবর শিকাগো থেকে আসে। সুতরাং বাকসর্বস্ব এই বঙ্গ-সন্তান প্রথম কয়েকদিন ভয়ে সরু হয়ে পথ হাঁটতুম।

প্রায়ই একটা দশাসই নিগ্রো বিনয়ে নীচু হয়ে কানের কাছে গুনগুন করে কী বলত। সে পাশে পাশে আসত সাউথ ওয়াবাস এভিনিউর মোড় পর্যন্ত, তারপর আর দুজন তার জায়গা নিত। সেই একই রকম পাশে পাশে গুনগুন। একটি অক্ষরও বুঝতে পারতুম না, নমস্কারের ভঙ্গিতে বারবার ‘থ্যাঙ্ক য়ু’, ‘থ্যাঙ্ক য়ু’, বলে সুট করে পাশের গলিতে ঢুকে পড়তুম।

কী চায় ওরা বুঝতে না পেরেই অমন অস্বস্তিতে ছিলুম। বিলেত দেশটা মাটির হলেও আমেরিকা দেশটা তো সোনার। তবে, আমার মতো কাদামাটির দেশের মানুষের কাছে কী ঘূঢ় দাবি থাকতে পারে ওদের। গলির মোড়ে মোড়ে বা কফিখানায় একদল সুসজ্জিত ছোঁকরাকে দুপুরে জটল্লা করতে দেখতুম, দেখে মনে হয় বেকার। একদিন প্রকাশ্য দিবালোকে আমার পঞ্চাশ গজের মধ্যে মাত্র পাঁচ মিনিটে বিয়ারের বোতল ছোঁড়াছুড়ি করে দুই দলে রোমহর্ষক মারামারি হয়ে গেল।

একা রাস্তায় ঘুরলেই সেই ফিসফিসানিদের পাল্লায় পড়তাম। ক্ষীণ সন্দেহ হত, পৃথিবীর সব শহরেই বিদেশিদের নিষিদ্ধ প্রমোদ ভবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক ধরনের লোক থাকে, ওরাও কি তাই? কিন্তু, বলা বাহুল্য, ওসব জায়গায় যাওয়ার ঝুঁকি নিতে আমার মোটই শখ ছিল না। যাই হোক ক্রমে সব রকম উচ্চারণ যখন কানে সড়গড় হয়ে গেল, তখন আমি একটু ভরসা করে দাঁড়িয়ে সেই লম্বা লোকটার কথা শুনলুম, অত্যন্ত বিনীত সুরে সে বলছে : আ ডাইম প্লিজ!

ওঃ, মোটে একটা ডাইম! (অর্থাৎ ওখানকার দশ নয়া পয়সা, আমাদের বারো আনা) ভিক্ষে চাই! তা হলে তো তুমি আমার চেনা লোক। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললুম। পকেট থেকে একটা ডাইম খসিয়ে ওরকম আনন্দ কখনও পাইনি।

সানফ্রান্সিস্কোর মতন অমন রূপসি নগরী দুনিয়ায় ক’টা আছে জানি না। অল্প শীতের দুপুরবেলা উপসাগরের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলুম। পথে একটি দর্শনীয় চেহারার মানুষ চোখে পড়ল। অতিশয় লম্বা, বৃষস্কন্ধ শালভূজ। বয়েস সত্তরের কম না, কিন্তু কী সবল শরীর। আর প্রায়-সব সাদা ঝোঁপ দাড়ি, লম্বা চুল, পোশাক দেখলে মনে হয় সে পোশাক পরেই লোকটা রাত্তিরে ঘুমোয়। অনেকটা মবি ডিক উপন্যাসের ক্যাপ্টেন এহাবের মতন চেহারা। কিন্তু এহাবের মতো অহঙ্কারী সে মোটেই নয়, বরং কোলরিজের সেই বুড়ো নাবিকের মতোই সে হঠাৎ আমাকে দেখে ঘুরে দাঁড়াল, তারপর কাঁধে হাত দিয়ে জিগ্যেস করল, তুমি ভারতীয়?

ততদিনে আমি আমেরিকার কথাবার্তার ধরন ঢের জেনে গেছি।

বললুম, হ্যাঁ, কিন্তু তোমাদের ‘ভারতীয়’ নয়, খাঁটি ভারতবর্ষের ভারতীয়।

লোকটি বলল, আমি ভাতরবর্ষে গিয়েছিলাম। চমৎকার দেশ। গান্ধি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। তুমি কোথায় যাবে, চলো, আমিও একটু তোমার সঙ্গে হাঁটি।

হাঁটতে-হাঁটতে লোকটা বলল, গান্ধির মতন লোক হয় না, সত্যি। আমি ওর অনেক লেখা পড়েছি। গ্রেট ম্যান–তারপরই লোকটি আমার কানের কাছে মুখ এনে নীচু গলায় বলল, তোমার কাছে একটা সিকি (কোয়ার্টার) হবে?

আমি স্তম্ভিত ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো লোকটির হাতে একটি সিকি তুলে দিলুম। লোকটি দরাজ গলায় আমাকে বলল, গড ব্লেস ইউ, মাই সান, তার পরই অন্তর্হিত হয়ে গেল।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, লন্ডনে ভারতীয়দের মধ্যে একটা রসিকতা চালু আছে যে, রাস্তায় কোনও অপরিচিত লোক যদি হঠাৎ এসে বলে যে, ‘নেহরু খুব ভালো লোক’ বা ‘গান্ধি একজন সত্যিকারের মহাত্মা’, তা হলে তৎক্ষণাৎ তাকে এড়িয়ে চলা উচিত। লোকটা নিশ্চিত কোনও মতলববাজ, ভিখিরি।

ওই সানফ্রান্সিস্কোতেই আর একজন মজার ভিখারির সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। কলম্বাস এভিনিউতে লরেন্স ফের্লিংগেটির সঙ্গে এক দোকানে বসে এসপ্রেসো কফি খাচ্ছিলুম, পাশে আর একটি খোঁচা দাড়ি বুড়ো বসে খুব বকবক করছিল, সাহিত্য, জীবন, ভগবান ইত্যাদি সম্বন্ধে; হঠাৎ এক সময় লোকটা হাই তুলে বলল, চারটে বাজল! বাবা!–তার পরই আমার দিকে ফিরে : তোমার কাছে খুচরো আছে?

ভাবলুম লোকটা টাকা ভাঙাতে চায়। কোটের পকেটে হাত দিয়ে বললুম, না পুরো হবে না, আমার কাছেও ডলারের নোট।

লোকটা উদার হেসে বলল, না, না, আমি আস্ত এক ডলার কারুর কাছ থেকে নিই না। ও খুচরো যা আছে, তাই দাও।

ফের্লিংগেটি বললো, ও কি হচ্ছে ডন, ছি ছি, ও এসেছে গরিব ভারতীয়, তাও কবি, ওর কাছ থেকে তোমার নেশার পয়সা না নিলে চলে না।

লোকটা বলল, তুমি ভারতীয়? আচ্ছা, তোমার পয়সা আমি শোধ দিয়ে দেব। ঠিক দেব, কোনও না কোনও দিন। আিম কথা দিয়ে কথা রাখি।

ওকে বলা হয়নি, আমি সেদিনই ওখান থেকে চলে যাচ্ছি।

মেয়ে ভিখারির দেখা পেলাম নিউ ইয়র্কে। গ্রিনিচ ভিলেজ থেকে ইস্ট সাইডে যেতে প্রায়ই একটি মাঝ বয়েসি মেয়ে নিঃশব্দে হাত পেতে থাকত। পরপর তিন দিন তাকে আমি একটি করে নিকেল (পাঁচ পয়সা) দিলাম। তাই দেখে অ্যালেন গিনসবার্গ হেসে বলল, কী, খুব মজা লাগছে বুঝি ভিক্ষে দিতে! একটা প্রতিশোধ। এত বড় লোকের দেশেও ভিখিরি।

আমি বললুম, না, এরা তো আমার চেনা লোক। একেবারে ভিখিরি না থাকলেই বরং দেশটা একেবারে কাঠকাঠ লাগত।

–এরা কিন্তু বেশিরভাগই নেশাখোর। না খেতে পাওয়া ভিখিরি প্র্যাকটিক্যালি এ দেশে নেই।

–সে যাই হোক, ভিক্ষে কেন করছে এটা বড় কথা নয়। ভিক্ষে চাইছে এইটাই আনন্দের খবর। সবাই পরিশ্রম করবে, তার কী মানে আছে। যে হিসেবে সাধু-সন্ন্যাসীরা ভিখিরি, আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। অবশ্য, আমাদের দেশে বেশিরভাগই বাধ্য হওয়া, খেতে না পাওয়া ভিখিরি।

–ঠিকই এদেশে আরও বেশি ভিখিরি থাকা উচিত ছিল। বেঁচে থাকা এখানে এত সহজ।

লন্ডনের হাইড পার্ক কর্নারে প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলা বক্তৃতা হয়। নানান জটলায় যে-ইচ্ছে বক্তৃতা দেয়, পৃথিবীর হেন বিষয় নেই যা নিয়ে ফাটাফাটি হয় না রোজ। একজন লোক ছিল ভারী মজার, সারা হাতে মুখে উল্কি, ফ্যাস-ফেসে গলা–চুরি করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম, এই বিষয়ের ভিত্তিতে সে তার জীবনের নানা চৌর্যকর্মের বর্ণনা দিয়ে বক্তৃতা দেয়। একদিন মাঝপথে বক্তৃতা থামিয়ে হঠাৎ দুঃখিত গলায় বলল, আজকাল চুরির বাজার বড় মন্দা, যাই হোক আশেপাশে পুলিশ নেই–আপনারা ঝটপট দু’চার পেনি করে ভিক্ষে দিন তো!

একটা জিনিস লক্ষ করেছি, আমাদের দেশে খুব দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি পেলেও, ভিক্ষের রেট খুব বাড়েনি। এখনও বুলি সেই পুরোনো, ‘মা, দুটো পয়সা ভিক্ষে দিন।’ বড়জোর আধুনিক ছেলে ছোঁকরা ভিখিরিরা পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা চায়। বিদেশের ভিখিরিরা কিন্তু চার-আনা আট-আনার কম কথাই বলে না। এক সময় শ্যামবাজারে একটি সত্যিকারের স্টাইলিস্ট ভিখারি দেখতাম। একটি পঁচিশ-ত্রিশ বছরের ছোঁকরা, প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা, বোধহয় আধপাগলা। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে সে লোক নির্বাচন করে নিয়ে–সেই লোকের কাঁধে টোকা দিয়ে বলত, আপনার সঙ্গে একটা প্রাইভেট কথা আছে। হতচকিত কোনও লোক যদি থেমে যেত তাকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে সে বলত, আপনার কাছে একটা স্পেয়ারেবল সিকি হবে? আমার শর্ট পড়ে গেছে।

কি জানি ছোকরাটা বিলেত ফেরত কি না। কারণ, বিলেতে অনেক ভিক্ষার্থীর মুখে ‘স্পেয়ারেবল’ শব্দটা শুনেছি।

প্যারিসেও দেখেছি মাটির তলায় ট্রেনের রাস্তায় হাত পেতে নিঃশব্দে বসে আছে। কেউ অথর্ব, কেউ হাত-পা কাটা। কেউ ব্যাঞ্জো বাজায়, কেউ চোখে চোখ ফেলে করুণ মিনতি করে! আর যেখানেই রিফিউজি, সেখানেই ভিখারি। প্যারিসে কিছু আছে আলজিরিয়ার রিফিউজি। একদিন দেখি, একটা ছোট্ট পার্কে ওয়াইনের বোতল সঙ্গে নিয়ে একজন কেক খাচ্ছে–আশেপাশে দু তিনটে রিফিউজি ছোঁকরা ছুকরি ঘুরঘুর করতে লাগল। একজন শেষে বলেই ফেলল, তার নাকি ওয়াইন সর্ট পড়ে গেছে, কেক খেয়ে গলা শুকিয়ে গেছে, সুতরাং সে যদি একটু।

রোমে একটা লোক এসে বলল, তুমি বোতাম কিনবে?

না, ধন্যবাদ।

ক্যালেন্ডার কিনবে?

না, ধন্যবাদ।

দেন, প্লিজ হেলপ মি টেন লিরা!

প্রত্যেক জায়গাতেই আমি এ সব শুনে খুশি হয়েছি। কারণ, ওসব দেশে, এত অসংখ্য লোক আমাকে অকারণে সাহায্য করেছে।

দেশে ফেরার পরের দিন গলির মোড়ে পুরোনো বৈরাগীকে দেখতে পেলাম, খঞ্জনি বাজিয়ে আগমনী গান গাইছিল : ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা কত মা-মা বলে কেঁদেছে।’ আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল, খোকাবাবু, ভাল আছ, কদ্দিন দেখিনি। দাও, গরিবকে দুটো পয়সা দাও।

পকেটে হাত দিলাম। হা-কপাল। একটাও পয়সা নেই। সত্যিই নেই।